প্রজ্ঞানন্দ মহাথের একটি আলোকিত নাম
1336
সারা বিশ্বের সত্তরের অধিক দেশে প্রায় ৩০ কোটি আদিবাসী বাস- যাদের নিবস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম বেশ বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ।
কিন্তু বিশ্বজুড়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের মনোভঙ্গি এবং শিল্প কারখানার প্রসারে বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে অনেক দেশের আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষিপদ্ধতি ত্রমাগত বিপন্ন ও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রক্ষার অঙ্গীকার নিয়ে১৯৯৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ”বিশ্ব আদিবাসী দিবস” পালন করতে শুরু করে।
১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ১৮৫টি সদস্য রাষ্ট্র ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত আদিবাসীদের পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নিশ্চয়তার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ”বিশ্ব আদিবাসী দশক” ঘোষণা করে- যার শ্লোগান হচ্ছে- “আদিবাসী জনগণ; কর্মজীবনের সঙ্গী”।
বিশ্ব আদিবাসী দশকে আদিবাসীদের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়ে ’ইউনেস্কো’ (UNESCO), স্বস্থ্যের জন্য ‘হু’ (WHO) এবং পরিবেশ- কষি সচেতনতার জন্য ‘ফাও’ (FAO) সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
জাতিসংঘের সাধারণ সভার ঘোষণা অনুযায়ী যারা বংশ পরম্পরায় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নিজস্ব ভাষা, বর্ণ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করছে তারা-ই আদিবাসী। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, কেনিয়া, থাইল্যান্ড, চিলি এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসীদের বাস সর্বাধিক।
বাংলাদেশের সমতল পাহাড় ও সমুদ্র উপকূল অঞ্চল জুড়ে চাকমা, সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশী, খাশিয়া, পাঙন, মনিপুরি, গারো, হাজং, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, কুকি, লুসাই, ম্রো, চাক, খুমি, ত্রিপুরা, পাঙ্খো, বোম, রিয়াং, রাখাইন, মিলে ত্রিশের অধিক আদিবাসী জাতিসত্তার বাস।
এসব আদিবাসী জাতিসত্তার মধ্যে রয়েছে বহু বিচিত্র জীবনাচার, ভাষা, কৃষি- পদ্ধতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাস। কিন্তু তাঁরা বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যালঘুর মধ্যেও সংখ্যালঘু। আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক অবস্থানে তাঁরা গরিবের মধ্যে আরো গরিব।
তবু তাদের নিজস্ব জাতিসত্তার আলো মৃদু মন্দ প্রদীপ শিখার মতো সমতলে, সমতলে, সমুদ্র উপকূলে কিংবা পাহাড়ের গায়ে গায়ে জ্বলছে।
তাদের মধ্যে অনেকেই এই আলোক শিখাকে বাঁচিয়ে রাখার, তাকে উজ্জ্বলতর করে তোলার সাধনায় নিবেদিত। তেমনি এক আলোকিত আদিবাসী, সংসার ত্যাগী সর্বজন শ্রদ্ধেয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো।
প্রজ্ঞানন্দ মহাথের ভান্তের পরিচিতিঃ
বাংলাদেশের যে কয়েকজন খ্যাতনামা মনীষী ত্যাগদীপ্ত কর্মে, মনস্বীতায়, উজ্জ্বল আদর্শে মহান আদর্শে ব্যক্তিত্ব মহিমায় স্বদেশে এবং বিদেশে অত্যন্ত সুপরিচিত, তাঁদের অন্যতম মাননীয় গ্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো।
তাঁর পরিচয়ের সীমারেখা পাহাড়ী-বাঙ্গালী বৌদ্ধ সমাজের গণ্ডী ছাড়িয়ে সারাদেশে আজ জাতীয় মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। এ প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে রয়েছে তাঁর সুদীর্ঘ কয়েক দশকের নিরলস সাধনা, ঐকান্তিক কর্মনিষ্ঠা এবং মহতী শুভৈষনা।
তাই তিনি আজ জ্যোতির্ময় প্রজ্ঞানন্দ। তাঁর জীবন তাই কর্মের ও প্রজ্ঞার জ্যোতিতে যুগপৎ ভাস্বর ও দেদীপ্যমান।
জীবনকে তুচ্ছ করে, মরণকে ভৃত্য জেনে, ব্যক্তিগত সুখ পরিহারপূর্বক ব্যক্তিত্ব এবং অপরাজেয় মনোবল নিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দেশ ও সমাজের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত মহাপ্রাণের অধিকারীরূপে যাঁরা বিশ্বভূবনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন তাঁদের মাঝে মাননীয় প্রজ্ঞানন্দ অন্যতম।
প্রজ্ঞানন্দ একটি নাম, একটি পরিচয়। সমগ্র জাতিসত্তার অফুরন্ত প্রেরণা, চলার পথে অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ সৃষ্টিকারী এক অজেয় উন্মাদনা।
আজ হতে প্রায় আটান্ন বৎসর পূর্বে ১৯৪৭ খৃস্টাব্দে নীলাভ জলরাশির অধিকারিণী মাইনী নদীর তীর ঘেঁষা পার্বত্যের সবুজ-শ্যামল বনরাজি ঘেরা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা থানাধীন বাবুছড়া গ্রামে এক নিম্নমধ্যবিত্ত চাকমা পরিবারে জন্মগ্রহণ করে একটি ফুটফুটে সন্তান- যাঁর গৃহী নাম বলেন্দ্র দেব চাক্মা।
তাঁর পুণ্যবান পিতার নাম প্রয়াত শ্রদ্ধেয় নরেন্দ্র লাল চাক্মা এবং পুণ্যশীলা জননীর নাম প্রয়াত ইন্দ্রপতি চাক্মা। সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা সবুজ মাঠ ঘেরা এই গ্রাম। মাঠে মাঠে সুফলা পাকাধানের স্বনন, কেবলি, গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গো-মহিষ, ক্ষেতভরা ফসল।
গ্রামবাসী সবাই ছিল প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিক ও বেশ সচ্ছল গৃহস্থ। কিন্তু বলেন্দ্র চাক্মার বাবা এত বিত্তশালী ছিলেন না। বলেন্দ্র চাক্মা অতি শৈশবে পিতৃহারা হন। তিনি ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ।
পুণ্যশীলা মায়ের কোলে শিশু বলেন্দ্র শুক্লপক্ষের চন্দ্রিমার মত দিন দিন বড় হতে লাগলেন। চাক্মা সমাজের গোজাগত পরিচয়মতে তিনি হলেন গোজা মুলিমা গোত্র পরিবারের সন্তান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের লীলা নিকেতন গ্রামের পরিবেশে কাটে তাঁর শৈশব কাল। ক্রমান্বয়ে শৈশব থেকে কৈশোর পদার্পণ পর্যন্ত বালক বলেন্দ্রকে তাঁর বড় ভাই বাবু আনন্দ মোহন চাক্মা পিতৃস্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন।
তিনি নিজ গৃহ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। অভাব অনটন ছিল তাঁর পরিবারের নিত্য সঙ্গী। আর্থিক দৈন্যর কারণে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর তাঁর লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পর একটি গোয়াল ঘরে দশ মাস শিক্ষকতা করেছেন। তৎকালে তাঁর বেতন ছিল মাসিক মাত্র ২৫ (পঁচিশ) টাকা। তাঁর হস্তাক্ষর ছিল খুবই সুন্দর।
এ হস্তাক্ষরগুলো দেখে তখনকার বাঘাইছড়ি ও নুনছড়ি মৌজার হেডম্যান বাবু পীযুষ কান্তি কামনা বালক বলেন্দ্রকে তাঁর বাড়িতে ডেকে নিয়ে আশ্রয় দেন এবং বালক বলেন্দ্রে লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে স্থানীয় বাবুছড়া জুনিয়র হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন।
দু’বছর তিনি উক্ত স্কুলে অধ্রয়ন করেন এবং প্রতিটি শ্রেণীতেই প্রথম স্থান অধিকার করেন। এজন্য তাঁকে ঐ বিদ্যালয়ে কোন বেতন দিতে হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
অষ্টম শ্যেণী পাশ করার পর তাঁর আশ্রয় দাতা বাবু পীযুষ কান্তি চাক্মা মাইনী উপত্যকার একমাত্র উচ্চতর বিদ্যাপীঠ দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নবম শ্রেণীতে পড়াশুনা করার ব্যয়ভার বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অতঃপর তিনি বাবু পীযুষ কান্তি হেডম্যান এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্যত্র চলে যান। এরপর অন্য একটি স্কুলে মাসিক ৩৫(পঁয়ত্রিশ) টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন। দশমাস তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেছেন।
কিন্তু একটি কপর্দকও তিনি সঞ্চয় করতে পারেন নি। কিন্তু বালক বলেন্দ্রের প্রবল ইচ্ছা ছিল শিক্ষকতা করেই নিজের লেকাপড়ার খরচ বহন করবেন। বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি।
পরে পরম হিতাকাঙ্ক্ষী জনৈক বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী মহাথেরো কর্তৃক বোয়ালখালী দশবল বৌদ্ধ রাজবিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমে অনাথ, অসহায় ও ছিন্নমূল শিশুদের আশ্রয় দিয়ে পড়ালেখার সুযোগ দেয়ার বিষয়টি বালক বলেন্দ্রকে অবহিত করেন।
শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নিতে গেলেও কিছু অর্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ঐ অর্থ সংগ্রহ করা বালক বলেন্দ্রের পক্ষে ছিল খুকই দুরূহ ব্যাপার। তাই অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ তিন ভাইসহ আরো অনেক গ্রামবাসীর সাথে সাজেক ভেলীর লালু কালু নামক গহীন অরণ্যে বাঁশ কাটতে চলে যান।
সেখানে তিনি দু’মাস কঠোর পরিশ্রম করে তিন সহস্র বাঁশ সংগ্রহ করতে সমর্থ হন এবং তাঁর সহযোগী ও হিতাকাঙ্ক্ষী কাট্টন্যারা তাকে ৫০ (পঞ্চাশ) কিংবা ১০০ (একশত) টি করে বাঁশ দান করায় সে সময় তাঁর ৩০০০ (তিন হাজার) টি কাটা বাঁশ সংগ্রহ হয়।
ঐ বাঁশ গ্রামের অপরাপর জনগণসহ তিন ভাইয়ের সহায়তায় সিজোগমুখ বাজারে এসে বিক্রয় করে সর্বসাকুল্যে ১৫০০.০০ (এক হাজার পাঁচ শত) টাকা দিয়েই স্বদ্ধর্মদিত্য পরম শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী মহাথেরো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পূর্বোক্ত অনাথ আশ্রমে এসে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত হন।
অতঃপর শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর পাদমূলে বসে তিনি স্বদ্ধর্মের পঠন-পাঠন শুরু করেন এবং পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রমের অর্থায়নে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। যে বছর তিনি অনাথ আশ্রমে এসে দীক্ষা নেন সে বছরটি ছিল ১৯৬৫ খৃষ্টাব্দ।
তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ (সতের) বছর। ১৯৬৮ সালে তিনি দীঘিনালা হাইস্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালের শেষভাগে উচ্চতর লেখাপাড়ার প্রত্যাশায় মহামান্য সংঘরাজ শ্রীমৎ শীলালংকার মহাথেরোর মন্দির চট্টগ্রামের মির্জাপুরস্থ শান্তিধাম বিহারে অন্তেবাসী হিসেবে গমন করেন।
আড়াই বছর তিনি পরম শ্রদ্ধেয় সংঘ নায়কের একান্ত সান্নিধ্যে থেকে ধর্ম বিনয়ের পঠন-পাঠনসহ সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের আশায় নাজির হাট ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন।
সেখান থেকে আড়াই বছর পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী বড়ুয়া গ্রাম জোবরাস্থ সুগত বিহারে অধ্যক্ষ হিসেবে গমন করেন। তৎকালীন শিক্ষাপদ্ধতি অনুসারে নাজির হাট কলেজে এইচ.এস.সি অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি প্রথম বর্ষ বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে ৫০% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হন।
পরে হাটহাজারী কলেজে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে প্রতি তাঁর অশেষ দুর্বলতা। এ দুর্বলতার কারণে আই.এ ক্লাসে তিনি উচ্চতর বাংলাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে নিয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি.এ (সম্মান) দ্বিতীয় শ্রেণী এবং ১৯৭৮ সনে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বাংলায় এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।
অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮০ সালে পালি ভাষায় প্রথম শ্রেণীতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করায় যথারীতি “বাংলাদেশ পালি ও সংস্কৃত বোর্ড” থেকে কৃতিত্বের সাথে যথাক্রমে সূত্র, বিনয় ও অভিধম্ম মধ্য ডিগ্রী লাভ করেন।
শৈশব থেকে তিনি ছিলেন বীতরাগ। সংসারের আকর্ষণ তাঁকে মুগ্ধ করতে পারেনি, সত্যের সন্ধান তাঁকে মুগ্ধ করেছে। তাঁকে দুঃখ মুক্তির আহবান পুরোপুরি পেয়ে বসেছে। তাই তিনি ১৭(সতের) বছর বয়সে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নেন।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কৃতি, নীতিশাস্ত্র শিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ বেড়ে যায়। ১৯৬৮ সালে বৈশাখী পূর্ণিমার আগে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার বোয়ালখালী দশবল বৌদ্ধ রাজবিহারে বাংলাদেশে সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সর্বজন শ্রদ্ধেয় পূজনীয় সভাপতি এবং বর্তমানে চট্টগ্রাম নন্দন কানন বৌদ্ধবিহারের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ জ্ঞানশ্রী মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে ভিক্ষু ধর্মে দীক্ষিত হন।
মহাপণ্ডিত মহাচার্য শ্রদ্ধেয় জ্ঞানশ্রী মহাস্থবিরের পবিত্র সাহচর্য ও তত্ত্বাবধানে ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন অনুশীলন করে তিনি প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বাংলা, পালি, সংস্কৃত ও ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় তাঁর যথেষ্ট দখল রয়েছে।
উপরন্তু, ধর্মীয় দর্শন ও বাংলা ভাষাগত অভিজ্ঞতা তাঁর অতুলনীয়। সাবলীল লেখায় ও বাগ্মীতায় তিনি সমভাবে পারদর্শী। মাননীয় ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো একজন প্রথিতযশা সংগঠক হিসেবে সমাজের সকল স্তরে স্বীকৃত ও নন্দিত।
আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সংগঠক, পণ্ডিত ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো তাঁর জীবনকে শুধু শিক্ষা-দীক্ষা আর ধ্যান সমাধিতে সীমিত রাখেননি। তাঁর সাধনা ও কর্মযোগ ছড়িয়ে দিয়েছেন “বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়”।
বিপুল কর্ম-কাণ্ডে সেবা-সংগঠনে ও শান্তি মৈত্রীর বাণী প্রচারে তাঁর অবদান ও আত্ম নিবেদন এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাই তাঁর খ্যাতি আজ কর্মবীর হিসেবেও স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের বিবরণ ও কার্যকাল সংক্ষেপে নিম্নে সন্নিবেশিত হল-
ক) রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় আদিবাসী ছেলেমেয়েদের জন্য একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন ১৯৭৪ সালে- যার নাম ”মোনঘর”। তিনি মোনঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯৭৪ সন হতে অদ্যাবধি “মোনঘর শিশু সদন” -এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এই মোনঘরে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসে ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন “মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়”।
১৯৮৬ সাল হতে অদ্যাবধি দীর্ঘসময় ধরে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।
খ) খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় দীঘিনালায় তাঁর গুরু ভদন্ত জ্ঞানশ্রী মহাথেরো কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত- পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম- এ ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
গ) “মোনঘর” – এর অঙ্গ বিদ্যাপীঠ হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলি নিম্নরূপ-
০১) আনন্দ বিহার পালি কলেজ, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮০ খৃষ্টাব্দ।
০২) মোনঘর আবাসিক উচ্চবিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ।
০৩) মোনঘর পালি কলেজ, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ।
০৪) মোনঘর কারিগরি বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।
০৫) মোনঘর সংগীত বিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।
০৬) মোনঘর ফাইন আর্ট স্কুল, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ।
০৭) মোনঘর মিনি হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠা- ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ।
০৮) বনফুল চিলড্রেন হোম, ঢাকা, প্রতিষ্ঠা- ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ।
০৯) বনফুল প্রাইমারী স্কুল, ঢাকা, প্রতিষ্ঠা- ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ।
১০) মোনঘর প্রি-ক্যাডেট স্কুল, প্রতিষ্ঠা- ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ।
১১) আদিবাসী ভাষা শিক্ষা একাডেমি, প্রতিষ্ঠা- ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ।
১২) প্রজ্ঞা কম্পিউটার জোন, প্রতিষ্ঠা- ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ।
উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম হতে দেখা যায় মহাথেরোর জীবন কর্মময়। কর্মকেই তিনি ধর্মরূপে জেনেছেন। তার জীবনের অবিস্মরণীয় কীর্তি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা।
এছাড়া রাঙ্গামাটির ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় তিনি যে সকল প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন এই সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করলে মহাথেরোর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় আপনা হতে মস্তক অবনত হয়ে যায়।
পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি যে সমস্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করে দেশ ও ধর্মের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছেন সে সকল সম্মেলন ও স্থানের নাম বছরওয়ারী পরিসংখ্যান নিম্নে বিধৃত হল-
০১) ১৯৮৭ সালে থাইল্যান্ডের মহামান্য রাজা ভূমিবলের ৬৮ তম জন্ম জয়ন্তিতে যোগদান।
০২) ১৯৮৮ সালের আমেরিকার লস এঞ্জেলস্ – এ অনুষ্ঠিত World Fellowship of Buddhists – এর ১৬তম মহা সম্মেলনে যোগদান।
০৩) ১৯৯০ সালের দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অনুষ্ঠানে World Fellowship of Buddhists এর ১৭তম মহা সম্মেলনে যোগদান।
০৪) ১৯৯২ সালে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে অনুষ্ঠিত World Fellowship of Buddhists- এর ১৮ তম মহা সম্মেলনে যোগদান।
০৫) ১৯৯৪ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত World Fellowship of Buddhists- এর ১৯ তম মহা সম্মেলনে যোগদান।
০৬। ২০০০ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত World Fellowship of Buddhists- এর ২১ তম মহা সম্মেলনে যোগদান।
পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মহৎ। পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘের জন্মলগ্ন থেকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল রাজধানী ঢাকার বুকে পার্বত্য বৌদ্ধদের জন্য একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করা- যে উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে সম্মিলন ঘটবে বাংলাদেশের সকল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।
পরস্পর মৈত্রী বিনিময় করবে এবং পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হবে সকলেই। করুণাগণ বুদ্ধের সাম্য মৈত্রীর কালজয়ী পতাকা তলে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ সুখী সমৃদ্ধ সমাজ ও সস্কৃতি তথা গৌরবদীপ্ত এ দেশ গড়ার দীক্ষা নেবে।
এবং ঢাকাসহ তিনি পার্বত্য অঞ্চলের কোমলমতি শিশুদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার মানসে একটি যুগোপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করবেন। এরই ফলশ্রুতিতে ২০০৪ সালের জুলাই মাসে শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহারের বনফুল কমপ্লেক্সকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে “বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ”।
এটি মাননীয় মহাথেরোর সাম্যবাদী মৈত্রীময়, অদম্য কর্মশক্তির ও সাংগঠনিক প্রতিভারই স্বাক্ষর। তাঁর ত্যাগে, শ্রমে এবং নিরন্তর প্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের দ্বার সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য অবারিত।
তাই সাম্য সৌম্যপরায়ণ সমদর্শী প্রজ্ঞানন্দ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মহান সাধু, মুসলমানদের কাছে সিদ্ধ দরবেশ এবং বৌদ্ধদের কাছে আদর্শ আর্য শ্রাবক হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বরূপে সম্মান, মর্যাদা ও সমাদর পেয়ে আসছেন। যেমনঃ
ক) ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে অত্তদীপা ফাউন্ডেশন স্থাপন এবং ১৯৯৮ সালে অত্তদীপা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ BLIA(Buddha’s Light International Association) এর সদস্যপদ লাভ করেন।
খ) ১৯৯৮ সালে BLIA -এর মহাসম্মেলনে কানাডার টরেন্টোতে অনুষ্ঠিত Monastic Seminar- এর মুখ্য প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন ভদন্ত প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো।
গ) ২০০৩ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদের মহেন্দ্র হিলে অনুষ্ঠিত BLIA- এর Executive Seminar for South Asia Members এর সম্মেলনেও মুখ্য প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন।
ঘ) ২০০৪ সালে তাইপের FO Guang sun এ অনুষ্ঠিত BLIA- এর মহাসম্মেলনে যোগদান। BLIA CHT Bangladesh এর President হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ।
বর্তমানে দায়িত্বরত পদসমূহের নাম নিম্নরূপঃ
০১) সাধারণ সম্পাদক, মোনঘর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহ কমিটি।
০২) অধ্যক্ষ, আনন্দ বিহার পালি কলেজ।
০৩) সভাপতি, মোনঘর আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি।
০৪) লর্ড এ্যাবোট, আনন্দ বিহার, রাঙ্গামাটি।
০৫) লর্ড এ্যাবোট, শাক্যমুনি বৌদ্ধ বিহার, ঢাকা।
০৬) সদস্য, বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা।
০৭) সভাপতি, অত্তদীপা ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
০৮) সভাপতি, পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
০৯) উপদেষ্টা মণ্ডলীর সভাপতি, পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ, বাংলাদেশ।
১০) সভাপতি, পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি।
১১) সভাপতি, দি মিডল ওয়ে ট্রাস্ট, রাঙ্গামাটি, বাংলাদেশ।
মোনঘরের সার্বিক সহায়তায় তিন পার্বত্য জেলায় চালু শিশু সদনসমূহ নিম্নরূপঃ
০১) কাচালং শিশু সদন, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। আশ্রিত শিশুদের সংখ্যা- ১৫০ জন।
০২) গিরিফুল সদন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা। আশ্রিত শিশুদের সংখ্যা- ১৩১।
০৩) বান্দরবান বৌদ্ধ অনাথালয়, বান্দরবান, বান্দরবান পার্বত্য জেলা। আশ্রিত শিশুদের সংখ্যা- ১৬৫ জন।
সমাজ সেবায় প্রাপ্ত পদকসমূহঃ
০১) সমাজ সেবায়, বুদ্ধ পূর্ণিমা স্মরণানুষ্ঠান ও গুণীজন সম্মাননা- ২০০১ পদক লাভ। সৌজন্যে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধ ছাত্র সংসদ।
০২) সমাজ সেবায়, মোনঘরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ২০০০ সালে Korean Chogye Jong পদক লাভ। সৌজন্যে- Choon Bool Sa, Korea.
মহাথেরো ক্ষণজন্মা পুরুষ, পাহাড়ী এবং সমতলের ক্রান্তিকালের মহানায়ক। মহাথেরো সাম্য, মৈত্রী, ত্যাগ, ক্ষমা, সেবা ও শিক্ষার মহৎ গুণাবলীর অপূর্ব বিকাশের দ্বারা হয়েছেন অজেয় অমর। পৃথিবীতে মানুষ তাঁর কীর্তির মাঝেই বেঁচে থাকে।
পৃথিবীতে কিছু বিরল মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যাঁরা চিরস্মরণীয় এবং বরণীয়। তাঁরা তাঁদের চিন্তায়, চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে-কর্মে কেবল আলোকিত নন, আলোকিত থাকেন নিরবধি শাশ্বতকাল। এঁরা প্রতিক্ষণ জ্বালিয়ে রাখেন অনির্বাণ আশার প্রদীপ এবং সৃষ্টি করেন শান্ত উদার বাতাবরণ।
ত্যাগের মহিমায়, মহত্বে, গৌরবে, ভালোবাসার মাধুর্যে মানুষ যে কত বড় হতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাননীয় মহাথেরো। তথাগত বুদ্ধ বলেছেন, জন্মের দ্বারা কেউ বড় হতে পারে না, কর্মের দ্বারাই মানুষ অনেক বড়, অনেক মহান হতে পারে।
তাই যৌবনের দুর্বার আকর্ষণ, লোভ, দ্বেষ ও মোহের আহবানকে উপেক্ষা করে ত্যাগ, ধৈর্য ও কর্মের মাধ্যমে স্বধর্মের শাসন ও সমাজ কল্যাণে তাঁর বৈরাগ্য জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন।
মহান কর্মবীর প্রজ্ঞানন্দ তাঁর মহৎ কর্মের জন্য তিন পার্বত্য জেলাসহ সমগ্র ঢাকাবাসীর আপামর জনগণের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বৌদ্ধ ভাগ্যাকাশের সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক এই প্রাণপুরুষ আমদের আদর্শ ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। এই মহান সংঘ পুরুষ- এর উদ্দেশ্য নিবেদন করছি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা ও বন্দনা।
পরিশেষে প্রার্থনা করব তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করুন এবং পরম কল্যাণমিত্র হয়ে সমাজে অবস্থান করুন।
জয়তু বুদ্ধ শাসনম।
লেখকঃ কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।