পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর বিবাহ (ইননেই)

Jumjournal
Last updated Jan 18th, 2020

869

featured image

বিবাহের সংজ্ঞাঃ পাংখোয়া সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিবাহ হলো একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানকে পাংখোয়া ভাষায় ‘রোয়েই’ বলা হয়। পরিবারের বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের সম্মতিতে সন্তানদের বিয়ে হয়।

পাংখোয়াদের সমাজ স্বীকৃত বিবাহের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘ইনকাই’(বাগদান) ও ‘মান’ (পণ) প্রদান অনুষ্ঠান। এই সামাজিক রীতি অনুসারে বিবাহিত দম্পতি সমাজসিদ্ধভাবে একত্রে বসবাস ও দৈহিক মিলনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অধিকার লাভ করে। এই সামাজিক রীতি অনুসরণ ব্যতীত পাংখোয়া সমাজে নর-নারীর জৈবিক মিলন ও সন্তান জন্মদান সমাজসিদ্ধ নয় বিধায় অবৈধ বলে গণ্য হয়।

সমাজ স্বীকৃত বিবাহের ক্ষেত্রে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম অনুসারী পাংখোয়া সমাজে খ্রিস্টধর্মীয় রীতিনীতিও অনুসরণ করা হয়। সমাজ স্বীকৃত বিবাহের ক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ প্রদানের সামাজিক রীতি অনুসরণ করাও অপরিহার্য।

বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা

বিবাহ রীতিঃ পাংখোয়া সমাজে পাত্র ও পাত্রীপক্ষের মধ্যে বিয়ের প্রস্তাব আদান-প্রদান এবং কনেপণ নির্ধারণের জন্য উভয়পক্ষের মতামত নিতে ঘটক নিয়োগ করা হয়। পাত্রপক্ষের ঘটককে ‘নিপারেল’ এবং পাত্রীপক্ষের ঘটককে ‘নুনারেল’ বলা হয়।

পাত্রপক্ষের দুইজন ঘটক পাত্রীর বাবা বা অভিভাবকের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়। বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর কনেপক্ষ রাজী হলে দ্বিতীয় দফায় পাত্রপক্ষের ঘটক কথাবার্তার মাধ্যমে কনের পিতাকে বায়না (ইনকাই) বিষয়ক বায়না হিসেবে কিছু টাকা (পূর্বে ২টি রৌপ্য মুদ্রা) প্রদান করে।

‘ইনকাই’ গ্রহণের পর সেই পাত্রীর জন্য অন্য কোনো পাত্র বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে না। বিয়ের কথা চলাকালীন পাত্রীপক্ষও যদি বিয়েতে মত পরিবর্তন করে তার জন্য সমাজের কাছে জরিমানা (লেইসাপুই) স্বরূপ একটি মাদী গয়াল দিতে হয়।

পাত্রের ঘটক তৃতীয় দফায় কনের বাড়ীতে গিয়ে কনেপণের টাকা ও বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করে। প্রাচীন সমাজে কনেপণ বাবদ ৩০ টাকা হতে ১৫০ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হতো সেই সাথে কনে মুখ দেখার জন্য টাকা দিতে হতো।

পূর্বে কনের মুখ দেখার জন্য টাকা ৩০ টাকা পর্যন্ত দিতে হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানের পূর্বে পনের টাকা (মান) এককালীন অথবা বিয়ের পর কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয়। নতুবা বর তার শ্বশুরেরর কাছে কায়িক শ্রমের বিনিময়ে মান শোধ করতে বাধ্য থাকে।

তবে কনেপণ একসাথে দিতে না পারলেও কনের মৃত্যুর পূর্বেই তা পরিশোধ করতে হয়। এরপর ব্যতিক্রম হলে মরদেহ দাফন করা হয় না। কনের ‘মান’ হিসেবে নির্ধারিত টাকার শতকরা ১০% ভাগের ওপর কনের মামার দাবী থাকে।

অন্যথায় মামা আপত্তি জানিয়ে বিয়ে স্থগিত করতে পারেন। আবার বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে ভাগ্নীর দাবী করা সামগ্রীও মামাকে দিতে হয়। পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষের ঘটক ‘নিপারেল’ ও ‘নুনারেল’কেও পণের টাকা হতে বখশিস দিতে হয়।

‘মান’ বাবদ প্রাপ্ত টাকা হতে কনেপক্ষের আত্মীয়স্বজনকে ‘সুইবাং’ (বখশিস) দিতে হয়। ‘সুইবাং’ গ্রহণকারী আত্মীয়স্বজনকে কনের শ্বশুর বাড়ী যাত্রার সময় সহযাত্রী হতে হয়। বিয়েতে ভোজের আয়োজনে ‘নিপারেল’ ও ‘নুনারেল’কে উঁচু আসনে বসিয়ে সম্মানের সাথে আপ্যায়ন করতে হয়।

বিবাহের সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান প্রথমে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে হয়। কনের শ্বশুর বাড়ি যাবার সময় বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া একটি মুরগীকে পরদিন ভোর বেলায় ‘লুকাৰ্থা’ অনুষ্ঠানে মরিচ ছাড়া রান্না করে কনেপক্ষের ‘নুনারেল’ ও বরপক্ষের ‘নিপারেল’ এবং বর-কনেসহ উভয়ের দুইজন বন্ধু, মোট ছয়জনে মিলে আহার করে।

‘লুকার্থা’ অনুষ্ঠানের দিনে সুর্য উঠার আগে স্বামী-স্ত্রী তাদের দুই বন্ধুসহ চারজনে মিলে পাহাড়ী ছড়া বা নদী থেকে পানি তুলে আনে। নববধূর তুলে আনা এই পানিকে পবিত্র পানি মনে করা হয়।

পাংখোয়া সমাজে খ্রিস্টধর্মের প্রচলনের পর বর্তমানে ‘রোয়েই’ অনুষ্ঠানের দিনে খ্রিস্টধর্মীয় রীতি অনুসারে চার্চ বা গীর্জায় বিবাহ সম্পন্ন হয়। অবশ্যই সামাজিক নিয়মে বরের বাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠান হয়।

বিবাহের যোগ্যতাঃ পাংখোয়া সমাজে বিবাহ (ইননেই) বন্ধনে আবদ্ধ হবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রকার যোগ্যতা বা বয়সের মাপকাঠি নেই। বয়োজ্যেষ্ঠের আগে বয়োকনিষ্ঠের বিবাহ সম্পন্ন হতে পারে।

বিবাহের বয়সকালের সুনির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি না থাকলেও শারীরিক গঠনের উপর পাত্র-পাত্রীর বিবাহের যোগ্যতা নির্ভরশীল। একসময় পাংখোয়া সমাজে বাল্য বিবাহের প্রচলন ছিল। বর্তমানে বাল্য বিবাহের প্রচলন নেই।

পাংখোয়া সমাজে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও বিবাহ হতে পারে যদি পাত্র-পাত্রী উভয়ের সম্মতি থাকে। যদিও প্রচলিত সাবালকত্ব আইন ১৮৭৫, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর উপর সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ সকল আইনে অপরিণত বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯২৯ সনের বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের ২(ক) ও ২(খ) ধারায় শিশু ও বালক বলতে যার বয়স পুরুষ হলে ২১ বছরের কম এবং নারী হলে ১৮ বছরের কম বুঝাবে।

পাংখোয়া জনগোষ্ঠীর গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত কম বয়সের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে দেশের বিদ্যমান আদালতে যদি কোনো কারণে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, এবং যদি প্রমাণিত হয় যে, বিবাহিত পক্ষগণ নাবালক, তাহলে পাংখোয়া সামাজিক প্রথামতে নাবালকের বিবাহ কার্য সমাজসিদ্ধ হলেও তার কোনো প্রকার আইনগত বৈধতা থাকবে না, বরঞ্চ তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

পাংখোয়া সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্কঃ পাংখোয়া সমাজ মোট ১৭টি গোত্রে বিভক্ত। একই গোত্রের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনকে সমাজে নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। মাতৃকুলের মাসীকে বিয়ে করা শুভ ও সৌভাগ্যদায়ক বলে একসময় মনে করা হতো।

শিক্ষিত পাংখোয়া সমাজে বর্তমানে এ রকম ধারণা লালন করা হয় না। পাংখোয়া, লুসাই ও বম এ সকল সমাজের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহ অনুমোদিত। তবে সমাজপতি হিসেবে ‘লাল’-এর পুত্র বা কন্যার বিয়ে অপর একজন ‘লাল’-এর পুত্র বা কন্যার সাথে হতে হয়।

এক্ষেত্রে কনেপণের (মান) টাকাও বেশী নির্ধারণ করা হয়। অতীতে ‘লাল’-এর পুত্র-কন্যার বিয়ে সমাজের সাধারণ কোনো পাত্র-পাত্রীর সাথে হলে তাকে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হতো।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কতিপয় অনুসরণীয়/পালনীয় রীতিনীতি:

ক) সাধারণভাবে একজন পাংখোয়া পুরুষ একজন পাংখোয়া মহিলাকে বিয়ে করে।

খ) পাত্র-পাত্রীকে বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতা বহির্ভূত হতে হয়।

গ) পাত্র-পাত্রীকে গোত্র সম্পর্কজনিত বিধি নিষেধ মেনে বিয়ে করতে হয়।

ঘ) পাত্র-পাত্রীকে সাবালকত্ব অর্জন করতে হয়।

ঙ) পাত্র-পাত্রীকে ইনকাই’ (বাগদান) ও ‘মান’ (পণ) সম্পন্ন করতে হয়।

বিবাহের প্রকারভেদঃ পাংখোয়া সমাজে দুই প্রকার বিবাহের অস্তিত্ব রয়েছে:

যথাঃ- (ক) সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ এবং (খ) পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ। পাংখোয়া সমাজে বিধবা বিবাহকে সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজে কোর্ট ম্যারেজ ও মিত্র বিবাহের কিছু প্রবণতা ইদানীং দেখা গেলেও সামাজিক রীতি ও প্রথা অনুসারে সমাজসিদ্ধ করা ব্যতিরেকে পাংখোয়া সমাজ তা অনুমোদন করে না।

রক্ত সম্পৰ্কীয় নিষিদ্ধ বিবাহের ক্ষেত্রে দম্পতিকে সমাজচ্যুত করা হয়। পাংখোয়া সমাজ নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ ও বহু বিবাহকে স্বীকৃত বিবাহ হিসেবে গণ্য করে না।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহ (দানথিয়াংহ্লিম): পাংখোয়া সমাজে পিতা মাতা বা অভিভাবকের অমতে বিয়ে হয় না। পাত্র-পাত্রী নির্বাচন ও বিবাহের শুভ অনুষ্ঠানাদি আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ঘটক, ধর্মীয় পূরোহিত এদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়। ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দম্পতিকে সামাজিক স্বীকৃতি নিতে হয়।

সামাজিক/নিয়মিত বিবাহের আইনগত ফলাফল: সামাজিক আচারঅনুষ্ঠান ও রীতিনীতি অনুসরণ করে বিবাহিত একজন যুবক (পুরুষ) এবং একজন যুবতী (মহিলা) উভয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করার সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, যা পাংখোয়া সমাজের বিবাহ প্রথা অনুযায়ী সমাজসিদ্ধ।

বিবাহিত দম্পতির দৈহিক মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম লাভ করে, সে বৈধ সন্তান ও পিতা-মাতার উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য হয়।

স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের একজনের উপর অপরজনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় । একজনের ভাল-মন্দ দেখার দায়িত্ব অপরজনের উপর বর্তায়। স্ত্রী তার স্বামীর নিকট থেকে ভরনপোষণ ও সামাজিক মর্যাদা এবং স্বামীর পারিবারিক পদবীর অধিকারী হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ (দানখিয়াংহ্লিম আচাংলাউ): সমাজে প্রচলিত নিয়মের বাইরে প্রেমঘটিত বা মনোমিলনের কারণে যুবক-যুবতী ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী রূপে গ্রহণ করাকে পাংখোয়া সমাজে ‘দানখিয়াংহ্লিম আচাংলাউ’ বলা হয়।

পাংখোয়া পুরুষ ও মহিলা পরস্পরের সম্মতিতে পালিয়ে যাবার পর সমাজে ফিরে এসে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক যদি না থাকে তাহলে পরিবারের সম্মতি অনুসারে কার্বারী বা হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ প্রদান করতে হয়। এরপর চার্চের রীতি অনুসারে বিবাহকে সমাজসিদ্ধ করা হয়।

অনিয়মিত বিবাহের ক্ষেত্রে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে বিয়ে হলে তাকে পাংখোয়া সমাজভূক্ত হয়ে বর্তমানে খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হতে হয়। অন্যথায় সমাজচ্যুত করা হয়।

কোর্ট ম্যারেজঃ কোর্ট ম্যারেজ মূলতঃ আদালতের কোনো প্রকার আদেশ নয়। আধুনিক সমাজে ইদানীং পরিবারের অসম্মতিতে বিবাহে ইচ্ছুক পাত্র-পাত্রী উভয়ে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নোটারী পাবলিক-এর সম্মুখে নিজেদেরকে আইনতঃ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে শপথ পূর্বক ঘোষণা প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়।

এক্ষেত্রে বলা চলে প্রাচীনকালের মনোমিলনে পলায়ন বিবাহের আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে কোর্ট ম্যারেজ, যদিও এটি নিছক একটি শপথনামা মাত্র। তাই এ বিবাহ অলঙ্ঘনীয়ও নয়।তবে বিবাহিত পাত্র-পাত্রী এক্ষেত্রে সাবালক হলেও নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় হলে সম্পাদিত কোর্ট ম্যারেজ সামাজিকভাবে বৈধ হয় না।

বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় না হলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রচলিত রীতি ও প্রথা অনুসরণের মাধ্যমে বিবাহিত দম্পতিকে সমাজের স্বীকৃতি বা অনুমোদন গ্রহণ করতে হয়, কারণ এ ধরণের কোর্ট ম্যারেজ প্রথাসিদ্ধ নয়, তা অসামাজিক বিবাহ। এই কারণে কোর্ট ম্যারেজ সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।

ব্যাখ্যা: মূলতঃ কোর্টে কোনো বিবাহ হয় না। পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত পাত্র-পাত্রীকে স্বেচ্ছায় কোর্টে আসার পূর্বে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। পরে কোর্টে এসে উভয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে এই প্রকার Love Marriage-এর সমর্থনে একটি শপথ সম্বলিত বিবৃতি Affidavit দেয় এবং এভাবে বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করে। কার্যতঃ এই প্রকার শপথ সম্বলিত বিবৃতি অর্থাৎ এফিডেবিটের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।

“অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসবর্ণে প্রণয়ঘটিত বিবাহগুলো উভয়পক্ষের অবিভাবকদের অসম্মতিতে হয়ে থাকে। এরূপ বিবাহিত দম্পতিকে বিবাহের অব্যবহিত পরেই কোর্টে গিয়ে তাদের বিবাহের সমর্থনে একটি দলিল সৃষ্টি করতে হয়, যাতে যে কোনঅ পক্ষের অভিভাবকের উদ্যোগে থানায় অথবা কোর্টে তাদের বিরুদ্ধে কোনঅ মামলা দায়ের হলে এই দলিল তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনে সহায়ক হয়”। (সূত্রঃ- হিন্দু আইনের ভাষ্যঃ গাজী শামছুর রহমান)

পরস্পরের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পাংখঅয়া যুবক-যুবতী কোর্টে আসার আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। কোর্টে এসে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে “আমরা পরস্পরকে বিবাহ করলাম’ মর্মে বিবৃতি (হলফনামা) সম্পাদন করে দেয়।

অর্থাৎ তারা কোর্টেই একে অপরকে বিয়ের ঘোষণা দেয় মাত্র। কোর্টে আসার আগে বিয়ে করে না। আগেই বলা হয়েছে যে, কোর্টে কোনো বিয়ে হয় না। পূর্বে সম্পন্ন হওয়া বিয়ের ঘোষণা কোর্টে এসে দেয়া হয় যায় মাত্র।

সুতরাং যুবক-যুবতী উভয়ে হলফনামার মাধ্যমে বিয়ে হয়েছে বলে যা বুঝাতে চায়, তা মোটেই সমাজসিদ্ধ বিয়ে নয়। পাংখোয়া সমাজসিদ্ধ বিবাহের পূর্ব শর্ত হচ্ছে ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ বিষয়ক কর্ম সম্পাদন করা।

মিশ্র বিবাহ (নামদাং ইননেই): পাংখোয়া সমাজে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে মিশ্র বিবাহের প্রচলন আছে। তবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সাথে বিবাহ হলে তাকে পাংখোয়া সমাজে প্রচলিত ধর্ম ও রীতি অনুসরণ করতে হয়। অন্যথায় তাকে সমাজচ্যুত করা হয়। এ ধরণের মিশ্র বিবাহে ভিন্ন ধর্ম বা জনগোষ্ঠী হতে আসা স্ত্রীকে পাংখোয়া সমাজে প্রচলিত ধর্ম ও গোত্রের পদবী গ্রহণ করতে হয়।

পলায়ন/অনিয়মিত বিবাহ (পালিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে করা) আইনগত ফলাফলঃ

পলায়নের পর প্রেমিক-প্রেমিকাকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। যদি মেয়ের অভিভাবক তার মেয়েকে সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজী না হয় কিংবা প্রেমিকের অভিভাবক যদি প্রেমিকার পিতা-মাতার কনেপণ ও অন্যান্য দাবী পূরণ করতে রাজী বা সমর্থ না হয়, তাহলে পলাতক যুগলের বিয়ে হয় না এবং প্রেমিকাকে তার পিতার বাড়ীতে ফিরে যেতে হয়।

প্রেমিক-প্রেমিকা এভাবে পলায়নের কারণে সামাজিক বিচারে জোর করে অপহরণ করার অভিযোগে পাত্রকে অপরাধী সাব্যস্ত করা না হলে এবং প্রেমিকার পিতা-মাতা সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলেও পলাতক অবস্থায় বিবাহ বহির্ভূতভাবে দৈহিক মিলনের সামাজিক অপরাধের জন্য সাজাভোগ করতে হয় এবং পাত্রপক্ষকে গরু/গয়াল বধ করে পাড়ার লোকজনকে ভোজ দিতে হয়।

সমাজের অনুমোদন সাপেক্ষে সেই বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনের ফলে ভূমিষ্ঠ সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয় এবং পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী হয়ে পূর্ণ সামাজিক মর্যাদা ভোগ করে।

প্রেমিক বা প্রেমিকার পিতা-মাতার অসম্মতির কারণে প্রেমিক যুগলের বিয়ে না হয়ে যদি পলাতক অবস্থায় উভয়ের দৈহিক মিলনের দ্বারা তথা বিবাহ বহির্ভূত দৈহিকমিলনের কারণে কোনো কুমারী মেয়ে গর্ভবতী হয় সেক্ষেত্রে পাত্রকে জরিমানা স্বরূপ ৪ মুঠি একটি শূকর এবং ৪০ টাকা অর্থদন্ড দিতে হয়। ভূমিষ্ট সেই সন্তান অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।

সন্তান যার ঔরসে জন্মলাভ করেছে/করে সেই পিতার উত্তরাধিকারী হয় না এবং পিতার পারিবারিক পদবী বা মর্যাদার অধিকারী হয় না, মায়ের পরিবারের পরিচয়ে সন্তানটি পরিচিত হয়। সামাজিকআদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে শিশুটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা হয়।

দেশের প্রচলিত আইনে আদালতে মামলা ও সাজা হওয়ার আশঙ্কাঃ প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়েতে তাদের অভিভাবকের সম্মতি না থাকলে পলায়নের খবর জানাজানি হবার পর প্রেমিকার পিতা প্রেমিকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর আওতায় মামলা দায়ের করতে পারে।

আদালতে এ ধরণের মামলার ফলে প্রেমিক গ্রেপ্তার ওবিচারে সাজা পায়। আর প্রেমিকা যদি নাবালিকা হয় অথবা তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপহরণ ও দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হয়েছে বলে আদালতে জবানবন্দি দেয়, তাহলে প্রেমিকের ১৪ বছর থেকেযাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে ।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহ (আনরুক্‌কানিম্‌ আনাম্‌): পাংখোয়াসমাজে রক্ত সম্পর্কীয় একই গোত্রের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। একই গোত্রের মধ্যে বিবাহ হলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পাত্রপক্ষকে সামাজিক দন্ড হিসেবে গরু বা গয়াল দিতে হয়। দন্ড প্রদানের মাধ্যমে নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় দম্পতিকে সমাজভূক্ত হতে হয়।

নিষিদ্ধ বা অননুমোদিত বিবাহের আইনগত ফলাফলঃ পাংখোয়া সমাজে নিষিদ্ধ সম্পর্কের আত্মীয়ের সাথে বিয়ের অপরাধের জন্য সামাজিক দন্ড বাধ্যতামূলক এবং সামাজিক প্রথা অনুসারে শাস্তিস্বরূপ গরু বা গয়াল জরিমানা দিতে হয়।

তবে পাত্রী যদি এ সময়ে গর্ভবতী হয়, তাহলে বিচারের পূর্বে পাত্রপক্ষকে গরু বা গয়াল বধ করে পাড়ার লোকজনকে খাওয়াতে হয় এবং পাত্রের পিতাকে সামাজিক বিচারে পাত্রীর পিতামাতার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়।

গোপনে বিয়ে করে সামাজিক স্বীকৃতি ছাড়া স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করার অপরাধের জন্য শাস্তি হচ্ছে অর্থদন্ড । এক্ষেত্রে গরু বা গয়াল জরিমানা করে সেই দম্পতিকে পাড়া বা সমাজভূক্ত করা হয়।

বিবাহ নিষিদ্ধ সম্পর্কীয় ভাগ্নী বা ভাইঝির সাথে বিয়ে কিংবা দৈহিক মিলনের অপরাধে সামাজিক আদালতে ভরপুইখ (জরিমানা) হিসেবে শূকর বা গরু কেটে পাড়ার লোকজনকে ভোজ দিতে হয়। এই পশুর মাংস মরিচ ব্যতীত রান্না করে কেবলমাত্র সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠরা খেতে পারে।

বিধবা বিবাহঃ পাংখোয়া সামাজিক প্রথামতে বিধবা বিবাহ অনুমোদিত। একজন বিপত্নীক যেমন বিয়ে করতে পারে, তেমনি একজন বিধবা মহিলাও আবার বিয়ে করতে পারে।

একজন বিধবা যদি তার স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততিসহ স্বামীর পরিবারে বা শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে একত্রে বসবাস করে তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবা আমৃত্যু ভরনপোষণ পাবার অধিকারী।

কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ে করে যদি স্বামীশ্বশুরের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে স্বামীর সম্পত্তি থেকে ভরনপোষণ পায় না। পাংখোয়া সমাজে একজন বিধবার দ্বিতীয় বিবাহ প্রথাসিদ্ধ। তবে মহিলাকে পিতার বা ভাইয়ের বাড়িতে থেকে দ্বিতীয় বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়।

পাংখোয়া সমাজভুক্ত কোনো নারীর দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে কনেপণের পরিমাণ কম ধার্য করা হয়। বিধবা নারীর ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর ৬ মাস হতে ১ বছরের মধ্যে বিধবার দ্বিতীয় বিবাহ হয় না।

সেক্ষেত্রে মৃত স্বামীর ঔরসজাত সন্তানকে মৃত স্বামীর নিকটাত্মীয়গণের কাছে অবশ্যই হস্তান্তর করতে হয়। তবে মাতৃদুগ্ধ ত্যাগ না করা পর্যন্ত সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকবে।

বহু বিবাহ: পাংখোয়া সমাজে বহু বিবাহকে সামাজিক প্রথা ও ধর্মীয় রীতিনীতি দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুর কারণে দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যায়।

বিবাহের প্রমাণঃ পাংখোয়া সমাজে বর্তমানে বিবাহ একটি সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান। তাদের বিবাহ নিবন্ধনের কোনো প্রকার সামাজিক ব্যবস্থা কিংবা স্বীকৃত কোনো প্রকার সামাজিক পদ্ধতির প্রচলন নেই।

অবশ্য বর্তমানে পাংখোয়া জনগোষ্ঠী খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের কারণে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতিতে চার্চ বা গীর্জায় বিবাহ নিবন্ধনের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে সাধারণতঃ বিবাহের সামাজিক ও আইনগত বৈধতার প্রশ্নে কোনো প্রকার সমস্যার উদ্ভব হলে সেক্ষেত্রে বিবাহের সত্যতা বা অস্তিত্ব প্রমাণ হয় নিম্নমতেঃ

ক) ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তি বা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উপস্থিত বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাক্ষী।

খ) ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ অনুষ্ঠান সম্পাদনকারী ধর্মীয় পুরাোহিত অথবা চার্চ বা গীর্জার পাদ্রীর সাক্ষী।

গ) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের বাবা-মায়ের স্বীকৃতি।

ঘ) ‘বিবাহ ঘোষণা’ সংক্রান্ত শপথনামা বা হলফনামা ।

ঙ) সমাজ স্বীকৃত পন্থায় স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস।

চ) স্ত্রীর গর্ভে স্বামীর ঔরসজাত সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার ।

ছ) স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পরস্পরকে স্বীকৃতি প্রদান।

জ) সার্কেল চীফ, হেডম্যান, কার্বারী বা গ্রাম প্রধান/লাল কর্তৃক অথবা চার্চ বা গীর্জা কর্তৃক বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রদত্ত সনদপত্র।

ঝ) “ইনকাই’ ও ‘মান” প্রদান অনুষ্ঠানের প্রামাণ্য ছবি ।

উপরোক্ত উপাদানগুলো বিয়ের অস্তিত্ব সরাসরি প্রমাণ করে।

বৈবাহিক কর্তব্য:

(ক) স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বসবাস করে এবং স্বামীর ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ ও পরামর্শ মেনে চলবে।

(খ) স্বামী তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতে ও তার ভরনপোষণ দিতে বাধ্য থাকবেন।

(গ) উভয়ে পারিবারিক ও সাংসারিক দায়-দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান থাকবেন।

আইনসঙ্গত বিবাহে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার এবং দায়িত্ব:

(ক) বিয়ের সময় যদি স্ত্রী নাবালিকা থাকে তবে নাবালিকা স্ত্রীর ওপর সাবালক স্বামীর অভিভাবকত্ব বর্তায়। এক্ষেত্রে

নাবালিকার পিতা-মাতার চেয়েও স্বামীর দাবী অগ্রগণ্য।

(খ) বিয়ের পর স্ত্রীকে অবশ্যই স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী পছন্দনীয় স্থানে স্বামীর সাথে বসবাস করতে হয় এবং স্বামীর সকল প্রকার ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ অনুযায়ী চলতে হয়। অনুরূপভাবে স্বামীকেও স্ত্রীর মর্যাদায় স্ত্রীকে তার সাথে রাখতে হয় এবং তাকে পারিবারিক মর্যাদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ভরনপোষণ দিতে হয়।

তথ্যসূত্র

১। Majority Act, 1875

২। Guardians and Wards Act, 1890.

৩। Child Marriage Restraint Act, 1929.

৪। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা