পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার : অর্জন ও সম্ভাবনা

Jumjournal
Last updated Dec 23rd, 2020

636

featured image

১. ভূমিকা

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তি দেশের সংবিধানের আওতায় ও অনুসরণে সম্পাদিত হয়েছে।

এ চুক্তিতে অনগ্রসর আদিবাসী জুম্ম জনগণ যাতে স্বীয় ভাষা-সংস্কৃতি তথা জাতীয় অধিকার সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয় এবং এ অঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসীরা সর্বক্ষেত্রে উন্নতির মাধ্যমে সমতলবাসীদের সমকাতারে উপনীত হয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে তার বিধান এ চুক্তিতে রাখা হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের অব্যবহিত পরে চুক্তির অন্যতম পক্ষ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’ তার উপর অর্পিত বিষয়াদি যথাসময়ে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে থাকে; কিন্তু সরকার পক্ষ চুক্তি মােতাবেক সংশ্লিষ্ট কতিপয় আইন প্রণয়নসহ কিছু বিষয় বাস্তবায়ন ছাড়া এযাবৎ কোন বিষয় বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

বাস্তবায়িত বিষয়ের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপন, ভারত থেকে পাহাড়ী শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, কিছু সংখ্যক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়গুলাে অন্যতম।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলাে- যেগুলাের উপর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি করে ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করে অত্রাঞ্চালে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন নির্ভর করে সেসব মৌলিক বিষয়গুলাে অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়ে গেছে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিল না হলেও চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল এবং পক্ষান্তরে চুক্তিকে নানাভাবে পদদলিত করা। হয়। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

২. সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার

আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ’-এ অঙ্গীকার করা হয়েছে যে- “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।” সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়যুক্ত হলে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৬ জানুয়ারী ২০০৯ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আধষ্ঠিত হওয়ার পর এ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতিপয় পদে নিয়ােগদান যেমন- পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে রাঙ্গামাটির সাংসদ দপঙ্কর তালুকদারকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক পদে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে, প্রত্যাগত পাহাড়ী শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান পদে খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত সাংসদ যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ডের চেয়ারম্যান পদে বান্দরবান থেকে নির্বাচিত সাংসদ বীর বাহাদুর উ শৈ সিংকে ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসর বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ােগদান এবং একটি ব্রিগেডসহ ৩৫টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তারপর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর অন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদাহরণ দেখা যায়নি।

তবে অতি সম্প্রতি কিছুটা আশা সঞ্চার হয়েছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষে চুক্তির অন্যতম স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা‘র সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভি’র বেশ কয়েকবার বৈঠক এবং তারই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র বৈঠক এস সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির ৪র্থ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বলাবাহুল্য যে, বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদ তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। অবশিষ্ট মেয়াদের মধ্যে পাবত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়িত না হলে পার্বত চট্টগ্রামের পরিস্থিতির উপর সুদূর প্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা অভিমত ব্যক্ত করেন।

৩. চুক্তি বাবায়নে আশুকরণীয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। চুক্তি বাস্তবায়ন যতই বিলম্বিত হবে ততই আস্থাহীনতা দেখা দেবে এবং ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ দেখা দেবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা।

সামগ্রিকভাবে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠবে। এমতাবস্থায় অবশিষ্ট মেয়াদের মধ্যে বিশেষ করে আগামী এক বছরের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির নিমােক্ত বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া অত্যাবশ্যক।

৩.১. পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা কার্যকরকরণ ।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলােকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান রয়েছে। তারই আলােকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণীত হয়।

দুই স্তর বিশিষ্ট এই বিশেষ শাসনব্যবস্থায় জেলা পর্যায়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ বাস্তবায়নের ভূমিকা পালন করবে আর অঞ্চল পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের ভূমিকা পালন করবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ

পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণয়নের পর ১৯৯৯ সালে অন্তবর্তী আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়ন (তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড, পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদের উন্নয়নসহ), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রমসহ এনজিও কার্যাবলীর উপর আঞ্চলিক পরিষদের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধনের বিধান এখনাে কার্যকর হয়নি।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উনয়ন বাের্ড, পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ইত্যাদি কর্তপক্ষ আঞ্চলিক পরিষদের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধনের কর্তৃত্বকে উপেক্ষা করে চলেছে। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কার্যবিধিমালাও সরকার নানা অছিলায় বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখে চলেছে।

ফলে একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পরিণত হয়েছে একটি ঠুটো জগন্নাথের প্রতিষ্ঠানে; অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থায় বিরাজ করছে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা; যেখানে চেইন অব প্রশাসনের সংকট তৈরি হয়েছে। তাই অনতি বিলম্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে ১৯৯৮ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণীত (সংশােধিত) হলেও এই আইনগুলাে যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে ১২টি বিষয় সংযােজনের ফলে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে মােট ৩৩টি বিষয় হস্তান্তরের বিধান করা হয়েছে।

চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে কৃষি, স্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, সমবায়, সমাজসেবা, মৎস্য, পশু সম্পদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়া দপ্তর, শিল্প ও বাণিজ্যের কিছু কর্ম (ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, বাজারফান্ড প্রশাসন ও টেক্সটাইল ভােকেশনাল ইনস্টিটিউট) এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি মােট ১২টি বিভাগ ও কর্মের অংশবিশেষ পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে।

কিন্তু অত্যন্ত হতাশার বিষয় যে, চুক্তির পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে “যুব দপ্তর ও টেক্সটাইল ভােকেশনাল ইনস্টিটিউট” হস্তান্তর ব্যতীত আর কোন বিষয় হস্তান্তর করা হয়নি।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ বিশেষ করে জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ ও উহার উন্নতি সাধন, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ (স্থানীয়), মাধ্যমিক শিক্ষা, যুব কল্যাণ, পরিবেশ, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান ইত্যাদি বিষয়সমূহ হস্তান্তরের নানামুখী চেষ্টা-তদ্বির চালানাে হলেও সরকারের তরফ থেকে কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি।

ফলে আইন আছে, প্রয়ােগ নেই এমন অরাজক অবস্থা চলছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে। আরাে হতাশার বিষয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের অনেক আগে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের ১৪ বছর পরেও পরিষদসমূহের নির্বাচনের কোন উদ্যোগ নেই।

যে দল ক্ষমতা আসে সেই দল স্ব স্ব দলীয় নেতা-কর্মীদের পরিষদের চেয়ারম্যানসদস্য পদে মনােনয়ন দিয়ে ৫-সদস্যক অন্তর্বর্তী পরিষদের মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলাে। অগণতান্ত্রিকভাবে বছরের পর বছর ধরে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে এসব অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদসমূহের জনগণের কাছে কোন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে।

অপরদিকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা ও ভােটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে চরম নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করে চলেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মূল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাের শক্তিশালীকরণের পরিবর্তে চুক্তি স্বাক্ষরের ১৪ বছর পরও যদি এসব প্রতিষ্ঠানগুলাে এরূপ বেহাল অবস্থা বিরাজ করে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনকাঠামাে গড়ে উঠবে কিভাবে? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ তথা আঞ্চলিক/স্থানীয় সরকারব্যবস্থার শক্তিশালীকরণের কোন বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের এককেন্দ্রীক শাসনব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা ফলপ্রসু প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে যেখানে এই কাঠামােকে একটি ‘রােল মডেল’ হিসেবে দাঁড় করানাের সুযােগ ছিল, সেখানে তা আজ মানুষের মধ্যে হতাশার জায়গা তৈরি হয়েছে।

তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ রাজনৈতিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সর্বোপরি দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়ােজনে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন কার্যকর করা জরুরী।

৩.২. পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার অন্যতম দিক হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই সমস্যা সমাধানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম বিধান হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি মােতাবেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির বিধান করা।

উক্ত বিধান অনুসারে ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণীত হলেও উক্ত আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে অনেক বিরােধাত্মক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভূমি কমিশন আইনের উক্ত বিরােধাত্মক ধারা সংশােধনের জন্য গত ৭ মে ২০০৯ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে পুনরায় সরকারের নিকট সংশােধনী প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়। উক্ত সংশােধনী প্রস্তাবের উপর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন স্তরে কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তম্মধ্যে ১০ অক্টোবর ২০১০ রাঙ্গামাটিতে ভূমি মন্ত্রীর সভাপতিত্বে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের আন্তমন্ত্রণালয় এক সভায় সর্বসম্মতিক্রমে মতৈক্য হয় যে, ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির কাজ শুরু করার আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর ২৩টি বিরােধাত্মক ধারা সংশােধন করা হবে। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ীই পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী দিক নির্দেশনাও প্রদান করেছিলেন (প্রথম আলাে, ২২ অক্টোবর ২০১০)।

সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রতিনিধিদলের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক আঞ্চলিক পরিষদের প্রস্তাবিত সংশােধনীসমূহ যাচাইবাছাই পূর্বক ১৩-দফা সম্বলিত সংশােধনী প্রস্তব চূড়ান্ত করা হয় এবং এসব প্রস্তাবাবলী বিল আকারে প্রস্তুত করে মন্ত্রী সভা ও জাতীয় সংসদে উত্থাপনের জন্য গত ২০ জুন ২০১১ ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।

তারই আলােকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৪র্থ সভায় উপরােক্ত প্রস্তাবিত ১৩-দফা সংশােধনী মােতাবেক জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনেই সংশােধনের উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

কিন্তু জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন প্রায় শেষ হতে চললেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ জাতীয় সংসদে উত্থাপনের জন্য আজ অবধি সরকারের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের চরম হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে।

একদিকে পার্বত্য জেলা পরিষদে ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়টি হস্তান্তর না করা এবং অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১ এর বিরােধাত্মক ধারা সংশােধনের কাজ বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক ভূমি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনসহ ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি করার বিষয়টি এখনাে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে বিরাজ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরােধ নষ্পত্তি অত্যন্ত জরুরী একটি বিষয়। এ সমস্যা সমাধানে যতই কালক্ষেপণ করা হবে ততই পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনের ভূমি সংক্রান্ত ৬৪ ধারা কার্যকর করার পরিবর্তে বাতিল করার জন্য তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক কর্তৃক জেলা প্রশাসকদের প্রত্যেক সম্মেলনে উত্থাপন করা হয়।

আরাে অধিকতর উদ্বেগের বিষয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির তৃতীয় সভায় (খাগড়াছড়িতে ২৬ ডিসেম্বর ২০১০ অনুষ্ঠিত) ভূমি কমিশনের বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত ঘােষণার সিদ্ধান্ত হলেও উক্ত সিদ্ধান্তকে লঙ্ঘন করে এবং সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বিরােধাত্মক ধারাসমূহ সংশােধনের পূর্বে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান কর্তৃক গত ২৮-২৯ ফেব্রুয়ারী ২০১২ একতরফা ও বিধি-বহির্ভূতভাবে ভূমি-বিরােধ নিষ্পত্তির মামলাগুলাের শুনানীর অপচেষ্টা চালানাে হয়। এতে করে পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

চেয়ারম্যান ও বিভাগীয় কমিশনার ব্যতীত কমিশনের অন্য কোন সদস্য উপস্থিত না হওয়ার কারণে শুনানী শুরু করা না গেলেও আগামী ১-২ এপ্রিল ২০১২ আবারও শুরু করা হবে বলে কমিশনের চেয়ারম্যান ঘােষণা দেন। ভূমি কমিশন আইনের বিরােধাত্মক ধারা সংশােধন না করে ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির কার্যক্রম শুরু করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার ক্ষেত্রে আরেক জটিলতা সৃষ্টি হতে বাধ্য।

ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের এরূপ স্বেচ্ছাচারী কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব না হলে এ নিয়ে আরেক সংকট তৈরি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে ভূমি কমিশনের কাজ যথাযথভাবে সম্পাদনার্থে বর্তমানে চেয়ারম্যান পদে নিয়ােজিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জনাব খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীকে অপসারণ করে অন্য একজন উপযুক্ত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে চেয়ারম্যান পদে নিয়ােগ প্রদান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে রাবার চাষের ও অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য বরাদ্দকৃত যে সকল জমি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি সে সকল জমির ইজারা বাতিল করা।

২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মােতাবেক বান্দরবান জেলায় ৫৯৩টি প্লট বাতিল করার সিদ্ধান্ত হলেও পরবর্তীতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে উক্ত বাতিলকৃত প্লটগুলাে অধিকাংশই পুনর্বহাল করা হয়।

পক্ষান্তরে বান্দরবান জেলার ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন করে নতুন করে ইজারা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলশ্রুতিতে জুম্ম অধিবাসীরা নিজ বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ছে এবং তাদের চিরায়ত জুম ভূমি হারিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে।

৩.৩. বেসমারিকীকরণ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর বর্তমানে বিজিবি) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামারিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করার বিধান রয়েছে।

এই বিধান অনুযায়ী পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে কিছু ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে; যদিও প্রত্যাহৃত ক্যাম্পের সংখ্যা নিয়ে সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মতভেদ রয়েছে। তবে চুক্তি অনুসারে বেসামরিকীকরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে চুক্তির বিধান অনুসারে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যহারের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করা নিয়ে।

চুক্তি স্বাক্ষরের ১৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজ অবধি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যহারের সময়সীমা নির্ধারিত হয়নি। ফলে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তর কালে ২০০১ সালে ‘অপারেশন দাবানল’-এর পরিবর্তে ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারী করা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সহায়তা করার লক্ষ্যে এই ‘অপারেশন উত্তরণ’ জারী করা হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হলেও অপারেশন উত্তরণের বদৌলতে কার্যতঃ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে বলে ব্যাপক অভিযােগ রয়েছে।

তাই চুক্তি অনুসারে পার্বত্যাঞ্চলের বেসামরিকীকরণের ক্ষেত্রে অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে সময়সীমা নির্ধারণ করা এবং জারীকৃত ‘অপারেশন উত্তরণ প্রত্যাহার করার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে হবে।

৩.৪. পুনর্বাসন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে পুনর্বাসন সংক্রান্ত যেসব বিষয় রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ী শরণার্থী, আভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু পাহাড়ী পরিবার, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা জনসংহতি সমিতির সদস্য, ভূমিহীন পাহাড়ী পরিবারগুলাের পুনর্বাসন প্রদান করা। এর মধ্যে সবচেয়ে জটিল অবস্থায় রয়েছে আভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু পাহাড়ী পরিবারগুলাের পুনর্বাসন এবং প্রত্যাগত পাহাড়ী শরণার্থীদের জমিজমা প্রত্যর্পণের বিষয়টি।

এর মধ্যে আভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু পাহাড়ী পরিবারগুলাের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে চুক্তিকে লঙ্ঘন করে “সেটেলার বাঙালীদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবেবিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের সরকারী উদ্যোগ”।

উল্লেখ্য, এলক্ষ্যে ১৯ জুলাই ১৯৯৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগ থেকে সেটেলার বাঙালিদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করার জন্য প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সকে এক পত্র দেয়া হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরিপন্থী এই উদ্যোগের প্রতিবাদে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদ্বয় টাস্কফোর্সের নবম সভা চলাকালে ‘ওয়াকআউট’ করেন। পরবর্তীতে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে ১৫ মে ২০০০ অনুষ্ঠিত টাস্ক ফোর্সের একাদশ সভায় একতরফাভাবে ৯০,২০৮ উপজাতীয় পরিবার এবং ৩৮,১৫৬ অউপজাতীয় সেটেলার পরিবারকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে ঘােষণা করা হয়।

অবশেষে পার্বত্যবাসীর প্রবল প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন টাস্ক ফোর্সের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগ থেকে “সেটেলার বাঙালিদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন সংক্রান্ত পত্রটি” প্রত্যাহার করা অত্যন্ত জরুরী।

৩.৫. আইন সংশােধন

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিভিন্ন ধারায় বিবৃত ঐকমত্য ও পালনীয় দায়িত্ব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন, বিধানাবলী, রীতিসমূহ প্রণয়ন, পরিবর্তন, সংশােধন ও সংযােজনের বিধান করা হলেও এক্ষেত্রে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে চুক্তি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধানাবলী সংশােধিত না হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনগত সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির অবসান হয়নি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিধানাবলীকে উপেক্ষা করে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ চুক্তির পূর্বেকার মতােই স্ব স্ব ক্ষমতার কার্যকারিতা অব্যাহত রেখেছে। ফলে চুক্তির আলােকে স্থাপিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন কাঠামাে অদ্যাবধি যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারেনি।

প্রথমত: চুক্তির আলােকে প্রণীত উক্ত বিধানাবলীর সাথে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা যেমন-পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড অধ্যাদেশ ১৯৮২ সংশােধন করা অত্যাবশ্যক।

দ্বিতীয়ত: পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযােজ্য কতিপয় সাধারণ আইনগুলাে “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির উক্ত বিধানাবলীর সাথে যতটুকু সংগতিপূর্ণ কেবল ততটুকু কার্যকর হবে” বা “পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ (সংশােধন) এর বিধানাবলী সাপেক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযােজ্য হবে” মর্মে কোন বিধান এসব আইনে যেমন- বন আইন, স্থানীয় সরকার পরিষদ (উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন) আইন, পুলিশ রেগুলেশনে সংযােজন করা জরুরী।

তৃতীয়ত: সংঘাতকালীন সময়ে “অপারেশন দাবানল” অর্থাৎ আন্দোলন দমনমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রতিরক্ষা আইনের আওতায় যে বিধান জারী করা হয় চুক্তি উত্তরকালে “অপারেশন উত্তরণ” পরিচালনার নামে উক্ত একই বিধান অব্যাহত রাখা হয়েছে যা প্রত্যাহার করা অত্যন্ত জরুরী।

৪. চুক্তি বাবায়নে চ্যালেঞ্জ

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হল- সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। চুক্তি স্বাক্ষরের পর আওয়ামী লীগ সরকারগুলাের মধ্যে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযােগ রয়েছে।

আওয়ামী লীগ যে সাহসিকতায় ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত করেছিল সেই সাহসিকতায় ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে আসলে চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যতই কঠিন প্রতিবন্ধকতা থাকুক না কেন তা অপসারিত হতে বাধ্য।

দ্বিতীয়ত: দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে চুক্তি বিরােধী দৃষ্টিভঙ্গি চুক্তি বাস্তবায়নে অন্যতম বাধা হিসেবে কাজ করে। দেশের ক্ষমতামুখী রাজনৈতিক দলগুলাের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পর্কে হয় চরম নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান রয়েছে না হয় চরম উদাসীনতা পরিব্যাপ্ত রয়েছে।

তৃতীয়তঃ উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারক-বাহক দেশের আমলাতন্ত্র চুক্তি বাস্তবায়নে আরেকটি বাধা। সাধারণভাবে দেশের সিভিল বা সামরিক আমলা নেতত্ব বরাবরই দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থায় গণমুখী ভূমিকার পরিবর্তে নানাভাবে অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক ভূমিকা পালন করে থাকে যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মতাে স্পর্শকতর বিষয়েও চরম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে।

চতুর্থত: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মধ্যকার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান অনেক ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে কাজ করে। জুম্ম সমাজের মধ্যে যারা। শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত ও জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে যুক্ত তাদের উচ্চাভিলাষ, আপোষমুখীতা, সুবিধাবাদিতা, স্বার্থপরতা ও সামন্ত মানসিকতা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রথমােক্ত তিনটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ অপসারণ করে এবং শেষােক্ত চ্যালেঞ্জকে মােকাবেলা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের কাজকে এগিয়ে নিতেই হবে।

৪ মার্চ, ২০১২।

লেখক : মঙ্গল কুমার চাকমা।

তথ্যসূত্র : কেদাকতুক বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু সংকলন ২০১২।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা