পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি : আগে পরের কথা
886
১. প্রাককথন :
২ডিসেম্বর পাবর্ত্য শান্তিচুক্তি দিবস। ১৯৯৭ সালের এদিন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি উচু ভূমি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। দেশের সবচেয়ে উচুঁ পাহাড়ি চড়াটিও পার্বত্য চট্টগ্রামে। এর নাম তাংজিংডং বা বিজয়। পাহাড়, পর্বত, বনজঙ্গল, নদী নালায় ঘেরা সুন্দর পাহাড়ি ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায়।
মােট জমির পরিমাণ ৭৭ হাজার একর। গাছপালা ও সবজি চাষের এলাকা হলাে মােট ভূমির প্রায় ২১ ভাগ। মােট জমির ২৬ ভাগ অর্থাৎ ৮ লাখ একর জমি জুড়ে আছে সরকারের রিজার্ভ ফরেস্ট। এসব জমি বাদ দিয়ে মােট জমির অর্ধেকেরও বেশি বনাঞ্চল।
১৯৯৫ সালের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের লােকসংখ্যা প্রায় ১১ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ আদিবাসী পাহাড়ি। বর্তমানে এই সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই অনেক বেড়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়ীদের মধ্যে ১১টি জাতিসত্তার লােক বসবাস করে। এরা হচ্ছে- বম, চাক, চাকমা, কুকি, খিয়াং, লুসাই, মারমা, ম্রো, পাংখােয়া, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা। জনসংখ্যার দিক থেকে চাকমারা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরপর মারমা এবং ত্রিপুরা।।
২. পার্বত্য চট্টগ্রামের পিছনের কথা :
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেকদিনের পুরনাে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এখানকার মানুষ ও সম্পদ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ কারণে নানাভাবে এই অঞ্চলের শাসনভার হাত বদল হয়।
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ছােট ছােট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এবং এ সময় চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি অনেক অঞ্চল জয় করে পার্বত্য রাজ্য গঠন করেন। তিনি রাঙামাটিকে এ রাজ্যের রাজধানী করেন।
এরপর কিছুদিন আরাকান এবং মগ রাজারা পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন করে। ১৯৬৬ সাল থেকে প্রায় একশত বছর ছিল মােগলের অধীনে। এ সময় মােগলদের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজার সম্পর্ক মােটামুটি ভালাে ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ইংরেজদের দখলে যায় ১৭৬০ সালে। এরপর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকসহ নানা। কারণে ইংরেজদের সঙ্গে পাহাড়ি আদিবাসীদের মােট পাঁচবার যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম চাকমা রাজার অধীনে ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৮৬০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলারই একটি অংশ ছিল। ইংরেজ সরকারই নিজেদের শাসনের সুবিধার্থে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক করে ‘পাহাড় তত্ত্বাবধায়ক’ নামে একজন রাজকর্মচারিরা। অধীনে নিয়ে আসে। সাত বছর পর কাজের দায়িত্ব বাড়িয়ে এ পদের নাম ডেপটি কমিশনার রাখা হয়।
ইংরেজ রাজশক্তি এ সময় বস্তুত আদিবাসাদের একতায় ভাত হয়ে এদের করতে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৮৮১ সালে অভিভাত রাজ্যকে চাকমা সার্কেল, বােমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল নামে তিন ভাগে বিভক্ত করে।
এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি মৌজায় বিভক্ত করা হয়। মােজা প্রধানকে হেডম্যান উপাধি দেওয়া হয়। ইংরেজ সরকারই প্রথম এখানে বসতির ব্যাপারে আইন জারি করে। এই আইন অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারের অনুমতিপত্র ছাড়া কোনাে অপাহাড়ি সেখানে ঢুকতে পারবে না বা বসতি গড়তে পারবে না।
বিতর্কিত উপায়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ফলে দেশটিতে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকায় যেমন বাঙালিদের অধিকার রক্ষা হয়নি, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের প্রতিও উদাসীন ছিল।
পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে এক নির্দেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের পুলিশ বাহিনী তুলে নেয়। ১৯৫০ সাল থেকে নানিয়ারছড়, লংগদু, তবলছড়ি, বেলছড়ি, আলিকদম, লামা ও নাইক্ষংছড়িতে বাঙালি পুনর্বাসন শুরু হয়। এ সময় পরিকল্পিতভাবে এখানে বাঙালি সরকারি কর্মচারি, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়ানাে হয়।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। ১৯৬৩ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫০ বর্গমাইল এলাকা পানির নিচে চলে যায়।
১০ হাজার পরিবারকে স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা হয়। এছাড়াও ১ লাখ লােক জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এমনকী চাকমা রাজার আদি বাড়িও পানির নিচে তলিয়ে যায়।
এর ফলে পাহাড়িদের যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল, তার শতকরা ছয় ভাগও তাদের হাতে পৌছেনি। নানাভাবে ওই অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এই ভয়াবহ ক্ষতিতে দিশেহারা হাজার হাজার জুম্ম জনগােষ্ঠী ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সেই বঞ্চনার ইতিহাস বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও শেষ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশের কোনাে সরকারই আদিবাসীসহ সংখ্যালঘুদের দুঃখ, কষ্ট আমলে নেয়নি।
৩. মুক্তিসংগ্রাম পরবর্তী জাতিগত পরিচয়ে বিভ্রান্তি :
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ঐতিহাসিক বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধু সরকার আদিবাসী পাহাড়িদের জুম কর কমায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্রদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসন সংরক্ষণ করে।
রেডিওতে পার্বত্যবাসীদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা নেয়। বাংলা একাডেমা আদিবাসী গল্প, কবিতা, ছড়া, লােকগাথা ইত্যাদি প্রকাশ করে। কিন্তু এত কিছুর পরও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে।
তারা চেয়েছিল নিজস্ব জাতিগত পরিচিতি, যেমন বাঙালি চেয়েছিল ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৭২ সালের বহুল নন্দিত সংবিধানে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, দেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’
আপত্তিটা এখানেই একজন চাকমা, একজন মারমা, একজন গারাে, একজন সাঁওতালকে…এমনকি বাংলাদেশের ৫০টি আদিবাসী জাতিসত্তার লােক সকলকে বাঙালি হিসেবেই পরিচিত হতে হবে।
এটা তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। এ কারণে জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মানবেন্দ্র লারমা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পীকার সাহেব এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল, সংবিধান বিলে আছে, “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।”
এর সঙ্গে সুস্পষ্ট করে বাংলাদেশের নাগরিকগণকে বাঙ্গালী বলে পরিচিত করা জন্য জনাব আবদুর রাজ্জাক ভুইয়ার প্রস্তাবে আমার একটু আপত্তি আছে যে, বাংলাদেশের। নাগরিকত্বের যে সংজ্ঞা তাতে করে ভালােভাবে বিবেচনা করে তা যথােপযুক্ত করে গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করি।
আমি যে স্থান থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা যুগ যুগ। ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষার বাঙ্গালীদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। সব দিক দিয়ে আমরা এক সঙ্গে একযােগে। বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ …কেউ। বলেন নাই, আমি বাঙ্গালী।
আমার সদস্য সদস্যা ভাইবােনদের কাছে আমার আবেদন, আমি। জানি না, আজ আমাদের সংবিধান আমাদেরকে কেন বাঙ্গালী বলে পরিচিত করতে চায়…।’
৪. জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই :
পাহাড়ি আদিবাসী জনগােষ্ঠী নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ আত্মপ্রকাশ করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের নেতৃত্বে এ ধরনের একটি সংগঠন ছিল। ‘শান্তি বাহিনী’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারি।
১৯৭৩-৭৪ সাল ছিল শান্তিবাহিনীর সদস্য সংগ্রহের সময়কাল। এ সময় হাজার হাজার পাহাড়ি যুবক শান্তিবাহিনীতে ভর্তি হয়। এছাড়া গ্রামে সহযােগী মিলিশিয়াদেরও ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়।
সামাজিক অনাচার, অত্যাচার, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের উপযুক্ত প্রতিকার ও ন্যায়বিচার তারা পায়নি। ফলে হতাশাগ্রস্ত পাহাড়ি জনগােষ্ঠী নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ পরিহার করে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরে। সে এক রক্তাক্ত, ভয়াবহ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি।
৫. সামরিক নির্যাতন :
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলে। এ সময় জনসংহতি পরিষদের নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা। (সন্তু লারমা) আত্মগােপন করেন।
জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য উন্নয়ন বাের্ড গঠন করেন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মনজুরকে পার্বত্য উন্নয়ন বাের্ডের চেয়ারম্যান নিয়ােগ দেওয়া হয়।
মেজর মনজুর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি পুনর্বাসনের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। সে অনুযায়ী বাঙালিদের পাহাড়ি এলাকায় পুনর্বাসন এবং মৌলিক অধিকার মেটানাের লক্ষ্যে সরকারি ঋণের ব্যবস্থা করা হয়।
পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রতি এ সময় অবিচার, অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। তৎকালীন সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রতি মনােভাব ছিল খুবই খারাপ। তকালীন এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মনজুর নাকি প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন, ‘আমরা তে তােমাদের যেখানে খুশি যেতে পার। আমরা শুধু তােমাদের এলাকা চাই।’
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উল্লেখিত মনােভাবের প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ। ঐদিন একটি বৌদ্ধ মন্দিরে চাকমাদের সভা চলাকালীন সময়ে গুলি চালিত পাহাড়ি আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে সেদিনের গণহত্যা ‘কলমপতি গণহত্যা’ নামে কালাে অক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে।
এর প্রতিবাদে তৎকালীন সাংসদ উপেন্দ্রলাল চাকমা একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। উল্লেখ্য, এই সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীণ সাংসদ বর্তমান বিএনপি দল নেতা শাহাজাহান সিরাজ এবং সাংসদ রাশেদ খান মেনন উপস্থিত ছিলেন। এই তিন সাংসদই সেদিন সংবাদ সম্মেলনে অবিলম্বে বাংলাদেশের পাহাড়ি আদিবাসীদের স্বায়ত্তশাসনের জানিয়েছিলেন।
তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং বাঙালি বসতি স্থাপন বন্ধের দাবি জানান। জেনারেল জিয়ার সরকার গণদাবীর মুখে এ গণহত্যার সামান্য নিন্দা জানালেও এ সময় ‘সমস্যা বিক্ষুব্ধ অঞ্চল’ নামে একটি বিল জাতীয় সংসদে পাশ করে।
নতুন আইনে চট্টগ্রামের পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর ও নন কমিশন সেনা কর্মকর্তাদের অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়। ঐ আইনে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গুলি এবং তাদের বাড়িঘর তল্লাশি করার অধিকার দেওয়া হয়। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী এবং অন্যদের অত্যাচার আরও বেড়ে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর হাতেই লােদাং গ্রামে (চাকমা পল্লী) আরও ৩০০ জন এবং একই বছরের ১৭ এপ্রিল নানিয়ারচর গ্রামে ৯০ জন আদিবাসী নিহত হয়।
এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১ বছরে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি আদিবাসী প্রাণ হারায়। সামরিক খাতে এজন্য ব্যয় হয়েছে ১০৬ কোটি টাকা। ২১ বছরে পাহাড়ি জনগণ অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছে যে, সেখানে থানার সংখ্যা বেড়েছে, ক্যান্টনমেন্ট বড় হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি শিক্ষার সুযােগ। লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া।
সবকিছুকে সামরিক বাহিনীর অধীনে নিয়ে আসা হয়। একাত্তরের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতাে বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাবাহিনীও আনন্দ-ফুর্তি করে আদিবাসী পাহাড়িদের বসত-বাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে।
প্রকৃত ব্যাপার হলাে তখন একটি বিশেষ মহলের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে তৎকালীন সেনাবাহিনীকে পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। এ কারণেই তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি ১৫ জন আদিবাসীর জন্য একজন সামরিক বাহিনীর লােক নিয়ােগ দেওয়া হয়।
৫. সরকারি উদ্যোগ :
শান্তিবাহিনীর সঙ্গে জেনারেল জিয়ার প্রথম বৈঠক বসে ১৯৮০ সালে। এ সভায় শান্তিবাহিনীর নেতারা ১২ দফা দাবি পেশ করে। অবৈধ দখলদারের কাছ থেকে জমি উদ্ধার এবং শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
ভূমি বিষয়ক প্রচলিত আইন বহাল রাখতে হবে। রিজার্ভ ফরেস্টের চাষযােগ্য জমি আদিবাসীদের ফেরত দিতে হবে। স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী কৃষি ঋণ, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, শিক্ষার সুবিধা বাড়াতে হবে। রাস্তাঘাট মেরামত এবং বৃদ্ধি করতে হবে। জেনারেল জিয়া এসব বিষয়ে আশ্বাস দিলেও কোনাে উদ্যোগই গ্রহণ করেননি।
তবে এ সময় লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সাক্ষাঙ্কারে জেনারেল জিয়া স্বীকার করেছেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের কিছু ভলক্রটি হচ্ছে। উপজাতীয়দের প্রতি আমরা অবিচার করছি। একটি রাজনৈতিক সংকটে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে মােকাবিলা করা হচ্ছে। তবে এখনও খুব সহজেই এর রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। আমাদের পক্ষে এসব এলাকা দখলের এবং উপজাতীয় জনগণকে একদিকে ঠেলে দেওয়ার কোনাে যুক্তি নেই। আমরা অন্তত উপজাতীয় নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক ডাকতে পারি, তাদের দাবিগুলাে জানতে পারি।’
কিন্তু ঐ পর্যন্ত। তারপর আর কোনাে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
জেনারেল জিয়ার হত্যাকান্ডের পর প্রেসিডেন্ট সাত্তার জুম্ম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু তিনি আদিবাসীদের সমস্যা সমাধানে বেশি অগ্রসর হতে পারেননি।
জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্কট সমাধানের লক্ষ্যে তিনি কয়েকটি চুক্তির প্রস্তাবও দেন।
এ সময় এরশাদের পক্ষে অনেকেই শান্তিবাহিনীর সঙ্গে বহু বৈঠক করেন এবং সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। কিন্তু কোনাে উদ্যোগই সফল হয়নি। উল্লেখ্য, এরশাদ সরকারের আমলে জন সংহতি সমিতির সঙ্গে সর্বমােট ৬টি বৈঠক কোনাে ধরনের সমাধান ছাড়াই শেষ হয়।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ৫০ হাজার পাহাড়ি শরণার্থী ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৯১ সালে তৎকালীন সরকার উদ্যোগ নেয়। ঐ সময় একদল সরকারি কর্মকর্তা আদিবাসী নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে যান। তারা সেখানে একটি সভা করে শরণার্থীদের ফিরে আসার আবেদন জানান।
কিন্তু শরণার্থীরা কয়েকটি দাবি মানা ব্যতীত ফিরে আসতে রাজি ছিল না। দাবিগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, বেদখল জমি ফেরত দেওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ইত্যাদি।
এরশাদ এসব দাবির ব্যাপারে কোনাে ইতিবাচক সাড়া প্রদানে ব্যর্থ হয়। পরে আবার হংসধ্বজ চাকমাকে আহবায়ক করে শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আর একটি যােগাযােগ কমিটি গঠন করেন।
এরশাদের পরে গণআন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি ক্ষমতায় আসলেও এ ব্যাপারে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি আদিবাসী জনগােষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের ওয়াদা করে। তাই ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যেই আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে প্রধান করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। কমিটিতে আওয়ামী লীগ, বি,এন,পি, জাতীয় পার্টির সদস্যদেরও অন্তর্ভূক্ত করা হয়। কিন্তু বি.এন.পি.র দু’জন সদস্য এ কমিটির কোনাে কাজেই শেষ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেনি।
এ কমিটি সর্বমােট সাতবার জন সংহতি সমিতির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের ৩০ নভেম্বর রাত ১ টা ২০ মিনিটে সমাপ্ত বৈঠকে উভয়পক্ষ শান্তিচুক্তির সকল বিষয়ে একমত হয়।
এরই আলােকে ২ ডিসেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ, সংসদ সদস্য, কূটনীতিক, সামার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। রাষ্ট্রের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের পক্ষে জন সংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) সম্পাদিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
৬. শেষ কথা :
বিশাল একটি স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে সম্পাদিত হয়েছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তি। স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয়ে গঠিত হয় আঞ্চলিক পরিষদ। এ পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আদিবাসীদের প্রাণের মানুষ জন সংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।
চেয়ারম্যানকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। এছাড়াও আছে ২১ সদস্য। এর মধ্যে ৩ জন নারী এবং ৭ জন বাঙালি। এসব কিছু সম্পন্ন হয় চুক্তি অনুযায়ী। কিন্তু যথাযথ বরাদ্দ এবং আরও নানা অজানা কারণে আঞ্চলিক পরিষদ প্রায়ই অকার্যকর হয়ে পড়ে।
বেদনাদায়ক সত্য হলাে, এ পর্যন্ত উল্লেখ করার মতাে কোনাে কাজই এ পরিষদ সম্পাদন করতে পারেনি। ভূমি কমিশনও একই রকম অকার্যকর। সেজন্য আদিবাসী নেতা জন সংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বােধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং তার অনুসারী সমর্থক শুধু নয়, সকল আদিবাসী মানুষ গভীর মর্ম যাতনায় ভুগছেন। এ অবস্থায় চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা সকলেই শঙ্কিত। শঙ্কিত জনপদে পথচলা কি কখনও মঙ্গলময় হতে পারে?
আমরা যে যাই বলি না কেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বহুজাতিক চরিত্রকে আমাদের সকলকে স্বীকার করে নিতেই হবে। এখন সময় এসেছে, আমাদের জাতীয়তার সংজ্ঞাকে পরিবর্তন করে এই বহুজাতিক চরিত্রকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।
সুন্দর এ পৃথিবীকে মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের উপযােগী রাখতে হলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনাে বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের সরকারসমূহ এ ব্যাপারে দূর্ভাগ্যজনক হলেও উদাসীন। ২০১১ সালে সংশােধিত সংবিধানে এই বহুজাতিক চরিত্রকে স্বীকার না করে একটি জাতির কথা স্বীকার করা হয়েছে।
বহুজাতিক এই বাংলাদেশের সংবিধানে একটি মাত্র জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করার মধ্য দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়কে প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও বাঙালি জাতির ইতিহাস বলে জাতিগতভাবে আমরা স্বৈরাচারী না। তাহলে আমাদের সরকার আমাদের আদিবাসী স্বজনদের সঙ্গে এমন আচরণ করবে কেন?
১৪ বছরে চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় সন্তু লারমা সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযােগ উত্থাপন করছেন। (দ্রষ্টব্য : প্রথম আলাে, ১ ডসেম্বর ২০১১)। আমরা এর সঙ্গে ভিন্নমত করতে পারি না। কারণ কোনাে অগ্রগতি নেই। সর্বত্রই পিছুটান। সর্বত্রই ভুল পথে যাত্রা। জানি না এসব শুধুই ভুল কিনা, নাকি জেনে শুনে বিষ পান!
লেখকঃ কুমার প্রীতীশ বল
তথ্যসুত্র : তাক্রুপ্ : বৈসুক -সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু-সংকলন ২০১৩
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।