পাংখোয়া জাতির আদ্যাপান্ত
2020
পাংখোয়া জাতির বসতি, অঞ্চল ও জসংখ্যা
বসতি ও অঞ্চল
পাংখোয়া জনগােষ্ঠী হলাে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন । আদিকাল থেকে সাধারণত পাংখােয়ারা উঁচু পাহাড়ের উপরে বসবাস করতে পছন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করে । এখনও তাদের বসবাসের স্থান লক্ষ করলে তা সহজেই বােঝা যায়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় বিলাইছড়ি ইউনিয়নে পাংখােয়া পাড়া এবং ফারুয়া ইউনিয়নে যমুনাছড়ি মডেল পাড়া ও ধুপশীল লতাপাহাড়ে নিউজৌডিন পাড়া, বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে নিউলংকর, ওল্ড লংকর, মামােয়াম পাড়া, ছিঃপুই, চিঃপুই, লুনতিয়ান, থাংনাং ও জৌপুই পাড়া; বরকল উপজেলায় জৌতুই, বুংমুন, লাইজৌ, সাইচাল ও জৌতুই পাড়া।
জুরাছড়ি উপজেলার দুমদুম্যা ইউনিয়নে গন্দাছড়ি পাড়া ও বরকলক (শহীদ আতিয়ার ক্যাম্প), লংগদু উপজেলায় হ্লাংপুই পাড়া, কাপ্তাই উপজেলার সদর ইউনিয়নে হরিণছড়া, বারুদগােলা মৌজায় বেথেল পাড়া, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় বালুখালী ইউনিয়নে বসন্ত পাংখােয়া পাড়া এবং বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় সাইজাম পাড়া ও নানখারপাড়া (বড়থুলী) ইত্যাদি স্থানে পাংখােয়াদের বসবাস রয়েছে।
রাঙ্গামাটি সদর থানার কর্ণফুলি নদীর পূর্ব পাড়ে ১৬১০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বসন্ত মােন-এ অবস্থিত পাংখােয়া পাড়াটি সবচেয়ে পুরােনাে। প্রায় ২০০ বৎসরেরও আগে এখানে পাংখােয়ারা বসতি স্থাপন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাংখােয়াদের বসবাস স্থানের বিবরণ দেওয়া হলাে :
ক্রম | থানা | মৌজার নাম | মৌজা নং | পাড়ার নাম | হেডম্যানের নাম |
১ | রাংগামাটি সদর | বসন্ত | ১২৮ | রাল আও(বসন্ত পাড়া) | চিয়ালজল পাংখোয়া |
২ | কাপ্তাই | বারুদ গোল | ১৩০ | বেথেল পাড়া | কালাচান তনচংগ্যা |
৩ | রাংগামাটি সদর | ভাজ্যতলী | ১১৯ | হরিণছড়া | হৃদয় রঞ্জন রোয়াজা |
৪ | বিলাইছড়ি | তিনকুনিয়া | ১২০৯(এ) | দিন থার (মালুম্যা) | লাল এংলিয়ান |
৫ | রাজস্থলি | ঘিলাছড়ি | ৩৩৩ | নিউ থলাংপুই (ঝান্ডিমোন) | সুশেন তঞ্চংগ্যা |
৬ | জুরাছড়ি | দুমদুম্যা | ১৫০ | কন্ডাছড়ি | সুমঙ্গুর পাংখোয়া |
৭ | লংগদু | কাকপুজ্যে | ১৮ | থলাংপুই | বিয়াকথাং পাংখোয়া |
৮ | বরকল | বামে হালাম্বা | ২১ | জৌতুই | লাল ঞাক পাংখোয়া |
৯ | বরকল | কুকিছড়া | ১৫৬ | বুংমুন | সাইনক পাংখোয়া |
১০ | বরকল | কলাবুনিয়া | ১৬৩ | লাইজৌ | জিরখুম লিয়ানা |
১১ | বরকল | সাইচাল | ১৬৪ | সাইচাল | সুমতোয়ালুন পাংখোয়া |
১২ | বরকল | কলাবুনিয়া | ১৬৩ | জৌ তুই | জিরখাং পাংখোয়া |
১৩ | বাঘাইছড়ি | লংকর | ১৫৬ | ওড লংকর ও নিউ লংকর | চালজোয়াম পাংখোয়া |
১৪ | বাঘাইছড়ি | রুই লুই | ১৬৭ | মা মুয়াম | লাল থাংয়া পাংখোয়া |
১৫ | বাঘাইছড়ি | কংলাক | ১৬৮ | ছিপ পুই চংমিং | থাং পাংখোয়া |
১৬ | বাঘাইছড়ি | সিয়াল দাই | ১৬৯ | চিঃপুই চাল | জনা পাংখোয়া |
১৭ | বাঘাইছড়ি | তুই চুই | ১৭০ | লুনতিয়ান | গরেন্দ্র ত্রিপুরা |
১৮ | বাঘাইছড়ি | বেটালিং | ১৭১ | থাং নাং ও জৌ পুই | রুয়াল থাত পাংখোয়াশনগুমা পাংখোয়া |
১৯ | বিলাইছড়ি | রাইনখ্যাং ফরেস্ট | নিউ জোদিন | রাললিয়ানা পাংখোয়া(ভিলেজার) | |
২০ | বিলাইছড়ি | রাইনখ্যাং ফরেস্ট | জগনা ছড়ি | রামকি পথন বম( ভিলেজার) |
বান্দরবান পার্বত্য জেলা
২১ রুমা | খুমি খিয়াং | ৩৫২ | সাইজাম পাড়া | রাম্থন বম |
২২ রুমা | বগা খাইন | ৩৫৭ | বড়তলি | গোপাল চন্দ্র ত্রিপুরা |
জনসংখ্যা
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন লুইন পাংখােয়াদের জনসংখ্যা ৩,০০০ বলে উল্লেখ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯০১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে জনসংখ্যা উল্লেখ করা হয় ১৬৮০ জন।
সর্বশেষ ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী পাংখােয়াদের জনসংখ্যা ৩২২৭ সন। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে জাতিভিত্তিক পৃথক তথ্য না থাকায় পাংখােয়াদের প্রকৃত জনসংখ্যা বর্তমানে কত তা জানা যায়নি। তবে পাংখোয়াদের মতে, বর্তমানে তাদের জনসংখ্যা ৪০০০ হতে পারে।
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় ৭৭১ জন, লংগদু উপজেলায় ৪৩ জন, বাঘাইছড়ি উপজেলায় ৬০৮ জন, বরকল উপজেলায় ৫২৮ জন, জুরাছড়ি উপজেলায় ২৫৬ জন, বিলাইছড়ি উপজেলায় ৯২২ এবং অন্যান্য স্থানে ৯৯ জনসহ পাংখােয়াদের মােট জনসংখ্যা ৩২২৭ জন।
কিন্তু পাংখােয়াদের এই সংখ্যাকে সঠিক পরিসংখ্যান হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নয় পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর অনেকে। ইতােমধ্যে অনেক পাংখােয়া বিভিন্ন কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরামে পাড়ি জমিয়েছে। মিজোরামে পাড়ি জমানাের প্রধান কারণগুলাের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা উল্লেখযােগ্য।
পাংখোয়া জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি
পাংখােয়া নামের উৎপত্তি
বিভিন্ন লেখক ও গবেষককে পাংখােয়াদের ‘পাংখাউই’, ‘পাংহয়’, ‘পাংকুয়া, ‘পানখুয়া’, ‘পাংখুয়া ইত্যাদি নামে উল্লেখ করতে দেখা যায়। কিন্তু পাংখােয়ারা নিজেদের ‘পাংখু’ বা ‘পাংখােয়া’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। পাংখােয়াদের বিশ্বাস সুদূর অতীতে তারা লুসাই পাহাড়ের পাংখােয়া নামক কোনাে এক গ্রাম থেকে এসেছিল। পাংখােয়া ভাষায় ‘পাং’ অর্থ শিমুল ফুল আর ‘খােয়া’ অর্থ গ্রাম। কথিত আছে যে, শিমুল গাছে পরিপূর্ণ একটা গ্রাম ছিল পাংখােয়াদের আদি গ্রাম।
সেই গ্রামে প্রচুর শিমুল ফুল ফুটতাে। কোথা থেকে এসেছে, তা জানতে চাইলে তারা শিমুল ফুল যে গ্রামে ফোটে সেই গ্রাম থেকে এসেছে বলে উত্তর দেয়। এ কারণে তাদেরকে ‘পাংখােয়া’ আখ্যায়িত করা হয়। জানা যায়, ভারতের মিজোরাম প্রদেশের ‘ছিমতুইপুই’ নামে একটি জেলার প্রধান শহরের নাম সা-ঙাও। পাংখােয়া ভাষায় ‘সা’ মানে বন্যপশু আর ‘ঙাও’ অর্থ বানর। সেই শহরের অনতিদূরে পাংখোয়া নামক একটি গ্রাম আছে।
মিজোরাম প্রাদেশিক সরকারের দলিলপত্র ও মানচিত্রে ৫৬১১ নং পাংখােয়া গ্রামটির চিহ্ন উল্লেখ পাওয়া যায় ।এছাড়া লুংলাই প্রশাসনিক জেলায় ‘পাংজল’ নামে আরাে একটি গ্রাম আছে। কথিত আছে যে, ঐ সব গ্রামগুলােতে শত বছরের পুরােনাে শত শত শিমুল গাছ রয়েছে।
পাংখােয়ারা মঙ্গোলীয় নৃগােষ্ঠীভুক্ত জনগােষ্ঠী। ব্রিটিশ কর্মকর্তা হাচিনসন মনে করেন, পাংখােয়া ও বম একই জাতির অন্তর্ভুক্ত এবং একই পিতার দুই সন্তান থেকে এদের বংশােদ্ভব ঘটেছে। কিন্তু পাংখােয়ারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, তারা বার্মার শান জাতির অংশ এবং দক্ষিণ দিক থেকে তারা এসেছিল।
গুংজংনোহ নামে তাদের কোনাে এক রাজার রাজত্বকালে পাংখােয়ারা খুবই প্রভাবশালী ছিল ও ঐ সময়ে সর্বাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বলে তারা বিশ্বাস করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ক্যাপ্টেন লুইন মনে করেন, পাংখােয়ারা লুসাই ও কুকিদের অন্তর্ভুক্ত জাতি।
সম্ভবত ভৌগােলিক ব্যবধানের ফলে তারা পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে কয়েকটি ভিন্ন-ভিন্ন জনগােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়েছে। এন ইলিয়াছ-এর মতে, এরা ব্রহ্মদেশের শান জনজাতির অন্তর্ভুক্ত ভিন্ন শাখা মাত্র। এদের সামাজিক রীতিনীতি বিশ্লেষণ করে জে শেক্সপিয়ার মনে করেন, এদের দেহে আদি মঙ্গোলীয় জনগােষ্ঠীর রক্তধারা প্রবাহিত । ভাষাতাত্ত্বিক জি এ গ্রিয়ারসন ভাষাতাত্ত্বিক সাদৃশ্যের ভিত্তিতে পাংখােয়াদের ‘মধ্য চীন’ নৃগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করেন।
পাংখােয়াদের আবাসভূমি
অনেক ঐতিহাসিক ও নৃবিজ্ঞানী মনে করেন, পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর মূল আবাসভূমি বর্তমান মায়ানমারের চীন প্রদেশে। চীন পর্বতমালার দক্ষিণে তসন ও উত্তরে জৌ উপত্যকার মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহে তাদের বসবাস ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষান্তে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে চীন পর্বতমালার অন্তর্গত ফালাম-হাকা অঞ্চল থেকে অন্যত্র জনঅভিবাসন শুরু হয়।
মূল জনগােষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বা গােষ্ঠীবদ্ধ হয়ে উক্ত থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশেষ করে সেই সময় বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর মধ্যে অন্তঃকলহ, সংঘাত, আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ, ফলশ্রুতিতে খাদ্যাভাব, চরম অরাজকতা ইত্যাদি কারণে অনেক জনগোষ্ঠী ঐ অঞ্চল থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে।
পণ্ডিতদের মতে, পাংখােয়ারা সেই অঞ্চল থেকে সরে এসে ক্রমান্বয়ে আরাকান ও লুসাই হিলসে বসতি স্থাপন করে এবং কালক্রমে ধীরে ধীরে জীবন-জীবিকার সন্ধানে পাংখােয়াদের একটি অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পড়ে।
টি এইচ লুইনের মতে, খুমী জনগােষ্ঠী কর্তৃক আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে , পাংখােয়ারা সপ্তদশ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করে। জানা যায়, ঐ সময় চীন পর্বতমালার লুসাইরাও অতিশয় পরাক্রমশালী হয়ে উঠেছিল। তারা পাংখােয়াদের উপরও নানাভাবে কর্তৃত্ব করেছিল বলে ইতিহাসে জানা যায়। ফলে পাংখােয়া জনগােষ্ঠী সেই অঞ্চল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
পাংখোয়া জাতির সামাজিক সংগঠন
গোত্র
সাধারণভাবে পাংখােয়াদের নামের আগে বা পরে গােত্রের নাম উল্লেখ থাকে না। তাই তাদের মধ্যে কে কোন গোত্রের লােক তা সহজে চিহ্নিত করা যায় না। সাধারণত পাংখোয়াদের ২৫টির মতাে গােত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব গােত্রের নামের সাথে বম জনগােষ্ঠীরও মিল দেখা যায়। নিম্নে পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর গোত্রের তালিকা দেয়া গেল-
১. ভান জাং (Van zang), ২. লাই স্লোয়াং (Lai tluang), ৩. সেইজাং (Sei zang), ৪. লাইঙুক Lai nguk), ৫. লাইবুর (Lai bur), ৬. সিরসিয়ার (Sir siar), ৭. খেয়ালরিং (Khual ring), ৮. চংনাম (Chawng nam), ৯. মিলাই (Milai), ১০. রামা (Rama), ১১. সা খং (Sa khawng), ১২. রােয়াললেং (Rual leng),১৩. পিপিলিং (Pipiling), ১৪. বংখােয়াই (Bawngkhuai), ১৫. পালাং (Palang), ১৬. সেভাল (Seval), ১৭. ডন (Dawn), ১৮. চে-নু (Che-noo), ১৯. লন্ সিং (Lawn sing), ২০. রি-পাচেই (Ri-pachei), ২১. রেই-হাং (Rei-hang), ২২. থাংতু (Thangtu), ২৩. সিংলা (Singla), ২৪. লাই ষােয়া (Laisuah) ও ২৫. হ্লাং লাউ (Tlang lau)।
জন্ম ও আচার-অনুষ্ঠান
শিশুর জন্ম নিয়ে পাংখােয়া সমাজে বিভিন্ন আচার-রীতি পালন করা হয়। পাংখােয়া সমাজে পরিবারে শিশু জন্মগ্রহণ করলে জন্মের সময় উপস্থিত ধাত্রী ও অন্য সাহায্যকারীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর রীতি রয়েছে। পাংখােয়া সমাজের প্রাচীন রীতি অনুসারে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর ঘরের সিঁড়ির গােড়ায় একটি শূকর ছানা এবং নিকটবর্তী নদী বা ছড়াতে একটি মােরগ/মুরগি অবশ্যই বলী দিতে হয়।
এর ফলে শিশুটি সকল প্রকার অমঙ্গল থেকে রক্ষা পায় বলে তাদের বিশ্বাস। শিশু জন্মের নয় দিন বা একমাস পর পারিবারিকভাবে শিশুর নামকরণের অনুষ্ঠান করা হয়। পুত্রসন্তান হলে একটি লাল মােরগ এবং ৫ পাত্র মদসহ পাড়ার মুরব্বিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। আর কন্যা সন্তানের জন্য ২টি মুরগি ও ৩ পাত্র মদের মাধ্যমে এই আয়ােজন করা হয়। সমাজের সমর্থ ব্যক্তি/পরিবার শিশুর নামকরণের এই অনুষ্ঠান আরও বড় আকারের ভােজসভার মাধ্যমে পালন করে থাকে।
এই ধরনের আয়ােজনে সাধারণত ধাত্রী সবার আগে আহার গ্রহণ করেন। পাংখোয়া জনগােষ্ঠীর লােকজন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে শিশুর নামকরণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে বাবা-মা তাদের নবজাত শিশুকে নিয়ে গির্জায় প্রার্থনা অনুষ্ঠানে যােগ দেয়। এ সময় নবজাতকের জন্য ধর্মীয় পুরােহিতের আশীর্বাদ গ্রহণ করা হয়।
বিবাহ
পাংখােয়া সমাজেও বিবাহের নিজস্ব রীতি আছে, যা হাজার বছরের পুরােনাে । আজকাল কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুযায়ী পাংখােয়া সমাজে বৈবাহিক আচারাদি আর অনুসরণ করা হয় না। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হবার পর অন্যান্য রীতি-প্রথার সঙ্গে বিবাহ সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠানাদিতেও যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে।
বিশেষ করে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে। যেমন আগের দিনে বিবাহ অনুষ্ঠানে সামাজিক আচারাদির পাশাপাশি মদ পরিবেশন করা হতাে। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদি অনেকটা অক্ষুন্ন থাকলেও মদের পরিবর্তে পানীয় হিসেবে চা, কফি ইত্যাদি পরিবেশনের রেওয়াজ চালু হয়েছে।
পাংখােয়া সমাজে অন্যান্য সমাজের মতাে কয়েক ধরনের বিবাহ প্রথা চালু আছে। তার মধ্যে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিবাহ প্রথা সমাজে সর্বোৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত। পাংখােয়ারা বিবাহকে পবিত্র কাজ হিসেবে জানে। বিবাহ উপলক্ষে সাধারণত বড় ধরনের উৎসবের আয়ােজন করা হয়, যা সব বয়সের নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ের অংশগ্রহণে রীতিমতাে এক ধরনের আনন্দ মেলায় পরিণত হয়।
পাংখােয়া পুরুষরা শুধু তাদের নিজেদের সমাজের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক সীমাবদ্ধ রেখে অন্যান্য পার্বত্য আদিবাসী জনগােষ্ঠী, যেমন : চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, খিয়াং, ম্রো, ত্রিপুরা, বম, লুসাই জনগােষ্ঠীর সদস্যদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। তাছাড়া হিন্দু বাঙালি এবং বিদেশিদেরও পাংখােয়ারা বিয়ে করছে। এই সব বিয়ে মূলত প্রণয়ঘটিত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলাে যে, সেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনাে পাংখােয়া মেয়ে বম ও লুসাই জনগােষ্ঠী ছাড়া অন্য কোনাে জনগােষ্ঠীর পুরুষকে বিয়ে করেছে এমন কোনাে তথ্য নেই।
পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর বিবাহের আনুষ্ঠানিকতার আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলাে পােয়ানসিলপুই (Puansil Pui) অর্থাৎ বড় কাপড়। এটি জুমের তুলা দিয়ে বুনা একপ্রকার কাপড়। কাপড়টি বুনতে সর্বনিম্ন ৩ মণ জুমের তুলা প্রয়ােজন হয় । আগেকার আমলে এই কাপড়টি ছাড়া বিয়ে সম্পূর্ণ হয় না। কারণ এটাকে পাংখোয়ারা খুবই পবিত্র জিনিস হিসেবে মনে করে। যে কোনাে পাংখােয়া মেয়ের বিয়েতে কনেরা এই কাপড়টি স্বামীর ঘরে নিয়ে যায়।
এই কাপড়টি একমাত্র বাসর রাতে প্রথম ব্যবহার করা হয়। যে কোনাে পাংখােয়া মেয়ের রজঃদর্শন শুরু হলেই তার অভিভাবক বা মা-বাবারা এই কাপড়টি তৈরি করে রেখে দেয়। কারণ কখন হঠাৎ করে বিয়ের প্রস্তাব আসে আর মেয়ের বিয়ে দিতে হয় তাতাে বলা যায় না । কিন্তু বর্তমানকালে পােয়ানসিলের পরিবর্তে (Blanket) বরের ঘরে কম্বল নিয়ে যাওয়ার প্রথা চালু হয়েছে।
পাংখােয়া সমাজের রীতি অনুযায়ী নিজের গােত্রের মধ্যে বিয়ে করা যায় না। বিশেষ করে পিতার বংশের দিকে হলে বিয়ে করা একেবারে নিষিদ্ধ।
বৈধ বিবাহ/সামাজিক বিবাহ
অভিভাবকের সম্মতিতে অনুষ্ঠিত বিবাহকে বলা হয় বৈধ বিবাহ। পাংখােয়া সমাজেও অন্যান্য সমাজের মতাে বৈধ বিবাহ সামাজিকভাবে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন হয়ে থাকে। নিম্নে সামাজিক বিবাহের বিভিন্ন ধরন তুলে ধরা হলাে—
১. পাংখােয়া সমাজের যে কোনাে যুবক যুবতী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
২. মামাতাে পিসতুতাে ভাই বােনের মধ্যে বিয়ে হতে পারে। তবে মামাতাে বােনকে বিয়ে করা গেলেও মামাতাে ভাইকে বিয়ে করা যায় না।
৩. মাসতুতাে বােন এবং মাসতুতাে বােনের মেয়েকে বিয়ে করা যায়।
৪. নিজ গোত্র ছাড়া অন্য যে কোনাে গােত্রে বিবাহ করা যায়।
৫. শালীকে বিয়ে করা যায়।
৬. বিপত্নীক পুরুষ এবং বিধবা মহিলার মধ্যে বিবাহ হতে পারে।
৭. পাংখােয়া । সমাজে স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায়ও একাধিক বিয়ে করা যায়। এজন্য কোনাে সংখ্যা/সীমা নির্দিষ্ট নাই।
৮. তালাকপ্রাপ্ত পুরুষ এবং তালাক প্রাপ্ত স্ত্রী লােক পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। এজন্য কোনাে সময় সীমা নির্দিষ্ট থাকে না।
৯. বড় ভাইয়ের স্ত্রী বিধবা কিংবা তালাক প্রাপ্ত হলে সে ভাইয়ের যেকোননষ্ঠ সহােদর কিংবা অন্য সম্পর্কের ভাই সেই স্ত্রী অর্থাৎ বৌদিকে বিয়ে করতে পারে।
১০. সমধর্মের পাত্র পাত্রী ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের হলেও তাদের মধ্যে বিয়ে হতে পারে। যেমন বর্তমানে বম-পাংখােয়া এবং লুসাই-পাংখােয়াদের মধ্যে নাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে প্রচলিত আছে।
১১. পাত্রী ভিন্ন ধর্ম এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও পাংখােয়া পাত্রের সংগে বিয়েতে কোনাে বাধা নেই।
অবৈধ বা অসামাজিক বিবাহ
প্রধানত নিজেদের বা একই গােত্র সম্পর্কের পাত্রপাত্রির বিবাহ অবৈধ। তারপরও বর্তমান সমাজে নানান রকম জরিমানা করে এই অবৈধ সম্পর্ককে মেনে নেয়া হয়। যেমন একই গােত্রের মধ্যে বিয়ে হলে একটি মাদি শূকর কেটে মরিচ লবণ মসলা ব্যতীত রান্না করে সমাজের মুরব্বিদের খাওয়াতে হয়। এরকম খাওয়ানাের অর্থ এই যে এরকম অবৈধ সম্পর্ক যেন আর না হয় এবং এরকম অরুচিকর খাবার যেন খেতে না হয়।
বিবাহের সময়
পাংখােয়া সমাজে জুলাই মাসে বিয়ে হয় না। এমন কি বিয়ের প্রস্তাবও দেয়া যায় না। কারণ মাসটি পাংখােয়া ভাষায় ‘জিং হ্লা’ অর্থাৎ অন্ধকার মাস। অন্ধকার মানে খারাপ এবং এসময় বিয়ে করলে সংসার সুখের হয় না বলে পাংখােয়ারা বিশ্বাস করে।
বিবাহের প্রস্তাবনা
মদের বােতল, ভালাে বিস্কুট, ভালাে সিগারেট, পান সুপারি এবং নারিকেল নিয়ে ছেলের পক্ষের দুলাভাই সম্পর্কের ১ জন ব্যক্তি, মামা বা বড় ভাই, মা-বাবা ও পাড়ার মুরব্বিদের নিয়ে, সাধারণত রাতের বেলায় মেয়ের ঘরে গিয়ে প্রস্তাব দেয়া হয়। রাতের বেলায় প্রস্তাব দেয়ার অর্থ হলাে নিরিবিলি পরিবেশে চিন্তা করা যাবে এবং প্রস্তাবিত সংবাদটি গােপন থাকবে যেন খবরটি তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে না পড়ে।
কনের ঘরে মা-বাবা, ভাই-বােন ও আত্মীয়-স্বজন থাকা অবস্থায় বিয়ের প্রস্তাবটি দেয়া হয়ে থাকে। প্রথা অনুযায়ী কনের বােনের স্বামীর কাজ হলাে খাবার-দাবারের আয়ােজন করা। যে জিনিসগুলাে সাথে করে আনা হয় সেগুলাে সুন্দরভাবে পরিবেশন করে খেতে খেতে বরের ভাই বা পাড়ার মুরব্বি প্রস্তাবের কথা শুরু করবে।
মেয়ের পক্ষ ও তাদের মতামত জানানাের ক্ষেত্রে মেয়ের বাবামা ও বড় ভাই-এর মতামতই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। বিয়ের কথাবার্তায় সব কিছুই সব সময় ঠিক নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে কনে পক্ষ বর পক্ষকে পুনর্বার প্রস্তাব নিয়ে আসার কথা বলতে পারে।
এইভাবে বিয়ের কথাবার্তা চলার পর এক পর্যায়ে উভয় পক্ষ একমত হলে কনেপক্ষ বরপক্ষ থেকে কী কী পণ দাবি করবে তাও নির্ধারণ করা হয়। বায়না করার প্রতীক হিসেবে তখন ১ টাকা বা ৫ টাকা মেয়ের বাবা বা অভিভাবককে অগ্রিম হিসেবে দিয়ে আসা হয়, যা ফেরতযােগ্য।
পণ
পাংখােয়া সমাজে বরপক্ষ থেকে কন্যাপক্ষকে পণ দেয়ার রীতি রয়েছে। পাংখােয়া সমাজে সমস্ত পণ মেয়ের বাবা অথবা মেয়ের অভিভাবক গ্রহণ কমে থাকে। পাংখােয়াদের বিয়েতে পণ প্রধানত দুই প্রকার। যথা : ১. কুমারী মেয়ে পণ ও ২. বিধবা নারীর পণ। কুমারী মেয়ের পণ বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।
যে: ১. রৌপ্য মুদ্রা ২০-৩০টি, ২. ১টি বড় ঘণ্টা (মং) বা ১টি গাভী বা গয়াল ( বাচ্চা থাকলে আরাে বেশি ভালাে), ৩. ১টি সিঙ্গার মেশিন, ১টি বড় থালা (পিতলের) ইত্যাদি। অপরপক্ষে সাধারণত বিধবা মহিলার ক্ষেত্রে তেমন কিছু ধার্য করা হয় না। তবুও বৈধভাবে বিবাহ হয়েছে তা প্রমাণ করবার জন্য রৌপা মুদ্রা ১০-১৫টির মতাে ধার্য করা হয়ে থাকে।
বিবাহের দিন
বর ও কনে উভয়ের বাড়িতেই বিবাহের দিন সকাল থেকে প্রস্তুতি চলতে থাকে। বরপক্ষে সকল আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। বিশেষ করে তাদের গােত্রের সকল দুলাভাই ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে খুবই আনন্দের মধ্যে সারাদিন কাটতে থাকে।
পুরুষরা জঙ্গল থেকে কলা পাতা, ঘরের উঠানে নতুন বৌ বসবার জন্যে মাচার বাঁশ, চুলার জন্য গাছ সগ্রহ করে। ভােজের জন্য প্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য রান্না ও আপ্যায়নের কাজও তারাই করে থাকে। মহিলারা জ্বালানি কাঠ সগ্রহ, পানি তােলা, ধান ভানা, বিন্নি ভাত রান্না (থাবু-হুত) ও মদ তৈরির কাজ সম্পাদন করে।
কনে পক্ষও বর পক্ষের মতই সকল আত্মীয়দের নিয়ে অনুষ্ঠান করে থাকে। বিশেষ করে কনের বােনেরা কনেকে ঘরের বৌ হওয়ার জন্য যা কিছু করণীয় সে সম্পর্কিত উপদেশ দিয়ে থাকে। এসময় আমন্ত্রিতদের রান্না করা শূকরের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
দুপুরে কনে কোনাে কোনাে জিনিস স্বামীর ঘরে নিয়ে যাবে সেগুলাে তার বােনেরাই গুছিয়ে দেয়। সাধারণত বিয়ের আগে তার হাতের তৈরি সব পরনের কাপড় (৪০-৫০ পিস্), ১টি ঝুড়ি, ১টি দা, ১ টি থুরুং (লান), ১টি মুরগি, ১টি জুমের তুলা দিয়ে তৈরি বড় কাপড় (পােয়ানসিল), ১টি ফুলবারেং (ডেমফর) ইত্যাদি সে স্বামীর ঘরে নিয়ে যায়।
বিয়ের দিন রাতে আনুমানিক ৮টার দিকে কনেপক্ষ কর্তৃক দাবিকৃত পণ সামগ্রী ও টাকাপয়সা একটি কুলায় যথাযথভাবে সাজিয়ে নিয়ে বর পক্ষের ঘটকরা উপস্থিত কনেপক্ষের সকলের সামনে প্রদর্শন করে থাকে। এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য যে দাবিকৃত পণ সামগ্রী ও টাকা যথাযথভাবে দেয়া হয়েছে।
বরের পক্ষ থেকে নিয়ে আসা পণের জিনিস বুঝিয়ে দেয়া শেষ হলে কনেপক্ষ থেকে তার স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য যে সমস্ত জিনিস দেয়া হলাে সেগুলাে কনের বােনের স্বামী বা অনুরূপ সম্পর্কের কেউ বরপক্ষের ঘটকদের সঙ্গে মিলে বাঁধাছাদা করবে।
বর পক্ষের পণ জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা বাজি ফোটানাে হবে। এতে পাড়াবাসী বুঝতে পারবে যে, পণ যথাযথভাবে জমা দেয়া হয়েছে। কনেকে ঘর থেকে নামানাের আগে উপস্থিত সকল মুরব্বিদের মদ পান করিয়ে কনের মা বাবা বা অভিভাবকের কাছ থেকে কনেকে নিয়ে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করতে হয়।
অনুমতি পাওয়া গেলে প্রথমে প্রধান ঘটক একটা ঝুড়িতে ১টি মুরগি ও ১টি দা নিয়ে সবার সামনে থেকে এগােতে থাকে এবং কনের বড় বােন, মাসি, পিসি এবং অন্য আত্মীয়বর্গ তাঁকে অনুসরণ করে বরের বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তার আগে কনে তার নিজের বাড়ি থেকে নামা মাত্র অর্থাৎ ঘরের মই থেকে নামার সাথে সাথেই আরেকটি বাজি ফোটানাে হবে।
এতে পাড়াবাসী জানতে পারবে যে, নতুন বৌ ঘর থেকে ঠিকভাবে নামতে পেরেছে। বরের বাড়ি যদি দূরের কোনাে পাড়ায় হয় তাহলে পরের দিন সকালেই নতুন বৌ নিয়ে বরের বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, কনের সাথে কনের বাবার পক্ষের যে সব ‘নি-সার’ বা ঘনিষ্ঠ মেয়ে আত্মীয় (দুধের শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত) বরের ঘরে কনেকে পৌছে দিতে অংশগ্রহণ করে তাদের প্রত্যেককেই কনের বাবা টাকা দিয়ে প্রতীকীভাবে পুরস্কৃত করে।
এই টাকার পরিমাণ বয়স ভেদে সর্বনিম্ন ২ টাকা থেকে অনুর্ধ্ব ২০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং টাকাটা সাধারণত কনের পণের টাকা থেকে দেয়া হয়। কনেকে নিয়ে বরের ঘরে পৌছানাের পর উঠানের মধ্যে আগে থেকেই তৈরি করে রাখা বাঁশের মাচার উপর কনেকে বসানাে হয়। এ সময় বরের বােন, মাসি, পিসি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়বর্গ মদ দিয়ে নতুন বৌকে সম্ভাষণ জানায়।
এই পর্ব শেষে বরের ঘরে কনের প্রবেশের পালা শুরু হয়। ঘরে উঠার মইয়ে পা দেয়ার আগে ঘটক বরের মা বাবা কিংবা অভিভাবকের উদ্দেশ্যে “খােয়াল কান হং ইয়ে” অর্থাৎ ভালাে অতিথি নিয়ে আসছি বাক্যটি ৩ বার উচ্চারণ করে। ঘরের ভেতরে বসে থাকা বরের বাবা কিংবা অভিভাবক সাড়া দিয়ে বলবে ‘ই খুয়াল’ বা কী ধরনের অতিথি, ‘খুয়াল সা মা খুয়াল সিয়া’ অর্থাৎ ভালাে অতিথি, না খারাপ অতিথি? উত্তরে ঘটক বলবে, “খুয়ালরিং খােয়াল” অর্থাৎ “ভালাে অতিথি”।
ঘরের ভেতর থেকে তখন আহবান আসবে , “ হং হ্লুং ররুং” অর্থাৎ “আস আস বা উঠ উঠ”, ‘মি নেয়, মি সুম, মি মাল হং লুত পুই রুং’ অর্থাৎ “অন্যের বা পরের ধন-সম্পদ এই ঘরে নিয়ে আস”। তখন কনে প্রথমে ডান পা বাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে এবং ঘরে ঢুকা মাত্র বরের বাবাকে এক গ্লাস মদ দিয়ে ‘মারাং’ বা বাবা বলে সম্বােধন করবে। অনুরূপভাবে কনের বান্ধবীও বরের মাকে এক গ্লাস মদ দিয়ে কনের পক্ষ হয়ে ‘নু’ বা মা বলে সম্বােধন করবে।
বিবাহের পরের দিন
বরের বাড়িতে সারারাত তরুণ-তরুণী, পাড়াবাসি ও আত্মীয়-স্বজন সকলেই মদ পানের পাশাপাশি গানবাজনা করে আনন্দ উল্লাস করে। সেদিন রাতে বর কিন্তু কোনােভাবে ঘুমাতে পারবে না। সে যদি ঘুমিয়ে পড়ে তাহলে তার সংসারে অমঙ্গল হবে বলে পাংখােয়া সমাজে বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
খুব ভােরে অর্থাৎ মােরগ ডাকার আগেই বর, কনে, বরের বন্ধু ও কনের বান্ধবীসহ সকলে মিলে ঝরনা থেকে পবিত্র পানি (তুই থিয়াংহ্লিম) তুলতে যায়। কেউ পানি তােলার আগেই তাদের ঝরনা থেকে পানি নিয়ে আসতে হবে, যে কারণে এই পানিকে পবিত্র বলা হয়।
এ কাজটি করতে পারলে সারা বছর তাদের সংসার পবিত্র হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হয়। সেখান থেকে এসে কনের বাড়ি থেকে ঘটকদের নিয়ে আসা মুরগিটি কেটে সিদ্ধ করে বর-কনে-বন্ধু-বান্ধবী ও ঘটকসহ এক সঙ্গে এক থালায় ভাের হবার আগেই খেয়ে ফেলতে হবে। কিছুই অবশিষ্ট রাখা যাবে না।
সকাল বেলা উপস্থিত সকলের সামনে বর-কনে একটি মদের গজিতে (মাটির তৈরি এক ধরনের পাত্র) রাখা মদ এক সাথে দুটি বাঁশের নল দিয়ে টানবে। এটাকে পাংখােয়ারা মুর মতং জু’ অর্থাৎ মুখে মুখে স্পর্শ করা বলে, যা ঐ মুহূর্তে তাদেরকে এক সুতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে বলে ধরে নেয়া হয়। এটাই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে বৈধতার স্বীকৃতি। সারাদিন আনন্দ উৎসবে দিন। কাটানাের পর বিকেল বেলায় সকলেই বিয়ের ভােজে অংশগ্রহণ করে।
সাধারণত নারী ও শিশুদের প্রথম দিকে খাওয়ানাের পরই পুরুষ/মুরব্বিদের জন্য খাবার পরিবেশন করা হয়। এখানে ঘটক, কনের অভিভাবকবৃন্দকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে আপ্যায়ন করা হয়। যেমন : যে জন্তু/পশুই বলি দেয়া হােক না কেন ঐ পশুর রান্না করার চর্বির টুকরা, পায়ের গােড়ালি আলাদা করে কলা পাতায় মুড়িয়ে তাদের সামনে পরিবেশন করা হয়। বিশিষ্ট ও সম্মানিত ব্যক্তিরাই পাংখােয়াদের দৃষ্টিতে মর্যাদাপূর্ণ এই ভােজে অংশ নিতে পারে। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে বরের বড় বােন/পিসিরা বাসর রাতের জন্য বিছানা করে দেয়।
বিয়ের পরের দিন শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া (নিয়া মালে)
জামাই কাজে দক্ষ ও পারদর্শী কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য শ্বশুর শূকর বা গরু বলী দিয়ে ভােজের আয়ােজন করে থাকে। ভােজের জন্য যদি শূকরের মাংস নির্দিষ্ট করা হয় তাহলে ঘরের মাচার নিচে বেঁধে রাখা শূকরটি নতুন জামাইকে দিয়ে ধরতে দেওয়া হয় । জামাই যদি শূকরটি ধরতে পারে তাহলে শক্তি এবং কাজে সে দক্ষ বলে ধরে নেয়া হয় ।
এই দিনে কনের আত্মীয়স্বজনরা নতুন জামাইয়ের সাথে ঠাট্টা তামাশার মাধ্যমে আনন্দ করে । পাংখােয়া বিবাহরীতিতে এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে পাংখােয়ারা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে সমস্ত বিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের নিয়ম অনুসারে পালন করা হয়।
এখন মদের পরিবর্তে কফি, মালটোভা, চা, কোকাকোলা বা সেভেনআপ এবং তার সাথে ভালাে ভালাে সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। আর ‘মুর মতং জু’-এর জায়গায় চার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে আংটি পরিয়ে দিয়ে বিয়ের সামাজিক বৈধতা দেয়া হয় ।
কালের বিবর্তনে পাংখােয়া সমাজের রীতিনীতি দিন-দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। একুশ শতকে এসে অনেক কিছুতে পিছিয়ে থাকলেও আধুনিকায়ন এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ছোঁয়াও পাংখােয়া সমাজে লেগেছে। সমাজ ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক পরিকাঠামােতে এভাবে পরিবর্তন হতে থাকলে পাংখােয়া সমাজের মৌলিক সামাজিক আচার-রীতি-নীতিগুলাে টিকে থাকবে কিনা তা চিন্তা করার মতাে একটি বিষয় ।
মৃত্যু ও সৎকার পদ্ধতি
পাংখােয়া সমাজে পরিবারের কারও মৃত্যু হলে গ্রামবাসী সকলে মৃতের জন্য শােক প্রকাশ করার জন্য মৃতের বাড়িতে সমবেত হওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অতীতে সৎকারের জন্য শবদেহ কফিনে রেখে দূরবর্তী জঙ্গলে নিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল। পরিবারের আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিদিন ঐ কফিনের নিচ থেকে ধোঁয়া দিতে হতাে।
এক বছর পর্যন্ত এই নিয়মে রাখার পর কফিন হতে শবদেহের প্রতিটি হাড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন কাপড়ে বেঁধে কবর দেয়া হতাে। কবরের উপর মৃত্যের নাম পরিচয় লেখা স্মৃতিস্তম্ভ বা ফলক থাকে। মৃতের আত্মার শান্তি ও সদ্গতির উদ্দেশ্যে গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনকে ভােজে আপ্যায়ন করা হয়।
তবে বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবর দেয়া হয়। ধর্মীয় পুরােহিত মৃতের আত্মার সদ্গতি ও শান্তি কামনা করে প্রার্থনা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রার্থনা শেষে কবরে শবদেহ রাখা হয় দক্ষিণমুখী করে। তারপর কবরে মাটি দিয়ে তার উপর স্মৃতিস্মম্ভ স্থাপন করে চারপাশে ঘেরা দেয়া হয়।
ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতিষ্ঠান
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে পাংখােয়াদেরও প্রথাগত সামাজিক নেতৃত্ব রয়েছে। গ্রাম পর্যায়ে কার্বারী এবং মৌজা পর্যায়ে হেডম্যান রয়েছে। সাধারণভাবে পাংখােয়ারা চাকমা সার্কেলের মধ্যে বসবাস করে। তাই ঐতিহ্যগতভাবে তারা চাকমা রাজার প্রজা এবং যে কোনাে সামাজিক ও ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত পর্যায়ে চাকমা রাজার দ্বারস্থ হয়ে থাকে।
সাধারণভাবে গ্রাম পর্যায়ে কার্বারীই গ্রামের যাবতীয় শান্তি-শৃঙ্খলা ও বিচার-আচার পরিচালনা করে থাকেন। তিনি ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মৌজা হেডম্যানকেও সহযােগিতা করে থাকেন। মৌজা হেডম্যান ভূমি ব্যবস্থাপনা, জুম চাষ, বিভিন্ন সামাজিক বিরােধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন।
কোনাে বিরােধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গ্রামের কার্বারীর রায় মনঃপূত না হলে হেডম্যান আদালতে আপিল করা যায়। অনুরূপভাবে হেডম্যানের রায়ে সন্তুষ্ট না হলে যে কোনাে ব্যক্তি রাজার আদালতে পুনঃবিচারের আবেদন করতে পারে।
অর্থনৈতিক সংগঠন
আর্থ-সামাজিক অবস্থা
পাংখােয়াদের উৎপাদন ব্যবস্থা মূলত পাহাড়, বন ও প্রকৃতি নির্ভর। পাহাড়, বন ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে তাদের উৎপাদন ও জীবনযাত্রা। তাদের জীবন-জীবিকার মূল ভিত্তি জুম চাষ। আগেকার দিনে জুম চাষে ভালাে ফসল হতাে। জুম চাষ করে অনায়াসে সারা বছরের খােরাকি যােগাড় করা যেতাে।
জুম থেকে শাক-সবজি ও ফলমূল পাওয়া যেতাে। প্রকৃতি থেকে তাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারতাে। কিন্তু বর্তমানে জুমচাষের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসা, জুমচাষের বিরতিকাল হ্রাস পাওয়া এবং তার ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে আসা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে জুমচাষ করে বছরের খােরাকি যােগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ফলে অন্যান্য অরণ্য-নির্ভর জনগােষ্ঠীর মতাে পাংখােয়াদের অর্থনৈতিক অবস্থাও শােচনীয় হয়ে উঠেছে এবং তাদের জীবনযাত্রার ভিত্তি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এখন জুম চাষ থেকে বড়জোর ৩/৪ মাসের খােরাকি সংগ্রহ করা যায়। অবশিষ্ট সময় তাদের চরম দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়।
অধিকাংশ পাংখােয়া দুর্গম ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করার ফলে তাদের সমতল জমির সাথে সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। ফলে বিকল্প জীবিকার সন্ধানও পাংখােয়াদের বেলায় খুবই সীমিত। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণে পাংখােয়াদের মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবীও নেই বললেই চলে।
ছােটখাটো চাকরিতে যে কজন পাংখােয়া জড়িত রয়েছে তাও অত্যন্ত নগণ্য ও স্বল্প বেতনের । ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরাে বেশি পিছিয়ে রয়েছে পাংখােয়ারা। পুঁজি, সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা ও ব্যাংক ঋণের অভাবের কারণে পাংখােয়াদের মধ্যে যারা দু একটি ব্যবসায় জড়িত তারাও তেমন একটা সুবিধে করতে পারছে না।
বিশেষ করে বাঙালি ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযােগিতায় টিকে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব না। যারা ব্যবসায়িক কলাকৌশলের দিক দিয়ে অদক্ষ ও যাদের পুঁজি অত্যন্ত অল্প, তাদের পক্ষে টিকে থাকা কোনাে ক্রমেই সম্ভব নয়।
পাংখোয়া নারীরা তাঁত শিল্পে দক্ষ। কিন্তু যথাযথ বাজারজাতকরণের অভাবে তাও পেশা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। বেত ও বাঁশশিল্পে পাংখােয়ারা পারদর্শী হলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাতেও সফলতা অর্জন করতে পারছে না তারা। অন্যান্য আদবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে পাংখােয়াদেরও জীবিকার অন্যতম উৎস হলাে বনজ
সম্পদ সংগ্রহ ও বিক্রি করা । কিন্তু নানা সরকারি বাধানিষেধের কারণে বনজ সম্পদ আহরণ ও বিক্রির কাজ বর্তমানে অনিশ্চিত। এহেন করুণ অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে পাংখােয়াদের অনেকেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে ।
পাংখোয়া ঐতিহ্যগত উৎপাদন ব্যবস্থা
জুম চাষ বা লাে-নেই (Lo-nei) : আদিবাসীদের জন্য জুম চাষ হলাে উৎপাদনের প্রধান উপায়, পাংখােয়াদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। স্মরণাতীতকাল হতে পাংখােয়ারা জুম চাষ করে আসছে এবং এখনও পাংখােয়াদের মধ্যে শতকরা ৯০% এর উপরে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছে।পাংখােয়াদের জুম চাষের কিছু নিয়ম-কানুন অথবা রীতি আছে। তা নিম্নে তুলে ধরা হলাে :
ফালদার জে : (Phaldar zeh) : সাধারণত পাংখােয়ারা জুম কাটার আগে যেখানে জুম করবে সে জায়গাটা আগেভাগে চিহ্নিত করবার জন্য ফালদার বা বাঁশ কেটে উপড়ে ফালা করে ক্রশের মতাে করে চিহ্ন দিয়ে আসে। যেদিন ‘ফালদার জে’ করা হবে সেদিন রাতে দেখা স্বপ্নের ভালাে-মন্দের উপর নির্ভর করবে জুমচাষ করা যাবে কি যাবে না। স্বপ্ন যদি ভালাে হয় জুমচাষ করা হবে, যদি ভালাে না হয় তাহলে করা যাবে না। এটা প্রধানত বছরের প্রথম দিকে বা জানুয়ারি মাসের দিকে করা হয়।
লৌ ভাত (জুম কাটা) (Lo-vat) : জুম কাটার আগে ‘ফালদার জে’ করার পরে সব কিছু ঠিক থাকলে জুম কাটা হয়। জুম কাটা/জঙ্গল কাটা সহজ কাজ নয়, তাই সাধারণভাবে একা একা না কেটে আত্মীয়-স্বজন অথবা সমমনা ৩-৪ জন মিলে একত্রে পালাক্রমে একে অপরের জুম কেটে দেয়।
একদিন একজনের জুম সবাই মিলে কেটে দেয়। অন্যদিন সবাই মিলে আরেকজনের জুম কেটে দিয়ে আসে। জুমে এভাবে কাজ চলতে থাকে। জুম কাটার প্রথম দিন কমপক্ষে ১টি মুরগি/মােরগ অবশ্যই সাথে নিতে হয়। তার চেয়ে কোনাে বড় প্রাণী (শূকর, গরু বা গয়াল) নিয়ে যেতে পারলে তাে আর কোনাে কথাই নেই।
যেখানে জুম করবে সেখানে অন্তত রক্ত ঝরাতেই হবে, তা নাহলে জুমক্ষেতের মালিক বা অধিষ্ঠাত্রী দেবতা অসন্তুষ্ট হয়। এই রেওয়াজ এখনও পাংখােয়ারা মেনে চলে। জুম কাটা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করে মার্চ মাসের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হয়। পাংখােয়া সমাজে জুম কাটার কাজটা খুবই পবিত্র এবং গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়।
একে একপ্রকার যুদ্ধ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। কারণ যে কোনাে মুহুর্তে গাছ-বাঁশ কাটতে গিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে পাশে নারীরা এ সময়ে খুবই চিন্তিত থাকে তাদের স্বামী বা পরিজনদের জন্য।
লৌ ওর (জুম পােড়) (Lo-ur)ঃ জুম কাটার পর প্রায় মাস দেড়েকের পরে ঋণ পুড়িয়ে ফেলা হয়। এতে দলবল নিয়ে যাওয়া হয়।
লৌ চু সাক (জুম/টঙ ঘর তােলা) (Lo Chu Sak) : জুম পােড়ানাের পরে সারা বছর জুম ঘরে থেকে কাজ করার জন্য অস্থায়ী জুম ঘর তৈরি করা হয়। এই ঠিক মাঝখানে বা কেন্দ্রস্থলে স্থান নির্বাচন করে তােলা হয়। কারণ চতুর্দিকে যেন আসা-যাওয়া করতে সুবিধা হয়।
মাং রা-সম (জুম পরিষ্কার করা) (Mang Ra Sawm) : জুম পােড়ানাের পরেও পুড়ে না যাওয়া অবশিষ্ট গাছের ডাল বা অন্যান্য পরে থাকা আগাছাগুলাে পরিষ্কার করা হয়, যেন ভালাে করে বিভিন্ন ধরনের রবিশস্যের বীজ বপন করতে সমস্যা না হয় ।
চিমু খং কা হ্লাক (বীজ বপন করা) (Chimu Khawngkha lak) : জুম পরিষ্কার করার পরে জুমে বিভিন্ন ধরনের বীজ বপন করা হয়। প্রধানত ধান, তিল, মিষ্টি কুমড়া, শসা, তুলা, ভুট্টা, কচু এবং বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা হয়। সহজভাবে এবং অল্প সময়ের মধ্যে একসাথে একটি জুমক্ষেতে বহুমুখী ফসল ফলানাে সম্ভব বলে পাহাড়িরা আজো জুম চাষকে ছাড়তে পারছে না। তাছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থানেরও তেমন কোনাে সুযােগ নেই।
লৌ হ্ল(আগাছা পরিষ্কার) (Lo-Thlaw) : সাধারণত জুমে ৩ বার আগাছা পরিষ্কার করা হয় ।
লৌ ভেং এবং ভা ভেং (ফসল পাহারা দেয়া/রক্ষা করা) (Lo-Veng/Va veng) : পাংখােয়ারা ধান বা অন্যান্য ফসল পাকার আগেই ফসল রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। প্রথমত পাখি তাড়াবার জন্য জুমের চারপাশে বাঁশ গেঁথে রাখে। এক প্রকার বাঁশ কেটে প্রত্যেক গাঁথানাে বাঁশের আগার সাথে বেঁধে রাখা হয় এবং বাঁশগুলােতে দড়ি বেঁধে সেগুলাে জুম ঘরে রাখা একটি দড়ির সাথে বেঁধে রাখা হয়।
জুম ঘর থেকে দড়িতে টান মেরে সব বাঁশে নাড়া দিয়ে শব্দ করা হয়। একসাথে বেজে ওঠা সেই শব্দ শুনে পাখিরা পালিয়ে যায়। বিভিন্ন বন্য পশুর (শূকর, ভালুক) হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য জুমের চারপাশে আশঙ্কাজনক স্থানগুলােতে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ (কাবুক) পেতে রাখা হয়।
সাংশিন (ধান কাটা) (Sang-sin) : জুমচাষে সবচেয়ে আনন্দের কাজ হলাে ধান কাটা। পাংখােয়ারা সাধারণত এককভাবে ধান না কেটে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে কাজটি করে থাকে খুবই আনন্দের সাথে।
সাং-রা চিল (Sang ra-chil) : ধান কাটার পরে দুভাবে ধান মাড়াই করা হয়। ধানের শীষ থেকে ধান ঝরানাের কাজটিকে পাংখােয়া ভাষায় বলে ‘সাং-রা চিল’ বা ধান মাড়া। ধানের শীষগুলাে দু পা দিয়ে মাড়িয়ে ধানের শীষ থেকে ধান ঝাড়া হয়।
আরেকটি পদ্ধতি হলাে ধান কেটে বাণ্ডিল করে বেঁধে রেখে থুড়ং বা একপ্রকার (বাঁশ দিয়ে তৈরি) ঝুড়ির ভিতরে রেখে আঘাত করলে ধানের শীষ থেকে সরাসরি ধানগুলাে ঝুড়ির ভিতরে ঝরে পড়তে থাকে।
সাং ফুর (ধান ঘরে তােলা) (Sang-Phur) : প্রথমে ধান জুম ঘরে তােলার পর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কাজ হলাে ‘সাং ফুর। এ ক্ষেত্রেও পাংখােয়ারা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে ধানগুলাে জুম থেকে ঘরে নিয়ে আসে। ঘরে ‘পাং’ বা গােয়ালে এ ধান রাখা হয়।
চিমু খংখা লাক/ রক্ষক(Chimu Khawngkha lak/Rawkhawk) : জুমে ধান কাটা এবং ফসল তােলা শেষ হলে বিভিন্ন ফসলের বীজ সংরক্ষণের জন্য রবি-শস্যের পরিপক্ক বীজগুলাে যত্ন সহকারে সংগ্রহ করে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।
জুম চাষ করতে পাংখােয়ারা বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে থাকে। যেমন : ধারালাে দা, মাথা সরু দা (বীজ বপনের জন্য ব্যবহার করে), কুড়াল (বড় গাছ কাটার জন্য) ও সারি (ধান কাটার সময় ব্যবহার করে)।
পাংখোয়া ভূমি মালিকানা ও সম্পত্তির উত্তরাধিকার
পাংখােয়া সমাজের অনুশাসন ও রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়। পাংখােয়া সমাজে পরিবারের কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সমাজে উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকারভিত্তিক নিম্নবর্ণিত শ্রেণী বিন্যাসের ক্ষেত্রে লাল বা সমাজপতির সিদ্ধান্ত অথবা কার্বারী-হেডম্যান-সার্কেল চিফ-এর সামাজিক আদালতের প্রতিবিধান ও সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়ঃ
ক. পাংখােয়া পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র বা পুত্ররা তার অপ্রতিরােধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী। পুত্রের উপস্থিতি অন্য সকল নিকট আত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। স্ত্রী বলতে পাংখােয়া সমাজ স্বীকৃত স্ত্রী, সন্তান বলতে ঔরসজাত ও দত্তক সন্তানকে সমঅর্থে বুঝাবে। মৃতের সংসারে অবস্থানকারী বিধবা স্ত্রী ও অবিবাহিত কন্যাদের বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত মৃতের সম্পত্তি হতে ভরণপােষণের অধিকারী হয়।
খ.পাংখােয়া পরিবারে মৃতের কোনাে পুত্র সন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃতের ভ্রাতা/ভ্রাতুস্পুত্র/বংশের রক্ত সম্পর্কীয় পুরুষ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।
গ. স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্বামী তার মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তবে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীর দ্বিতীয়বার বিবাহ না হলে মৃত স্বামীর সম্পত্তি হতে ভরণপােষণ লাভের অধিকারী হয়।
ঘ. মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যার ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে সেই পিতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
ঙ. পাংখােয়া সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, নাতি, পিতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
চ. পাংখােয়া পরিবারে মৃতের যদি পুত্র,পিতা, ভাই এবং ভাইপাে এ সকল রক্ত সম্পৰ্কীয় কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে কাকা/জেঠা, তাদের পুত্র আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
ছ. পাংখােয়া সমাজে মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পৰ্কীয় কেউ না থাকলে, সমাজপতি বা (লাল) বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আইনগত উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করা হয়।
পাংখােয়া পরিবারে মৃত স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রী আইনগত উত্তরাধিকারী হয় না। তবে নাবালক সন্তানের ভরণপােষণ এবং কন্যা সন্তানের বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিজ ভােগ দখলে রেখে মৃতের রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের পরামর্শ ও অনুমতি সাপেক্ষে বিক্রি করতে পারে।
পাংখোয়া জাতির ধর্মীয় অবস্থা
ধর্ম ও ধর্মীয় গােষ্ঠী (সা-খােয়া)
আদিম যুগে পাংখােয়ারা ধর্মীয়ভাবে শিব দেবতার অনুসারী ছিলাে। পাংখােয়াদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য কোনাে মঠ বা মন্দির ছিলাে না। বট গাছের গােড়ায় তারা শিবের পূজা করত। অসুখ বিসুখ হলে ঝরনা বা ছড়াতে গিয়ে মােরগ কেটে পূজা করতাে। প্রকৃতির পূজাই ছিলাে তাদের আস্থা ও সম্বল। তবে কালের বিবর্তনে পরবর্তীতে পাংখােয়ারা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে। এখন সকল পাংখােয়া খ্রিস্টধর্ম পালন করে।
পাংখােয়াদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্ম প্রথম প্রচার শুরু করেন ভারতের মিজোরাম থেকে গত দুজন পালক। ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে ভারতের নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া জেনারেল মিশন (এনইআইজি) পরিবারসহ দুজন পালককে পাংখােয়াদের মধ্যে সুসমাচার প্রচারের কাজ করার জন্য বাংলাদেশে পাঠায়।
এই দুজন পালকের নাম ছিলাে যথাক্রমে পাস্টার আর, রুয়ালা লুসাই এবং পাস্টার পাথলাই লুসাই। এই দুজন ব্যক্তি পাংখােয়াদের পাশাপাশি বমদের মধ্যেও সুসমাচার প্রচারের কাজ করেছেন। তাঁরা প্রথমে বর্তমান বরকল থানার সাইচাল (হাতি) পাড়া এবং লুংইনখার (পাথরের দরজা) গ্রামে সুসমাচার প্রচার করা শুরু করেন। তারা লুসাই ভাষায় সুসমাচার প্রচার করতেন ও শিক্ষা দিতেন।
মিশন প্রথমে লুংইনখার জুনিয়র হাই স্কুল (ক্লাশ থ্রি পর্যন্ত) স্থাপন করে সেটাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে। এখান থেকে পাংখােয়ারা লুসাই ভাষা শিখতাে ও প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করত। এই পাস্টরদ্বয় প্রায় পনের বছর ধরে পাংখােয়াদের মধ্যে সুসমাচার প্রচার করেন। তাদের কাছ থেকেই পাংখােয়ারা প্রথম যীশু খ্রিস্টের সুসমাচার শােনে।
এদের কাজের ফলে সাজেকের দিকে ও দুম্বা পাহাড়ের দিকে পাঁচ হাজারেরও বেশি পাংখােয়া খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে (১৯৪৩ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) নানা কারণে ভারতের মিজোরামে চলে যায়। তখনাে পর্যন্ত সাইচাল এলাকায় কোনাে পাংখােয়া খ্রিস্টান হয় নাই। পূর্বোক্ত দুজন পাস্টারের উত্তরসূরি পাস্টার নেইথাং বম সাইচাল এলাকার বম এবং পাংখােয়াদের মধ্যে কাজ শুরু করেন।
পাস্টর নেইথাং বম ১৯৫৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত এই এলাকায় সুসমাচার প্রচার করেন। তার কাজের ফলে প্রায় ২০ জন পাংখােয়া খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। পাংখােয়া খ্রিস্টানরা প্রথমে নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া জেনারেল মিশন (এনইআইজি মিশন)-এর অধীনে তাদের ধর্মীয় কার্যাবলি পরিচালনা করত।
পরবর্তীতে তারা বমদের নিয়ে গঠিত ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ডিনােমিনেশন ইভ্যানজিলিক্যাল খ্রিস্টান চার্চ (ইসিসি)এর অধীনে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাদের ধর্মীয় কার্যাবলি পরিচালনা করে। পরবর্তীতে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে তারা নিজেরা ইভ্যানজেলিকাল প্রেসবিটারিয়ান চার্চ নামে নিজেদের ডিনােমিনেশন গঠন করে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে এই ডিনােমিনেশন ন্যাশনাল খ্রিস্টিয়ান ফেলােশিপ অব বাংলাদেশ-এর অ্যাফিলিয়েশন পায়।
বর্তমানে এটি ইভ্যাজেলিকাল চার্চ অব বাংলাদেশ (ইসিবি) নামে বিদ্যমান। এটি বাংলাদেশের পাংখােয়াদের সবচেয়ে বড় চার্চ ডিনােমিনেশন বলা যায়। তবে পাংখােয়াদের মধ্য থেকে কেউ-কেউ ব্যাপ্টিস্ট সংঘ, ইউনাইটেড প্যানটিকস্টাল চার্চেও সদস্য রয়েছে। পাংখােয়ারা সকলেই খ্রিস্ট ধর্ম পালন করে এবং তারা শুধুমাত্র প্রােট্যাস্ট্যান্ট মতবাদের চার্চ ডিনােমিনেশনে আছে।
পাংখোয়া ধর্মীয় উৎসব
খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী পাংখােয়ারা বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে এবং ঐ দিনে। তারা সৃষ্টিকর্তার প্রশংসামূলক বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংগীত পরিবেশন করে । দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক এসে একটি গ্রামে জড়াে হয়ে এই উৎসবগুলাে পালন করে।
বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠান (রিন মি/খিয়াম মি)
পাংখােয়ারা বিশ্বাস করে যে, মানুষ সর্বপ্রথম যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল মৃত্যুর পর সেখানেই চলে যায়। তারা বলে যে, সেটা মৃত ব্যক্তিদের দেশ। কিন্তু যদিও তারা ফিরে আসতে চায় এবং অনেক কান্নাকাটি করে তথাপি তারা যদি এই পৃথিবীতে খারাপ জীবনযাপন করে তাহলে ফিরে আসতে পারে না। তবে যদি অন্যথা হয় তাহলে ‘খােজিং’ তাদেরকে একটা নতুন দেহ দিয়ে ফেরত পাঠাতে পারে।
কেউ যদি অপরাধ করে তাহলে দা, বর্শা, বন্দুক এবং রক্তকে সাক্ষী রেখে শপথ করানাে হয়। বিশ্বাস রয়েছে যদি কেউ শপথকে অবজ্ঞা করে তাহলে সে নিজে এবং তার পরিবারের নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে। যদি গ্রামে কোনাে কিছু চুরি হয়, তাহলে চিফের (বর্তমানে হেডম্যান) বর্শাকে সাক্ষী রেখে শপথ করানাে হয়।
চিফের বর্শাটা মাটিতে বিদ্ধ করে রাখা হয় এবং যারা সেটাকে অতিক্রম করে যায় তাদেরকে সেটা স্পর্শ করতে হয়। এভাবে বর্শা স্পর্শ করে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে বলে তাকে শপথ করতে হয়। যে এভাবে শপথ করার সাহস পাবে না, যা কিছু হারিয়ে যাচ্ছে তার জন্য তাকেই জবাবদিহি করতে হয় এ ধরনের বিশ্বাসগুলাে এখনও পাংখােয়া সমাজে বিদ্যমান। নিম্নে পাংখােয়াদের বিশ্বাসের কিছু উদাহরণ দেয়া হলাে :
• থি রােয়াক (লাশ) : স্বপ্নে মানুষের লাশ দেখলে পরের দিন শিকারে গেলে শিকার মেলে।
• না চাং মিন (পাকা কলা খেলে) : স্বপ্নে পাকা কলা খেলে পরের দিন মাংস খেতে পায়।
• লু উই (পাকনা কাঁঠাল) : স্বপ্নে পাকা কাঁঠাল খেলে পরের দিন মাংস খেতে পায়।
•তুই নুট (ঘােলা পানি) : স্বপ্নে ঘােলা পানি তুললে অসুখ-বিসুখ হয়।
•বেল ইন মাখে থিলয়াক(পাতিলাতে নাড়ানি ভাঙলে) : শিকারে বের হবার আগে ভাত বা তরকারি রান্না করে নাড়ানী দিয়ে নেড়ে দেয়ার সময় ভেঙে গেলে বিপদ আসে।
• তুই থিয়াং (পরিষ্কার পানি) : স্বপ্নে পরিষ্কার পানি তুললে রােগ থেকে মুক্তি পায়।
•থাং চিম আর খােয়াং (মধ্য রাতে মােরগ ডাক) : পাড়ায় মধ্যরাতে মোরগ ডাক দিলে ধরে নেয়া হয় যে, কোনাে অবিবাহিত মহিলা পেটে অবৈধ সন্তান ধারণ করেছে।
• থাং চিম আন ভা আর চা খােয়াং (মধ্য রাতে জংলি মােরগের ডাক) : মধ্য রাতে জংলি মােরগের ডাক শুনে যদি পাড়ার মােরগ সেই ডাকে সাড়া দেয় তাহলে পাড়ায় কোনাে বড় অতিথি আসবে বা শুভ লক্ষণ।
•সাক-সাই (চাল দেখা) : কেউ যদি স্বপ্নে চাল দেখে তাহলে আয়ু বাড়ে।
•ঙা (মাছ দেখা) : কেউ যদি স্বপ্নে মাছ দেখে তাহলে টাকা পায়।
• এক মু (পায়খানা খাওয়া) : কেউ যদি স্বপ্নে মানুষের বিষ্ঠা খায় তাহলে তাজা মাংস পায় ।
• সাই (হাতি) : স্বপ্নে হাতি দেখলে কাজে সাফল্য লাভ হবে।
পাংখোয়া পূজা-পার্বণ
পাংখোয়ারা আদিকালে শৈব ধর্ম পালন করতাে। যার ফলে পূজা-পার্বণ তাদের জীবনে বেশি ছিলাে। কিন্তু কালের বিবর্তনে যে পূজাগুলাে তারা করতাে এখন আর তা করে না। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হবার পর অন্যান্য রীতি-প্রথার যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তেমনি পূজা-পার্বণেও সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন এসেছে।
যেমন : আগের দিনে যে কোনাে শুভকাজ, নতুন কাজ এবং অসুখে-বিসুখে পূজা করা হতাে। সে পর্বগুলােতে তারা এখন বাইবেল পাঠ করে প্রার্থনা করে থাকে। বর্তমানে সেই পূজাগুলাে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
পাংখােয়া সমাজে অন্যান্য সমাজের মতাে কয়েক ধরনের পূজা ছিলাে। তার মধ্যে ‘সুনথামাজির’ (Suntha Mazir) অর্থাৎ ধন-সম্পদ দেবতার পূজা হলাে সবচেয়ে বড় পূজা। আদিকালে পাংখােয়ারা নিজস্ব আয়ােজনে বিভিন্ন পার্বণ, উৎসব, উদযাপন করতাে। উল্লেখযােগ্য প্রধান প্রধান পূজা সম্পর্কে নিম্নে আলােচনা করা হলাে :
সুনথা মা-জির (Suntha Mazir) : অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ‘মানত’ করা হয়।
ডাই মাহের (Dai Maher) : নতুন বছর শুভ সূচনা এবং সারা বছর যেন ভালাে কাজের সফল কামনা করবার জন্য এ পূজা।
পাংখোয়া জাতির ভাষা ও বর্ণমালা
পাংখােয়াদের ভাষা উত্তর কুকি-চীন ভাষা পরিবারভুক্ত। কুকি-চীন ভাষায় অভিজ্ঞ আমেরিকান ভাষাবিদ ড. ডেভিড এ পিটারসন মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বম, খিয়াং, পাংখােয়া ও লুসাই আদিবাসীদের ভাষা কুকি-চীন দলভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন ভাষা।
পাংখােয়াদের নিজস্ব কোনাে বর্ণমালা নেই। তবে তারা রােমান হরফ গ্রহণ করেছে। রােমান হরফে পাংখােয়ারা লিখে থাকে। লুসাইরাও একই ধরনের বর্ণমালা ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৪ সালে লন্ডন ব্যাপ্টিস্ট মিশন এর পাদ্রি লুরিয়ান এবং সেভিজ মিজোরামে লুসাইদের প্রথমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন।
ঐ সময়ে লুরিয়ান লুসাই অভিধান লেখার জন্য লুসাই ভাষার উপযােগী রােমান হরফ প্রস্তুত করেন। বর্তমানে পাংখােয়ারা এই বর্ণমালা ব্যবহার করে। নিম্নে পাংখােয়া ভাষার রােমান বর্ণমালার উদাহরণ দেয়া হলাে :
A Aw B CH D E F G
আ অ বি চ ডি এ এফি জি
N G H I J K L M N O
এ্যাং এইচই ই জে কে এল এম এন ঔ
P R S T U V Z
পি আর এসি তি টি উ ভি জেত
(৮ = ঙ E
পাংখোয়া জাতির লােকসংস্কৃতি ও সাহিত্য
গান (লা)
জনসংখ্যায় কম হলেও পাংখােয়া সমাজে গান বাজনা পারে না এমন ছেলেমেয়ে খুব কমই দেখা যায়। গান পারে না ও গিটার বাজাতে পারে না এমন সংখ্যা পাংখােয়া সমাজে খুবই কম। কম বেশি ছােটবেলা থেকেই তাদের মুখে গান চলে আসে প্রাকৃতিকভাবে। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, এসব ব্যাপারে পাংখােয়াদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনাে প্রশিক্ষণ বা লেখাপড়াও নেই।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, পাংখােয়াদের আদি সংস্কৃতি ও আধুনিক সংস্কৃতির সংমিশ্রণের দ্বারা পাংখােয়া সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে চলেছে। আদিতে পাংখােয়াদের বিভিন্ন ধরনের গান ও নৃত্য ছিলাে কিন্তু সেগুলাে চর্চা না থাকার ফলে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ধরা যাক, আদিকালের গান এখনকার পাংখােয়া ছেলেমেয়েরা মােটেই জানে না।
সেগুলাে শুনলেও তারা মনে করবে তা অন্য জনগােষ্ঠীর গান। নৃত্যের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যেমন : লামদেব ও সালমালাম-এর মতাে গান বা নাচগুলাে কোনােটাই তাদের কাছে পরিচিত নয় । পাংখােয়াদের বিভিন্ন ধরনের উৎসবের গান রয়েছে। নিম্নে ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক গানের উদাহরণ তুলে ধরা হলাে :
সাখা লা (শিকারি নৃত্যের গান)
শিকার মিললে গানের তালে তালে শিকারের মুণ্ড/শির নিয়ে শিকারি কর্তৃক এ নৃত্য পরিবেশন করা হয়। সাখা-লা বা শিকারি নৃত্যের গান :
সা মা কা-সা মা কাসা,
হাই র পা-সা মা কা-সা;
আই রিয়াম তু মেন বেই লেই ইন,
কেই মা লৌ রিয়াম তা উ মো
তুয়ার না লিয়ানচি কেই মা-নি;
তুয়ারনা লিয়ানচি রালনা থাং নু লাই লৌ ম,
লিয়ানচি লিয়ানচি কেই মা-নি,
তুয়ারনা লিয়ানচি কেই মা-নি৷
মর্মার্থ : এসাে, এসাে, রাস্তার আশপাশে ও বন জঙ্গল ভেতরে আরাে যত শিকার (পশু) আছে এসাে… কেউ যদি তােমাদেরকে সমাদর না করে আমার কাছে এসাে।
ভার হাই লা (লােক গীত)
জুম কাটার সময় যখন কেউ একাকিত্ব বােধ করে তখন এ গানটি করে থাকে।
লেং দের লা (শােকাহতকে সান্ত্বনা)
কেউ মারা গেলে শােকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দেবার জন্য এ গানের সাথে দলগত নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
নাউ ওয়াই লা (বাচ্চা ঘুম পাড়ানাে গান)
বাচ্চাকে ঘুম পাড়াবার জন্য এ গানটি পরিবেশন করা হয়।
ব-লা (শিকারি আহ্বান)
এ গানের মাধ্যমে দূর থেকে পাড়াবাসী বা পরিবারপরিজনকে আহ্বান করা হয় যে শিকার মিলেছে।
লা লেং লং (রােমান্টিক গান)
এ ধরনের গান বিভিন্নভাবে রচনা ও সুর করা হয়। লা লেং লং বা রােমান্টিক গান :
রং খােয়াল লুং দি, কানান তং জান নেই…
মেল কিন ডু আ, নাং নিমেল কিন ডু;
নাং নি মেল তৌ পার ইন রা হােয়াই,
পারতিন রা হােয়াই, লিয়ান ডােয়াই ও এইই…
লিয়ান ভােয়াই ও চো নিল বেই কা সন,
নিল লৌ খম্ সে, কা নিল খাম চাং সে;
নি হ্রক লাই আম রেল নি জান না,
চাল ভস্ হােক লাই আন রেল ইন জান নেই…
মর্মার্থ : ‘পরদেশী অচেনা যুবকরূপে অতিথির ছদ্মবেশে আজ সন্ধ্যায় তােমার ঘরে বেড়াতে আসবাে… তুমি আমায় চিনতে পারবে তাে, রূপসী? আমাকে চিনতে পারাে, নাইবা পারাে আমার কিছুই যায় আসে না। শুধু আমি আজ তােমাকে পেতে চাই! চাই!! ফুলের মতাে সুন্দর তােমার রূপ, এই অপরূপ রূপ যেন সারাজীবন আমার হয়ে থাকে।
পাংখোয়া বাদ্যযন্ত্র (লা সাকনা মানরােয়া)
১. সিয়াল রাকি (গয়ালের শিং); ২. ডার সন (ছােট্ট পিতলের ঘণ্টা), ৩. ডার পুই (মং বা বড় ঘণ্টা), ৪. খােয়াং (গাছের তৈরি ঢােল), ৫. থেই খাং (এক কৌটা বাঁশ), ৬রুয়া খােয়াং (বাঁশের ঢােল), ৭. রুয়া টিংটাং (বাঁশের গিটার) ইত্যাদি।
নৃত্য (লাম)
•লামদেপ : এটি একটি দলীয় নৃত্য। পাংখােয়াদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এটি পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
• সালু মালাম : এটি একপ্রকার একক শিকারি নৃত্য।
• পােয়াল মা থলা লাম : রাজহংসের পাখা দিয়ে পরিবেশিত এই একক নৃত্যটি বিশেষ বিশেষ সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।
•জামা লাম : এই একক নৃত্যটি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।
•চাং রাপাল দেং : গয়েলের শিং দিয়ে পরিবেশিত একপ্রকার একক নৃত্য।
• লেংদের কাই লাম : এটি একপ্রকার দলীয় নাচ। শােকার্তকে সহমর্মিতা বা সমবেদনা জানাবার জন্য এ নাচ পরিবেশন করা হয়।
পােশাক পরিচ্ছদ (নি-পােয়ান)
পাংখােয়া নারীদের পােশাক ( নাউ নি পােয়ান) বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নিম্নে এসব পােশাকের বিবরণ দেয়া গেল :
পাংখােয়া | বাংলা |
কেং জেল ফেল করড ভম্পোয়ান ঙৌ বা পোয়ান সেনসাদা চং নাক পোয়ান | স্কার্ট (এক পার্ট নিজস্ব তৈরি) দৈর্ঘ্য-৫ প্রস্থ-৩কালাে শার্ট/টপস্লাল কাপড় বিশেষ নকশা করা কাপড় সামাজিক/ বড় ধরনের অনুষ্ঠানে পরিধান করা হয়। |
পাংখােয়া মেয়েরা কোমরের নিচে পরার জন্য নিজেদের হাতের তৈরি এক ধরনের স্কার্ট পাংখােয়া ভাষায় যাকে ‘কেংজেল ভেল’ বা এক পাট কাপড় বলে এবং দেহের উর্ধাংশে পরার জন্য ‘করড’ বা টপ ব্লাউজ ব্যবহার করে। বিশেষ দিনে সাজের জন্য সাদা কাপড় বা ‘পােয়ান ঙৌ’ পরে থাকে। পাংখােয়া মেয়েরা হাতের কাজে খুবই পারদর্শী
। ব্যবহারের সমস্ত কাপড়ই তারা নিজেরা তৈরি করে এবং কাপড়গুলােতে চমৎকার সব ফুলের নকশা বুনতে পারে। এসব ঐতিহ্যবাহী পােশাক আর পাংখােয়া সমাজে দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব কিছু পরিবর্তন করে দিয়েছে। তবে কাপড় ও টপস্ এখনও পাংখােয়া মেয়েরা পরে কিছু আধুনিকায়ন করে। বেশির ভাগ দেখা যায় সেলােয়ার কামিজ, ছেলেদের মতাে প্যান্ট ও শাড়ি।
পাংখােয়া পুরুষদের পােশাক (মি পা নি পােয়ান) :
পাংখোয়া | বাংলা |
রেন তে রেং | নেংটি (এক পার্ট কাপড় যা দীর্ঘ-৭-৮ প্রস্থ-৬) |
পােয়ান পুই | কোমর তাঁতের কাপড় নানান রঙ ও জুমের তুলা দিয়ে নিজস্ব তৈরি |
কর ড (জৌ কর ড) | ফুলহাতা জামা জুমের তুলা দিয়ে তৈরি |
ঙৌ লেপ পােয়ান | স্রেফ সাদা কাপড়, বিশেষ অনুষ্ঠান বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য। |
বিয়ার | পাগড়ি (কাজ করার সময়ের জন্য) |
কিছু কিছু জায়গায় বয়স্ক পাংখােয়াদের পােয়ান পুই ব্যবহার করতে দেখা যায় । এসব জায়গায় জিন্স প্যান্ট, টি শার্ট, নানান ধরনের আধুনিক কাপড় ব্যবহৃত হয়। কোমরের নিচে পরার জন্য ব্যবহার করা হয় ‘রেনতে রেং’ বা এক পাট কাপড়, যা লম্বায় ৩-৪ ফুট এবং প্রস্থে আধা ফুট চওড়া হয়। বিশেষ দিনে পরার জন্য ব্যবহৃত হয় ‘চং নাক পােয়ান’ বা জমকালাে পােশাক, যাতে অনেক কারুকাজ করা থাকে।
‘ঙৌ-লেপ’ বা সাদা কাপড় বর্তমানে পাংখোয়ারা আর ব্যবহার করে না।তারা বর্তমানে আধুনিক ফ্যাশন অনুযায়ী পােশাক পরে এবং অলঙ্কার ও প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে। তাছাড়া বম, লুসাই এবং পাংখােয়ারা খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ায় পজা এবং প্রসূতিকে বেশি খাওয়ানাে হয়। ভকমে বুনক-শূকরের মাংস সাথে চাল সিদ্ধ ইত্যাদি।
আন মুং (বাঁশের চোঙা দিয়ে রান্না) : এটি একটি প্রাকৃতিক রান্না । যেখানে হাঁড়ি-পাতিল নেয়া সম্ভব নয় সেখানে বাঁশ দিয়ে তরকারি রান্না করাকে ‘আন মুং’ বা বাঁশের চোঙার তরকারি রান্না বলে। এটি এক প্রকার ঐতিহ্যবাহী খাবার। এ রান্না খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
বু মুং (বাঁশ দিয়ে ভাত রান্না) : একইভাবে এটিও একটি প্রাকৃতিক রান্না । যেখানে হাঁড়ি-পাতিল নেয়া সম্ভব নয় সেখানে বাঁশ দিয়ে ভাত রান্না করাকে ‘বু মুং’ বা বাঁশের চুঙ্গার ভাত রান্না বলে। বাঁশের ভিতরে চাল দিয়ে পরিমাণ মতাে পানি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে এটি আগুনের উত্তাপ দিয়ে রান্না করতে হয়।
মে থু (পচা চর্বি) : এটি টেস্টিং সল্টের মতাে কাজ করে । এই পচা চর্বিটি স্রেফ শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি। নিয়ম হলাে, শূকর চর্বিটি পুরাতন একটি হাঁড়ির ভিতরে রাখা হয়, রাখার পর কলা পাতা দিয়ে সুন্দরভাবে পাতিলের মুখটি বন্ধ করতে হয় যাতে কোনাে বাতাস না ঢুকতে এবং বের হতে না পারে তারপরে আগুনের চুলার উপর ৪-৫ মাস রাখার পর সেটি খাওয়ার উপযােগী হয়।
বু তুই চম (পানি ভাত) : ঘরে তরিতরকারি কিছু না থাকলে পাংখােয়ারা খালি ভাত, পানি ও হালকা লবণ দিয়ে ‘বু তুই চম’ বা পানি ভাত খায়। প্রসূতিকে সন্তান প্রসবের পর পরই এ ভাত খাওয়ানাে হয় যেন পেট ঠাণ্ডা হয়।
যে কোনাে তরকারি বা তরিতরকারি সুস্বাদু করে রান্নার জন্য অবশ্যই উপকরণের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। যেমন : তেল, মরিচ, মসল্লা, হলুদ, পেঁয়াজ ও রসুন ইত্যাদি। তবে পাংখােয়ারা এসবের তেমন প্রয়ােজন বােধ করে না। কারণ তারা সিদ্ধ খাবার খেতে অভ্যস্ত। যে কোনাে তরিতরকারি সেদ্ধ বা হলুদ, তেল, মরিচ, পেঁয়াজ-রসুন ছাড়াই খেতে পছন্দ করে।
ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা (ইন লত)
পাংখােয়াদের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী অনেক খেলাধুলা। বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে এসব খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এছাড়া যে কোনাে সময় অবসর সময়েও যুবক-যুবতী ও শিশু-কিশােররা বিভিন্ন খেলা খেলে থাকে। উল্লেখযােগ্য খেলাধুলার মধ্যে হলোঃ ১. পইকা (ঘিলার খেলা), ২. সাইলেব (কাঠি খেলা), ৩তৈরি), ৬. কালচেক (বাঁশ দিয়ে হাঁটা), ৭. সােয়ান ভাল্ ইন কাই (বেতের রিং খেলা), ৮. বুজোয়াল ইনমের (বাঁশ ঘােরানাে), ৯. দার খােয়াং লাক (বড় ঘণ্টা দাঁত দিয়ে তােলা), ১০. সুং ইন পের (হাই জাম্প), ১১. সার তাং সাই লাক (গুই সাপ চাল তােলা), ১২. কর সাই লাক (বাঙালি চাল তােলা/বুকা) ইত্যাদি।
পাংখোয়া প্রথা ও রীতি
অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে পাংখােয়া সমাজেও নানা রীতিনীতি ও প্রথা বিদ্যমান রয়েছে। তার মধ্যে নিম্নলিখিত প্রথা ও রীতিসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বলা যায় :
জু (মদ) : পাংখােয়ারা মদকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে। পাংখােয়া নারীরা তাদের স্বামী বা ভাই শিকার পেলে ঘরে উঠার পর মাচাতে তােলে শিকার করা পশুর মাথায় মদ ঢেলে আশীর্বাদ করে যেন ভবিষতে আরাে অনেক শিকার পায়।
সাই মে (হাতির মাংস) : শিকারিকে সারারাত না ঘুমিয়ে হাতির মাংস খেতে খেতে রাত পার করতে হয়। তা না হলে বাঘ এসে শিকারিকে বধ করার আশঙ্কা থাকে।
কেই মে (বাঘের মাংস) : পাংখােয়ারা বাঘের মাংস খায় না। কারণ আদিকালে পাংখােয়া ও বাঘের বন্ধুত্ব ছিলাে বলে তারা বিশ্বাস করে।
ভম মি তিন (ভালুকের নখ) : পাংখােয়ারা বাচ্চা অসুস্থ হলে ভালুকের নখ সুতা গেঁথে গলায় পরিয়ে দেয়। এটি ওষুধ হিসেবে কাজ করে বলে তাদের বিশ্বাস।
উই ইন নাউতে থেন (শিশু ও কুকুর ছানা এক সাথে দোলনাতে দোলা) : শিশু ও কুকুরের ছানা এক সাথে দোলনাতে দোলা দিলে ভূত ভয়ে কাছে আসে না বলে তারা বিশ্বাস করে।
পাংখোয়া রূপকথা ও লােককাহিনী
পাংখােয়াদের অনেক রূপকথা ও লােককাহিনী রয়েছে। বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে পাংখােয়াদের এসব রূপকথা ও লােককাহিনী প্রচলিত হয়ে আসছে। বুড়াে-বুড়িরা রাতে ঘুমানাের আগে শিশু-কিশােরদের এসব রূপকথা মধুর রসে শুনিয়ে থাকে। পাংখােয়াদের রূপকথার সাথে মিশে আছে তাদের বিশ্বাস ও মূল্যবােধ। এসব রূপকথা কতক ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বান্ধব বটে । তেমনই একটি জনপ্রিয় রূপকথা হলাে ‘বাঘের সাথে বন্ধুত্ব’ (Mi in Mariampa insian thu) । সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তা তুলে ধরা হলাে :
বাঘের সাথের পাংখােয়াদের সম্পর্ক সুদূর অতীতের। বাঘকে ভয় করে না এমন মানুষ খুবই কম পাওয়ার যায়। বন থেকে বনজ সামগ্রী সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক মানুষ বাঘের হিংস্র থাবায় প্রাণ হারায়। এমন ভয়ংকর হিংস্র প্রাণীর সাথে কোনাে কোনাে আদিম জনগােষ্ঠীর পরম বন্ধুত্ব থাকতে পারে যা শুনলে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হয়।
জগতের সব পশু শিকার করা হলেও পাংখােয়াদের বেলায় বাঘ শিকার করার কোনােভাবেই সামাজিক অনুমতি নেই। এক কথায় পাংখােয়া সমাজে বাঘ শিকার করা নিষিদ্ধ। তারপরেও কোনাে পাংখােয়া যদি ভুল বশত বাঘ শিকার করে ফেলে তাহলে সে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। পাংখােয়া পূর্ব পুরুষেরা
বাঘের পরম বন্ধু হয়ে পরস্পর ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে। তাদের যে কোনাে শিকার মিললে যে কোনাে পশুর একটি উৎকৃষ্ট অংশ বন্ধুর জন্য রেখে দিত উভয়েই। বাঘ তার মানব বন্ধুর ভাগটা পৌছে দিত ঘরের দুয়ারে দুয়ারে। বন্ধু রেখে আসত জঙ্গলে গাছের নিচু ঢালে বা বাঘ চলাচলের পথের ধারে।
পাংখােয়াদের কাছে বাঘ হচ্ছে তাদের প্রধান দেবতা খােজিং এর বাড়ির পালিত কুকুর স্বরূপ । তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে খােজিং এর আশীর্বাদ পেয়ে তাদের মধ্যে কিছু মানুষ যাদুমন্ত্রের প্রভাবে দৈব শক্তির অধিকারী হয়। পাংখােয়া ভাষায় তাদের বলা হয় কোয়াভাং বা সিদ্ধি পুরুষ।
পাংখােয়ারা বিশ্বাস করে কোয়াভাং হচ্ছে করলে বাঘের স্বরূপ ধারণ করতে পারে। এসব কারণে পাংখােয়ারা বাঘের মাংস খায় না। পাংখােয়াদের মধ্যে সাকং গােত্রের কোনাে ব্যক্তি মারা গেলে মৃত ব্যক্তির কবরের আশপাশে বাঘ আসে শােক জানাতে। ভালাে করে লক্ষ করলে কবরের আশপাশে বাঘের পায়ের চিহ্ন দেখা যায় বলে তারা বিশ্বাস করে।
বাঘ নাকি প্রতিদিন ভাের বেলায় সূর্যোদয়ের সময় প্রণাম করত শিকারের সময় তার মানব বন্ধুর সাথে যেন দেখা না হয়। বাঘ সূর্যের কাছে আরাে প্রার্থনা করত এই আজ সারাদিন হিংসাত্মক মনে বন্ধুর সাথে যেন মুখােমুখি না হই। সে পাহাড়ে গেলে আমি যেন ঝরনা বা ছড়াতে থাকি।
সে ছড়াতে গেলে আমি যেন পাহাড়ে যাই। তারপরেও হঠাৎ করে শিকারের মুহূর্তে দেখা হলে যে কোনাে পাংখােয়া ‘মারিয়াম-পালামপুই হং কিয়ান র’ বা সুপ্রিয় বন্ধু যাওয়ার জন্য আমাকে রাস্তা দাও- সরে যাও। একথা বললে বাঘ সরে যায় আপন মনে। এই সত্য প্রমাণ আজও পাংখােয়াদের মনে আছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, এমন হিংস্র পশু কেমন করে পথিকের কথা শুনে সরে যায়? অবিশ্বাস করার কিছুই নেই, এখনও এরকম কথা বলে বাঘকে সরিয়ে দিয়েছে,এমন লােক পাংখােংয়া সমাজে খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রবাদ প্রবচন
পাংখােয়া ভাষায় প্রবাদ প্রবচন হলাে ‘থু ফিং’ বা পণ্ডিতদের কথা । পাংখােয়াদের প্রবাদ প্রবচন কিভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা জানা যায় না। তবে বেশির ভাগ প্রবাদ প্রবচনের প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ততা বা মিল খুজে পাওয়া যায়। নিম্নে পাংখােয়াদের কয়েকটি প্রবাদ দেয়া গেল ।
পাংখােয়া : তুই রাখুপ রি খাম চি র মি পা নাউ চি র
বাংলা : হাঁটু পর্যন্ত পানি ও বালককেও ভয় করাে অর্থাৎ পানি ও পুরুষ জাতকে উপেক্ষা করতে নেই।
পাংখােয়া : মিতদেল মু লেম না সেত মু লেম
বাংলা : অন্ধ ও বধির যেমন যে কোনাে কাজ একবার করে বার বার সেদিকে নজর দেয় একটি কাজ বারবার করা ।
পাংখোয়া : মা হই ইন সর সাখি রা ঙাল মে বেই অ কাং
বাংলা : হরিণের পায়ে যেমন মাংস নাই অনুরূপ নিজের প্রশংসা করাও অনুচিত।
পাংখােয়া : জং তুই খুর মু চিয়া
বাংলা : বানর ঝরনা দেখার মতাে অর্থাৎ একই কাজে বারে বারে তাগিদ দেয়া।
পাংখােয়া : তুই মা-কা সিপ
বাংলা : মুখে পানি ভরা অর্থাৎ নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা।
পাংখােয়া : বুই বুম আমা হই আন্ ন অ কাং
বাংলা : বাঁশের ইঁদুর মাটি খুঁড়ে নিজের পথ বন্ধ করে রাখে অর্থাৎ নিজের দোষে শাস্তি পাওয়া।
পাংখােয়া : রামু রাং সুং হ্লাং ভে বের পৌ রাং ভের সিন।
বাংলা : যখন ঈগলে রাগ তুলে তখন বুলবুলিও রাগ দেখায় অর্থাৎ খারাপ দিন আসলে সব দিকে আসে।
পাংখােয়া : লম এক হ্লাউ
বাংলা : একের দোষে সবাইকে দোষের ভাগিদার হতে হয় অর্থাৎ দলের মধ্যে একজন প্রাকৃতিক দুর্গন্ধ ছাড়ে ঐ দলের সকলেরই দুর্নাম হয় ।
পাংখােয়া : কপ সা-দাক বিয়াং ল
বাংলা : সুবিধাবাদী
পাংখােয়া : মি সিক তুয়া মাং
বাংলা : প্ররােচণাকারী।
সংস্কার
লাউ, শশা, মিষ্টি কুমড়া ও চাল কুমড়া বা লতা জাতীয় ফল গর্ভবতী অবস্থায় খাওয়া যাবে না। কারণ বাচ্চা যদি পুত্র সন্তান হয় বড় হয়ে শিকার করার সময় তার পায়ে লতা প্যাচাবে। এই ভয়ে পাংখােয়া গর্ভবরা কোনাে লতা জাতীয় ফল খায় না ।
মা গর্ভকালীন অবস্থায় বেগুন তরকারি খেতে মানা করা হয়। কারণ যদি বেগুন খায় তাহলে বাচ্চাটির মুখে দাগ হয়। আনারস ও খেতে দেয়া হয় না আনারসের মতাে চুল কুঁকড়াবে বলে। কলার গুর গর্ভবতী মাকে খেতে দেয়া হয় না । কলার থুর খাওয়ালে বাচ্চাটি মাথা লম্বা হয় এবং ডিম ও খেতে দেয়া হয় না কারণ এতে বাচ্চার মাথা গােল হয়। তবে এই বিশ্বাসগুলাে আর নেই বললেই চলে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী ছাড়া এসব আর বিশ্বাস করে না।
শিক্ষার অবস্থা
পার্বত্যাঞ্চলে পাংখােয়াদের শিক্ষার অবস্থা খুবই নাজুক। পাংখােয়াদের শিক্ষার অবস্থা জানতে গিয়ে বিভিন্ন পাংখােয়া বসতি এলাকার প্রতিনিধির মাধ্যমে নিম্নে উল্লেখিত পাড়াগুলােতে থেকে তথ্য নেয়া হয়, যেমন : বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের নিউ লংকর, ওল্ড লংকর, মামােয়াম বা কংলাক, বিলাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত বিলাইছড়ি ও ফারুয়া ইউনিয়ন, পাংখােয়া পাড়া, নিউ জৌদিন বা লতা পাহাড়, মডেল খােয়া বা যমুনাছড়ি, নিউ হ্লাং পুই বা ঝান্দি মুইন পাড়া, বরকল উপজেলার বড় হরিণা ইউনিয়নের লাইজৌ পাড়া এবং সাইচাল পাড়া ইত্যাদি।
এসব পাড়া থেকে তথ্য নিয়ে এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, পাংখােয়াদের মধ্যে মাত্র ৪ জন বিএ, ১৪ জন এইচএসসি এবং ২৯ জন এসএসসি পাশ পুরুষ/মহিলা আছে। এ যাবৎ বাংলাদেশে পাংখােয়াদের মধ্যে থেকে একজনও মাস্টার ডিগ্রি পাওয়া লােকেরও খোঁজ মেলেনি। এর মাধ্যমে পাংখােয়ারা শিক্ষায় কত পিছিয়ে আছে তার স্পষ্ট ধারণা মেলে।
তাছাড়া বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইনঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে, কৃষি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এমন একজনও নেই এবং ভবিষ্যতে পড়বে এধরনের কোনাে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। পাংখােয়াদের শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে।
প্রথমত, ভাষাগত সমস্যা। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মতাে ছােট বেলা থেকে বাংলা ভাষা চর্চা করার সুযােগ পায় না। আর পাংখােয়া ভাষা বাংলা ভাষা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাছাড়া তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, জীবন-যাত্রা এবং সমাজ ব্যবস্থা অন্যান্য জনগােষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা।
পাংখােয়ারা বাংলা ভাষা ভালাে বুঝতে পারে না বিধায় অনেক ছেলেমেয়ে এসএসসি পাশ করতে না পেরে ঝরে যায়। পাংখােয়া পাড়াগুলােতে দেখা যায় যে, কয়েক বার পরীক্ষা দিয়েও এসএসসিতে খারাপ করেছে এমনও নজির রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সুযােগের অভাব। সাধারণত পাংখােয়ারা উঁচু পাহাড়, গভীর জঙ্গল অথবা যেখানে অন্য কোনাে লােকালয় নেই সেসব জায়গাগুলােতে তারা বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করে। এমন দুর্গম জায়গা থেকে এসে উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেকটা অসম্ভব। যার ফলে কোনাে রকমে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর অধিকাংশ ছেলেমেয়ে লেখাপড়া থেকে অবসর নিতে বাধ্য হয়।
তৃতীয়ত হচ্ছে দারিদ্র। পার্বত্য অঞ্চলে পাংখােয়াদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অন্যান্য জনগােষ্ঠীর চেয়ে শােচনীয়। কারণ হলাে : শুধু জুম চাষ এবং শিকার ছাড়া অন্য কোনাে পেশা তাদের জানা নাই । বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের আধুনিক যন্ত্রপাতি অধিক ফলনের জন্য সার বা অন্যান্য জিনিসের ব্যবহার তাদের জানা নেই বললেই চলে।
এসব কারণে পাংখােয়ারা এখনও আর্থিকভাবে খুবই দুর্বল। এসব কারণেই কোনাে ছেলেমেয়ে ম্যাট্রিক, আইএ পাশ করার পরেও উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। পাংখােয়াদের শিক্ষায় উন্নত করতে হলে প্রয়ােজন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপােষকতা ।
পাংখোয়া নারীর অবস্থা
সামাজিকভাবে পাংখােয়া নারীরা স্বাধীন বলা যায়। কোনােভাবে ধরাবাঁধা বা কঠোরভাবে নিয়ম-কানুন মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই। স্বাধীনভাবে চলাফেরা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে কোনাে সমস্যা দেখা যায় না। পাংখােয়াদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক যার ফলে সেখানে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলাে পুরুষরাই দিয়ে থাকে।
কাজের ক্ষেত্রে পাংখােয়া নারীরা পুরুষদের চাইতে কোনাে অংশে কম নয়। দৈনন্দিনের খাবার জোগার হতে শুরু করে জুম চাষ করা পর্যন্ত তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। অন্যান্য আদিবাসীর মতাে বরাবরই তারা পুরুষদের চেয়ে কর্মঠ। এবং বিভিন্ন কাজে পারদর্শী।
যেমন : কোমর তাঁতের কাজে বিভিন্ন রকমের নকশা দিয়ে ফুল তৈরি এবং শৈল্পিক কাজে দক্ষতা আছে। অন্যান্য জনগােষ্ঠীর তুলনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাংখােয়া নারীদের তাদের পরিবারে সমান দৃষ্টিতে দেখা হয় । উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, নতুন বৌ বিয়ের দিনে তার প্রথম স্বামীর ঘরে প্রবেশের সময় শাশুড়ি হিসেবে প্রথম সম্বােধন করে এক গ্লাস মদ (আদিকালে) অবশ্যই শ্বশুরের পাশাপাশি শাশুড়িকেও দিতে হবে।
পাংখােয়া সমাজে ‘ইনকাই’ ও ‘মান’ প্রদানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামী হতে ভরণপােষণের অধিকারী হয়।একজন পাংখোয়া নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্বউপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে।
বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনাে সম্পত্তির উপর আইনত নিরংকুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। বিবাহের পর একজন নারী স্বামীর পরিবারের পদবি ও মর্যাদার অধিকারী হয়। তবে ‘লাল’ বা ‘কার্বারী’ পদবির অধিকারী হয় না। বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপােষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা লাল-কার্বারী-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে।
পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংসক হলে অথবা দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা লাল-কার্বারী-হেডম্যান আদালতের মাধ্যমে পৃথকভাবে বসবাসের (ইনসেন) অধিকারী হয়।
পাংখােয়া সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য দেখা যায়। মেয়েসন্তানের তুলনায় ছেলেসন্তানের অনেক গুরুত্ব বা প্রাধান্য থাকে। কেননা ছেলেসন্তান হলে শিকার করতে পারবে, মা-বাবাকে লালন পালন করতে পারবে এবং বংশ ধরে রাখতে পারবে বলে ছেলে সন্তান হলে অভিভাবকেরা খুশি হয় বেশি।
নারীরা বৈষম্যের স্বীকার হয় বিভিন্নভাবে খাবার বেলায়, খেলাধুলায়, লেখাপড়ার সুযােগ দানের ক্ষেত্রে এবং একই কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক পাওয়ার ক্ষেত্রে ইত্যাদি।
পাংখােয়া নারীরা খােলামেলাভাবে চলাফেরা করলেও তাদের উপর নির্যাতন বা সহিংসতা তেমন দেখা যায় না। একথাও সত্য যে, এখনও পাংখােয়া নারীরা নির্যাতিত হবার মতাে স্থানে আসার সুযােগও পায় নাই। আদিম যুগের বিশ্বাসে আপন ভুবনে এখনও পাংখােয়া নারীরা পড়ে আছে সেই গহীন জঙ্গলে।
তাদের প্রতিদিনের কাজ হলাে ভাের বেলা ঘুম থেকে উঠে জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করা, তরিতরকারি সংগ্রহ করা, ঝরনা থেকে পানি তােলা এবং ঘরে গৃহপালিত পশু বা শূকর দেখাশােনা করা।
এ যাবৎ পাংখােয়া নারীদের উপর বড় ধরনের সহিংসতার খবর জানা যায়নি। তবে তারাও আশঙ্কা মুক্ত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে মাত্রায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়া হয় তাতে কোনাে আদিবাসী নারীই সহিংসতা থেকে নিরাপদ নয়।
পাংখােয়া সমাজে প্রথাগত সামাজিক আইন লিখিত আকারে নেই ।সুতরাং নারী-পুরুষের সম্পত্তি ভাগাভাগির বিষয়টির ক্ষেত্রে কোনােভাবে এ যাবৎ কোন কাজ সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই।
তবে পাংখােয়া সমাজে এই প্রথা প্রচলন আছে যে,পিতা/অভিভাবকের সম্পত্তি প্রধানত কনিষ্ঠ পুত্র সন্তানকেই দেয়ার রীতি আছে। কারণ কথায় আছে যে, ‘পা ইন রা তুং মা তুক তু’ অর্থাৎ পিতার গড়া/স্থাপন করা কুঠির ধারক নামে কনিষ্ঠ পুত্র সন্তানকে অভিহিত করা হয়। তাই এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যক্তির উপরে নির্ভর করা হচ্ছে।
যদি অভিভাবকের মর্জি হয় যে, তার সন্তানদেরকে তার সম্পত্তি সবাই সমান করে ভাগাভাগি করে দিতে পারে। এ কথাও সত্যি যে, এ যাবৎ পাংখােয়া সমাজে এমন বিত্তবান পাংখােয়া পরিবার নাই যে, তার সম্পদ ভাগাভাগি করার ব্যবস্থা করার প্রয়ােজন রয়েছে ।
পাংখোয়া রাজনৈতিক সংগঠন
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি ও দেশের জাতীয় রাজনীতিতে পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর লােকজনের সম্পৃক্ততা চোখে পড়ে না। শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের কারণে মূলত রাজনীতির অঙ্গনে তাদের উল্লেখযােগ্য সম্পৃক্ততা অনুপস্থিত বলে অনেকে মনে করেন। তবে স্থানীয় সরকারের নিম্ন স্তর ইউনিয়ন পরিষদে তাদের কিছু কিছু অংশগ্রহণ রয়েছে।
১৯৮৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন এর বদৌলতে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলার সকল আদিবাসী জনগােষ্ঠীর এই বিশেষ শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের সুযােগ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে এই বিশেষ শাসন কাঠামাে পরিবর্তিত হয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ নামে প্রবর্তিত হয়।
এই পার্বত্য জেলা পরিষদগুলাের মধ্যে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে আইন অনুযায়ী পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর জন্য একটি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমানে এই পরিষদসমূহ মনোনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে আসন সংরক্ষিত থাকলেও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে পাংখােয়া জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব অনুপস্থিত রয়েছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে খুমী, লুসাই, বম, পাংখাে, চাক ও খিয়াং এই ৬টি জনগােষ্ঠীর একটি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। তবে ৬টি একত্রে মাত্র একটি সদস্যপদ সংরক্ষণ করার ফলে পাংখােয়া প্রতিনিধিত্ব যথার্থভাবে হবে না বলে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন।
লেখকঃ লাল চুয়াক লিয়ামা পাংখো
আরও পড়ুন – মারমা জাতির আদ্যোপান্ত
টীকা
৫৯.পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতি ও সংস্কৃতি। পৃ. ১৫৮
৬০.রাঙামাটি বৈচিত্র্যের ঐকতান-পৃ. ৪৮
৬১। পাংখোয়াদের খ্রিস্টীয়ান হওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-স্যামসন পণ্ডিত, আর্টিকেল
৬২। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আদিম জনগােষ্ঠী পৃষ্ঠা- ১৩৪, ১৩৫
তথ্যসূত্র
১।সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৪।
২। ড. জাফর আহমেদ খান (সম্পাদনা), রাঙামাটি বৈচিত্রের ঐকতান, জেলা প্রশাসন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, এপ্রিল ২০০৪
৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় উৎসব ও বিবাহ, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট,রাঙ্গামাটি
৪. বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূবাঞ্চলের আদিম জনগােষ্ঠী, ক্যাপ্টেইন টি. এইচ. লুইন
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম পাংখােয়া কথা ও সাহিত্য, শাওন ফরিদ ৬. পাংখােয়াদের খ্রীষ্টিয়ান হওয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, স্যামসন পণ্ডিত
৭. পাংখােয়া, হাফিজ রশিদ খান, আদিবাসী জনগােষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০০৭।
৮. পাংখােয়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, কপাে সেবা সংঘ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন,সেপ্টেম্বর ২০০৭
9. Muhammad Ishaq (editor), Bangladesh Disrict Gazetteers, Chittagong Hill Tracts, Ministry of Cabinet Affairs, Establishment Division,Government of Bangladesh, Dacca, 1971
10. Mapping-Chittagong Hill Tracts Census Indicators 2001 & Trends
(Bangladesh), Geographical Information System (GIS) Unit, Local Government Engineering Department (LGED), Bangladesh, 2005
১১. এডভােকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভােকেট প্রতিম রায়, সাংবাদিক শৈলেন যে,পাংখােয়া ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, কপাে সেবা সংঘ, আদালত সড়ক, বনরূপা, রাঙ্গামাটি, সেপ্টেম্বর ২০০৭।
১২। মি. লিয়ান জলা পাংখােয়া, পাংখােয়া পাড়া, বিলাইছড়ি উপজেলা, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার
১৩। মি. সন লাইয়া পাংখােয়া, পাংখােয়া পাড়া, বিলাইছড়ি উপজেলা, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার
১৪।মি. সুমখামা, পাংখােয়া পাড়া, বিলাইছড়ি উপজেলা, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার
১৫। মি. রুয়ালখামা, পাংখােয়া, পাংখােয়া পাড়া, বিলাইছড়ি উপজেলা, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার
১৬। মি. এল, ঙ্গাক থাংয়া পাংখােয়া, সাজেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, বাঘাইছড়ি পাংখােয়া পাড়া, বিলাইছড়ি উপজেলা, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।