পার্বত্য চট্টগ্রাম: একটি চৌ-খণ্ডিত রক্তাক্ত জনপদ

Jumjournal
Last updated Jun 2nd, 2020

1086

featured image

“শত্রুতার দ্বারা শত্রুতার উপশম হয়না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়, এটিই চিরকালীন ধর্ম।” – মহামানব গৌতম বুদ্ধ

পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন আর আগের মতো ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ নেই। সেখানে বহুকাল ধরে বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী বাঙালির জাতিগত আগ্রাসন চলছে।

ঐ পরিবেশ দেশের অধিকাংশ বাঙালির জন্য স্বস্তির, সমৃদ্ধির, আনন্দের। কিন্তু পাহাড়ি আদিবাসীদের কাছে চিরস্থায়ী দারিদ্র্যের, উদ্বেগ আর আতঙ্কের।

যদিও একসময় প্রকৃতির মতো স্বতঃস্ফুর্ত মধুর জীবন তাদেরই ছিল। পুরনো সেই সুদিন আজ সোনালী অতীত। বোকা পাহাড়িরা তবুও বৈসাবির দিনে, পূর্ণিমা তিথী বা রাজপূণ্যাহর দিনে আনন্দ উৎসবে মাতে।

নেতৃত্ব কিংবা আদর্শের আতিশয্যে বিভ্রান্ত হয়ে পরষ্পরকে আক্রমণ করে বসে। আদর্শের নামে স্বজাতি-স্বজনের প্রাণও কেড়ে নেয়। ঠিক যেমন বুদ্ধের বিপ্রতীপে জ্ঞাতিভাই ও ছায়াশত্রু দেবদত্ত তীরবিদ্ধ করেছিলেন মুক্ত বিহঙ্গটিকে।

মানে মানুষের স্বাধিকার তথা মুক্তির চেতনাকে। সিদ্ধার্থ গৌতম আহত পাখিটিকে পরম মমতায় সেবা-শুশ্রুষা দিয়ে সুস্থ করে তুলে অবশেষে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর সুকঠিন মানবিক সিদ্ধান্তে হংস বলাকাটি আবারও তার মুক্ত জীবন ফিরে পেয়েছিল, যা এক অর্থে নতুন জীবনও। একাজ করতে গিয়ে তিনি দেবদত্তের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছিলেন। বলেছিলেন, জীবন যে কেড়ে নেয় সে নয়, বরং জীবন যে ফিরিয়ে দেয় সেই প্রকৃত বিজয়ী। ইতিহাসে তিনিই পূজনীয় বীর।

অথচ পাহাড় সমতল নির্বিশেষে সারা দেশে আমরা বাংলাদেশিরা প্রতিনিয়ত কারও না কারও জীবন কেড়ে নিচ্ছি।

আমাদের সমাজে সেই সিদ্ধার্থ-হৃদয়, সংবেদনশীল মহৎ প্রাণের বড়ো আকাল। অনগ্রসর, অসচেতন জুম্ম সমাজে দেবদত্তদের ভূমিকাই বরং আনন্দে-উল্লাসে-সহিংসতায় প্রবলভাবে দৃশ্যমান ও গ্রাহ্য হয়।

খাদ্য কিংবা অন্যতর প্ররোচনায় যেমনভাবে আনন্দ ও হিংস্রতার প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে চিড়িয়াখানায় বন্দী সিংহ কিংবা ওরাং ওটাংরা। বিশেষ দাবি পূরণ অথবা অগ্রাহ্য হলে জেলখানার কয়েদিরা।

নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহে এসব প্রাণীও জখম হয়, মর্যাদা রক্ষার কদর্য লড়াইয়ে কখনওবা জীবনেরও অপমৃত্যু ঘটায়।

কিন্তু তারা যে লোহার বিরাট খাঁচায় পরাধীনতার শিকলে বন্দী হয়ে আছে, সে চেতনা বা অনুভূতি তাদের থাকেনা।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, পাহাড়ি আদিবাসীদেরও সে অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা যেন হারিয়ে গেছে। তারা এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক সামরিকায়িত বিরাট খাঁচায় বন্দী হয়ে উল্লাসে-বেদনায়, হতাশা-হানাহানি ও নৈতিক অধঃপতনে বিভ্রান্তিকর এক জীবন যাপন করছে।

ক্ষীণ চোখের, ক্ষীণ মনের দৃষ্টি আরও ক্ষীণতর হয়েছে। জুম্মদের বৃহত্তর জাতীয় সংহতির বদলে গোঝা-গোষ্ঠী-অঞ্চল বা দলপ্রীতি তাদের মনে প্রবলভাবে দানা বাঁধছে। যেমনটি বাঙালি সমাজেও দেখা যায়।

বাঙালিদের জেলাকেন্দ্রিক আত্মীয়তাবোধ কিংবা অঞ্চলভিত্তিক উপজাতীয় সংহতির প্রাবল্যও অনেকটা জুম্মদের গোঝা-গোষ্ঠীপ্রীতির মতোই।

পাহাড়ি সমাজে এখন দেখা যায়, সব ক্ষেত্রে মাথার আগে দেহটি এগিয়ে যাচ্ছে। ধীশক্তি ও মেধা পরাজিত হচ্ছে গোঁয়ার্তুমি, দুর্নীতি ও প্রতিহিংসা প্রবণতার কাছে।

বাঙালি সমাজ ও রাজনীতির অনুকরণে পাহাড়ি সমাজেও অনৈক্য, আত্মীয়তাবাদ, পরিবারতন্ত্র এবং পরশ্রীকাতরতা যেন দিন দিন ব্যাপক আকার ধারণ করছে। না হলে লড়াকু জুম্ম জাতির নেতৃবৃন্দ আজকের আত্মঘাতি আদর্শে অনুপ্রাণিত হতেন না।

বিভ্রান্তিকর এই আদর্শের নামে স্বজাতির শত শত তগবগে তরুণের জীবন কেড়ে নিতেন না। ঐতিহাসিকভাবে বিপন্ন, দরিদ্র কিংবা উদীয়মান জুম্মদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে তাদেরকে হতোদ্যম এবং অধিকতর বিপন্ন করতেন না।

অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে তাদের সন্তানদের শিক্ষা এবং উন্নয়নের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতেন না।

বলাবাহুল্য, আদিবাসী জুম্মদের আগেকার প্রকৃতিলীন প্রশান্ত জীবন ও জনপদ অনেক ভাল ছিল। বয়স্করা আজও পুরনো সুদিনের কথা স্মরণ করে স্মৃতিভারাক্রান্ত হন।

আদিবাসীদের গানে, কবিতায়ও সেই সমৃদ্ধ অতীত আর সুখস্মৃতির বিধুরতা আছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও প্রথাগত শাসন ব্যবস্থাসহ বেশ একটা স্বাধীন জীবন আদিবাসীদের ছিল।

অর্থাৎ মাত্র পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও তাদের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ছিল কার্যতঃ স্বাধীন ও বাইরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। প্রকৃতির সান্নিধ্যে একটি সরল জীবনধারা ও জনপদ স্বতঃস্ফুর্ত স্বকীয়তায় বিকশিত হচ্ছিল।

বাংলাদেশের জন্মের পর আদিবাসীদের উপর জাতিগত শোষণ-নিপীড়ন তীব্রতর হয়েছে। সেই সাথে সমতলের শাসক সমাজের নানা নেতিবাচক মূল্যবোধ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা প্রকৃতিলীন জুম্ম সমাজকেও ধীরে ধীরে কলুষিত করেছে।

দেশের মাত্র এক দশমাংশ অঞ্চল হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন রাষ্ট্রের মোট সেনাশক্তির এক-তৃতীয়াংশ মোতায়েন রয়েছে। এই ডেপ্লয়মেন্ট সেখানকার আদিবাসীদের স্বার্থে নিশ্চয়ই নয়।

১৯৪১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার ৯৭.৫% ছিল আদিবাসী পাহাড়ি। বাঙালি জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২.৫%। পরে দেশ স্বাধীন হলে সমতলের জেলাগুলো থেকে হতদরিদ্র লোকজনকে নিয়ে এসে পাহাড়ে বাঙালির জনসংখ্যা সুপারসনিক গতিতে বাড়ানো হয়।

বাংলাদেশ সরকার আদিবাসীদেরকে নিজ ভূমিতে সংখ্যালঘু করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। বর্তমানে বাঙালিরা পাহাড়ের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫% (পঞ্চান্ন শতাংশ)।

অনেকের অনুমান প্রকৃত সংখ্যাটি হবে ৬০% বা তারও বেশি। ভেবে দেখুন, ২.৫% থেকে বেড়ে এখন তাদের জনসংখ্যা ৬০%।

মাত্র সাত দশকের ব্যবধানে জনমিতির এই দৃষ্টিকটু উল্লম্ফন একমাত্র বাংলাদেশেই হয়তো সম্ভব। স্বাধীনতার পর গত আটচল্লিশ বছরে সারা দেশে জনসংখ্যা দ্বিগুণের অধিক বেড়েছে।

এটি একটি ভীমরতিদুষ্ট জনবিস্ফোরণ তো বটে! অর্থাৎ সাত কোটি মানুষ এখন হয়েছে প্রায় সতের কোটি! কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এসময়ে বাঙালির জনসংখ্যা দ্বিগুণ নয়, বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ।

আর ব্রিটিশ আমল থেকে ধরলে সাতটিমাত্র দশকে পাহাড়ে তাদের জনসমষ্টি প্রায় চব্বিশ গুণ বেড়েছে। বিপরীতে আদিবাসীরা সেভাবে বাড়েনি। বরং তাদের জন্মহার ও মৃত্যুহার এখন প্রায় কাছাকাছি।

জনসংখ্যা ও সম্পদের দিক থেকে এক সময়ের মেজরিটি পাহাড়ি এখন নিরীহ মাইনরিটি। সরকারি পরিভাষায় তারা আজ ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, আরও খারাপ অর্থে ‘উপজাতি’। মানে কোন একটি জাতির বাই-প্রোডাক্ট।

অতি বর্বর ও বিদ্বেষপূর্ণ মানুষকে হেয়, অসন্মানিত করার এই মানসভঙ্গি। দেশের আদিবাসীদেরকে একদিকে দ্রুত সংখ্যালঘু করে ফেলা হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার আপন ইচ্ছেমতো তাদের আত্মপরিচয় নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

পাহাড়ের ও সমতলের আদিবাসীদের উপর বাঙালির জাতিগত আগ্রাসনের এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?

এ প্রসঙ্গে তরুণ লেখক-গবেষক রওনক জাহান সম্প্রীতি লিখছেন, ‘যদি বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে তিন পার্বত্য জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো, তাহলে পরবর্তী সময়ে আদিবাসীদের ভ‚মির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা সহজ হতো এবং রাষ্ট্রীয় মদতে তাদের ভূ-সম্পত্তি যুগ যুগ ধরে নির্বিবাদে কেড়ে নেয়া সম্ভব হতোনা।

১৯৭৯ সালে তৎকালীন সরকার পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের পার্বত্য অঞ্চলে সেটেলমেন্ট দিতে শুরু করে। ৩০ হাজার বাঙালি পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং এজন্য ৬৫ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়।

এই ৩০ হাজার বাঙালি পরিবারকে পুনর্বাসনের পর থেকেই মূলত পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়া শুরু হয়। সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে সেখানে শুরু হয় হত্যা, ধর্ষণ ও লুন্ঠন।

আঞ্চলিক নিরাপত্তার নামে সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনা ক্যাম্প (মোট সেনাবাহিনীর তিন ভাগের এক অংশ) নির্মাণ করা হয়, যা মূলত আদিবাসীদের দমনপীড়ন ও সরকারের ভূমিগ্রাসের নীল নকশা বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছে এবং এখনো তা-ই করে যাচ্ছে।

সেনা নিয়ন্ত্রিত কিংবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক যে সরকারই আসুক না কেন, আদিবাসীদের নিধন কিংবা তাদের সম্পদ গ্রাস করার ক্ষেত্রে তাদের চরিত্র আলাদা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।

এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা সবসময় একই রকম আচরণ করেছেন ও করছেন’ (তথ্যসূত্র: ‘সাতকাহন’, একটি অনলাইন পত্রিকা, প্রকাশকাল: ২৫ জুন ২০১৪)।

মানবতাবাদী এই লেখিকা বাংলাদেশের আদিবাসীদের উপর যুগ যুগ ধরে জারি থাকা রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সম্পর্কে শতভাগ সত্য কথাটিই বলেছেন। আরও সত্য হলো, এভাবে চলতে থাকলে আগামী দেড়, দুই দশকে পাহাড়ি-বাঙালির জন-অনুপাত হবে ১০:৯০।

সে আলামত এখনই দৃশ্যমান। জাতিগত আগ্রাসনের এই প্রক্রিয়াতে ছোট ছোট জাতিগুলোকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে।

পাহাড়িদের বর্তমান খাঁচাবন্দী নিষ্পেষিত অবস্থাটিই তো আসলে ‘নিজ দেশে পরবাসী’ হওয়া, দেহে-মনে উচ্ছেদিত, ছিন্নমূল হওয়া। এককথায় ‘দেশহীন মানুষ’ হয়ে পড়া। ভূমি, সংস্কৃতি হারিয়ে বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর দেহে-মনে বিলীন হয়ে যাওয়া।

এভাবে রাষ্ট্রের বহুমাত্রিক শোষণে, ষড়যন্ত্রে আদিবাসীরা প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছেন। তবে আমাদের পূর্বপুরুষদের সকলে কিন্তু ভুল করেননি। জাতিগত আগ্রাসনের এহেন পটভূমিতে তাঁরা পাহাড়ে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করতে পেরেছিলেন।

নিপীড়ন নিষ্পেষণ থাকলে প্রতিরোধও এর স্বাভাবিক পরিণতি। প্রকৃতির এই সরল নিয়মে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অন্তরেও তাই একদিন দ্রোহের, প্রতিরোধের আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল।

পরে বহুধাবিভক্ত হলেও তাদের সত্ত্বার গভীরে সে আগুন এখনও জ্বলছে। আসলে তাদের প্রকৃতিদত্ত সারল্য ক্রমাগত নিষ্পেষণে বিস্ফোরিত হয়ে এদেশে জাতি-ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতি নিরপেক্ষ ন্যায্যতা ও মানবিক সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য শাসকগোষ্ঠীর জাত্যাভিমানী তন্দ্রাকে ভাঙাতে চেয়েছিল।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের পার্বত্য চুক্তিটি এর একটি ‘আপেক্ষিক’ পরিণতি। তবে চুক্তির দু’টি পক্ষ বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে বৈরিতা আজও চলছে।

চুক্তির পরেও তারা যেন পরষ্পরের শত্রুপক্ষ। কারণ চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছেনা। বাঙালি ও পাহাড়িদের একটি বড় অংশের চুক্তি বিরোধিতাকে অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

অথচ দীর্ঘ আড়াই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং পাহাড়ি আদিবাসীদের জন্য আঞ্চলিক স্ব-শাসন নিশ্চিত করাই ছিল চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্য।

শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মনে করে সাধারণ মানুষও এটিকে ‘শান্তিচুক্তি’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।

তবে পার্বত্য চুক্তির সূত্রে সংঘটিত আপাতঃমসৃণ কিছু পরিবর্তন এবং শাসকগোষ্ঠী ও বাঙালি সেটেলারদের একপেশে পর্যটনবান্ধব প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হলে পাহাড়ের বর্তমান তথা প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাবেনা।

‘শান্তিচুক্তি’র পরে পার্বত্য অঞ্চলে সেনা এবং শান্তিবাহিনীর মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধের পরিস্থিতি এখন আগের মতো না থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ সমর্থনে বাঙালি সেটেলারদের দ্বারা পাহাড়ি ভূমি-বসতি জবরদখলের প্রক্রিয়া ও আদিবাসী নারী ধর্ষণ যথারীতি চালু আছে।

ইদানিং সেনা অভিযানও আগের মতোই চলছে। যুগ যুগ ধরে যেমন চলে আসছে ইজরাইলের আগ্রাসী জায়নবাদী ইহুদি শাসকদের দ্বারা, বর্তমান প্যালেস্টাইনে।

অনুরূপভাবে জুম্ম নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন এবং সহিংসতাও দিন দিন বাড়ছে। সাধারণ পাহাড়িদের ওপর নির্দিষ্ট বিরতিতে সশস্ত্র বাহিনীর হামলা-মামলা-নির্যাতন-হয়রানি পূর্ববৎ চলছে।

অতি সুক্ষভাবে বৃহৎ নৃ-গোষ্ঠী বাঙালির সাংস্কৃতিক একাধিপত্য ও ভাবাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজটিও জারি আছে। আদিবাসীদের পবিত্র মন্দির, মূর্তি, সংস্কৃতিকেন্দ্র, গীর্জা, সমাধিক্ষেত্র, আত্মপরিচয় প্রভৃতি নানাভাবে আক্রান্ত, লাঞ্চিত হচ্ছে।

তবে এত কিছুর পরেও পার্বত্য চুক্তি পরবর্তী সময়ে জুম্ম জনগণ সবচেয়ে ভয়াবহ যে চক্রান্তের জালে এখন আটকা পড়েছে, সেটি হলো নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত।

এই সংঘাতের উন্মাদনায় তাদের মনন-মানস-চেতনা আজ দিগভ্রান্ত, সন্মোহনগ্রস্ত। তারা বুঝেও বুঝতে পারছেনা সংঘাতটি নীলনকশা অনুযায়ী অতি সুক্ষভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের রোপন করা একটি রাক্ষুসে ‘রক্তবীজ’, যা ভেতরে ভেতরে পুরো জুম্ম সমাজদেহে বিষক্রিয়া ঘটাচ্ছে।

আমাদের সামন্ততান্ত্রিক চেতনাদুষ্ট গোত্রীয় অহংবোধ, সাধারণ জনগণের বোকামি ও অর্ধপক্ক চৈতন্য (যা আসলে গোঁয়ার্তুমি, আত্মীয়প্রীতি আর অল্পবিদ্যার সমষ্টি) এবং পাহাড়ের ত্রিসীমাবদ্ধ প্রবল দেশপ্রেম বা জুম্মপ্রেমের গুপ্ত চেতনাকে উস্কে দিয়ে অতি সুকৌশলে এ সংঘাত বাধানো হয়েছে।

এর পরিকল্পনাকারী ও গবেষকরা ঠিকই জানেন কোন সুইচটি কখন টিপলে বিভক্তির চোরাবালিতে আটকে পড়া জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনার আলো জ্বলবে, নিভবে কিংবা বাল্বসুদ্ধ বিস্ফোরিত হয়ে এর চেতনাধারীদেরকে আত্মঘাতী ‘অজাতশত্রু’তে পরিণত করবে।

বোদ্ধা পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে, সাত ও আটের দশকে শান্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণ সত্ত্বেও সরকারি গবেষকেরা জুম্মদের স্বাধিকার আন্দোলনকে সেসময় ‘স্কুলমাস্টারদের আন্দোলন’ নামে অভিহিত করেছিলেন।

এর সত্যাসত্য বা যাথার্থ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এই প্রশ্নটা জাগা স্বাভাবিক যে, পৃথিবীর দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতি এবং বিশ্বায়নকালের বহুমুখী জুম্ম স্বার্থকে এই আন্দোলন একত্রে ধারণ করতে পারেনি বলেই কি সেটি আজ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে রূপ নিয়েছে?

দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিকদের যুগ যুগ ধরে লালিত ধ্রুপদী আদর্শের সুক্ষাতিসুক্ষ কুটতর্ক আজ স্বার্থের, অহংকারের, প্রতিহিংসার অব্যর্থ বুলেট হয়ে জুম্ম জাতির দেহ-মনকে প্রতিনিয়ত বিদীর্ণ করছে।

এখন পাহাড়িদের অবস্থা রামায়ন-মহাভারত যুগের সেই তমসাচ্ছন্ন মৌষল পর্বের সাথে তুলনীয়। মহাভারতের সেই মৌষল কালে সত্যকে সত্য বলে চেনার, জানার উপায় ছিলনা। জগতের সককিছুই হয়ে পড়েছিল বিভ্রান্তিকর, মায়া ও প্রহেলিকাময়।

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাসও পৃথিবীর আনাচে কানাচে অস্তিমান এরূপ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও বিপন্নতাকেই একদিন নিজের সহজাত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নির্ভুলভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

জুম্মদের ভ্রাতৃঘাতী পরিস্থিতির সাথে কী গভীর মিল কবির এই অন্তর্দৃষ্টিজাত সরল উপলব্ধির! আমাদের মতো আত্মঘাতী জাতি বা প্রাণীদেরকে উদ্দেশ্য করেই হয়তো তিনি নীচের বিখ্যাত কবিতাটি রচনা করেছিলেন –

 “অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা নীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।”

আদর্শিক বিভ্রান্তি ও ক্ষয়ক্ষতি আদর্শের যে সঙ্গীতই বাজানো হোক না কেন প্রকৃত সত্য হলো, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি আঞ্চলিক দলের সশস্ত্র সংঘাতে বহু জুম্ম ভ্রাতা-পিতা-সন্তানের জীবন অকালে ঝরে পড়ছে।

বহু মাতা-ভগ্নী-কন্যার কোল খালি হচ্ছে। তাদের জীবন ও জগৎ প্রতিনিয়ত বিপন্ন, সংকুচিত হয়ে পড়ছে।

স্বাধিকার অর্জনের চিন্তা বা কৌশল নির্ধারণের চেয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় জুম্ম ভাই-বোনেদেরকে প্রতিপক্ষ ভ্রাতা-ভগ্নীদের আক্রমণ সামলাতে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

তিন চারটি দলকে চাঁদা দিতে গিয়ে জুম্ম সমাজের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলে ক্রমশঃ নিঃস্বতর হচ্ছেন।

সামাজিক সুসম্পর্ক রক্ষাসহ চারটি দলের সদস্যদের মন জুগিয়ে চলতে গিয়ে সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন সংসার খরচও অনেক বেড়ে গেছে। আগে সবাইকে সাথে নিয়ে সামাজিক সুসম্পর্ক ও সৌজন্য রক্ষা করা যেতো।

ঢাকা শহরে চার পাঁচ বছর আগেও এই সম্প্রীতিপূর্ণ অবস্থাটি ছিল। এখন খোদ রাজধানীতেও সেই সুদিন আর নেই। বিভাজনের রাজনীতি পর্যায়ক্রমে সবকিছুকে, সব অঞ্চলকে দূষিত করেছে এবং করছে।

এই অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ভূমি জবরদখলসহ আদিবাসীদের উপর সেটেলার বাঙালিদের সহিংসতাও আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশেষ করে আদিবাসী নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা, মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আর সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র তো মহানন্দে একের পর এক জুম্মবিরোধী পরিকল্পনা ও প্রকল্প তৈরির মোচ্ছবে মেতেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

‘শান্তিচুক্তি’র পর বাঙালির স্বার্থ-পরিপন্থী যুদ্ধ-পরিস্থিতি তো এখন আর পাহাড়ে নেই। পূর্বপুরুষের ভূমি-প্রকৃতি-নীলাকাশ আর নব প্রজন্মের সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতকে কোরবানির বিনিময়ে যুদ্ধের মরণ খেলাটিও এখন লুফে নিয়েছে খাঁচাবন্দী পাহাড়িরা।

ফলে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প, বনজ সম্পদ কিংবা পর্যটন ব্যবসা থেকে নিরাপদ উপার্জন হস্তগত করার মোক্ষম সুযোগ এখন বাঙালির জন্য তৈরি হয়েছে।

পাহাড়ে কর্মরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিজেদের গ্রামে/নগরে গড়ে তোলা সম্পদের পাহাড়, গৃহসজ্জায় সেগুন বা অন্যান্য মহামূল্যবান আসবাবের বনেদিয়ানা পরিমাপ করে দেখলে এর সত্যতা মিলবে।

অন্যদিকে পাহাড়িদের কেউ কেউ নিজেদের বাগানের মূল্যবান সেগুন, গামারসহ অন্যান্য ফলদ-বনজ সম্পদ বিক্রি করলেও দিনশেষে সেই কপর্দকশুন্যই থেকে যাচ্ছেন, চাঁদাবাজিসহ আমলা এবং মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের শোষণ ও দৌরাত্ম্যের কারণে।

সাধারণত যে কোন দুঃখের একটি শেষ থাকে, অন্ধকার সুরঙ্গের শেষ প্রান্তে থাকে আলোর দিশা। কিন্তু জুম্ম জাতির সামষ্টিক দুঃখ যেন কখনও শেষ হবার নয়।

পাহাড়ে পরষ্পরের জীবন সংহারে ব্যস্ত আমাদের আঞ্চলিক রাজনীতির নেতা-কর্মীরা নিজেরাও জানেন না কী করুণ পরিণতির দিকে তারা নিজের জাতি, সমাজকে পরিচালিত করছেন।

জুম্মকে দিয়ে জুম্ম নিধন প্রক্রিয়ায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৬০ জনের তাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রধানত পরিবারের সুস্থ সবল উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরাই এই সংঘাতের বলি হচ্ছেন। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে নিহতের এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

সেনাবাহিনীর উৎপীড়নসহ জুম্ম যোদ্ধা কর্তৃক অপহরণ-নির্যাতন-হয়রানির ভয়ে শহর ও গ্রামে বসবাসরত অনেক পাহাড়ির জীবন ও চলাচল দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বাঙালি সেটেলারদের বিচরণ অবাধ ও সর্বত্রগামী হয়েছে। সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র পাহাড়িদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে সৃষ্ট এক জটিল ভয়ের সংস্কৃতিতে আবর্তিত হচ্ছে সাধারণ পাহাড়িদের জীবন ও মনোজগত।

পাহাড়ি বাঙালি নির্বিশেষে যারা অস্ত্রধারী তাদের পক্ষে ভুক্তভোগীদের এই অসহায়ত্ব ও মর্মযাতনা উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়। এখন অস্ত্রের ভাষা, অস্ত্রবাজির সংস্কৃতি এবং এর চোরা জৌলুস স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের কচি মনগুলোকেও ধীরে ধীরে প্রভাবিত করছে।

পড়াশোনায় অনাগ্রহী অনেক ছাত্র-ছাত্রী অস্ত্র ও দলবাজির দাপট দেখিয়ে স্কুল-কলেজের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরকে অপমানিত-নিগৃহীত করতেও পিছপা হচ্ছেনা।

অথচ পাহাড়ি সমাজে নিকট ও দূর অতীতে এ ধরনের আচরণ ছিল অকল্পনীয়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ি ‘মুক্তিসেনা’রাই কোথাও পুড়িয়ে দিচ্ছে জুম্ম স্বজনের বহু কষ্টে-সৃষ্টে গড়ে তোলা কোন দোকানপাট বা ঘরবাড়ি।

এধরনের অনেক আক্রমণে, হত্যাকান্ডে বা সহিংসতায় হয়তোবা দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমান্ডের কোনরূপ নিয়ন্ত্রণও নেই!

আসলে হিংসা-প্রতিশোধের আগুন একবার জ্বালানো হলে তা প্রশমনের কাজটি সত্যিই দুরূহ।

কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চীন, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, প্যালেস্টাইন, মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ এবং ইউরোপ আমেরিকার জনগণ বহু আগে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

দুই বিশ্বযুদ্ধে মানুষের নৃশংসতা কোন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল সেটি আমরা নাৎসি হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞ বা ‘হলোকাস্ট’ থেকে কিছুটা আঁচ করতে পারি। পৃথিবীতে এইসব হত্যা বা ধ্বংসযজ্ঞ কিন্তু পরিচালিত হয়েছিল বা হচ্ছে কোন না কোন মহৎ আদর্শের নামে।

নিজের মর্জিমতো সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত অধিপতি যোসেফ স্ট্যালিন স্বদেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবন সংহার করেছিলেন।

বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পীঠস্থান কম্বোডিয়ায় শ্রেণীশত্রু নির্মূলের নামে কমরেড পলপটদের নেতৃত্বে প্রায় বিশ লক্ষ স্বদেশবাসীকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল।

এতসব হিংসা-প্রতিহিংসা ও আদর্শিক বিভ্রান্তির বিপরীতে আমরা চাইলে পৃথিবীর একটি আধুনিক জাতি হিসেবে অবশ্যই ভিন্ন উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি।

জগতে মানুষ পর্যায়ক্রমে স্বার্থপর, প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে বলেই তথাগত বুদ্ধ জগৎবাসীকে সংযত মন ও মনন, অন্তরের পবিত্রতা, অপরিমেয় মৈত্রী ও অহিংসা লালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সমাজে রাজনৈতিক বা আদর্শিক দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট সংঘাত ও সহিংসতা সহজে বা আপনা আপনি প্রশমিত হয়না।

এতে কায়েমি স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় উস্কানি যুক্ত হলে তো কথাই নেই। এর বিপরীতে সমাজের শুভশক্তি চিরন্তন মানবতাবাদ, আত্মিক সংহতি ও শুভবোধের মশালগুলো নানা সৃজনশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে সুকৌশলে জ্বালিয়ে দিতে পারলে ধীরে ধীরে সহিংসতা প্রশমিত হতে পারে।

কিন্তু জুম্ম সমাজে শুভবাদী সেসব তৎপরতা আজও খুব সীমিত বা ক্ষীণপ্রাণ। এর পেছনের কারণটিও সহজবোধ্য। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক নানা সীমাবদ্ধতা এবং বোধবুদ্ধির সঙ্কট তো আছেই।

সেই সাথে জুম্ম সমাজের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটির বয়সও বেশি দিনের নয়, যারা ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর’ দুঃসাধ্য এই কর্মটি সাধন করবে।

বিরাজমান এই বাস্তবতায় এখন গুম, খুন, অপহরণের যে অপরিণামদর্শী প্রবল রাজনীতি সেটিকেই জুম্ম জাতীয় মুক্তির পরম আদর্শ মনে করে এর অনুসারীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

‘আপোষকামিতা’ আর ‘আপোষহীনতা’, ‘জুম্ম মুক্তিসেনা’ আর ‘সন্ত্রাসী’ এই দুই ধারার মতাদর্শের ধোঁয়াশা জাতিকে দ্বি-খণ্ডিত করেছে এবং প্রতিনিয়ত করছে।

সুতরাং, খণ্ডিতভাবে বাজারজাতকৃত এই দু’টি মতাদর্শই আসলে কৃত্রিম, বাস্তবতা বিবর্জিত এবং জুম্ম স্বার্থের পরিপন্থী। আদর্শের এই ভেজাল আফিম খাইয়ে জুম্ম সমাজে স্থিতধী, অহিংস বিপ্লবী তৈরি করা যাবেনা।

অথচ এখন সেই বিপ্লবীদেরই বড় প্রয়োজন আমাদের। যেমন ছিলেন, আছেন মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্শাল টিটো, প্যাট্রিস লুমুম্বা, ফিডেল ক্যাস্ট্রো, এমনকি মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে বাবাসাহেব আম্বেদকর, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, এম এন লারমা এবং অং সান সু চি পর্যন্ত।

বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতেও এই মানবতাবাদীদের অহিংস স্পিরিটটিই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এদেশে শান্তির, অহিংসার সেই কাঙ্খিত স্পিরিটটি রাজনীতির মূলধারায় কখনও ছিলনা।

দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ নেওয়ার বীভৎস রাজনীতি কখনও জনগণের মুক্তি আনবেনা। কারণ সময় তো এখন আর মধ্যযুগে থেমে নেই।

পৃথিবীতে মানবাধিকারের ধারণা আর প্রযুক্তিতে অভাবিতপূর্ব অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। বেঁচে থাকলে এখন কার্ল মার্ক্স, লেনিন আর মাও সেতুংও হয়তো অনেক বদলে যেতেন।

শুধুমাত্র রক্তাক্ত শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বে পড়ে থাকতেন না। যুদ্ধ ও মৈত্রী, হিংসা ও ক্ষমার অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে তাঁরা মানব জাতিকে আরও অনেক মানবিক করে তুলতেন। পর্যায়ক্রমে এবং চূড়ান্তভাবে তাঁরা অহিংস মানবতাবাদীই হতেন।

নিজেদের বিপ্লব-তত্ত্বের সংস্কার, পরিমার্জন করতেন। কারণ অবিমিশ্র রক্তাক্ত সংগ্রামের তত্ত্ব স্পেনের বর্ণান্ধ ষাঁড়দের মতো একরোখা সহিংস ‘বিপ্লবী’ সৃষ্টির জন্য অব্যর্থ মহৌষধ।

এরা অনেকটা বর্তমান সময়ের ধর্মান্ধ জিহাদী আল-কায়েদা, হামাস, তালেবান বা বোকো-হারাম যোদ্ধাদের মতোই। উস্কানি পেলে এই ষাঁড়েরা নিজের পিতামাতা, ভাইবোন, প্রশিক্ষক বা গুরুকেও নির্দ্বিধায় শিং মেরে কুপোকাত করে দিতে পারে।

বর্তমানে পাহাড়ের জুম্ম সমাজেও অনেকটা সেরকম ব্যাপারই ঘটছে। এখানে বয়স্ক, প্রাজ্ঞ, নেতা, গুরুজন কারও প্রতি কারও কোন ধরনের সমীহ, শ্রদ্ধাবোধ আর পরিলক্ষিত হয়না। আমাদের আত্মঘাতী হাবভাব দেখে বাঙালিরা, বিদেশিরা হাসছেন।

কিন্তু আমাদের কোন লজ্জ্বা নেই, অনুশোচনা বা দুঃখবোধ নেই। আসল কথা হলো, ভ্রান্ত আদর্শের রঙিন চশমা এঁটে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে কোন লাভ হবেনা। জুম্মদের অস্তিত্বের স্বার্থে পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন আর পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দু’টোই আমাদের প্রয়োজন।

এই দু’টি আরাধ্য বস্তু একে অপরের পরিপূরক, সাংঘর্ষিক মোটেও নয়। যেটি আগে পাওয়া যাবে সেটিই লাভ। বাকিটার জন্য সন্মিলিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

নিজেদের মধ্যে ঢুসাঢুসি করে কোনটাকে পাওয়া যাবেনা। এই সহজ সত্যটি সাধারণ জনগণকে বোঝানো হয়না। বরং তাদেরকে বিভাজনের রাজনীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে ‘জাতীয় মুক্তি’র অলীক স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে।

অনুসারীরা নিজের দলটিকে অন্য দলগুলোর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দাবি করে জনগণকে সংশ্লিষ্ট দলে ভিড়তে অনুপ্রাণিত করছেন।

কেউ অনুরূপ আদর্শে উদ্বুদ্ধ, সহমত না হলে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সুবিধাবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, দালাল জাতীয় তকমাও তাদের ভাগ্যে জুটছে।

এই ভ্রাতৃঘাতী রাজনীতি থেকে বাঁচতে অভিভাবকদের পরামর্শে অনেকে শহরাঞ্চলে এসে গার্মেন্টস কর্মীর কষ্টকর জীবনও বেছে নিচ্ছেন। আমরা এখন শ্রেণীযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত কয়েকবছর আগের সেই কম্বোডিয়ায় যেন বসবাস করছি।

আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন এক মিনি কম্বোডিয়া। তাদের সাথে ধর্ম ছাড়াও আমাদের চেহারায় রয়েছে অদ্ভুত মিল। নাকচ্যাপ্টা মোটাবুদ্ধির একরোখা প্রাণী আমরা।

স্যার রোনাল্ড জোফে’র ‘দ্য কিলিং ফিল্ডস’ সিনেমাটি দেখলে তাদের সাথে আমাদের রাজনীতি ও বুদ্ধির এই মিলটি বোঝা যাবে। ইদানিং পার্বত্য চট্টগ্রামেও হত্যা, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি দিন দিন বেড়ে চলেছে।

একসময় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ‘সর্বহারা’দের উৎপাতের ধরণও এমন ছিল। এর সাথে পাহাড়ের পরিস্থিতির আশ্চর্যজনক সাদৃশ্য বেশ কৌতুহলোদ্দীপক।

স্মরণ করুন, দক্ষিণবঙ্গে ‘জনদরদী’ এই সর্বহারাদের দমনের জন্য সরকার একসময় ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’, ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’ পরিচালনায় বাধ্য, প্ররোচিত বা উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান অনুরূপ পরিস্থিতিরই প্রতিফলন কিনা, বোদ্ধামহল একটু ভেবে দেখতে পারেন।

লেখক : ধীমান ওয়াংঝা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা