সেইসব বনফুলস্মৃতি এবং আমার করোনাকালীন “ভাবনা”

Sulav Changma Dhenga
Last updated Dec 7th, 2020

1259

featured image

নির্ধারিত শিরোনামের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করার আগে ব্যবহৃত কভার ছবিখানির কিয়ৎ ব্যাখ্যা টানার প্রয়োজন আছে। ছবিটি আজ থেকে প্রায় ২০/২২ বছর আগেকার একটি ছবি। ১৯৯৭/৯৮ এর দিকের ছবি। তখন আমি ২য় শ্রেণীর সুবোধ বালক।

ডানপাশ থেকে-

প্রথম সারিতে- ১. সুলভ শাকমা ২. বাবলু চাকমা ৩. রনি বম

২য় সারিতে- ১. শংকর তঞ্চঙ্গ্যা ২. পাইন্দুমং মারমা

৩য় সারিতে- ১. প্রদীপ ত্রিপুরা ২. স্বতসিদ্ধ চাকমা ৩. এপোলো চাকমা

৪র্থ সারিতে- ১. রাসুময় তঞ্চঙ্গ্যা ২. তন্ময় দেওয়ান

বর্তমান যে “বনফুল আদিবাসী গ্রীণহার্ট স্কুল এন্ড কলেজ” তার নাম তখন ছিল- “বনফুল শিশু সদন”। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে তুলনামূলকভাবে ছিন্নমূল এবং অনাথ শিশুদের ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আবাসিক শিক্ষা প্রদানের এক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল বনফুল শিশু সদন।

তখন রাঙ্গামাটির মোনঘর শিশু সদন এর একটি দূরবর্তী প্রতিষ্ঠান ছিল এটি। ফ্রান্সের বিখ্যাত সংস্থা “PARTAGE” অর্থায়ন করতো মোনঘর এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য মানবসেবামূলক প্রকল্পগুলোকে। ছবিটি তুলেছিলেন শ্রীমৎ উত্তমালঙ্কার ভিক্ষু। তিনি জাতিতে মারমা। শুনেছি তিনি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। রেসলিং পছন্দ করতেন। আমাদেরকে দিয়ে ডেমো রেসলিং খেলাতেন।

তিনি হতেন আন্ডারটেকার আর আমাদের একেকজনকে বানাতেন- অস্টিন গোল্ড, রক, কেইন, ট্রিপল এইচ, বিগ শো ইত্যাদি। তিনি ছিলেন হাউস তত্বাবধায়ক আর আমরা ছাত্র।বর্তমান বনফুলের যেখানে ডাইনিং হল টি আছে তার উপরে, দোতলায় থাকতাম আমরা। ১৬ জনের বেড। আমাদের উপরের তিনতলায় হাউসটিচার ছিলেন নভেন্দু চাকমা দা।

প্রত্যেকদিন ভোরে বন্দনাপর্ব শেষে সূর্য উঠি উঠি করা মাত্রই উন্নতমানের নাস্তা- ডিম, পাউরুটি, কলা এবং একগ্লাস দুধ। যেখানে বাড়িতে দুবেলা নিয়মিত ভাত জুটতো কি জুটতো না সেইসব প্রান্তিক আদিবাসী ছেলের জন্য এমন প্রাত:নাস্তা রাজার খানাপিনা বটে।

এরপরে ৮ টার দিকে স্কুল। সত্যি মনে আছে- আমার ২য় শ্রেণীর প্রিয় সাবেজক্ট ছিল- পরিবেশ-পরিচিতি সমাজ! খুব সম্ভব নবারুন স্যার নামে একজন পড়াতেন। স্কুলের প্রধান ছিলেন তন্দ্রা চাকমা দিদি। ১২ টার দিকে স্কুল ছুটি হতো। দুপুরের দিকে ক্যারম, লুডু, দেশভ্রমন লুডু, দাবা, টেনিস, টেবল টেনিস প্রভৃতি ইনডোর গেমস খেলার সুযোগ ছিল।  দুপুরের খাবারের তালিকায় প্রত্যহ মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সবজি- দুপুর ১টায়। রাতের বেলায়ও একপ্রকার তাই- রাত ৮টায়।

বাবুর্চি মামুদের মধ্যে অমিত মামু-র নামখানিই কেবল মনে আছে। বিকেলের দিকে ছেলেদের অধিকাংশ ক্রিকেট খেলতো। দুইটা দোলনা ছিলো মাঠে- সেগুলো থাকতো মেয়েদের দখলে। আর ছিল টিভিরুম। বিশাল লাইব্রেরীতে ছিলো নানাধরনের বই। বছরে বেশ কয়েকবার টি শার্ট, স্কুল ড্রেস, জুতাসহ নানাধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপাতি পেতাম আমরা। ব্যবহৃত পোশাক নিজেদের ধুতে হতো না।

চাচামিয়া আসতেন প্রতি সপ্তাহে, ময়লা কাপড়চোপড়গুলো রুমভিত্তিক সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন, ধুয়ে আবার দিয়ে যেতেন যার যার রুমে।ছোট ছোট আলমারি ছিল সবার জন্য যেখানে পরিপাটি করে বইপত্র রাখা যেত আর হেঙ্গারস্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রাখা যেত কাপড়-চোপড়।

ব্যবহার করে শেষ করা যেত না জিনিসপাতিগুলো। বছরান্তে বার্ষিক পরীক্ষার পরে একবার মাসখানেকের জন্য বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হতো A, B, C, D  চারটি “চ্যালেনজারস” বাসে। পথে বাসগুলোর মধ্যে হালকা প্রতিযোগিতা হতো। কী যে আনন্দ।

প্রথমে রাঙ্গামাটির মোনঘরে ড্রপ করা হতো, পরে সেখানে খাগড়াছড়ি বা বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটির অন্যান্য উপজেলা থেকে অভিভাবকরা তাদের আদরের “ধনও”, “তুঙঙো”,  “চিক্কো’ “পরান্নে” “বাবু”-কে বহুদিন পর বাড়িতে নিতে আসতেন।

অনেকে শার্ট বা অন্যান্য পোষাকগুলো জমিয়ে রাখতো ছুটির সময় বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন ঘরে ফেলে আসা ভাই বা বোনটিকে ঢাকার উপহার হিসেবে চমকে দেওয়া যায়। অনেক পোশাক-পরিচ্ছদ আসতো সোজা বিদেশ থেকে। তাই সেগুলোর মান, উফ্ -ওয়াও!

খেলাধুলা দাদু আসতেন প্রতি শুক্রবার সকালে। দৌড়ানো, লংঝাম্প, হাইঝাম্প আরো কি কি জানি ব্যায়াম-তেয়াম শেখাতেন। কখনো কখনো নিয়ে যেতেন ক্যাম্পাসের বাইরে।

ক্যাম্পাসবন্দী শিশুর হঠাৎ উন্মুক্ত আকাশ দেখার আনন্দঘন মজা তখন দেখে কে! প্রতি শুক্র-শনিবার বিকেলে গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় প্রভৃতি শেখানো হতো। আর্ট শেখাতেন ধনমনি দা।

আমার আর্ট, গান, খেলাধুলা কিছুই ভালো ছিলো না- তবে মনে আছে একটা গানের দুই লাইন মুখস্থ করতে সক্ষম হয়েছিলাম-

“ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে- বহে কিবা মৃদুবায়”

বেশ ওইটুকুই আমার আনুষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা। আর আর্ট শেখার মধ্যে মনে আছে – বড় আকারের একটি ৫ লিখলে তার মাথায় উপর দিক থেকে একটা বক্ররেখা টেনে দিলে আর ৫ এর উপর সবুজ রঙ মেরে দিলেই, বেশ ঝটপট একটা কাঁচা আম হয়ে যেত। বছরে দুইবার আমাদের ঢাকাস্থ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান বা বিনোদন পার্কে নিয়ে যাওয়া হতো। এই যেমন জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, বোটানিকেল গার্ডেন।

তখন পাহাড়ি সমাজে ডিস টিভি ছিল অলীক কল্পনা মাত্র। আর আমরা ঢাকা পড়ুয়া কতিপয় শিশু কত না ভাগ্যবান ছিলাম। বনফুলের টিভিরুমে আমরা ছেলেরা প্রচুর ক্রিকেট আর রেসলিং দেখতাম। মেয়েরা দেখতে চাইতো হিন্দি গানের চ্যানেলগুলো। এ নিয়ে ছেলে-মেয়ে প্রায়ই টিভি রিমোট নিয়ে লাগতো। এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে রিমোট চলে যেত “Pappay” বা “Tom and Jerry”- র উপর। ছেলে-মেয়ে সবার পছন্দ ছিলো এ দুটি কার্টুন।

বিশেষত পেপেয় যখন তার বিশেষ বলবর্ধক ঔষধ- ঘাস বা Weed  টুকু সেবন করা মাত্রই বলশালী হয়ে যেতেন এবং অসাধ্যকে সাধ্য করে ফেলার ক্ষমতা অর্জন করতেন, তখন সবার মধ্যে কী যে হাসির রোল! দ্যা মাস্ক মুভিটি ছিলো অনেকের প্রিয়। কতবার যে দেখেছি- দ্যা মাস্ক! ছেলেদের অনেকেই ক্রিকেট খেলতো, কমিকস পড়তো। বিখ্যাত ক্রিকেটারদের ছবি, নানা কমিকস বই এবং তিলের খাজা, গাজর প্রভৃতি ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে সংগ্রহ করে এনে দিতেন দারোয়ান দাদু-রা।

ক্রিকেটার হিসেবে আমার পছন্দের তালিকায় ছিলো বাংলাদেশের পাইলট, অপু, ভারতের মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাস, রমেশ কালুভিতারানা, আফ্রিকার শন পোলক, এলান ডোনাল্ড, ল্যান্স  ক্লুজনার, অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা, জ্যাসন গিলেস্পি, জিম্বাবুয়ের এ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওয়ালস ভ্রাতৃদ্বয়, পাকিস্তানের সাকলায়েন মুশতাক। বিখ্যাত খেলোয়ারদের ছবি বা কমিকস বুকস সংগ্রহ করা হতো। আমার সংগ্রহে ছিল মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের একটি পোস্টার।

আমি তেমন একটা কমিকস পড়ি নি। রুপকথা বা গল্পের বই ভালো লাগতো। অনেকেই টিনটিন, শক্তিমান ও অভয়, চাচা চৌধুরী ও সাবু প্রভৃতি কমিকস পড়তো। আমি ক্রিকেট টিমেও চান্স পেতাম না। তাই আমার গত্যন্তর  ছিলো হয় দাবা খেলা নতুবা লাইব্রেরী।

বলাবাহুল্য- দাবা খেলায় বহু সিনিয়রকে হারিয়ে দিতে সক্ষম ছিলাম। আমাদের হাউসটিউটর উত্তমালঙ্কার ভান্তে ক্যাম্পাসে-র প্রায় সকলের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। ছাত্র-শিক্ষক কর্মচারী সবার কাছে। তার একটি কম্পিউটার এবং একটি ডেস্কসেট ক্যাসেট প্লেয়ার ছিলো। রুমে থাকলে তিনি সাদা মনিটরের সেই উইন্ডোজ ৯৮-এ তাস খেলতেন অথবা ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাতেন রণজিৎ দেওয়ানের এ্যালবাম “মর চব্বিশ বজরর হোজপানা” থেকে-

“হোই হোই হোই হোই হোই হোই জুমোত যেবঙ

জুমোত যেই নে গোচ্চে সুদো তুলিবোঙ।”

অথবা-

“মর চব্বিজ বজররররররররররররর হোজপানাআআআআআআঅ

বুগোত গুরি তরে বাবেলুং ল- নাআআ আআ আ আ আ! ”

সেসময় বনফুল এ কেউ পড়ার সুযোগ পেয়েছে মানে ছোট-বড় গ্রামের সকলের কাছে সে বিশাল আগ্রহের পাত্র। আমরা পাহাড়ের সেইসব ভাগ্যবান কতিপয় শিশু যারা ডিস টিভি, খেলাধুলা, রাজকীয় খানা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত সমাজ-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ আর সুশৃঙ্খল জীবনের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম সেই শৈশবেই, যখন পাহাড়ে ‘‘শিক্ষা” শব্দটি-ই ছিল একটি বিলাস।

ঢাকা-র সাথে তখনও পাহাড়ের খুব একটা নৈকট্য ছিলো না। কেননা এই তো কিছু আগেও যে রক্তধারার জনপদ ছিল- পাহাড়। ৯৭ এর শেষেই না “পার্বত্য চুক্তি” হয়েছিলো ।  আমার বনফুল ভর্তি একপ্রকার কাকতালীয়। মোনঘর বা বনফুলে তখন ভর্তি করা হতো অনাথ-ছিন্নমূল-হতদরিদ্র শিশুদের। আবার প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষাও দেওয়া লাগতো।

অন্যদিকে আমার বাপ সরকারি চাকুরে, তাই সে অর্থে আমি ছিন্নমূলও নই, অনাথও নই, হত-দরিদ্রও নই। ঘটনা হলো- লটারি! আমার মা একটা ভর্তি ফরম কিনেছিলেন- হলে হলো, না হলে নাই এমন। তো- মোনঘর প্রতিষ্ঠানটি যেহেতু আমাদের গ্রামে অবস্থিত, আমাদের গ্রামের অনেকের প্রত্যক্ষ শ্রম বা অন্য-অনেক অবদান আছে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠার পেছনে, সেহেতু আমাদের রাঙাপান্যে গ্রামবাসীর দাবী ছিল- প্রতিবছর কমপক্ষে তিনজন ভর্তি করতে হবে রাঙাপান্যে থেকে।

আবার আমাদের পাশের গ্রাম ভেদভেদী থেকে ২জন ভর্তি করতে হবে। মোনঘরের পেছনে ভেদভেদী-বাসীরও অবদান আছে। ভেদভেদী আর রাঙামাটির মিলনস্থল হলো মিলন বিহার, সেই মিলন বিহার-কে কেন্দ্র করেই মোনঘর।

যাই হোক, কর্তৃপক্ষ মেনে নিলো এলাকাবাসীর দাবী। প্রতিবছর রাঙাপান্যে থেকে ৩ জন এবং ভেদভেদী থেকে ২ জন অবধারিতভাবে বনফুলে ভর্তি-র সুযোগ পাবে। কিন্তু কাকে রেখে কাকে ভর্তি করা হবে? সমাধান- যারা ভর্তি ফরম কিনবে- সেগুলোর মধ্যে চলবে লটারি, যার নাম উঠবে সেই- “বুনোফুল”! নির্ধারিত দিন রাঙাপান্যে-র ভৈরব চন্দ্র কার্বারী-র উঠোনে জড়ো হলেন ভেদভেদী-রাঙাপান্যের কার্বারী-মেম্বার-গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং ভর্তি ফরম বা লটারি কেনা সেইসব অভিভাবকরা।

একে একে লটারিতে নাম উঠবে ভাগ্যবান বুনোফুলদের। থমথম উত্তেজনা। প্রথমেই নাম উঠলো-

মঙ্গলসোনা চাকমা! এরপরে- মিন্টু চাকমা! ভেদভেদীর পালা শেষ। এবার রাঙাপান্যে-র পালা। কারা সেই ভাগ্যবান তিনজন?

প্রথমে নাম উঠলো- রঙ্গদেবী চাকমা, পিতা- ভাগ্য চাকমা। এরপর চিক্কোমুনি চাকমা, পিতা- বৃক্কমুনি (জব্বর) চাকমা। এবার সর্বশেষ জন! কে সে?????

যারা পড়ছেন- বুজতেই পারছেন, রাঙাপান্যের ভৈরব চন্দ্র কার্বারীর উঠোনে সেদিনকার সেই সর্বশেষ ভাগ্যবান শিশু- আর কেউ নয়, এই নরাধম- আজকের হেরেঙা, মি: সুলভ চাঙমা ঢেঙা! পাঠককল্পনায়- (একটা ইমো হবে এখানে) অথবা বাংলা সিনেমার কোন এক আবহ সঙ্গীত!

আমার বনফুল জীবনের সমসাময়িক আরো কিছু ঘটনা মনে আছে।

. “কহোনা প্যায়ার হে” গানখানি-নতুন রিলিজ পেয়েছে তখন এবং সুপারহিট। ঋত্বিক রোশন সমুদ্র পারে আই লাভ ইউ বলতে বলতে আমিশা প্যাটেলের দিকে ছুটে যাচ্ছেন এই গানটি বাজলেই তখনকার বনফুল মেয়েরা পাগল হয়ে যেত। আর ছেলেরা তখন রিমোট কেড়ে নিতে চাইতো রেসলিং বা ক্রিকেট চ্যানেল চালিয়ে দিতে।

২. সম্ভবত ১৯৯৮ বা ৯৯ সালে প্রয়াত চাকমা রাণী তাতু রায়ের মৃত্যু হয় ঢাকা বা কলকাতায়। তার মরদেহ বনফুলে আনা হয়েছিলো কিছু সময়ের জন্য। ঢাকাস্থ পুরো জুম্মসমাজ বনফুলে মিলিত হয়েছিলো সেদিন। আমরা বনফুলের সবাই প্রয়াত রাণী-র মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম।

৩. আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে পরাজিত করে ১৯৯৯ সালে। রাত ১০ টা কি ১১ টায় বোধহয় ঢাকার রাজপথ যেন জনারণ্য। শৈশব উল্লাসে আমরাও বনফুলের কেউ কেউ হয়তো চিৎকার করে বলেছিলাম- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। ১৯৯৯ এর শেষে সম্ভবত পারতেজ মোনঘর এবং মোনঘর সংশ্লিষ্ট সকল অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। আমাদের চলে যেতে হয় “অহদে অহ্দ ফিত্তি আয়”। আমার বনফূল স্মৃতি-র আনুষ্ঠানিকতা এখানেই সমাপ্ত।

শুধু বাস্তব মূর্ত স্মৃতি হয়ে আছে উপরের ছবি টি। তাও-সবার চেহারা বোঝা যায়- কেবল আমার মুখাবয়ব ঝলসে গেছে।

লেখার অন্যতম আলোচ্য “করোনা” -তে আসি।

করোনায়-য় এখন পুরো বিশ্ব কাবু। করোনা আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বৈষয়িক ভোগ-বাসনায় মত্ত হতে হতে আমরা দিনদিন কেমন নির্লজ্জ-বেহায়া সমাজ তৈরী করছি। পুজি-র চরম বিকাশের এই যুগে ভোগবাদী লালসা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি ও আধিপত্য বিস্তারের উগ্র বাসনা সমগ্র বিশ্বজুড়ে তৈরী করেছে এক বিশালকায় বৈষম্যের শৃঙ্খল।

বিশ্বজুড়ে নিত্য হানাহানি, বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, রেষারেষি, যুদ্ধের দামামা। এর শেষ কোথায়? কোনদিকে যাচ্ছে মানবসমাজ ও সভ্যতা? পৃথিবী নামক এই গ্রহের ভবিষ্যত-ই বা কী? করোনা আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দিলো- প্রকৃতির কোনও কোনও অমোঘ সত্যের কাছে আমরা কখনো কখনো নিতান্তই অসহায়।

করোনা আমাদের সবাইকে ভাবাচ্ছে-হাসাচ্ছে-কাঁদাচ্ছে, শেখাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে আবার সাহসও যুগাচ্ছে। করোনাকালে নানাজনে নানাউদ্যোগ, সামাজিক কর্মকান্ড, অনলাইনে ব্যক্তিগত ভাবে পরামর্শমূলক টিপস দেওয়া প্রভৃতি প্রশংসনীয়-অণুস্মরণীয় ভালো ভালো কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের আদিবাসী ভাই-বোনেরাও অনেকেই সক্রিয় ভূমিকায় মাঠে নেমেছেন।

আমি কিছুই করতে না পারা-দের দলে আছি আপাতত। তাই পেট-পুড়ে ঘাস খাওয়া গরুর মতন কিছু পুরনো এবং শৈশবীয় স্মৃতি-অস্মৃতি জাবর কাটছি। অনেকেই করোনা- লকডাউনে আটকে পড়ে “চিৎ ন ভিজ্চ্যে মন” আর “তেনেয়ে মনরিভেং” নিয়ে দিনের পর দিন হুদাই বাড়িতে পড়ে থাকার বিরক্তিতে আছেন।

অনেকের মনে হয়তো অপ্রত্যাশিত অস্বস্তি-উৎকন্ঠা-উদ্বেগ-হতাশা-নিরাশা-র ছাপ। আমি করোনাকালে আমার দুইটা পুরনো ভালো অভ্যেস পুন:জাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিছু সুফল পেয়েছি। ভালো লাগলে কেউ কেউ সত্য সত্যই চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

১.            বই পড়া

২.           ধ্যান বা ভাবনা বা মেডিটেশন

আমি এই করোনাকালে রাঙামাটির রাজবনবিহারে ৩৩ দিনের পরীক্ষামূলক স্বেচ্চা ব্রক্ষ্মচর্যা বা শ্রামণ্যব্রত পালন করে আসলাম।

সুবাদে রাজবন লাইব্রেরীতে বেশ কিছু বইয়ের সাথে সন্ধি হয়েছে। এই যেমন- May Flower by C. T Shen, Buddha and His Teachings by Narada, Buddhist Wisdom and Faith by Thich Thein Tam,  শান্তিপদ ও প্রজ্ঞা দর্শন – সুবল চন্দ্র বড়ুয়া, জাতক পঞাশক- জিনবংশ মহাথেরো, জ্যোতিপাল মহাথেরর চর্যাপদ, প্রয়াত সংঘরাজ শীলালংকার মহাস্থবিরের তিনটি অসাধারণ জীবনীমূলক বই আনন্দ, জীবক, অজাতশত্রু, ডা: ভগদত্ত খীসা রচনা স্মারক, দক্ষিণ-পূর্ব বাঙলায় ফ্রান্সিস বুকানন, নারায়ণ স্যানালের অজন্তা-অপরুপা এবং শ্রদ্ধেয় বনভান্তের নিজের লেখা দুটি বই – সুদৃষ্টি এবং সুত্ত-নিপাতের কিয়দংশসহ আরো বেশ কিছু দেশী-বিদেশী বই।

পড়তে যেয়ে ভালোলেগেছে এমন কিছু বই থেকে দুএকটি কোটেশন তুলে দিচ্ছি এখানে-

“ক্ষমা ও মৈত্রী-করুণাই চিত্তের পবিত্রতা আনয়ন করে। চিত্তের মল স্বরুপ বৈরভাবের বিরামেই জীবন হয় সুন্দর ও শান্তিময়। শত্রুর চেয়েও মানুষের সমধিক ক্ষতিকারক বিপথগামী চিত্ত। আসক্তি-বন্ধন লৌহ বন্ধন হতেও দৃঢ়তর।” 

– আনন্দ, শীলালংকার মহাস্থবির।

ÒThis Body of Flesh and Blood I bear

Just for the World’s

Good and Welfare”

  • Sri Sanghabodhi.

“I looked at my brother with microscope of criticism

And I said, ÒHow coarse my brother is!”

I looked at him through the telescope of scorn

And I said, ÒHow small my brother is!”

Then I looked in the mirror of truth

And I said, ÒHow like me my brother is!”

  • Bolton Hall

“The gift of Truth Excells all other Gifts.”

 – Dhammapada, Narada.

এই করোনাকালে ঘরের বাইরে যেতে না পারলে কিছু বই তো পড়া যেতেই পারে!

হয় বই পড়ুন নয় ধ্যান করুন! ধ্যান বা ভাবনা প্রসঙ্গে আসি।

কেবল করোনাকালীন উঠকন্ঠার সময়ে নয়, যে কোন মানসিক অস্থিরতা-উদ্বেগ-উঠকন্ঠা-হতাশা-নিরাশা বা কোন দুর্বিসহ স্মৃতি কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় এবং পরিচিত প্রেসক্রিপশন হচ্ছে নিয়মিত ধ্যান/ভাবনা/মেডিটেশন চর্চা করার অভ্যাস।

সংস্কৃত ধ্যান শব্দটিকে জাপানীরা বলে জেন ((ZEN)), চাইনীজরা চেন (CHAN)। ধ্যান বিষয়ক প্রচুর কন্টেন্ট পাওয়া যাবে অনলাইনে। ইউটিউবে মিলবে সহ¯্র টিউটোরিয়াল।মেডিটেশন লিখলেই দেখবেন কতশত কন্টেন্ট। পৃথিবীর তাবৎ মোটিভেশনাল স্পিকার বা প্রতিষ্ঠিতজনরা অবশ্যকরণীয় তালিকা করতে গেলে “ভাবনা”-র কথা উল্লেখ না করে পারেন না।

আমাদের মনের অস্থির প্রকৃতিকে বোঝানোর জন্য ইংরেজীতে একটি টার্ম ব্যবহার করা হয়- “Monkey Mind”। প্রকৃতই আমাদের মনচিত্তে-র গতি-প্রকৃতি অনেক সময় স্বয়ং আমরা নিজেরাও বুজতে সক্ষম নই। বানরের মতো কখন কোন গাছ থেকে কোন গাছে, কোন শাখা থেকে কোন শাখায় সে লাফ দিয়ে বেড়ায় তার ইয়ত্তা নেই।

তাছাড়াও বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, আমাদের মনে নীরবে বাসা বেধে থাকে নানাবিধ মন:ব্যাধি; লোভ-দ্বেষ-মোহ! এজন্য আত্মপ্রশান্তি, আত্মউন্নতি, আত্মসমৃদ্ধি সবকিছুর জন্য বৌদ্ধ শিক্ষায় জীবনযাত্রার সবক্ষেত্রেই সংযম-কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বুদ্ধ তিন প্রকার সংযম বা শীল এর কথা বলেছেন- ১. কায় সংযম শীল ২. মন:সংযম শীল ৩. বাক্য সংযম শীল। এই তিনটি শীলই বাকি সকল বৌদ্ধ শীলাচার-বিনয় বা নিয়ম কানুনের মূল উৎস।

কায় বা শরীরের সংযম, মনের সংযম এবং বাক্যে বা কথা-বার্তায় সংযম প্রতিষ্ঠার জন্যই মূলত বৌদ্ধরা ধ্যানস্থ হন বা নিয়মিত ভাবনা চর্চা করে থাকেন। বোধহয়, বিশ্বাসী বা চর্চাকারী অর্থে আমি তেমন একটা বৌদ্ধ চর্চাকারী নই, তবে বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা অর্জনের লোভ আমার বহু আগে থেকে। তার অন্যতম একটা কারণ সম্ভবত উপরের ছবিটি। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে বনফুলের কতিপয় সুবোধ বালকেরা ধ্যানস্থ বা মেডিটেশনস্থ।

বৌদ্ধ সাহিত্যে এবং বৌদ্ধ শাস্ত্রে ধ্যান বিষয়ক শতশত বই-পত্র রয়েছে। প্রখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত আচার্য বুদ্ধঘোষপ্রণীত প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বই- বিশুদ্ধিমার্গ। বলা হয়ে থাকে বিশুদ্ধিমার্গ হচ্ছে সমগ্র ত্রিপিটক বা সমগ্র বৌদ্ধ শিক্ষা ও দর্শনের সারমর্ম। বিশুদ্ধিমার্গে বুদ্ধঘোষ মূলত ভাবনা সংশ্লিষ্ট আলোচনায় করেছেন। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষাসমূহ এবং সমগ্র ত্রিপিটক অধ্যয়ন করে আচার্য বুদ্ধঘোষ শাক্যমুনি বুদ্ধের শিক্ষাকে মূলত দুই প্রকার “ভাবনা” প্রকরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আচার্য বুদ্ধঘোষের মতে বুদ্ধ নির্দেশিত ভাবনা দুই প্রকার,-

১. শমথ ভাবনা

২. বিদর্শন ভাবনা।

শমথ ভাবনার মাধ্যমে মনচিত্তকে স্তির করা যায়। বিশুদ্ধিমার্গ অনুসারে প্রায় ৪০ প্রকার উপায়ে শমথ ভাবনা করা যায়। যেমন- বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা, মরণানুস্মৃতি ভাবনা, মৈত্রী ভাবনা ইত্যাদি।

বুদ্ধানুস্মৃতি ভাবনা হচ্ছে বুদ্ধ এবং বুদ্ধের গুণাবলীগুলোকে নিবিড় এবং একাগ্রচিত্তে স্মৃতিসহকারে পুন:পুন স্মরণ করতে থাকা। এভাবে মনচিত্তকে কেবল একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বা ক্ষেত্রে স্থির করে রাখার চেষ্টা করা। আমরা জানি, প্রাণী মাত্রই আজ না হয় কাল না হয় পড়শু মরে যাবে। সেজন্য বৌদ্ধ শিক্ষায় বলা হয় যে- জগৎ অনিত্য। অর্থাৎ জগতের কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। সুতরাং এ অনিত্য জগতের কোনকিছুর সাথেই আসক্তিপূর্ণ হওয়া উচিত নয়।

এমনভাবে একাগ্রচিত্তে পুন:পুন নিবিষ্টমনে স্মরণ করা যে সকল “সত্ত্বা” – যেভাবে মরে যায়, আমারও সেরুপ কোন না কোনসময় মরে যেতে হবে। মৃত্যু সকল সত্ত্বার জন্যই অবধারিত। এটাই মরণানুস্মৃতি ভাবনা। মরণানুস্মৃতি ভাবনা করলে মনচিত্ত থেকে লোভ-লালসা হ্রাস পায়। মৃত্যুভয় কমে যায়। আবার মৈত্রী ভাবনায় জগতের সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করা হয়।

বিদর্শন ভাবনা উচ্চস্তরের ভাবনা। এর অনুশীলন লক্ষ্য হচ্ছে নিজের সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি, উচ্চতর জ্ঞান ও সম্যক ধারণা অর্জন করা। অর্থাৎ সোজা কথায় নিজের অন্দরমহলটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টিপাতের সহিত পর্যবেক্ষণ করা। আমাদের চিত্তে উৎপন্ন যাবতীয় চিন্তাবলীকে গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করা। স্ব-ধর্ম সমূহকে বা নিজের মনচিত্তের এবং শরীরের প্রকৃত স্বরুপ কে চিহ্নিত করা ও পর্যবেক্ষণ করা, মনচিত্ত ও শরীরের নিজস্ব প্রকৃতিগত বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও স্বতস্ফূর্ত আচরণগুলো সম্বন্ধে জানা ও বোঝার চেষ্টা করা।

এভাবে একসময় গভীর একাগ্রতায় আবিষ্কার করা যায় কত ক্ষণস্থায়ী সবকিছুই। এতে জাগতিক মোহ হ্রাস পায়। জীবন ও জগত যে কতটা অসার-অনিত্য সে সম্বন্ধে স্বচ্ছ, গভীর এবং সম্যক ধারণা জন্ম নেয়। ফলত আমাদের মনচিত্ত কোনকিছু দ্বারা সহজে আর বিচলিত হয় না, আসক্ত হয় না, মোহিত হয় না। মনে একধরনের প্রশান্তিবোধ জন্মে। চিত্ত স্থির হয়, শান্ত হয়।সোজাকথায়- ভাবনার অর্থ হচ্ছে নিজেকে নিজে সম্যকভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। চারপাশের জগৎকে অনাসক্তরুপে দর্শন করা।

সর্বোপরি- মনচিত্তকে অধিকতর একাগ্রতায় প্রতিষ্ঠিত করা। এই করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তি কামনায় থাইল্যান্ডের বিখ্যাত ধম্মকায়া ফাউন্ডেশন বিশ্বব্যাপী অনলাইনে গণ ভাবনার আহবান জানায়। এতে রাজবনবিহারও সংশ্লিষ্ট ছিল। আমিও সেইসব সৌভাগ্যবানদের একজন ১৫/২০ দিন দৈনিক ৩০ মিনিট করে পুজ্য বনভান্তের দেহধাতু সাক্ষী রেখে বিশ্বশান্তি কামনায় “নিয়মিত ভাবনা-য়” অংশগ্রহণ করতে সুযোগ পেয়েছি।

লেখার প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছি। শেষ করার আগে- যারা পড়ছেন এবং যারা আমাকে চিনেন তাদেরকে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বহুআগেকার সময়ের অর্থাৎ বনফুল সময়কার একটি চমকপ্রদ সত্য ঘটনা শুনিয়ে দিই।

এখন যেখানে বনফুলের অফিসকক্ষ,তার উপরের দোতলায় হাউসটিউটর ছিলেন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি। ধরুন তার নাম দিকবলয় তঞ্চঙ্গ্যা (একটি ছদ্মনাম আরোপ করে দিলাম)। বনফুলের আমরা সবাই তাকে জানতাম নিখাদ ভদ্রলোক। তেমন একটা কথাবার্তা বলতেন না। চুপচাপ শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। ভালো কবিতা লিখতেন।

একদিন সন্ধ্যেকালীন বন্দনা-র সময়ে যখন পুরো বনফুল ক্যাম্পাসের বালক-বালিকারা প্রার্থনাহলে প্রার্থনারত সেসময় তিনি আমাকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে গেলেন। এরপরের দৃশ্যটি আমার জীবনের সবচেয়ে বিভৎস-বিভীষিকাময়-কুৎসিত “অ-স্মৃতি/দু:স্মৃতি”।

তার কক্ষের খাটে আমাকে শুয়ে পড়তে বললেন। অনেকটা বাধ্য হলাম। এরপর একে একে তার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলতে লাগলেন। আমি ঠিক বুজে উঠতে পারছিলাম না কী হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার গোপন অঙ্গটা “টিবুরুক টিবুরুক” করতেছে। আমাকে নির্দেশ দিলেন প্যান্ট-শার্ট খুলে ফেলতে। ওতটুকুন বাচ্চা ছেলে আমি, বেশ ভয় পেয়ে গেছি তখন। কি করবো বুজে উঠতে পারছি না।

তিনি নিজেই আমার পড়নের টি শার্ট-টা খুলে দিলেন। জোড় করে। আমার ভাগ্য ভালো ছিল বলেই হয়তো সেদিন আমার প্যান্ট টা আর খুলতে হয় নি। তিনি যৌনাবেগে এমনই উত্তেজিত ছিলেন যে, আমার টি শার্ট খোলামাত্রই তার গোপন অঙ্গটা আমার নাভি বরাবর আনলেন। অমনি তার গোপনঅঙ্গ থেকে হুড়হুড় করে বীর্যপাত হয়ে গেল- আমার নাভি-তলপেটজুড়ে।

কী যে বিভৎস বিশ্রী এক “অ-স্মৃতি”, দু:স্মৃতি। সম্ভবত আমাকে তিনি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বা জোড় করে পায়ুপথে (ধর্ষণ) করতে চেয়েছিলেন। আমার সৌভাগ্য যে, তার দ্রুত বীর্যপাত হওয়ায় আমি সেযাত্রায় তার ভোগ-কামনা-লালসা চিত্তের “পুরোপুরি” এবং নৃশংস শিকার হই নি। এরপরেই আমি দৌড়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে পড়ি।

সেই ঘটনা পরবর্তী মাসখানেকের বেশি সময় পর্যন্ত আমি ঠিকঠাক ঘুমাতে পারতাম না। কারো কাছে কিছুই প্রকাশ করতে পারি নি। আমাকে যারা একেবারে ছোটবেলা থেকে চিনেন-জানেন তারা জানেন শৈশবে আমি আজকের দিনের মতন এতটা বাচাল ছিলাম না। খুব একটা কথা বলতাম না।

লাজুক স্বভাবের ছিলাম। প্রায়শই আনমনা হয়ে থাকতাম। এর কারণ সম্ভবত সেই দু:সহ স্মৃতি। সেই দুঃসহ স্মৃতিটা আমি কখনোই ভুলতে পারি নি।বিষয়টা আমি কোনদিন কাউকে শেয়ার করতেও পারি নি। প্রায় ২০/২২ বছর ধরে আমি নীরবে বয়ে বেড়িয়েছি আমার জীবনের সেই দু:সহ স্মৃতি।

পড়ে মোনঘর স্কুলে পড়ার সময় অর্থাৎ কৈশোরকালে, বিশেষত ক্লাস সিক্সে উঠার পর থেকে হঠাৎ দূরন্তপণায় পেয়ে বসে আমায়। ইতিমধ্যে ভুলেও গেছি সে ঘটনা। তবুও মাঝে মাঝে হুট করে আমার চিত্তে সেই বিশ্রী বীর্য তা-র কথা মনে পড়ে যেত। নাইন-টেনে পড়ার সময় আমি সহপাঠি বন্ধুদের কখনো কখনো হুটহাট করে পিঠে চাপড় মারতাম। এখনো মাঝে-মধ্যে আমি হুট করে কারণে-অকারণে চিল্লা-পাল্লা করি! আর পেটে হালকা-পাতলা এ্যালকোহল পড়লে কী যে হয়ে উঠি আমি নিজেও বুজে উঠতে পারি না।

আমার ধারণা- সেই ঘটনা-র মনস্তাত্ত্বিক আঘাত থেকেই আমি এমন করি, কেননা সেই ঘটনা আমি কখনোই কারো কাছে শেয়ার করে হালকা হতে পারি নি।

আমি গ্রাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পরে আমার জীবনের এক ঘনিষ্ঠতম মেয়েবান্ধবীকে (হুরি)কে প্রথম এই ঘটনা শেয়ার করি। আমার বিশ্বাস ছিল সে আমাকে হাল্কা করতে পারবে।

কেননা তার সাথে পরিচয় হওয়ার পরে বিভিন্নসময়ে আমার নানা-ন মনস্তাত্তিক ধাক্কাগুলো সামলানোর ক্ষেত্রে সে আমাকে যেভাবে সাহস যুগিয়েছ তার জন্য আমি তার কাছে আজীবনের জন্য ঋনী। পরে অবশ্য ক্যাম্পাসে আমার কতিপয় জুম্ম ছোটভাইয়ের নিকটও ঘটনাটা শেয়ার করেছিলাম বোধহয়। আজ শেয়ার করলাম সকলের সাথে। কেননা- আমাদের অনেকের জীবনে-ই হয়তো এরকম অবর্ণনীয়-আপাত:অপ্রকাশযোগ্য নানা দু:সহ স্মৃতি-অস্মৃতি, ঘটন-অঘটন থেকে থাকে।

কেবল যৌন বিষয়ক নয়, অন্য আরো নানাবিধ আপাত:অপ্রকাশ্য ঘটনা-অঘটনা হয়তো আমাদের জীবনকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যায়, মানসিক ভাবে প্রচন্ড আঘাত করে, অস্তিরতা বাড়িয়ে দেয় বা আমাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা বা স্বাভাবিক বিকাশের জন্য বেশ হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। নানাকারণে আমরা সেগুলো- এবংকি কাছেরজনদের কাছেও প্রকাশ করতে পারি না।

এভাবেই হয়তো আমাদের যাপিত জীবনের এমনকিছু ঘটনাবলী থাকে যেগুলো আমাদের প্রচন্ড মানসিক আঘাত-উদ্বেগ-উঠকন্ঠা-নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু নানাবিধ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান কারণে সেগুলো আপাত: অপ্রকাশযোগ্য।

কারো জীবনে এমন কিছু না ঘটুক, যাদের জীবনে এমন কিছু ঘটেছে তারা যেন আমার মতো সেইসব “কুট্টা”-গুলোকে ক্ষমা করার শক্তি অর্জন করতে পারে সে কামনা করি। জীবনে যা কিছুই আসুক, ঘটুক সবকিছু ইতিবাচকভাবে আত্মবিশ্বাসের সাথে মোকাবিলা করার আবশ্যকীয় এবং অব্যর্থ দ্রোণাস্ত্র হচ্ছে বই এবং ভাবনা। আমি ভাগ্যবান আমাকে উত্তমালংকার ভান্তে ধ্যান শিখিয়েছিলেন। এবংকি মাত্র ১০ মিনিটের সেই ধ্যান আমার সমগ্র জীবনে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে বলেই আমি মনে করি।

আমি দিকবলয় বাবুকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আবার তাকে ক্ষমা করার শক্তি অর্জন করতে যেয়ে আবিষ্কার করেছি যে, আমার নিজেরই তো কত কত অপরাধ জমে গেছে কতো কারো কাছে। আমার জীবনসংশ্লিষ্ট সেরকম কেউ এই লেখা পড়ে থাকলে তারা আমায় ক্ষমা করুক।

শেষান্তে নিবেদন জীবনযুদ্ধের প্রতি পদক্ষেপে ইতিবাচক থাকতে অবশ্যই নিয়মিত বই পড়ুন – ধ্যান করুন আর এইমুহুর্তে অতিঅবশ্যই করোনা বিষয়ক যাবতীয় সতর্কতা অবলম্বন করুন।

বনভান্তের এক দেশনায় শুনেছি-

“অতীতের যা কিছু, ফেলে দাও অতীতে

কদাপি না দিও তারে পুনঃআবির্ভাব হতে।”

বৌদ্ধমাত্রই যে কোন কার্য বা প্রার্থনা শেষে একটি কথা অবশ্যই উচ্চারণ করেন –

সব্বে সত্তা সুখী হোন্তু

জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা