পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল : যুগসন্ধিক্ষণ, নানা সমস্যা ও নানা কথা
636
ভূমিকা :
পাবত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এশিয়া মহাদেশ ভূখন্ডে ভারত উপমহাদেশের অন্তর্গত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার শাখা-প্রশাখার পাহাড়-পর্বতময় একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল। ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চল জুম্ম (পাহাড়ী) জাতির আবাসভূমি।
কালের ঘটনাপ্রবাহে এ অঞ্চল এখন প্রধানত ভূমিস্বত্ব ও জনসংখ্যাগত ভারসাম্য পরিবর্তনের মাধ্যমে জুম্ম জাতির আবাসভূমির বৈশিষ্ট্য হারাবার চড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সাথে স্বকীয় ভাষা ও সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা শাসন সংক্রান্ত কর্তৃত্ব হারিয়ে অচিরেই বিলুপ্তির দিকে অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
এর পেছনে শাসকগােষ্ঠীর নীতি বা পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রেখে চলেছে। আর এ নীতি বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সহায়তা দিয়ে। চলেছে ক্ষুদ্র স্বার্থে নিমগ্ন জুম্ম জাতির মধ্যেকার আত্মঘাতী বিভেদ নীতি। ফলে জুম্ম জাতির জাতীয় জীবনে দেখা দিয়েছে চরম সন্ধিক্ষণ এবং সর্বক্ষেত্রেই উদ্ভূত হয়ে চলেছে নানা সমস্যা ও নানা কথা।
ভূমি ও ভূমিস্বত্ব :
এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, অবিভক্ত চট্টগ্রাম (চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলা) অধিকাংশ সময় ধরে আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। উক্ত আরাকান রাজ্যে শাক্য রাজা তাঁর প্রজাগণসহ গৌতম বুদ্ধের জন্মের পূর্ব থেকে বসবাসরত ছিলেন এবং রাজত্ব করতেন৮। ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা। (পরবর্তীকালে শাক্য রাজা চাকমা রাজা নামে খ্যাত হন) ও
অধিকাংশ চাকমা নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ তথা মাতামুহুরী উপত্যকায় অর্থাৎ এক সময়কার আরাকান রাজ্যভুক্ত উত্তরাংশে প্রত্যাগমন করেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে গহীণ অরণ্য আবাদ করতে করতে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত ফেণী উপত্যকা পর্যন্ত বসতি গড়ে তুলে।
তখনকার সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের পাশেই ছিল খাসিয়া ও গারােদের রাজ্য। আর এর পাশে ছিল অহােম (আসাম) রাজ্য ও এর পশ্চিম পাশে কোচ রাজ্য। এ সব পাহাড়ী রাজ্যে তখনাে পর্যন্ত বসবাসরত ছিলেন কেবল সংশ্লিষ্ট পাহাড়ী জাতির লােকজন। আর বিজাতি শাসিত বঙ্গ বা বাংলার পূর্ব সীমানা ছিল মেঘনা নদী পর্যন্ত৯।
এ বঙ্গ বা বাংলা থেকে মূলত অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির লােকজন যারা ততক্ষণে বাঙালী হিন্দ বা বাঙালী মুসলমান নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তারা তখনাে উক্ত প্রতিবেশী পাহাড়ী রাজ্যসমূহে বর্তমান কালের মতাে ছড়িয়ে পড়েন নি।
সমুদ্রোপকূলবর্তী চট্টগ্রাম বন্দর বা তদৃসন্নিহিত পূর্ব বা পশ্চিম দিকের সমদ উপকুলের ক্ষুদ্র এলাকা চট্টগাম বা ফতেয়াবাদ বা অন্য কোন নামে কখনাে কখনাে সাময়িক কালের জন্য ভারতবর্ষের কিংবা এর আওতাভুক্ত বাংলার শাসকদের অধিকারভুক্ত হয়ে পড়ে। তাই, বলে চাকমা রাজা বা আরাকান রাজার শাসনাধীন রাজ্য কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ও চট্টগ্রামের।
সম্পর্ণ অঞ্চল কখনাে স্থায়ীভাবে ভারতের বা বাংলার শাসকদের শাসনাধীন ছিল না। আর বাংলাও ভারতবর্ষের বিজাতীয় বা অবাঙালী শাসকদের শাসনাধীন হলেও দূরগম্যত্যর কারণে কদাচিৎ প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল।
আজকালকার দিনের মতাে সে যুগে অবশ্য স্থায়ীভাবে শাসন। সতষ্ঠা করবার তেমন কোন প্রয়ােজন ছিল না। প্রয়ােজন ছিল কেবল কর-খাজানা পাবার। ভারতবর্ষের মােগলগণ ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা জয় করেন এবং ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে মােগলগণ সে সময়কার সমুদ্রোপকূলবর্তী চট্টগ্রাম ও তদ্সংলগ্ন সন্দ্বীপ অধিকার১০ করেন।
তবে তা বেশী দিন ধরে রাখতে পারেন নি। পরে “১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় বাংলার কিয়দংশ আকবর শাহে’র সনাধীন হয়। আকবর বিচার, শাসন ও রাজস্ব আদায়ের বন্দোবস্ত করেন। এতে বিহারে ভীষণ বিদ্রোহের সুচনা হয় এবং ক্রমে বাংলা ও বিহার হতে আকবর শাহের আধিপত্য তবাহিত হয়।”১১
দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার কারণে মােগল বাদশাহগণ বিলাস-ব্যসনে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। নেতৃত্ব হয়ে পড়ে অত্যন্ত দুর্বল। স্বাধীন হয়ে যায় বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চল। তা বজায় থাকে পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বা ব্রিটিশ ভারত সরকারের শাসনাধীন না হওয়া পর্যন্ত। “ ১৫২৬ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত ১৮১ বছর মােগল সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল।
এ রাজবংশের ছয়জন বড়াে শাসক ছিলেন, তাদের শাসন শেষ হলে সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এ সব বিচ্ছিন্ন অংশ থেকে শিখ, মারাঠা এবং অন্য অনেক নূতন রাজ্য গড়ে উঠে।”১২ ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যখন বাংলার নবাবকে পরাস্ত করেন তখন বাংলার নবাব ছিলেন কার্যত স্বাধীন। স্বাভাবিকভাবে, উক্ত সময়কালে বা এর আগে থেকে বাংলার পশ্চাদ্ভাগে অবস্থিত চাকমা রাজ্যও ছিল স্বাধীন১৩।
চাকমা রাজার সাথে মােঘল বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছিল। শেষে ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজার সাথে মােঘলদের এক চুক্তি হয়। উক্ত চুক্তির মূল বিষয় ছিল-চাকমা রাজার প্রজাগণ মােঘল অধিকারভুক্ত চট্টগ্রামস্থ সমতল এলাকার হাটে-বাজারে তুলা, তিল ইত্যাদি দ্রব্য বিক্রয়ের এবং লবণ, কেরােসিন ইত্যাদি পণ্য ক্রয়ের সুবিধা পাবার বিনিময়ে চাকমা রাজা কর্তৃক বাৎসরিক নির্দিষ্ট হারে ‘পণ্য শুল্ক’ প্রদান করতে হবে। চাকমা রাজা পণ্য শুল্ক দিতেন।
আর স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন নিজের আওতাভুক্ত রাজ্যে। তাই দেখা যায় যে, ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগীজ ঐতিহাসিকের অঙ্কিত মানচিত্র অনুযায়ী চাকমা রাজ্যের সীমানা ছিল দক্ষিণে নামে বা নাফ নদী, উত্তরে ফেনী নদী, পূর্বে কুকি রাজ্য ও পশ্চিমে সমুদ্র (অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর)১৪। পরে আরাকানের রাজা শঙ্খ নদীর দক্ষিণ তীর পর্যন্ত দখল করেন।
তাই, ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজ্যের সীমানা ছিল দক্ষিণে শঙ্খ নদী, উত্তরে ফেনী নদী, পশ্চিমে নিজামপুর রােড (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রােড) ও পূর্বেকুকি রাজ্য১৫। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলে (অর্থাৎ ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজ্যকে ব্রিটিশ ভারত শাসনের আওতাভুক্ত করবার পূর্ব পর্যন্ত) চাকমা রাজার নিকট হতে পণ্য শুল্ক গ্রহন নীতি অব্যাহত থাকে এবং আভ্যন্তরীণ শাসন কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন হস্তক্ষেপ করা হয় নি।
তবে, পণ্য শুল্কের পরিমাণ ও রাজ্য সীমানা নিয়ে সতেরােশাে সঙুর ও আশি দশকে কোম্পানীর সাথে চাকমা রাজার মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে তা অবসান হয়। ঠিক হয় পণ্য শুল্ক সংগ্রহের জন্য কোম্পানী কোন মধ্যস্বত্বভােগী বা ইজারাদার (Speculator) নিযুক্ত করবে না।
কোম্পানী তখন থেকে চাকমা রাজা কাছ থেকেই সরাসরি পণ্য শুল্ক গ্রহণ করতে থাকে ও চাকমা রাজার শাসন অধিকার মেনে নেয়। এ সম্পর্কে শ্রী এস, পি, তালুকদার চট্টগ্রামের কমিশনার-এর মতামত উল্লেখ করে লিখেছেন। Again, in 1829, Mr. Halhed, the Commissioner reaffirmed that “the hill tribes were not British subjects.’১৬
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত সরকার চাকমা রাজার শাসনাধীন রাজ্যকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে এবং সে সময়ে ব্রিটিশ ভারতের শাসনাধীন বাংলা প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত চট্টগ্রাম (ইংরেজীতে Chittagong) জেলার সাথে সংযুক্ত করে। তখন বাংলা প্রেসিডেন্সি ব্রিটিশ ভারতের সাধারণ আইনের অধীনে শাসিত ছিল।
স্বাভাবিকভাবে Chittagong জেলা তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ও ব্রিটিশ ভারতের শাসনামলে অন্যতম সাধারন আইন হিসাবে প্রযােজ্য District Act, 1836 (Act XXI of 1836)১৭ অনুযায়ী শাসিত হতে থাকে। উক্ত সাধারণ আইনের আওতায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও অপরাপর জাতির লােকদের অধিকারের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব ছিল না।
অচিরেই চট্টগ্রাম জেলা সমতলবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত হয়। এ সব জাতি চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমি ও ভূমি স্বত্ব হারিয়ে ফেলে। ব্রিটিশ ভারত সরকার ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে Bengal Act XXII of 186018 ১৮বলে Chittagong District থেকে আলাদা করে গহীণ অরণ্য ও পাহাড়-পর্বতময় অঞ্চল নিয়ে ‘Chittagong Hill Tracts’ নামে একটি আলাদা জেলা সৃষ্টি করে।
অতঃপর ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত ‘ভারত শাসন আইন, ১৮৭০’ এর আওতায় ‘তফসিলভুক্ত জেলা আইন, ১৮৭৪’ এর অধীনে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অপরাপর আঞ্চলের পশ্চাদপদ অধিবাসীদের ভূমি অধিকার সুরক্ষিত করা হয়ে থাকে। এরপরে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০’ অনুসারে পাহাড়ী অধিবাসী নয় এমন ব্যক্তির নিকট ভূমি হস্তান্তর ক্ষেত্রে বাধা নিষেধ আরােপ অব্যাহত থাকে।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগ হয় ‘ভারত স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭’ অনুসারে। উক্ত আইনে বর্ণিত হয় যে, দেশ স্বাধীন হবার পরে নিজস্ব সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ‘ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫’ এবং এর আওতাধীন বিধানাবলী কার্যকর থাকবে। উক্ত আইন বলে দেশ বিভাগােত্তরকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০’ বলবৎ থাকে এবং পাকিস্তানের প্রথম ও দ্বিতীয় শাসনতন্ত্র অনুযায়ী তা বহাল থাকে।
কিন্তু, পাহাড়ী অধিবাসীদের ভূমি ও ভূমিস্বত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ দ্বারা অবৈধভাবে সমতলবাসী অধিবাসীদেরকে ভূমি হস্তান্তরের প্রেক্ষিতে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দেশ স্বাধীন হলে উক্ত একই শাসনবিধি প্রচলিত আইন হিসেবে কার্যকর থাকে। তবে ভূমি জবর দখল বেড়ে যায়। ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত ভূমি মালিকানাস্বত্ব হয় পদদলিত। এ লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ভূমি, ভূমিস্বত্ব সংরক্ষণের ও পুনরুদ্ধারের জন্য বিধান রাখা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলােকে প্রণীত রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে এ সব জেলা পরিষদের পূর্ব অনুমােদনক্রমে ভূমি হস্তান্তরের বিধান করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ বিধান সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় ও বন মন্ত্রণালয়-এর কোন কোন কর্মকর্তা যথাযথভাবে অনুসরণ করেন নি বা অদ্যাবধি করছেন না।
তাই, অবৈধভাবে ভূমি ইজারা প্রদান ও বনাঞ্চল ঘােষণা এখনাে চলছে। সরকারের বিভিন্ন স্তরের প্রশাসনযন্ত্রের সহায়তায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগতভাবে ভূমি জবর দখল চলছে। চুক্তি উত্তরকালে অধিকতর সংখ্যায় যুক্ত হয়ে পড়েছে। জাতীয় সরকার পর্যায়ের প্রশাসনে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কর্মকর্তা এবং কিছু এনজিও।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে নানা স্তরের স্থানীয় পাহাড়ী ভূমি টাউটগণ বা কোন কোন ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক দল বা গ্রুপের স্থানীয় নেতা ও কর্মীগণ বা ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত কোন কোন সরকারী বা পরিষদীয় কর্তৃপক্ষ।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে পাহাড়ী নয় এমন কোন ব্যক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিস্বত্বের অধিকারী ছিলেন না। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগে পাহাড়ী নয় এমন মাত্র কতিপয় পরিবার ভূমিস্বত্ব লাভ করেন। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে চুক্তির পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাষযােগ্য সমতলভূমি ও আবাদ হওয়া টিলা বা পাহাড়ী ভূমির প্রায় ৪০ শতাংশ পাহাড়ী নয় এমন ব্যক্তির মালিকানাধীন বা দখলাধীন ছিল।
আর বর্তমানে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশে। বিশেষ করে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সমতল চাষযােগ্য ভূমির প্রায় ৭০ শতাংশ পাহাড়ী জাতির লােকদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক দশকে এমনকি দুর্গম এলাকার টিলা বা পাহাড়ও আর তাদের দখলে থাকছে না।
এর পরে রয়েছে খাগড়াছড়ি। এ পার্বত্য জেলায় সমতল চাষযােগ্য ও নিচু টিলা বা পাহাড়ের পরিমাণ বেশী। এখানে উনিশশাে আশি দশকে স্থান্তান্তরিত বাঙালী সেটেলার সংখ্যাও বেশী। স্বাভাবিকভাবে, সরকারী প্রশাসনের সহায়তায় ছলে-বলে-কৌশলে সেটেলাদের দ্বারা ভূমি জবর দখল প্রক্রিয়াও অধিকতর জোরদার হয়েছে এবং জবর দখল চলছেও বেশী।
এ পর্যন্ত এ জেলার সমতল চাষযােগ্য ভূমির প্রায় ৫৫ শতাংশ ভূমি পাহাড়ী অধিবাসীদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার সমতল চাষযােগ্য অধিকাংশ ভূমি কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ডুবে যায়। সেখানেও হ্রদের পানি কমে গেলে যে সব জমি চাষ করা যায় সে সব জলেভাসা জমি (Fringe Land ) জবর দখল অব্যাহত রয়েছে। এ পার্বত্য জেলায় সমতল চাষযােগ্য ভূমির। প্রায় ৪০ শতাংশ স্থানীয় পাহাড়ী অধিবাসীদের হাত ছাড়া হয়ে গেছে।
চুক্তির আওতায় প্রণীত ‘পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১ সংশোধন হতেও পারে। এ বিষয়ে ১৬ জানুয়ারী ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির সভাপতির সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলােচনা হয়। ২২ জানুয়ারি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে তিন সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি সভায় উক্ত আইন সংশােধনের জন্য পুনরায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
অবশ্য এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ প্রদত্ত ২৩ (তেইশ) টি সুপারিশের (চৌদ্দ) টি সুপারিশ সরকার পক্ষ কর্তৃক গৃহীত হয়। ঐ ১৪ টি সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে পার্বত্য মন্ত্রণালয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১২’ বিল-এর খসড়া প্রস্তুত করে ও ২০ জুন ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে ভূমি মন্ত্রণ প্রেরণ করে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে তা আটকে যায়। অনেক টানা-পােড়েনের পরে ভূমি মন্ত্রণালয় তা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিবীক্ষণ কমিটির নিকট পাঠিয়ে দেয় সিদ্ধান্ত পাবার জন্য। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে উক্ত আইন পার্বত্য মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় প্রক্রিয়াকরণ করবে এবং ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাসে চলমান জাতীয় সংসদ অধিবেশনে তা সংশােধনের ব্যবস্থা হবে।
এ কমিটি পার্বত্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত খসড়া বিল-এ অন্তর্ভত এবং আঞ্চলিক পরিষদ হতে ০৭ মে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রদত্ত ২৩ (তেইশ) টি সুপারিশের মধ্যে ১৪ (চৌদ্দ) টি সুপারিশ ভূমি কমিশন আইন সংশােধনের জন্য গ্রহণ করে। এর আলােকে অঞ্চলিক পরিষদ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। ভূমি কমিশন আইন সরকার সংশোধন করবে কিনা তা এখনো সঠিকভাবে বলা যায় না। যদি সংশোধন হয়ে থাকে তাহলে ভূমি কমিশন কাজ করতে পারবে। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়-হারানো ভূমি কতটুকু ফেরত মিলবে।
এক কথায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও ভূমিস্বত্বের ক্ষেত্রে চরম সন্ধিক্ষণ চলছে। এ ভূমি ও ভূমিস্বত্বের অবস্থার উপরই মূলত নির্ভর করছে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব। এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ভিত্তিতে কোন না সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতায় পাহাড়ীদের অংশীদারিত্ব লাভ হতে পারে।
অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা মিলতে পারে। কিন্তু, ভূমি ও ভূমিস্বত্ব একবার হাত ছাড়া হয়ে গেলে তা আর ফিরে আসবে না সহজে। তাই, যারা সচেতন ও সংগ্রামী তাদের উচিত ভূমি ও ভূমিস্বত্ব ধরে রাখবার জন্য সর্বাত্মকভাবে বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এ বিষয়ে কোন প্রকার আপােষ করা বা শিথিলতা প্রদর্শন সমীচিন নয়।
ভূমি নিজেদের হাতে থাকলে পাহাড়ীগণ নিজেদের ভূমিতে থাকতে পারবেন আর নিজেদের ভূমিতে থাকতে পারলে ব্যক্তি বা পরিবার হিসেবে তাদের অস্তিত্ব থাকবে, জাতি হিসেবে অস্তিত্ব থাকবে। আরাে স্মর্তব্য যে, দেশে ক্রমে গণতান্ত্রায়ণ অবশ্যই হবে এবং হতে বাধ্য। সে প্রক্রিয়ায় জুম্ম জনগণ গণতান্ত্রিক শাসন ও অধিকার পেয়ে যেতে পারবে। তাই ভূমি বিষয়ে চাকমা প্রবাদে প্রবাদ বর্ণিত ‘ঝুল থাক্কে ঘাধঅ আর অক্ত থাক্কে হাদঅ’ (ঝোল থাককে নাড় আর সময় থকতে হাঁটো) প্রবাদ অনুসরণ অপরিহার্য।
শাসন ক্ষমতা
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ ভারতের অধিকারভুক্ত করবার সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চাকমা রাজা ও বােমাং রাজার শাসনাধীন ছিল। ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হবার পরে ডেপুটি কমিশনারের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পিত হয়।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রমে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত ‘টেরিটোরিয়্যাল সার্কেল রুলস’ অনযায়ী রাজাগণ সার্কেল চীফ হিসাবে আখ্যায়িত হন। আর ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত মৌজা বেজা অনুসারে মৌজা প্রধানগণ হেডম্যান নামে আখ্যায়িত হন।
জাতীয় সামাজিক রীতি-প্রথা অনুযায়ী বিচার কার্য সম্পাদন বাদে শাসন কার্য পরিচালনা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের সকলের ক্ষমতার বিভাজন হয় আরো একবার। বাংলাদেশ আমলে প্রবর্তিত হয় উপজেলা ব্যবস্থা। সৃষ্টি হয় আরাে একটি প্রশাসনিক একক। চুক্তি উত্তরকালে গড়ে উঠে পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্বলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা।
সর্বোপরি সংঘাতকালীন সময়ে নিয়ােজিত হয় সেনাবাহিনী। অর্পিত হয় ছলে-বলে-কৌশলে জুম্ম জাতির আন্দোলন দমন করবার দায়িত্ব। দেওয়া হয় অসীম ক্ষমতা। চক্তি উত্তরকালেও তাদেরকে সে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়নি সরকার। বলা যায়, সরকার শান্তি প্রক্রিয়া অনুসরণের পরিবর্তে যুদ্ধমান ধারাকেই ধরে রেখে দেয়। সরকার সােবাহিনীকে অধিকারকামী জুম্ম জনগণ বা জুম্ম নেতৃত্বের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখে।
তাই, পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসন কর্তৃপক্ষ বলতে বর্তমানে রয়েছে – জুম্ম জাতির ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান হিসাবে সার্কেল চীফ, হেডম্যান ও কাবারীগণ, ব্রিটিশ শাসনমলে বিশেষ আইনের অধীনে স্থাপিত ডেপুটি কমিশনার ও তার অধীনস্ত প্রশাসন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আওতাধীনে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্বলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থা, সরকারের সাধারণ আইনের আওতায় স্থাপিত উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নামের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি রয়েছে সেনা কর্তৃপক্ষ। এ সব বহু কর্তৃপক্ষ সম্বলিত শাসন ব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ করবার জন্য চুক্তির ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বা ধারায় আইনের সংশােধন, প্রণয়ন ও বাতিলের বিধান রয়েছে।
চুক্তির উক্ত বিধান অনুসরণে সেনাবাহিনীকে যে আইন অনুযায়ী নিয়ােগ করা হয়েছে সে আইন তুলে নেওয়া সমীচিন। ৬ (ছয়) টি স্থায়ী সেনানিবাস (অর্থাৎ ৩ টি জেলা সদরের ৩ টি সেনানিবাস এবং রুমা, আলিকদম ও দীঘিনালা সেনা নিবাস), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-এর ১৫০ এর অধিক ক্যাম্প বাদে অস্থায়ী সেনা, আনসার ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প তুলে নেওয়া যেতে পারে।
চুক্তির উক্ত বিধান বলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি সংশােধন করে এবং স্থানীয় সরকার পরিষদ আইনসমূহে প্রয়ােজনীয় বিধান সংযােজন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্বলিত বিশেষ শাসন ব্যবস্থার সাথে সংগতি সাধন করা যেতে পারে। অথচ, সরকার তা এখনাে করে নি। করাও সহজ নয়।
এ দেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মানসিকতা এমনিতে কম। তদুপরি মােলবাদী ও উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী ধারণা শক্তভাবে সক্রিয় রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসন ক্ষমতার ৩০ শতাংশ জুম্ম জাতির আওতাভুক্ত হলেও অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ তাদের আওতার বাইরে।
পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে নির্বাচিত তিন জন জাতীয় সংসদ সদস্য আংশিকভাবে নিরপেক্ষভাবে জন্ম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের অনুকূলে দায়িত্ব পালন করতে পারলেও পরিপূর্ণভাবে সম্ভব নয়, আঞ্চলিক পরিষদ তার নিজস্ব দায়িত্বের মাত্র ৩০ শতাংশ পালন করতে পারছে, পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ মাত্র ২৫ শতাংশ দায়িত্ব পালন করতে পারছে। ২৫ টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে প্রায় ১৮ টিই স্থায়ী অধিবাসীদের অনুকূলে দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক।
ইউনিয়ন পরিষদ ও পারসভাসমূহর অবস্থাও তথৈবচ। চক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এর ভারসাম্য হয়তাে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ছিল। তা হয়নি। পরিবর্তে বিভিন্ন অনিয়মের সুযােগে শাসন ক্ষমতায় এ ভারসাম্য পরিবর্তনের ধারা উল্টো দিকে প্রবাহিত হবার সকল পরিবেশ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
তাই শাসন ক্ষমতার এ ভারসাম্য যাতে উল্টোদিকে প্রবাহিত না হয় অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা স্থায়ী অধিবাসী তাদের হাতে যাতে যথাযথ পরিমাণের শাসন ক্ষমতা দেওয়া যায় সে লক্ষ্যে চুক্তির সংশ্লিষ্ট বিধান কার্যকর করবার জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে সকলেরই অর্থাৎ সরকারী কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট পরিষদ এবং বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের মধ্যে যারা পরম দূরদর্শিতায় চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন, হীন স্বার্থ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন এবং লােভ, হিংসা ও অহেতুক অহংবােধ ত্যাগ করে জাতীয় তথা সামগ্রিক স্বার্থে সংগ্রাম করতে অকৃত্রিমভাবে আন্তরিক রয়েছেন তাদেরকে সর্বাগ্রণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট এদের তালিকাভুক্ত ৩৩ (তেত্রিশ) টি কার্যাবলী বা বিষয়-এর মধ্যে এযাবৎ মাত্র ১২ টি বিষয়-এর ২১ টি দপ্তর বা প্রতিষ্ঠান হস্তান্তর হয়েছে।
অবশিষ্ট ১৯ টি বিষয় এবং এসব বিষয়ের আওতাভুক্ত ৪৮ (আটচল্লিশ) টি প্রতিষ্ঠান বা দপ্তর হস্তান্তরের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য মন্ত্রণালয় যাতে আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কার্যাবলী সম্পাদন করতে পারে তা দেখতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী অধিবাসীগণ যাতে চাকুরীতে নিয়ােগ পান তার নিশ্চয়তা বিধান করা। তা না হলে আইনে যতই ভাল বিধান বা ব্যবস্থা বা অধিকার থাকুক না কেন তা কখনাে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত বা কার্যকর হবে না।
তবে, স্মর্তব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ বড় বিচিত্র ধরনের হয়ে থাকেন। তারা মধ্যবর্তী বিধায় যে কোন সময় উপরের দিকের মানুষের অনুকুলেও যেতে পারেন। আবার নিচের দিকের মানুষের দিকেও ঝুঁকতে পারেন। অথচ, তাদের উপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন চাকুরীতে দায়িত্ব গ্রহণ করা নির্ভর করছে।
বলা যেতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে মােট ৭ (সাত) টি পদে বা চাকুরীতে বিসিএস কেডারভুক্ত সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী হতে যুগ্ম-সচিব পর্যায়ভুক্ত ৭ (সাত) জন কর্মকর্তা আবশ্যক।
অথচ, সে সব পদে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাস হতে মাত্র একজন সিনিয়র সহকারী সচিব পদ-মর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের অবস্থাও এ ক্ষেত্রে খুব ভাল নয়। এ সব পদে জুম্ম কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে এখনাে এ সব পরিষদে কাজ করতে রাজী নন। কারণ, বহুবিধ হতে পারে।
তবে, মূল কারণ হল তা কোন না কোনভাবে নিজেদের সুবিধামত নয়। তা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চলতে পারে না। এ অবস্থাকে কিভাবে দেখা যেতে পারে তা সমাজের উচিত মূল্যায়ন করা এবং তা সমাধানের প্রচেষ্টা চালানাে। তবে, যারা সচেতন ও কার্যক্ষম তাদের সকলেরই উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকুরীতে যাতে স্থায়ী অধিবাসীগণের নিয়োগকে নিশ্চয়তা বিধান করা যায় সে বিষয়ে সকল উপায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
ভাষা ও লিপি :
বাংলাদেশ সংবিধান বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করেছে। অপরাপর ভাষা চর্চা ও বিকাশর পথ প্রশস্ত না হলেও নিষিদ্ধ নয়। মৌলবাদী ও উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা যে সৃষ্টি করে নি তা বলা যায় না। তবে জুম্ম সমাজে যারা নিজেদেরকে উন্নত ও উঁচ স্তরের মনে করেন তারা স্ব স্ব জাতির ভাষা লালন পালনে অনেক সময় অনীহা বােধ করেন অথবা কতেক ক্ষেত্রে অবজ্ঞা দেখান।
সংঘাতকালীন সময়ে সরকারী কর্তৃপক্ষের জন্ম বিরােধী অভিযানকালে তা আরাে উৎসাহিত হয়ে উঠে। চুক্তি উত্তরকালে এ অবস্থা অবসানের সযােগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রচেষ্টা চলছে। সংস্কৃতির বেলায়ও তা চলছে।
ভাষা মানুষের ভাব বা অভিব্যক্তি প্রকাশের মাধ্যম। ভাষা স্বকীয় জাতি পরিচিতির মূল উপাদান। ভাষা হারানাে মানে স্বীয় জাতি পরিচিতি হারানাে। জুম্ম জাতি এখন ভাষাগত ক্ষেত্রে এক কঠিন সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভাষা-ভাষী পাহাড়ী জাতি যাতে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারে এমন কোন স্বতন্ত্র ভাষার উদ্ভাবন বা বিদ্যমান কোন পাহাড়ী ভাষার যথার্থ বিকাশ হয় নি।
ফলে বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাহাড়ীদের সব ভাষাই বাংলাকরণের পথে এগিয়ে চলেছে। আর তা ঘটছে বিশেষ করে শিক্ষিত ও সমাজের উচ্চ স্তরের ব্যক্তিদের মাধ্যমে। শুধু তা নয় যে সব পাহাড়ী জাতির নিজস্ব লিপি ও নিজস্ব ভাষা রয়েছে সেগুলাের ব্যবহার বিশেষ করে লিপির ব্যবহার বন্ধ হয়ে রয়েছে।
এমনকি কোন কোন ভাষা চর্চাকারী বেসরকারী সংগঠন বিনা গবেষণায় মনগড়াভাবে লিপি ব্যবহার করে পুস্তক ছাপিয়েছে বা ছাপাবার প্রচেষ্টা করছে। ইতােমধ্যে গণনার অঙ্কগুলােকেও বিশেষ করে চাকমা ভাষার অঙ্কগুলােকে নানাভাবে লিখে চলেছেন।
অথচ, চাকমাদের ১ (এক) থেকে ১০ (দশ) পর্যন্ত অঙ্ক এখনাে রয়েছে১৯। আর এ সব অঙ্ক দিয়ে সহজে শতকিয়া পর্যন্ত সব সংখ্যা লেখা যেতে পারে। ভাষাবিদদের মতে সাধারণত প্রতি ১০ (দশ) মাইল অন্তর ভাষার ব্যতিক্রম ঘটে২০। তবে, প্রতিষ্ঠিত লিখিত ভাষা থাকলে তাতে তেমন কোন অসুবিধা হয় না। আর না হয় এ ভাষাগত ব্যবধানই নানা ধরনের পার্থক্য গড়ে তুলে।
“ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন রূপ ভাষা গড়ে উঠেছে। ভাষাতত্ত্ববিদদের হিসেবে পৃথিবীতে কয়েক সহস্র ভাষা বর্তমান। তার মধ্যে একমাত্র ভারতে ভাষা ও উপ-ভাষার সংখ্যা হল তিন সহস্রাধিক।”২১
ভাষাতত্ত্ববিদগণের মতে ভারতের ভাষাসমূহ প্রধানত চারটি পরিবার হতে উদ্ভূত। সেগুলি হল যথাক্রমে ইন্দো-ইউরােপীয়, দ্রাবিড়ীয়, অস্ট্রো-এশীয় ও ভােট-চীনীয়।২২
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সাঁওতাল, মুন্ডা, হো প্রভৃতি অস্ট্রিকভাষীগণ প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগ হতে বসবাস করে আসছে। সম্ভবত এরা ভারতের প্রাচীনতম অধিবাসীদের অন্যতম। এদের পরে দ্রাবিড়গণ ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে। আর্যগণ মধ্য এশিয়া হতে দলে দলে তরঙ্গের ন্যায় ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ধীরে ধীরে শত শত বৎসর ধরে ভারতে অনুপ্রবেশ করে।২৩
ভাষাতত্ববিদ ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের (Chatterji, S.K. – The Indian Synthesis Racial and cultural, Bombay, 1958, p. 13) মতে মঙ্গোল জাতীয় ব্যক্তিরা, যারা কিরাত নামে আভহিত হত, আর্যদেরও পূর্বে ভারতে প্রবেশ করে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নাগা, মিজো, লাডাকী , ভুটিয়া, ত্রিপুরী, মণিপুরী প্রভৃতি ভাষাগােষ্ঠী ভােট-চীনীয় পরিবারভুক্ত।২৫
মূলতঃ একই ভাষা পরিবার হতে উদ্ভুত হলেও ঐতিহাসিক কারণে ও ভিন্নতর ভৌগলিক পরিবেশের ফলে কোন এক ভাষা পরিবার বিভিন্ন ভাষা পরিবার, শাখা, বর্গ প্রভৃতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।২৬
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের ভাষা মূলত ভারতীয় ভাষার পরিবারভুক্ত তিব্বেতাে-বর্মণ ও ভােট-চীনীয় বৰ্গভুক্ত ভাষা। আদিকাল থেকে লিপি মানুষই উদ্ভাবন করে এসেছে। “খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে মিশরীয়রা ছবি এঁকে লেখার লিপি উদ্ভাবন করে। এই পদ্ধতিকে বলে হায়েরােগি- ফ (Hieroglyph), বাংলায় চিত্রলিপি।
প্রায় ৭৫০ টি চিত্রলিপি-চিহ্ন দিয়ে এই প্রাচীন মিশরীয় লিপি পদ্ধতি তৈরী হয়েছিল। পাপিরস গাছের কান্ড পাতলা করে চেলাই করে তার উপরে আঁঠা দিয়ে পাতা সাঁটতাে। তার উপরে লিখতাে।২৭
খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে মেসােপটেমিয়ায় কীলক লিপি (ইংরেজীতে বলে Cuneiform – কিউনিফর্ম) আবিষ্কার হয়।২৮ ফিনিসিয়রা আবিষ্কার করে মিশরীয়দের মত চিত্রলিপি। বর্ণমালা আবিষ্কার করলাে মােট ২২ টি।২৯ চীনের জনগণ খ্রীষ্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দে তাদের লিপি উদ্ভাবন করেছিল। অক্ষর হিসেবে তারা ব্যবহার করতাে চিত্রলিপি বর্ণমালা।৩০
সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কালে গ্রীসে যে লিপি চালু ছিল খ্রী পূ: ২য় সহস্রাব্দের শেষ দিকে তার প্রচলন উঠে যায়। হােমারীয় যুগের শেষ ভাগে ফিনিসীয়দের লিপির সাথে গ্রীকরা পরিচিত হয়। ব্যঞ্জন বর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যুক্ত হরে গ্রীকরা মােট ২৪ টি অক্ষরের বর্ণমালা উদ্ভাবন করে।”৩১ খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের অবলুপ্ত লিপির বদলে ভারতে নতুন লিপি দেখা দিল। ফিনিসীয় বর্ণমালার ভিত্তিতেই ভারতীয়রা তাদের বর্ণমালা আবিষ্কার করেছিল।৩২
“প্রাচীন কালে …সর্বত্রই সংস্কৃত, প্রাকৃত ও দেশীয় ভাষা সবই এক রকম অক্ষরে লিখিত হইত, দেশ ও কাল অনুসারে তাহার ভিন্ন ভিন্ন রূপ ছিল। কেবলমাত্র সংস্কৃত লেখার জন্য কোন পৃথক অক্ষর ব্যবহৃত হইত না।”৩৩
সুতরাং, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সব জাতিসমূহের নিজস্ব লিপি হারিয়ে গেছে তারা হয় রােমান হরফ ব্যবহার করতে পারেন অথবা প্রাচীন ভারতীয় প্রাচীন লিপি অর্থাৎ ব্রাক্ষী লিপির আদলে নিজেদের ভাষার উপযােগী হরফ উদ্ভাবন করতে পারেন। উল্লেখ্য, উনিশ্শাে আশি দশকে ম্রো (মুরুং) ভাষার লিপি আবিস্কার করে ম্রো জাতির ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মােচিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জাতিসমূহের বিভিন্ন ভাষা ও লিপির ক্ষেত্রে চলছে এক অনিশ্চিত সন্ধিক্ষণ। এ বিষয়ে বিজ্ঞজন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনােযােগ আবশ্যক। তবে, প্রাত্যাহিক জীবনে স্ব স্ব ভাষাকে ব্যবহারের জন্য মা-বােনদের ভূমিকা অপরিহার্য। তারা যদি ছােট শিশুদেরকে স্ব স্ব ভাষায় কথা বলার ও লেখাপড়া শিখার জন্য উৎসাহিত করেন তাহলে তা অনেকটা সহজতর হতে পারে।
সাথে সমাজের উচ্চ স্তরের ব্যক্তিবর্গের সচেতন পৃষ্ঠপােষকতা আরাে সুফল বয়ে আনতে পারে। স্মর্তব্য, কবি মাইকেল মধু সুদন দত্ত প্রথমে ইংরেজী সাহিত্য চর্চা করতে গিয়েও পরে মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য চর্চা করেছিলেন এবং বলেছিলেন ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি মনের আশা ?’
অর্থনীতি :
বিশ্বে বহু আগেই অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাল সে বিষয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। পরিশেষে, উনিশ্শাে নব্বই দশকে সােভিয়েট সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এর আওতাভুক্ত ১৫ টি সােভিয়েট সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র স্বাধীন হয়ে যায়। এর ধারাবাহিকতায় পূর্ব ইউরােপের দেশসমূহ থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলে যায়। এশিয়ার চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া, লাওস ও উত্তর ইয়েমেনে সংস্কার সাধিত হয়।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে আমেরিকায় নিউইয়র্কের টুইন টাউয়ারের উপর ইসলামিক মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। এর পরে বিশ্বের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির উপর চরম প্রভাব পড়ে। আমেরিকার অর্থনীতিতে চরম মন্দা অবস্থা দৈখা দেয়।
বেশ কিছু বাণিজ্য সংস্থা ও ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। তখন প্রশ্ন উঠে খোদ আমেরিকার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা সম্পর্কে। বলা যায়, বিশ্ব সমাজ এখন অর্থনৈতির উন্নত স্তরে আরোহণ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক করেছে। আর জুম্ম সমাজ এর ধারে কাছে পৌছতে এখনো অনেক অনক দেরী।
নাফ নদী থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত সমতলভূমি হাত ছাড়া হয়ে যাবার পরে গহীন অরণ্য আবৃত পার্বত্য চট্টগ্রাম আবাদ করা শুরু হয়েছে মাত্র ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। প্রথমে জুম চায় অর্থাৎ বন-জঙ্গল সাফ করে, আগুন লাগিয়ে বন পুড়ে এবং চুচ্যাং তাগল (ছুঁচালাে দা) দিয়ে ধান, সজী ও অন্যান্য শস্যের বীজ রােপণ করে চাষ চলতে থাকে।
অতঃপর ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে কিছু কিছু সমতল জমি লাঙল দিয়ে চাষ করার উপযােগী হয়ে উঠে। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০ (১৯০০ সনের ১ নং বিধি)’। এ শাসনবিধি বা আইনের ১৮ ধারা বলে প্রণীত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন সম্পর্কিত বিধি’-এর ৩৪ নং বিধি কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে ভূমি হস্তান্তরের বিধান অন্তর্ভুক্ত হয়। এ বিধিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি রেকর্ডভুক্ত করার বিধান রাখা হয়। পাশাপাশি বাৎসরিক খাজনা প্রদানের বিনিময়ে মৌজাবাসীগণ নিজেদের মৌজায় গ্রাম ভিত্তিতে জুম চাষের জন্য সমষ্টিগত ভূমি মালিকানাস্বত্ব ভােগ করতে থাকেন।
গহীন অরণ্যসম্ভার নিয়ে প্রকৃতি লালন পালন করতে থাকে পাহাড়ী অধিবাসীদেরকে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত মহাপ্রলয়ঙ্করী দু’টি মহাযুদ্ধ এবং বাংলার ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বা ‘দুর্ভিক্ষ’ তাদের জীবন-জীবিকায় কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। তারা যেমনি ছিলেন তেমনিই থেকে যান।
তবে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ পার্বত্য চট্টগ্রামের চাষ যােগ্য প্রায় সকল সমতল ভূমি পাহাড়ী অধিবাসী ও পুরণােবস্তী বাঙালী (ব্রিটিশ শাসনামলে বসতি প্রাপ্ত) অধিবাসীদের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়ে যায়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে কাপ্তাই বাঁধের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ চাষ যােগ্য সমতল জমি পানিতে ডুবে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে।
প্রকৃতি আবারাে পাহাড়ী অধিবাসীদেরকে বনের কোলে জায়গা দেয়। সমতল চাষ যােগ্য ভূমির অভাব আর সাথে জাতিগত নিপীড়ন ও বঞ্চনাকে সহ্য করতে না পেরে চল্লিশ হাজার পাহাড়ী অজানার উদ্দেশ্যে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে ভারতের মিজোরামে গিয়ে পৌঁছে। সেখান থেকে ভারত সরকার তাদেরকে চীন সীমন্তে অবস্থিত অরুণাচল প্রদেশে নিয়ে যায়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দেশ মুক্ত হয়। পাকিস্তান আমলের ধ্যান-ধারণায় পরিপুষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাগণ নিপীড়ন-নির্যাতন জোরদার করে। উনিশ্শাে সত্তুর দশকের মাঝামাঝি হতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়। সামরিক অভিযান চলতে থাকে। ১৯৮০ দর্শক হতে সমতলবাসীদের ব্যাপক পুনর্বাসনকল্পে উচ্ছেদ করা হয় পাহাড়ী অধিবাসীদেরকে।
এ প্রেক্ষাপটে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় দশ হাজার চাকমা অধিবাসী ভারতের মিজোরামে চলে যায়। মিজোরাম সরকার তাদেরকে পুশব্যাক (Push Back) করে। এর পরে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সংঘটিত সশস্ত্র সংঘাতের সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সর্বমােট ৭৫ ০০০ (পঁচাত্তর হাজার) পাহাড়ী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে।
তাদের মধ্যে অনেকে বাধ্য হয়ে কৃষি কাজ বাদেও ক্ষুদে ব্যবসা, গাড়ী ড্রাইভিং, নাপিতের কাজ, কার্পেন্ট্রি প্রভৃতি শিখে নেয়। চুক্তি উত্তরকালে স্ব স্ব জায়গা-জমি ও ভিটে-মাটি সেটেলারদের নিকট হতে ফেরৎ না পেয়ে অনেক সে ধরনের নানা পেশা অবলম্বন করতে বাধ্য হয়।
জায়গা-জমি হারিয়ে এখন অনেকে মুঠে-মজরীর কাজও করছে। অপরদিকে, চুক্তির সুফলের কিছু কিছু সুযােগে স্বল্প মানের ঠিকাদারী কাজে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে আগের চেয়ে। তবে বড় মাপের ঠিকাদারী এখনাে তাদের নাগালের বাইরে। ক্ষুদে দোকানদারের সংখ্যা অল্প কিছু দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়ভাবে ফলমূল-শাক-সজীর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন কয়েকজন। এসব মিলিয়ে চুক্তি উত্তর কালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী অর্থনীতিতে ১৫ শতাংশ থেকে মাত্র ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে পাহাড়ী অধিবাসীদের সম্পৃক্ততা। অপরদিকে কৃষি অর্থনীতিতে দিন দিন তাদের সম্পৃক্ততা কমে যাচ্ছে। সে স্থান পরিপুরণ করে চলেছেন উনিশ্শাে আশি দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত বাঙালী সেটেলারগণ।
পাহাড়ীগণ আগের চেয়ে অধিকতর পরিশ্রমী হয়েছেন এবং কৃষিতে ও উদ্যান চাষে তাদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। কিন্তু ভূমি হারানাের কারণে কৃষিজ ও উদ্যানজাত চাষের ক্ষেত্রে তাদের সম্পৃক্ততা সেটেলাদের তুলনায় আনুপাতিক হারে কমে গেছে। সব কিছু মিলিয়ে কৃষি ও উদ্যান (ফলজ) চাষের উৎপাদনের ক্ষেত্রে পাহাড়ীদের অংশীদারিত্বের পরিমাণ আগেকার ৬০ শতাংশ থেকে এখন ৫০ শতাংশে নেমে গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা হল – পাহাড়ীদের মধ্যে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, শহরে বা গ্রামে মিতব্যয়ীতা ও সঞ্চয়ের মনােবৃত্তি এখনাে অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি ব্যাংকের সাথে পরিচিতিও এখনাে নেই বললেই চলে। সর্বসাকুল্যে শতকরা ১৫ (পনর) জনের মত পাহাড়ী অধিবাসী এখন ব্যাংক সম্পর্কে জ্ঞাত ও সম্পৃক্ত আছেন। অবশ্য তাদের বেলায় বিভিন্ন স্থানে ব্যাংক সহযােগিতাও তেমন অনুকূল নয়।
আমাদের দেশে সরকার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, দশমবার্ষিকী পরিকল্পনা করে থাকে। বহু ধনী এবং সাধারণ বাঙালীদের মধ্যেও সে ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু পাহাড়ীদের মধ্যে আজীবনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করতে দেখা যায় নি। এমনকি বাৎসরিক পরিকল্পনাও কদাচিৎ দেখা যায়। বলা যায়, জুম্ম জাতি অর্থনীতির ক্ষেত্রে এখনাে পরিকল্পনাবিহীন।
সংস্কৃতি ও রাজনীতি হল অর্থনীতির দর্পণ বা আয়না। জুম্ম সমাজের অর্থনীতি তেমন বিকশিত হতে পারে নি। তাই, জুম্ম সমাজের সংস্কৃতি ও রাজনীতি সামন্ততান্ত্রিক পর্যায় থেকে গণতান্ত্রিক স্তরে উপনীত হতে পারে নি। খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা, চলন-বলন, পােশাক-পরিচ্ছদ, খেলাধূলা, আবেগ-অনুভূতি, রীতি-প্রথা, ইত্যাদি সম্পর্কিত আচার-আচরণ ও অভিব্যক্তিই হল সংস্কৃতি।
এসব ক্ষেত্রে জুম্ম সমাজ বেশ কিছু এগােলেও এখনাে প্রয়ােজনের তুলনায় বেশ অনগ্রসর। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এ অনগ্রসরতাই টেনে রেখে দিয়েছে জুম্ম সমাজকে। সামনের দিকে যায় যায় করেও পেছনের দিকে ফিরে গেছে বা যাচ্ছে জুম্ম সমাজ। বলা যায়, অনেকটা ইস্পাতের স্প্রিং-এর মত।
উনিশ্শো সত্তুর দশক হতে গনতন্ত্রায়ণের প্রবল জোয়ারের দিনে বেশ কিছুদূর অতি দ্রুত সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল জুম্ম সমাজের সংস্কৃতি অর্থাৎ গণতন্ত্রায়ণের সংস্কৃতি। কিন্তু তা বিশেষ করে উনিশ্শাে আশি দশকের মাঝামাঝি হতে আবারাে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। ধর্ম সংস্কৃতিরই অংশ। তাই, ধর্মীয় অঙ্গনেও দেখা দেয় এর প্রভাব। সংস্কৃতির পরিবর্তন বা আবর্তন হয় অতি ধীরে।
অথচ সংস্কৃতির পরিবর্তন ব্যতিরেকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিবর্তনকে স্থায়ী করা সম্ভব নয়। তাই দেখা যায়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অংগনের অনেক পরিবর্তন অনগ্রসর সংস্কৃতির টানে পিছুটান নিয়ে থাকে। ব্যক্তির জীবনেও এ অনগ্রসর সংস্কতিই এনে দেয় অবক্ষয়, ঘটিয়ে থাকে পতন।
জুম্ম সমাজও এখন এ অনগ্রসর সংস্কৃতির শিকারে পরিণত হয়েছে বা হতে চলেছে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের পর চর্চা, পর নিন্দা, পরজীবি মননশীলতা, অহেতুক অহংকারবােধ ছাপিয়ে যাচ্ছে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার জাতীয় স্বাথবােধকে। বিভেদ-সংঘাত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে সর্বত্র। ভাঙনের ধারা প্রবাহিত চলেছে সব ক্ষেত্রে।
বিভেদপন্থাই যেন এখন সবচেয়ে শক্তিশালী। বিভেদপন্থীরাই যেন এ জুম সমাজের শিরােমণি। এতে জুম্ম সমাজের সাধারণ মানুষ এখন হতবাক। বিশেষ করে ভয় তরুণ সমাজের বিশাল অংশ এখন যেন কিছুটা বিভ্রান্ত, দিশেহারা। আর এ সুযােগ নিতে চাইত শাসকগােষ্ঠী তাদেরকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে।
মাত্রাতিরিক্ত অনাচার-দুরাচার, বিভেদ-সংঘাতই নির্দেশ করে সমাজের অস্থিতিশীলতার। আর এ অস্থিতিশীলতাই ত্বরান্বিত করে পরিবর্তনকে। তাই, জুম্ম সমাজের বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে ধারণা করা যায় যে, গণতন্ত্রায়ণের জন্য জুম্ম সমাজে পরিবর্তন অপরিহার্য এবং তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে।
এ পরিবর্তনের ধারাকে সঠিকভাবে প্রবাহিত করবার জন্য জুম্ম সমাজের সকল সচেতন মানুষের উচিত স্থির ও লক্ষ্যভেদী দৃষ্টি রেখে নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিশেষ করে ভূমি ও ভূমিস্বত্ব, শাসন ক্ষমতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতি তথা সব বিষয়ে এক অনিশ্চয়তার যুগ সন্ধিক্ষণের অবসান ঘটিয়ে জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব সংরক্ষণের তথা গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ প্রশস্ত হতে পারে।
১৮ মার্চ, ২০১২
৮ S.P. Talikdar – The Chakmas Life and Struggle, New Delhi, 1988, page – 25
৯ আবদুল মমিন চৌধুরী – প্রাচীন বাংলার সংস্কৃতি, ঢাকা, প্রকাশকাল : মার্চ ২০০২, পৃ: ২৭।
১০ ড. আবদুল মমিন চৌধুরী ও অন্য তিন জন – বাংলাদেশের ইতিহাস, ঢাকা, পঞ্চদশ সংস্করণ: মে ২০১১, পৃ: ২২৩।
১১ শ্রী কেদারনাথ প্রণীত ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ২০০৫ / ফাল্গুন ১৪১১, পৃ: ৩১।
১২ জওহরলাল নেহেরু – বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ, কলকাতা, ১৯৯১, প;২৮০।
১৩ সতীশ চন্দ্র ঘােষ – চাকমা জাতি গ্রন্থ পৃ: ৬৪।
১৪ Dr. Qanungo, Suniti Bhusan – Chakma Resistance to British Domination 17721798, P-2।
১৫ SER H. Sneyd Hutchinson – Chittagong Hill Tracts, page 24
১৬ S.P. Talukdar – The Chakmas Life and Struggle, New Delhi, 1988, page 36
১৭ Website of Ministry of Law, Justice and Parliamentary Affairs, The Government of Bangladesh, 2008 – An Act enacted on 11th September 1836 and published in the Chrutta Gazette on 19 september 1836; Encyclopedic Compendium of the Laws of Bangladesh, Volume 1 by Dr. Borhan Uddin Khan and Quazi Mahfujul Hoque Supan, Dhaka, June 2002, P. 395.
১৮ Section 20 of The Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900 (Regulation 1 of 1900)
১৯ S.P. Talukdar – The Chakmas Life and Struggle, New Delhi, 1988, P. 119
২০ সুকুমার সেন – ভাষার ইতিবৃত্ত, ১৯৫০, পৃ: – ৩।
২১ ড. স্নেহময় চাকলাদার – ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি, পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা, নভেম্বর ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ৩; Report Census of India, 1971, Part II-c, (f), P. 1।
২২ ড. স্নেহময় চাকলাদার – ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি, পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা, নভেম্বর ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ১৪।
২৩ ড. স্নেহময় চাকলাদার – ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি, পশ্চিমবঙ্গ পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা, নভেম্বর ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ১৫।
২৪ ড. স্নেহময় চাকলাদার – ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা, নভেম্বর, ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ১৬।
২৫ ড. স্নেহময় চাকলাদার – ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা, নভেম্বর, ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ১৬। নভেম্বর, ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ১৬।।
২৬ ড. স্নেহময় চাকলাদার – ভারতের ভাষা সমস্যা ও রাষ্ট্রনীতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলিকাতা, নভেম্বর, ১৯৮১, পৃষ্ঠা – ১৬।
২৭ জেদের করােভকিন – পৃথিবীর ইতিহাস, প্রাচীন যুগ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৭৯ ।
২৮ প্রাগুক্ত, পৃ- ৮৯।
২৯ প্রাগুক্ত, পৃ- ১০৬।
৩০ প্রাগুক্ত, পৃ- ১৩৮।
৩১ প্রাগুক্ত, পৃ- ২১৪।
৩২ প্রাগুক্ত, পৃ- ১১৮।
৩৩ রমেশ চন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশের ইতিহাস – প্রাচীন যুগ, কলিকাতা, অষ্টম সংস্করণ, ১৯৮৮, পৃ; ১৮০ ।
লেখক : গৌতম কুমার চাকমা
তথ্যসূত্র : কেদাকতুক বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু সংকলন ২০১২।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।