আদিবাসী নারীর অবস্থানঃ প্রেক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম

Jumjournal
Last updated Sep 22nd, 2021

2079

featured image

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশ-ব্যাপী যে ক্লাসিক পিতৃতন্ত্রের বিস্তৃতি তা থেকে পাহাড়ি সমাজ-ব্যবস্থাও বেশী দূরে সরে যেতে পারেনি।

এখানেও নারীকে অবদমিত করে রাখার প্রবণতা লক্ষণীয়। সমাজে নারীর অবস্থান নির্ণয় করতে গিয়ে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হল আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকার কতটুকু রক্ষিত হয়েছে এবং বর্তমান সময়ে এ-অধিকার কতখানি যৌক্তিক ও কার্যকরী তা নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।

তবে বাংলাদেশের অপরাপর সমাজ-ব্যবস্থা থেকে পাহাড়ি সমাজ ব্যবস্থা কিছুটা উদার। যেমন, পাহাড়ি সমাজে পর্দা-প্রথা নেই এবং নারীর শ্রমের উপর কোন বিধি-নিষেধ নেই।

পাহাড়ি নারীরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী স্বাধীনতা ভোগ করে অর্থাৎ চলাফেরায় স্বাধীন, তবে অধিকার প্রশ্নে গতানুগতিক পুরুষতান্ত্রিক ধারাই  লক্ষণীয়।

১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষিত হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের নারীদের জন্য নিঃসন্দেহে অগ্রগতির একটি মাইলফলক ছিল।

জোট সরকারের আমলে এসে এই নারী উন্নয়ন নীতিমালায় সংশোধনী আনা হয় এবং ৮ মার্চ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরেকটি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করে।

কিন্তু গৃহীত নীতিমালাসমূহে আদিবাসী নারীদের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংঘাতের সময়ে যেসব নারী ও শিশু নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এখনও যারা প্রতিনিয়ত আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও সেটেলারদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে সে সর্ম্পকে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য নেই।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১০ ও ২৮ নং অনুচ্ছেদের (১,২,৩,৪ নং) ধারায় নারীর মৌলিক অধিকারের কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। কিন্তু সকল পর্যায়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমান মর্যাদা সংরক্ষণের কথা সংবিধানে বলা হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য দেখা যায়।

অনেকে নারী অধিকারকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে বলে থাকেন নারীদের জন্য আলাদা আইন প্রনয়ন করে তাদের অধিকার রক্ষা করতে হবে।

বিষয়টি কিন্তু তা নয়। নারী অধিকারের অর্থই হল, সংবিধানে নারী অধিকার রক্ষার জন্য যে আইন রয়েছে তা যথাযথভাবেই বাস্তবায়ন করা। তাহলে নারী অধিকার অনেকখানি রক্ষিত হয়।

পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সবসময় অধস্তনতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নারী সর্ম্পকে কমন যে ধারণা তা হল – নারী মানেই মা, স্ত্রী জাতি; যে গৃহের অন্ত:পুরকে পরিপাটি করে রাখে।

নারীর প্রতি এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই দৃষ্টিভঙ্গি। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণ একটি চিত্র।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক হলেও নারীদের ভূমিকাকে মোটেও গৌণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়না।

বরং সমাজ ও পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি গঠনে পাহাড়ি নারীদের অবদান সবচেয়ে বেশী। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় ৮০% নারী ঘরের বাইরে কাজ করেন ।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্পদের উপর পাহাড়ি নারীদের অধিকার না থাকায় পুরুষের চেয়ে নারীরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পাহাড়ি সমাজের প্রচলিত উত্তরাধিকার প্রথায় পুত্র সন্তানই সম্পদের উপর একক ও অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। যেমন, চাকমা সমাজে কন্যা সন্তানরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না।

প্রথাগত আইনের মাধ্যমে তাকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। ফলে সম্পত্তির উপর নারীর মালিকানার বিষয়টি পরিবারের পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

কেবল দান বা উইলের মাধ্যমে নারীরা সম্পত্তির অধিকার লাভ করতে পারেন। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী উত্তরাধিকার লাভ করতে পারেন, তবে অপুত্রক অবস্থায় অন্য কোথাও বিয়ে হলে সে প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির উপর অধিকার হারায়।

পাহাড়ি নারীদের আরেকটি বিষয়ে আইনতগত ভিত্তি থাকা খুবই জরুরী – তা হল বিবাহ রেজিষ্ট্রি করা। কারন বিয়ের লিখিত কোন দলিল না থাকাতে পারিবারিক যে কোন ঝামেলায় জড়ালে তারা আর জাতীয় আইনের সহযোগিতা নিতে পারেন না। বর্তমান সময়ে এসে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।

ঐতিহ্যবাহী প্রথার ক্ষেত্রেও আমরা দেখি নারীকে কিভাবে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেলের প্রধানগণ পুরুষ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল পুরুষ সদস্যরাই উত্তরসূরী হিসেবে বিবেচিত হন।

এছাড়া মৌজা প্রধান হেডম্যান এবং গ্রাম প্রধান কারবারী পদগুলিও পুরুষকেন্দ্রিক। তবে বর্তমানে এর ব্যতিক্রমও কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে।

রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়াচর মৌজা ও শুকরছড়ি মৌজা এবং খাগড়াছড়ি জেলার ১৯৬ নং মাটিরাঙ্গা মৌজার  প্রধান হিসেবে তিনজন নারী হেডম্যান এখনও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তাছাড়া অতীতেও দেখা যায়, ১৮৩২ সালে চাকমা রাজা ধরমবক্স খাঁর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী কালিন্দী রানী দক্ষতার সাথে দীর্ঘ তিন দশককাল রাজ্য শাসন করেছিলেন।

প্রথমদিকে বৃটিশরা রাজ্যশাসনের ভার তাঁর হাতে তুলে দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রানী এর বিরুদ্ধে আপীল করে অবশেষে ১৮৪৪ সালে রানী আইনগতভাবে রাজ্য-শাসনের কর্তৃত্ব অর্জন করেন।

এ-সময় তাকে ক্যাপ্টেন লুইনের মত ঝানু কূট-কৌশলীসহ অনেক বড়-বড় সমস্যাকে কঠোর হাতে মোকাবেলা করতে হয়েছে। কাজেই রাজনীতি ও নীতি-নির্ধারণেও নারীরা যে সাবলীল ও দক্ষ তা অতীতেও প্রমানিত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নারীর অবস্থানঃ

ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর স্বাতন্ত্র ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃটিশ আমল থেকে বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম হয়। পাহাড়ি নেতাদের মতে, এই সংগঠনগুলোর জন্ম ছিল সময়ের দাবী।

এ-সংগঠনগুলো স্ব-স্ব অবস্থান থেকে নিজেদের অস্তিত্বের সংগ্রাম চালিয়ে যায়। বৃটিশ আমলে গঠিত সংগঠনগুলোর মধ্যে ছিল চাকমা যুবক সমিতি (১৯১৫), চাকমা যুবক সংঘ (১৯১৮), পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি (১৯২০), পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সমিতি (১৯৩৯)। পাকিস্তান আমলে হিল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন (১৯৫৬), ট্রাইবেল স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন (১৯৬৫), উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি (১৯৬৬), রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পাটি (১৯৭০) অন্যতম।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ে সারা দেশ যখন উদ্বেলিত তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল আতঙ্কিত। কারন রাজাকার খোঁজার নামে পাহাড়ি গ্রামগুলোর সাধারণ জনগণের উপর সশস্ত্র জোয়ানরা জুলুম ও অত্যাচার করেছিল।

কাপ্তাই বাঁধের ফলে জলমগ্নতার কারনে পাহাড়ি জনগণের উপর যে বিরূপ অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছিল, তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবল বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রোতে পাহাড়িদের স্বাতন্ত্র্য ও অস্তিত্ব আবার বিপন্ন হয়ে পড়ে।

সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য সুস্পষ্ট কোন বিধান রাখা হয়নি বরং আরো অধিক সংখ্যায় বাঙালী সেটেলারদের সেখানে পুর্নবাসন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে গভীর করা হয়েছে।

তাই পার্বত্য অঞ্চলের এই ক্রান্তি মুহূর্তে তৎকালীন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

এছাড়া মহান মুক্তিযুদ্ধে চাকমা রাজা পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় পাহাড়িদের ঢালাওভাবে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং এই অপবাদের অংশ হিসেবে কারনে-অকারনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপর শোষণ, নির্যাতন ও জুলুম; এমনকি পাশবিক নির্যাতন পর্যন্ত করা হয়েছিল।

স্বধীনতার পর সশস্ত্র জোয়ানরা রাজাকার খোঁজার নামে সাধারণ গ্রামবাসী ও নিরীহ জনগণের উপর চড়াও হতো। সেই সাথে মারধর, লুটপাত ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য কাজ চালানো হত।

সারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে এই জুলুম ও অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে জনগণ এর প্রতিকারের পথ খুঁজতে থাকে। যখন সকল নিয়মতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ হয়ে যায় তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ৭ জানুয়ারী গঠন করা হয় পিস ফোর্স বা শান্তিবাহিনী।

পরবর্তীতে এটি জনসংহতি সমিতির আর্মড র্ফোস হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে, শান্তিবাহিনী গঠনের পর হতে সমাজে সামাজিক অনাচার যেমন হ্রাস পেয়েছিলো, এরা মাঠে আসার পরে পুলিশ ও বিডিআর জোয়ানরা আর আগের মতো গ্রামে-গ্রামে ঢুকে নির্যাতন চালাতে সাহস করতো না।

জনসংহতি সমিতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সংগ্রাম করতে গিয়ে যে উপলব্ধি করে তা হল, নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া চুড়ান্ত জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়।

আন্দোলনকে আরো বেগবান করার লক্ষকে সামনে রেখে ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি গঠন করা হয়।

এটি জনসংহতি সমিতির নারী-শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই শাখার জন্ম-লগ্ন থেকেই পাহাড়ি  সাধারণ জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচীতে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিল।

সে-সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় মহিলা পঞ্চায়েতও গঠন করা হয়। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে মহিলা সমিতির সদস্যরা মিলিশিয়া ট্রেনিং প্রাপ্ত (হালকা অস্ত্র পরিচালনা) হয়ে গণ-লাইনের মাধ্যমে (শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, চিঠি-পত্র আদান-প্রদান) বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদান করে জনসংহতি সমিতির সহযোগী সংগঠন হিসেবে ভূমিকা পালন করে।

কিন্তু ভৌগলিক অবস্থান এবং সামাজিক প্রতিকূলতার কারনে নারীদের সব-সময় সশস্ত্র যুদ্ধে সক্রিয় হওয়া সম্ভব ছিলোনা।

তবে এ-সংগঠন দীর্ঘ ২৪ বছর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্দোলনে জড়িত থাকার ফলে প্রকাশ্যে মহিলা সমিতির কার্যক্রম চালানো দূরহ হয়ে পড়ে।

মহিলা সমিতির প্রাক্তন সদস্য মনিতা দেওয়ান জানান, মহিলা সমিতি গঠনের সময় আমাকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছিল।

সে সময় মাধবীলতা চাকমার নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মেয়েদের সাথে মিটিং করতাম এবং মেয়েরা কিভাবে স্বাধীকার আন্দোলনে সহযোগিতা করতে পারে সে-বিষয়ে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতাম।

পার্টির নির্দেশে ১৯৭৮ সালে আমি কুটির শিল্পে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকুরী করতে শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল, চাকুরীর পাশাপাশি গোপনে পার্টির কাজ করা এবং অন্য মেয়েদেরও একইভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা।

প্রতি মাসে বেতনের সমস্ত টাকা দিয়ে পার্টির সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু পরে দেখা গেল পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাকে আর তেমন অবহিত করা হচ্ছিল না।

ফলে এক-সময় আমি পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি এবং স্বাভাবিক জীবনযাপণ করা শুরু করি।

মহিলা সমিতির আন্ডারগ্রাউন্ড কার্যক্রমের ফলে পাহাড়ে ওভারগ্রাউন্ড রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এক-প্রকার অবরুদ্ধই ছিল।

পাহাড়ে সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড তো নিষিদ্ধ ছিলই, তদুপরি সামাজিক কর্মকান্ড চালাতে গেলেও আগে সেনাবাহিনীর অনুমতি নিতে হতো। সে-সময় পাহাড়ি জনগণের ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না।

দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে ঘরের অতিথির তালিকাও স্থানীয় ক্যাম্পে গিয়ে জমা দিতে হতো। এই অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষে ১৯৮৮ সালে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সংখ্যক পাহাড়ি ছাত্রী সংগঠিত হয়ে গঠন করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন।

১৯৯০ এর স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনেও হিল উইমেন্স ফেডারেশন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এরপর থেকে সংগঠনটি সামাজিক অধিকার আদায়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক অধিকার আদায়েও সোচ্চার হয়।

নারী অধিকার আদায় এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে পার্বত্য চট্টগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশন এক নজির সৃষ্টি করে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের গতিশীল নেতৃত্ব পাহাড়ের সকল শ্রেনীর নারীদের এ-সংগঠনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংগঠনটি সফলতার সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পেরেছে এবং দুর্বৃত্তরা শাস্তিও পেয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দোষীরা বরাবরের মতো প্রশাসনের ছত্রছায়ায় থেকে নিজেদের আড়াল করার সুযোগ পেয়েছে এবং এদের কোন বিচার পর্যন্ত হয়নি।

এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে বহুল আলোচিত কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমাকে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৯৬ সালের ১১ জুন রাতে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে অপহরণ করা হয় হয় বলে অভিযোগ আছে।

পরবর্তীতে এর বিরুদ্ধে হিল উইমেন্স ফেডারেশন পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ও বিদেশে প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলে। অব্যাহত প্রতিবাদ এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়।

এ-কমিটি ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সরকারের কাছে রির্পোট পেশ করে। সেই রির্পোট অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি। ফলে দোষী ব্যাক্তিরাও আড়ালে থেকে যায় এবং কেউ শাস্তি পায়নি। আজ পর্যন্ত কল্পনা চাকমার খোঁজ সরকার দিতে পারেনি।

হিল উইমেন্স ফেডারেশন ১৯৯৫ সালে বেইজিং এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব নারী সন্মেলনের এনজিও ফোরামে অংশগ্রহণ করে। সেখানে তারা সামরিকীকরণের ইস্যুটি এবং সামরিকায়িত অবস্থায় আদিবাসী নারীদের উপর যৌন হয়রানির বিষয়টি তুলে ধরেন।

প্রশাসনিক কাঠামোতে পাহাড়ি নারীর অবস্থানঃ

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কাঠামোর অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ।

এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদে নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ রয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোতে ১৯৯৮ সালে সংশোধনী আনা হয়।

এই সংশোধনীর মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোতে তিনজন নারী-সদস্য অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে, যাদের দুজন পাহাড়ি এবং একজন হবেন বাঙালি। জেলা পরিষদ আইনের ধারা ১৬(ক)-তে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।

১৯৮৯ সালের পর জেলা পরিষদসমূহে আর কোন নির্বাচন না হওয়ায় ১৯৯৭ সাল থেকে অন্তর্বর্তীকালীন আইন জারীর মাধ্যমে অদ্যাবধি পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ দ্বারা জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে।

এ- অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদে দীর্ঘ একযুগ ধরে কোন নারী প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।

বর্তমানে যেখানে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়নকে স্থবির করে রেখে দেয়া হয়েছে।

অনুরূপভাবে আঞ্চলিক পরিষদেও তিনজন নারী প্রতিনিধির বিধান আছে তবে তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়।

এছাড়া জাতীয় সংসদে মহিলাদের জন্য ৪৫টি সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে। সেখানেও আইনগতভাবে আদিবাসী নারীদের জন্য কোন কোটা রাখা হয়নি। তবে একজন আদিবাসী নারীকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।

কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, মনোনীত নারী সাংসদ আদিবাসী নারীদের প্রতিনিধিত্ব কতটুকু করতে পারবেন।

বিগত সময়েও তিনি মনোনীত সাংসদ ছিলেন। কিন্তু তার ইতিবাচক কোন ভূমিকা দেখা যায়নি। তাই একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, শুধু সংখ্যালঘুদের কাছে টানার জন্য নয়; বরং সংসদে এমন আদিবাসী নারী প্রতিনিধি থাকা উচিত যারা আদিবাসী নারীদের স্বার্থটাকে সংসদে তুলে ধরে তাদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করতে পারবেন।

এ কথা মনে রাখতে হবে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হলে স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ব্যবস্থায় নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সামাজিক আইনে যেমন পরিবর্তন আনা জরুরী, তেমনি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিবাহ রেজিষ্ট্রি বাধ্যতামূলক করা দরকার।

বর্তমান সময়ে এসে এ-বিষয়গুলিকে আমাদেরকে গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।

সহায়ক গ্রন্থাবলী:

* আল মাসুদ হাসানউজ্জামান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের নারী বর্তমান অবস্থান ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ’ ইউপিএল,২০০২
* হিল উইমেন্স ফেডারেশন সম্পাদিত ‘পাহাড়ের রুদ্ধকন্ঠ’ ১৯৯৯
* হিল উইমেন্স ফেডারেশন সম্পাদিত ‘পাহাড়ের রুদ্ধকন্ঠ’ ২০০৬
* পার্বত্য জেলা আইন সংকলন, জেলা প্রশাসন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, ২০০৫
* পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯
* মেঘনা গুহঠাকুরতা, সুরাইয়া বেগম, হাসিনা আহমেদ সম্পাদিত নারী প্রতিনিধিত্ব ও রাজনীতি, ১৯৯৭
* প্রদীপ্ত খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ১৯৯৬
* আইইডি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ও নারী অধিকার ২০০৬


লেখকঃ ইলিরা দেওয়ান, মানবাধিকারকর্মী। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারন সম্পাদক।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা