বিংশ শতাব্দী পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সাহিত্য চর্চার নবজাগরণ
3086
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান-এ তিনটি জেলাকে বাংলাদেশের ‘পার্বত্য অঞ্চল’ বলা হয়। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এ তিনটি জেলা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা ছিল যা ১৮৬০ সালে গঠন করা হয়। ১৮৬০ সালের ২০ জুন তারিখে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন নং-৩৩০২ অনুসারে ‘রেইড অব ফ্রন্টিয়ার্স ট্রাইবস অ্যাক্ট ২২ অব ১৮৬০ অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠিত হয়।
বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেশের মূল ভূ-খণ্ডের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল যার বর্তমান আয়তন ৫,০৯৩ বর্গমাইল। এ ভূ-খণ্ডটি এক সময় ‘কার্পাসমহল’ নামেও পরিচিত ছিল।
তবে এটিকে বৃটিশ শাসনামলে অফিসিয়ালি ‘শাসন বহির্ভূত অঞ্চল’ (Excluded Area) এবং পাকিস্তান আমলে ‘উপজাতি অঞ্চল’ (Tribal Area) হিসেবেও বলা হত। পার্বত্য অঞ্চলে সুদীর্ঘকাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গা, ম্রো, বম,চাক, খিয়াং, পাংখোয়া, খুমী এবং লুসাইসহ ১১টি জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
এসব নৃ-জাতিগোষ্ঠির রয়েছে স্বতন্ত্র বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য । ভাষা, দৈনন্দিন চাল-চলন, খাদ্যোভাস, চাষাবাদ পদ্ধতি ইত্যাদিতে স্বাতন্ত্রিকতা লক্ষ করা যায়। তাদের রয়েছে আলাদা সঙ্গীত ও নৃত্য । সঙ্গীত ও নৃত্যে আদিম সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়।
মোট কথা তাদের স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আরো বর্ণাঢ্য ও রঙীন করেছে। তবে এসব জাতি-গোষ্ঠী দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে সকল বিষয়ে পূর্বেও পিছিয়ে ছিল এখনো রয়েছে।
মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী নৃ-জাতি গোষ্ঠীদের পরিচয় নিয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই। পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টি জাতি বসবাস করে থাকে। সরকারিভাবে এদের পরিচয় হচ্ছে ‘উপজাতি’ । ইংরেজিতে বলা হয় Tribe।
বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’-এ (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ জুলাই ১৯৯৮) ‘উপজাতি’ অর্থ দেওয়া হয়েছে-১.প্রধান জাতির অন্তর্ভুক্ত ক্ষুদ্র জাতি ২. পাহাড়ি আদিবাসী সম্প্রদায়।
Oxford Advanced learner’s Dictionary( 7th edition)-তে Tribe-এর অর্থ দেওয়া আছে (In developing countries) a group of prople of the same race, and with the same customs, language, religion, etc., living in particular area and often led by a chief : tribes living in remote areas of the Amazonian rainforest.
প্রতীয়মান হচ্ছে ইংরেজীতে যাদের Tribe বলা হয় বাংলায় উপজাতি বলতে অন্য অর্থ বোঝানো হয়। কাজেই Tribe অর্থ উপজাতি যে একেবারে মানতে হবে তা সঠিক নয়। বরং ইংরেজীতে Tribe-এর যে অর্থ করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী জাতিদের বেলায় Tribe অনেকটা প্রযোজ্য কিন্তু উপজাতি নয়।
কারণ এসব জাতি-গোষ্ঠী কোন বৃহত্তর জাতির শাখা বা ক্ষুদ্র জাতি নয়। তাদের স্বতন্ত্র ইতিহাস,ঐতিহ্য রয়েছে। রয়েছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক নিজস্ব পরিমণ্ডল । ইদানিং আদিবাসীও বলা হচ্ছে। এ শব্দটি ইংরেজী Indigenous-এর সমার্থক হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে ৯ আগস্ট-কে International Indigenous Day ঘোষণা করার পূর্বে এ শব্দটি তাদের মধ্যে প্রচলন ছিল না। উপরে বর্ণিত অভিধানে ‘আদিবাসী’-এর অর্থ করা হয়েছে-আদিম জাতি বা অধিবাসী।
অপরদিকে Oxford Advanced learner’s Dictionary(7th edition)-তে Indigenous শব্দটির অর্থ দেওয়া হয়েছে-Belonging to a particular place rather than coming to it from somewhere else. এক্ষেত্রেও প্রতীয়মান হচ্ছে যে, Indigenous শব্দটির সাথে বাংলা ‘আদিবাসী’ শব্দটি সমার্থক নয়।
মোট কথা হচ্ছে এসবের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের এসকল জাতিদের জাতি হিসেবে স্বীকার না করার কৌশল বিরাজমান রয়েছে। আমরা অতীতে দেখি তাদেরকে সাধারণ পরিচয়ে ‘পাহাড়ি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ইংরেজরাও বলতো Indigenous Hill man. এটি অনেকটা সঠিক বলে বিবেচিত হতে পারে।
এছাড়া শত শত বৎসর ধরে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের ফলে তারা যে সকল বৈশিষ্ট্য লালন করে থাকে সেদিক থেকে ‘পাহাড়ি’ শব্দটি উপযুক্ত বলে মনে হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে এসকল দিক বিবেচনা করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী নৃ-জাতিদের ‘পাহাড়ি’ হিসেবে পরিচয় করা হল এবং এ প্রবন্ধে বিংশ শতাব্দীতে তাদের সাহিত্য চর্চার দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের মধ্যে যে সাহিত্য চর্চা হয়েছে তা বিশ্ব সাহিত্যের লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেলেও তা অন্যান্য পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠির কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে বলে আমি মনে করি। এ কথা সত্য যে, পাহাড়িদের চালচলন ,চিন্তা-চেতনা এবং কাজে কর্মে এখনো কোন কোন ক্ষেত্রে আদিমতার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।
আধুনিক যুগের সংস্পর্শে এসে শত শত বৎসর ধরে লালিত চিন্তাধারায় একটি মিশ্র ভাবধারা এবং চিন্তা এসে সংযুক্ত হয়েছে যার প্রতিফলন সাহিত্যের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে। এ ধরনের সাহিত্য কর্মে সাধারণত ভিন্ন আমেজ থাকে।
মানের দিক বিবেচনা করলে আমরা হয়তো এর স্বাদ অনুভব করতে পারবো না কিন্তু সৃষ্টিশীলতা এবং সৃজনশীলতাকে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয় তা হলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এগুলো অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে। আলোচ্য আলোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ২% । ১৯০১ আদমশুমারিতে (Census Report) দেখা যায়, চাকমাদের মধ্যে ২১৫৬ জন পুরুষ এবং ৪৪ জন মহিলা শিক্ষিত। এ সংখ্যাতে যাদের অক্ষরজ্ঞান রয়েছে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
তাদের মধ্যে ৭৮৮ জন পুরুষ ও ২৪ জন মহিলা বাংলা এবং ৫৫ জন পুরুষ ইংরেজি জানত। অবশিষ্টরা চাকমা ভাষা লিখতে ও পড়তে পারত। অপরদিকে যারা বাংলা পড়তে পারে তাদের মধ্যে ২৯৪ জন পুরুষ এবং ৪ জন মহিলা চাকমা বর্ণমালায় পড়তে পারে। ১২ জন পুরুষ মগ ( মারমা বা বার্মিজ) ভাষাও পড়তে পারত।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দে চাকমাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ৪% এর মত। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য পাহাড়ি জাতিদের শিক্ষার হার আলাদাভাবে দেখানো হয়নি। এ আদমশুমারীতে হিন্দু ও মুসলমান-এ দুটো ভাগে শিক্ষার হার দেখানো হয়। এতে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে হিন্দুদের শিক্ষার হার ৫.৯% এবং মুসলমানদের ৬.৩% ।
সম্ভবত হিন্দুদের মধ্যে পাহাড়িদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। উক্ত আদমশুমারীতে ধর্মীয়ভাবেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আলাদাভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। মি. R.H. SNEYD HUTCHINSON তার CHITTAGONG HILL TRACTS গ্রন্থে লিখেছেন
“ Male education is much further advanced than might have been expected as 79 persons per 1000 can read write.” তাছাড়া চাকমা ব্যতিত অন্যান্য জাতির মধ্যে শিক্ষিত বা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন লোক ছিল না বললেই চলে। ফলে তাদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা না হওয়াই স্বাভাবিক।
কিন্তু পাহাড়ি জাতিগুলোর মধ্যে লোকসাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। চাকমাদের এ নগন্য সংখ্যক শিক্ষিতের মধ্যে সাহিত্য চর্চা স্বাভাবিকভাবে হবে না তা এক বাক্যে স্বীকার করে নিতে হবে। তবে একটি বিষয় সন্তোষজনক যে, তৎকালীন সময়ে চাকমা বর্ণমালায় অনেকে পড়তে জানত। যার ফল আমরা বিভিন্ন কাব্য রচনায় দেখতে পাই।
কালক্রমে চাকমা বর্ণমালায় পড়তে জানা লোকের সংখ্যা কমতে থাকে। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীন জেলা সদর ‘চন্দ্রঘোনায়’ । এ স্কুলের নাম ছিল ‘চন্দ্রঘোনা বোর্ডিং স্কুল’। স্কুলে চাকমা ও বার্মিজ ক্লাশ নামে ২টি ক্লাশ ছিল।
শিক্ষায় অনগ্রসরতার কারণে স্বভাবত পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চা দেরিতে শুরু হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে সাহিত্য চর্চা কম হবে- এটাও স্বাভাবিক । তবে আনন্দের খবর এই যে, বিংশ শতাব্দী থেকে এসব জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে যখন শিক্ষার আলো প্রবেশ করতে শুরু করে এবং তা দ্রুততার সাথে সাথে বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তাদের আধুনিক সাহিত্য চর্চাতেও পদার্পণ শুরু হয়ে যায়।
বিংশ শতাব্দীর ৩০-এর দশকে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়িদের মধ্যে বিশেষত চাকমাদের মধ্যে আধুনিক সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। তবে দেরিতে আধুনিক সাহিত্য চর্চা শুরু হলেও তাদের লোকসাহিত্য ভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ-একথা নির্ধিদ্বায় স্বীকার করতে হবে।
এসকল লোকসাহিত্যে তাদের সমৃদ্ধ জীবন প্রণালী এবং গভীর জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীতে শিক্ষার আলো তাদের সমাজে পৌঁছার পর থেকে তারা আধুনিক সাহিত্য চর্চায় মনযোগী হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে চাকমাদের সাহিত্য চর্চার বিষয়গুলো বেশি পরিমাণে উঠে আসবে।
কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি পাহাড়ি জাতির মধ্যে চাকমারা শিক্ষা-দীক্ষাসহ সকল বিষয়ে এগিয়ে রয়েছে। আরো লক্ষ্যনীয় ব্যাপার যে, ম্রো, খুমীসহ বেশ কয়েকটি জাতির আধুনিক সাহিত্য চর্চা শুরু হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমাজের বিশিষ্ট্য সাহিত্যিক সুহৃদ চাকমা ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত তাঁর এক প্রবন্ধে চাকমা সাহিত্যের কালকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা ঃ- ১। প্রাচীন যুগ (১৩০০-১৬০০), ২। মধ্য যুগ (১৬০০-১৯০০) এবং ৩। আধুনিক যুগ (১৯০০- বর্তমান ) ।
প্রাচীন যুগ এবং মধ্য যুগের সময়কালকে বাদ দিয়ে আধুনিক যুগের সময়কে যথার্থ বলে মনে হয় । চাকমাদের বিভিন্ন বারমাসিগুলো কখন রচিত হয়েছিল তার সঠিক সময় এখনো জানা যায়নি কাজেই সাহিত্যের প্রাচীন যুগ এবং মধ্য যুগ নির্ণয় করা কঠিন ।
অন্যান্য পাহাড়ি জাতিদের বেলায়ও একই কারণ হতে পারে বলে মনে হয়। একই ভূ-খণ্ডে এবং এলাকায় দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করার কারণে পাহাড়ি জাতিরা একই সময়ে শিক্ষার আলো লাভ করে। তবে চাকমাদের আধুনিক সাহিত্য অন্যান্যদের চেয়ে আগে যাত্রা শুরু করেছিল বললে ভুল বলা হবে না ।
উল্লেখিত ভাগ ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের সাহিত্যকে শ্রেণী অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এ দুটি ভাগ হচ্ছে-১। পাহাড়িদের নিজস্ব মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা এবং ২। বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংবাদপত্র বিষয়ে বিশিষ্ট্য গবেষক নন্দ লাল শর্মা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য চর্চার কালকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা ঃ- ক) দেশবিভাগ পূর্ব যুগ (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ) খ) দেশবিভাগ উত্তর যুগ এবং গ) স্বাধীনতা উত্তর যুগ।
সাধারণত পাহাড়িদের মধ্যে বাংলা এবং তাদের নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য চর্চা অব্যহত রয়েছে। ফলে একই ব্যক্তির দুটি ভাষায় সাহিত্য কর্ম রয়েছে। ইতোমধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিসত্ত্বাদের তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চা প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
ফলে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণে সাহিত্য চর্চা করে পাহাড়িদের মধ্যে অনেকে আত্নতুষ্টি করছেন। যদিও ২১ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অনেক পূর্ব থেকে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণে সাহিত্য চর্চা অব্যহত রয়েছে পাহাড়িদের মধ্যে। নন্দ লাল শর্মা লিখেছেন, “দেশ বিভাগ পূর্বযুগের বাংলা সাহিত্য চর্চা ছিল মূলতঃ ‘গৈরিকা’ কেন্দ্রিক।
বলা যায় এখানে বাংলা সাহিত্য চর্চার প্রথম সুযোগ আসে ‘গৈরিকা’কে কেন্দ্র করেই ।———গৈরিকার লেখক নন অথচ দেশ বিভাগোত্তর যুগে সাহিত্য চর্চা করেছেন এমন লেখকের সংখ্যা স্বল্প ।” গৈরিকায় যারা সাহিত্য চর্চা করেছিলেন তারা হলেন- প্রভাত কুমার দেওয়ান, অরুণ রায়, কুমার কোকনদাক্ষ রায়, বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, রাণী বিনীতা রায়,
অবিনাশ চন্দ্র দেওয়ান, কালাঞ্জয় চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান, ভগবান চন্দ্র বর্মণ, কুমার বিরূপাক্ষ রায়, গোপাল চন্দ্র গুর্খা, তনুরাম খীসা, নীলা রায়, বিপুলেশ্বর দেওয়ান, রাজা নলিনাক্ষ রায়, চুনী লাল দেওয়ান, শান্তি রায়, সুনীতি জীবন খীসা, গিরীন্দ্র বিজয় দেওয়ান, নীরোদ রঞ্জন দেওয়ান, কুমার রমণী রায়, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, জগদীশ চন্দ্র বর্মণ ও রাজেন্দ্র নাথ তালুকদার।
এসকল ব্যক্তিদের মধ্যে অরুণ রায়, সলিল রায়, রাণী বিনীতা রায়, বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, কুমার কোকনদাক্ষ রায়, প্রভাত কুমার দেওয়ান, চুনী লাল দেওয়ান প্রমুখ ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক সাহিত্য জগতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ধর্মধন চাকমা (ধর্মধন পণ্ডিত), পুষ্প মনি চাকমা, প্রবোধ চন্দ্র চাকমা(ফিরিং চান) , চুনীলাল দেওয়ান, শরত চন্দ্র রোয়াজা, হর কিশোর চাকমা, কবি অরুণ রায়, সলিল রায়, রাণী বিনীতা রায়, প্রভাত কুমার দেওয়ান, কুমার কোকনদাক্ষ রায় প্রমুখ ব্যক্তিরা হলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের পথিকৃৎ।
বিংশ শতাব্দীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী পাহাড়িদের জন্য আধুনিক সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে নবজাগরণ বলা যেতে পারে। এ শতকেই পাহাড়িদের মধ্যে আধুনিক সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এসকল সাহিত্য কর্ম হয়তো কখনো প্রকাশিত হয়েছে বা কখনো হয়তো প্রকাশ হয়নি।
এর কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে বিংশ শতাব্দীর ৭০ দশক পূর্ব পর্যন্ত কোন মুদ্রণের ব্যবস্থা না থাকা এবং বাজারজাতকরণ তথা পাঠকের অভাব।
চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে বই মুদ্রণ করে আনা তৎকালীন সময়ে ছিল দুরূহ ব্যাপার। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত খারাপ।
এর মধ্যে চট্টগ্রামের কোন একটি প্রেস থেকে প্রবোধ চন্দ্র চাকমা (ফিরিং চান) ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর চাকমা ভাষায় লিখিত অমর কবিতাগ্রন্থ ‘আলসি কবিতা’ (আলসে কবিতা) নামক বইটি মুদ্রণ করতে সক্ষম হন।
কাব্যগ্রন্থের বিচারে এটিকে ঠিক কাব্যগ্রন্থও বলা যায় না। তবুও এটি কাব্যগ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে আসছে। গ্রন্থের বিভিন্ন শিরোনামে তিনি চাকমা অলস মহিলা ও অলস মানুষের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এটি তিনি পয়ার ছন্দে রচনা করেছিলেন। আমাদের প্রাপ্য তথ্য মতে , এ গ্রন্থটি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথম ‘চাকমা কাব্যগ্রন্থ’।
গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয়। পাহাড়িদের লিখিত প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়-এর ‘চাকমা রাজ বংশের ইতিহাস’ (প্রকাশকাল ১৯১৯ খ্রিঃ) । প্রবোধ চন্দ্র চাকমা তাঁর ‘আলসি কবিতা’র কাব্যে অলস মানুষকে নিয়ে লিখেন-
প্রবোধ চন্দ্র চাকমা তাঁর আলসি কবিতায় ‘কবিতা আরাম্ভ’ শিরোনামে একজন অলস মানুষের পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর এ কাব্যটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যকে উচ্চ আসনে আসীন করেছে। এই কাব্যে তিনি ‘আলসি মিলার কথা’ (আলসে মহিলার কথা) অংশে লিখেন-
এ অংশেও তিনি একজন আলসে মহিলার বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এ কাব্যে মূলতঃ একজন চাকমা আলসে মহিলার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেছে।
চাকমা সমাজে পণ্ডিত বলে খ্যাত ধর্মধন চাকমা’র ‘চান্দবী বারমাস’ অমর কাব্যটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের সাহিত্য কর্ম বলে ধরে নেওয়া যায়।
কারণ রূপবতী চান্দবী’র বিচারকার্য চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায় (রাজত্বকাল ১৮৯৭-১৯৩৩) রাঙ্গামাটি চাকমা রাজবাড়িতে সম্পন্ন করেছিলেন।
ধর্মধন চাকমা এ কাব্যটি অনেকটা প্রাচীন বাংলা ভাষায় চাকমা বর্ণে রচনা করেছিলেন রূপবতী চান্দবী’র জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী নিয়ে ।
এটি পুস্তকারে প্রকাশিত না হলেও তৎকালীন চাকমা সমাজে তা অনুলিপি হয়ে অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন চাকমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ কাব্যের ‘রূপ বন্দনা’ নামক শিরোনামে ধর্মধন লিখেন-
ধর্মধন চাকমা’র ‘মলি কবিতাটি’ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। এ কবিতায় কবি মলি (Yeast জাতীয় জিনিস) তৈরি করা থেকে মদ তৈরি করার পদ্ধতি এবং মদ খাওয়ার পরিনাম কাব্যসুরে বর্ণনা করেছিলেন দক্ষতার সাথে।
এ কবিতাটিও তৎকালীন কোন সংবাদপত্র কিংবা কোন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। তবে এ কবিতাটি একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে কপি হয়ে অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন চাকমাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই তারা মুখস্থ করে ফেলেছিল। কারণ কাব্য মুখস্থ হতে কষ্টসাধ্য ছিল না।
চান্দবী বারমাস কাব্যটির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কাব্যটি রচিত হয় সেটি হচ্ছে পুষ্প মনি চাকমা’র ‘চিত্ররেখা বারমাস’ কাব্যটি। জনৈক চিত্ররেখা সুন্দরীর প্রেম কাহিনী এ কাব্যের বিষয়বস্তু। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে এটি রচিত।
গৈরিকা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথম ‘সংবাদপত্র’ যেটির নাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়েছিলেন। পুষ্প মনি চাকমা ‘চিত্ররেখা বারমাসের ‘অন্তঃ অগ্রাইয়ন মাসের বিবরণ’ (চিত্ররেখার সহিত কান্দারার মিলন) লিখেন-
এতক্ষণ আমরা বুঝতে সমর্থ হয়েছি যে, পূর্বে চাকমারা শুধুমাত্র কাব্য চর্চা করত। বিভিন্ন বারমাসি এবং ভারত রামায়ণও পড়ত। আর যাদের একটু লেখার অভ্যাস ছিল তারা বিভিন্ন বারমাসি লেখত।
এজন্য চাকমাদের মধ্যে আমরা চান্দবী বারমাস, চিত্ররেখা বারমাস, মেয়েবী বারমাস, মা-বাব বারমাস, সৃষ্টি বারমাস সহ বারমাসির আদলে রচিত ‘কলি চদিজা’ এবং ‘রাধামন ধনপুদি পালা’, তান্যাবী পালাসহ আরো কত রকমের পালা দেখতে পাই।
উল্লেখিত রচনাগুলোতে চাকমা ভাষার সাথে আমরা মধ্যযুগীয় বাংলার সংমিশ্রণ দেখতে পাই। অবসরে এসব পালা বা বারমাসি পড়ে পড়ে চাকমারা সময় কাটাত।
প্রবোধ চন্দ্র চাকমা’র ‘আলসি কবিতা’র পরবর্তীতে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশিত হয় পমলাধন তঞ্চঙ্গা’র বাংলাভাষায় রচিত ‘ধর্মধ্বজ জাতক’ নামক বইটি। তিনি ছিলেন মূলত একজন কবিরাজ। তাঁর একটি হ্যান্ডপ্রেস ছিল।
ঐ প্রেস থেকে তিনি তার কবিরাজী সম্পর্কে বিজ্ঞাপন ছেপে প্রচার করতেন। তাঁর হ্যান্ডপ্রেস থেকে তিনি ‘ধর্মধ্বজ জাতক’ নামক বইটি ছাপেন। এটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় বিষয়ক জাতকের কাহিনী নিয়ে পয়ার ছন্দে রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ ।
এছাড়া ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত শ্রীমৎ অগ্রবংশ মহাথের’র ধর্মীয় নাটক ‘পরিণাম’, ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কার্তিক চন্দ্র তাঞ্চঙ্গা’র বাংলাভাষায় প্রকাশিত বৌদ্ধ ধর্মীয় বিষয়ক কবিতা গ্রন্থ ‘উদয়ন বস্তু’, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বরেন ত্রিপুরা’র গানের বই ‘অজানা পাহাড়ি সুর’ রাজমাতা বিনীতা রায়-এর ‘গ্রামের কল্যাণ’ (১৯৬৩ খ্রিঃ) উল্লেখযোগ্য।
বরেন ত্রিপুরা’র ‘অজানা পাহাড়ি সুর’ গ্রন্থটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরাদের রচিত প্রথম বই। এমনকি এটি পার্বত্য প্রকাশিত প্রথম গানের বই।
ত্রিপুরাদের মধ্যে সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। তিনি একাধারে গবেষক, গীতিকার ও সাহিত্যিক।
তাঁর রচিত অনেক ত্রিপুরা গান রয়েছে। তাঁর আপন কনিষ্ঠভ্রাতা মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরাও ত্রিপুরাদের মধ্যে পরিচিত একজন সাহিত্যিক। তিনি গান ও কবিতা লিখে থাকেন।
এছাড়াও রাজা দেবাশীষ রায়, শান্তি ময় চাকমা, পরমানন্দ চাকমা, সমিত রায়, বীরকুমার তঞ্চঙ্গা, কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গা , ক্য শৈ প্রু, প্রভাংশু ত্রিপুরা, নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রশান্ত ত্রিপুরা, শোভা ত্রিপুরা প্রমুখগণের নাম পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য জগতে পরিচিত নাম।
সাহিত্যকর্ম বিকশিত হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র। এছাড়া স্বতন্ত্রভাবে গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হলে তো কথা নেই। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে কোন সংবাদপত্র তথাপি কোন সাময়িকী প্রকাশিত না হওয়ায় পাহাড়িদের জন্য সাহিত্য চর্চা করা দুরূহ ছিল।
চাকমা রাণী বিনীতা রায়-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘গৈরিকা’ প্রকাশিত হওয়ায় সংবাদপত্র প্রকাশের বন্ধাত্বতা কেটে যায়।
অথচ বর্তমান বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড থেকে ‘রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ’ নামে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান রংপুর জেলা থেকে। এতে বোঝা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম অপরাপর এলাকা থেকে কত পিছিয়ে ছিল।
অদ্যাবধিও পিছিয়ে রয়েছে-একথা স্বীকার করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়িদের মধ্যে গদ্য সাহিত্যের সূচনা অনেকটা রাঙ্গামাটি চাকমা রাজবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘গৈরিকা’র মাধ্যমেই সূচিত হয়েছিল। গৈরিকা পত্রিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন শিক্ষিত পাহাড়ি সমাজ সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ পায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে গদ্য সাহিত্যের সূচনা অনেকটা গৈরিকা’র মাধ্যমে হয়েছিল এ কথা বলা যায়। ছোটগল্পের রচনা করার চর্চাও আমরা প্রথম গৈরিকা পত্রিকায় দেখতে পাই। গৈরিকায় লিখে অনেকে হাত পাকিয়েছিলেন।
গৈরিকায় বাংলা অনুবাদসহ প্রকাশিত শিল্পী চুনী লাল দেওয়ানের ‘ঘর দুয়ারত’ কবিতাটি উপজাতীয় ভাষায় লিখিত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম উপজাতীয় আধুনিক কবিতা বিলে বিবেচিত। এটি চাকমা ভাষায় রচিত।
চুনী লাল দেওয়ান ছিলেন একজন হ্যাডম্যান। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি সম্প্রদায় থেকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন চিত্রশিল্পী। তিনি কলকাতা আর্ট কলেজে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ফাইন আর্টসে ডিপ্লোমা পাশ করেন।
তিনি বিখ্যাত শিল্পী জয়নুল আবেদীন-এর সমসাময়িক ছিলেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত ২টি শিরোনামহীন বাংলা কবিতা পাওয়া গেছে। এ ২টি কবিতা ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গামাটি প্রকল্পনা সাহিত্যাঙ্গন ‘প্রকল্পনা’ নামে একটি সংকলনে মুদ্রণ করেছিল।
চুনী লাল দেওয়ান-এর কবিতা রচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আনুষ্ঠানিকভাবে আধুনিক সাহিত্য চর্চা শুরু হয়েছিল এ কথা নিশ্চিন্তে বলা যায়। তাঁর পূর্বে কোন পাহাড়ি আধুনিক সাহিত্য চর্চা করেননি। চুনী লাল দেওয়ানের প্রথম প্রকাশিত কবিতা হচ্ছে ‘ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে’ ।
বাংলাভাষায় রচিত এটি তাঁর দীর্ঘ একটি কবিতা। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে এ কবিতাটি গৈরিকায় ছাপা হয়েছিল। সাহিত্যের গুণগতমান মূল্যায়ন না করে সাহিত্য চর্চার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে চুনী লাল দেওয়ানের কবিতাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য জগতে অমর হয়ে থাকবে।
নব্য সাহিত্য হিসেবে পাহাড়িদের সাহিত্য কর্ম হয়তো এত উন্নত নয় কিন্তু পশ্চাৎপদ পাহাড়ি জাতিদের সাহিত্য হিসেবে এগুলো ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকাল। চুনী লাল দেওয়ান বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ-এর দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন।
তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মধ্যে আধুনিক সাহিত্যের জনক বললেও বোধয় অটুক্তি হবেনা। চুনী লাল দেওয়ানের ‘ঘর দুয়ারত’ শীর্ষক চাকমা কবিতার পরে আমরা ১৯৫৪/৫৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে ডাঃ ভগদত্ত খীসা’র ‘দুরোত ন যেইচ সোরি’ (সরে যেওনা দূরে) শীর্ষক চাকমা কবিতা খানি রচিত হতে দেখতে পাই। এযাবৎকালে প্রাপ্ত রেকর্ডমূলে এ কবিতাটি হচ্ছে চাকমা ভাষায় রচিত দ্বিতীয় আধুনিক কবিতা।
গৈরিকা পত্রিকাটি কখনো নিয়মিত কখনো অনিয়মিতভাবে ১৯৩৬-১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিটি সংখ্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন কোন পাহাড়ি গৈরিকায় লিখেছিলেন। তবে সবচেয়ে বেশি লিখেছিলেন কুমার কোকনদাক্ষ রায়।
নাটিকা ও ছোটগল্প লেখনিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। চাকমা রাজ পরিবারের অন্যতম সদস্য কোকনদাক্ষ রায় হলেন চাকমাদের মধ্যে তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়িদের মধ্যে প্রথম এমএ ডিগ্রী অর্জনকারী ব্যক্তি(১৯৩৭ খ্রি) ।
গৈরিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রায় ১৬ বৎসর পরে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম মাসিক পত্রিকা ‘পার্বত্য বাণী’ বিরাজ মোহন দেওয়ানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর পুনরায় অনেকে সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ পায়।
অনেক পাহাড়ি পার্বত্য বাণীতে প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ছড়া, কবিতা লিখে সাহিত্যানুশীলন করেছিলেন। এছাড়া বিরাজ মোহন দেওয়ান নিজেই ‘সরোজ আর্ট প্রেস’ নামক একটি প্রেস স্থাপন করেন এবং উক্ত প্রেস থেকে পার্বত্য অঞ্চলের অনেকে সংকলন, বই, সাময়িকী ইত্যাদি প্রকাশের সুযোগ লাভ করেন।
এতে অনেকে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে বই, সাময়িকী, সংকলন ছাপার ঝামেলা থেকে রেহাই পায় এবং পার্বত্য অঞ্চলে সাহিত্যানুশীলন বৃদ্ধি পায়।
বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকটিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়িদের সাহিত্য চর্চার জন্য সুবর্ণ দশক বলা যেতে পারে। পাহাড়ি আধুনিক গান ও কবিতা রচনার জন্য এ দশকটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এ দশকের শুরুতে অর্থাৎ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু শিক্ষিত উদীয়মান যুবক ‘জুভাপ্রদ’ (জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর) গঠন করে পাহাড়ি সাহিত্যে নবপ্রাণ সৃষ্টি করেন। এ দশকে পাহাড়ি আধুনিক গান ও কবিতাসমূহ পরিপক্ষতা লাভ করতে সক্ষম হয়।
যদিও আধুনিক কবিতা ৪০-এর দশকে এবং আধুনিক গান ষাট-এর দশকে রচিত হওয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ৪ জন কবির কবিতা রুশ ভাষায় অনুদিত হয়ে যে কাব্যগ্রন্থ রাশিয়া থেকে প্রকাশিত হয় তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের কবি দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা’র ‘কখনো অন্যমনে’ কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এটি নিঃসন্দেহে পাহাড়ি জাতিদের জন্য আনন্দ ও গৌরবের ব্যাপার। সম্ভবত পাহাড়ি সাহিত্যের মধ্যে কোন বিদেশী ভাষায় অনুবাদকৃত প্রথম কবিতা। উক্ত কবিতাটি একই বৎসর ঢাকা কলেজ বার্ষিকীতেও প্রকাশিত হয়েছিল। ‘কখনো অন্যমনে’ কবিতাটি কোন পাহাড়ি লিখিত কবিতার বিদেশী অনুবাদ এটিই প্রথম।
এছাড়া রাঙ্গামাটিতে প্রেস স্থাপনের কারণে সাহিত্যানুরাগীদের জন্য সুবিধা হয়। মোট কথা হচ্ছে বিংশ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়িদের মধ্যে সাহিত্যানুশীলনের ক্ষেত্রে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা’র ‘অন্তর্গত বৃষ্টিপাত’ কাব্যগ্রন্থটি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাংলাভাষায় প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকার একাল প্রকাশনী এ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করে। কোন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থটি হচ্ছে পাহাড়িদের প্রথম বই।
এ কাব্যগ্রন্থে কবির ৪২টি কবিতা ছাপা হয়েছিল। আমরা দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা’র কবিতা ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে বান্দরবান থেকে প্রকাশিত ‘ঝরণা’ সাময়িকীতে প্রথম দেখতে পাই। দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করতেন।
তাঁর স্বপ্ন ছিল পাহাড়ি সাহিত্য একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে । ১৩৭৯ বাংলা সনে তিনি ‘ফুরা মোন’ নামে একটি সংকলন চাকমা ভাষায় বাংলা হরফে প্রকাশ করেন। সংকলনের সব লেখা তাঁর রচিত। সংকলনের সম্পাদকীয় ‘দ্বিয়ান কদা’ শিরোনামে তিনি লিখেন-
“—সাহিত্য সংস্কৃতি এমন এক্কান জিনিষ যিয়ানিয়ে বৈষয়িক উন্নদি আনি দি ন পারে কিন্দু মানসিক উন্নদি আনি দি পারে। ———-আমাত্তুন পুরানি সাহিত্য আগে, কিন্দু সিয়ানির যুগরদাবী পুরণ করিবার খেমতা নেই। আমাত্তুন আধুনিক চাংমা সাহিত্য দরকার। চাকমা সাহিত্য ইক্কু তা জাগাআন সুপ্রতিষ্টিত গরিদ চায়। এজনা, আমা এই প্রচেষ্ঠাত তুমিঅ অংশগ্রহণ গরঅ। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস লেগঅ। তমা খেমতাআনত পানি দ্য, সার দ্য, সিয়ানত্তুন নিশ্চয় ফুল ফুদিব ।”
অর্থাৎ “সাহিত্য সংস্কৃতি এমন একটা জিনিস যেগুলি বৈষয়িক উন্নতি এনে দিতে পারে না কিন্তু মানসিক উন্নতি এনে দিতে পারে । ——– আমাদের পুরনো সাহিত্য আছে কিন্তু সেগুলির যুগের পুরণ করবার ক্ষমতা নেই।
আমাদের আধুনিক সাহিত্য দরকার। চাকমা সাহিত্য এখন তার স্থান সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এসো, আমাদের এই প্রচেষ্ঠায় তোমরাও অংশগ্রহণ করো। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস রচনা কর। তোমাদের ক্ষমতায়( চারা গাছে) পানি দাও, সার দাও, সেগুলো থেকে নিশ্চয় ফুল ফুটবে ।”
আসলে দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা আধুনিক সাহিত্যকে উন্নতি শিখরে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চাকমা আধুনিক সাহিত্যকে কিভাবে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো যায় এ নিয়ে ভাবতেন।
দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা ছিলেন আধুনিক চাকমা কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি বাংলা ও চাকমা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন। ৭০-এর দশকে তাঁর রচিত আধুনিক কবিতা তৎকালীন সাহিত্যানুরাগীদের যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল।
চাকমা সাহিত্যিক সুহৃদ চাকমা তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা’র এ যাবত প্রকাশিত কবিতাগুলোর ভাব ও আঙ্গিক বিশ্লেষণে এ কথা সত্য হিসেবে স্বীকার করে নিতে হয় যে, তিনি রোমান্টিক কবি-প্রচ্ছন্ন পল্লাটোনিক প্রেমাভিসারী কবি ।”
দীপংকর শ্রীজ্ঞানের ‘পাদা রঙ কোচপানা’ নামক একটি ছোট্ট কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে। জুভাপ্রদ এটি প্রকাশ করে।
এতে কবির ৭টি চাকমা কবিতা ছাপা হয়। কবিতাগুলোর বাংলা অনুবাদও দেয়া হয়েছে। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাঁর ‘পাদারঙ কোচপানা’ নামক কবিতাটি। তাঁর রচিত ‘অলর গাচ্চোর পাদা লরের’ (নীরব তরুর পল্লব দোলে) শীর্ষক নামক একটি পান্ডুলিপি অপ্রকাশিত অবস্থায় রয়েছে।
বাংলা অনুবাদঃ
সবুজাভ ভালবাসা
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিজু উৎসব উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রথম সংকলন প্রকাশিত হয় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। সে বৎসর প্রকাশিত ‘লুরা’ সম্পাদনা করেন দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা এবং জুভাপ্রদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিজু’ নামের সংকলনটি সম্পাদনা করেন স.ন. দেওয়ান (সৌমেন্দ্র নারায়ন দেওয়ান) ।
লুরা সংকলনটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এতে বাংলা এবং পাহাড়ি (তারা লিখেছেন মুড়াল্যা) ভাগ নামে দু’টি ভাগ ছিল। পাহাড়ি ভাগের লেখাগুলো শুধুমাত্র পাহাড়ি ভাষায় রচিত ছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যকে আলোচনা করতে গেলে জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর (জুভাপ্রদ) সম্পর্কে অবশ্যই আলোচনা করতে হয়।
আধুনিক পাহাড়ি সাহিত্য সৃষ্টিতে এ সংগঠনের ভূমিকা চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে আছে এবং আগামীতেও থাকবে। এ সংগঠনটি সম্পর্কে কিছু না বললে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার মত ব্যাপার হতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সাহিত্য বিকাশে সংগঠনটির অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। বলতে গেলে এ সংগঠনের সদস্যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আধুনিক পাহাড়ি সাহিত্য সৃষ্টির অভিযাত্রী।
কবিতা, গান, ছড়া, ছোটগল্প ইত্যাদি রচনায় তারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাহাড়ি ভাষায় বর্তমানে যে সাহিত্য আমরা নিভু নিভু অবস্থায় হলেও দেখতে পাই সেগুলোর প্রেরণাদাতা অনেকটা জুভাপ্রদ বললেও বোধয় অটুক্তি হবে না।
তবে বাংলাভাষায় যে সকল আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল তা গৈরিকার মাধ্যমে সূত্রপাত হয়েছিল। মোট কথা যে, জুভাপ্রদের যে অবদান আমরা দেখতে পাই সেটিকে বাদ দিয়ে এখানকার সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আকারে ছোট হলেও এ সংগঠনের ব্যানারে অনেক সাময়িকী এবং বই প্রকাশ করা হয়েছিল।
এ সংগঠনের তৎকালীন সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য জগতকে আলোর দিকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। তাদের গঠনমূলক ভূমিকার কারণে আজ আধুনিক পাহাড়ি সাহিত্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে এবং সাহিত্য নবজাগরণ সৃষ্টি করে। লোক সাহিত্যের খোলস থেকে বেরিয়ে এসে পাহাড়ি আধুনিক সাহিত্য তার স্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
এ সংগঠনের উদ্যোগে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব ‘বিজু’ উপলক্ষে স. ন. দেওয়ানের (সৌমেন্দ্র নারায়ন দেওয়ান)-এর সম্পাদনায় ‘বিজু’ নামে প্রথম সংকলন প্রকাশ করা হয়েছিল।
অবশ্য একই বৎসর অর্থাৎ ১ বৈশাখ ১৩৭৯ বাংলা তারিখে মুড়াল্যা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’র ব্যানারে দীবঙ্গর শিরিগ্যান (দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা)-এর সম্পাদনায় ‘লুরা’ নামে আরো একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।
ইতোপূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এ জাতীয় সংকলন প্রকাশিত হয়নি। ‘বিজু’ এবং ‘লুরা’ সংকলন প্রকাশিত হওয়ার পর সংকলন প্রকাশে দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এবং পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, বিজু উৎসবকে উপলক্ষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অনেক সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে। এ দৃষ্টান্তের জন্য ‘জুভাপ্রদ’ এবং ‘মুড়াল্যা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ ইতিহাস হয়ে থাকবে।
এ কথা সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যের ইতিহাস বা এ বিষয়ে কিছু তথ্য পেতে হলে ছোট ছোট সংকলন বা লিটন ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যেতে হবে। পাহাড়িদের সাহিত্য চর্চাও অনেকখানি সংকলন বা লিটন ম্যাগাজিনকে নির্ভর করে এগিয়েছে যা এখনো যাচ্ছে বলা যায়।
সুতরাং এসকল সাহিত্যেগুলোর মানের দিক বিচার না করে চর্চাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। পাহাড়ি জাতি হিসেবে তাদের বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা করা দুরূহ হলেও এ যাবতকালে যত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তা একেবারে ফেলনা নয়।
রাঙ্গামাটিতে উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা হলে সুগত চাকমাও সেখানে যোগদান করেন এবং তাদের জুভাপ্রদ সংগঠনের অধিকাংশ লোক বিভিন্ন চাকরিতে যোগদান করায় জুভাপ্রদ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। তবে জুভাপ্রদের গড়া ভিত্তি ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাহাড়ি ছাত্ররা সাহিত্য চর্চায় মগ্ন হয়ে পড়ে।
যেমন-জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হয় ‘মুরল্যা লিটারেচার গ্রুপ’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিল্লো লিটারেচার গ্রুপ’ ইত্যাদি। মুরল্যা লিটারেচার গ্রুপ ‘১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘কজলি’ , ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ‘বিজু’ এবং ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ‘BIZU’ নামে সংকলন প্রকাশ করে। অন্যদিকে হিল্লো লিটারেচার গ্রুপ ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ‘সত্রং’, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ‘BIZUFUL’ নামে সংকলন প্রকাশ করে।
এসকল সংকলনে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীরা সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ পায়। বিক্ষিপ্তভাবে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও পাহাড়ি ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্যোগে সংকলন প্রকাশিত হতে থাকে। ফলে আধুনিক সাহিত্যের গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
যারা এসকল কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িয়েছিলেন তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য জগতে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আজ তাঁদেরকেই অনুসরণ করে পাহাড়ি সাহিত্য উত্তরোত্তর এগিয়ে যাচ্ছে।
তাঁদের মধ্যে সুহৃদ চাকমার অনেক অবদান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া পাহাড়ি ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনকারী এ ব্যক্তিকে নিয়ে লালন চাকমা নামে এক প্রবন্ধকার লিখেন “……………….চাকমা সাহিত্যের মারাত্নক অনটন ও অস্বচ্ছলতার মধ্যে সুহৃদ চাকমা একজন ঋণহীন চিত্তবান, যিনি আলোর দিক থেকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন তার সীমান্ত। এক আধা উর্বর মাটিতে তিনি স্বল্পায়ু নিরোগবৃক্ষ ।”
(BIZU FUL, হিল্লো লিটারেচার গ্রুপ। জা.বি. ১৩ এপ্রিল ১৯৮৩) প্রবন্ধকারের সন্দেহ ঠিক ছিল বলে মনে হয়। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট তারিখে তাকে আলোর পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এ সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পাহাড়িদের মধ্যে একজন উদীয়মান সাহিত্যিকের কবর রচিত হয়।
তিনিও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত নাম। বাংলা ও চাকমা উভয় ভাষাতেই তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। বার্গী নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়। এতে কবির ২২টি চাকমা কবিতা ছাপা হয়। কবিতাগুলোর বাংলা অনুবাদও দেয়া হয়েছিল। কবিতা ছাড়াও তিনি ছোটগল্প লিখতেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রথম কবিতাগ্রন্থ ছাপা হয়েছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। এ কৃতিত্বের অধিকারী হলেন সুগত চাকমা। তিনি ননাধন নামেও ব্যাপক পরিচিত। তিনি ঐ বৎসর ননাধন চাকমা নামে ‘রাঙামাত্যা’ নামক কবিতা সংকলন ছাপিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য জগতে তাঁর অবদান অসীম।
তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি সম্পন্ন এ ব্যক্তিটির পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ও বাংলা সাহিত্যে অফুরন্ত অবদান রয়েছে। আজ পথে ঘাটে যে সকল জনপ্রিয় চাকমা গান শুনতে পাওয়া যায় সেগুলোর অধিকাংশ স্রষ্টা হলেন তিনি। তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক পাহাড়ি সাহিত্যের দিকপাল হিসেবেও গণ্য করা যায়।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে জুভাপ্রদ তাঁর দ্বিতীয় কবিতা সংকলন ‘রঙঢঙ’ প্রকাশ করেছিল। সম্ভবত এটিই জুভাপ্রদের শেষ প্রকাশিত বই। দীর্ঘ প্রায় ৭ বৎসর ধরে নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি করে জুভাপ্রদের পথ চলাও ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে এসে থামে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ননাধন চাকমা’র (সুগত চাকমা) ‘রাঙামাত্যা’ ও ‘রঙঢঙ’ কে আকারে ছোট হওয়ায় ঠিক কাব্যগ্রন্থও বলা যায় না।
তবে এগুলো যে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্যকে অনুপ্রাণিত করেছিল তা নির্ধিদায় স্বীকার করে নিতে হবে। কারণ এ গ্রন্থগুলো প্রকাশের পূর্বে এ ধরনের বই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়নি। রাঙামাত্যা কবিতা গ্রন্থে মুদ্রিত ১২টি কবিতা-ই চাকমা কবিতা। অপরদিকে রঙঢঙ গ্রন্থে ২৩টি ছোট-বড় চাকমা কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল।
এ গ্রন্থে ‘ধনপুদি-ধনপাদা’ শীর্ষক কবিতায় কবি নিজেকে রোমান্টিকতায় উজাড় করে দিয়েছেন। কল্পনার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী ‘ঘিলা খেলা’য় পিনন পরা একজন চাকমা সুন্দরী যুবতীকে অবলোকন করেছেন এভাবে-
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, লোকসাহিত্যের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে পাহাড়ি আধুনিক সাহিত্যকে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছিল। ষাট দশকে যখন পাহাড়িদের মধ্যে আধুনিক সাহিত্যের বিকাশ পুরোদমে শুরু হয় তখন পাহাড়ি সমাজ সেগুলোকে সহজে গ্রহণ করতে চায়নি।
বিশিষ্ট কবি, গীতিকার ও প্রবন্ধকার সলিল রায় আধুনিক গান লিখে কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ বিষয়ে তিনি লিখেছেন, “অধুনা বেতার শিল্পী শ্রী সুরেন ত্রিপুরার নিজস্ব সুর যোজনায় যখন রাঙ্গামাটি কলা পরিষদের অনুষ্ঠানে আমার এ ধরনের ক’টি গান প্রথম গীত হলে যেদিন সুধী মহলের তরফ হতে স্বরূপ এবং বিরূপ উভয় সমালোচনাই আমাকে শুনতে হয়েছে।
বিপক্ষ দলের যুক্তি ছিল এই-চাকমা সমাজে প্রচলিত উবাগীতের ঐতিহ্যকে আমি নষ্ট করতে চলেছি ।” এটি শুধু চাকমা সমাজের বেলায় ছিল তা নয়। কিন্তু যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক পাহাড়ি সাহিত্য বিকাশ হতে থাকে এবং তার স্থান দখল করতে সক্ষম হয়।
বর্তমানে লোকসাহিত্যের অন্যতম অঙ্গ পাহাড়ি লোকসঙ্গীতগুলো আজ লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে। লুপ্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি যদিও সুখকর নয়। পাহাড়িদের মধ্যে এ লোকসাহিত্য চর্চাকারী এখন শুধুমাত্র গেংখুলি নামক চারণ কবিগণ।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে চাকমা রাজবাড়ী। একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে, রাজপরিবারের সদস্যগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বিশেষত গৈরিকা প্রকাশের মাধ্যমে তাঁদের সাহিত্য চর্চার পথ উন্মোচিত হয়েছিল। অরুণ রায়, সলিল রায়, কোকনদাক্ষ রায়, বিনীতা রায় প্রমুখরা পার্বত্য চট্টগ্রামে সাহিত্যের জগতে এক অনন্য নাম। তবে তাঁদের মধ্যে কোকনদাক্ষ রায় ছিলেন অন্য ধরনের সাহিত্যিক। তিনিই সম্ভবত পাহাড়িদের মধ্যে প্রথম ছোটগল্প লেখক।
তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোটগল্পের জনক বলা যেতে পারে। তবে তিনি বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন। তাঁর অনেক ছোটগল্প ও নাটিকা গৈরিকা ও মাসিক পার্বত্য বাণী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। রাজপরিবারের অন্যতম সদস্য অরুণ রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে কবি খ্যাতি পাওয়া একমাত্র কবি।
তাঁর নামে বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। কিন্তু জীবিত কালীন সময়ে তাঁর কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ‘ঝরাপাতা’ নামে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ পরিবারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল।
এটি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থে কবির ৫২টি কবিতা ও ১টি দীর্ঘ গীতিকাব্য ছাপা হয়। কবি অরুণ রায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন। কবি তাঁর ‘হে নূতন জাগো’ কবিতায় লিখেছেন-
আধুনিক পাহাড়ি সাহিত্য তার নিজস্ব স্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও এখনো পরিপূর্ণতা লাভ করেনি এ কথা নির্ধিদায় বলা যায়। এজন্য এ নিয়ে তেমন কোন আলোচনাও হয়ে ওঠে না। মোট কথা যে, আধুনিক সঙ্গীত ব্যতিত বিশেষ কোন সাহিত্য যেমন-কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি জাতীয় কোন সাহিত্য প্রশংসা পায়নি।
তবে পাহাড়িদের মধ্যে ৭০-এর দশকে রচিত ফেলাজেয়্যা চাকমা’র ‘জুম্মবী পরানী মর’ কবিতাটি পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি সাহিত্যিকদের বেশ নজর লাড়ে। বলা হয় যে, এ কবিতাটি এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় জুভাপ্রদের ‘বার্গী’ সংকলনে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে।
সুগত চাকমা ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন “মূল কবিতায় প্রায় ৭০টি লাইন ছিল। কিন্তু এটির প্রথম প্রকাশে অর্থাভাবে মাত্র ৩৫টি লাইন প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীকালে প্রকাশের জন্য বাকী ৩৫টি লাইন আর খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং মূল রচনা পত্রটি হারিয়ে যাওয়ায় কবির পক্ষেও নূতন করে বাকী লাইনগুলি রচনা করা সম্ভব হয়নি।
তা’ সত্ত্বেও প্রথম প্রকাশিত ৩৫টি লাইনের কবিতাটিকে খণ্ডিত না বলে স্বয়ং সম্পূর্ণই বলা যায় ।” সুগত চাকমা এ কবিতটিকে ইংরেজি বিষাদময় গীতিকবিতা ‘ওড’ (Ode) –এর আঙ্গিকে লেখা বলে উল্লেখ করেছেন। মূলত এ কবিতায় পাহাড়িদের জুমিয়া জীবনের ব্যথা, বেদনা, হাসি-কানা, বিরহ প্রকাশ পেয়েছে। যেমন-
ফেলাজেয়্যা চাকমা’র ‘জুম্মবী পরানী মর’ কবিতাটির ন্যায় কবিতা চাকমা’র ‘জ্বলি ন উধিম কিত্তেই’ (রুখে দাঁড়াব না কেন !) কবিতাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। কবিতাটি প্রতিবাদী কবিতা। কবিতা চাকমা’র ‘জ্বলি ন উধিম কিত্তেই’ নামক একটি চাকমা কাব্যগ্রন্থও ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নীরবে যে ব্যক্তিটি সাহিত্য চর্চায় নিজেকে নিমজ্জিত করে রেখেছেন তিনি হলেন মৃত্তিকা চাকমা। তিনি মূলত চাকমা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। ইতোমধ্যে তাঁর ৩টি কাব্যগ্রন্থ ছাপা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ‘মন পরানী’(২০০২খ্রিঃ), ‘দিকবন সেরেত্তুন’(১৯৯৫খ্রিঃ), এবং ‘এখনো পাহাড় কাঁদে’(২০০২ খ্রিঃ) ।
শেষোক্ত কাব্যগ্রন্থটি ছাড়া অপর দু’টি চাকমা ভাষায় রচিত। চাকমা ভাষাকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি তাঁর প্রায় সব কবিতা এবং অন্যান্য রচনাবলী চাকমা ভাষাতেই করে থাকেন। এটি তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মৃত্তিকা চাকমা নাট্যকার হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। ইতোমধ্যে তাঁর রচিত ১১টি চাকমা নাটক ঢাকা, রাংগামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় মঞ্চস্থ হয়েছে। এসবের মধ্যে ‘এক জুর মান্নেক’ ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে এবং ‘গোজেন’১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে পুস্তকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
তাঁর রচিত অন্যতম একটি নাটক ‘দেবংসি আহ্দর কালা ছাবা’ ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে সিডিতে প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত তিনিই একমাত্র ভাগ্যবান ব্যক্তি যার রচিত এতগুলো নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
আমরা পাহাড়িদের মধ্যে গান, কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প লেখার চর্চা হরহামেশা দেখলেও এখনো উপন্যাস লেখার প্রবণতা দেখি না। বিংশ শতাব্দীতে রাণী বিনীতা রায়ের রচিত ‘অকূলে’ নামক একটি উপন্যাস গৈরিকা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।সম্ভবত তিনিই প্রথম উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন।
পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, পাহাড়িদের মধ্যে নিজস্ব মাতৃভাষা ও বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা হয়ে থাকে। বর্তমানে নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মাতৃভাষাতে রচিত গান, কবিতা, ছড়া জনপ্রিয়তা হচ্ছে।
অনেক সময় ভিন জাতীয় কোন লোককেও পাহাড়ি গান, কবিতা চর্চা করতে দেখা যায়। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে এ দেশের বরেণ্য শিল্পী মাহমুদুন্নবী নেপালে চিত্র মোহন চাকমা রচিত ‘আয় তুঙুবি ম লঘে কাঙারা ধরা যেই, ছড়া পারত জুম লেঝাত লুরা লবং ধরেই’ (আয় তুঙুবি আমার সাথে কাঁকড়া ধরতে যাই, ছড়া পাড়ে জুমের পাদদেশে আগুনের শিখা নেবো জ্বালাই) শীর্ষক চাকমা গানটি গেয়েছিলেন।
বলা যায়, পাহাড়িদের ভাষার ব্যবহার প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে কম্পিউটারে নিজস্ব বর্ণের সফ্টওয়্যার তৈরি হওয়ায় সাহিত্যানুশীলনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষাসমূহ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকেও মুক্তি থাকছে। এক্ষেত্রে একুশে ফেব্রুয়ারি মন্ত্রদাতার ভূমিকা পালন করছে বলে আমার মনে হয়।
বিংশ শতাব্দীর বহু পূর্ব থেকে পাহাড়িদের মধ্যে সাহিত্য চর্চা হয়ে আসছিল। কিন্তু সাধক শিব চরণ রচিত ‘গোজেন লামা’ ছাড়া ঐ সকল সাহিত্য কর্ম ছাপার অক্ষরে কোনদিনও আলোর মুখ দেখেনি। যারা সাহিত্য চর্চায় নিমজ্জিত ছিলেন তাদের রচনা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে চাকমাদের মধ্যে শুধু নয়, পাহাড়িদের মধ্যে যারা তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন বারমাসী রচনা করেছিলেন সেগুলো লোক মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল।
যার কারণে মৌলিক রচনা থেকে বারমাসীগুলোর ভাষা ও শব্দে অনেক পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে পাহাড়িদের মধ্যে নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হতে থাকে এবং এগুলো ছাপার অক্ষরে ছাপা হতে আরম্ভ করে। মোট কথা যে, বিংশ শতাব্দীতে পাহাড়ি সাহিত্য তার একটি মজবুত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।
এসকল সাহিত্য কর্মের মান হয়তো এখনো বিচারযোগ্যতায় নিজেকে তৈরি করতে পারেনি কিন্তু পিছিয়ে পড়া একটি জাতির জন্য এগুলো নিঃসন্দেহে বড় সম্পদ। এদিক বিবেচনা করলে পাহাড়িদের সাহিত্য কর্মগুলোর মান কোন অংশে কম নয়। এছাড়া প্রচার না হওয়ার কারণে এগুলো আলোচনার বাইরে ছিল। ফলে অধিকাংশ মানুষ পাহাড়িদের সাহিত্য কর্ম আছে বলে অবহিত নয়।
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক বিপ্রদাশ বড়ুয়া লিখেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো সংকলিত প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই ।ফলে এই অঞ্চলের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো ধারণা বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি।”
বিপ্রদাশ বড়ুয়ার বক্তব্য আংশিক সত্য বলে মেনে নেয়া যায়। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে এযাবৎকালে প্রচুর সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সংকলন ছাড়াও বিশেষভাবে গান, ছড়া ও কবিতার সংকলন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
যেমন-জুভাপ্রদ কর্তৃক ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সাইক্লোস্টাইল করা রঞ্জিত দেওয়ান ও ঝর্ণা চাকমা সম্পাদিত ১৬ পৃষ্ঠার গানের সংকলন ‘চাকমা গান’ , ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘রাঞ্জুনী’, ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে সুহৃদ চাকমা সম্পাদিত গানের সংকলন ‘ছদক’ , ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুগত চাকমা সম্পাদিত চাকমা গানের সংকলন ‘হাওঝর চাঙমা গান’ ও সুহৃদ চাকমা সম্পাদিত চাকমা কবিতা সংকলন ‘গেংখুলী’,
সুগত চাকমা সম্পাদিত চাকমা গানের সংকলন ‘চাকমা গান’ ‘চিজির গান’ ও ‘রঙ্গীদ’, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে সুগত চাকমা ও দেবী প্রসাদ দেওয়ান সম্পাদিত চাকমা গানের সংকলন ‘চাঙমা গান’, ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে সুগত চাকমা সম্পাদিত চাকমা কবিতা সংকলন ‘রংধং’ , ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী প্রকাশিত বিনয় শংকর চাকমা সম্পাদিত পাহাড়ি গানের বই ‘শিঙা’, ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে উন্মাদ শিল্পী গোষ্ঠী প্রকাশিত মানস মুকুর চাকমা সম্পাদিত চাকমা ছড়ার সংকলন ‘চাঙমা ছড়া’,
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘রিপরিপ’, ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত রাজা দেবাশীষ রায় ও রূপায়ন দেওয়ান সম্পাদিত চাকমা গানের সংকলন ‘হুয়াং ছেরে চাকমা গীত’, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সুসময় চাকমা সম্পাদিত মুড়াল্যা লিটারেচার গ্রুপ প্রকাশিত কবিতা সংকলন ‘রেঙ’, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাঙামাটি ঈসথেটিক্স কাউন্সিল প্রকাশিত বীর কুমার চাকমা সম্পাদিত চাকমা কবিতা সংকলন ‘পাত্তলী’, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে জুম ঈসথেটিক্স কাউন্সিল প্রকাশিত চাকমা ছড়া বিষয়ক সংকলন ‘কজ ফুল’,
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত চাকমা কবিতা সংকলন ‘কজমা পাদা’, ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তরুণ কুমার চাকমা রচিত চাকমা গানের বই ‘বাজী র’ ইত্যাদি গান, ছড়া ও কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।কিন্তু প্রচার না থাকায় সেগুলো বাংলাভাষী পাঠকদের সকাশে পৌঁছেনি।
এমনটি পাহাড়িদের মধ্যেও এসকল সংকলনগুলোর কথা কতজন বা অবগত আছেন। আমি মনে করি পাহাড়িদের সাহিত্য কর্মকে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। এতে করে বাংলাভাষীসহ অন্যান্য ভাষার পাঠকদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়বে। ফলে এগুলো আলোচনায় উঠে আসবে এবং তাতে প্রতিনিয়ত মানের দিকে অগ্রসর হবে এমনকি ভুল-ভ্রান্তি শোধরানোরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের সাহিত্য কর্মকে ২টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-১। পাহাড়িদের নিজস্ব মাতৃভাষায় সাহিত্য চর্চা এবং ২। বাংলাভাষায় সাহিত্য চর্চা। আমরা দেখেছি বিংশ শতাব্দীতে উপরোক্ত দু’টি ভাগে পাহাড়িদের সাহিত্য কর্মগুলো সৃষ্টি হয়েছে।
সংখ্যা বিচারে হয়তো বা বাংলাভাষায় সাহিত্য কর্মের সংখ্যার পরিমাণ বেশি হবে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিগত দু’শত বৎসরেও অধিক সময় ধরে বাংলা চর্চা হয়ে আসছিল। ফলে সুদীর্ঘকাল নৈকট্যের কারণে পাহাড়িরা সহজে বাংলাভাষাকে আয়ত্ত করে থাকে।
নিজেদের মধ্যে নিজস্ব ভাষা প্রয়োগ করলেও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে পূর্বে চাকমা ও মারমা হরফের পাশাপাশি বাংলা হরফও পাহাড়িরা ব্যবহার করতো। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা গেছে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাংলাভাষার বিপরীতে চাকমা হরফকে ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু তৎকালে চাকমা হরফের মুদ্রণ যন্ত্র না থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চাকমা হরফে কোন পুস্তক প্রকাশিত হয়নি। হরফ তৈরি করে পুস্তক ছাপানো শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পাহাড়ি জাতির জন্য ছিল কল্পনা প্রসূত ব্যাপার। যার কারণে আমরা বিংশ শতাব্দীর পূর্বে নিজস্ব হরফে কোন মুদ্রিত বই দেখতে পাইনা।
কিন্তু অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে থাকা বৃটিশদের পক্ষে উল্লেখিত সমস্যাটি ছিল একেবারে নগন্য। যার কারণে তারা ভারতের এলাহাবাদ থেকে চাকমাদেরকে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার উদ্দেশ্যে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে চাকমা হরফে চাকমা ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিল।
সাহিত্যের প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা। ভাষা না থাকলে সাহিত্য কল্পনা করা যায় না। আর সাহিত্য প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সংবাদপত্র কিংবা মুদ্রিত বই, সংকলন ইত্যাদি। এসন না থাকলে যতই সাহিত্য কর্ম মনের মধ্যে প্রস্ফুটিত হোক না কেন তা প্রকাশ করা না গেলে সাহিত্যে রূপান্তরিত হয় না।
পাহাড়িদের ক্ষেত্রে এটি অন্যতম সত্য একটি ব্যাপার। দেখা গেছে অতীতে অনেক সাহিত্যপ্রাণ ব্যক্তি তার মনের খোড়াক মেটানোর জন্য নীরবে ঘরে বসে সাহিত্য চর্চা করেছিলেন। পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা ভরে কবিতা, গান, ছড়া, ছোটগল্প এবং নানা ধরনের বারমাসী রচনা করেছিলেন।
কিন্তু এগুলো রচনাকারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল অতিশয় দুর্গম থাকা, আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল না থাকা সর্বোপরি সচেতনতা না থাকায় ঢাকা কিংবা কলকাতায় গিয়ে বই মুদ্রণ করে নিয়ে আসা পাহাড়িদের জন্য ছিল দুষ্কর। এছাড়া পাঠক সংকট তো ছিলই।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ অনেক পরিমাণে দূরীভুত হওয়ায় আমরা মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন লেখকের রচিত ও মুদ্রত বই দেখতে পাই। এজন্য আলোচ্য প্রবন্ধে বিংশ শতাব্দীকে পাহাড়ি সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে নবজাগরণ বলা হয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
বাংলা
১। চাকমা জাতি, সতীশ চন্দ্র ঘোষ, কলকাতা, ১৯০৯ খ্রিঃ ।
২। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যিক, নন্দ লাল শর্মা, ১৯৮৩ খ্রিঃ।
৩। চম্পকনগর সন্ধানেঃ বিবর্তনের ধারায় চাকমা জাতি,সুপ্রিয় তালুকদার,উ.সা.ই. রাঙ্গামাটি,১৯৯৯ খ্রিঃ।
৪। বাংলাদেশের চাকমা ভাষা ও সাহিত্য, সুগত চাকমা,উ.সা.ই. রাঙ্গামাটি, ২০০২ খ্রিঃ।
৫। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি,সম্পাদক-বিপ্রদাশ বড়ুয়া, দিব্য প্রকাশ, ঢাকা,২০০৩ খ্রিঃ ।
৬। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিংশ শতাব্দীর নির্বাচিত কবিতা, উ.সা.ই. রাঙ্গামাটি ২০০৮ খ্রিঃ ।
ইংরেজি
- Chittagong Hill Tracts by R.H. Sneyd Hutchinson, 1909. (Reprint 1978,India)
- Bengal District Gazetteer,B. Volume, Chittagong Hill Tracts District, 1933, Calcutta.
সংকলন
১। BIZU, EDITOR-SUSAMOY CHAKMA,MURALLYA LITERATURE GROUP, JAHANGIRNAGAR UNIVERSITY, 13 APRIL 1981.
২। ইরুক, বিজু সংকলন ১৩৮৯, দীপেন দেওয়ান ও কৃষ্ণ চাকমা সম্পাদিত, রাঙ্গামাটি ঈসথেটিক্স কাউন্সিল।
প্রবন্ধ
১। চাকমা রাজপরিবারে লেখনি চর্চা, শুভ্র জ্যোতি চাকমা, স্থানীয় ইতিহাস, সম্পাদক ড. মোঃ আবুল কাশেম, হেরিটেজ আর্কাইভস অব বাংলাদেশ হিসট্রি ট্রাস্ট, রাজশাহী, ২০০৮ খ্রিঃ ।
২। সমকালীন চাকমা কবিতার রূপরেখা, বিজু, সম্পাদক-সুসময় চাকমা, মুরল্যা লিটারেচার গ্রুপ, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮১ খ্রিঃ ।
৩। দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমার চাকমা কবিতা ঃ ভাব ও আঙ্গিক বিশ্লেষণ , সুহৃদ চাকমা, ইরুক, সম্পাদক-দীপেন দেওয়ান ও কৃষ্ণ চাকমা, রাঙ্গামাটি ঈসথেটিক্স কাউন্সিল, ১৩৭৯ বাংলা ।
৪। কবিতা সমালোচনা (জুম্মবী পরাণী মর), সুগত চাকমা (ননাধন), জুম প্রকাশনা, সম্পাদক-অনুপম চাকমা, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৩ খ্রিঃ ।
৫। চাকমা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, নন্দ লাল শর্মা, গিরিনির্ঝর, জুন সংখ্যা, উ.সা.ই. রাঙ্গামাটি, ১৯৮৮ খ্রিঃ ।
লেখকঃ শুভ্র জ্যোতি চাকমা, রিসার্চ অফিসার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।