পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার (রৌহুইতু)

Jumjournal
Last updated Dec 22nd, 2019

1116

featured image

পাংখোয়া উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী পাংখোয়া সমাজ ব্যবস্থায় জুম চাষকে অদ্যাবধি প্রধান পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ নং বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানার প্রয়োজন হয় না, যার কারণে পাংখোয়া সমাজে স্থাবর সম্পত্তি তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী পাংখোয়া সমাজে অতীতে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা গড়ে ওঠেনি।

ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যানকৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হয়েছে।

পাংখোয়া সমাজভুক্ত পরিবারের কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব পালনের বিষয়টি মৃতের ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার সাথে একান্তভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

 

 পাংখোয়া উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

উত্তরাধিকার: পাংখোয়া সমাজভুক্ত পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করায় বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন ও রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য বিশেষ কয়েকটি আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়।

মৃতের আত্মার শান্তি ও সদ্গতির উদ্দেশ্যে গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনকে ভোজে আপ্যায়ন করা হয়। বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম অনুসারী পাংখোয়া সমাজে কারোর মৃত্যুর পর খ্রিস্টধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মূতের সৎকার হয়।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যান সেসবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি, কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদি পশু ইত্যাদিও উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন হয়।

কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধিবিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না। কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়।

কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

 

সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি: রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ নং ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ান আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী পাংখোয়া পরিবারে কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় খরচ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবী পরিশোধ বা নিষ্পন্ন করার পর উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি নির্ধারণ করার রীতির প্রচলন রয়েছে।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০এর ৪৮ নং বিধিতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় লিপিবদ্ধ আছে।

ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ এর ৪৮ বিধিতে পাংখোয়া সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হেডম্যান/কার্বারী পিতার পছন্দ অনুসারে যে পুত্র যোগ্য হয় তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেই পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

খ) পাংখোয়া সমাজে সমাজপতি বা পাড়া প্রধানগণ তাদের নামের আগে ‘লাল’ পদবী ধারণ করেন।‘লাল’ পদবী সাধারণতঃ বংশানুক্রমিক পদবী নয়। সমাজের সিদ্ধান্ত অনুসারে যাকে সমাজপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয় তিনিই। ‘লাল’ পদবী ধারণের অধিকারী হন, যদিও উক্ত লাল পদবীটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি সম্মত নয়।

 

পাংখোয়া সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস:- পাংখোয়া সমাজে উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক নিম্নবর্ণিত শ্রেণী বিন্যাসের ক্ষেত্রে ‘লাল’ বা সমাজপতির সিদ্ধান্ত অথবা কার্বারী/হেডম্যান/সার্কেল চীফ-এর আদালতের প্রতিকার ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ঃ-

ক) পাংখোয়া পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র বা পুত্রগণ তার সম্পত্তির অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী। পুত্রের উপস্থিতি অন্য সকল নিকট আত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। স্ত্রী বলতে পাংখোয়া সমাজ স্বীকৃত স্ত্রী, সন্তান বলতে ঔরসজাত ও দত্তক সন্তানকে বুঝায়। মৃতের সংসারে অবস্থানকারী বিধবা স্ত্রী ও অবিবাহিত কন্যাগণের বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত মৃতের সম্পত্তি হতে ভরনপোষণের অধিকারী হয়।

খ) পাংখোয়া পরিবারে মৃতের কোনো পুত্র সন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃতের ভ্রাতা/ভ্রাতুস্পুত্র/বংশের রক্ত সম্পর্কীয় পুরুষ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

গ) স্বামীস্ত্রী: স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্বামী তার মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীর দ্বিতীয়বার বিবাহ না হলে মৃত স্বামীর সম্পত্তি হতে ভরনপোষণ লাভের অধিকারী। হয়।

ঘ) পিতামাতা: মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যার ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে যে সেই পিতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) রক্ত সম্পর্কীয়: পাংখোয়া সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি, পিতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র উত্তরাধিকারী হয়।

চ) পাংখোয়া পরিবারে মৃতের যদি পুত্র, পিতা, ভাই এবং ভাইপো এ সকল রক্ত সম্পর্কীয় কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে কাকা/জেঠা, ভ্রাতুস্পুত্র উত্তরাধিকারী হয়।

ছ) পাংখোয়া সমাজে মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ থাকলে, সমাজপতি বা ‘লাল’ বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আইনগত উত্তরাধিকারী নির্ধারিত হয়।

 

সম্পত্তির ভাগৰন্টন

ক) পাংখোয়া পরিবারে মৃত ব্যক্তির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে কন্যা উত্তরাধিকারী হয় না। স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী তার সম্পত্তি পায়। আর বিধবা স্ত্রী কেবল ভরণপোষণ পায়। তবে নিঃসন্তান স্ত্রীকে বাপের বাড়িতে ফিরে যেতে হয়।

খ) পাংখোয়া পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান তার পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সিংহভাগ লাভ করে। বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরনপোষণের দায়িত্ব কনিষ্ঠ সন্তানকে বহন করতে হয়। তবে পিতা ইচ্ছা করলে তার মৃত্যুর পূর্বে যে কোনো সন্তানকে দানমূলে সম্পত্তি দিতে পারেন। চাকমা ও বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী পাংখোয়া সমাজে মৃত পিতার সম্পত্তিতে পুত্র অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী। তবে মৃত ব্যক্তি যদি মৃত্যুর পূর্বে দান বা উইলের মাধ্যমে নিজ স্ত্রী ও কন্যাকে সম্পত্তি দান করে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও কন্যা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

ঘ) স্ত্রীর নামে কোনো প্রকার সম্পত্তি থাকলে স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামী, তার অবর্তমানে পুত্র সন্তানগণ মৃত মাতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) মৃত ব্যক্তির ঔরসজাত পুত্র-সন্তান থাকাবস্থায় দত্তক-সন্তান মৃত পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না, তবে মৃত ব্যক্তি যদি তার মৃত্যুর পূর্বে দান বা উইলের মাধ্যমে দত্তক-সন্তানকে সম্পত্তি দান করে, সেক্ষেত্রে দত্তক-সন্তান মৃত পিতার সেই সম্পত্তির অধিকারী হয়।

 

অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার স্বত্ব: যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করে সেই ব্যক্তির (জন্মদাতা) সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয়, সেক্ষেত্রে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পায় না, কেবলমাত্র নিজ মায়ের (যদি থাকে) নামীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা