পার্বত্য চট্টগ্রামঃ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ

Jumjournal
Last updated Aug 18th, 2020

4317

featured image

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পূর্বকালীন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ সামাজিক অবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিস্থিতি

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পার্বত্যঞ্চলের এক বেদনাদায়ক যুগান্তকারী ঘটনা। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে এই বাঁধ নির্মাণ এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিষয়টি এখনও বির্তকিত রয়েছে।

পৃথিবীর অনেক আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে সব প্রকল্প ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বির্পযয় ও বিলুপ্তির জন্য দায়ী কাপ্তাই বাঁধ তন্মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য।

এই বাঁধ অত্রাঞ্চলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। পার্বত্য অঞ্চলের জৈব্য বৈচিত্র্য, পরিবেশ ধ্বংস ছাড়াও চাকমা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজনকে বিলুপ্তির কাছাকাছি এনেছে কাপ্তাই বাঁধ।

কাপ্তাই বাঁধ পার্বত্যঞ্চলের জনগণের তথা চাকমা জনগোষ্ঠীর দূর্গতির মূল কারণ। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নের নামে নির্মিত এই বাঁধ পার্বত্য অঞ্চলের অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়কে বিলুপ্তি ও ধ্বংসের প্রান্তে এনেছে।

Kaptai Hydro Electric dam which caused a huge migration
কাপ্তাই বাঁধ, ছবিঃ উইকিপিডিয়া

আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এই বাঁধ নির্মিত হলেও এর বিরুপ প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ভৌগলিক, পরিবেশগত ও জৈব্য বৈচিত্র্যের উপর এর অবর্ণনীয় ক্ষতিকর প্রভাব হাজার বছরব্যাপী অত্রাঞ্চলে বিরাজ করবে।

বাঁধ নির্মাণ কার্য যারা প্রত্যক্ষ করেছে কিংবা বাঁধ নির্মাণের ফলে যারা উচ্ছেদ হয়েছে, যারা তাদের পিতৃভূমি জনপদ থেকে স্থানান্তরিত, যারা শারিরীক, মানসিক ও আর্থিকভাবে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি ও অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে সে সব প্রজন্মের অধিকাংশ লোকজন আর বেঁচে নেই।

আর যারা বেঁচে আছেন তাদের অধিকাংশের বয়স এখন ষাটের উপর থেকে সত্তর-আশির কোঠায়। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ লোকজনের যাদের বয়স এখনও পঞ্চাশের নিচে তাদের কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ পূর্বকালীন পার্বত্যঞ্চলের সেই হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলো প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য হয়নি।

তাদের অধিকাংশেরই জন্ম নতুন পুনর্বাসন এলাকায়। তারা হয়তো অনেকেই তাদের নিকট আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব যারা বয়সে প্রবীণ তাদের নিকট থেকে তৎকালীন পার্বত্য অঞ্চলের সুদিনের কথা সামান্য শুনে থাকবে।

তাই বর্তমান প্রজন্মের সময় হয়েছে অতীতকে জানার ও উপলব্ধি করার। আমাদের সেকালের জনগণের অবস্থা কেমন ছিল, পার্বত্য অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক, ভৌগলিক ও পরিবেশগত অবস্থা পরিবর্তনের কারণসমূহ, আমাদের হারিয়ে যাওয়া অতীত কেমন ছিল, কিভাবে পিতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ ও বাস্তুচ্যুত হলাম এসব কৌতুহল হয়তো অনেকেরই জানার আকাঙ্খা রয়েছে।

বিশেষভাবে বর্তমান প্রজন্মের এবং অনাগত বংশধরদের পার্বত্য অঞ্চলের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা এবং অতীত ইতিহাসকে জানা একান্ত আবশ্যক।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল তখন একক অখন্ড জেলা। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল মোতাবেক এর প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হতো। জেলা প্রশাসক ছিলেন সর্বময় কর্তা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল শাসন বর্হিভূত এলাকা (Excluded Area)। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল কেবল আদিবাসী অধ্যুষিত নিবিড় এলাকা। আদিবাসী ছাড়া তখন অন্যান্যদের স্থায়ী বসবাস ও জমিজমা ক্রয় করা নিষিদ্ধ ছিল।

জেলা শহর ও উপজেলার হাটবাজারগুলো ছাড়া অন্য এলাকায় কোন অ-আদিবাসী বহিরাগত লোকজনের বসবাস ছিল না। ব্যবসা বাণিজ্য প্রধানত চট্টগ্রাম জেলার হিন্দু ও মুসলমান ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল।

তারা ছিল অস্থায়ী ও ভাসমান। তারা কেবল ব্যবসা বাণিজ্য উপলক্ষে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থান করত। তাদের সঙ্গে আদিবাসীদের কোন বিবাদ ছিল না। সম্পর্ক ছিল অতি মধুর।

তারা আদিবাসীদের নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য দ্রব্যাদি সরবরাহ করত। আর তাদের কাছ থেকে কাঁচামালসহ অন্যান্য মালামাল ক্রয় করে চট্টগ্রামে চালান দিত।

অপরাধের হার ছিল অতি কম। সে জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন জর্জ কোর্ট বা সেসনস কোটের্রও প্রচলন ছিল না। তখন মহকুমা হাকিম বা এস.ডি.ও. কোর্ট ছাড়া আরো দু’একটি ১ম শ্রেণী ও ২য় শ্রেণীর কোর্ট ছিল মাত্র।

এইসব কোর্টের মামলার সংখ্যা ছিল অতি সল্প। অধিকাংশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ছিলেন আদিবাসী পাহাড়ী সম্প্রদায়ের। আর জমি জমা ও সেটেলমেন্টের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারিরাও ছিল পাহাড়ী সেজন্য আজকাল দিনের মতো ভূমি সংক্রান্ত কোন মামলা মোকদ্দমা ও বিরোধ তখন ছিল না।

আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ছিল সর্বত্র অতি সন্তোষজনক। গ্রামাঞ্চলের হেডম্যান ও কার্বারীরা স্থানীয় আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন। সর্বত্র ছিল স্থিতিশীল অবস্থা। গ্রামে কোন বিরোধ দেখা দিলে কার্বারীরা তা মিটমাট করে দিতেন।

বিরোধ একটু বেশি জটিল হলে হেডম্যান অফিস পর্যন্ত তা গড়াতো। তাও ছিল কদাচিৎ। দুই তিন বছরের মধ্যে কদাচিৎ বিচ্ছিন্ন কয়েকটি খুনের ঘটনা সংগঠিত হতো। ধর্ষণ সংক্রান্ত অপরাধ আদিবাসী সমাজে অজানা ছিল। মেয়ে সংক্রান্ত মামলা ও বিবাদ কার্বারীরা মিটমাট করতেন।

বাঁধ নির্মাণের পূর্বে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল একান্তভাবে নিবিড় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। ছোট ছোট হাটবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র ও জেলা প্রধান শহরগুলো ছাড়া কোন বাঙালী বা বহিরাগত লোকের বসবাসই ছিল না।

হাটবাজার ও জেলা শহরগুলোতে বসবাসরত ব্যবসায়ী ও লোকজন সবাই ছিল অস্থায়ী ও ভাসমান। তারা কোন কাজ কিংবা ব্যবসা উপলক্ষে বিশেষ সময়ের জন্য এ অঞ্চলে আগমন করতো। তাদের অবস্থান ছিল অস্থায়ী।

এসব অধিকাংশ ব্যবসায়ীর ঘরবাড়ি ছিল প্রতিবেশি চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায়। তারা প্রধানত এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থ উপার্জনের জন্য আসা যাওয়া করতো। পার্বত্য অঞ্চলে তাদের কোন স্থায়ী জমিজমা ও বসতবাড়ি ছিল না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েল অনুযায়ী বহিরাগতদের এ অঞ্চলে ভূ-সম্পত্তি স্থায়ীভাবে ক্রয় ও বসতি স্থাপন নিষিদ্ধ ছিল। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল পাহাড়ীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। তাদের ছিল বাঁধাহীন উন্মুক্ত জীবন।

তারা মুক্ত বিহঙ্গের মতো পার্বত্য অঞ্চলে সর্বত্র বিচরণ করতো। তারা পার্বত্য অঞ্চলের যে কোন স্থানে নির্বিগ্নে বিচরণ ও বসতি স্থাপন করতে পারতো। পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামগুলো ছিল ফাঁকা ফাঁকা। লোকজনের বসতি ছিল অতি কম।

এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামের দুরত্ব ছিল চার/পাঁচ মাইল থেকে সাত/আট মাইল। কোথাও কোথাও সাত/আট মাইল। অধিকাংশ গ্রামগুলো ছিল কন্নফুলি (কর্ণফুলী), হাজলং (কাসালং), চেঙে (চেঙ্গী) ও মিইনি (মাইনী) নদীর তীরবর্তী কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে।

কোথাও যেন কাঁদা বা স্যাঁতসেতে পরিবেশ ছিল না। সর্বত্র ছিল শুকনো ও ঝকঝকে পরিবেশ। পরিবেশ ছিল নির্মল ও স্বাস্থ্যকর। চতুর্দিকে সর্বত্র ছিল সবুজ শ্যামল আস্তরণ।

উত্তর দক্ষিণে, পূর্ব পশ্চিমে যেদিকে দৃষ্টি দেয়া হোক না কেন কেবল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ভূমি, ছড়া-ছড়ি, খাল-বিল, গিরি-খাদ ও ঝর্ণা। বনভূমিতে ছিল বিশাল বিশাল মূল্যবান বৃক্ষ – গজ্জন (গর্জন), মেয়গিনি (মেহগিনি), সিবিগ (সিবিট), চাম্বা (চাম্পা), চাপালিশ ইত্যাদি।

এক একটা গাছের উচ্চতা আশি–একশত হাত, প্রস্থে দশ-বার হাত। বয়স হবে কমপক্ষে একশ থেকে দেড়শ বছর। সারা পার্বত্য অঞ্চল জুড়ে ছিল শান্তির সুবাতাস। সর্বত্র ছিল স্থিতিশীলতা।

ছিল না কোন চুরি, ডাকাতি, খুন ও রাহাজানি। জনগণের মধ্যে ছিল না কোন অভাব অনটন, ছিলনা ভয়াতঙ্ক ও টেনশন। ছিল না জীবিকা সংস্থানের কোন উদ্বিগ্নতা কিংবা ভবিষ্যৎ বাঁচার জীবন মরণ সংগ্রামের প্রস্তুতি।

আদিবাসীরা প্রকৃতির সন্তান। তারা জানে প্রকৃতির দান অফুরন্ত। প্রকৃতি তার অফুরন্ত সম্পদ দু’হাতে উজার করে দিয়েছে তার সন্তানদের।

প্রত্যন্তর গ্রামের আদিবাসী জুমিয়ারাও অতি স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করতো। সল্প পরিশ্রমে জুম থেকে বছরের খোরাখী ছাড়াও হরেক রকম তরকারী ও অর্থকরী ফসল উৎপাদিত হতো।

Jum cultivation
জুম চাষ

গৃহস্থের চাহিদা মিটিয়েও এসব তরকারী ও অর্থকরী ফসলাদি বাজারে বিক্রয় করে প্রচুর অর্থ উপার্জিত হত। গ্রামগুলোর কাছে ছিল ঘন সবুজ অরণ্য। এসব অরণ্যে বিশাল বিশাল উঁচু গজ্জন (গর্জন) ও সিবিগ (সিবিট) গাছের সারি। গভীর রাত্রে গজ্জন (গর্জন) কিংবা সিবিগ (সিবিট) গাছের উঁচু মগডালে বসে হুতুম পেঁচা (চাকমা ভাষায় দুদুখাং) দু-দু-দু-দু করে ডাকতে থাকে।

ইহারা নিশাচর পাখি। রাত্রে ছড়া ও খালগুলোতে কাঁকড়া ও মাছ ধরে ধরে খায়। সেই ডাকে গা ছম ছম করে উঠে। ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে বিছানায় মায়ের বুকে লুকিয়ে থাকে। চাকমাদের বিশ্বাস এই হুতুম পেঁচাদের রাত্রে নাকি ভুতে পায়।

যদি কেউ ইচ্ছা করে তাদের অনুসরণ করে দু-দু-দু-দু করলে সেই লোককে বাড়িতে আক্রমণ করতে থাকে। কাদি (কার্তিক) ও  আয়ুন (অগ্রাহায়ন) মাসে যখন লোকজন জুম থেকে প্রত্যাবর্তন করে তখন গ্রামের শান্তি ও সুদিন।

লোকর ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব ও খানাপিনার অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই সময় রাত্রে লক্ষী পেঁচা বাড়ির কাছাকাছি বৃক্ষের ঝোপে থেকে ‘‘মোকপো কদরক’’, “মাকপো কদরক” করে ডাকতে থাকে।

তখন গ্রামে এক অনির্বচনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তখনকার দিনে আরেক ধরণের নিশাচর জাতীয় চিল ছিল। চাকমা ভাষায় এদের ‘‘উ-আং’’ বলা হয়।

ইহারাও গভীর বনে উঁচু পাহাড়ে সিবিগ (সিবিট) কিংবা গজ্জন (গর্জন) গাছের মগডালে বসে “উ-আং , উ-আং” করে বিকট চিৎকার করতে থাকে। একা হলে সে শব্দে গা ঝিম ঝিম করে উঠে। একটা অজানা, অচেনা ভয় উৎপন্ন হয়।

বৈশাখ মাসে যখন ধান বপনের জন্য জুম পরিস্কার করা হয় তখন চর্তুদিকে সর্বত্র ন্যাড়া পাহাড়। লোকজন কোমরে “কুড়-মের” মধ্যে ধান নিয়ে এক প্রকার পুরাতন দা (চুচ্যেং টাগল) দ্বারা মাটিতে ধান বপন করতে থাকে।

ঠিক সময়ে পাহাড়ে কতগুলো পোকার আর্বিভাব হয়। সেই পোকাকে চাকমারা “চেরেই পুক” বলে। এইসব পোকা পোড়া গাছের গোড়ায় বসে সারাক্ষণই “চেরেই-রে-রে-ই” করে ডাকতে থাকে। তাদের ডাকে নিদাগ ক্লান্ত দিনের অবসাদ যেন দূরও হয়।

এই পোকা দেখতে অনেকটা ডাঁশ মাছির মতো দেখায়। আর এক ধরণের পোকা বৈশাখ মাসে আর্বিভাব হয়। এরা পাহাড়ের নিবৃত স্থানে ঢালু জায়গায়, খাঁড়া পাহাড়ের ঝিরিতে কিংবা পাহাড়ের খাদে বা গাছের আগায় বসে সকাল বিকাল “ঞায়-ঞায়-ঞায়” করে সমসুরে একসাথে ডাকতে থাকে। এদের খরান্যেপুক বলা হয়। তখন জুম পাহাড়ের পরিবেশ ভিন্নরুপ ধারণ করে।

ভাদ্র-আর্শ্বিন মাসে জুমে এক ধরণের খয়েরি রঙের মাথায় শিংযুক্ত পোকা পাওয়া যায়। চাকমা ভাষায় এদেরকে “শিং পুক” বলা হয়। সন্ধ্যার দিকে “সিন্দিরে ফুল” ফালি ফালি করে কেটে ছোট ছেঝাট বাঁশের আগায় ছিটিয়ে দিলে রাত্রে এগুলো দেখতে আসে। তারপর তাদের আটকানো হয়।

ছোট ছোট ছেলেমেযেরা শিং পুক (পোকা) হাতে নিয়ে বিভিন্ন পোকার মধ্যে ষাড়ের লড়াইয়ের মতো লড়াই আয়োজন করে মজা পায়। এই সময় পাহাড়ে আরেক রকম ঘন সবুজ ও নীল রঙ মিশ্রিত পোকা পাওয়া যায়।

এদের চাকমা ভাষায় “হেজ কুমোরি” পুক (পোকা) বলা হয়। এই সব পোকা দেখতে অনেক সুন্দর হয়। ইহারা হোড়ই (কড়ই) গাছের কচি কচি পাতা খেতে পছন্দ করে। এরা অলংকারিক জাতীয় পোকা। তারা ফসলের কোন ক্ষতি করে না।

ভাদ্র-আশ্বিন (ভাদ-আজিন) মাসের পার এসব পোকা অদৃশ্য হয়ে যায়। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ও বনে এইসব পোকার ছড়াছড়ি ছিল। গোটা পার্বত্য অঞ্চলে ছিল ছোটবড় বিভিন্ন প্রকার পাখি, পোকা মাকড়, কীট পতঙ্গের আবাসস্থল।

তখন সারাল্যা চিল নামে (শরৎকালীন চিল) এক প্রকার চিল ছিল। আকারে ইহা বেশ বড়। ইহারা সাপ ধরে খায়। আশ্বিন ও কার্তিক (আজিন-কাদি) মাসে আকাশের খুব উঁচুতে ঘুরপাক খেতে খেতে “চিজিক চিজিক চিক, চিজিক চিজিক চিক” করে করুন সুরে ডাকতে থাকে।

এরা গজ্জন (গর্জন) ও সিবিগ (সিবিট) গাছের খুব উঁচু মগডালে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। একসঙ্গে সবসময় একজোড়া থাকে। তাদের ডাকে মানুষের মনে এক করুন ও নিঃসঙ্গ ভাব সৃষ্টি হয়।

এইসব পাখি একসময় পার্বত্য অঞ্চলের সম্পদ ছিল। গভীর বন জঙ্গল ও গাছ গাছড়া ধ্বংসের ফলে এই প্রজাতির পাখি এখন বিরল। গভীর বনে উঁচু পাহাড়ের বড় বড় বৃক্ষের মাখায় বসে গম্ভীর স্বরে “উরু-ধুং, উরু-ধুং” ধুংকল করে ডাকতে থাকে।

ইহা ধুংকল শিকারিদের অতি প্রিয় শিকার ছিল। আকৃতিতে বেশ বড়। দেখতে সবুজ ও কয়েরি রঙের। গাছের ফলমূল তাদের অন্যতম খাদ্য। বছরের একটা বিশেষ সময়ে মধু খেতে তাদের দেখতে পাওয়া যায়।

সেকালে গভীর বনে উঁচু পাহাড়ে ঘোরার সময় ধুংকলের গম্ভীর স্বর শোনা একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। বন জঙ্গল ও তাদের আস্তানা ধ্বংসের ফলে আজ তারা হারিয়ে গেছে।

আর এক প্রজাতির বাদামাী রঙের মাঝারি আকারের পাখি আছে। চাকমারা তাদের বিজু পেক বলে। চৈত্র (চোন) মাসের শেষ দিকে বিজু আসার পূর্বে বাড়ির কাছাকাছি ঝোপে বসে বিজু বিজু করে বিজুর আগাম বার্তা জানিয়ে দেয়। এই পাখিটি ডাকলে বুঝতে হবে যে বিজু আসতে খুব একটা দেরী নেই।

জুমিয়াদের বিশ্বাস যে বছর “মে-মে-ছাগলী” (টুনটুনির মতো ছোট পাখি) ধানের আগায় বাসা বাঁধে সে বছর গৃহীর সৌভাগ্য ফলে। “মে-মে–ছাগলী” সৌভাগ্য প্রতীক বলে তাদের বিশ্বাস।

তখন তারা আনুষ্ঠানিক ভাবে ধানের পুরো গাছসহ সেই বাসাটাকে তুলে এনে বাড়ির মূল খাম্বার সাথে বেঁধে রাখে। যেদিন বাসা তুলে আনা হয় সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে পাড়া প্রতিবেশিদের শুকর কেটে আমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হয়।

তখনকার সময়ে প্রত্যন্তর অঞ্চলে শিক্ষার হার অতি কম হওয়ায় সময় ও ঘড়ির সাথে সাধারণ মানুষের বিশেষ পরিচিতি ছিল না। এমনি ঘড়ির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে তখন আষাঢ় (আজার) ও শ্রাবণ (সাওন) মাসের ঘনঘোর বর্ষায় একটানা রাত দিন মুষলধারে বৃষ্টি নামতে থাকে।

সারাদিন আকাশ অন্ধকার ও ঘোরতর মেঘাচ্ছন্ন থাকে। সূর্য ডুবছে কিনা বুঝা দায়। সন্ধ্যা নামছে কিনা সহজে বুঝা যায়না। এদিকে সন্ধ্যার আগেভাগে গরু-মহিষগুলোকে গোয়াল ঘরে আনার প্রয়োজন হয়।

তাছাড়া মোরগ-মুরগীগুলোকে তাদের খাঁচায় ঢুকানো আবশ্যক হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় ঘরের গৃহিনী পিজোর/বাইছসানা (পাক) ঘরের ছাদে অবস্থিত কদু শাকের আগায় সন্ধ্যাকালীন ফুল ফুটেছে কিনা চুপি চুপি লক্ষ্য করতে থাকে।

যদি ফুল ফুটে থাকে তবে বুঝতে হবে সূর্য ডুবে গেছে। সেভাবে সন্ধ্যাকালীন বিভিন্ন কার্য সমাধান করা হয়। প্রকৃতির সাথে এসব ফুল ফোটার যে নির্দিষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তখনকার দিনে আদিবাসীদের অজানা ছিল না।

পাহাড়ের পাদদেশে গ্রামে অধিকাংশ বাড়ির সন্নিকটে ছোট-ছোট বন জঙ্গল, ঝোপ ঝাড় ও বাঁশবন পরিবেষ্টিত ছিলো। এইসব বনজঙ্গল ও বাঁশের আগায় বিভিন্ন ধরণের লম্বা লম্বা পাযুক্ত গেছো ব্যাঙ, খাকব্যাঙ বর্ষাকালের বাদলঝরা ঘনঘোর বর্ষার রাতে “খাক-পেরেত”, “খাক-পেরেত” শব্দে ডাকতে থাকে।

আর বনের ধারে ঝিরি কিংবা খাল-বিলে বিভিন্ন ধরণের ব্যাঙ যেমন – ভাজা ব্যাঙ, কুরকুরি ব্যাঙ, ভোয়া ব্যাঙ (সোনা ব্যাঙ), ঘিলে ব্যাঙ, ও কদুবিচি ব্যাঙ (এক ধরণের ক্ষুদ্রাকৃতির ব্যাঙ) সারাক্ষণই ডাকতে থাকে।

আর ঘিলে ব্যাঙগুলো মেঘের ঘনঘটা বুঝে কচুবনে “ওয়া, ওয়া” শব্দে ডেকে ওঠে। অনেকেই এই ডাককে চাকমা ভাষায় এভাবে শুনতো “পেয়ছ, নপাং, তগা” অর্থাৎ পেয়েছ, পায়নি, খোঁজ ইত্যাদি।

তখনকার সময়ে সমতল এলাকায় গ্রামের সন্নিকটে বিশাল বিশাল ফসলের মাঠ। বিভিন্ন ফসলসহ ধান উৎপাদন করা এসব মাঠ সমূহে ফসল তোলা হলে এসব মাঠ একদম ফাঁকা হয়। তখন গ্রামে কোন গরু, মহিষ মারা গেলে এইসব মাঠে ফেলে দেয়া হয়।

ফেলে দেওয়ার দুয়েকদিন পর কাক ডাকাডাকি শুরু করে। এর পরবর্তী দুই-তিন দিনের মধ্যে হাজার হাজার শকুনের দল এসব মরা পশু টানাটানি শুরু করে। তখন তাদের কি চেঁচামেচির শব্দ। ওরা দুয়েকদিনের মধ্যে মরা পশু হাড্ডিসহ খেয়ে সাবার করে ফেলে।

সাধারণত শীতকালে এসব শকুনের ঝাঁক দেখা যায়। তারা গ্রামের কাছাকাছি বড় বড় বৃক্ষের উচুঁ ডালে বসে। কোন মরা গরু-মহিষ মাঠে ফেলে দিলে তারা বহু দূর থেকেও টের পায়। গভীর জঙ্গলে এসব শকুন গজ্জন (গর্জন) গাছের উঁচু ডালে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। এরা মরা ছাড়া কোন বস্তু খায় না।

বন জঙ্গল ধ্বংস ও বড় বড় বৃক্ষের অভাবে বর্তমানে শকুনের দল আর চোখে পড়ে না। পরিবেশ ধ্বংসের ফলে তারা অন্যত্র চলে গেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমি চিরকালই অজস্র বন্য ফলমূলে সমৃদ্ধ ছিলো।

পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সর্বত্র দিগন্ত বিস্তৃত সেই বনভূমি। বিশাল বিশাল উঁচু উঁচু বৃক্ষের সারি। সমস্ত বন চিরহরিৎ বৃক্ষের সমাহার, কোথাও পাতাঝরা বৃক্ষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল। এইসব বনে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন স্বাদের বড় ছোট ও মাঝারি ধরণের অসংখ্য বুনো ফল গাছের সমাহার।

টক, মিষ্টি, ঝাল আর তেতো স্বাদের কত নাম না জানা ফল। তন্মধ্যে “গ্রে আম” নামে এক ছোট আম লতায় ধরে। খেতে খুব মিষ্টি। সাইজেও দেখতে কাজু বাদামের মতো। এককালীন গভীর বনে পাওয়া যেত আর নল আম নামে এক ধরণের ছোট অকারের মিষ্টি আম পাওয়া যেত।

এগুলো গাছে ধরে। আর ছিল গুইগুট্যা, কোগুলো, কুজুমগলো, বট্টগুলো, ডুমুরগুলো, সরবেতগুলো, রগোচকো (রসকোগুলো) ও চামিনি হাত্তোল (চামনি কাঁঠাল) ইত্যাদি। চামানি কাঁঠাল চাপালিশ গাছে ধরে এমন এক ধরণের জংলী কাঁঠাল।

আষাঢ় (আজার) ও শ্রাবণ (সাওন) মাসে পাকে। ছোট ছোট কোষ। খেতে খুব মিষ্টি। আর ছিলো “পক পক গুলো” ও “পিত্তং (পিত্তুং) গুলো”। “পক পক” গুলো লতায় ধরে। আর পিত্তং (পিত্তুং) গুলোধানের মতো ছোট এক গাছে ধরে।

গায়ে কাঁটাযুক্ত আকৃতির ছোট বান্দর মারফা নামে এক ধরণের জংলী ফল ছিল। সারা গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁটা এগুলো লতায় ধরে। এখন আর চোখে পড়ে না। আর ছিল প্রেজাং বীচি নামে এক প্রকার ছোট আকৃতির ফল। এগুলো গাছে ধরতো।

গভীর জঙ্গলে বিশাল বিমাল উঁচু বৃক্ষের গিলালতার বহর জন্মাতো। এ গিলেলতায় (গিলালতায়) সারি সারি গিলে (গিলা) ধরতো। ইহা চিরহরিৎ গুলোর অর্ন্তগত। আর ছিল বিশাল বিশাল বৃক্ষের “পিলেগুলো (পিলাগুলো) লতার বহর।

পিলেগুলো (পিলাগুলো) সাইজে বেশ বড়। এক একটার ওজন এক থেকে দুই কেজি হবে। এগুলো থেকে ভালো তৈল পাওয়া যায়। আর শাঁসগুলো ভাজা করে খেতে খুব মজা লাগে।

গভীর অরণ্যে ছিল আরো “মরিজে (মরিচা)” ও “কেরেত” বেতের বন। এক একটা মরিজে (মরিচা) বেত ত্রিশ-চল্লিশ হাত লম্বা হয়। মরিজের (মরিচার) কচি আগা পাহাড়ীরা তরকারী হিসেবে খেতে খুবই পছন্দ করে। গোলা ও কেরেত বেত গিয়ে উৎকৃষ্ট মানের ফার্নিচার তৈরি করা হয়। বন-জঙ্গল ধ্বংসের ফলে বর্তমানে এসব আজ বিরল।

জুমে প্রচুর “মু আলু” ও “জুরো আলু (ঠান্ডা আলু)” ও “রেং” উৎপন্ন হয়। মু আলু পানিতে সিদ্ধ করে ও আগুনে পুড়ে খাওয়া যায়। আশ্বিন (আয়ুন) ও কার্তিক (কাদি) মাসে এগুলো জুম থেকে তোলা হয়। বাজারেও বিক্রয় করা হয়।

জুমঘর
জুম ঘর

বৈশাখ (বইজেক) মাসে পাহাড়ের জংলী পান আলু ও কয়েং (কৈয়াং) আলু পাওয়া পাওয়া যায়। এগুলো প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। খেতে খুবই মিষ্টি। ভাতের পরিবর্তে খাওয়া চলে।

অনেক সময় দুর্ভিক্ষ ও অভাবের সময় এসব জংলী আলু খেয়ে লোকজন বেঁচে থাকে। আর পাহাড়ে প্রচুর জংলী কলা গাছ পাওয়া যায়। এই কলাগাছ ছিঁড়ে ভেতরের অংশ তরকারী হিসেবে খাওয়া হয়। জংলী কলা থোড়ও তরকারী হিসেবে উৎকৃষ্ট।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পূর্বে সমতল এলাকায় সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলব্যাপি ছিল দিগন্ত বিস্তৃত শত শত মাইল লম্বা বিশাল বিশাল শনখোলা। এইসব শনখোলা থেকে কোটি কোটি টাকার শনের আটি কন্নফুলি (কর্ণফুলী), চেঙে (চেঙ্গী) ও হাজলং (কাসালং) নদী দিয়ে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশের চালির উপর দিয়ে চালান দেওয়া হত।

সমতল জেলাগুলোতে গৃহ নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যাপকভাবে এই শন ব্যবহারের প্রচলন ছিল। এই শন ঘাস কাঁটার জন্য ফাল্গুন (ফায়ুন) ও চৈত্র (চোন) মাসে হাজার হাজার বাঙালী মুসলমান শ্রমিক চট্টগ্রাম জেলা থেকে পার্বত্যাঞ্চলে আগমন করে থাকে।

অধিকাংশ শন খোলাগুলো ছিল কন্নফুলি (কর্ণফুলী), চেঙে (চেঙ্গী) ও হাজলং (কাসালং) নদীর তীরবর্তী। শন কাঁটার পর নদীর ধারে বিশাল বিশাল স্তুপ করে রেখে বাঁশের চালির উপর জড়ো করা হতো। কাপ্তাই বাঁধে সমস্ত সমতল এলাকাসমূহ জলমগ্ন হওয়ায় মনখোলাগুলি সম্পুর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়। বর্তমানে ইহা অতীত স্মৃতি।

আর সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে পাহাড়-পর্বত গুলোতে সারা বনভূমিব্যাপী ছিল সর্বত্র “ভূলং বন”। এইসব ভূলং বনে কার্তিক (কাদি) ও অগ্রাহায়ন (আয়ুন) মাসে ফুল ধরে তাতে সমগ্র পাহাড়গুলো দিগন্তজুড়ে শ্বেতবর্ণ ধারণ করে।

এই ভূলংগুলো হল এক ধরণের ঘাস এইগুলো থেকে যে নতুন কচি ডগা জন্মে তা গরু মহিষের উৎকৃষ্ট ঘাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ভূলং ফুলগুলোতে একধরণের তুলা জন্মে।

শীতকালে সকালে ও বিকালে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ির সামনে/উঠানে আগুন পোহানোর সময় ভূলং এর ডগা আগুনে দিয়ে খেলা করতে আনন্দ পায়।

কার্তিক (কাদি) মাসে কয়েক মাইল দূরে থেকেও শ্বেতবর্ণের ভূলংবন চোখে পড়ে। তখন সমগ্র এলাকা এক অপরুপ দৃশ্য ধারণ করে। এইসব নান্দনিক দৃশ্য ছিল তদানীন্তন পার্বত্যাঞ্চলে উপভোগের বিষয়।

তখনকার দিনে পাহাড়গুলোতে সর্বত্র ছিল পায়া বাঁশের বিশাল সবুজ বন। উত্তর-দক্ষিণে ও পূর্ব-পশ্চিমে কেবল ছিল বাঁশের ঘন বন। বাঁশ ঝাড়ের নীচে সর্বত্র ছিল ঝরা বাঁশ পাতার ছড়াছড়ি।

এইসব বাঁশঝাড়ের নীচে হাটার সময় বাঁশ পাতার খোল পাতার পট পট শব্দ। আষাঢ় (আজার) ও শ্রাবণ (সাওন) মাসে ভাচ্ছুরি (বাঁশ কুড়োল) তোলার ধুম। বিভিন্ন ধরণের ভাচ্ছুরি (বাঁশ কুড়োল)।

মিদিঙ্গে (মিটিংগা) ও মুলি বাঁশের ভাচ্ছুরি (বাঁশ কুড়োল) খেতে বেশি মজা। পাহাড়ী মেয়েরা মাথায় থুরং নিয়ে ভাচ্ছুরি (বাঁশ কুড়োল) তুলতে দলবদ্ধভাবে পাহাড়ে গমন করে। ভাচ্ছুরি (বাঁশ কুড়োল) প্রতিটি পাহাড়ী লোকেরই অতি প্রিয় খাদ্য। ইহা পাহাড়ী অঞ্চলের অন্যতম কালচার ও চিরন্তন পরিবেশ। আজ যেন সবই অতীতের স্বপ্ন।

কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পূর্বে আদিবাসীদের জীবন সর্বত্র ছিল সুখ ও শান্তির পরিবেশ। কন্নফুলি (কর্ণফুলী) ও ইহার শাখা প্রশাখা বিধৌত অববাহিকার সমতল অঞ্চলগুলো ছিল অতি উর্বর। জনবসতি ছিল অতি কম।

Hill village, Painting: Nantu Chakma
Hill village, Painting: Nantu Chakma

পাহাড় পর্বতগুলো চিরহরিৎ সবুজ অরণ্যে আবৃত। এসব পাহাড় পর্বত, সবুজ অরণ্যে ভ’মি বিচিত্র ধরণের সরীসৃপ পশুপাখি ও জীবজন্তুতে ছিল পরিপূর্ণ। খাল বিল জলাশয়, নদনদী ও ছড়াছড়িগুলি ছিল অগাধ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ।

সমগ্র অঞ্চল খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে ছিল অগ্রগামী। শিক্ষা দীক্ষা, ক্রীড়া এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তদানীন্তন তিন মহকুমার মধ্যে রাঙ্গামাটি ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী।

বাঁধের ফলে কন্নফুলি (কর্ণফুলি) নদী ও ইহার উজান ভাটিতে একশ মাইল এলাকা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। রাঙ্গামাটি শহর ও ইহার সংলগ্ন উপর ও নীচ ভাটিতে একশ ভাগ বিশাল উর্বর সমতল জমিগুলো জলমগ্ন হয়।

কন্নফুলি (কর্ণফুলি) শাখা বিধৌত হাজলং (কাসালং), চেঙে (চেঙ্গী), মিইনি (মাইনী), সুবলং, রেংখ্যা অঞ্চলের উর্বর সমতল এলাকাগুলো অন্তত ৮০% হতে ১০০% আক্রান্ত হয়।

পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরও জলমগ্ন হয়। রাঙ্গামাটি শহর ছিল শতাব্দী পুরাতন ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ী নগরী। তখন ইহা ছিল সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম শহর এবং অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী।

ইহা চাকমা সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং প্রশাসনের প্রধান কেন্দ্র। ১৮৭০ সনে ইহার পত্তন। তার আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজধানী ছিল চন্দ্রঘোনা। চাকমা রাজার বাসস্থান ও ছিল এই রাঙ্গামাটি শহর।

তিন দিকে কন্নফুলি (কর্ণফুলী) নদী দ্বারা পরিবেশবেষ্ঠিত ইহা ছিল অতি ছিমছাম ঝকঝকে পাহাড়ী শহর। সরকারি অফিস আদালত ও বাসস্থান গুলো ছিল টিলার উপর। সমগ্র জেলার একমাত্র প্রাচীন উচ্চবিদ্যালয়টি ছিল এই নগরে। বাজারটিও ছিল বিশাল।

শহরটি বর্তমান ডি.সি. বাংলোর প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে সোজা দক্ষিণে প্রায় দেড় মাইল ব্যাপী সমান্তরালভাবে বিস্তৃত। প্রস্থে আনুমানিক পাঁচশত গজ। আবার পশ্চিম দক্ষিণে দিক পরিবর্তন করে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে চলে গেছে।

তারপর কোতোয়ালী থানার পার্শ্ব দিয়ে সোজা পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে পুরাতন কাসিমবাজার পর্যন্ত চলে যায়। কোতোয়ালী থানার পার্শ্ব দিয়ে কন্নফুলি (কর্ণফুলী) ঘেঁষে চট্টগ্রাম শহরের রাস্তা খচ্চর ঘাট হয়ে চলে গেছে।

ডি.সি. বাংলোর পূর্বপার্শ্বে কর্ণফুলী নদীর উঁচু গভীর খাদ। ইহা বিশাল শিলাখন্ড দ্বারা গঠিত। এ খাদে কন্নফুলি (কর্ণফুলী) নদীর পানি এমন গভীর ও নীলাভ যে স্নান করতে অনেকে সাহস পায় না।

বর্ষাকালে পানি আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করে ত্রাসের সৃষ্টি করে। চাকমারা এ খাদকে রাঙামাত্য মোর বলে। থানার সাথে লাপোয়া ওসির কোয়ার্টার, পুলিশ ক্লাব ও পানি সরবরাহের মেশিন ঘর পূর্ব দিকে সামান্য টিলার উপর বাজার ফান্ড অফিস, ট্রেজারি অফিস, ডি.সি. অফিস, নীচে সিএন্ডবি অফিস, তারই সংলগ্ন উত্তর দিকে পোস্ট অফিস।

ডি.সি. অফিসের নীচে রাস্তার পার্শ্বে একটা বিরাট হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, ইহার নাম ছিল কোর্ট বিল্ডিং রেস্টুরেন্ট। পোষ্ট অফিসের পার্শ্বে কন্নফুলি (কর্ণফুলী) নদীর ঘাটের পাকা সিঁড়ি। ঘাটে খেয়ামাঝি সবসময় প্রস্তুত থাকে। নদীর ঐ পাড়ে মুসলমান পাড়া পুরান বস্তি। কোতোয়ালী থানার উভয় পার্শ্বে সামনে দিয়ে পাকা সড়ক।

সড়কের মাঠের উত্তর পার্শ্বে ইন্দ্রপুরী সিনেমা। সড়কের উভয় পাশে বিরাট বিরাট পুরাতন মেহগিনি গাছের সারি। সিনেমা হলের দক্ষিণ বরাবর ফুটবর মাঠ। যেখানে ফুটবল মাঠ শেষ হয়েছে সড়ক দুটি সেখানে মিলিত হয়ে টাউনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে।

ফুটবল মাঠের শেষ প্রান্তে ( পশ্চিম দিকে) কন্নফুলি (কর্ণফুলী) কূল ঘেঁষে একটি দোকান, একটি হিন্দু কালীবাড়ি, শাহ হাই স্কুল (বয়েজ স্কুল), স্টাফ কোয়ার্টার, সরকারি হাসপাতাল, সিভিল সাপ্লাই এর হেড অফিস, কারমাইকেল হল (অফিসারদের জন্য), টেনিস কোর্ট, সরকারি স্টাফ কোয়ার্টার, প্রাইমারি গার্লস স্কুল, আবার সরকারী স্টাফ কোয়ার্টার এবং আবাসিক স্থাপনা।

তারপর রাঙ্গামাটি সরকারী সমবায় সমিতি ইত্যদি স্থাপনা রয়েছে। স্থাপনাগুলির ফ্লোর পাকা, বেড়াগুলি বাঁশের, কোনটির বেড়া বাঁশের তৈরি শিকের উপর সিমেন্টের প্লাস্টার করা উপরে টিনের ছাউনি।

এখান থেকে রাস্তার দুপার্শ্বে বিভিন্ন ধরণের দোকান। রাস্তার শেষ প্রান্ত (দক্ষিণে) উভয় পার্শ্বে একটি হিন্দু মন্দির, একটি মসজিদ, একটি ধর্মশালা ও একটি বড় বটবৃক্ষ আছে। তারপর বাজারের খেয়াঘাট। খেয়াঘাট বরাবর নদীর ছড়া কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। ছড়াটি রাঙামাত্যা ছড়া নামে পরিচিত। ছড়ার মাটি রাঙা।

এ রাঙামাত্যা ছড়া থেকে রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) নাম হয়েছে। টাউনের পূর্বদিকে বাজারের খেয়াঘাট ও কন্নফুলি (কর্ণফুলী) নদী। নদী পার হয়ে আনুমানিক হাজার গজ দূরে চাকমা রাজার সুরম্য দোতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা।

পাকা ফ্লোর মাটি থেকে ৭/৮ ফুট উঁচু। সামনে নাট্যঘর। চর্তুদিকে খোলা মাঠ। রাজবাড়ীর বিরাট সিংহ দরজার দুপার্শ্বে পাথর তৈরি দুটি সিংহ মূর্তি। দুটি সিংহ মূর্তির নিচে একটি করে ২টি চোট কামান। ফটকের অনতি দূরে আরও একটি কামান।

কামানগুলি পাকা উঁচু ফ্লোরের উপর বসানো। শ্বেত পাথরের রাজবাড়ীর সামান্য দূরে রাজা ভূবন মোহন রায়ের তৈরি আবক্ষ মূর্তি দন্ডায়মান।

মূর্তিটি ১০ ফুট পাকা ফ্লোরে গোলাকার ছোট ঘর। উপরে ৪ ফুট উঁচু ওয়াল। রাজার বড় কাচারী ঘর, দরবার হল, নাট্যশালা, বৌদ্ধ বিহার ছিল। মন্দিরে অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি দেড় টন ওজনের একটি বিরাট বৌদ্ধ মূর্তি। ইহা শাক্যমুনি নামে পরিচিত।

ডেপুটি কমিশনারের বাংলো থেকে পুলিশ বাংলো ও ফরেস্ট বাংলো পর্যন্ত সড়কের দুই পার্শ্বে রাস্তার বিভিন্ন প্রজাতীর ছোট বড় গাছ সারিবদ্ধ থাকায় সড়কের সৌন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি করেছে।

পুলিশ লাইনের প্রায়মারী স্কুলের লাগোয়া নীচে (দক্ষিণে) খচ্চর ঘাট। ইহা কন্নফুলি (কর্ণফুলী) ঘেঁষে একটি আবাসিক এলাকা। এখানে একটি ছড়া ছিল। ছড়ার উপর একটি কাঠের ব্রীজ। এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরের বাস, জীপ ইত্যদি যানবাহন চলাচল করে।

এক্সিকিউটিব ইঞ্জিনিয়ারের বাংলোর অনতি দূরে উত্তরে খ্রীস্টানদের কবরস্থান। ইহা চতুর্দিকে পাকা ওয়াল দিয়ে পরিবেষ্ঠিত। ইহার সন্নিকটে মহালছড়ি গাড়ী স্টেশন। এখানে ২/৩টি চায়ের দোকান ছিল।

রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে কন্নফুলি (কর্ণফুলী) নদীর তীরে পাথরঘাটা এলাকা। গাড়ী স্টেশনটি রিজার্ভের সাথে লাগোয়া। রিজার্ভটি ছিল গভীর অরণ্যে পরিপূর্ণ। এখানে অনেক জাতের পাখি, বানর, হরিণ, শেয়াল, বন্যশুকর এমনকি বাঘ, ভাল্লুকসহ বিভিন্ন সরীসৃপের অভয়ারণ্য ছিল।

১৯৬৯ সনের প্রথম দিকে এই রিজার্ভটি সাফ করে বর্তমান রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের নিকটে পুরাতন ডি.সি. অফিস নির্মিত হয়।

বর্তমান কাপ্তাই বাঁধের গোড়া থেকে রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি), রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) থেকে সুবলং, কাট্টলী, লুংগুদু (লংগদু), মিইনি (মাইনী), বুড়িঘাট, নান্যচর (নানিয়াচর), মালছড়ি (মহালছড়ি) প্রভৃতি বিশাল জলপথ; যেখানে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি।

সেখানে এখন দিন রাত হাজার হাজার বিভিন্ন ধরণের নৌযান চলাচল করে হাজার হাজার বহিরাগত জেলে মাছ ধরে, লক্ষ লক্ষ সেটেলার প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে, সেনাবাহিনীর বিভিন্ন নৌযান চলাচল করে থাকে।

এই বিশাল হৃদের তলে এককালে ছিল গভীর লক্ষ লক্ষ জনপদ, বিশাল বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত সমতর মাঠ, কৃষকদের সারি সারি ক্ষেত খামার, আম্রকানন ও ঘন লোকবসতি, কোলাহলপূর্ণ লোকালয়, জনারণ্য, উর্বর মাঠ, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গোয়ালঘর, শস্যশ্যামল উর্বর ক্ষেত ও ফসলের জমি।

লক্ষ লক্ষ নরনারীর কোলাহলে অহরহ মুখরিত ছিল এই অঞ্চল। লক্ষ লক্ষ লোকের পদচারণা, জনকোলাহল, বিশাল জনসমাগম, হাসি কান্না, বিরহ বেদনা, রোমাঞ্চ, সুখ-দুঃখের কাহিনী এই হ্রদেরতলে চিরতরে বিলীন হয়েছে।

লক্ষ লক্ষ সবুজ পাহাড়, অরণ্য, টিলা ছড়াছড়ি, ঝিরি, ঝর্ণা, ক্ষুদ্র ক্ষদ্র পরিসরের পাহাড়ে, ঢালু উপত্যকা, কিজিং, গিড়ি খাদ, তারেং লক্ষ লক্ষ গবাদিপশুর দিগন্ত বিস্তৃত চারণক্ষেত্র এই হৃদের তলে তলিয়ে গেছে।

এ হৃদের জলে সহস্র আর্ত মানুষের আহাজারি লুকিয়ে রয়েছে। লক্ষ লক্ষ গ্রাম ডুবে গেছে, সোনালী ফসলের জমি তলিয়ে গেছে, পাহাড়ীদের বছর পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটি , পবিত্র সমাধি ভূমি, শ্মশানঘাট, মন্দির, উপাসনালয় নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

এখন এ হৃদের জলে নৌকাবিহারে নগরের হাজার হাজার সুখীজন আনন্দ ভ্রমণ করে বেড়ায়, এ হৃদের তীরে লোকজন প্রমোট ভ্রমণ করে, সিনেমার বা নাটকের শুটিং করে, ভিডিও ক্যামেরা হাতে ভঙ্গি করে গান করে পিকনিক পার্টি ভ্রমণ করে, ওরা কি কখনও জানতে চায় এ হৃদের জলে এক নির্মম ইতিহাস লুকিয়ে আছে? আদিবাসীদের নিচিহ্ন করার ইতিহাস আছে।

এই হ্রদের বুকে আদিবাসী জনগোষ্ঠি চাকমাদের হাজার বছরের ঐহিত্য, ইতিহাস, আবাসভূমি, জনপদ, সভ্যতা, সলিল সমাধি হয়েছে। সেই অতীত ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, হারানো দিনের কথা, সোনালী যুগের কথা, রূপকথার দিনগুলোর কাহিনী এখন কেউ কখনও স্মরণ করেনা। খেয়ালও করে না।

এই বাঁধের ফলে উচ্ছেদ হওয়া দূর্ভাগ্যপীড়িত ৬০ হাজার আদিবাসী চাকমা জনগোষ্ঠী ছিন্নমূল অবস্থায় ভারতে দেশান্তরিত হয়। ইহা ছিল ১৯৬৩-৬৪ সালের ঘটনা। সেই এক মহাদুঃখের করুণ কাহিনী।

তারা এখনও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছে। এরা সবাই আমাদের অতি আপনজন অনেকেই আমাদের নিকট আত্মীয়। তাদের অনুপস্থিতি আমরা এখনও গভীরভাবে অনুভব করি।

এই কাপ্তাই বাঁধ যেন সমান্য বাঁধ নয় এই হৃদ যেন সামান্য নয়। এই হৃদের জল যেন সামান্য জল নয় এই যেন লক্ষ লক্ষ দূর্ভাগ্যপীড়িত বাস্তুহারা আদিবাসীদের চোখের জল।

kaptai dam
কাপ্তাই বাঁধ

লক্ষ লক্ষ ভাগ্য বিড়ম্বিত উচ্ছেদ হওয়া জনসাধারণের চোখের জলে গড়া এই কাপ্তাই বাঁধ, লক্ষ লক্ষ লোকের অশ্রুসজল চোখে সিক্ত এই হৃদ, লক্ষ লক্ষ অদিবাসীর রক্ত মাংসে গড়া এই কাপ্তাই বাঁধ, কর্ণফুলী বুকের উপর নির্মিত অভিশপ্ত এই বাঁধ।

এ যেন মরণ ফাঁদ, সর্বনাশা বাঁধ। পার্বত্যাঞ্চলের হতভাগা পাহাড়ীদের সব দূর্গতির কেন্দ্রবিন্দু, সর্ব দুঃখের আখড়া, গোটা পাহাড়ীদের ধ্বংসের মূল কারণ। চাকমা জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তির জন্য দায়ী সর্বনাশা এই বাঁধ। কর্ণফুলীর কান্না।

কন্নফুলি (কর্ণফুলী), চেঙে (চেঙ্গী) ও হাজলং (কাসালং) নদীর দু’তীরে অপরূপ শোভায় শোভিত সেই বিস্তৃত গ্রামের পর গ্রাম, শস্যশ্যামল ও সবুজ মাঠ, ক্ষেত খামার, বিশাল বিশাল জনপদ, পুকুর খেলার মাঠ, আম্রকানন বিশাল বিশাল বটবৃক্ষের ছায়াঘেরা কুঞ্জ, রাখালের খেলাঘর আজ কোথায়?

কোথায় সেই পিতৃ পুরুষের পবিত্র ঋতুতে অপরূপ শোভায় শোভিত শান্তশীতল অপরূপ সেই মাতৃভূমি? কোথায় সেই সারা বছরের বিভিন্ন ঋতুতে অপরূপ শোভায় শোভিত শান্তশীতল অপরূপ সেই পার্বত্য ভূমি? সবই কাপ্তাই হৃদের অতল জলে বিলীন হয়েছে। কোন দিন তার মূখ আর কেহ প্রত্যক্ষ করবে না।

কর্ণফুলী তীর ঘেঁষে শোভিত পুরাতন সেই রাঙ্গামাটি শহর পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রানকেন্দ্র আজ অতীতের স্বপ্ন। সেই শস্য শ্যামল সমতল ভূমি, শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত সেই মগবান গ্রাম, উর্বর বালুকালী অঞ্চল, ইতিহাসখ্যাত প্রাচীন বরাদম আজ কাপ্তাই হৃদের তলে বিলীন। হাজলং (কাসালং) নদীর তীর ঘেষে ওঠা সবুজ শ্যামলীময় ঘেরা, পাখি ডাকা উর্বর বিশাল জনপদ তুলোবান (তুলাবান)।

হাজলং (কাসালং) অঞ্চলের শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় সবচেয়ে অগ্রগামী তুলোবান (তুলাবান) গ্রাম। আমাদের হারানো গৌরব, শিক্ষার পাদপীঠ তুলোবান (তুলাবান), আজ অতীতের ইতিহাস।

আজ সেখানে দিগন্ত বিস্তৃত বিশাল জলরাশি যা পূর্ব পশ্চিমে ২০-২৫ মাইল বিস্তৃত। বিরাট বিরাট নৌযান চলে, লঞ্চ আসা যাওয়া করে, হাজার হাজার বহিরাগত জেলেরা বিভিন্ন ধরণের নৌকা ও জাল দিয়ে বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরে।

তার কোল ঘেঁষে লক্ষ লক্ষ বহিরাগত সেটেলারদের নিত্যনতুন কলোনী গড়ে ওঠেছে, শত শত মসজিদ ও কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে আদিবাসী লোকের আর কোন অস্তিত্ব চোখে পড়ে না, নেই অতীতের কোন নিশানা নিদর্শন।

হাজলং (কাসালং) উপত্যকার যেসব জনপদ কাপ্তাই হৃদের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে সেগুলো হল লুংগুদু (লংগদু), বরাদাম (বড়াদাম), বনছড়া , ডাইনে লুংগুদু (লংগদু), মইনতলা, গোলাছড়ি, ঢলন্যামূখ, ছয়কুড়ি বিল নাল, বরকলক (বড়কলক), রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) ঘাট, ঢেবাছড়ি, ভাসন্যা আদাম, বড় কাট্টলী এলাকা, ছোট কাট্টলী এলাকা, বিশাল কেরেঙ্গাছড়ি গ্রাম, শীলকাটাছড়া, শাক্যতুলী, তারেঙ্গাঘাট, কাকপরিয়া, ঠাকুরমা কলক, দরবিল, জর্নালমূখ, মানিকজোড়ছাড়, পেতান্যামাছড়া, হাতিলাদছড়া, উগলছড়ি, দুঃখ্যাচর, ঘনমোড়, কৌশল্যঘোনা, করদিছড়ি, বেগেনাছড়ি, সৌন্দর্ষনালা গ্রাম, রাঙাপানিছড়া, পুরাতন ডানে ও বামে আদরকছড়া (আটারকছড়া), উলুছড়ি, ঘাটছড়া, হুগুদছড়ি, কড়ল্যাছড়ি, মল্লাদীপ্যা, ইয়ারেংছড়ি, রেংকায্য, লম্বাছড়া, ভাঙামুড়ো, মেরুং আদাম (গ্রাম), পুরাতন মিইনিমুগ (মাইনিমুখ), বগাচতর, দুলুছড়ি, গুইছড়ি, রাঙেপাড়া, মারিচ্চেচর (মারিশ্যাচর), শাল্যাতুলি, গবছড়ি, তালছড়ি, মধ্য ও ডানে হারিকাবা, হুজুমছুড়ি (কুসুমছড়ি), ভেইবোনছড়া (ভাইবোনছড়া), ভুরবান্যা, হালাম্বা প্রভৃতি।

উল্লেখিত স্থানগুলো ছাড়াও আরও হাজার হাজার নাম না জানা অখ্যাত গ্রাম ও জনপদ কাপ্তাই হৃদের তরে সলিল সমাধি হয়েছে।

সেই বিশাল বিস্তৃত প্রাচীন জনপদ লুংগুদু (লংগদু) বরাদাম (বড়াদাম)। পাঁচ-ছয় মাইলব্যাপী বিস্তৃত বিরাট জনপদ। হাজার হাজার লোকের কলহাস্য মূখরিত, অসংখ্য খালবিল, বিশাল বিশাল ফসলের মাঠ, আম্রকানন, বিশাল বটগাছের ছায়াঘেরা গ্রামহাজার হাজার লোকের পদচারণায় মূখরিত বিশাল জনপদ লুংগুদু (লংগদু) বরাদাম (বড়াদাম)।

এক বুক চিড়ে প্রবাহিত হয়েছে লুংগুদু (লংগদু) খাল, গ্রীষ্মকালে ক্ষীণকায়া কিন্তু বর্ষাকালে প্রমত্তরুপ ধারণ করে। আজ অর সেই গ্রাম নেই। নেই সেই হাজার হাজার লোকের কোলাহল, জনসমাগম, নেই সেই জোৎস্নারাতের যুবকদের বাঁশির সুর, বিজুর সময় যুবক যুবতীদের আনন্দ-উল্লাস।

সেই বিশাল বটগাছের সুশীতল ছায়া, গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তাপে বটগাছের ছায়ায় বিশ্রামরত গ্রামবাসীদের সমাবেশ, নেই সেই গেংগুলি (গেংখুলী) গীতের আসর।

পুরাতন রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) শহর ও ইহার সংলগ্ন কন্নফুলি (কর্ণফুলী) তীরবর্তী যেসব প্রখ্যাত জনপদ ও বিশাল সমতল অঞ্চরসমূহ হৃদের তলে তলিয়ে গেছে তন্মধ্যে মগবান, বালুকালি, ঝগরাবিল, গোলাছুড়ি (গোলাছড়ি), বিলেইছুড়ি (বিলাইছড়ি), ফাঁকড়াছুড়ি (ফাঁকড়াছড়ি), ধল্যাছুড়ি (ধল্যাছড়ি), বরাদাম হুজুনালা (বড়াদম কচুঁনালা), পুরাতন বসতি, পাত্তরঘাতা (পাথরঘাটা), রাজবাড়ি এলাকা, হাজারীবাক, কাইন্দ্যা, হেমন্ত, বসন্ত জীবতলী, কৌশল্যঘনা, কামিলাছুড়ি (কামিলাছড়ি), মানিকছুড়ি (মানিকছড়ি), ধূল্যাছুড়ি (ধূল্যাছড়ি), গবছুড়ি (গবছড়ি), বাকছুড়ি (বাকছড়ি), হেডশীলা, ক্ষারিখ্যং, চারিখ্যং, বাদলছুড়ি (বাদলছড়ি), পুরাতন সুবলং বাজার, বাঘাশোলা গ্রাম, হাজালং দুঅর (মুখ), মিদিঙেছড়া (মিটিঙ্গ্যাছড়া) প্রভৃতি। এতদ্ব্যতীত আরো হাজার হাজার গ্রাম, জনপদ ও লোকালয় হৃদের তলে বিলীন হয়েছে।

চেঙে (চেঙ্গী) নদীর অববাহিকায় দু’তীরে সংলগ্ন যে সকল প্রখ্যাত গ্রাম ও জনপদ বিলীন হয়েছে তন্মধ্যে বন্দুক ভাঙ্গা, কাটাছুড়ি, তৈমিদং, ভাঙ্গামুরো, গজ্জনতলি (গর্জনতলী), এটমরা (হাতিমারা) ত্রিপুরাছড়া, বাকছীড়পাড়া, গুইছুড়ি, গবছুড়ি, বেতছুড়ি, অজ্যাংছুড়ি, মাচ্যছড়া (মাইচছড়ি), কুদুকছুড়ি, পুদিহালি (পুদিখালী), বর মাওরুম (বড় মহাপ্রুম), চিগোন মাওরুম (ছোট মহাপ্রুম), বুড়ীঘাট, গড়হেড, নোয়াপাড়া, নান্যাচর, পুলী, নানাক্রুম, কাবুক্ক্যা, হল্যাবিল, ছয়ছড়ি বিলনাল, বরাদাম (বড়াদাম), সাবেক্ষ্যং, তৈচাঙমা, মরাচেঙে (মরাচেঙ্গী), সাপমারা, শৈলশ্বরী, হাত্তলছুড়ি (কাঁঠালছড়ি), কেরেটছুড়ি, চংড়াছুড়ি, ডুলুছুড়ি, জগনাতলী, মুরোছুড়ি, মাচ্যছড়া (মাইচছড়ি), ভুয়াটেক, বেতছুড়ি, কেড়েঙাছুড়ি, মনাটেক, পুরান মালছুড়ি (মহালছড়ি), চৌধুরীছড়া, হাজাছড়া, সিঙ্গিনালা, লেমুছুড়ি, মানিকছড়ি, করল্যাছুড়ি, ক্যায়াংঘাট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়াও আরো কত অগণিত গ্রাম ও লোকালয় আক্রান্ত হয়েছে।

চেঙে (চেঙ্গী) এলাকার সবচেয়ে উন্নত সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামব্যাপী যে প্রাচীন গ্রামটির নাম উল্লেখযোগ্য তা হলো ঐতিহাসিক মাওরুম (মহাপ্রুম) গ্রাম। এই গ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি জুম্ম জনগোষ্ঠীর প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয় মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার জন্মভূমি।

এই মাওরুম (মহাপ্রুম) গ্রামটি বিভিন্ন ভাবে ইতিহাসখ্যাত। এখানে চাকমা সমাজের আরো একজন বিশিষ্ট জনসেবক স্বর্গীয় শ্রী কৃঞ্চ কিশোর চাকমা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তদানীন্তন চাকমা সমাজের শক্তিশালী সামন্তবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পার্বত্য অঞ্চলে আনাচে কানাচে শিক্ষার মশাল প্রজ্জ্বলিত করেন।

সমগ্র পার্বত্যঞ্চলে শিক্ষা দীক্ষা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিতে মাওরুম (মহাপ্রুম) ছিল অগ্রগামী। এখানে একটি পুরাতন জুনিয়র হাই স্কুল ছিল। ইহাও একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বলাবাহুল্য এই শিক্ষা প্রতিস্তানকে কেন্দ্র করে চেঙে (চেঙ্গী) অঞ্চলে একটি শিক্ষিত সমাজ গড়ে ওঠে যারা পরবর্তীতে পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রধান করে।

জেলা প্রধান শহর রাঙামাত্যর (রাঙ্গামাটির) অনতিদূরে অবস্থিত ইহার যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল বেশ উন্নত। চতুর্দিকে সবুজ নীলিমায় পরিবেষ্ঠিত খাল-বিল, উর্বর ক্ষেত, বিস্তৃত শস্য শ্যামল মাঠ, আম কাঁঠালের বাগান সবুজ ধান ক্ষেত, সারি সারি বাড়ি, বিশাল জনপদ, প্রাকৃতিক সম্পদে, শ্যামশস্য হিল্লোলে পরিপূর্ণ ছিল ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামটি। শিক্ষার হার ছিল শতকরা একশ ভাগের কাছাকাছি। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক গ্রামটি অতীতের স্মৃতি।

রাঙ্গামাটি, রিজার্ভ বাজার
রাঙ্গামাটি, রিজার্ভ বাজার; ছবিঃ কালের কন্ঠ

উল্লেখ্য যে, চেঙে (চেঙ্গী) অঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামগুলো ছিল অন্য যে কোন অঞ্চলের জনপদগুলোর চেযে অধিক সমৃদ্ধশালী। ধণাঢ্য লোকের সংখ্যাও চেঙে (চেঙ্গী) এলাকায় তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। এখানে চেঙে (চেঙ্গী) নদীতে খুব কম প্লাবন হয়।

জমিগুলো ছিল অধিকতর উর্বর। প্রতি বছর বর্ষাকালে চেঙে (চেঙ্গী) নদী প্রচুর পলিমাটিতে সিক্ত করে নদীর দু’তীরবর্তী ভুমিগুলোকে উর্বর করে ফলে আর্থিকভাবে এ অঞ্চলের লোকজন ছিল বেশ স্বচ্ছল।

এ অঞ্চলে প্রচুর ধান, পাট ও অন্যান্য রবিশস্য উৎপন্ন হয়। জুমিয়ার সংখ্যা এ অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে কম ছিল। পরিবার পিছু প্রচুর গবাদিপশু সম্পদ ছিল। ধানের অন্যতম শস্যভান্ডার ছিল চেঙে (চেঙ্গী) এলাকা।

যাতায়াত ব্যবস্থাও ছিল বেশ উন্নত। প্রায়ই লোকের গোলাভরা ধান ও প্রচুর গবাদিপশু ছিল। বিলগুলো ছিল বিভিন্ন মৎস্যে পরিপূর্ণ। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তারা উন্নত ছিল এই শান্তির-নীড় সুখের দিনগুলো আজ রুপকথায় পরিণত হয়েছে।

এ মাওরুম (মহাপ্রুম) ছাড়াও চেঙে (চেঙ্গী) অঞ্চলে আরও কয়েকটা ঐতিহ্যবাহী, শিক্ষা-দীক্ষায় ও সংস্কৃতিতে উন্নত গ্রাম ছিল। তন্মধ্যে বিশাল বরাদাম (বড়াদাম) ছিল অন্যতম। নান্যাচর বজার সংলগ্ন চেঙে (চেঙ্গী) নদীর পূর্ব তীরে এই বড়াদম ছিল বিশাল জনপদ। এই গ্রামের প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার পরিবার ছিল।

এই জনপদের আর্থিক অবস্থা ছিল বেশ স্বচ্ছল। শিক্ষার হারও উন্নত ছিল। তাদের প্রচুর জমিজমা ও গবাদিপশু ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের গৌরব, চিত্রশিল্পী বাবু চুনীলাল দেওয়ানের বাড়ি ছিল এই গ্রামে। কয়েক হাজার হাজার লোকের বসবাস ছিল এই গ্রামে। এখানে একটি পুরাতন বৌদ্ধ মন্দির ছিল।

প্রতি বছর জাঁকজমক ও ধুমধামের সহিত বৌদ্ধ মেলা অনুষ্ঠিত হত এই গ্রামে। সপ্তাহ খানেক ধরে চলত এই মেলা। মেলায় সমগ্র রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) মহকুমার বিভিন্ন স্থান হতে প্রচুর লোকজন আগমন করত। নানা ধরণের অনুষ্ঠান হত মেলায়। তন্মধ্যে যাত্রাপার্টি অন্যতম। এই সবই আজ অতীত ইতিহাস।

বরাদাম (বড়াদাম) জনপদের অদূরে ছিল সাবেক্ষ্যং গ্রাম। এখানে ছিলেন তদানীন্তন পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে ধণাঢ্য ব্যক্তি বাবু ফুলেশ্বর মহাজন। চেঙে (চেঙ্গী) এলাকায় তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি কয়েকশ একর জমি-জমার মালিক ছিলেন।

তিনি হাজার হাজার গবাদিপশুরও মালিক ছিলেন। পার্বত্যাঞ্চলে যে কয়জন ক্ষুদে জমিদার ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি প্রচুর অর্থ ও অন্যান্য সম্পদের মালিকও ছিলেন।

ফুলেশ্বর মহাজনের পরিবার শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ সুশিক্ষিত ছিল। ফুলেশ্বর মহাজন ছাড়াও সাবেক্ষ্যং গ্রামের নিকটস্থ মরাচেঙে (মরাচেঙ্গী) গ্রামে গোবিন্দ মহাজন ও অন্নপূর্ণ মহাজন নামে দুজন ধণাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন।

তারাও প্রচুর জমিজমা ও গবাদিপশুর মালিক ছিল বলে জানা যায়। কাপ্তাই বাঁধের করাল গ্রাসে এখন সবই অতীত ইতিহাস। প্রচুর জমিজমা ও বিপুল সম্পত্তির মালিকসম্পন্ন অনেক ধণাঢ্য ব্যক্তি এখন কপর্দকশুণ্য ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছেন।

সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলে বিশেষভাবে হাজলং (কাসালং),  মিইনি (মাইনী), চেঙে (চেঙ্গী), সুবলং ও রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি) সন্নিকটবর্তী এলাকায় শত শত ধণাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। যাদের পরিচিতি ও তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা তাদের এলাকায় যথেষ্ট প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন কাপ্তাই বাঁধের করাল গ্রাসে তাঁদের পরিচিতি সব মুছে গেছে। আজ সবই ইতিহাস।

কন্নফুলি (কর্ণফুলী) নদীর উজানে ভাটিতে সুবলং বাজার অতিক্রম করে বরকল থানাধীন কর্ণফুলী নদীর তীর সংলগ্ন যেসব সমৃদ্ধশালী জনপদ ও গ্রামাঞ্চল জলমগ্ন হয়েছে তন্মধ্যে বরকল বাজার, চিগোন অরিনে (ছোট হরিণা) বাজার, দেয়ানচর (দেওয়ানচড়), ভুজনছড়া (ভুষণছড়া), গৌরস্থান, আইমছিড়া, গুইছুড়ি, অজ্যাংছুড়ি, গজ্জনতলি (গর্জনতলী), হেডবোরেয়া, বাঘাছোলা হরিণ, হালাম্বা, করুল্যাছুড়ি, রামুক্যছড়া, মালছুড়ি (মহালছড়ি), কলাবন্যা, কুগিছড়া (কুকিছড়া), বেগেছুড়ি, কুরকতিছুড়ি, বুরবান্যা, আন্দারমানেক, বাঘাছোলা, হাজলং দুঅর (কাসালং মুখ), বরণাছড়ি, ধামেইছড়া, বিল্লোছড়া, মিদিঙেছড়া (মিটিঙ্গাছড়া), হালাম্বা মৌজা, নলবন্যাছড়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, পুরাতন বরকল বাজার সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে একটি বিরাট উঁচু জলপ্রপাত ছিল । ইহা ছিল অত্র অঞ্চলের একমাত্র জলপ্রপাত। কাপ্তাই হৃদে জলমগ্ন হওয়ায় বর্তমানে ইহার কোন অস্তিত্ত্ব চোখে পড়ে না।

বরকল থানার অধিকাংশ জমি-জমাগুলো বহিরাগত সেটেলাররা জবরদখল করে রেখেছে। ভুজনছড়া (ভুষণছড়া), গৌরস্থান, কলাবন্যা (কলাবুনিয়া), হেডবোরেয়া আইমছিড়ে ও অন্যান্য এলাকায় সব সমতল উর্বর জমিগুলো সেটেলাররা জোরপূর্বক দখলে রেখেছে। উল্লেখ্য যে, ১৯৭৯ সন হতে কয়েক লক্ষ বাঙালী মুসলমানদের এ অঞ্চলে সরকারী ভাবে বসতি স্থাপন করানো হয়।

তারপর তারা স্থানীয় আদিবাসীদের জমিজমা জোরপূর্বক গ্রাস করতে থাকে। আদিবাসীরা বাঁধা দিলে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ১৯৮৪ সনে শান্তিবাহিনী কর্তৃক জমির দখলকারী বহিরাগত কিছু লোককে হত্যা করা হলে এই এলাকায় পাহাড়ীদের বিরুদ্ধে নৃশংস গণহত্যা চালানো হয়।

বহিরাগত সেটেলাররা সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সমজাতীয় স্থানীয় আদিবাসীদের এলাকা থেকে প্রায়ই নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। আদিবাসীদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

শত শত আদিবাসী নর-নারী ও শিশুকে জবাই করা হয়। সেটেলাররা সেনাবাহিনীর সহায়তায় ঐ এলাকায় বসবাসরত লাখখানেক আদিবাসী লোকের জনপদ চোখের নিমিত্তে ভুষ্মীভুত করে সমগ্র এলাকাটি কব্জা করে নেয়। অগণিত সংখ্যক মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়।অনেক যুবতী মেয়ে নিখোঁজ হয়।

অনেক মহিলাকে জোর করে ধর্মান্তর করে বিবাহ করা হয়। উচ্ছেদ হওয়া লোকজন সবাই ১৯৬০ সনের কাঁপ্তাই বাঁধে আক্রান্ত হওয়ায় এসব এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল। বর্তমানে স্থানীয় আদিবাসীদের আর এখানে চোখে পড়ে না।

তার বদলে লক্ষ লক্ষ বহিরাগতদের নিত্যনতুন কলোনী গড়ে ওঠেছে। দাঙ্গায় উচ্ছেদ হওয়া অধিকাংশ আদিবাসী লোকজন অরিনে (হরিণা), সাজেক, গঙ্গারাম ও সরকারি রিজার্ভ এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বর্তমানে ঘোরতর মানবেতর জীবনযাপন করছে।

সুবলং অববাহিকা অঞ্চলে যেসব জনপদ ও গ্রামাঞ্চল কাপ্তাই বাঁধে আক্রান্ত হয় তন্মধ্যে কুজুমছুড়ি (কুসুমছড়ি), লুলংছুড়ি, বনযোগিছড়া, ফকিরাছড়া, এড়াইছড়ি, চকপতিঘাট, মৈদং শিলেছুড়ি, দুবজারুল মৌজা, জারুলছুড়ি প্রভৃতি উল্রেখযোগ্য।

বর্তমান বিলেইছুড়ি (বিলাইছড়ি) উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন কাপ্তাই বাঁধে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। তন্মধ্যে বিলেইছুড়ি (বিলাইছড়ি) ইউনিয়ন, কেঙেরাছুড়ি (কেংরাছড়ি) ইউনিয়ন, ফারুয়া ইউনিয়ন।

পুরাতন বিলেইছুড়ি (বিলাইছড়ি) বাজারও জলমগ্ন হয় ও অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, বিলেইছুড়ি (বিলাইছড়ি) উপজেলায় অধিকাংশ এলাকায় তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই এলাকায় বনসম্পদসহ প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল।

জমিজমাগুলো ছিল অত্যন্ত উর্বর। বাঁধে আক্রান্ত অধিকাংশ লোকজনকে রাজস্থলি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে স্থানান্থরিত করা হয়। তবে বান্দরবান জেলার বালাঘাটা ও রেইশা এলাকায় অনেকেই বসতি স্থাপন করে।

পার্বত্য এলাকায় অধিবাসীদের সোনালী দিন আজ অতীতের ইতিহাস। তখন আদিবাসী পাহাড়ীদের অভাব অনটন ও দুঃখ বলে কিছু ছিল না, অগাধ প্রাকৃতিক সম্পদে, ফুলফলে শুশোভিত পাহাড় পর্বত, শ্যামল বনভূমি, সেই গভীর অরণ্য আর নেই।

সেই দিগন্ত বিস্তৃত বাঁশ ঝাড়, সেই ঘন মুলি বাঁশের ঝাড়, মিদিঙে (মিটিংগা) বাঁশের গভীর অরন্য, পার্বো ও দুলু বাঁশের সারি সারি বাঁশঝাড় আর চোখে পড়ে না। কোথায় সেই পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত শত শত উঁচু বিশাল গজ্জন (গর্জন) গাছের সারি?

সিবিগ (সিবিট) গাছের অরন্য আর পাহাড়ের গায়ে চাম্বাফুল (চাম্পাফুল) গাছের অগণিত সারি। কোথায় সেই চাপালিশ গাছের মিষ্টি কাঁঠাল? নেই সেই গভীর অরণ্য ঘিল্যত্তাক (ঘিলালতার) বহর। কোথায় সেই নরম লতার সবুজ বেষ্টনী।

নেই সেই বনমোরগের ডাক। নেই সেই হরিয়ালের গান, নেই সেই উচুঁ গাছের ডালে ঘুঘু (হঅ্) পাখির ডাক, নেই সেই অরণ্যে ধনেশ পাখির (কেটকেত্যা) গান। কোথায় সেই গানের উপকন্ঠে ছায়া প্রদানকারী বিশাল অশ্বথ গাছ?

নেই সেই সুশীতল ছায়া প্রদানকারী বিশাল বটবৃক্ষ যেখানে দিন দুপুরে ভিতরে সূর্যের আলো পৌঁছে না, নেই সেই গ্রামের অনতিদূরে ভয়াতঙ্কে ভরা পাগজ্যা গাছ যার বহুদূর বিস্তৃত শিকড় গাছের ভিতর সূর্যের আলো পৌছে না সেখানে দিনদুপুরেও কোন লোক যেতে সাহস করে না।

কন্নফুলি (কর্ণফুলী) ও হাজলং (কাসালং) নদীর দু’তীরে শত শত মাইল বিস্তৃত ঘর শনখোলা আর নেই। পাহাড়ের গিরিখাদ বেয়ে নেমে আসা হাজার হাজার ঝর্ণা, ঝিরি আর নেই। বনজঙ্গল ধ্বংসের ফলে সব ঝর্ণা ও ঝিরি-খাদ শুকিয়ে গেছে।

হাজার হাজার পাহাড়ী স্রোতস্বিনী কুলকুল রব আর নেই। ঝোপ-ঝাড়-গাছড়ার অভাবে সব স্রোতস্বিনী ও পাহাড়ী ছড়াগুলো শুকিয়ে মরে গেছে। বাঁধে পানি আটকানোর ফলে থেমে গেছে কর্ণফুলীর কুল কুল রব। সেই এখন গৃহবন্দী।

শরৎকালে কন্নফুলি (কর্ণফুলী), হাজলং (কাসালং) ও চেঙে (চেঙ্গী) নদীর দু’তীরে দিগন্ত বিস্তৃত কাঁশবনের অপূর্ব সমারোহ আর নেই। কাঁশবনে সেই শেয়ালের ডাক আর শোনা যায় না।

বহুদূর থেকে দৃশ্যমান অপরূপ শোভায় অগ্রহায়ন (আয়ুন) ও পৌঁষ (পুজ) মাসে সমগ্র পাহাড়-পর্বতব্যাপী শত শত মাইল জুড়ে বিস্তৃত সেই “ভূলং” ফুলের শোভা আর নেই। তখন সমস্ত প্রকৃতি শ্বেতবর্ণ ধারণ করে।

শত শত অজানা জংলী ফুলের সুভাস পাহাড়ে পাহাড়ে বসন্তের আগমন বার্তা নিয়ে আসে। সমগ্র বনভূমি তখন সুশোভিত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার পাখির গানে আর কোলাহলে পাহাড় মেতে ওঠে।

দূর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে প্রত্যহে সোনালী সূর্য ওঠে। আর সোনালী আভা বাঁশবনে ছড়িয়ে পড়ে। সেই অরণ্য ভূমি, পাখির গান আর ফুলের সুভাস আর মানুষের হাসি সবই অতীত।


লেখক : তারাচরন চাকমা
সাবেক উপসচিব এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান


***কর্ণফুলীর স্থানীয় নাম হচ্ছে বরগাঙ। মধ্যযুগীয় পুঁথিতে নদীটিকে কাঁইচা খাল লিখা হয়েছে, মারমা আদিবাসীদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে কর্ণফুলীর নাম খাওৎলাং তুইপুই

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply
You must be logged in! Login Now?
Kaniska Changma
Kaniska Changma

gm lagilo ektal…ami sigono lokke vulong,satrong fulloi hodok hara hellong!!hodok putting gulo, pok gulo,chamini hattol,sorbesgulo hedong ekke r se dinun nei…bek jummogunor ei leghagan porana dorkar amar ago jinghani henne dol elo r hene dugot purilong sini janibatte…ju ju Tarachan Changma da re dol lega legibatte

Jan 30th, 2020 1:05 PM