পার্বত্য চট্টগ্রামের চাষযােগ্য জমির উপর জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রভাব

Jumjournal
Last updated Dec 21st, 2020

663

featured image

গত শতাব্দীর আশি ও নব্বই এর দশকে সরকার বাংলাদেশের সমতল অঞ্চলের বাঙালীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়ায় এ অঞ্চলে জনসংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আয়তন বাংলাদেশের মােট আয়তনের এক দশমাংশ হলেও এখানে আবাদযােগ্য জমির পরিমাণ খুব কম। বিদ্যমান জনসংখ্যার সাথে এই অঞ্চলের আবাদযােগ্য জমির পরিমাণ তুলনা করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে।

আবাদ/চাষযােগ্য জমির বিবরণ :

কানাডীয় কোম্পানীর Forestal Forestry & Engineering International পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৬৪-৬৬ সালে Chittagong Hill Tracts Land & Soil Survey নামে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির উপর একটা জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিকে ব্যবহার যােগ্যতা অনুযায়ী মােট ৫টি শ্রেণীতে ভাগ করে। শ্রেণী ও ব্যবহার অনুযায়ী জমির বিবরণ নীচে সারণী-১ এতে দেওয়া হল :

সারণী- ১

শ্রেণী-‘ক’পলিমাটি দ্বারা হঠিত জমি যা ধান চাষের উপযোগী৭৬,৪৬৬ একর (শতকরা হার ৩.২)
শ্রেণী-‘খ’উঁচু নীচু পাহাড় জমি যা ঢালু পাহাড় হিসেবে চাষযোগ্য৬৭,৪৭১ একর (শতকের হার ২.৯)
শ্রেণী-‘গ’নিম্ন তাপমাত্র ও অসতমল উচ্চ ভূমি ৩,৬৬,৬২২ একর (শতকের হার ১৫.৫)
শ্রেণী-‘ঘ’আংশিক ভাবে সুবিধাজনক অসমতল উচ্চ ভুমি৩২,০২৪ একর (শতকের হার ১.৬)
শ্রেণী-‘ঙ’বনায়নযোগ্য খুব খাড়া উচ্চ ভূমি যা পরস্পরকে ১৮,১৬,৯৩৩ একর (যার শতকরা হার ৭৭)

উপরােক্ত জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কৃষি সম্প্রসারণের জন্য সীমাবদ্ধতা ‘ক’ থেকে ‘গ’ ক্রমবর্ধমান হারে বেশী। কৃষির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জমির বেশী অংশই এই জেলা। (তৎকালীন) উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত।

পরিসংখ্যান ব্যুরাের তথ্য বিভ্রাট :

এবার দেখা যাক বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের পার্বত্য চট্টগ্রামের জমি/ভূমি সংক্রান্ত তথ্যাবলী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে কর্তৃক প্রকাশিত Statistical Year Book of Bangladesh, 2008 এতে প্রদত্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের কষি এবং অন্যান্য প্রকারের জমির বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হল :

সারণী-২ :

জেলাউচ্চ ভূমি মধ্যম উচ্চ ভূমি মধ্যম নীচু ভূমিমোট জমিবন্দোবস্তনদী, খাল, হ্রদ ও অন্যান্যসর্বমোট
খাগড়াছড়ি২,৩৮,৮৮৬ হেক্টর১৮,৬৩০১,০৯৭২,৫৮,৬১৩৫,০৫২১০,৪৬৫২,৬৯,০৭৯ হেক্টর
বান্দরবান৪,২২,৪৬০ হেক্টর৮৩৩১১৪৫৪,৩০,৯৮৬২,৫৮৭৭,১৪৫৪,৩৮,১৩১ হেক্টর
রাঙ্গামাটি৫,৪৭,৭১৩৭,২৮৩১,৮১৩৫,৫৬,৭৬৯৫,২৫৮৬১,৪৯৮৬,১৮,২৭৬ হেক্টর
১২,০৯,০৫৯ হেক্টর২৪,২৯৪ হেক্টর৩,০৫৫ হেক্টর১২,৪৬,৩৬৮ হেক্টর১২,৮৯৭ হেক্টর৭৯,১০৮ হেক্টর১৩,২৫,৪৮৬ হেক্টর
২৯,৮৬,৩৭৫,৭৩ একর ৬০,০০৬,১৮ একর ৭,৫৪৫,৮৫ একর ৩০,৭৮,৫২৮ একর৩১,৮৫৫,৫৯ একর১,৯৫,৩৯৬,৭৬ একর৩২,৭৩,৯৫০৪২ একর

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাবে দেখা যায় যে, তিন পার্বত্য জেলার উচ্চ ভূমির পরিমাণ ১২০৯০৫৯ হেক্টর (২৩৮৮৮৬+৪২২৪৬০+৫৪৭৭১৩) বা ২৯৮৬৩৭৫.৭৩ একর, মধ্যম উচ্চ ভূমির পরিমাণ ২৪২৯৪ হেক্টর বা ৬০০০৬.১৮ একর, মধ্যম নিম্নভূমির পরিমাণ ৩০৫৫ হেক্টর বা ৭৫৪৫.৮৫ একর।

বন্দোবস্ত জমির পরিমাণ হচ্ছে ১২৮৯৭ হেক্টর বা ৩১৮৫৫.৫৯ একর। এছাড়া নদী, খাল, পুকুর এবং হ্রদ এলাকার পরিমাণ ৭৯১৩৮ হেক্টর বা ১৯৫৩৯৬.৭৬ একর। একেবারে নিম্নভূমিসহ সব ধরনের জমি মিলে তিন পার্বত্য জেলার জমির পরিমাণ দেখানাে হয়েছে ১৩২৫৪৮৬ হেক্টর বা ৩২৭৩৯৫০.৪২ একর।

এবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে কর্তৃক প্রকাশিত Statistical Year Book of Bangladesh, 2008 এতে প্রদত্ত তিন পার্বত্য জেলায় সরকারী বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন বনের/বনভূমির পরিমাণ/আয়তন সংক্রান্ত তথ্যাদি সারণী-৩ এতে তুলে ধরা হল :

সারণী-৩

জেলাসংরক্ষিত বনভূমিঅশ্রেণীভুক্ত বনমোট বনভূমি
রাঙ্গামাটি৬৩০৩৯২.৮৮ একর৪৫৮২৮০.৭১ একর১৩৯৪৩০৬.৪১ একর
খাগড়াছড়ি৯৫৮৩৫.৫০ একর ৫৩৩০১৭.২৯ একর৫৫৪১১৬.২১ একর
বান্দরবান২৬৬২২৮.৮০ একর-নাই-৭৯৯২৪৬.০৯ একর
মোট =৯৯২৪৫৭.১৮ একর৯৯১২৯৮.০০ একর২৭৪৭৬৬৮.৭১ একর

বন বিভাগের বন সংক্রত তথ্যাবলী :

বনবিভাগের রাঙ্গামাটি সার্কেলের নিয়ন্ত্রণাধীন বনের হিসাব থেকে জানা যায় যে, এই সার্কেলের অধীনে বনাঞ্চল নিয়ে ১৯৮৬ সালে ১৬২.৪৩ বর্গমাইল দ্বারা পাবলাখালী বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এবং ১৯৯৯ সালে ১৩৪৯৮ একর এলাকা নিয়ে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান গড়ে তােলা হয়েছে।

তিন পার্বত্য জেলার মােট আয়তন হল ৫০৯৩ বর্গমাইল বা ৩২৬৩৩৩৯.৭৫ একর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব মতে পাহাড়, সমতল পাহাড়ের ঢালু (ঢালু), নদী, নালা, খাল-বিল ও হ্রদ মিলে তিন জেলার ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩২৫৪৮৬ হেক্টর বা ৩২৭৩৯৫০.৪২ একর।

এর মধ্যে সংরক্ষিত, রক্ষিত এবং অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল মিলে মােট জমির পরিমাণ দাঁড়ায়। ২৭৪৭৬৬৮.৭১ একর বা ৪২৮৮.২০ বর্গ মাইল। এতে তিন জেলার অবশিষ্ট জমির পরিমাণ। দাঁড়ায় ৫২৬২৮১.৭১ একর বা ৮২১.৩৫ বর্গমাইল।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলার উচ্চ ভূমির পরিমাণ ২৯৮৬৩৭৫.৭৩ একর বা ১২০৯০৫৯ হেক্টর যা তিন জেলার মােট জমির/ভূমির ৯১.২১ শতাংশ আর মধ্যম উচ্চ ভূমির পরিমাণ হচ্ছে ২৪২৯৪ হেক্টর বা মােট জমির ১.৮৩ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরাের তিন পার্বত্য জেলার জমির উপরােক্ত হিসাব মতে মােট জমির ৯৩.০৪ (৯১.২১+১.৮৩) শতাংশ কৃষির উপযােগী নয়। এই হিসাব মতে মাত্র ৭ (প্রায়) শতাংশ পরিমাণ জমি কৃষি এবং বসতভিটার জন্য অবশিষ্ট থাকে। এই ৭ শতাংশ জমির মধ্যে নদী, পুকুর, খাল, হ্রদ ও নীচুভূমি মিলে রয়েছে ৭৯১০৮ হেক্টর বা ১৯৫৩৯৬.৭৬ একর যার শতকরা হার ৫.৯৬। এতে কৃষি অনুপযােগী জমির/ভূমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৯ (৯৩.০৪+৫.৯৬) শতাংশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব বিভ্রান্তিকর। এই হিসাব অনুযায়ী বসতভিটা ও চাষাবাদের জন্য তিন পার্বত্য জেলায় মােট জমির পরিমাণ ১ শতাংশ অবশিষ্ট থাকে। অথচ বাস্তবে তা নয়।

কারণ পরিসংখ্যান ব্যুরাের সেই প্রকাশ বই-এ ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলার চাষাবাদের আওতাধীন জমির পরিমাণ দেখানাে হয়েছে ৪৪৬০৪৬ (১২৭২৮৩+১৫৬৯১০+১৬১৮৬৩ একর) একর। অথচ সারণী-২ এ প্রদত্ত সংখ্যা অনুযায়ী বন্দোবস্তকৃত জমির পরিমাণ দেখানাে হয়েছে মাত্র ১২৮৯৭ হেক্টর বা ৩১২৫৫.৫৯ একর যদি তা কৃষি কিংবা উচু/পাহাড়ী জমি কিনা তা উল্লেখ করা হয়নি।

বিদেশী কেম্পানীর জরিপ মতে বনায়নযােগ্য ভূমির পরিমাণ :

Forestal Forestry and Engineering International এর জরিপ অনুযায়ী কৃষির জমির পরিমাণ মাত্র ৭৬,৪৬৬ একর। পাহাড়ের ঢালে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৬৭,৮৭১ একর, আংশিকভাবে চাষযােগ্য ঢালু জমির পরিমাণ ৩২০২৪ একর, উদ্যান চাষ উপযােগী জমির পরিমাণ ৩৬৬,৬২২ একর এবং শুধু বনায়ন উপযােগী জমির পরিমাণ ১৮,১৬৯৩৩ একর, যার মােট পরিমাণ দাড়ায় ২৩৫,৯৯২৩ একর বা ৩৬৮৩,০৬ বর্গমাইল। এর মধ্যে অবশ্য শুধু বনায়নযােগ্য জমির পরিমাণ হচ্ছে ১৮,১৬৯৩৩ একর বা ২৮৩৫.৩৩ বর্গমাইল।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল :

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব মতে (২০০৭-২০০৮ পর্যন্ত) সংরক্ষিত বনের পরিমাণ ৯৯২৪৫৭.১৮ একর বা ১৫৪৮,৮৯ বর্গমাইল। আর অশ্রেণীভুক্ত বনের পরিমাণ (রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলাদ্বয়ে) ৯৯১২৯৮.০০ একর বা ১৫৪৭.০৯ বর্গমাইল।

পরিসংখ্যান ব্যুরাের উলে- খি হিসাবে বান্দরবান জেলায় অশ্রেণীভুক্ত বনের কোন হিসাব দেখানাে হয়নি। তবে ২৬৬২২৮,৮০ একর সংরক্ষিত বনসহ জেলার মােট জমির পরিমাণ দেখানাে হয়েছে ৭৯৯,২৪৬,০৯ একর। কিন্তু সংরক্ষিত বনভূমির অতিরিক্ত ৫৩৩০১৭.২৯ (৭৯৯২৪৬.০৯২৬৬২২৮.৮০) একর জমির কোন শ্রেণী উল্লেখ করা হয়নি।

বান্দরবান জেলার উল্লেখিত শ্রেণীবিহীন ৫৩৩০১৭.২৯ একর জমি থেকে ৫২৫৮ হেক্টর বা ১২৯৮৭.২৬ একর এবং নদী-নালা, পুকুর এবং জলাভূমি সহ ২৮৩৩ হেক্টর বা ৬৯৯৭.৫১ একর। জমি বাদ দিলে মােট শ্রেণীবিহীন জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২৬০১৯.৭৮ একর (পৃষ্ঠা-১০)। বান্দরবান জেলার উল্লেখিত শ্রেণী বিহীন জমিকে অশ্রেণীভুক্ত/বনায়নযােগ্য জমি ধরে নিলে তিন পার্বত্য জেলার মােট অশ্রেণীভুক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬৫১৭৩১৭.৭৮ একর বা ২৩৬৮.০৩ বর্গমাইল।

জমির সার্বিক অবস্থা :

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব মতেই তিন পার্বত্য জেলার ৩২৬৩৩৩৯.৭৫ একর ভূমির মধ্যে ২৯৮৬৩৭৫.৭৩ একরই উচ্চভূমি বা কৃষি অনুপযােগী। আর Forestal Forestry and Engineering International এর হিসাব মতে ১৮১৬৯৩৩ একরই পরস্পর ভেদী ভীষণ ঢালু।

ভূমি যা শুধুমাত্র বনায়নযােগ্য। পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব মতে কৃষি, ফলজ বাগান ও বসত ভিটার জন্য অবশিষ্ট থাকে মাত্র (৩২৬৩৩৯.৭৫-২৯৮৬৩৭৫,৭৩) ২৭৬৯৬৪,০২ একর। আবার Forestall Forestry and Engineering International এর হিসাব মতে মাত্র ৫৪২,৯৮৩ একর। তবে এর মধ্যে ৩৬৬,৬২২ একর নিম্ন শ্রেণীর অসমতল উচ্চ ভূমি যা চাষাবাদ বা উদ্যান/বাগান গড়ার অনুপযােগী।

ফলে চাষাবাদ ও উদ্যান গড়ার যােগ্য জমির। পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭৬৩৬১ একর। এতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে এবং Forestal Forestry and Engineering International এর চাষাবাদ ও বাগান উপযােগী জমির পরিমাণের পার্থক্য দাঁড়ায় ১০০৬০৩ (২৭৬৯৬৪,০২-১৭৬৩৬১) একর।

কৃষি এবং উদ্যান উপযােগী জমির বিবরণ :

ক) কাপ্তাই বাঁধের ক্ষতিগ্রস্থদের পুনর্বাসন :
সরকারী হিসাব মতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ৫৪ হাজার একর সর্বোকৃষ্ট কৃষি জমি নিমজ্জিত হয়েছে এবং সেই জমির পরিমাণ ছিল তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের মােট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। এতে ১৮ হাজার পরিবারভুক্ত ১০০০০০ লােক বাস্তুচ্যুত হয়। এদের মধ্যে ৭৩৯৮ পরিবারকে ২০২৩১ একর কৃষি জমি প্রদান করা সম্ভব হয়।

আবার ৭৬৭৬ ক্ষতিগ্রস্থ জুমিয়া পরিবারকে ১২৬১৫ একর পাহাড় জমি বরাদ্দ দিয়ে হ্রদ এলাকায় পুনর্বাসন করা হয়েছে। বাকী ৩০০০ (২৯২৬) পরিবারের মধ্যে কিছু পরিবারে ৮০০ একর অসমতল উঁচু (Bumpy Land) জমি এবং বাকীদের মাছ ধরার সরঞ্জাম দিয়ে নাম মাত্র পুনর্বাসন করা হয়।

খ) বাঙালী বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে জমি বন্দোবস্ত প্রদান :
বাঙালী বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যার বিষয়ের কোন সরকারি তথ্য পাওয়া যায়না। কারণ অত্যন্ত গােপনীয়তার মাধ্যমেই সরকারী উদ্যোগে তাদেরকে তৎকালীন অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল। ১৯৭৯-৮০ থেকে ১৯৮৪-৮৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিন দফায় এদেরকে আনা হয়।

প্রথম দফায় ৩০,০০০ পরিবারকে আনা হয়। দ্বিতীয় দফায় আনা হয় ২৫,০০০ এবং তৃতীয় দফায় ২৫,০০০ পরিবার মিলে মােট ৮০,০০০ পরিবার বাঙালী আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই বিষয়ে বিভিন্ন লেখকের অনুমান/সংখ্যা বিশ্লেষণ করে ড. স্বপন আদনান তার Migration, Land Alienation and Ethnic Conflict: Cause of Poverty in Chittagong Hill Tracts গ্রন্থে বাঙালী বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা ৩৪০০০০ থেকে ৩৫০০০০ বলে হিসাব করেছেন।

প্রথম দফায় যে ৩০,০০০ পরিবার আনা হয় তাদেরকে পরিবার প্রতি ২.৫০ একর কৃষি জমি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সেই হিসাব মতে তাদের বরাদ্দ বন্দোবস্ত জমির পরিমাণ দাঁড়ায়। (২.৫০X৩০০০০) ৭৫,০০০ একর। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায় যাদেরকে এখানে আনা হয় তাদেরকে পরিবার পিছু ৪ একর মিশ্র জমি অথবা ৫.০০ একর পাহাড় জমি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।

ঠিক কত পরিবারকে মিশ্র জমি এবং কত পরিবারকে পাহাড়ী জমি প্রদান করা হয়েছে, এর কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। যদি এই ৫০ হাজার পরিবারের সবাইকে পরিবার পিছু ৪.০০ একর মিশ্র জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে মােট জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লক্ষ একর। আবার যদি তাদের সবাইকে পরিবার পিছু ৫.০০ একর পাহাড়ী জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাহলে জমির প্রয়ােজন (৫x৫০,০০০) ২,২৫,০০০ একর। এতে শুধুমাত্র জমির পরিমাণ দাঁড়ায় (৭৫,০০০+২,০০,০০০) ২,৭৫,০০০ একর।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে এবং Forestal Forestry and Engineering International এর জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে উপরে দেখানাে হয়েছে যে বনায়নযােগ্য জমির অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ২৭৬৯৬৪.০২ একরই জমি পাওয়া যায়। তাছাড়া কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের পুনর্বাসনের লক্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮-৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটা মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল ৫৯ মৌজায় ৬৬,০০০ একর জমিতে (অসমতল পাহাড়) ১১০০০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা। ১৯৭৪ সালের মে মাসে এই প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) এর নিকট হস্তান্তর করা হয় এবং ইতমধ্যে ৪৫টি মৌজায় ১৭০২ পরিবারকে ১০০৬১ একর জমি বরাদ্দ করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় পর্যন্ত এই প্রকল্পের কার্যক্রম চলে।১০

সমন্বিত জুমিয়া পুনর্বাসন ও বনায়ন প্রকল্পের আওতায় জমি বরাদ্দ :

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড ১৯৮৪-৮৫ খ্রিঃ ৪০০০ একর পাহাড়ী জমিতে ৯০০ ভূমিহীন জুমিয়া পরিবার (তিন জেলায়) পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এসব পরিবারকে রবার বাগান এবং ফলমূল চাষাবাদের জন্য ৪.৫০ একর পাহাড়ী জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯৮৫-৮৬ খ্রিঃ পর্যন্ত ৩৮৫০ একর জমি আবাদ ৮৩৫ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়।১১

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় কাপ্তাই বাঁধের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ১১ হাজার পরিবারকে ৬৬ হাজার একর পাহাড়ী জমি বরাদ্দ প্রদান, ৮০ হাজার বসতি স্থাপনকারী বাঙালী পরিবারকে ৭৫,০০০ একর কৃষি জমি, ২.০০ লক্ষ একর পাহাড়ী জমি বন্দোবস্ত ও সমন্বিত জুমিয়া পুনর্বাসন ও বনায়ন প্রকল্পের আওতায় ৪ হাজার একর জমি কোথা থেকে পাওয়া গিয়েছে।

কারণ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের হিসাব মতে বনায়নযােগ্য জমির বাইরে কৃষি ও ফলজ বাগান/উদ্যান গড়ার জন্য প্রাপ্য জমির পরিমাণ মাত্র ২৭৬৯৬৪.০২ একর। তাহলে ধরে নিতে হয় যে, Forestal কোম্পানীর জরিপে যে ৩,৬৬,৬২২ একর ‘গ’ শ্রেণীর নিম্ন মানের অসমতল উঁচু (Lower Class Bumpy Land) জমি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেই জমি থেকে এ যাবত এত বিপুল পরিমাণ জমি বন্দোবস্ত বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। এই শ্রেণীর জমিকে কেবল রবার এবং বাঁশ চাষের উপযােগী বলে পরবর্তী আর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।১২

আবাদকৃত (বর্তমান) জমির হিসাব :

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাের ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী কৃষি কাজে ব্যবহৃত তিন পার্বত্য জেলার জমির পরিমাণ ছিল ৪,৪৬,০৪৬ একর। বাঙালী বসতি স্থাপনকারীদের বন্দোবস্তকৃত (৫০,০০০ পরিবারকে) ২,০০,০০০.০০ লক্ষ একর এর সাথে কাপ্তাই পুনর্বাসন প্রকল্পের (১৯৫৬-৬৬) খ্রিঃ আওতায় ৭৬৭৬ পরিবারকে বন্দোবস্তকৃত ১২৬১৫ একর, অতিরিক্ত পুনর্বাসন প্রকল্পের (১৯৬৬-৭৫) আওতায় বন্দোবস্তকৃত ৮০০ একর অসমতল উঁচু পাহাড়ী জমি, পাবত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন মহা প্রকল্প (১৯৬৮-৬৯ খ্রিঃ) এর আওতায় বরাদ্দকৃত (১৯৭২-৭৩ খ্রিঃ পর্যন্ত) ১০,০৬১.০০ একর, ১৯৮৪-৮৫ খ্রিষ্টাব্দের জুমিয়া পুনর্বাসন ও বনায়ন প্রকল্পের আওতায় প্রদত্ত ৪,০০০.০০ একর জমি যােগ করলে মােট বন্দোবস্তকৃত/বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৭৩৫২২ একর।

পক্ষান্তরে, বনায়নযােগ্য জমির বাইরে কৃষি ও ফলজ বাগান, বাঁশ এবং রাবার চাষের জন্য প্রাপ্য মােট জমির পরিমাণ হচ্ছে (২৭৬৯৬৪.০২+৩৬৬৬২২) ৬৪৩৫৮৬.০২ একর। অর্থাৎ ইতমধ্যে ব্যবহার যােগ্য জমির অতিরিক্ত জমি বরাদ্দ/বন্দোবস্ত দেওয়া হয়ে গেছে।

জনসংখ্যার অনুপাত জমির প্রাপ্যতা :

২০০১ খ্রিষ্টাব্দে লােক গণনা হিসাব অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলার লােক সংখ্যা হল (৫৩১a ৫৪৯১৩৪+৩১১৭৪১) ১৩৯২৩৬৪ জন। আর ১৯৯১ খ্রিঃ জনসংখ্যা ছিল ১০৪২৩৭৩ জন। বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ৩৪৯৯৯১ জন, যার শতকরা বৃদ্ধির হার হল ৩৩.৫৭। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের লােক গণনার সরকারী হিসাব পাওয়া যায়নি যদি পরবর্তী দশ বছরের হিসাব ধরা হয়, তাহলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৫৯৭৮০।১৩

পরিস্থিতির ভয়াবহতা :

উপরের বিস্তারিত আলােচনা থেকে পরিস্কার হয়েছে যে, বনায়নযােগ্য ভূমি ব্যতীত তিন পার্বত্য জেলায় ব্যবহারযােগ্য কোন জমি অবশিষ্ট নেই। অথচ জনসংখ্যা, বিশেষতঃ বাঙালী বসতি স্থাপনকারীদের দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পার্বত্য (চট্টগ্রাম) ভূমি জনসংখ্যা/মানুষ ধারণ ক্ষমতা ইতমধ্যে হারিয়েছে। তাহলে এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ভবিষ্যৎ কি? এর একটা মাত্র সমাধান হচ্ছে বিদ্যমান (সরকারী) বন ভূমির ধ্বংস সাধন, রােহিঙ্গারা ঢুকে এখন যেভাবে রাইখ্যং সংরক্ষিত বনকে ধ্বংস করছে।

তাই ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামে হয় মানুষ থাকবে অথবা বন/বনভূমি থাকবে। একদিন পরিস্থিতি এমনই ভয়াবহ হবে।

লেখক : জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা

তথ্যসূত্র :

সারণী-১ : Forestal Forestry and Engineering International এর রিপোর্ট (১৯৬৪-৬৬ খিঃ)

সারণী-২ : Statistical Year Book of Bangladesh- 2008. Bangladesh Bureau of Statistics.

সরণী-৩ : ————
১। Statistical Year Book of Bangladesh – 2008
২। ঐ-
৩। ঐ-
৪। Forestal Forestry and Engineering International (1964-66)
৫। Statistical Year Book of Bangladesh- 2008
৬। ঐ-
৭। ঐ এবং Forestal Forestry and Engineering International,
৮। Agricultural and Horticultural Development in the Chittagong Hill Tracts, Many 76 by B. Grimwood. Post Harvest Technologist.
৯। Migration, Land Alienation and Ethnic Conflict: Causes of Poverty in Chittagong Hill Tracts- Dr. Shapan Adnan.
১০। Agricultural and Horticultural Development in the Chittagong Hill Tracts, May 76 by B. Grimwood. Post Harvest Technologist.
১১। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ডের বাের্ড সভার ২৭-১১-১৯৮৫ খ্রিঃ এর কার্যবিবরণী/সিদ্ধান্ত।
১২। Population Census 2001, National Series, Vol. I- Analytical.

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা