পাহাড়ি নারীর নিরন্তর সংগ্রামের ইতিকথা
2604
বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধ একটি কঠিন বাস্তবতা। যুদ্ধের রূপ একেক দেশে একেক রকম। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা সর্বত্রই সমান।
দেশভেদে এর মাতৃকতার ধরন ভিন্ন হয় বটে, তবে যুদ্ধের প্রভাবটা ভুক্তভোগীদের কাছে সমানই। সশস্ত্র সংঘাত, রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে অনেক গবেষণা করা হয়ে থাকে।
কিন্তু সেসব গবেষনণায় যুদ্ধকালীন সময়ে নারীর উপস্থিতিকে কখনও সম্পূর্ণ, কখনো বা নারীর অবদানকে উপেক্ষা করে তাদের ভূমিকাকে গৌণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
তবে আশার বিষয় হল যে, পরবর্তীকালে কিছু গবেষক যুদ্ধকালীন সময়ে নারীর নানান মাত্রিকতার অভিজ্ঞতাকে চর্তুমুখীকরে বিশ্লেষন করে এর বিকল্প কি হতে পারে সে বিষয়ে বিষদ আলোচনার অবকাশ রেখেছিলেন।
প্রথমদিকে এসব গবেষনায় কেবলমাত্র পুরুষ আধিপত্যকে প্রাধান্য দেয়া হত অর্থাৎ সমস্ত আন্দোলনের কর্তত্ব দেয়া হত পুরুষকে। আর যুদ্ধের সময় নারীর প্রতি সহিংসতাকে গবেষকরা খুবই সাদামাটাভাবে বিশ্লেষণ করতেন।
যুদ্ধে নারীর আত্মত্যাগকে সচরাচর কিভাবে মূল্যায়ন করা হয় সেটি দেখার ও উপলব্দি করার জন্য পৃথিবীর অন্য প্রান্তে তাকানোর প্রয়োজন নেই।
আমাদের দেশের দিকে তাকালেই এর চিত্রটি পরিষ্কার হবে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারীদের অনেক ত্যাগ, কষ্ট লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রম ও রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে।
কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্যে নারীর এই ত্যাগের স্বীকৃতি কেবল ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে সীমাবদ্ধ ছিল। আজ স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পরে পুরুষ আধিপত্যবাদী এ রাষ্ট্র, সমাজ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর যে ত্যাগ ও অবদান ছিল সে জন্যে নারীরাও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতির যোগ্যতা রাখেন!
আমরা আরেকটু সুনির্দিষ্টভাবে ফোকাস করি, ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সেখানেও নারীর অবদানের স্বীকৃতি অনুপস্থিত দেখি।
দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে স্বাধীকার আদায়ের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছে। সেসময়ে নারীরাও আন্দোলন সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছিলেন।
কিন্তু পার্বত্য চুক্তিতে সেসব নারীর অবদান ও স্বীকৃতির বিষয়টি সম্পূর্ন উপেক্ষিত ছিল। অথচ আন্দোলনের সময় নারীকেও চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
নারীরা বিভিন্ন সময়ে নিরাপত্তাবাহীনির সদস্য, বাঙালী সেটেলারদের দ্বারা যৌন হয়রানি, শ্লীলতাহানি বা ধর্ষনের শিকার হয়েছেন। এমনকি কোন পরিবারের সদস্য যদি আন্দোলনের কর্মী হত তাহলে নিরাপত্তাবাহীনির সদস্যদের দ্বারা পরিবারের অন্য সদস্যরা হয়রানির শিকার হতেন।
আমরা এমন অনেক পরিবারের কথা জানি যাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আন্দোলনে অংশগ্রহন করেছে, আর পুরো পরিবারকে আগলে রেখে নারী একাই টিকে থাকার সংগ্রাম করে গেছেন।
তাই পাহাড়ী নারীর নিরন্তর সংগ্রামের পরিসর অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে যেমন ছিল, একইভাবে সেই সংগ্রাম পরিবারে, সমাজে বর্তমানে রাজপথেও চলছে।
বাস্তুহারা জীবনে পাহাড়ী নারীরা সংগ্রাম:
কাপ্তাই বাঁধের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিল না কোন চাকচিক্যের জৌলুস বা বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি! প্রাকৃতিকভাবে ঘন সবুজ বনে আচ্ছাদিত পাহাড় ঘেরা এই অঞ্চলের ছোট ছোট ঝিরি আর খরস্রোতা চেঙ্গী, মাইনী, ফেনী, কাচালং নদীর ছন্দময় স্রোত পাহাড়ী মানুষগুলোর জীবনকে নির্মল আর স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে রেখেছিল।
সে সময় নদীর কোল ঘেঁষেই পাহাড়ী জনবসতিগুলো গড়ে উঠেছিল। নদীর তীরবর্তী জমিগুলো ছিল খুবই উর্বর। ফলে মানুষের চাষের জমির অভাব ছিল না।
অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি হলেও সম্পদে তারা ছিলেন পরিপূর্ণ! এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম দূরে হলেও প্রতিটি চেনা-অচেনা মানুষের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় বিশ্বাস আর গভীর আন্তরিকতা।
সন্ধ্যার পর অপরিচিত কোন ক্লান্ত পথিক দোর গড়ায় এসে হাজির হলে সেই আগন্তুকের জন্য গৃহস্থের দরজা সবসময় খোলা থাকত!
পাহাড়ের সেই সোনালী দিনগুলির কথা শুনলে মনে হয় যেন কোন রুপকথার কল্পকাহীনি শুনছি! এমনই রুপকথার রাজ্যের মতন ছিলো পার্বত্য চট্টগ্রাম।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দুঃখ ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ’ প্রকল্পটি পাহাড়ের শান্ত-নিরিবীলি জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলোর নির্মল জীবন আর তাদের ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে হ্রদের পানির অতল অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছে।
আর সমতলকে করেছে আলোকিত। এই বাঁধের ফলে পাহাড়ী দুঃখী মানুষগুলো শুধু বাস্তুচ্যুতই হন নি, তাদের সুখ-দুঃখের সামাজিক বন্ধন ও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।
যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাজার হাজার পাহাড়ী মানুষ হয়েছেন দেশান্তরী।
পাহাড়ী দুঃখী মানুষগুলোর বাস্তুহারা জীবন সংগ্রামের ইতিকথা আর চোখের নোনাজল শুধু পাহাড়ের আঁকে-বাঁকেই নয়, কাপ্তাই হ্রদের বিশাল জলরাশির সাথেও মিশে আছে!
কাপ্তাই হ্রদের নীল জলে যখন ঢেউ খেলে যায় তখন অনেকে অভিভূত হয়ে পরেন! কিন্তু সেই ঢেউয়ে যদি একটু গভীরভাবে কান পাতেন তাহলে শুনতে পাবেন-এই নীল জলের নীচে তলিয়ে যাওয়া গোলাছড়ি, বড়াদম, মগবান, ঝগড়াবিল, বালুখালি, মাওরুমসহ আরো অসংখ্য গ্রামের মানুষগুলোর গভীর দীর্ঘশ্বাস!
একদিকে বাস্তুচ্যুতি অন্যদিকে সামাজিক বন্ধনে ভাঙনের ফলে পাহাড়ীদের ঐতিহ্যগত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও চরমভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
এতে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী আরও দরিদ্র হয়ে পড়ে। এই ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরে আবার পাহাড়ীদের অস্তিত্বের উপর চরম আঘাত আসে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তেরটি জাতিসত্তাসহ সারাদেশে প্রায় পঞ্চাশের অধিক ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তাগুলোর স্বাতন্ত্রতাকে ভুলে গিয়ে সংবিধানে যখন সব জাতিস্বত্তার মানুষগুলিকে বাঙালী জাতিয়তাবাদের মাপকাঠিতে বিচার করা হয় তখন পাহাড়ী মানুষগুলো নিজেদের স্বাতন্ত্রতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
ফলে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও পাহাড়ীরা স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারেনি। কাপ্তাই বাঁধের ফলে পাহাড়ের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই পাহাড়িদের ওপর আবার উগ্র বাঙালী জাতিয়তাবাদ এসে আবার আঘাত হানে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে বহু নারীর দুঃখ গাঁথা যেমনি আছে, তেমনি আছে নারীর বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের কাহিনীও।
ষাট দশকে কাপ্তাই বাঁধ চালুর পর থেকে পাহাড়ী নারীর নিরন্তর দুঃখ গাঁথা শুরু। এর আগে পাহাড়ী নারীদের কোন দুঃখ ছিল না সে দাবি অবান্তর।
পুরুষ আধিপত্যবাদী এ সমাজে নারীর প্রতি বৈষম্য আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে সেসময়ে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মাঝেও নারীর নিরাপত্তা ও স্বাধীন চলাফেরার নিশ্চয়তা ছিল।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন থেকে সামরিক উপস্থিতি বেড়ে যায় এবং সেটেলার বাঙালী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকে পাহাড়ী নারীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে।
যুদ্ধের একটি ভয়াবহ স্মৃতি হল বাড়ি ছাড়া হওয়া। যুদ্ধের সময় মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য আরেক যায়গায় বসবাস করার কারনে সে আর্থিকভাবে যেমন নিঃস্ব হয়, তেমনি মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কারন কোন ব্যক্তি যখন ঘর ছাড়া হয় তখন সে তার মৌলিক নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার পরপরই যদি সে নিজের জন্য একটা আশ্রয় না পায়, তাহলে তার মধ্যে হতাশা কাজ করে এবং সে সাময়িকভাবে নিজেকে নিরাপত্তাহীন মনে করে।
এছাড়া বাস্তুচ্যুত হওয়ার ফলে এলাকার লোকরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার ফলে লোকগুলোর মধ্যে সামাজিক ঐক্যবোধ (Community spirit) হারিয়ে যায়।
Morning Light By Nantu Chakmaকাপ্তাই বাঁধের ফলে যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫৪,০০০ হাজার একর ধানি জমি আর গ্রামের পর গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায় তখন বাস্তুহারা এ মানুষগুলো কিভাবে এই দীর্ঘ দিনের চেনা পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন সেই চিত্র স্নেহ কুমার চাকমা’র ‘জীবনালেখ্য’ বইয়ে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
লেখক স্নেহ কুমার চাকমার বর্ণনায় আমরা সেই চিত্রকে এভাবেই আবিস্কার করি-‘সকলে ভাত খেলাম।
খাওয়া শেষ হওয়ার পর মা হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন পরিস্কার করে সেগুলো ভাঁজ করে কাল্লঙে (বাঁশের ঝুড়ি) ঢুকালেন……..মা শুভান্যুধায়ী অথিতিদের হুক্কা, পান-সুপারী দিয়ে আপ্যায়ন করলেন মা……উনুনটি পরিস্কার করে মাটি দিয়ে লিপলেন মা-বাবা ও শুভান্যুধায়ীরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে বিদায় নিলেন……….মা বাড়িটিকে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন…….. বাবা ঘরের মালামালের শেষ বোঝাটি কাঁধে নিলেন…….মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল…..নৌকা কর্ণফুলীর উজানে চললো…..বাবা-মা অপলক নেত্রে দক্ষিণ দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন!
এ অনিশ্চত যাত্রার চিত্রটি হল, একটি পরিবারের ভিটেমাটি ছেড়ে চিরদিনের জন্য অন্যত্র চলে যাবার করুন ও বেদনার চিত্র। অন্যদিকে, একটি শরনার্থী পরিবার যখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপত্তার জন্য ঘর ছাড়ে তখন নিঃস্ব অবস্থায় কেবল প্রান নিয়ে ছুটে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।
মূলত ১৯৮০ সালের কলমপতি ঘটনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সাম্প্রদায়িক হামলা, গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘঠিত হয় সেসব খবর বাইরে প্রকাশ পেতে শুরু করে।
বিভিন্ন সময়ে সংঘঠিত সাম্প্রদায়িক হামলার পর নিরাপত্তার জন্য পাহাড়িরা পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিতো। তবে তাদের আবার স্বদেশে পাঠানো হত।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে পহেলা মে একযোগে খাগড়াছড়ি, মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি, দিঘীনালায় পাহাড়িদের ওপর বাঙালী সেটেলার ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হামলা, লুটপাত, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার পরে হাজার হাজার পাহাড়ী ভারতে আশ্রয় নেয়।
সেসময় নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত আশ্রয়প্রার্থীরা আর স্বদেশে ফিরে আসতে চায় না। তাই ভারত সরকার তাদেরকে ভারত শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়।
আশ্রিত শরনার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ভারত সরকার ত্রিপুরা রাজ্যে ৬টি শিবির ক্যাম্প স্থাপন করে দেয়। সরকারী হিসেব মতে, ১৯৯৭ সালে ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে আসে ১২,২২২ পরিববারের ৬৪,৬০৯ জন পাহাড়ি মানুষ।
শরনার্থীরা যখন নতুন কোন জায়গায় যায় তখন তাদেরকে সম্পূর্ন নতুন বৈরি পরিবেশে, নতুন সংস্কৃতি ও নতুন সমাজের মুখোমুখি হতে হয়।
অচেনা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদেরকে দু’টো দিককে মোকাবেলা করতে হয়। একদিকে বস্তুগত চাহিদা যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা। অন্যদিকে মানসিক দিক। অর্থাৎ তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের মনকে সর্বক্ষণ সংকুচিত রাখে।
অতীত অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে উদ্বেগ অনিশ্চয়তা, মানষিক বিষন্নতা, অপরাধ প্রবনতা ও ক্রোধের জন্ম দেয়। এমনকি যে কোন ধরনের সহযোগিতার প্রতি ও তাদের অবিশ্বাস জন্মে।
পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই হোক না কেন শরনার্থী নারীর বেঁচা থাকার জন্য নারীর সংগ্রাম ছিল বেদনাদায়ক। ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে প্রতিটি নারী ঘর ছাড়া হয়েছেন।
ঘর থেকে বেরিয়ে অনিশ্চিত যাত্রার মধ্য দিয়ে নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু হয়। তারা জানে না কোথায় যাচ্ছেন, কিন্তু কেবলই জানেন বাঁচতে হলে পালাতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, পাহাড়ী শরনার্থীদের ভারতে পৌঁছতে গড়ে প্রায় ৭/৮ দিন রাত হাঁটতে হয়েছে।
এই সময়ে তাদেরকে খোলা আকাশের নিচে রাতের পর রাত কাটাতে হয়েছে অভুক্ত অবস্থায়। দিনের বেলায় হাঁটতেন। অন্যের ভালো-মন্দ দেখার কোন অবস্থা ছিল না।
সবার একটাই লক্ষ্য-নিরাপদ স্থানে আগে পৌঁছতে হবে। জঙ্গলের লতা-পাতা সিদ্ধ খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছিল। কখনও দু’মুটো ভাত হয়টো জুটেছিল সহযাত্রীদের দয়ায়।
কখনও এমন হয়েছে নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতির উড়ো খবর শুনে ভাতের পাত ফেলে দৌড়াতে হয়েছে! এভাবে পাহাড়ী ছড়ার পানি খেয়ে দিনের পর দিন হাটতে হত।
যেসব স্থানে নিরাপত্তাবাহিনীর আতঙ্ক ছিল সেসব স্থান রাতের আধাঁরে কোন আলো না জালিয়ে নিঃশব্দে অতিক্রম করতে হয়েছে। এসময়টি নারী-শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ছিল আরও কঠিন!
শরনার্থী হিসেবে সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ হচ্ছে নারী ও শিশু। যুদ্ধকালীন সময়ে এ অংশটি সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত থাকে।
একটি যুদ্ধ একটি নারীর জীবনের কৌশলকেই পাল্টে দেয়। নিজের বাস্তুভিটায় থাকার সময় নারী বেঁচে থাকার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেন অন্য আরেক যায়গায় গেলে তাকে নতুন আরেক পরিবেশে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়।
ফলে তার দীর্ঘ দিনের কৌশলে পরিবর্তন আনতে হয়। একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, পাহাড়ী নারীরা জুমচাষ এবং অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকে।
কিন্তু যখন তাদেরকে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় তখন তাদের কাজের ধরন বদলে যায়। তারা টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন পন্থা বেছে নেন। যেমন, কোমড় তাঁতে কাপড় বুনে বিক্রি করা, চা ও মুদির দোকানে শ্রম দেয়া, হাতের তৈরি পিঠা বানিয়ে রাস্তার ধারে বিক্রি করা, জঙ্গল থেকে জ্বালানী কাঠ (লাকড়ি) সংগ্রহ করে বিক্রি করা, এমনকি সুদের ব্যবসাও করতে হয়েছে।
কাজেই শরনার্থী জীবন একটা পাহাড়ী নারীর গতানুগতিক ধারাকেই আমূলভাবে বদলে দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অতীত ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পাহাড়ি নারীর সনাতন জুমচাষের সাথে জড়িত এবং যারা শিক্ষিত তারা মূলত শিক্ষকতা পেশার সাথে বেশি জড়িত ছিলেন।
কিন্তু বর্তমানে পেশা বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে নারীরা নিজেদের চিন্তাকে চর্তমুখীভাবে বিস্তৃতি ঘটাচ্ছেন। বর্তমানে নারীরা একইসাথে চাকরীজীবী, কৃষিজীবী, ব্যবসায়ী, মুদির দোকানী, রাজনৈতিক কর্মী, অধিকারকর্মী।
দীর্ঘদিন যাবত শরনার্থী হিসেবে থাকার ফলে পরিবার কাঠামোতে শরনার্থী নারীর ভূমিকায় পরিবর্তন দেখা দেয়।
স্বদেশে থাকার সময় গৃহকর্তা হিসেবে পুরুষের যে অবস্থান ছিল দেশ ছাড়া হওয়ার পর তার সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে যাওয়ায় অনেক পুরুষ নিজেদের গুটিয়ে নেয়।
ফলে নারীকেই তখন পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোন কোন পরিবারে পুরুষরা একেবারেই কাজ করতেন না।
সেক্ষেত্রে মেয়েরাই তাঁত বুনে, পাহাড়ের ঢালে শস্যাদি বপন করে কিংবা টিউশনি করে পরিবারের হাল ধরেছিলেন। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একজন মা ভারত সরকার থেকে প্রাপ্ত সীমিত রেশন থেকে চাল বাঁচিয়ে সন্তানের স্কুলের বেতনের খোড়াক যোগাতেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য মায়েরা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন।
এসব ঘটনা পর্যালোচনার পর দেখা গেছে, পুরুষরা যখন আত্মমর্যাদার সংকটে পড়ে দিধাগ্রস্ত, তখন নারীরা শক্ত হাতে পরিবারের হাল ধরেছিলেন।
এখানে দুই প্রজন্মের দুটি কেস স্টাডি থেকে বাস্তুহারা জীবনে নারীর টিকে থাকার সংগ্রামের চিত্রকে আরও স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।
মধুমিতা চাকমা (ছদ্ধনাম), বয়স ২৮। তার মুখেই শোনা যাক-
‘আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। দিন তারিখ মনে নেই। একদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ছেড়ে আমরা সবাই ভারতের উদ্দ্যেশে রওনা দিই। বাবা কৃষি কাজ করতেন।
সবসময় নিরিবিলিতে থাকতে পছন্দ করতেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে আমরা চারবোন তখনও অবিবাহিত ছিলাম। একদিন এক লোক এসে বাবাকে বললো- তোমার ঘরে যুবতী মেয়ে আছে, এখানে (বাংলাদেশে) থাকলে তোমাকে বাঙালীকে বেয়াই ডাকতে হবে!
আমাদের বাড়ির কাছেই নিরাপত্তবাহীনির চেকপোষ্ট ছিল। তাই রাতের বেলা বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা যাতে বুঝতে না পারে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে সেজন্য বাড়িতে হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে রাতেই অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি।
শরনার্থী থাকাকালীন সময়ে খুব অল্প বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমার বিয়ের পর বাবা-মা শরনার্থী কতৃপক্ষকে না জানিয়ে দেশে ফিরে আসে।
আমি শ্বশুর বাড়িতে থেকে গেলাম। আর বিয়ের পরপরই বাবা-মা দেশে ফিরে আসায় প্রথম প্রথম খুব অসহায় বোধ করতাম। তাছাড়া আমাদের বিয়েতে প্রথমদিকে শ্বশুর-শ্বাশুরির অমত থাকায় আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হীনমণ্যতায় ভুগতাম! আমার স্বামী দিন মজুরীর কাজ করে দিনে ১৫ টাকা পেতো।
জীবনে কখনো কামলা খাটে নাই, তাই প্রথম প্রথম বাড়ি ফিরে বিষন্ন হয়ে বসে থাকতো। তখন তাকে আমি মানসিকভাব শক্ত থাকার জন্য বিভিন্নভাবে সাহস যোগাতাম।
পরে ধীরে ধীরে তার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। এভাবে কামলা খেটে একসময় কিছু টাকা জমে যায়। এরপর আমরা নিজেরা জঙ্গল কেটে জুমচাষ করা শুরু করি। পরে কিছু টাকা হাতে পেয়ে আমি একটা সেলাই মেশিন কিনে সেলাইয়ের কাজ শুরু করি। এভাবে শরনার্থী শিবিরে ৭/৮ বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে আসি।”
দেশে ফিরে মধুমিতা চাকমা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। তিনি জানান, এসময় পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বাত্নক সহযোগিতা পেয়েছি এবং নির্বাচনে জিতে নিজের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। আমি আশা রাখছি ভবিষ্যতেও জনসেবার কাজটি চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।
অন্যদিকে, মমতা চাকমা (ছদ্মনাম), বয়স ৬৫। স্বামী সাবেক ইউপি মেম্বার এবং গ্রামের কার্বারী। মিসেস মমতা চাকমা লেখাপড়া না জানা গ্রামের সরল এক বধু! তার ভাষায়- “১৯৮৯ সালের ৩১ মে রাতের আঁধারে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।
রাতে গ্রাম ছাড়ার প্রধান কারন হল, নিরাপত্তাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে চলা এবং গ্রামের লোকেরা যাতে আমাদের চলে যাওয়া দেখে হতাশ না হয়। কারণ মেম্বার হওয়ার কারনে নিরাপত্তাবাহিনী প্রায়ই সময় আমার স্বামীকে ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যেত।
তখন তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত খুব চিন্তায় থাকতাম। যেদিন আমরা ঘর ছেড়ে যাই সেদিনও সারাদিন তাকে ক্যাম্পে মিটিংয়ের কথা বলে আটকে রাখা হয়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরা মাত্র আবার ক্যাম্প থেকে লোক পাঠানো হয় সেখানে যাবার জন্য।
তিনি কৌশলে শরীর খারাপের কথা বলে তাদের বিদায় করেন। তবে ক্যাম্পের লোকেরা তাকে শর্ত দিয়ে যায় যে, পরদিন ভোরে যেন আমার ভাই নিলয় কান্তি চাকমা (ছদ্মনাম) কে নিয়ে ক্যাম্পে যায়।
আমার ভাইয়ের নামে ক্যাম্পে তখন অভিযোগ দেয়া হয়েছিল সে নাকি শান্তবাহিনীর এজেন্ট। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছিল। আর তাকেও ঘন ঘন ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে।
যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে এই ভয়ে আমরা সেদিনই বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই। বাড়ি ছাড়ার আগে গরু, ছাগল, শুকর, মুরগীগুলো রাতের অন্ধকারে ছেড়ে দিই। ঘরে ছিলো বিন্নি ধানের চাল।
সেগুলো মাটিতে ঢেলে রেখে প্রণাম করে একটি হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে ঘর ছেড়েছিলাম। সাথে কিছু কাপড় চোপড়, কিছু চাল এবং ২/৩ টি হাড়ি পাতিল নিয়ে যাই। ভারতে পৌছতে আমাদের ১১ দিন সময় লেগেছিল।
প্রথম রাতে পাহাড়ের কাছাকাছি জঙ্গলে ছিলাম। পরদিন সেখান থেকে রওনা হয়ে ‘তৈচাংমা’ পৌঁছলাম। সেখানেও মোনের (পাহাড়ের) উপর কলাপাতা বিছিয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম।
পথে বন্য শাক, কলাগাছের ‘বকুলি’ ছিল প্রতিদিনের খাবার! আমরা যে পথে যাচ্ছিলাম সবই ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। একের পর এক পাহাড় পাড় হতে গিয়ে আমি এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
এভাবে একে একে পাহাড় ডিঙিয়ে ‘মধ্যজুমচাপ’ নামে এক জায়গায় পৌঁছাই। সেখানে নিরাপত্তাবাহিনীর ভয় না থাকায় দুদিন বিশ্রাম নিয়েছিলাম। এরপর একে একে চাদারাছড়া, ধনপাদা, সদ্যেংছড়া হয়ে ভারতের রইস্যাবাড়ি পৌঁছাই।
মধুমিতা চাকমা বলেন, পরিস্থিতিই বাধ্য করেছিল নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে! উপায় ছিল না তাই একসময় নিজেদেরকে সেভাব গড়ে তুলতে শুরু করেছিলাম।
দেশে ছিলাম মুক্ত পরিবেশে আর শরনার্থী হয়ে এক রুমে বন্দী হয়ে পড়তে হয়েছিল। শিবিরের সমস্ত পরিবেশটাই ছিল অস্বাস্থ্যকর। স্থানীয় ভারতীয়রা প্রথম প্রথম আমাদের সাথে মোটেও ভাল ব্যবহার করত না।
পানির প্রচন্ড অভাব ছিল। স্থানীয় পুকুরের পানি ব্যবহার দূরে থাক জমিতেও পানির জন্য কুয়া খুড়তে দিতো না। জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে যেতে পারতাম না, বাধা দিতো।
পরে শিবিরের নেতাদের সাথে স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের মধ্যে একটা সমঝোতা হওয়ার পর পরিস্থিতি কিছুতা স্বাভাবিক হয়। সমস্যা শুধু লোকালদের সাথে হয় তা কিন্তু নয়।
আমাদের শরনার্থীদের মধ্যেও প্রথম প্রথম কোনো বোঝাপড়া ছিল না। পানির জন্য প্রতিদিন ঝগড়াঝাটি, মারামারি হত। কিন্তু পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে পারষ্পরিক আন্তরিকতা গড়ে ওঠে।
একসময় আলাপে আলাপে কখনওবা আত্মীয়তার সূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এভাবেই ধীরে ধীরে আমরা (শরনার্থীরা) পরষ্পর আপন হয়ে যাই।
মধুমিতা চাকমা জানান, দেশে ফেরার খবর শুনে উত্তেজনায় কয়েকদিন ঠিকমত ঘুমাতেই পারি নাই। দেশে ফিরে চারপাশটা কেবল ফাঁকা ফাঁকা মনে হত।
গাছপালা বাগানবাগিচা যা ফেলে রেখে গিয়েছিলাম সব কেটেকুটে শেষ করা হয়েছে। ভিটেমাটির মাটির অতি পরিচিত জায়গাগুলো জঙ্গলে ভরে গেছে।
চারদিক কেবল সুনসান। শিবিরে সকাল থেকে রাত অবধি কোলাহল, আর এখানে সম্পূর্ন বিপরীত পরিবেশ। তাই অন্যরকম একটা ভালো লাগা কাজ করতো। অনেক বছর পরে আবার নতুনভাবে সংসার গুছানো শুরু করলাম।
অধিকার আদায় সংগ্রামে পাহাড়ি নারী:
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তাগুলোর স্বাতন্ত্র ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাকিস্তান আমল থেকে বিভিন্ন সংগঠেনর আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু এসব সংগঠনে নারীর উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, চাকমা রানীর কালিন্দী’র ১৮৪৪ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত প্রায় তিন বছরের শাসনকাল বাদ দিলে পরের এক শতকে নারীর নেতৃত্ত্বই ছিল না।
এর প্রায় ১০০ বছর পর ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের মধ্যে আবারও জাগরণের সূচনা ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা এম এন লারমা পাহাড়ি জনগনের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন।
এর ফলস্বরুপ ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’ নামে পাহাড়ি নারীদের একটি রাজনৈতিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মহিলা উইং হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মূলত নারীদের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে স্বাধিকার আন্দোলনকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যেই এ মহিলা সমিতি গঠন করা হয়েছিল। এটি গঠনলগ্ন থেকেই পাহাড়ি নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর কর্মসূচি দিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
সে সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিভিন্ন যায়গায় মহিলা পঞ্চায়েতও গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শ্বায়ত্তশাসন আন্দোলন জোরদার হতে থাকলে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে সামরিকায়ন শুরু করে।
একদিকে ভৌগোলিক অবস্থার প্রতিকূলতা, আরেকদিকে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিয়ত চাপের ফলে মহিলা সমিতির সদস্যদের চলাফেরা ও নিরাপত্তা চরমভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ে। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে মহিলা সমিতির কার্যক্রমও স্মিত হয় পড়ে।
Artwork’ by Dhonomani, Photo: Nantu Chakmaপার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়ন ও সংঘাতকালীন সময়ে নারীরাই সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছিল। তবু তারা দমে না গিয়ে বরং নিরাপত্তাবাহিনীর চোখ রাঙানী উপেক্ষা করে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ ‘হিল উইমেন্স ফেডারেশন’ নামে একটি গনতান্ত্রিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
এটি শুরু থেকেই নারী ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধিকার আন্দোলনের পথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত ছিল।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ছাড়াও আদিবাসী নারী নেটওর্য়াক, দূর্বার নারী নেটওর্য়াক, তৃণমূল নারীদের নিয়ে গঠিত ‘সাজেক নারী সমাজ’, ‘ঘিলাছড়ি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, নারী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইত্যাদি সংগঠনগুলি নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
তৃণমূল নারীদের কাছে নারীবাদ, নারী মুক্তির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। কিন্তু পাহাড়ের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা ও কঠিন বাস্তবতা এ নারীদের প্রতিবাদী ও প্রতিরোধমুখী হতে শিখিয়েছে।
২০০৯ সালে রাঙামাটির ঘিলাছড়িতে নিরাপত্তাবাহিনীর এক সদস্য দ্বারা এক পাহাড়ি বধূ শ্লীলতাহানির শিকার হলে ওই এলাকার সাধারন নারীরা রাস্তা অবরোধসহ লাগাতার কর্মসূচি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিবাদের এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিল।
বর্তমানে ‘কল্পনা’ একটি মশালের নাম। যে মশালের আলো পাহাড়ের বাঁকেবাঁকে ছড়িয়ে আছে। কল্পনা চাকমা খুব কম সময়ে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলো পাহাড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই আলো এখনও পাহাড়ে জ্বলজ্বল করছে।
খাগড়াছড়ির ধুদুকছড়া থেকে বান্দরবানের ঘুনধুম, বাঘাইছড়ির সাজেক থেকে রাঙ্গামাটির ঘিলাছড়ি সর্বত্রই কল্পনার চেতনা বহমান রয়েছে।
শৈশবের অর্ন্তমুখী, শান্ত স্বভাবের গ্রাম্য মেয়েটিই ধীরে ধীরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছেন। পাহাড়ে যেখানে অন্যায় সংগঠিত হত কল্পনা সেখানে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কল্পনা সেই তেজ্বসী চেতনা আজকের পাহাড়ী নারীদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে।
শত প্রতিকূলতার মাঝেও অন্যায়, অবিচার, জুলুম ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে পাহাড়ের নারীরা একজোট হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন।
কল্পনা চাকমার অপহরন ঘটনা নিছক কোন নারী অপহরন সংক্রান্ত ঘটনা নয়। কারণ অপহরণের সময় তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের একজন সক্রিয় কর্মী ও নেত্রী ছিলেন।
বিশ বছর ধরে কল্পনা অপহরণ মামলায় শুধু তদন্ত-তদন্ত খেলা চলছে। এতবছর পরেও কল্পনাকে উদ্ধার করতে না পারা ও অপহরণকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় না আনতে পারার ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রকেই দায় বহন করতে হবে।
বিগত শতকে বাস্তুহারা হয়ে পাহাড়ি নারীদের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সংকটময় পরস্থিতি মোকাবেলা করে জীবন যুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পরেও পাহাড়ি নারীকে এখনও নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য জাতিগত ও লিঙ্গীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমানভাবে লড়াই করে যেতে হচ্ছে।
এতসব বৈষম্য-বঞ্চনা, নিপীড়নের মাঝেও পরিবারে, সমাজে, রাজপথে পাহাড়ি নারীর সরব উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।
তাই পরিশেষে বলতে হয়, পাহাড়ি নারীর এই সংগ্রাম কেবল নারীর ন্যায্য অধিকার লড়াই নয়, এই লড়াই সকল প্রকার বৈষ্যম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, এই লড়াই একজন স্বাধীন নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লড়াই, এই লড়াই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই, সর্বোপরি এই লড়াই পাহাড়ের মানুষদের স্বাধিকারের লড়াই।
কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামের তেরটি জাতিসত্তার অধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পাহাড়ি নারীর নিরন্তর সংগ্রাম চলতেই থাকবে।
লেখকঃ ইলিরা দেওয়ান
তথ্যসূত্রঃ দ্বিতীয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী লেখক সম্মেলন ২০১৬, স্মারক সংকলন।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।