পার্বত্য চট্টগ্রামে বহুমাত্রিক সমস্যার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমি
1913
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ১৩টি সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার উপর ধারাবাহিক, হত্যা, নির্যাতন, শোষণ, উৎখাত ও বঞ্চনাজনিত মানবাধিকার লংঘনের সমস্যা বহুমাত্রিক।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও এই সমস্যার রয়েছে ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক, সামরিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং এর একটি অপরটির সঙ্গে এমনই নিবিড়ভাবে যুক্ত যে কোনটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা সম্ভব নয়।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই সমস্যা সৃষ্টি করেছে রাষ্ট্র, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীসমূহ, বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা এবং সুবিধাপ্রাপ্ত অভিবাসী বাঙালি সম্প্রদায়।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যখন পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে তখন থেকে ‘অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিকরণ’ নীতি অনুযায়ী আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেয়া,
সামরিক-আধাসামরিক বা অসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা নির্যাতন, হত্যা এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য-আবাসন-ব্যবসা-চাকরিতে বঞ্চনা, অবকাঠামো উন্নয়নে বৈষম্য, ধর্মপালন ও সংস্কৃতিচর্চায় বিঘ্ন সৃষ্টি প্রভৃতি প্রাত্যহিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানকে গণ্য করা হয় বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে। শতকরা ৮৫ ভাগ জনসংখ্যা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে –
যা সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও এথনিক সম্প্রদায়ের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও এই সংবিধানে আদিবাসীর স্বতন্ত্র জাতিসত্তার কোনও স্বীকৃতি এবং বিশেষ মর্যাদার কোন বিষয় উল্লেখ করা হয়নি।
আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে – দুই উর্দিপরা জেনারেলের জমানায় ৫ম ও ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা মুছে ফেলে উপরে ‘বিসমিল্লাহ ….’ এবং মুখবন্ধে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস’ স্থাপন করে এটিকে একটি সাম্প্রদায়িক সংবিধানে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
৮ম সংশোধনী জারি করে যখন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে ঢোকানো হয় তখন থেকে সংখ্যালঘু অমুসলিম ধর্মীয় ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্যরা কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে।
রাষ্ট্রের এই নির্যাতন, বঞ্চনা ও আগ্রাসন বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অস্তিত্ব ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। ১৯৭১-এর আদমশুমারি থেকে আমরা জানতে পারি বাংলাদেশে ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থান রয়েছে পাহাড় ও সমতলে, যাদের ভাষার সংখ্যা ৩২।
গত আটত্রিশ বছরে বাংলাদেশে অন্ততপক্ষে দশটি নৃ-গোষ্ঠী হারিয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়েছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ইতিহাস। আদিবাসীদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈরি মনোভাব পরিবর্তিত না হলে একশ বছর পর বাংলাদেশে আদিবাসী পরিচয়ের কারও অস্তিত্ব থাকবে না।
এই গাঙ্গেয় অববাহিকায় সভ্যতা নির্মাণে আদিবাসীদের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
এমনকি ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতার সংগ্রামেও আদিবাসীদের অবদান কম নয়। অথচ রাষ্ট্র যখন আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা কেড়ে নেয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি কোনও প্রতিবাদ করে না।
যে বাঙালি পাকিস্তানের কলোনিসুলভ শাসন-পীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই বাঙালি স্বদেশী আদিবাসীদের প্রতি পাঞ্জাবীদের মতো ঔপনিবেশিক প্রভুসুলভ আচরণ করছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাঞ্জাবী শাসকদের দ্বারা এতদঞ্চলের বাঙালিরা যত না নির্যাতিত হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে আদিবাসীরা।
জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্ব অনুযায়ী শতকরা মাত্র তিন ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কথা ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ধারণা ছিল তাদের এলাকা ভারত বা বার্মার অন্তর্ভুক্ত হবে।
যে কারণে ১৪ আগস্ট পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলিত হলেও ১৫ আগস্ট রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলিত হয়।
১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ প্রকাশিত হলে জানা যায় – পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে। ২১ আগস্ট পাকিস্তানী সৈন্যরা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে গিয়ে ভারতীয় ও বার্মার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করে।
এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকিস্তানী শাসকরা পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির প্রলোভন দেখিয়ে সমতলের বাঙালিদের বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে।
১৯৪৭ সালে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৯৭ ভাগ, ’৬১ সালে তা কমে ৮৫ ভাগে দাঁড়ায়। ১৯৯৭-এ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৫২ ভাগ।
পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে এক লক্ষ আদিবাসীকে স্থানচ্যুত করা হয়েছে কোন ক্ষতিপূরণ অথবা বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা না করেই। উপত্যকার ৪০ শতাংশ কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে।
কাপ্তাই হ্রদের নিচে হারিয়ে গিয়েছে চাকমা রাজার প্রাসাদ। উৎখাত হওয়া চাকমাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের অরুণাচলে, চার দশকেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তারা সে দেশের নাগরিকত্ব লাভ করেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বঞ্চনা ও নির্যাতন বন্ধের কোন পথ খুঁজে না পেয়ে বিদ্রোহ করেছে, অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে।
এই বিদ্রোহ দমনের নামে সেনাবাহিনী এবং বহিরাগত বাঙালিরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যাসহ যে ধরনের নির্যাতন চালিয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেছে।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার পর বিদ্রোহের অবসান হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের হৃত ভাবমূর্তি বহুলাংশে উজ্জ্বল হয়েছে।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের আগে ও পরে বিএনপি-জামাতের মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক জোট যেভাবে এর বিরোধিতা করেছে তাতে এই অশুভ শক্তির দেশ ও জাতিবিরোধী অবস্থান আরও প্রকট হয়েছে।
এ বিষয়ে তখন আমার একটি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলাম, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি দেশে ও বিদেশে শান্তিকামী ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের দ্বারা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের অনেকে এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেছেন—বিশ্বের যে সমস্ত দেশে এ ধরনের এথনিক সমস্যা রয়েছে যা বহু বর্ষব্যাপী সংঘর্ষ ও রক্তপাতের ভেতর আজও অব্যাহত রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি সে সব দেশের জন্য অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা যেমন প্রাচীন তেমনই জটিল। অত্যন্ত প্রতিকূল এক পরিস্থিতি অনুকূলে এনে শেখ হাসিনার সরকারকে এ চুক্তি করতে হয়েছে পার্বত্য জেলাসমূহে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য।
‘শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়েছে কারণ, তিন পার্বত্য জেলার নির্বাচিত সাংসদরা হচ্ছেন এই দলের প্রতিনিধি। আওয়ামী লীগ একমাত্র দল যাদের অবস্থান রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের ভেতর।
বিএনপি, জামাত ও অপরাপর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলো যারা শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করেছে তাদের এই এলাকায় উল্লেখযোগ্য জন সমর্থন নেই। বহিরাগত বাঙালিদের ভেতর কিছু সমর্থন থাকলেও বিপুল সংখ্যক বাঙালি ও পাহাড়ি সম্প্রদায় বিএনপিকে সমর্থন করে না।
কারণ তারা জানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিএনপি ও তাদের সহযোগীরা সরাসরি অবস্থান নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। বিএনপি, জামাত ও তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সহযোগীরা বাংলাদেশে কোনও অমুসলমান রাখতে চায় না।
‘শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার আগে থেকেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের চিরশত্রু জামাতে ইসলামী এবং তাদের অপরাপর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরোধিতা করছে।
তাদের এই বিরোধিতা এবং বিরোধিতা করতে গিয়ে নানাবিধ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এক সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চক্রান্তের অন্তর্গত। বিএনপি ও তার সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সহযোগীরা শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করতে গিয়ে সর্বশেষ অবস্থান থেকে জেহাদের ডাক দিয়েছে।
জামাতপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ হাসানউজ্জামান চৌধুরী ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি একটি আগাগোড়া প্রামাণ্য বিশ্লেষণ’ নামে একটি বই লিখেছেন।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি, জামাত ও অপরাপর উগ্র সাম্প্রদায়িক দলসমূহের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
১৭ ফেব্রুয়ারি ’৯৮ দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে—এই আলোচনা সভায় জামাতী লেখক হাসানুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, ‘যে কারণে আমরা নামাজ পড়ি সে কারণেই শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করতে হবে। ইসলাম এবং পার্বত্য শান্তি চুক্তি এখন মুখোমুখি।’
এই আলোচনা সভায় শায়খুল হাদিস মওলানা আজিজুল হক বলেছেন, “চুক্তি হয়ে গেছে বলে কান্নাকাটি করে লাভ হবে না। জেহাদে যেতে হবে। পার্বত্য চুক্তির ইস্যুতে নবী করিম (দঃ)-এর সময়কার মতো যুদ্ধের সময় চলে এসেছে।”
৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙার পর এই মওলানাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা প্ররোচিত করার জন্য বলেছিলেন ‘ইসলাম নামক বৃক্ষটির গোড়ায় পানি নয়, রক্ত ঢালতে হবে।’ এর ফলশ্রুতি হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তখন নজিরবিহীন নৃশংস হামলা চালানো হয়েছিল।
‘আলোচনা সভায় একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযোগী জামাত নেতা যুদ্ধাপরাধী আব্বাস আলী খান বলেছেন, ‘চুক্তি কার্যকর হলে দেশের মানুষের ওপর লানত হবে।’
অপর যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতা মওলানা দেলোয়ার হোসেন সাইদী বলেছেন, ‘আমাদের সামনে এর চেয়ে বড় ইস্যু কবে আসবে! আসুন জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
জেহাদের সময় এসেছে। আমরা জেহাদে নেমে গেলাম।’ এই সভায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী বিএনপি নেতা আনোয়ার জাহিদ, জামাত নেতা কামরুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা প্রমূখ একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন।
‘৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে জামাত ও তাদের সহযোগীরা ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল, শান্তি চুক্তিকে তারা একইভাবে ‘ইসলামের মুখোমুখি’ দাঁড় করাতে চায়।
ইসলামের দোহাই দিয়েই ’৭১-এ তারা ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা এবং ২ লক্ষ ৬৯ হাজার নারীকে ধর্ষণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত যে কোনও কার্যক্রম তাদের ভাষায় ইসলামের শত্রু এবং ভারতের চক্রান্ত।
‘প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে তারা শান্তি আলোচনার শুরু থেকেই জেহাদের হুঙ্কার দিচ্ছিল। তাদের সকল হুঙ্কার ও প্রতিবন্ধকতা অগ্রাহ্য করে শান্তি চুক্তি হয়েছে এবং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াও আরম্ভ হয়েছে।
হরতাল ডেকে তারা অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান বানচাল করতে পারেনি। ১০ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৮) প্রচুর উৎসাহ আর আগ্রহ নিয়ে তিন পার্বত্য জেলার বিপুল সংখ্যক পাহাড়ি বাঙালি সমবেত হয়েছিল খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে।
বহু রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রতিনিধি ও বিদেশী সাংবাদিক এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, যারা এক বাক্যে শান্তির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ বাঙালিরাও বুঝে গেছে বিএনপি ও জামাত তাদের যেসব কথা বলে উত্তেজিত করতে চাইছে বাস্তবে তার কোনও ভিত্তি নেই।
সচেতন বাঙালি মাত্রেই জানে সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ খারিজ করে কিভাবে জিয়ার আমল থেকে বিএনপি বাঙালির যাবতীয় অর্জনকে ধ্বংস করতে চাইছে।
’৭১-এ যারা বাঙালিদের কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছিল, যারা বাঙালি নারীদের ‘গণিমতের মাল’ বলে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেই জামাতীদের বাঙালিপ্রেমও পার্বত্য এলাকায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজের অজানা নয়।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও বাঙালি মাত্রেই এ বিষয়ে সম্যকরূপে অবগত—যুদ্ধাবস্থা জারি থাকলে জীবন কিভাবে দুর্বিষহ হয়, কিভাবে আতঙ্কের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয় প্রতিটি প্রহর, কিভাবে সইতে হয় আপনজন হারানোর তীব্র বেদনা।
২০ হাজার পাহাড়ি বাঙালির জীবনের বিনিময়ে এই উপলব্ধি আজ শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের ভেতর এসেছে—শক্তি প্রয়োগ করে এ ধরনের সমস্যার সমাধান হয় না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তা সংখ্যায় যত ক্ষুদ্র হোক না কেন তাদের নিশ্চিহ্ন করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বরং গত ১৫ বছর ধরে আমরা দেখেছি তাদের পক্ষে বিশ্বজনমত যেভাবে সংগঠিত হয়েছে, যেভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের পক্ষ নিয়েছে, বাংলাদেশের মতো বিদেশী সাহায্য নির্ভর দরিদ্র দেশের পক্ষে তার মোকাবেলা করা অসম্ভব।
এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বলেই জেনারেল এরশাদের সরকারকে শুরু করতে হয়েছিল শান্তি আলোচনা, প্রণয়ন করতে হয়েছে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন’
এবং খালেদা জিয়ার সরকারকেও সেই প্রক্রিয়া জারি রাখতে হয়েছিল গত দু’দশক পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উপর সরকারের নির্মম নির্যাতন, হত্যা, নারী নির্যাতন, গৃহে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশ প্রচন্ডভাবে নিন্দিত হয়েছিল বহির্বিশ্বে।
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চরম মানবাধিকার লংঘনের জন্য বাংলাদেশের সমালোচনা হয়েছে। দাতা দেশসমূহকে বলা হয়েছে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।’ (শান্তির পথে অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম: শাহরিয়ার কবির, অনুপম প্রকাশনী, বইমেলা ১৯৯৮, পৃ. ৭-৯)
পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের আগে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ হয়ে যাবে।
অথচ ’৯১ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত প্রথমবার তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তাঁকেও সংক্ষুব্ধ পাহাড়ীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়েছিল এবং সেনা প্রত্যাহারের দাবি মেনে নিতে হয়েছিল।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর এক যুগ পেরিয়ে গেছে, খালেদা জিয়ার মুখে ছাই দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনও বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।
পৃথিবীর যে সকল দেশে বাংলাদেশের মতো এথনিক সমস্যা রয়েছে সর্বত্র সংবিধানে তাদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার বিধান রয়েছে এবং এটি জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত বিধান।
বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, পাকিস্তানে উপজাতি অধ্যুষিত কোরাম, খাইবার, মালাকান্দ এবং ভারতের জম্মু, কাশ্মীর, অরুণাচল, মিজোরাম প্রভৃতি অঞ্চলে এ ধরনের Inner line Regulation রয়েছে যার দ্বারা এ সব অঞ্চলের অধিবাসীদের জাতীয় অস্তিত্ব, ভূমিস্বত্ব এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বঞ্চিত ও অবহেলিত পাহাড়ি সম্প্রদায়ের জন্য আংশিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের কাঠামোর ভেতরই করা হয়েছে। সংরক্ষণের অর্থ এটা নয় যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশের নাগরিকরা যাওয়া আসা করতে পারবেন না।
বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলের যে কোনও নাগরিক বৈধ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে পারবেন। সংরক্ষণ ব্যবস্থা শুধুমাত্র জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রেই রাখা হয়েছে।
জেনারেল এরশাদের আমলে প্রণীত ‘রাংগামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯’-এও পাহাড়িদের এ অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। এই আইনের ৬৪ ধারায় বলা হয়েছে,
‘আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, রাংগামাটি পার্বত্য জেলার এলাকাধীন কোন জায়গা-জমি পরিষদের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাইবে না, এবং অনুরূপ অনুমোদন ব্যতিরেকে উক্তরূপ কোন জায়গা-জমি উক্ত জেলার বাসিন্দা নহেন এইরূপ কোন ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করা যাইবে না।’
বিএনপি যখন জনসংহতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছে তখন তারাও এই ধারাটি সমর্থন করে বলেছে এটি পাহাড়িদের রক্ষাকবচ হিসেবে করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার ধারাবাহিকতায় এতদঞ্চলে মুসলিম বাঙালি অভিবাসনের কারণে জঙ্গী মৌলবাদের ঘাঁটি স্থাপন ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের জমানায় বার্মা থেকে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের আগমন ঘটেছে এই অঞ্চলে। রোহিঙ্গাদের সাহায্যের নামে কিছু মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক দল গত ৩০ বছরে মধ্যপ্রাচ্য ও ওআইসির অর্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত মাদ্রাসা বানিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইসলামিকরণ ও পাকিস্তানিকরণে জিয়াউর রহমানকে মদদ দিয়েছে জামাতে ইসলামী ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বি সৌদি আরব ও পাকিস্তান। ১৯৬১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদ ছিল ৪০টি, মাদ্রাসা ছিল ২টি।
জিয়ার আমলে ১৯৮১ সালে মসজিদের সংখ্যা হয়েছে ৫৯২টি এবং মাদ্রাসা ৩৫টি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মসজিদের সংখ্যা ৩০০০ এবং সরকারি-বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় ৮০০।
এই সব মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রত্যক্ষ মদদে জঙ্গী-রিক্রুট, তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বহিরাগত জঙ্গীদের আশ্রয়স্থল গড়ে উঠেছে।
তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের দুই ডজন জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন রয়েছে। বিএনপি ও জামাতে ইসলামী বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ইসলামবিরোধী বা হিন্দুয়ানি বিবেচনা করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা বাংলাদেশী নয়, ঘোরতর বাঙালি!
মূলতঃ জামাতের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম জঙ্গী মৌলবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। এই জঙ্গীরা শুধু অমুসলিম আদিবাসী নয়, বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। শেখ হাসিনার গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতার কারণে সম্ভব হয়েছিল পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন।
এই চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং শান্তি চুক্তি বিরোধীদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র প্রতিহতকরণ বর্তমান সরকারের পক্ষেই সম্ভব। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলেছে।
আমরা আশা করব এই সংবিধানে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সত্তা, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। আরাকানের রোহিঙ্গা জঙ্গীদের মদদ দিয়ে যারা আরাকান ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক করে স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চক্রান্তে নিয়োজিত বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের চিরতরে নির্মূল করতে হবে।
জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আদিবাসীদের অস্তিত্ব ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন বেশি উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ’ ছাড়াও বারোটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে, যেখানে আদিবাসীদের মানবাধিকারের কথা বলা হয়েছে।
সভ্যতার মানচিত্রে স্থান পেতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই আদিবাসীদের বিশেষ অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ আদিবাসীদের মর্যাদাব্যঞ্জক অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে, যা অতীতে বার বার কলঙ্কিত হয়েছে।
লেখক : শাহরিয়ার কবীর (জানুয়ারি ৭, ২০১০)
তথ্যসূত্র : bdnews24.com
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।