বম জাতির আদ্যোপান্ত

Jumjournal
Last updated Sep 26th, 2021

2033

featured image

বম জাতির বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা

জাতি বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল আমাদের এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান-এই তিন জেলার বিভিন্ন নৃগােষ্ঠীর, নানা সংস্কৃতির এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্ভার আমাদের অহংকার। ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মধ্যে বম জনগােষ্ঠী অন্যতম।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং মায়ানমারের চীন প্রদেশে বম জনগােষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলাের মধ্যে বম জনগােষ্ঠীর বসবাস রয়েছে মণিপুর ও মিজোরাম রাজ্যে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান পার্বত্য জেলার রুমা, থানচি, রােয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় এবং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় ৭০টি গ্রামে বমরা বসবাস করে। সরকারি পরিসংখ্যানে বম জনগােষ্ঠীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় না।

১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে বম জনগােষ্ঠীর মােট জনসংখ্যা ৬,৯৭৮ জন বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে বমরা সরকারি পরিসংখ্যান যথাযথ নয় বলে মনে করে। ২০০৩ সালে বম সােশাল কাউন্সিল বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত জরিপ অনুসারে বম আদিবাসী জনসংখ্যা ৯,৫০০।

দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী এই অরণ্যচারী বম জনগােষ্ঠী তুলনামূলকভাবে এখনাে অনেক পেছনে। ভৌগােলিক অবস্থান ও দূরত্বের জন্য এরা উন্নয়নের সুযােগ হতে বঞ্চিত। বছরের অধিকাংশ সময় গভীর অরণ্যে শিকারে এদের সময় কাটে। শিকারি স্বভাবজাত গহীন অরণ্য এবং পাহাড়ি ঝরনার পানি প্রভৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া প্রকৃতি প্রেমিক এ জনগােষ্ঠী কালের পরিবর্তনের ধারায় বর্তমানে নানা হুমকির মধ্যে রয়েছে।

বম জনগােষ্ঠীর নামকরণ

বম আদিবাসী কুকি-চিন ভাষাভাষী মঙ্গোলীয় গােষ্ঠীভুক্ত। ‘বম’ শব্দের অর্থ বন্ধন, মিলন, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, একত্রীভুক্ত, এক করা বা হওয়া। আদিম প্রথার জীবনপ্রণালি, যেমন : বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য একস্থান হতে অন্যস্থানে পরিভ্রমণ, গোত্রীয় প্রাধান্যের লড়াই, উপগােত্রীয় দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ প্রভৃতির কারণে তারা বিভিন্নকালে দলচ্যুত বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গহীন অরণ্যে আর দুর্গম পাহাড়-পর্বতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়েছে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্তির ফলে তারা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই ক্রমে ক্রমে দুর্বল ও সংখ্যায় কমতে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলকে একত্রীভুক্ত করা বা সংযুক্ত করণের ফলে ‘বম’ শব্দের প্রচলন হয়েছিল।

আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, আহার-পানীয়, সঙ্গীত-নৃত্য ও পূজা-পার্বণ ইত্যাদি প্রায়ই একরূপ। সেই গােত্র বা গােষ্ঠী অখণ্ডভাবে বা একটি সমষ্টিগতভাবে একক রূপে নিজেদের আখ্যায়িত করার ফলে বম’ শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।

বম শব্দের উৎপত্তি এবং অর্থ নিয়ে নানান মত বিদ্যমান। জির কুং সাহু এবং এস এল পারদো বম শব্দগত অর্থ এবং তার সম্ভাব্য প্রয়ােগ এভাবে দিয়েছেন, The word Bawm literally meaning, with the noun, ‘coop, cage, ‘container, or basket does not contribute seriously to answer why they retained the name by which they called themselves… with the verb, Bawm’ meaning, ‘unite, to become one ‘merge, absorption in greater whole, share of partake with others …sound better to explain the origination of the term literally (Shahu and Pardo : 1994; 1-2) | এস এল পারদো মনে করেন বোন-জো Bonzu, Banjoogee, Bounjwes, Boung-Jus, Banjogus ev Banjog বমদের প্রকৃত নাম বমজৌ (Bawm-Zo)-এর অপভ্রংশ (Shahu and Pardo : The Bawms : The Forest Wandering Tribe of Chittagong Hill Tracts, 1998)। আর লালনাগ বম মনে করেন যে ‘বমজৌ’ শব্দ থেকে ‘বম’ শব্দের উৎপত্তি। (লালনাগ বম : উপজাতি পরিচিতি, বােম : অঙ্কুর ১৯৮১)
ব্রিটিশ ও অন্য লেখকেরা বমদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছেন। যেমন : বনজো (বুকানন ১৭৯৮), বনযােগী (ম্যাক্রোয়া ১৮০১), বুনজোস (বারবে ১৮৪৫), বৌন-জুস এবং বৌনজিস (পিয়ারে ১৮৪৫)।

বম শিকারী যুবক
বম শিকারী যুবক। ছবি-জুলিয়ান বুম

আরাে অনেকে, যেমন : লুইন, ম্যাকেঞ্জি, ওয়ে, রীবেক, হাচিনসন, মিলস, লেভি স্ট্রাউস, বাসানেত, বারনােটস প্রমুখ লেখকরা বনযােগী বা বানযােগী (বার্বি), বম ও বম-জো (লােরেন ১৯৪০), বােম-লাইজো এবং বােম (বারনােটস), বােম-জৌ (লােফলার, ১৯৫৯), বনযােগী এবং বোম (সোফার, ১৯৬৪), বম (ওলফগং মে, ১৯৬০) আর বােম (প্রামাণিক) শব্দটি উল্লেখ করেছেন।

Banjoogee, Banjoos, Bounjous, Bounjwes, Banjogis, Banjogies ইত্যাদির বহুরূপী ইংরেজি বানানের বাংলা ‘বনযােগী’। এই বনযােগীই বমদের সর্বাধিক ব্যবহার হতে দেখা যায় ! হাচিনসন (১৯০৬ : ১৫৯) এর ব্যাখ্যায় The name Banjogi is derived from ‘ban’ a forest, and ‘jogi’ wanderer, তার অর্থ forest wandering tribe। ‘বন’ (Ban) এবং ‘যােগী’ (Jogi) শব্দ দুটির কোনােটি বমদের নিজস্ব নয়।

একটি নির্দিষ্ট জনগােষ্ঠীকে বিবিধ নামে অভিহিত করার ঐতিহাসিক কারণ হয়তাে আছে তবে Bawm, Bom, Bom-Zo Bawm-Zo, Zo, Lai, Laimi (বানানের প্রকারান্তরে) ছাড়া অন্য নামগুলাে নিজেদের বেলায় কখনাে ব্যবহার করেনি।

বম জনগােষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বাস করে বান্দরবান জেলায়। এ জেলায় রুমা, থানচি, রােয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর থানায় তারা বসবাস করেন। এছাড়া রাঙামাটি জেলায় বিলাইছড়ি থানায়ও এদের আবাস আছে। দুই জেলার মােট পাঁচটি থানায় ৬৫টি গ্রামে বমদের বসবাস রয়েছে।

বম জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি

পূর্বেকার প্রতিবেদনগুলােয় বমদেরকে ‘বনযােগী’ (Bonjoogees) ‘বানজুস’ (Bunzoos) ‘বৌংজুস’ (Boung-Jus) বা ‘বৌনজ্যুস’ (Boung-Jews) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। লুইন, ম্যাকেঞ্জি, উয়ে, রিবেক, হাচিনসন, মিলস, লেভি স্ট্রাউস, বেসাইনেট এবং বার্নটসহ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন আদমশুমারি এবং অন্যান্য লেখকগণ যাঁরা নতুন তথ্য প্রদানের স্থলে মূলত লেউইনের রচনাবলি বিন্যস্ত করেছেন এবং তাঁরা এই গ্রুপকে ‘বনযােগী’ (Banjugis) বুনযােগিস’ (Bunjugis) বা তজ্জাতীয় নামে জানেন। বাবি ‘বম’ নাম উল্লেখ করেছেন, ঠিক যে নামে বম সম্প্রদায় নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে।

লােরেন বম বা ‘বম-জৌ’ (Bawm or Bawm-Zo) নামে লিপিবদ্ধ করেছেন। বার্নট নামকরণ করেছেন ‘বম-লাই জৌ’ বা ‘বম’ (Bawn-Laejo or Bawm) হিসেবে। লফলার ‘বম-জৌ’ (Bawm-Zo) বলেছেন এবং সােফার ‘বনযােগী’ এবং ‘বম’ (Boniogi and Bom) বলে উল্লেখ করেছেন।

চীন ভাষার মাপকাঠির বিচারে যেসব লেখক ‘বম’ জনগোষ্ঠীকে ‘কুকী’ (Kuki) বা ‘চীন’ (Chin) বলে জোর দাবি করেছেন তাদের মধ্যে লেউইন, রিবেক, গ্রিয়েরসন, হাচিনসন, উম্ফেনেডেন, শ্যাফার প্রমূখ অন্যতম।

উনবিংশ শতকের পূর্বে এবং বিংশ শতকের বিভিন্ন লেখালেখিসমূহে বমদেরকে চীন (Chin) জাতির উপশাখা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফায়ের, বার্বি, লুইন, গ্রীয়েরসন, হাচিনসন, মিলস ও অন্যান্য লেখকগণ অনুরূপ মত পােষণ করেন।

শব্দাবলি ও বৈচিত্র্যতা, যা চীন জাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় এমন বিশেষত্ব ছাড়াও তারা বম জাতির স্বকীয় শ্রেণীভেদ উপস্থাপনপূর্বক তাদের মতের স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন।

বমদের আদি নিবাস নিয়ে নানা রকম কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয় চীনের চিনলুং এলাকার এক গুহা থেকে তারা এসেছে। ধারণা করা হয় এই কাহিনী মনে রাখার জন্য বান্দরবান জেলার একটি বম গ্রামের নাম চিনলুং রাখা হয়েছে।
এতদ্বিষয়ে একটি বহু প্রচলিত গীত :

কা পা লাম তলাক আ ঠান দাং
সিন লুং লাম তলাক অ আ ন দাং

অনুবাদ

আমার পিতার পদপাত অতি চমৎকার
সিন লং পদপাত অতি চমৎকার।

বর্তমান স্থানে বমদের আগমন সপ্তদশ দশকে। ফ্রান্সিস বুকানন দক্ষিণপূর্ব বাংলায় (কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম) তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে চমৎকার ঐতিহাসিক ঘটনাবলি উল্লেখ করেছেন। তিনি ১৮ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাজালিয়া (বােমাং হাট) নামক স্থানে তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান কালে ৬ জন ‘জৌ’ নারীপুরুষের দেখা পান।

বম জাতির সামাজিক সংগঠন

বমদের গােত্র ও পরিবার

বমরা শুনথলা (Sunthla) এবং পাংহয় (Panghawi) এই দুইটি গােত্রে বিভক্ত। এই দুই প্রধান প্রধান গােত্রের আবার অনেক উপদল ও গােত্র রয়েছে যেমন :
গােত্র উপদল শুনথলা (Sunthla) জাহাও, জাথাং, চিনজা, লনচেও, চেওরেক, সিয়ারলন, সানদৌ, তেনু, বয়তেলাং , থিলুম, ভানদির, লনসিং, লাইতাক, চেওলাই, দয়তেলাং,হাওহেং, তৌনির, লালনাম, থেলয়াথাং, মিলাই, মারাম, থাংতু, রুয়াললেং, ক্ষেংলত, লেইহাং, আইনে, লাইকেংপাংহয় (Panghawi) সাইলুক, পালাং, রােখা, সাতেক, রুপিচাই, সাখং, তিপিলিং, সামথাং, থাংমিং, সাংলা, কমলাউ, সাহু, পংকেং, লেংতং, নাকো, আমলাই, থাংথিং, বুইতিং ডেমরং, তালাকসা, মিলু, চারাং, খুয়ালরিং, সানথিং, রেমপেচে, মিত, ইচিয়া, কংতােয়া।

বম জুমচাষী।
বম জুমচাষী। ছবি – জুলিয়ান বম

ইদানীং বমরা তাদের নামের আগে বা পরে গােত্রের নাম লিখতে শুরু করেছেন। যেমন : এস লনচেও, জির কুং সাহু, জুয়ামলিয়ান আমলাই ইত্যাদি। বিশিষ্ট দুই বম নেতা পার্দো এবং দৌলিয়ান তাদের নামের পূর্বে গােত্রীয় নাম লেখার প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যেমন : পার্দো লেখেন-এস এল পার্দো, এস এল মানে সাইলুক আর দৌলিয়ান লেখেন-এল দৌলিয়ান। এল মানে লনচেও। নামের আগে গােত্রের নাম ব্যবহারের চেয়ে বর্তমানে নামের পরে গােত্রের নাম ব্যবহার জনপ্রিয় হচ্ছে।

বম পরিবারের প্রধান ব্যক্তি হলেন পিতা। পিতার দিক থেকেই সন্তানদের বংশ গণনা করা হয়। বমদের একই গােত্রে বিয়ে হয় না। নিজেদের গােত্রের বাইরে বিয়ে করতে হয়। বিয়ের ব্যাপারে ছেলে মেয়েরা মা বাবার সিদ্ধান্তই মেনে নেয়। তাদের মধ্যে বিধবা বিয়ের প্রচলন আছে। নারীরা সংসারের সকল কাজ করেও পুরুষদের কাজে সহায়তা করেন। জুম চাষ, কাঠ কাটা ও কাঠ সংগ্রহেও তারা সহায়তা করেন। মেয়েদেরও হাট-বাজারে বেচা কেনা করতে দেখা যায়।

বমদের সামাজিক প্রথা

১৯১৮ সন হতে বম জনগােষ্ঠী পর্যায়ক্রমে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হওয়াতে বর্তমানে এদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক রীতি-নীতিতেও উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন এসেছে।

বম সমাজের প্রাচীন রীতি-নীতি, প্রথা ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে বম সমাজের নেতৃবৃন্দ সর্বসম্মতভাবে ১৯৮৫ সালে বম সােস্যাল কাউন্সিল গঠন করে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ গ্রামেই সালিশের মাধ্যমে মিমাংসা করা হয়। সামাজিক বিচার সালিশের জন্য ‘বম ডান বু’ নামে বম সমাজ একটি আইনের বই প্রকাশ করেছে। এই বইয়ের আইনি নিয়মনীতি তারা কঠোর ভাবে মেনে চলে।

বমরা স্বভাবে বিনম্র । তাদের মােলায়েম ভাষায় বিশ্রী রকম গালাগালের শব্দটি পর্যন্ত অনুপস্থিত। নিজেদের মধ্যে হাতাহাতি, চুলাচুলি বা মারামারির ঘটনা বিরল। তাদের সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তিও খুবই সুদৃঢ়। সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার শালিস এবং বিবাদ মীমাংসার জন্য যে সামাজিক অবকাঠামাে রয়েছে তা অত্যন্ত প্রাণবন্ত, নির্মল, যা সামাজিক সংহতি রক্ষণে, ঐক্য ও কল্যাণ সাধনে বম সমাজকে সঞ্চারিত করে এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক আচরণ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বম সমাজের কেউ এই যাবত নিজেদের মধ্যে সংঘটিত কোনাে বিবাদ মীমাংসার জন্য কোর্ট বা অন্য কোনাে সরকারি সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছে বলে জানা যায় না।

সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার সালিশ ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বম সম্প্রদায় ১৯৪৮ সালে প্রথম Bawm Dan Bu (Bawm Customary Law) নামে একখানি পুস্তক প্রণয়ন করে। একে বম জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংবিধান বলা চলে যার নির্দেশ বিনা বাক্য ব্যয়ে আপামর বম জনগোষ্ঠী মেনে চলে।

এই সংবিধানটি সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে সংশোধনী আকারে মুদ্রিত হয়। একটি জনগোষ্ঠীর সকল কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের শিকড় হচ্ছে এই সামাজিক আইন। সুষ্ঠু সুন্দর ও সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থার জন্য প্রথাগত সামাজিক আইন অপরিহার্য। স্মরণাতীতকাল থেকে বম আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব এ প্রথাগত সামাজিক আইন দিয়ে জীবন ধারা পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু কালের বিবর্তন ধারার সাথে সময়োপযোগী পরিবর্তন না হওয়ায় এ প্রথাগত সামাজিক আইনসমূহ প্রয়ােগে বিভিন্ন সমস্যা, সংকট দেখা দিচ্ছে।

বমদের প্রথাগত আইনের উৎস

বম জনগোষ্ঠীর সামাজিক আইন প্রধানত তাদের সামাজিক রীতি-প্রথার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বম জনগোষ্ঠী তাদের সামাজিক, পারিবারিক ও গোত্রগত শৃঙ্খলা এবং শাসন সংহত রাখতে সমাজের সর্বজনগ্রাহ্য বিশেষ কিছু নিয়ম, রীতি-নীতি ও প্রথা অনুসরণ করে।

আদিবাসী বম সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি ও প্রথাসমূহকে সমাজের বিকাশ ও বিবর্তনের ধারায় বর্তমানে বম সমাজের নেতৃবৃন্দ এসব আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, বিচার-সালিশ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৪৮ সালে সর্বপ্রথম Bawm Dan Bu অর্থাৎ বম প্রথাগত আইন নামে এক খান পুস্তিকা প্রণয়ন করেন, যা পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী আদিবাসী সমাজে একটা ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। বম জনগোষ্ঠী ১৯৯৫ সনে Bawm Dan Bu-কে সংশোধন করে।

পার্বত্য এলাকায় বম সমাজ ব্যবস্থায় অদ্যাবধি জুম চাষ তাদের প্রধান পেশা। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ বিধিমতে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়ােজন হয় না, যার কারণে বম সমাজে স্থাবর সম্পত্তির তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তি বা স্থানীয় মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা তেমন একটা ছিল না বলেই চলে।

বম শাল
বম শাল । ছবি – জুলিয়ান বম

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী বম সমাজে অতীতে তেমন একটা সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য নতুন নতুন জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে এই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে অবস্থানের কারণে বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা উদ্ভব হয়েছে।

বম পরিবারে কেউ মারা গেলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজে আনুশাসন অনুসারে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার হতে হয়।

বম সমাজে সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর মৃতের সৎকার, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পাদনের পর তার অনাদায়ী ঋণ, জীবদ্দশায় সম্পত্তি উইল বা দানমূলে দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব স্থানান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়ী/দাবি মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার উপরই উত্তরাধিকারগণের দাবি/অধিকার বর্তায়।

বম জাতির সম্পত্তি বন্টন

বম সোস্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতে, সম্পদশালী স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী তার স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তি হতে ২৫%-এর আইনগত উত্তরাধিকার লাভ করবে। তবে বিধবা তার মৃত স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে যদি দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় সেক্ষেত্রে পূর্বের স্বামীর সম্পত্তির ২৫% অংশ লাভের অধিকার হারাবে।

বম সমাজের কন্যা সন্তানেরা বম সােস্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্তমানে মৃত পিতার অস্থাবর সম্পত্তিতে মাতার অনুরূপ ২৫% ভাগের আইনগত উত্তরাধিকার লাভ করবে।

পুত্র সন্তানেরা মৃত পিতার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সিংহভাগ লাভ করবে। তবে মৃত পিতার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র সম্পত্তির বৃহৎ অংশের উত্তরাধিকারী হয়।

বম জাতির অর্থনৈতিক সংগঠন

বম জনগােষ্ঠীর জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন ঐতিহ্যগত উৎপাদন ব্যবস্থা যা জুম চাষ নামে অধিক পরিচিত। বমরা সাধারণত সমতল ভূমিতে বাস করে না। গিরিচূড়ায়, উঁচু পাহাড়-পর্বতে, গভীর অরণ্যে তাদের বসবাস। বন্য জন্তু-জানোয়ার ও পশুপাখি শিকারে তারা নিপুণ।

বন্য জন্তু-জানোয়ার ও পশুপাখি শিকারে এক বম শিকারী
বন্য জন্তু-জানোয়ার ও পশুপাখি শিকারে এক বম শিকারী। ছবি : জুলিয়ান বম

পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭২.৯% ভূমি খাড়া পাহাড় ও পর্বত বিধায় ভূতত্ত্ববিদদের মতানুযায়ী তাতে কেবল বন করার উপযােগী। পার্বত্য অঞ্চলে জুম চাষ একসময় অতি নির্ভরযোগ্য এবং কার্যকর অবলম্বন ছিল।

ফলনও হতাে প্রচুর। সারা বছরের ধান, মরিচ হতাে আর অর্থকরী হিসেবে কার্পাস তুলা, তিল প্রচুর উৎপন্ন হতাে। তুলা উৎপাদনের জন্য পার্বত্য অঞ্চলকে তৎকালে ‘কার্পাস মহল’ বলা হতাে।

এককালে যে পাহাড় প্রচুর ফলন দিত সে পাহাড় আজ উৎকর্ষহীন, শীর্ণকায়, রুক্ষ এবং ন্যাড়া । জুম চাষের অনেক অসুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন : একই পাহাড়ে পর পর চাষ করা যায় না। এক চাষের পর পরবর্তী চাষের জন্য কমপক্ষে ৩ থেকে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়।

পাহাড়কে বিশ্রাম দিতে হয় যাতে গাছ-গাছালি, লতা-গুল্ম জন্মে এবং মাটিকে উর্বর করে। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বনায়ন কার্যক্রমের জন্য জুম চাষের পাহাড় কমে গেছে। জনসংখ্যার চাপ, জুম চাষের ক্রমােৎপাদন এবং অনির্ভরযােগ্যতার কারণে জীবিকার বিকল্প উপায় হিসেবে কাঠ আহরণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।

এই অবাধে কাঠ আহরণ পার্বত্য অঞ্চলের বনজ সম্পদ উজাড়করণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেই চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূ-প্রাকৃতিক কারণে ভূমির উর্বরতা ও চাষযােগ্য ভূমির পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা দেশের অপরাপর অঞ্চল হতে বেশি।

বিপর্যয়ােন্মুখ অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে ফল চাষের জন্য জোর প্রচারণা চালান হয় বম সমাজে। জীবন নির্বাহের নির্ভরযোগ্য উপায় হিসেবে ফল চাষকে চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে বম পরিবারগুলো নেমে আসতে থাকে নদীর নিকটবর্তী পাহাড়ে, অপেক্ষাকৃত সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা বা বাজারের নিকটবর্তী এলাকায়।

রুমা উপজেলার ১ থেকে ১০ কি. মি.-এর মধ্যে গড়ে উঠে উল্লেখযোগ্য বম বসতি। যেমন : বেথেল, এডেন, লাইরুনপি, মুনলাই, বেথলেহেম, নাজারেথ ও তলাংনুয়াম পাড়া সমূহ, যেখানে ৩৩১ বম পরিবার ফল চাষ করে জীবন ধারণ করছে। বান্দরবান জেলা শহরের নিকটবর্তী পাহাড়েও বম বসতি ১৯৮০ সালের দিক থেকে শুরু হয়েছে।

চিম্বুক রােডে গড়ে উঠেছে লাইমি, ফারুখ, লাইলুনপি, শারণ ও গেটশিমানী পাড়া ইত্যাদি আর বালাঘাটা ও মেঘলার কাছাকাছি আরাে ৪টি বম পাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাড়ার নামগুলাে হলাে হেব্রন, চিনলুং ও কানা পাড়া। রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার কাছে আরাে ৪টি বম বসতি গড়ে উঠেছে। এই তথ্যানুযায়ী ৭৩৭ পরিবার পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে জুম চাষ পরিত্যাগ করে নির্দিষ্ট বন্দোবস্তিকৃত পাহাড়ে ফল চাষ করে জীবনধারণ করছে, যা বম জনগােষ্ঠীর ৩৮%।

আশির দশকের এই নবউদ্যোগকে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক বড় পরিবার স্বাগত জানায়। বাগান করার জন্য নির্দিষ্ট পাহাড়/ভূমি নিজ নামে বন্দোবস্তি নেওয়া শুরু করে। নতুন জায়গায় নিজ নামে পাহাড় বন্দোবস্তি নেওয়ার এই উদ্যোগ/প্রচেষ্টা শুধুমাত্র নতুন জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে নাই।

যত বম গ্রাম রয়েছে অনেকেই এই সময়ে বন্দোবস্তি নিয়েছে। বম সমাজের ৫০ শতাংশ পরিবারের পাহাড়/ভূমি বন্দোবস্তি আছে বলা যায়।

১৯৫০ সাল থেকে বমরা হর্টিকালচারের দিকে সোৎসাহে মনােনিবেশ করে এবং উৎপাদন ক্ষেত্রেও সাফল্য অর্জন করে। এই অঞ্চলের আনারস গুণে ও মানে উৎকৃষ্ট। কালুরঘাটস্থ মাল্টিপল জুস প্লান্টের কাঁচামালের পুরাে চাহিদা পূরণের পরও খোলা বাজারে বিক্রির জন্য আনারসের স্তুপ লক্ষ করা যেত প্রতিটি পাড়ায়।

ক্রমে ক্রমে ফলনে ভাটা পড়তে থাকে বাজারজাতকরণে বিস্তর সীমাবদ্ধতা, অনুন্নত যােগাযোগ ব্যবস্থা, সংরক্ষণ ও গুদামজাতকরণের কোনাে ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি কারণে উৎপাদিত দ্রব্যের ন্যায্য দাম না পেয়ে চাষিরা নিরুৎসাহিত হতে থাকে।

ব্যবসা-বানিজ্যে অনভিজ্ঞতা, ভাষার সীমাবদ্ধতা ও সমতল এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় টিকতে না পারা, ব্যবসার নিয়মনীতি বা কলাকৌশল না জানা প্রভৃতি কারণে প্রধান অর্থকরী ফসল আনারস চাষের উৎসাহ ক্রমশ কমেছে। দ্রুত পচনশীল বলে এই ব্যবসায় ঝুঁকিও অনেক।

উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ফলনের গুণগতমান বৃদ্ধি করার জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি প্রয়ােগের চেষ্টা বা উদ্যোগও নেই, পৃষ্ঠপােষকতাও নেই। আরেকটা কথা, যেসব পরিবার ফল চাষ করছে তাদের সবার নিজস্ব পাহাড় বা বাগান নেই। পাড়াপড়শী এবং কাছের আত্মীয় স্বজনদের পাহাড়গুলাে তারা ভাগাভাগি করে থাকে। প্রতি পরিবারের গড়ে ৫ একরের বেশি বন্দোবস্তি নেই।

সেই ৫ একরের সব পাহাড়ও আবার চাষের উপযুক্ত নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভূমি খাড়া অথবা এবড়ো-থেবড়ো শিলাময় পাহাড় যা চাষের উপযুক্ত নয়। কম মূল্যবান গাছগাছালি, ছােট ছােট বাঁশ ও তার সাথে লতাগুল্ম ছাড়া এইসব জায়গায় কিছুই উৎপাদিত হয় না। চুপচাপ, স্বল্পবাক, শান্তিপ্রিয় ও গােটানাে স্বভাবের বম লােকেরা কখন যে ব্যবসা-বাণিজ্যিক লেনদেনে পদচারণা করবে! রাজ্যের লজ্জা, সংকোচ যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। অন্যের জন্য নিজেকে সে গুটিয়ে নিয়ে ছাড় দিয়ে নিরপেক্ষ থাকে বা অন্যকে জিতিয়ে দেয়।

সমবায়ের ভিত্তিতে এই জড়তা কাটিয়ে উঠা যায়। প্রয়ােজন উদ্যোগের। জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধিওয়ালা হাতে গােনা কয়েকজন বম নেতৃবর্গ আছেন এ বিষয়ে তাদের মনােযােগ দেওয়া অতি জরুরি। বম আদিবাসীরা ৮০ ভাগ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। তবে বাংলায় নয়।

ইংরেজি বর্ণমালায় মিশনারিদের প্রবর্তিত পদ্ধতিতে অবলীলায় বম শব্দগুলাে লেখা যায়। সমবায়ের শিক্ষাদান ও পরিচালনায় এই অবস্থা খুবই সহায়ক হবে। তা ছাড়া বর্তমান প্রজন্মের সবাই বাংলায় লেখাপড়া করে। দুয়েকটি বাদ দিলে প্রতি বম গ্রামেই হয় সরকারি নয় নিজেদের উদ্যোগে স্কুল রয়েছে।

বম জাতির ধর্মীয় অবস্থা

আদিবাসী বম জনগোষ্ঠী এককালে জড়োপাসক ছিল। জড়োপাসক বম জনগােষ্ঠীর মধ্যে ভূত-প্রেত, ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্র, ওঝা-বৈদ্য, জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি বিশ্বাস ছিল। বমরা খুজিং-পাথিয়ানকে বিধাতা পুরুষ মানে, তিনি স্রষ্টা, তিনি কখনাে রুষ্ট হন না, তিনি সদা কল্যাণময়ী। তাই বমদের খুজিং বা পাথিয়ান এর প্রতি পূজা, যজ্ঞ, বলিদান, অর্ঘ্য নিবেদন কিছুই করতে হয় না। কেননা তিনি কারো অমঙ্গল করেন না। যত পূজা, যজ্ঞ, অর্ঘ্য নিবেদন করা হয় সবই অপদেবতার উদ্দেশ্যে।

কারণ যত অকল্যাণ, তা জ্বরা, ব্যাধি-মৃত্যু, ফসল-হানি, খরা-অনাবৃষ্টি, প্লাবন, মহামারি সবই তাদের কীর্তি। তাদের তুষ্টি বিধানের জন্যই যত পূজা, অর্চনা, যজ্ঞ-বলিদান, অর্ঘ্য নিবেদন আবেদনের আয়ােজন করা হয়।

বম গির্জা
বম গির্জা। ছবি- জেরেত বম

তদুদ্দেশ্যে হরেক রকমের বিচিত্র নিয়মকানুনের মাধ্যমে যে পূজা অর্চনা বলিদান তারই নাম ‘বলশান’ (Bawlsan)। সমস্ত বলশানের পুরােহিত্য করেন ‘বলপু’ (Bawlpu)। ১৯১৮ সন হতে বম জনগােষ্ঠী পর্যায়ক্রমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়াতে বর্তমানে এদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক রীতি-নীতিতেও উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন এসেছে।বমদের জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন জুম চাষকে কেন্দ্র করেই ‘বলশান’ পূজা পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে কোনো না কোনো উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পূজা-পার্বণগুলাে আয়ােজন করে থাকে তারা। নীচে তার দুয়েকটি বর্ণনা দেওয়া হলাে।

বমদের খুয়া-টেম (পাড়া শুদ্ধি) :

খুয়া-টেম বা পাড়া শুদ্ধি বমদের অতি গুরুগম্ভীর অত্যাবশ্যকীয় অনুষ্ঠান। পাড়া/গ্রামের কল্যাণ কামনায় খুয়া-টেম বা পাড়া শুদ্ধি অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

পাড়ায় অসুখ-ব্যামাে, জুমের ধানের শীষ সাদাটে হওয়া, ভুট্টার গাছ বা কুমড়ার লতা লিকলিকে শীর্ণকায় থাকা, এসবই হয়ে থাকে ‘জল খুরী’ অপশক্তির কারণে। সে পাড়ায় আস্তানা গাড়ার কারণে হয়ে থাকে যত অকল্যাণ, অসুখ-পীড়া, জরা-মৃত্যু আর ফসলহানি! এই অপশক্তি বিতাড়নের মহা আয়ােজনই হলাে পাড়া শুদ্ধি বা খুয়া-টেম।

গ্রাম শুচিকরণ অনুষ্ঠানে পাড়ার শিশু, নারী পুরুষ যুবক সকলের অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। গ্রামের লােকেরা নাম জানা, না জানা বিবিধ বৃক্ষের শিকড়, বাকল, লতাগুল্ম, আধপােড়া খড়ি, কয়লা, নানান রকম হাড়ের টুকরা, মাটির হাঁড়ির ভাঙ্গা টুকরা সংগ্রহ করে পাড়ার মধ্যস্থানে সমান জায়গায় স্তুপ করে রাখে।

লতাগুল্ম, গাছের শিকড়-বাকলগুলাে কুচি-কুচি করে কাটে। হলুদ চুনা মিশ্রিত পানি ছিটিয়ে মিশ্রণগুলােকে রঙিন করে নেয়। এই মিশ্রণ পাড়াময় ছিটানাে হয় মানুষের ঘরে, মুরগির ঘরে, গােলাঘরে, ঢেঁকিশালায়, গােয়ালঘরে, ঘরের মাচার নীচে, পােকার গর্তে, মাটির ফাঁক-ফোকরে—সর্বত্রই।

পাড়ার ‘বলপু’ পুরােহিত মশাই মিশ্রণের এক মুঠি হাতে নিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্রের মতাে উচচারণ করে-

‘পাড়ার যত অকল্যাণের আখড়া তুই, নাম তাের কি জানি
না, তাের আস্তানা ঠিক কোনাে গর্তে জানি না—কাঁকড়ার গর্তে?
গাছের ফাঁক ফোকরে? ছনের চালের কোনাে কোণায়? নাকি
কোনাে মানুষের নাকের কানের গর্তে? যেথায় ঠাঁই নিস না ।
কেন আজ তােরে বিদায়। যা, দূর হ, ঐ দূর পর্বত শৃঙ্গে যা,
পূর্ব কি পশ্চিম উত্তর বা দক্ষিণ তাের তাে সীমাহীন আস্তানা,
সেথায় যা না।’

মঙ্গল প্রার্থনার পর নারী-পুরুষ চুন এবং হলুদের ভাঁড়ে চুবান রঙিন করা ফিতা কেউ হাতে, কেউ গলায়, কেউ কানে পড়ে। এ ফিতা এক সপ্তাহ গায়ে রাখার নিয়ম আছে।

বেলা প্রায় পড়ে এলে গ্রামের চারিদিকে ডাকাডাকি, খোঁজ-খবর করা হয়, এ সময় প্রতিটি নর-নারী গ্রামে ফেরা চাই। নয়তাে ভােগান্তি আছে। পাড়ার সব বাড়ির লােক গণনা করা হয়। পাড়ার বাইরে আর কেউ নেই—এটা নিশ্চিত হবার পর চার হাত লম্বা বাঁশের ফালি দিয়ে রামধনুর মতাে করে পুঁতে পাড়ার সকল প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এরপর পাড়ার কোনাে লােকের বাইরে যাওয়ারও নিয়ম নেই, ভিন গ্রামের লােকদের প্রবেশেরও নিয়ম নেই। অনুষ্ঠানের রাত আর তার পরের দিন বাইরের সাথে গােটা গ্রামবাসী বিচ্ছিন্ন, সংযােগবিহীন হয়ে থাকতে হবে।

গ্রামের কারাে বাড়ির উঠানে, আঙিনায় বা চালে এক টুকরাে কাপড়ও টাঙানাে থাকতে পারবে না। কারণ কোনাে কাপড়-চোপড় বিশেষ করে মেয়েদের পরিধানের বস্ত্র ঘরের বাইরে থাকলে তা এই ‘পাড়াশুদ্ধি’ বা গ্রাম শুচিকরণ অনুষ্ঠানকে অকার্যকর করে দেয়।

এই খুয়া-টেম বা পড়াশুদ্ধির দিনে দৈনন্দিনের হরেক রকম কার্যাদিও নিয়মমাফিক সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষ রীতিতে অতি সতর্কতায় ঝরনার পানি তুলতে হয়। পিঠে করে লাউয়ের খােলে পানি আনার সময়ে কারাের পিঠ বা কাপড় ভিজলে খুয়া-টেম বা পাড়শুদ্ধি অনুষ্ঠানকে অকার্যকর করে দেয়।

পাড়ার সকল নারী-পুরুষ সেই অপশক্তি বিতাড়নের মহৌষধি মিশ্রণ যে যার থুরং- এ ভরে নেয়। সবার হাতে থাকে একখানা শলা ঝাড়ুর মতো ফালি ফালি করা প্রায় এক হাত লম্বা বাঁশ। এবার পাডাময় মিশ্রণ ছড়াও। হৈ রৈ চিৎকারসহ বাঁশের ঠোকাঠুকি, প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে সজোরে আঘাত, আর সমস্বরে আওয়াজ তোলা হয়, ‘দূর হ, দূর হ।’

পাড়ার মাথায় শেষ হয় মিছিলটি। এরপর থুরুংগুলাে আর বাঁশের ঝাড়ুগুলাে উল্টো করে স্তুপ করে রেখে সবাই যে যার বাড়ি চলে যায়। এবার সব কোলাহল বন্ধ। পাড়াময় নীরবতা আর নিস্তব্ধতা। সেই রাত্রি আর পরের দিনের জন্য কোনাে কথা বলা নিষিদ্ধ। ততক্ষণে সূর্যদেব অস্ত গিয়েছে, পড়ে থাকে চুপচাপ, নিথর সাড়াশব্দহীন গােটা গ্রাম।

এই অরণ্যের প্রায় সকল আদিবাসী সমাজের কাছে ‘পাড়াশুদ্ধি’ এক অতি গুরুগম্ভীর অত্যাবশ্যকীয় অনুষ্ঠান। এর অবশ্য নির্দিষ্ট দিন-মাস নেই, সমাজে বয়ে যাওয়া বিচিত্র ঘটনাপঞ্জি এবং প্রকৃতির খেলাই এ পর্বের নির্ধারক।

এই আরণ্যকরা যার প্রসন্নতা সাধন এবং তুষ্টি বিধানে ব্যস্ত ও ব্যাকুল, সেই শক্তি থাকে কাঁকড়ার গর্তে, পাহাড়ি ঝরনার উৎসমুখের সেই স্যাঁতসেঁতে পাহাড়ের খাদে, জুমের আগুনে আধ পোড় খাওয়া বৃক্ষের ফাপড় বা গর্তে, চুলার মুখে, শিলা পাথরের গুহায়, এ যে সর্বব্যাপী। তাই এদের তুষ্টি বিধানের জন্য হরেক রকমের আচার-প্রথা, পৰ্বাদি এই আরণ্যকরা পালন করে।

বমদের লৌ থিং কুং বল (জুম মঙ্গল পূজা)

এক জুমবছর অনেক হাসি কান্নার স্মৃতিতে ভরা। যে জুম তাকে সারা বছরের আহার পানীয় যুগিয়েছে, সুস্বাস্থ্য দিয়েছে সেই জুমের আত্মা মালিকের পিছু ছাড়ে না তিন বছর। সেই জুমের প্রতি অকৃতজ্ঞ বা অবহেলা করলে তার অমঙ্গল হয়। তাই জুমের আত্মার সন্তুষ্টির বিধান বাঞ্ছনীয়।

জুম পূজা/অনুষ্ঠান হলাে জুমের আত্মার সন্তুষ্টি সাধন। জুম মঙ্গল পূজার আগের দিনে পাড়ার মেয়েরা ঢেঁকিতে ধান ভানে, বিনি ধানের পিঠা বানিয়ে রাখে। পুরুষরা খুব ভােরে উঠে জুমে যায়। সারা জুম পথে চালের গুড়া ছিটাতে ছিটাতে যায়। জুমে পৌঁছলে জুমের জন্য জঙ্গল কাটার প্রথম দিনে একটি গাছের নীচে যে পাথরটি মাটির নীচে পুঁতে রাখা ছিল তা খুঁজতে থাকে।

বম শিশুর নামকরন
বম শিশুর নামকরন । ছবি জুলিয়ান বম

সেই গাছ এবং পাথর খুঁজে পাওয়া খুব সহজ কাজ নয়, সারা দুপুর চলে যায়। পাথরটি খুঁজে পাওয়া মাত্র সকলেই আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠে এবং জুমের মাটি কপালে মাখে। সেই পাথরটি যেখানে জুম আলুর গর্ত আছে তার পাশে লম্বালম্বিভাবে পুঁতে রাখে, তার পাশে একটি মারফা ও একটি বাঁশের চোঙ্গাও পুঁতে। পুঁতে রাখা পাথরের উপরে চালের গুড়া ছিটায়। মােরগ অথবা শূকর কেটে বলি দেয়। মাংসগুলি পূঁজার ডালায় নিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে-

‘কোথায় সব তােমাদের বসতি চিনি না, জানি না, কাঁকড়ার গর্তে? গাছের ফাঁকে-ফোঁকরে? পাথরের গর্তে? জুমের কোনাে প্রান্তে? যেখানে থাকো বেরিয়ে এসাে, এই দেখাে তােমাদের উদ্দেশ্যে আমাদের অর্ঘ্য। এই যে মারফা, এই যে দুই মুঠা শূকর, এই যে মোরগ, এই এসাে সন্ধি করি, আত্মীয় কুটুম করি, হৃষ্টপুষ্ট ধানের শীষ প্রার্থনা করি, সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করি।’

পুঁতে রাখা পাথরটির চারিদিক বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখে, পূজার ঘরের মতো ঘর বানায়, তাতে ফুল দেয়, আর কলা পাতা ও মােরগের পালক দিয়ে সাজিয়ে রাখে। তার মধ্যে কলা পাতায় করে রান্না করা মাংস, তরিতরকারি প্রভৃতি উৎসর্গ করে। আর কিছু কাঁচা মাংস কলার পাতায় বেঁধে ঘরে ফেরার পথে প্রতিটি গাছের গোড়ায় রেখে আসে। প্রতিটি গাছ যেন আরাধ্য দেবতা। তার পরের দিন জুমের মালিকের জুমে যাওয়া নিষেধ।

বমদের রুয়া-খা-জার (বৃষ্টির আহবান)

রুয়া-খা-জার হলো জুমের ফসল ভালো হওয়ার জন্য বৃষ্টির কামনা। অনাবৃষ্টি ও খরা হলে তাদের জীবন বিপন্ন হবে, ফসল তোলা যাবে না। অপদেবতার কোপদৃষ্টি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এবং অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রুয়া-খা-জার-এর আয়োজন করা হয়।

প্রতি পূজায়/অনুষ্ঠানে উপচার বা জীব বলি অত্যাবশ্যক হলেও এই বৃষ্টি আহবান অনুষ্ঠানের জন্য কোনাে জীব বলি অত্যাবশ্যক নয়, এর জন্য নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ নেই। জুমের আগাছা, লতাগুল্ম, জঙ্গল পরিষ্কার শেষে কোনাে একদিন বৃষ্টির কামনার জন্য একটি দিন ঠিক করে নেয় তারা। এই বিশেষ দিনে তারা ফসল ভালো হওয়ার জন্য বৃষ্টি কামনা করে প্রার্থনা করে।

মেয়েরা অতি ভােরে ঝরনার পানি আনতে যায়। পানির পাত্র হিসাবে ব্যবহার করা লাউ-এর খােলের মুখ অতি যতনে পাথরে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করে । থুরুং-এর মধ্যে অতি সতর্কতার সাথে একটার উপর আরেকটা বসিয়ে দেয় যাতে উল্টিয়ে গিয়ে পানি পড়ে না যায়। এটিও যেন একটা শিল্প। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে উঠা নামার সময়ে থুরুং-এ সাজানাে পানির পাত্রগুলাে সুশৃঙ্খলভাবে থাকা চাই। যাদের পিঠ ভিজে যায়, সারা পথে যার পানির জন্য পাহাড়ি পথ পিছলিয়ে দেয় তার যথেষ্ট দুর্নাম হয়।

পুরুষেরা বাড়ির চারিদিকের জঙ্গল পরিষ্কার করে, মাচাং ঘরের নীচে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে। ঘরের নীচ দিয়ে বৃষ্টির পানি যাতে না যায় তার জন্য নালা কাটে । ঘরের সিঁড়ি মেরামত করে, প্রয়ােজনে গাছ/বাঁশ পাল্টিয়ে দেয়। জীব বলী না থাকায় এই রুয়া-খা-জার-এ আনুষ্ঠানিকতা নেই।

বর্তমানে বম, পাংখুয়া এবং লুসাইরা একশত ভাগই খ্রিস্টিয়ান। তাদের মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে। ভারতের মণিপুর ও মিজোরামের একই ভাষাভাষী স্বগােত্রীয় লুসাইরা বমদের কাছে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করেন। তারা ভারতের মণিপুর রাজ্যের চুরাচাঁদপুর (Churachandpur)-এ অবস্থিত নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া জেনারেল মিশন সংক্ষেপে (Neig Mission)-এ চাকরি করতেন।

এই মিশন তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মিশনারি কাজে প্রেরণ করে। স্থানীয় লােক প্রেরণের পূর্বে এক আমেরিকান মিশনারি Rev. Roland Edwin সাহেব ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে এতদঞ্চলে পরিভ্রমণ করেন। বম সমাজে খ্রিস্ট ধর্ম শিক্ষা, চার্চ প্রতিষ্ঠা এবং সম্প্রসারণের প্রধান ভূমিকা পালনকারী স্বর্গীয় পাষ্টর এইচ ডালা’র ( Pastor H. Dala) সন্তানেরা বম সমাজের নেতৃত্বস্থানে আজ প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেকেই আজ শিক্ষকতা, ধর্ম শিক্ষা এবং সমাজ সেবায় নিয়ােজিত।

বম জাতির ভাষা, লােকসংস্কৃতি ও সাহিত্য

বমদের ভাষা ও বর্ণমালা

বমদের নিজস্ব ভাষা আছে। খ্রিস্টান মিশনারি আসার আগে বম ভাষায় কোনো বর্ণমালা ছিল না। ১৮৯৪ সালের দিকে দুজন খ্রিস্টান মিশনারি রোমান হরফ অনুসরণে নতুন বম বর্ণমালা তৈরি করেন। এখন বম ভাষায় বেশ কয়েকটি বই ও একটি মাসিক পত্রিকা রয়েছে।

বম আদিবাসী কুকি-চিন ভাষাভাষী মঙ্গোলীয় গােষ্ঠীভুক্ত। খ্রিস্টান মিশনারিদের আগমনের পূর্বে বম, পাংখুয়া, লুসাই, তথা মিজো/জৌ ভাষায় কোনাে বর্ণমালা ছিল না। Rev. J.H. Lorrain Ges ও Rev. F. W. Savidge খ্রিস্টান মিশনারিদ্বয় আইজলে আসেন ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে।

তারা রােমান বর্ণমালা অনুসরণে বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। তা দিয়ে বাইবেলের অংশ, ধর্মীয় শিক্ষার পুস্তিকা, অভিধান ইত্যাদি বের করেন। মিজোরাম থেকে আগত লুসাই ধর্ম প্রচারকগণ এই বর্ণমালা বম-পাংখুয়াদের মধ্যে প্রচলন করেন। এই একই বর্ণমালা বম-পাংখুয়ারা ব্যবহার করে।

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময়গুলােতে যখন বম-পাংখুয়ারা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে তখন থেকে এই বর্ণমালার ব্যবহার শুরু হয়। প্রথমাবস্থায় লুসাই ভাষার বাইবেল, ধর্মীয় সংগীত ব্যবহৃত হতাে। পাংখুয়ারা এখনাে লুসাই ভাষার (মিজো ভাষা) বাইবেল ব্যবহার করে । বমদের নিজস্ব ভাষায় পবিত্র বাইবেল অনূদিত হয়েছে।

বাইবেল ছাড়াও ধর্মীয় সংগীত, বাইবেলের ব্যাখ্যাসহ ধর্মীয় পুস্তিকা এবং অন্যান্য বেশ কয়টি বই-পুস্তিকা বম ভাষায় রয়েছে। ইভাঞ্জেলিকাল খ্রিস্টিয়ান চার্চ কর্তৃক প্রকাশিত Kawhmi Arfi নামক মাসিক পত্রিকা রয়েছে।

বম ছাত্র সংগঠন ‘বম স্টুডেন্টস অ্যাসােশিয়েশন’ জির কুং সাহু কর্তৃক সম্পাদিত লাই-ইংরেজি অভিধান বের করেছে। বম ছাত্র সংগঠনের ‘মেনরিহয়’ নামে বার্ষিক ম্যাগাজিন রইয়েছে।

বর্ণমালা পরিচিতি প্রাথমিক বই (Bawm Premier) পারিবারিক উদ্যোগে অথবা গির্জা অথবা পাড়া, সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় শিশুদের পড়ানো হয়। ভালাে কথা যে, বম সমাজের শতকরা আশি জন নিজ ভাষায় লেখাপড়া জানে। চিঠিপত্র, লেনদেন, হিসাবপত্র, সভা সমিতির কার্য বিবরণী, নথিপত্র তথা সামগ্রিক সামাজিক যােগাযােগ বম ভাষায় সম্পাদিত হয়। এ ক্ষেত্রে বম সমাজ অনেকখানি এগিয়ে আছে।

বম লােকসঙ্গীত

বমদের লোকসঙ্গীত বিশেষ স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বমদের অনেক প্রাচীন গাথা রয়েছে। বম আদিবাসীদের সমাজ জীবনে তাই এতাে গান। এমন কোনো লৌকিক উৎসব আচার অনুষ্ঠান নেই যেখানে নৃত্যগীত নেই।

বম

নান দু থু সিম লা উ
নান দু লা সাক উ মিনতি করি বলাে না কথা
গেও গান পরান ভরে

বঙ্গানুবাদ

প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রাণের আর্তি, বিরহ ব্যথা, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, সমাজের মানুষের মনের কথা, প্রেম-ভালোবাসা, মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা সমস্তই প্রকাশ পায় সংগীতে! প্রেমিক প্রেমিকার বিরহ বেদনা, প্রেম-অনুরাগ, সখ্যতা আদান প্রদান হয় সুরের মাধ্যমে। ‘রিরৎ’ (এক প্রকার এক তারা), ‘মিমীম’ (ধানের নাড়া দিয়ে তৈরি বাঁশি) আর ‘জলপাল’ (এক প্রকার বাঁশি) বাজিয়ে যে সুর সৃষ্টি হয় তাতে বিরহ বেদনা ও বিচ্ছেদের ব্যথা মূর্ত হয়ে উঠে। কথা নেই আছে শুধু সুর। আছে এক সহজ-সরল আবেদন।

বম লােকনৃত্য

বমদের রােখা (বাঁশ নৃত্য) :

বম আদিবাসীদের সমাজ জীবনে আনন্দোৎসবের চেয়ে শােকানুষ্ঠানের প্রাধান্য লক্ষণীয়। রােখা নামে বিখ্যাত নৃত্যগীত আনন্দের নয় শােকানুষ্ঠানে হয় কারাের অপঘাত মৃত্যু, প্রসবজনিত মৃত্যু অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এই নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হয়।

শােকার্ত পরিবারের বাড়ির উঠানে সমান জায়গায় যুব-যুবা, প্রবীণ, বৃদ্ধরা সকলেই সমবেত হয়। এই নৃত্যগীতে যুবক-যুবতীরা সাধারণত অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা করে। নিজেদের মধ্যে অনুনয় বিনয় আর এক রকম জোরাজুরিতে অবশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করে।

জোড়া জোড়া লম্বা বাঁশের দুই প্রান্তে আড়াআড়িতে দুবার উপরে নীচে, দুবার পাশাপাশি অর্থাৎ একবার ফাঁক একবার চাপা ঠোকাঠুকিতে ছন্দতাল সৃষ্টি হয়। যখনই ফাঁক পড়বে সুচারু পদস্ফালন করে বৃত্তের আকারে যুবক যুবতীরা নেচে নেচে ঘুরে যায়।

বম যুবক-যুবতির ঐতিহাসিক বাঁশ নৃত্য।
বম যুবক-যুবতির ঐতিহাসিক বাঁশ নৃত্য। ছবি- জুলিয়ান বম

পূর্বপাশে উপবিষ্ট অন্যরা তখন গান গেয়ে চলে। বিরহ বিধুর একটা করুণ সুর এই গানে ধ্বনিত হয়। বিচ্ছেদের ব্যথা মূর্ত হয়ে উঠে। ছন্দে ছন্দে বাঁশের ঠোকাঠুকি আর হালকা চপল গানের সুর শােকের পরিবেশকে হালকা করে। শােকার্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দান ও সাহচর্য দেওয়া এই নৃত্যগীতের মূল বিষয়বস্তু।

বম

রােখা তলা হেন
আয় খালান, কান, পু লু চু,
থলান মেন্ আ রল মান রী লৌ হেন;
কা হয় মান লৌ না রেঃ লান্
রােখা তলা হেন
লুংতিয়াম আ কিয়াম, মান রী লৌ
কাথাই কীর মেন্ কীর মেন্ কীর মেন্
কা রুণ-আল মুন লৌ হি তেঃ
রােখা তলা হেন
কান জুয়াত মায়সিয়ল নু বাং আয়
কা হয় থলা মী কা হয় থলা মী
খয়ানু নিঃ আ তেলই তির তুয়ান।
রােখা তলা হেন
তিলিম মার ঙৌ কী ঠা খী,
মাল সম্ মানলৌ না রেঃ লান
লেই দায় তাং দাঙ না যাওয়ে।

বঙ্গানুবাদ

পিতামহের মরদেহ মাটিতে যায় নাই মিলে নয়ন জুড়ে তােমায় না দেখতেই
চলে গেলে আমায় ছেড়ে।
মনে সাধ পুরল না রে বধূ
ওগো বধূ ফিরে এসাে ফিরে এসাে
ঘর যে আমায় বড় শূন্য হলাে।
সােহাগী গয়ালরে যেমন রাখতাম আদরে নয়নভরে দেখতাম দিবানিশি যারে
বিধাতা ছড়িয়ে নিলাে ত্বরা করে
চেয়ে দেখাে সােহাগী গয়ালটির শিং দুটি
আসছে পাবণ-উৎসবে উঠব যে মেতে
শুয়ে রয়েছে যে নরম মাটির কোলে।

বমদের সাবাংরুয়াই (Savangruai) :

এটি কোনা বিত্তবান লােকের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজিত আনন্দ উৎসব। এতে সব গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করে থাকে। আয়োজক গৃহস্তের শৌর্য বীর্য খ্যাতি গুণকীর্তনই এ অনুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু। গৃহস্থের বাড়ির আঙিনায় নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকারে একবার সামনে একবার পেছনে ধীরগতিতে তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করে। এদের মধ্যে এক মূল গায়েন গানের মধ্য দিয়ে আয়োজক বিত্তবানের বীর রসাত্মক কাহিনী পরিবেশন করে আর অন্যরা দুয়াে তোলে।

গ. লাদৌ বা বর-লা (Lado /Vawr La) : এটি সফল শিকারির আনন্দ উল্লাসের গীত। শিকারলব্ধ বন্যজন্তুর মাথাসমেত গ্রামের প্রবেশদ্বারে উচ্চৈরবে উদ্ধত ভঙ্গিতে আস্ফালন সহকারে যে বীররসাত্মক গীত গাওয়া হয় তাকে লাদৌ বা বর-লা বলা হয় ! খ্যাতিমান শিকারি তার শিকারলব্ধ জন্তুর মাথা উঁচুতে ধরে বিজয়ের গীত গায় আর সঙ্গীরা দুয়াে তুলে।


বম

খুয়াই অ্যা আ কাপ লৌ তিন অ্যা
বাল মে তেলায়াংখং লা উ অ্যা
কান পুন অ্যা আলতিলং শন থলাই অ্যা
কান লেই রি আঃ নাক অ্যা
কা খুপ অ্যা, কা হয় বাল রােয়াল লাকাঃ খিন অ্যা
লেং অ্যা আ লেং হেন হং কা জৌ উ ল,
তুলাং আঃ অ্যা লেই সক বাং রিং জিল অ্যা
জেল হেন দাঃ কা সুয়াক অ্যা।

বঙ্গানুবাদ

ওহে যদি শুয়াের ভালুক নাই ফেলেছাে
কীসে তােমার দর্প আস্ফালন
তাকিয়ে দেখাে ঐ যে যশমান শিরােমণি
আমি চলি চূড়ায় চূড়ায়।

সিয়া কী দেং (Sia ki deng) :

সিয়া কী দেং বা শিং নৃত্য মৃতদের স্মরণোৎসব অতি ব্যয়বহুল ভোজ উৎসব। কেবল বিখ্যাত মৃতলােকের স্মরণার্থে এই নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে। জীবৎকালে তার যশ, খ্যাতি ও নানান সুকীর্তির কথা পরিবেশন করাই শিং নৃত্যানুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু।

অংশগ্রহণকারী সকলই পুরুষ। মাথায় পাগড়িসহ উত্তম পােশাক পরিধান করে একক অথবা সমবেতভাবে নৃত্য পরিবেশন করে। এই নৃত্যে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। শিং জোড়া হাতে নিয়ে প্রথমে সামনে, উঁচুতে, পিছনে এবং বাঁ পা উঁচু করে উঠিয়ে, একইভাবে ডান পা উঁচু করে উঠিয়ে ফাঁকে শিং দুইটি ঠুকঠাক বাজায়, আবার এক পা অপর পায়ের সাথে জড়িয়ে হাটু মাটিতে না লাগিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে নিতম্ব মাটিতে বাজিয়ে আবার উঁচিয়ে শিং দুটির ঠুকঠাক তালে তালে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এই নৃত্যে শারীরিক সক্ষমতা এবং বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন হয়। এই নৃত্যে গীত হয় না।

বমদের সালু লাম (Salu lam) :

গৃহের সম্মুখ দেয়ালে সারি সারি সাজানো বন্যজন্তুর মাথা/কঙ্কালগুলাে জীবৎকালে অন্তত একবার শুচিকরণ করা বিধেয় নয়তাে পরকালে হত্যার জন্য এরা হিংস্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এরকম বিশ্বাসের জন্য ‘সালু লাম’-এর আয়োজন। রীতি অনুযায়ী শুচিকরণ সম্পন্ন হলে তারা গৃহকর্তার বশীভূত হয়।

তার শিকার করা পাখি দেখাচ্ছে এক বম শিশু
তার শিকার করা পাখি দেখাচ্ছে এক বম শিশু। সুত্র: kapaeeng.org

সে উদ্দেশ্যে দেয়াল থেকে সব মাথাগুলাে নামানাে হয়, দাঁত, চোখ, চোয়াল, শিং, মাথার খুলি, দাঁতের কপাট একে একে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। অনেকদিন রৌদ্রে, বৃষ্টিতে অযত্নে অবহেলায় ঝুলে থাকায় নড়বড়ে হয়ে যাওয়া অংশগুলােকে দড়ি বেত দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। এরপর শুরু হয় নৃত্যানুষ্ঠান।

জন্তুর মাথা দুই হস্তে উচ্চে উত্তোলন করে ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে নাচিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিমায় পদস্ফালন ও বাহুশক্তি প্রদর্শন পূর্বক আত্মপ্রসাদমূলক নিম্নোক্ত গীত গাওয়া হয়। এই নৃত্যগীতে পৌরুষের স্পর্শ অনুভব করা যায়।

তুই সুম বান জৌ উ লে
তি না অ্যা বান রিয়াল রুয়াঃ যুই অ্যা
কা রাল অ্যা এ্যান্দঃপা রাম অ্যা টুয়ান অ্যা আলুং হের কৌ সেলে অ্যা

বমদের বিয়ের গান (Lawi la) :

বিবাহ উৎসবে বিভিন্ন গীত পরিবেশন করা হয়। নিম্নেএকটি বিয়ের গান দেয়া হলাে-

বম

নেম জিয়ার মার লেইলাক বাক আ টুম টুয়ান্দঃ সেনচিয়ার নু তুসুন চু
আ লুং তুম বালপা রুন ইন সুং
টুয়ান রেল লাই কা রেল লাই আতি।
ওম বাং অ্যাই রুয়াং খাত ওম উ ল
ফাং বাং অ্যাই কাওখাত ওম উ ল
দঃতে নান রুন টুয়ান রেল উ ল।
আ কে কার দিনয়ািন আ ময়ে
অয়বিয়ল ঠিলাই তলা আ নঙাঃ
সেই তিম আ হয়নু লু চুঙাঃ
আ কম রুয়াল নিঃ আ দুং আন্ জুল।
আ দুং মায়া রেল নু রেল পা
আ লাইয়া সেন চিয়ারনু মৌনু
আ দুঃ বালপা ইনলেই আ লয়ে।

বঙ্গানুবাদ

ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে ঐ রূপসী কন্যা চলছে আজি রিনিঝিনি
বাঁধবারে ঘর প্রাণবন্ধুর।
লাউ যেমন ধরে এক লতায়
ধান যেমন আসে এক শীষেতে
বাঁধিয়াে ঘর এক হৃদয় বৃন্তে।
চরণ ফেলে যায় কন্যা ধিকি ধিকি
জোড়া পুঁতির মালা গলায় ঝনঝনিয়ে
পিছে পিছে তার সখি দল
আগে সখা পিছে সখা
মধ্যে রূপকন্যা রূপখানির মেলিয়া
চলছে আজ মনমানুষের কাছে।

শিঙা হাতে বম যুবক
শিঙা হাতে বম যুবক । ছবি- জুলিয়ান বম

বম লােকসংগীত

লােক সংগীতের মধ্যে অনেক শ্রেণীর গান রয়েছে। যেমন কাইলেক, লা ফিং, লা তুং। লাফিং বা লাতুং গান বৈচিত্র্যে, মাধুর্যে ও ভাবে সমৃদ্ধ। এটি মূলত ভাব প্রধান গান। এ গান বিষয়, ভাব, রস আর সুরের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ।


বম রূপকথা ও লােককাহিনী

বম জনগােষ্ঠীর রয়েছে নানান রূপকথা, পুরাকাহিনী, লােককাহিনী, গীতিকা ও নৃত্যগীত। এগুলাে যদি সংগ্রহ করা যায় তাহলে লােকসাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে। এইগুলাের মধ্যে আদিবাসীদের সমাজ, তাদের জীবনযাত্রা এবং জীবিকার চিত্র দেখতে পাওয়া যায়।

বম আদিবাসীর নানান পুরাকাহিনী, লোকজ কাহিনী, প্রবচন, ছড়া, গীতিকা ও সৃষ্টি তত্ত্বকথা ইত্যাদি হারিয়ে যাচ্ছে। বম ভাষায় এই জাতীয় লিখিত কোনাে গ্রন্থ নেই। এইগুলাে সংরক্ষণ করা দরকার।

এগুলােতে বম সমাজের কঠোর জীবনসংগ্রাম, ব্যক্তি ও সমাজজীবনের গভীর যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা, বৈষম্য, নৃশংসতা ও মহানুভবতার চিত্র নিখুঁতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগাড়ের জন্য উদয়াস্ত কঠোর শ্রমসাধ্য জুম চাষ ও বন্য জন্তু শিকারের চিত্র অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে বারংবার উপস্থাপিত হয়েছে জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হিসেবে।

বম জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা

শিক্ষা ক্ষেত্রে বমরা বেশ অগ্রগামী বলা হলে অত্যুক্তি হবে না। পার্বত্য বান্দরবান জেলার প্রথম বিএ পাশ একজন বম। তিনি প্রয়াত লাল নাগ বম। ১৯৫৬/৫৭ খ্রিস্টাব্দে রুমা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের খামংখ্যং মৌজায় আর্থা পাড়া নামক স্থানে একটি ইংরেজি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের অগ্রগামীতার ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখে।

বমদের উল্লেখযোগ্য গ্রামগুলোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বমদের লেখাপড়া মােটামুটি ভালাে, কিন্তু উচ্চ শিক্ষায় নয়। বমদের সাধারণভাবে শিক্ষার হার ৪০% ধরা যায়।

বম নারীর অবস্থা

বম জনগোষ্ঠী পুরুষতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোতে পুরুষের একচ্ছত্র প্রভাব থাকলেও যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পুরুষরা নিজেদের পরিবারের নারীদের জড়াতে বাধ্য হয়ে পড়ে। নারীরা কেবল পরিবারের উপার্জনমূলক কাজে জড়িত থাকলেও ক্রমশ তারা গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের দাসসুলভ গণ্ডি পেরিয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ততাকে ত্বরান্বিত করতে থাকে। ফলে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে নারীরা চলাফেরা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চায় জড়িয়ে পড়ে।

তুলনামূলকভাবে অশিক্ষিত ও প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী বম পরিবারসমূহের নারীরা পারিবারিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ অবস্থায় রয়েছে। অপরদিকে শিক্ষিত এবং উন্নত এলাকায় বসবাসরত বম পরিবারের নারীরা যথেষ্ট এগিয়েছে।

বম নারীর সাংস্কৃতিক জীবনচিত্র
বম নারীর সাংস্কৃতিক জীবনচিত্র। ছবি : জুলিয়ান বম

বম জনগোষ্ঠীর নারীরা দৈনন্দিন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটা, নিজের ও সন্তানের অসুখে চিকিৎসা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ এবং গর্ভাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবাসহ নিজেদের ও সন্তানের পোশাক পরিচ্ছদ কেনাকাটা হতে শুরু করে বাপের বাড়ি কিংবা গ্রামের বাইরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষদের সাথে প্রায়ই সমভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে।

অপরদিকে পরিবারের বিভিন্ন সম্পত্তি ও ফসল ক্রয়-বিক্রয়সহ ছেলেমেয়েদের বিয়েতে নারীরা সীমিত পরিসরে মতামত রাখতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়ে থাকে। শিক্ষা ও সচেতনতার কারণে বমদের পারিবারিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের সম্পৃক্ততা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকলেও এখনাে পুরুষের প্রাধান্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়।

বম সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণের মাত্রা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় নারীর ক্ষমতায়নের গতিও অতীতের যে কোনাে সময়ের তুলনায় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অতীতে বম সমাজের নারীরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি তাঁত বস্ত্র তৈরি, পশুপালন ও জুম চাষাবাদের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল।

আদিবাসী বম নারী
বম নারী। সুত্র : kapaeeng.org

বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও মুদি ব্যবসায় নিজেদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রয়েছে।

ফলে পারিবারিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি সামাজিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও বম সমাজের নারীরা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করার সক্ষমতা অর্জনের গতিশীলতা অব্যাহত রেখেছে।

অন্য সমাজের মতাে বম সমাজেও পুরুষরা যেমন নারীদেরকে অবলা হিসেবে মনে করে এবং প্রথাগত কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করে, ঠিক তেমনিভাবে নারীরাও নিজেদের স্বকীয় স্বাধীন চিন্তা চেতনার প্রয়ােগ করতে পারে না। এভাবে পুরুষের ইচ্ছা বা মর্জিমাফিক নারীদের কাজ করার প্রবণতার ফলে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর উপর নানা বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে।

বম সমাজে ‘ইনকাইসিয়াহ’/’তেলঙহাম’ (Tlengkham) সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামী হতে ভরণপােষণের অধিকারী হয়। একজন বম নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃকসূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্বউপার্জিত অর্থে সম্পতি.ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে।

বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনাে সম্পত্তির উপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর নিকট হতে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সার্কেল চিফ বা প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামী নিকট হতে খোরপোষ লাভের অধিকারী হয়।

বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপোষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা আইনত সার্কেল চিফসহ দেওয়ানি আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে।

বম যুবতী
বম যুবতি। ছবি- জুলিয়ান বম

স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখে। পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংসক হলে অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী বম সোশ্যাল কাউন্সিল বা সামাজিক আদালত বা প্রচলিত আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারী হয়।

বম জাতির রাজনৈতিক সংগঠন

পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলােতে বম জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নয়। ফলে বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া তেমন আশানুরূপভাবে এগোয়নি।

সঙ্গত কারণে বম জনগোষ্ঠীর যেমন নিজস্ব রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে ওঠেনি, ঠিক তেমনিভাবে ত্বরান্বিত হয়নি তাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াও। থানা ও জেলা সদরে কিংবা কাছাকাছি এলাকায় বসবাসকারী বম জনগােষ্ঠী থেকে কতিপয় ব্যক্তির আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা লক্ষণীয় হলেও তাতে রাজনৈতিক সচেতনতার মাত্রা সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার তেমন কোনাে অবকাশ নেই।

স্বল্প জনসংখ্যার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদে বম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত মহিলা মেম্বার হিসেবে বম জনগোষ্ঠীর গুটিকয়েক নারী বর্তমানে দায়িত্ব পালন করলেও সরাসরি নির্বাচিত মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যান হিসেবে বম জনগোষ্ঠীর কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততার নজির এখনাে নেই।

১৯৯৭ সালে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতাে বম জনগোষ্ঠীরও আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে।

এর মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে বম, লুসাই ও পাংখু জনগােষ্ঠীর জন্য ১টি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে বম, লুসাই, পাংখাে, খুমী, চাক ও খিয়াং জনগােষ্ঠীর একটি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। তবে এসব জনগোষ্ঠীকে একত্রে আঞ্চলিক পরিষদে মাত্র একটি সদস্যপদ এবং বান্দরবান জেলা পরিষদে একটি সদস্যপদ সংরক্ষণ করার ফলে বম জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত নয় বলে অনেকের অভিমত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত প্রত্যেক জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বম জনগােষ্ঠীসহ এসব স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন আদিবাসী জনগােষ্ঠীসমূহের জন্য আঞ্চলিক পরিষদ অন্তত একটি করে আসন এবং অনুরূপভাবে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদেও সংরক্ষণ করা উচিত বলে অনেকে অভিমত প্রদান করেন।

টীকা
১. Bonzu (Buchanan, 1798), Banjoogee (Macrea, 1801), Bunjoos (Barbe,
1845), Boun-jus Ges Bounjwes (Phayre, 1845)
২. Lewin, Mackenzie, Way, Riebeck, Hutchinson, Miles, Levi Strauss, Bessaignet, Bernots), Banjogis ev Banjogies (Barbe), Bawm, Bawm-Zo (Lorrain, 1940), Bom-Laejo Ges Bom (Bernots), Bom-Zou (Loffler, 1959), Bonzogi Ges Bom (Sopher, 1964), Bawm (Wolfgang Mey, 1960), Avi Bom (Paramanik).

তথ্যসূত্র
১. Vumson, Zo History, 1986.
২. Rajput, A.B., The tribes of The tribes of Chittagong Hill Tracts, Karachi, 1965.
৩. Hutchinson, R.H.S, An Account of Chittagong Hill Tracts, 1906.
৪. Bessaignet, P, Social Research in East Pakistan, Asiatic Society of Pakistan Publication, No. 5. (ed) Pierre Bessaignet 2nd Edition, 1964.
৫. Bernot, L, Ethnic Group of Chittagong Hill Tracts, Social Research in East Pakistan, Asiatic Society of Pakistan Publication, No. 5. 2nd edition, 1964 (ed.) Pierre Bessaignet.
৬. Lewin, T.H, Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein: with Comparative Vocabularies of the Hill Dialects, Calcutta, 1869.
৭. Mackenzie, Alexander, The North-East Frontier of India, reprinted, 1989.
৮. Willem van Schendel(ed), Francis Buchanan in South East Bengal (1798) His Journey to Chittagong Hill Tracts, Noakhali and Comilla, 1992.
৯. Shahu & Pardo, The Bawms: Forest Wandering Tribes of Chittagong Hill Tracts, 1998.
১০. Ishaque, M. (ed), Bangladesh District Gazetteers, Chittagong Hill Tracts, 1971.
১১. Bawm Social Council Bangladesh, Bawm Census 2003,
১২. Shahu & Dolian, L, Bawm Zo History, Unpublished.
১৩. চাকমা, উৎপল কান্তি, ‘বম সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন’, জুম পাহাড়ের জীবন, গণ উন্নয়ন
গ্রন্থাগার, ঢাকা, ২০০৮।
১৪. চাকমা, এডভােকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ; রায়, এডভােকেট প্রতিম; দে, শৈলেন, বম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন, কপাে সেবা সংঘ, আদালত সড়ক, বনরূপা, রাঙ্গামাটি, সেপ্টেম্বর ২০০৭।

লেখকঃ জির কুং সাহু

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা