পার্বত্য চট্টগ্রামের বনজ সম্পদ এবং পরিবেশের উপর তার প্রভাব
2140
বর্তমান সময়ে পরিবেশ বিপর্যয় এবং বনভূমি ধ্বংস অন্যতম আলোচিত বিষয়। যেহেতু বনভূমি পরিবেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কাজেই বনভূমি ধ্বংসের ফলে যেমন একদিকে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে অন্যদিকে আদিবাসীরা পড়েছে হুমকির মুখে। আদিবাসীদের সংস্কৃতি হয়েছে বন রক্ষার সংস্কৃতি।
আদিবাসীরা থাকলেই বনভূমি থাকবে। যেহেতু এই আদিবাসীরা পাহাড়ে অরণ্যে বাস করে তাই তাদের প্রকৃতির নানা বিপর্যয়ে প্রকৃতিই তাদের রক্ষা করে। সুতরাং তারা যদি বন ধ্বংস করে তবে তাদের আত্মরক্ষার কোন সুযোগ থাকবেনা।
পাহাড়ে আদিবাসীরা বাস করে মাচা বেঁধে। কাজেই তাদের বাসস্থান তৈরিতে দরকার পড়ে না কোন পাহাড় কাটার, পাহাড় সমতল করার। ফলে পাহাড়ে ভূমি ক্ষয়, উর্বরতা হ্রাস কোনটাই ঘটে না ।
অনবরত বৃক্ষ নিধনের ফলে এই পৃথিবী যেমন তার অরণ্য হারাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী হয়ে পড়বে বৃক্ষহীন। আমার আলোচনা আমি ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে চাইনা।
আমি শুধু সীমাবদ্ধ রাখব বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থার উপর। আগে এই অঞ্চল ছিল গভীর অরণ্যে ঢাকর। বিভিন্ন হিংস্র জীবজন্তুর ছিল নিশ্চিত পদচারণা। কিন্তু ক্রমাগত বৃক্ষ নিধনের ফলে পুর্বের সেই অবস্থা আর নেই।
বর্তমানে পাহাড়ী অঞ্চলে লোক বসতি বৃদ্ধি, পাহাড়ী ঢালে অপরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ এবং সর্বোপরি অরণ্য ধ্বংসের ফলে বনাঞ্চল আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং গাছপালাহীন ঢালু পাহাড়ে মৃত্তিকা ক্ষয় ও মৃত্তিকা ধ্বংস বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে ।
এদেশের প্রেক্ষাপটে সমতল ভূমির যেহেতু পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে সেহেতু অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত/অব্যবহৃত পাহাড়ী অঞ্চলকে কাজে লাগানো ছাড়া উপায় নেই।
ভূমন্ডলীয় জলবায়ু অনুসারে বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
(ক) পাহাড়ী বনাঞ্চল
(খ) সমুদ্র উপকূলীয় বা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল
(গ) শালবন।
অন্যদিকে উদ্ভিদ জগতের পরিবেশের সামঞ্জস্য বা বাস্তুবিদ্যা অনুসারে (Ecologically) বাংলাদেশের বনাঞ্চলকে যেভাবে ভাগ করা যায়-
(ক) গ্রীষ্মমন্ডলীয় বৃষ্টিবহুল চিরসবুজ বনাঞ্চল
(খ) আংশিক চিরসবুজ বনাঞ্চল
(গ) জলভূমি মগ্ন বনাঞ্চল
(ঘ) পত্র হরিৎ বনাঞ্চল
(ঙ) ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ।
কোন দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য সে দেশের আয়তনের ন্যূনতম ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বনভূমি খুবই কম। ৯৪.৫ মিলিয়ন হেক্টর বাংলাদেশের মধ্যে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ২.৪ মিলিয়ন হেক্টর।
এটা দেশের আয়তনের শতকরা হিসেবে ১৭ ভাগ। বেসরকারী হিসাবমতে বাংলাদেশের বনাঞ্চল রয়েছে মাত্র ৬.৪৬% যা খরা বন্যা সহ যাবতীয় পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
এর মধ্যে সরকার নির্ধারিত বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ৯.৪৭ মিলিয়ন হেক্টর অর্থাৎ মোট আয়তনের ১৪.৯ শতাংশ এবং মোট বনভূমির প্রায় ৬৯ শতাংশ অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল যা সংশ্লিষ্ট ডেপুটি কমিশনার দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের বনাঞ্চল লক্ষ্য করলে দেখা যায় – মায়ানমার – ৫০%, চীন- ৪৮%, ফিলিপাইন – ৩৭%, মালয়েশিয়া – ৫৬%, নেপাল – ২৫%, থাইল্যান্ড – ৩৪% ।
এবারে আসা যাক পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি প্রসঙ্গে। চার ধরনের বনাঞ্চল এখানে দেখা যায় –
(১) নিরক্ষীয় চিরসবুজ বনভূমি
(২) মিশ্র চিরসবুজ বনভূমি
(৩) পত্র হরিৎ বনভূমি
(৪) বাঁশবন।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটির ভূ-তাত্ত্বিক গঠন লক্ষ কোটি বছরের পুরনর। প্রাচীন[1] কাল হতে প্লায়োসিন[2] কালের মধ্যে এসব বনভূমি সৃষ্টি হয়েছে।
এই সুদীর্ঘ সময়ে প্রাকৃতিক উপায়ে মাটি সৃষ্টি হয়েছে – যা ঢালু পাহাড়ী ভূমিতে ভূমিক্ষয়ের কারণে গভীর হতে পারছে না। প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ পলল এলাকা, শতকরা ৮ ভাগ গড় এলাকা[3] এবং শতকরা ১২ ভাগ পাহাড়ী এলাকা রয়েছে।
পাহাড়ের প্রতিকূল ভূমিরূপের জন্য দীর্ঘদিন এই এলাকার মৃত্তিকা ও ভূমি সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হয় নি।
তবে ভূমির অবস্থান, মাটির প্রকৃতি, উচ্চতা, ঢালের তীব্রতা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, ফলজ বনজ বৃক্ষের উৎপাদন, বন্যপ্রাণীর খাদ্য আবাসস্থল বৃদ্ধি এবং পানি সংরক্ষণ বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৬৪-৬৬ সালে প্রথমবারের মত কানাডার Forestal Forestry and Engineering International আলোকচিত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমে এতদঅঞ্চলের প্রাথমিক মৃত্তিকা ও ভূমি ব্যবহার জরিপ কাজ চালায়।
উক্ত জরিপের ভিত্তিতে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদনের জন্য ভূমি ও মৃত্তিকা ক্ষমতা অনুযায়ী সমগ্র এলাকাকে শ্রেণী বিন্যাস করা হয়।
এতে সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের মোট ভূমির শতকরা ৩.১ ভাগ মাঠ ফসলের জন্য, শতকরা ১৭.৪ ভাগ উদ্যান ফসলের জন্য এবং শতকরা ৭৪.২ ভাগ বনরৃক্ষ বা পানি বিভাজিকার জন্যে উপযোগী বলে মত প্রকাশ করা হয়। এছাড়া শতকরা ৫.৩ ভাগ কাপ্তাই হ্রদ ও বসতবাড়ি এলাকার অন্তর্গত।
১৯৮৩ সালের পরিসংখ্যান মতে পার্বত্য অঞ্চলের মাথাপিছু আয় সমগ্র বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের ৩২০% বেশী। বনজ সম্পদের ফলে এই অসাধারণ পার্থক্য বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
অন্য এক পরিসংখ্যান মতে এ অঞ্চলে মোট ভূমির ১৯,৪৩,৩৫০ একর বনায়ন উপযোগী কিন্তু মাত্র ৯,৮৩,১০১.২৫ একরে পরিকল্পিতভাবে বনায়ন করা হয়েছে । বিগত ৪০ দশকে পার্বত্য অঞ্চলের ৮০% জমি ছিল গভীর অরণ্যে ঢাকা।
কিন্তু পাঁচের দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ২২.৩৪ বর্গমাইল সংরক্ষিত বনাঞ্চল জলমগ্ন এবং ৪৪.৭৫ বর্গমাইল এলাকা ধ্বংস হয়। আর ২৩৪ বর্গমাইল অশ্রেণীভুক্ত বন জলমগ্ন হয় ফলে ২৫৪ বর্গমাইল এলাকা জলমগ্ন হয়ে এক কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি হয়।
পলে ১৮ হাজার জুম্ম পরিবার উদ্বস্তু হয়ে পড়ে এবং পরে এই সব উদ্বাস্তু জুম্মরা কাচালং, রেংখং, সুভলং সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে। এতে একদিকে জলমগ্নতা ও অন্যদিকে নতুন জনপদ সৃষ্টির ফলে বনভূমির পরিমাণ হ্রাস পায়।
[1] ২ কোটি ৬০ লক্ষ বছর হতে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ বছর পূর্ব পর্যন্ত ।
[2] ১৮ লক্ষ বছর হতে ৫০ লক্ষ বছর পূর্ব পর্যন্ত ।
[3] মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল দেশের বৃহত্তম বনাঞ্চল। এখানে শ্রেণীভুক্ত ও অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ যথাক্রমে ১,০০১ ও ৩,৪০০ বর্গমাইল। এই অঞ্চলে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে প্রধান সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো অবস্থি।
দুইশত বছরের এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গর্জন, রাবার, চাপলিশ, তেলসুর প্রভৃতি মূল্যবান বৃক্ষ রয়েছে । কিন্তু সরকারী অব্যবস্থাপনা, কাঠ চোরাচালানকারীদের দৌড়াত্ম্যে যেভাবে বন উজাড় হচ্ছে তা অব্যহত থাকলে সম্পূর্ণ বনভূমিকে ধ্বংস হতে আর বেশি দিন লাগবে না।
চোরা কারবারীরা মূলতঃ ভূমিহীন অথবা স্বল্প আয়ের গ্রামীণ লোকজনদেরকে বন থেকে চোরাই কাঠ আহরণে নিয়োগ করে থাকর।
এদের মধ্যে পাহাড়ী ও অন্যান্য সম্প্রদায় রয়েছে যারা বনজ সম্পদ আহরণ করে লাভবান হচ্ছে খুব সামান্য । অথচ লাভবান হচ্ছে মূলতঃ কতিপয় কাঠ ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারী সমতলবাসীরা।
পার্বত্য অঞ্চলে বনজ সম্পদ ধ্বংসের জন্যে যে সকল বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা যায় –
(১) বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঠ আহরণ।
(২) ব্যাপক জনসংখ্যার চাপ।
(৩) অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটা।
(৪) বন বিভাগের অসাধু সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী।
(৫) অনুপ্রবেশকারীদের জমি আবাদিকরণ ও সামরিক বাহিনীর চলাচলের জন্য পথের দু’ধারে ব্যপক জঙ্গল কাটা প্রভৃতি।
অবশ্যই অনেকে জুম চাষকে বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম কারণ বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাঠ আহরণের পূর্বে জুম্ম জনগণ যুগযুগ ধরে জুম চাষ করলে ও পার্বত্য অঞ্চলের বনাঞ্চল আজকের মতো ধ্বংসের মুখোমুখি হয়নি।
বস্তুত পার্বত্য অঞ্চলের অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চলে জুম চাষ হয়ে থাকে এবং কোন স্থানে একবার জুম চাষের পর কম পক্ষে ৪/৫ বছর পর্যন্ত ঐ স্থান পতিত রাখা হয় বনাঞ্চল গড়ে ওঠার জন্য।
এই আবর্তন পদ্ধতিতে জুম চাষের ফলে সংরক্ষিত বনের কোন ক্ষতিই হয় না। তদুপরি উল্লেখ্য, প্রধানত বাঁশ বনেই জুম চাষ হয়ে থাকে এতে গাছের কমই ক্ষতি হয়ে থাকে । কাজেই জুম চাষকে বর্তমান বনভূমি ধ্বংসের প্রধান কারণ বলা যায় না।
কাঠ অবৈধ ভাবে চালানোর ফলে ব্যাপক হারে এ অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেইট। পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে চার ভাবে বৈধ ও অবৈধ কাঠ চালান দেওয়া হয়। (১) গোল কাঠ (২) রদ্দা ও বল্লি (৩) জ্বালানী (৪) আসবাবপত্র।
প্রধানত সংরক্ষিত বনাঞ্চল হতে খুব বড় বড় গাছ বিভিন্ন বাগান হতে ব্যাপক হারে পাচার করা হয়। ফলে দুইশ’ বছরের কাচালং মাইনি বনাঞ্চল, রেংখং বনাঞ্চল, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী বনাঞ্চল আজ বৃক্ষ শূন্য হয়ে পড়েছে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চল হতে রদ্দা আকারে কড়ই, গামার, জারুল, মেহগনি, চাপলিশ, গর্জন, তেলসুর ও যেকোন জাতের গাছ ব্যাপক হারে হরণ করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ধ্বংসের কারণ হচ্ছে ব্যাপক হারে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ। বিভিন্ন ইটের ভাটায় প্রচুর পরিমাণে গাছ পোড়ানোর জন্য সরবরাহ হয়ে থাকে। আসবাব তৈরির ফলে কাঠের চাহিদা বাড়ছে হু হু করে।
যারা এখানে চাকরী করতে আসে, যাবার কালে প্রচুর পরিমাণ আসবাব পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে নিয়ে যায়। যার ফলে কাঠের প্রচুর চাহিদা এবং সে কারণে কাঠ আহরণ করে থাকে প্রচুর।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ধ্বংসের কারণে ইতিমধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। এই ব্যপক বন ধ্বংসের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল হতে অনেক প্রজাতির পাখি ও জীবজন্তু আজ বিলুপ্ত।
সবুজ বনানী পার্বত্যঞ্চল আজ ধূসর মরুতে পরিণত হচ্ছেচ। এর ফলে পাহাড়ের ব্যাপক ভুমিক্ষয় ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে বর্ষার সময় সামান্য বৃষ্টিতে বন্যার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে।
অন্যদিকে খরার সময় পানীয় জল ও সেচের জলের সংকট পরিলক্ষিত হচ্ছে। কাপ্তাই বাঁধের ফলে যে বিপুল পরিমাণ বন ধ্বংস ও গত দুই দশকে একচেটিয়া বাঁশ, কাঠ আহরণের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকির মুখর।
এই অনিবার্য্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে। আবার অতিরিক্ত ভুমি ক্ষয় ও পাহড় ধ্বংসের কারণে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, কাপ্তাই হ্রদের পলিমাটি ড্রেসিং এর মাধ্যমে বাঁধের নীচে ফেললে তা চট্টগ্রাম বন্দরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।
এই পলিমাটির ফলে কাপ্তাই বাঁধ পরিকল্পনায় বাঁধ থেকে প্রাপ্ত সুবিধাদির মেয়াদ ১৪৫ বছর ধরা হলে ও গত ৩৫ বছরের মধ্যে সেসব সুবিধাদি নিঃশেষ হওয়ার পথে। তাই কাপ্তাই হ্রদের ব্যাপারে দৃষ্টি না দিলে আগামী ১০/১৫ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
আর স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক সূত্র হতে জানা যায় যে, রাঙ্গামাটির যেসব কৃষি জমিতে চাষ করা হয় তার দুই তৃতীয়াংশ কাপ্তাই হ্রদের ভাসা ভাসা জমি। বর্তমান প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়াই প্রতি বছর অকাল বন্যা ও খরায় ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আর শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থারও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায় কৃষি পণ্যের দাম কমে যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হারে বন ধ্বংস হচ্ছে, সে হারে বনায়ন হচ্ছে না, না সরকারী ভাবে না ব্যক্তিগত উদ্যোগে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ জমি সরকারী মালিকানাধীনস।
সরকারী মলিকানাধীন সরকারী বনভূমির মধ্যে রয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, রক্ষিত বনাঞ্চল ও অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল। সরকারী হিসাবে এখানে আছে দেশের মোট বনাঞ্চলের ৫৪ ভাগ কিন্তু আসলেই তা আছে কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
শেষে বলা দরকার, প্রকৃতির অকৃত্রিম দানে ভরপুর পার্বত্য অঞ্চল এখন ক্রমশ বৃক্ষ শূন্য হযে পড়েছে। নতুন করে বনায়ন সময় সাপেক্ষ হলে ও তা করা দরকার কেননা পরিবেশের মারাত্মক প্রভাব এড়াতে বনভূমি তথা প্রকৃতির দায়িত্ব অপরিসীম।
গাছপালা হতে আমরা দু’ভাবে উপকার পাই। প্রত্যক্ষ উপকার (Tangible benefit) এবং পরোক্ষ উপকার (Intangible benefit)। প্রত্যক্ষ উপকার হলো কাঠ হতে বিভিন্ন ফার্নিচার, ক্যাবিনেট, কাগজ উৎপাদন, ম্যাচ প্রস্তুতি, ফলমূল প্রদান প্রভৃতি আর পরোক্ষ উপকার হলো অক্সিজেন প্রদান, পরিবেশ শীতলীকরণ সহ মরুকরণ রোধ, নতুন বনভুমি সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান প্রভৃতি।
ধীরে ধীরে বৃক্ষ ধ্বংসের ফলে আমরা ভবিষ্যতে এইসব উপকার হতে বঞ্চিত হবো এবং সবুজ শ্যামল পার্বত্য অঞ্চল পরিণত হবে মরুভুমিতে। এর ফলে বাংলাদেশের উপর তার যথেষ্ট প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের বন এমনিতেই ক্রমশ কমে যাচ্ছে। ১৯৩০ সালে বাংলাদেশে ৩০% বনাঞ্চল ছিলো। ১৯৫২ সালে নেমে আসে ২৭% এবং ১৯৭৭ সালে দাঁড়ায় ১৮% এ।
কাজেই দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য হলেও বনায়ন এবং বনভূমির রক্ষা করা প্রয়োজন এবং তার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে।
তথ্যসূত্র :
(১) পার্বত্য চট্টগ্রাম হিভিয়া রাবার চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ – সুদিব্য কান্তি খীসা
(২) প্রতিধ্বনি (ম্যাগাজিন)
(৩) দৈনিক ভোরের কাগজে ছাপানো হরি কিশোর চাকমার প্রতিবেদন সমূহ
(৪) শ্রেণী
(৪) শ্রেণী শিক্ষকদের লেকচার সমূহ
লেখক : মিশুক চাকমা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ফরেস্ট্রী (সম্মান)
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।