প্রভাংশু ত্রিপুরাঃ অনন্ত লোহিত সরোবরে একঝলক জ্যোৎস্না

Jumjournal
Last updated Aug 1st, 2020

946

featured image

[পার্বত্য সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ প্রভাংশু ত্রিপুরা শ্রদ্ধাভাজনেষু ২০১৩ সালের জন্য গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় একগুচ্ছ ভাবনাবাণী]

সাহিত্যে আধুনিকতার চর্চা অপরিহার্য। কিন্তু স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে আধুনিকতার মহাস্রোতে অবিবেচনাপ্রসুত অবগাহন পরিহার্য। ঐতিহ্যে আস্থা, নিজস্বতার প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর আধুনিকার সাথে সাংস্কৃতিক মৌলিকতার সমন্বয়শীলতা মননশীল ও প্রগতিশীল সাহিত্যের অনুষঙ্গ।

দানবীয় গোলকায়নের প্রভাব হতে এসবের কোন কিছুই মুক্ত নয় আজ। নিত্য নতুন পরিবর্তনের উত্তাল ঢেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আমাদের মাথার ওপর।

গৃহস্থের জীবিকা ভিটেমাটি অথবা সংসারের আত্মীয়-স্বজন লেখকের কলম থেকে শুরু করে পাড়ার পুকুর কবির কবিতা কিম্বা আস্থ মানব সন্তানের বিবেক সবকিছু সহজে বিকিকিনি হয়ে যায় গোলকায়নের এই দুনিয়ায়।

শৈশবের সবুজ প্রান্তর পেরিয়ে কৈশোর আর যৌবনের সোনালী শস্যখেত দেখার পরম্পরাগত অধিকার হতে বঞ্চিত আজকের জেনারেশন।

ড্রাগনের অগ্নিনিঃশ্বাস যেন মুখিয়ে থাকে দুনিয়ার তাবৎ অর্জন আর সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার জন্যে।

সাম্প্রদায়িকতা, কুপমন্ডুকতা, লোভ, অমাঙ্গলিক আচার-ব্যবস্থা, দারিদ্র, বিচ্ছিন্নতা, অশিক্ষা, নীতিভ্রষ্টতা ইত্যাদির দোলাচলে টালমাটাল সমাজ এবং প্রজন্ম।

বঞ্চনা, নিগ্রহ, অনটন, দুঃখ বেদনার কালোছায়ায় নিমজ্জিত পাহাড়। স্বজন হারানো মানুষের আহাজারিতে ত্রস্ত আকাশ বাতাস।

মানবিক ও মননশীল ভাবনাকাঠামোগুলো যেন অঘোষিত উপদ্রুত অঞ্চল। আমাদের মুক্ত বাতাস ভরপুর হিংসার সিসায়।

একে ফরটি-সেভেন আর ক্রেডিট কার্ড এখন সমান্তরালে ছুটে চলে লাগামহীন। এই অসুর সময়ের রাশ ধরে টানবার যেন নেই কেউ।

অন্ধকারময় মাৎসন্যায় যুগে যেন তাসের ঘর সাজিয়ে বসে আছি আমরা নিত্য অগ্রসরমান এই ডিজিটাল সময়েও।

যুগে যুগে এই উত্তাল ঝড়ো বাতাসের অন্ধকারময় রাতে নানা রঙিন আলোর কুপি জ্বালিয়ে চলেছেন আলোকিত কিছু মানুষ।

তাঁদের এই রঙিন আলোকরশ্মিতে কখনও কখনও আলোকিত হয়ে ওঠে পাহাড়। দেখা দেয় কখনও কখনও একঝলক জ্যোৎস্নারাশি।

এ যেন অজস্র লোহিত সরোবর-মাঝে একঝলক জ্যোৎস্না। প্রাগসরজনদের এক একটি কুপির আলোকরশ্মি তাঁদের সাহিত্যের নির্যাস হতে নিসঃরিত।

এই আলো প্রজ্জ্বলনের মেলায় যাঁদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যায় তাঁদের মধ্যে প্রভাংশু ত্রিপুরার নাম সবিশেষ উল্লেখ করার মতো। প্রভাংশু ত্রিপুরা আমাদের আত্মীয়, পরিজন, প্রিয়জন এবং বন্ধু।

ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও আদিবাসী জীবন ব্যবস্থা তাঁর গবেষণার মূখ্য বিষয়বস্তু হলেও ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা ও গান লিখে তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমিদের কাছে প্রশংসতি ও সমাদৃত হয়েছেন।

নান্দনিক ও শিল্প সৌন্দর্য সাহিত্যের অন্যতম অলংকার হলেও লেখক-সাহিত্যিকের নির্দ্দিষ্ট সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনও সাহিত্যের প্রধান লক্ষ্য।

প্রেম ভালোবাসার মতো মানসিক মুগ্ধতার পাশাপাশি তাই সাহিত্যের নির্ঝরে সামাজিক চেতনাবোধ, নাগরিক কর্তব্য, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রাম, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের বঞ্চনা ও নিগ্রহের কাহিনি এবং কখনও কখনও দ্রোহের প্রতিধ্বনিও আমরা শুনতে পাই।

প্রভাংশু ত্রিপুরার গল্প, গান, কবিতা ও সাহিত্যকর্মে আমরা তাঁর এসব সামাজিক দায়বদ্ধতার নিশানা পাই। তিনি আমাদের অনেকের কাছে সাংস্কৃতিক অভিধান হিসেবে পরিচিত।

সাহিত্য সংস্কৃতির যে কোন শাখার যে কোন বিষয়ে আমাদের কোন তথ্যের প্রয়োজন দেখা দিলে আমরা তাঁর কাছে ছুটে যাই।

তাই তিনি শুধু গবেষক কিংবা লেখক নন, তিনি একাধারে পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতিকর্মীও।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। পড়ালেখা শুরু করেন নিজ গ্রাম মদন কারবারি পাড়ার পাঠশালায়।

পানছড়ি বাজার উচ্চ বিদ্যালয়, পানছড়ি হাই স্কুল ও খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে পর্যায়ক্রমে অধ্যয়ন করেছেন। লেখক গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরার বাবা বর্তমানে একজন সংসারত্যাগী ঋষি।

১৯৫১ সালের ৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলাস্থ মদন কারবারি পাড়ায় পিতা শ্রী সন্দ মোহন ত্রিপুরা ও মাতা শ্রীমতি কুমুদিনী ত্রিপুরার সংসারের জ্যেষ্ঠ সন্তান প্রভাংশু ত্রিপুরা জন্ম হয়।

প্রভাংশু ত্রিপুরা বহুমুখি প্রতিভাসম্পন্ন একজন লেখক ও গবেষক। সংস্কৃতিবোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে পার্বত্য আদিবাসী শিল্পকলার উৎকর্ষ সাধন ও প্রসারতাদানে আত্মোৎসর্গ করে তিনি হয়ে উঠেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আধুনিক ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম।

তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল জাতীয় মহিলা সংস্থার খাগড়াছড়ি জেলা সমন্বয়কারী হিসেবে। তিনি ১৯৭৬ সালে বেতার উপস্থাপক হিসেবে সৃজনশীল সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৭৯ সালে সিনিয়র প্রযোজক পদে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি একই বেতার কেন্দ্রে মূখ্য প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তিনি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তাঁর কর্মপ্রতিভাকে বহুগুণে বিকশিত করেছেন।

আলোকোজ্জ্বল এই মিডিয়া জগতে প্রবেশের পর থেকেই যেন লেখালেখি করা তাঁর দৈনন্দিন ব্রতের অংশ হয়ে দাঁড়ায়।

আদিবাসীদের মধ্যে যে ক’জন লেখকের উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বই প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রভাংশু ত্রিপুরার নাম চলে আসবে প্রথম সারিতে।

তাঁর সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে ককবরক আদি শিক্ষা (১৪০১ ত্রিং), ত্রিপুরা জাতি ও সংস্কৃতি (১৪১২ ত্রিং), ত্রিপুরা লোককাহিনী (২০০৪ খ্রি), ত্রিপুরা জাতির মাণিক্য উপাখ্যান (১৪১০ ত্রিং), ত্রিপুরা জাতির মানব সম্পদ (১৪১১ ত্রিং), ত্রিপুরা জাতির লোক সঙ্গীত (১৪১১ ত্রিং),

ত্রিপুরা আয়ুর্বেদিক ও বৈদ্যশাস্ত্র (১৩৯২ ত্রিং), ত্রিপুরেন্দ্র (ঐতিহাসিক নাটক) (১৪১৩ ত্রিং), ত্রিপুরা তন্ত্রসার (১৩৮৫ ত্রিং), পার্বত্যাঞ্চলের ত্রিপুরা লোকালয় পরিচিতি (১৩৯৫ ত্রিং), ত্রিপুরা লোকাচার ও গার্হস্থ্য বিধি (১৩৯৫ ত্রিং), ভাগ্য বিড়ম্বনা (গল্প সংকলণ) (১৩৮৯ ত্রিং),

ঈশারা (ধর্মীয় নাটক) (১৩৯৪ ত্রিং), প্রবন্ধ বিচিত্রা (১৩৮৮ ত্রিং), ককবরক গীতি সংকলন “খুম সাংদারি” (১৩৯০ ত্রিং), খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ইতিহাস (২০০৬ খৃ:), ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইত্যাদি।

পার্বত্য সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ প্রভাংশু ত্রিপুরা ২০১৩ সালের জন্য গবেষণায় সামগ্রিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

১৯৬০ সালে প্রবর্তিত হওয়ার পর এই প্রথম কোন আদিবাসী লেখক এই সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হলেন।

এর আগে তিনি আগরতলা বইমেলা সম্মাননা ২০০০, লেখা প্রকাশনের ‘শ্রেষ্ঠ গল্পকার পুরস্কার’ ২০১০ এবং অবসর সাংস্কৃতিক পরিষদের সাহিত্য পুরস্কার-এ ভূষিত হন।

তিনি কেবল ত্রিপুরা বা আদিবাসীদের জন্য লেখেন না। অনাগত দিনের সমাজ পরিচালকদের জন্য তিনি আহবান রেখে যান তাঁর প্রতিটি লেখনিতে।

তাই তিনি তাঁর গানে আহবান জানান- হেমদি বির চাকলিরক/ তাকিরিদি তালাচিদি/ সাকাংসে য়াথৈ সেবদি নক/ উল আইতা তা হেমদি নক। চলো বীর জওয়ানরা/ ভয় লজ্জা ঝেড়ে ফেলে/ সম্মুখপানেই এগিয়ে যাবে/ পিছু হটিও না কখনোই।

আমাদের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই তোমাকে- তোমার হিরন্ময় আলোয় উদ্ভাসিত হোক পাহাড় সমতল।

লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা