সদ্য পিএইচডি করা প্রজ্ঞাতেজ চাকমার সাথে জুমজার্নালের সাক্ষাৎকার
2500
জুম পাহাড়ের কৃতি সন্তান প্রজ্ঞাতেজ চাকমা ২০১৫ সালে পিএইচডির জন্য পাড়ি জমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মায়ামি শহরের ইউনিভার্সিটি অফ মায়ামি – তে। সম্প্রতি তিনি তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। অত্যন্ত দক্ষ একজন গবেষকের স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন ‘Dissertation Scholar’ 2019 Award, Dept. of Chemistry and Biochemistry, Miami University। তাঁর প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা মোট ১১টি। বর্তমানে, পোস্ট ডক্টরাল ফেলো (Post Doctoral Fellow) হিসেবে বিশ্বখ্যাত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে (Washington University) গবেষণারত। তাঁর সাথে আলাপকালে জানিয়েছেন সংগ্রাম ও পরিশ্রমের দিনগুলোর কথা।
অনলাইনে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী পার্বন চাকমা।
প্রথমেই, জুমজার্নালের (Jumjournal) পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি মার্কিন মুলুকের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অফ মায়ামি (University Of Miami) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য।
তাহলে চলুন, আজকের সাক্ষাৎকার ও আলোচনা শুরু যাক।
পার্বন: প্রথমেই, আপনার ছোটবেলার বেড়ে উঠার গল্প বলুন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম পাহাড়ে শৈশব আপনার কেমন কেটেছে?
ড. প্রজ্ঞাতেজ: আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে, আর কিছু অংশ বাংলাদেশের পানছড়ি উপজেলার মনজু আদামে।
আমার পুরো ছোটবেলায় প্রকৃতির সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা। চেংগী নদীতে সাঁতার কেটে, মাছ ধরে। আমার শৈশবকালে আমাদের গ্রামের আশেপাশে অনেক জঙ্গল ছিলো।
এখন অবশ্য সব সবুজ চলে গিয়ে মানুষের ঘন বসতিতে পরিণত হয়েছে। আমি যে শৈশব পেয়েছি তা নির্মল আনন্দের ছিলো।
সেখানে ভিডিও গেম ছিলোনা, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো, দুষ্টামি করা ছিলো। আমি এ শৈশবের জন্য কৃতজ্ঞ।
পার্বন: আজকের ড.প্রজ্ঞাতেজ চাকমা হয়ে উঠার পেছনে কাদের ভূমিকা ও অবদান বেশি বলে মনে হয় আপনার কাছে?
ড. প্রজ্ঞাতেজ: সর্বোচ্চ অবদান অবশ্যই আমার মায়ের। আমার মা নিজের সবকিছু নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য উৎসর্গ করেছেন। আমার এতদূর আসার পেছনে তাই আমার মায়ের অবদানই সর্বোচ্চ।
পার্বন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি অনার্স সম্পন্ন করে উচ্চ শিক্ষার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালেন।মার্কিনি শিক্ষা ব্যবস্হা ও বাংলাদেশীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঝে মূল কোন পার্থক্য আপনি দেখেছেন কি?
ড. প্রজ্ঞাতেজ: একটি উন্নত রাষ্ট্র আর উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যাবস্থার মাঝে অনেক পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। পার্থক্য অনেক দিক দিয়েই। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক অনেকটা বন্ধুর মতো।
তার মানে এ নয় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সম্মান করেনা। আমাদের দেশে শিক্ষকদের প্রতি আমাদের একধরনের ভয় কাজ করে। এজন্য হয়তো এক ধরনের গ্যাপ থেকে যায়। তবে এটার পজিটিভ দিকও অবশ্য রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উন্নত রাষ্ট্র হওয়ায় এখানে রিসার্সের জন্য অনেক ফান্ডিং রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ননর্যাংকড বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চের জন্য যে পরিমান বাজেট থাকে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাবি, বুয়েট-এ রিসার্চের জন্য বাজেট তার ধারে কাছেও থাকেনা।
আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কোচিং ও প্রাইভেট কেন্দ্রিক, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কোচিং/প্রাইভেট তেমন প্রচলিত নয়। আমাদের শিক্ষ্যাব্যবস্থায় থিওরি (theory) বেশী প্রাধান্য পায়, এখানে থিওরি আর প্র্যাকটিকাল দুটোই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
পার্বন: প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে কেউ না কেউ রোল মডেল, আপনার জীবনেও এমন কোন রোল মডেল বা আদর্শ ব্যক্তিত্ব আছেন কি?
ড. প্রজ্ঞাতেজ: আমার নির্দিষ্ট একজন রোল মডেল নেই। তবে আমি অনেকের দ্বারা অনুপ্রাণিত।
আমাদের পাহাড়ি সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মধ্যে অন্যতম ড মংসানু মারমা যেমন অনুপ্রেরণার, ঠিক তেমনি সৎ উপায়ে বেঁচে থাকা একজন জুমিয়াও আমাকে অনুপ্রাণিত করে।
তবে বিজ্ঞানীদের মাঝে কার্ল স্যাগান, ডেভিড এট্যানবার্গ এবং ব্রায়ান কক্স আমার প্রিয় ব্যাক্তিত্ব।
পার্বন: আপনার গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে যদি কিছু বলতেন।
ড. প্রজ্ঞাতেজ: আমার পিএইচডি এর মূল রিসার্চ হচ্ছে পলিমারিক ম্যাটেরিয়াল নিয়ে।
পাঁচ বছরে আমার গবেষণা ছিল, ডাইনামিক (dynamic) ম্যাটেরিয়াল ডেভলপ (develop) করা। এই ম্যাটেরিয়ালগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে এগুলো সেলফ হিলিং আর রিসাইক্ল্যাবল (self-healing, recyclable)।
মূলত আমরা চেষ্টা করেছি অর্গানিক (organic) কেমিস্ট্রির কিছু বিশেষ রিয়েকশনকে (reaction) পলিমারিক ম্যাটেরিয়ালে ব্যাবহার করে নতুন ম্যাটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসা।
পার্বন: পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য আগ্রহী কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেন এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য আপনার মূল্যবান পরামর্শ এবং গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের কাছে আপনার উপদেশ কী?
ড. প্রজ্ঞাতেজ: আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে আসা আসলেই খুব কঠিন। তবে এটি অসম্ভব নয়।
সম্প্রতি অনেক আদিবাসী শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র,অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। এটি খুবই আনন্দের খবর।
আমার পরামর্শ থাকবে স্কুল-কলেজ থেকেই ইংরেজি ভাষা চর্চাটা করা। এখন এই ডিজিটাল যুগে রিসোর্চের কোন অভাব নেই। শুধুমাত্র ইউটিউবেই ইংরেজী, বিজ্ঞান, গণিতের জন্য ফ্রি কোর্স রয়েছে।
এসব সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। উচ্চ শিক্ষার জন্য সিনিয়র যারা ইতোমধ্যে বাইরে পড়তে আসছে তাদের কাছে থেকে পরামর্শ আর দিক নির্দেশনা নিতে হবে। আমাদের লক্ষ্য আর স্বপ্নগুলোকে বড় করতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি – এর জন্য প্রতি বছর ৮ হাজারের মতো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পিএইচডি করতে আসে।
বাঙালি শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ নিতে পারলে, আমরাও পারবো। শুধুমাত্র সদিচ্ছা, সঠিক দিকনির্দেশনা আর একটু পরিশ্রমের প্রয়োজন।
পার্বন: বিশ্বখ্যাত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আপনি পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে গবেষণারত এরপর আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
ড. প্রজ্ঞাতেজ: পোস্ট ডক (post doc) – এর পর আমার ইচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি (faculty) হিসেবে জয়েন করা।
তবে ইন্ডাস্ট্রিতে সায়েন্টিস্ট (scientist) হিসেবে জয়েন করারও সুযোগ রয়েছে। সবকিছু নির্ভর করবে কোন পজিশনে গেলে আমার রিসার্চের বেশী সুযোগ-সুবিধা থাকবে তার উপর।
পার্বন: অসংখ্য ধন্যবাদ,আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় দেওয়ার জন্য। কোভিড-১৯ এর এই দুঃসময়ে আপনার সুস্থতা আমরা কামনা করছি। ভালো থাকবেন, সুস্হ থাকবেন।
ড. প্রজ্ঞাতেজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
আরও কিছু লেখা
Leave a Reply
Dr.Ratan B.Chakma PhD
That’s statement is very important for new generations in whole Jumland or CHT.Thanks.