প্রথাগত আইনে আদিবাসী খিয়াং নারীর অবস্থান

Jumjournal
Last updated Sep 30th, 2021

2271

featured image

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী ১১টি আদিবাসী জাতির মধ্যে অষ্টম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো খিয়াং। আদিবাসী খিয়াং সমাজ মূলত কুকি-চীন ভাষাভাষী দক্ষিণ কুকি-চীন মতান্তরে টিবেটো-চীন দলের অন্তর্ভুক্ত।

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাজস্থলী ও কাপ্তাই উপজেলা এবং বান্দরবান সদর, রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় খিয়াং জনগোষ্ঠীর বসবাস। খিয়াংদের জনসংখ্যা তাদের নিজ জরিপ মতে আনুমানিক তিন হাজার ছয়শত, আর পরিবারের সংখ্যা আনুমানিক সাতশোর অধিক।

খিয়াং জনগোষ্ঠী প্রধানত দুটি শাখা উপদলে বিভক্ত। যথা কোংতু ও লাইতু। যারা পাহাড়ে বাস করে তাদের কোংতু এবং যারা সমতলে বাস করে তাদের লাইতু বলা হয়। এ দুটি শাখার মধ্যে কিছুটা ভাষাগত পার্থক্যও রয়েছে।

জুমের জন্য নতুন নতুন জমি বা পাহাড়ের প্রয়োজন দেখা দেয় বলে জুমচাষ-নির্ভর কোংতু শাখাভুক্ত খিয়াংরা জীবিকার টানে ভাসমান বসতি গড়ে তোলে। কোংতু ও লাইতু এ দুটি শাখায় বিভক্ত খিয়াং জনগোষ্ঠীর মানুষ আবার ১২টি গোত্রে বিভক্ত।

খিয়াং জাতিভুক্ত একজন আদিবাসী পুরুষের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিই খিয়াং পরিচয়ের অধিকারী। খিয়াং জাতির অন্তর্ভুক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণকারী শিশু সামাজিকভাবে খিয়াং বলেই স্বীকৃত হয়।

এজন্য মাতাকে খিয়াং নারী হতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নিজেকে খিয়াং হিসেবে পরিচয় দান করে, এরূপ একজন খিয়াংয়ের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী এবং দত্তক সূত্রে খিয়াং পরিবারে লালিত সন্তানও খিয়াং পরিচিত লাভ করে।

খিয়াং সমাজে একজন গর্ভবতী নারীকে নিজ পরিবারের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি কক্ষে রাখা হয়। কক্ষে গর্ভবতী নারীর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে পারেন না। অবশ্য নারীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা নেই।

ভূমিষ্ঠ সন্তান মেয়ে হলে পাঁচদিন এবং ছেলে হলে ছয়দিন প্রসূতিকে আগুন পোহাতে হয়। সন্তান প্রসবের পর প্রসূতি মাকে একমাস অশুচি মনে করা হয়।

এই একমাস সময়ের মধ্যে প্রসূতি অন্য কোথাও বেড়াতে যেতে পারেন না। এমনকি তাকে পরিবারের রান্নাঘরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। সন্তান জন্মদানের ছয়দিন পরে বয়োবৃদ্ধদের ডেকে পিতা-মাতার পছন্দ অনুযায়ী সন্তানের নাম রাখা হয়।

খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী শিয়া জনগোষ্ঠী তাদের পরিবারে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার ছয়দিন পর ‘ওপেল’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাড়া-পড়শির জন্য ভোজের আয়োজন করে। এসময় সমাজের বয়োবৃদ্ধ বা প্রবীণদের উপস্থিতিতে বাবা-মায়ের পছন্দ অনুসারে শিশুর নাম রাখা হয়। খিয়াং জনগোষ্ঠীর যেকোনো ধর্মানুসারী পরিবারে শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর ওপেল অনুষ্ঠান করা হয়।

খিয়াং নারীর বিয়ে

খিয়াং সমাজে পাত্র-পাত্রীর বিয়ে (ফিয়া চ্ নক পেয়)-কে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ সম্প্রদায়ের স্বীকৃত বিয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘লাকশোত’।

খিয়াং সমাজে সচরাচর দুই প্রকার বিয়ের অস্তিত্ব রয়েছে। যথা সামাজিক/নিয়মিত বিয়ে ও পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে। বিধবা বিবাহ ও বহুবিবাহের ক্ষেত্রে সমাজের দাবি পূরণ করতে হয়।

নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীকে কঠোর দণ্ড দেয়া হয়। বিধবা বা বিপত্নীকের বিয়ে ও বহুবিবাহের ক্ষেত্রে সমাজের অনুমোদন নিতে হয়। আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজে কোর্ট ম্যারেজ ও মিশ্র বিয়ের কিছু প্রবণতা ইদানীং দেখা গেলেও সমাজিক রীতি ও প্রথা অনুসারে সমাজসিদ্ধ করা ব্যতিরেকে খিয়াং সমাজ তা অনুমোদন করে না।

রক্ত সম্পৰ্কীয় নিষিদ্ধ বিয়ের ক্ষেত্রে দম্পতিকে সমাজচ্যুত করা হয়। খিয়াং সমাজ নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিয়েকে স্বীকৃত বিয়ে হিসেবে গণ্য করে না।

সামাজিক/নিয়মিত বিয়ে (ভিয়েইউলা-ন): খিয়াং সমাজে অভিভাবকের মতামতসাপেক্ষে পাত্র-পাত্রীর বিয়ে ঠিক করা হয়। পাত্রপক্ষ বা ছেলের বাবা নিজ গোত্রের গণ্যমান্য ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের পছন্দের পাত্রীর অভিভাবকের কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাবে পাত্রীর অভিভাবক রাজি হলে বিয়েসংক্রান্ত পরবর্তী আলোচনার জন্য উভয়পক্ষ দিন তারিখ নির্ধারণ করে।

পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে (এচেনেইস): সমাজে প্রচলিত নিয়মের বাইরে প্রেমঘটিত কারণে যুবক-যুবতী উভয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে পরস্পরের মনমিলনে নিজেদের স্বামী স্ত্রী রূপে গ্রহণের মাধ্যমে পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে সম্পন্ন করে।

খিয়াং সমাজে পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ের প্রচলন রয়েছে। খিয়াং সমাজে এ ধরনের বিয়েকে এচেনেইস’ নামে অভিহিত করা হয়।খিয়াং পুরুষ ও নারী উভয়ে পরস্পরের সম্মতিতে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর সমাজে ফিরে এসে বিয়ের ক্ষেত্রে গোত্রগত নিষিদ্ধ সম্পর্ক না-থাকলে সামাজিক আদালত বা সমাজ পতির সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘লাকশোত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিয়েকে সমাজসিদ্ধ করে।

পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ের ক্ষেত্রে খিয়াং সমাজে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর পাত্রীর সাথেও বিয়ে হয়। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী পাত্র-পাত্রীর সাথে বিয়ে হলে তা বৈধ হিসেবে গণ্য হয়। তবে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে বিয়ে হলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে স্ত্রীকে লাকশোত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গোত্রভুক্ত করা হয়। এ ধরনের বিয়েতে খিয়াং জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও গোত্রের মর্যাদা ও পদবি ধারণ করতে হয়।

বিয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক: লাইতু ও কংতু এ দুইটি শাখায় বিভক্ত খিয়াং সমাজে মোট ১২টি গোত্র আছে। এ সকল গোত্রের নামকরণ করা হয়েছে মূলত তাদের পেশা বা জীবিকা ও সামাজিক অবস্থানকে বিবেচনায় নিয়ে।

খিয়াং সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে বৈধ সম্পর্কীয়কে “আসাংশ’ বলে। ‘আসাংশ’ সম্পৰ্কীয় পাত্র-পাত্রীর বিয়েকে বৈধ বিয়ে হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যদিকে বিয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ককে ‘সাংআশ’ বলে।

একই গোত্রের মধ্যে বংশানুক্রমিক তিন পুরুষ পর্যন্ত অতিক্রান্ত হলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ককে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজ অনুমোদন করে না।

তবে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের সাথে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াংদের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক স্থাপন স্বীকৃত। এক্ষেত্রে পাত্রীকে তার স্বামীর ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতি গ্রহণ করতে হবে।

খিয়াং সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে নিম্ন বর্ণিত সম্পর্কগুলো নিষিদ্ধ সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করা হয়।

  •  একই গোত্রের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে তিন পুরুষ অতিক্রান্ত না-হওয়া পর্যন্ত;
  • মামা-ভাগ্নীর মধ্যে;
  • পিসি-ভাইপোর মধ্যে;
  • স্ত্রীর আপন বড়বোনের সাথে;
  • কাকা-ভাইঝির মধ্যে;
  • মাসি-ভাগ্নের মধ্যে;
  • বিমাতার সঙ্গে;
  • একই পিতার ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন মায়ের সন্তানদের মধ্যে;
  • ভাইপোর স্ত্রীর সঙ্গে;
  • ভাগ্নের স্ত্রীর সঙ্গে;
  • মামি-সম্পৰ্কীয় আত্মীয়ের সঙ্গে;
  • কাকি-সম্পর্কীয় আত্মীয়ের সঙ্গে;
  • তালতো ভাইয়ের সাথে আপন কন্যা;
  • দত্তক কন্যার সাথে আপন পুত্রের;
  • আপন কাকা ও জেঠার ছেলে;
  • মেয়ের মধ্যে এবং
  • ছোট ভাইয়ের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে;

উল্লিখিত নিষিদ্ধ আত্মীয়-সম্পৰ্কীয় বা সমগোত্রীয়দের মধ্যে বিয়ে হলে খিয়াং সমাজে তা নিষিদ্ধ বা অনুমোদিত বিয়ে বলে গণ্য হয় এবং সন্তানগণ অবৈধ হিসেবে সমাজে পরিচিত পায়। এই ধরনের দম্পতিকে গ্রাম বা পাড়া এবং খিয়াং সমাজ থেকে সমাজচ্যুত করা হয়। নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে বিবাহিত দম্পতির সন্তানও পিতা-মাতার অনুরূপ সমাজচ্যুত হিসেবে বিবেচিত হয়।

বহুবিবাহ: খিয়াং সমাজে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয়, তবে বহুবিবাহ সচরাচর লক্ষ করা যায় না। বিশেষত খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন নেই। তবে একজন বিবাহিত খিয়াং স্বামী তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন না করে সামাজিক আদালতে স্ত্রীর সম্মতিতে নিমোক্ত কারণে বহুবিবাহে আবদ্ধ হতে পারেন;

  • সন্তানহীন দম্পতির বংশরক্ষার তাগিদে;
  • স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে;
  • স্ত্রী উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে;
  • স্ত্রী শারীরিকভাবে পক্ষাঘাত্মস্থ হলে;
  • স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি সাপেক্ষে;
  • স্ত্রী যদি কোনো কারণে স্বামীর অমতে দীর্ঘ সময় পিত্রালয়ে বা দেশান্তরে থাকেন;
  • স্ত্রী যদি ব্যভিচার কিংবা পরকীয়াতে লিপ্ত হন এবং এ ধরনের অপরাধে সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন।

অবশ্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজে বহুবিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীর পূর্ব অনুমতি গ্রহণের বাধ্যবাধকতা নেই।

মিশ্র বিয়ে: খিয়াং সমাজে অতীতে মিশ্র বিয়ের প্রচলন ছিল না। এরূপ বিয়েকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে দণ্ড দেয়া হতো, তবে বর্তমানে আধুনিক খিয়াং সমাজ মিশ্র বিয়েকে অনুমোদন করে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসীসহ বৌদ্ধ এবং খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী পাত্র-পাত্রীর সাথে খিয়াং জনগোষ্ঠীর পাত্র-পাত্রীর মননমিলন বা সম্মতিতে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অথবা নিজ নিজ ধর্মীয় রীতি অনুসারে সম্পন্ন হওয়া মিশ্র বিয়ের ক্ষেত্রে খিয়াং সমাজের স্বীকৃতি নিতে হয়।

এরূপ বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রী যে জনগোষ্ঠী থেকে খিয়াং সমাজে এসেছে, সেই পিতৃকুলের ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা ও পারিবারিক পদবি লোপ পায় এবং স্ত্রী তার খিয়াং স্বামীর পরিবারের প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস, বর্ণ, গোত্র, মর্যাদা ও পদবির অধিকারী হন।

অনুরূপভাবে খিয়াং সমাজের কোনো নারীর সাথে অন্য জনগোষ্ঠীর পুরুষের বিয়ে হলে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য জনগোষ্ঠীভুক্ত হলে সেই বিবাহিত নারী খিয়াং সমাজের উত্তরাধিকাসহ পদবি হারান।

বিবাহবিচ্ছেদ (ফ্রি খাওয়েইল স): খিয়াং পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক বিচ্ছেদকে হ্রি থাওয়েইয়াল স্’ বলা হয়। স্বামী কিংবা স্ত্রী যেকোনো একজনের মৃত্যুতে খিয়াং সমাজে স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

এছাড়াও, সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা হি খাওয়েইয়াল স্ হতে পারে :স্বামী-স্ত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে পাড়াপ্রধান বা সমাজপতির দ্বারস্থ হয়ে তাদের উপস্থিতিতে কার্বারির আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হি খাওয়েইল স সম্পাদন করতে পারেন।

কার্বারি বা সমাজপতির উপস্থিতিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে ঘরের সিঁড়িতে পরস্পরকে কাঁঠাল গাছের পাতা ফেরত দিয়ে বিচ্ছেদ দেবার রীতি খিয়াং সমাজে প্রচলিত আছে।

খিয়াং সমাজের মধ্যে পাড়াপ্রধান বা সমাজপতির উপস্থিতিতে কার্বারি আদালতে অথবা কার্বারি আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চিফের আদালতে অভিযোগ করা যায়।

হ্রি খাওয়েইয়াল স প্রদানের বিষয়ে সার্কেল চিফের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। যদিও অদ্যাবধি খিয়াং সমাজে হ্রি খাওয়েইয়াল স-সংক্রান্ত কোনোপ্রকার সামাজিক মোকদ্দমা হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চিফ আদালত পর্যন্ত গড়ায় নি।

খিয়াং সমাজে নারীর উত্তরাধিকার

খিয়াং সমাজভুক্ত কোনো একটি পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়দায়িত্ব পালনের সাথে মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী (উমুই পেঙেয়াল স) হবার বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউপি চেয়ারম্যান/কার্বারি/পৌর চেয়ারম্যান। সার্কেল চিফের কাছ থেকে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণপূর্বক ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীদের উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী খিয়াং পরিবারের কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যয়িত অর্থ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবি পরিশোধ বা নিস্পন্ন করার পর নিমোক্ত উপায়ে খিয়াং সমাজে উত্তরাধিকারযোগ্য স্থাবর সম্পত্তি ভাগবণ্টন হয়ে থাকে। খিয়াং জনগোষ্ঠীর লাইতু উপদলের/শাখার প্রচলিত রীতি অনুসারে মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যারা সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। মৃত পিতার নামীয় সম্পত্তি থেকে পুত্ররা ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং কন্যারা ২ ভাগের ১ ভাগের উত্তরাধিকারী হয়;

পুত্রের অবর্তমানে কন্যাসন্তানরা মৃত পিতার সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। মৃত ব্যক্তি নিঃসন্তান হলে তার স্ত্রীর সহোদর ভাই, ভাইয়ের অবর্তমানে ভ্রাতুস্পুত্ররা মৃতের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়;

মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রসন্তানরা মৃতের সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার লাভ করে;

দত্তক পুত্র পালক পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। দত্তক পুত্র গ্রহণের পর যদি পালক পিতার ঔরসে পুত্রসন্তান জন্মায়, সেক্ষেত্রে নিজ সন্তানের ন্যায় দত্তক পুত্রও মৃতের সম্পত্তির ৪ ভাগের ১ অংশের উত্তরাধিকারী হয়;

অবৈধ সন্তান এবং সমাজচ্যুত সন্তান যদি সামাজিক বিচারে স্বীকতি পায়, তাহলে মৃত পিতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়;

পুত্ররা মাতার সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকারী হয়। পুত্র না থাকলে কন্যার মাতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়;

দান বা উইলের মাধ্যমে পিতা-মাতার কাছ থেকে কন্যা অথবা স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী সম্পত্তি পেতে পারেন।

বর্তমানে বোমাং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত খিয়াং সম্প্রদায়ের কন্যাসন্তানেরা মৃত পিতার স্থাবর সম্পত্তিতে পুত্রসন্তানদের সাথে উত্তরাধিকার স্বত্ব পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে  ‍পুত্ররা মৃতের সম্পত্তির ৩ ভাগের ২ ভাগ এবং স্ত্রী ও কন্যাসন্তানরা ৩ ভাগের ১ ভাগ পেয়ে থাকে।

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ ও পদবি: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০-এর ৪৮ বিধিমতে সার্কেল চিফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে যে,

  • খিয়াং সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চিফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারি নিয়োগর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র যদি যোগ্য হন, তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।
  • খিয়াং সমাজের পাড়াপ্রধান বা সমাজপতির পদটিতে বংশানুক্রমিক পদবি হিসেবে পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র অগ্রাধিকার পান, যদিও পদটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসম্মত নয়।

খিয়াং সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস: খিয়াং পরিবারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাসন্তানরা পিতার অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী।

তার বা তাদের উপস্থিতি অন্য সকল নিকটাত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। সন্তান বলতে ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকে সমঅর্থে বোঝায়। পুত্রের মৃত্যুজনিত কারণে পুত্রের সন্তানরা আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়।

  • খিয়াং সমাজে মৃত ব্যক্তির যদি পুত্রসন্তান না থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও কন্যাসন্তান তাদের অনুপস্থিতিতে মৃতের পিতা, তার অবর্তমানে সহোদর ভাই/ভাইয়ের সন্তানরা মৃতের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়;
  • স্বামী-স্ত্রী : খিয়াং পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী স্বামীর স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারসহ ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হন।
  • স্ত্রীর সম্পত্তিতে স্বামীর অবর্তমানে সন্তানরা উত্তরাধিকারী হয়;
  • পিতা-মাতা : মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি যদি না থাকে সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তানরূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছেন, সেই পিতা মৃতের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
  • রক্তসম্পৰ্কীয় খিয়াং সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র, স্ত্রী, কন্যা, নাতি, পিতার কেউ যদি জীবিত না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সহোদর ভ্রাতা, অবর্তমানে তার সন্তানরা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

দত্তক সন্তান কন্যা আর নিজ ঔরস বা গর্ভজাত সন্তান পুত্র হলে: খিয়াং সমাজের সাধারণ রীতি অনুযায়ী কন্যাসন্তান পিতার সম্পত্তির তিন ভাগের এক অংশের উত্তরাধিকারী হয়। ঔরসজাত পুত্রসন্তান পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগের উত্তরাধিকারী হয়। দত্তক কন্যাটি একজন ঔরসজাত কন্যাসন্তানের ন্যায় সব অধিকার ভোগ করতে পারে। এক সন্তান পুত্র আর নিজ ঔরস বা গর্ভজাত সন্তান না হলে ।

দত্তক পুত্রসন্তান আসল কানের মর্যাদা নিয়ে ঘরে আসে বলে সে পালক পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তির চার ভাগের এক অংশের উত্তরাধিকারী হয়। আর নিজ ঔরসজাত বা গর্ভজাত কন্যাসন্তানটি পিতার তাজা সম্পত্তির তিন ভাগের এক অংশের উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করে।

দত্তক ও ভূমিষ্ট সন্তান উভয়ই পুত্র হলে:উভয়ে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় এবং ঔরসজাত সন্তান ত্যাজ্য সম্পত্তির তিন অংশের এক অংশ এবং দত্তক সন্তান চার অংশের এক অংশ পায়। তবে হেডম্যান/কার্বারি পদ নিজ ঔরসজাত সন্তান পায়।

দত্তক ও ভূমিষ্ঠ সন্তান উভয়েই কন্যা হলে: উভয়েই পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় এবং পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তির (মৌরসী সম্পত্তি ব্যতীত) সমান অংশীদার হয়।


তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (সুস্মিতা চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা