বম ভাষা: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
1683
ভাষা
একটি ভাষার মধ্যে একটি জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি থাকে। ভাষাহীন মানুষ এই জগৎ সংসারে বাঁচতে পারে না। আর মানুষের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সাহিত্য এই ভাষা ছাড়া প্রতিবিম্বিত হতে পারে না। এজন্য ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ঐতিহ্য কল্পনা করা যায় না। একটি জাতি ছোট বা বড় হোক নিজ ভাষা আর সংস্কৃতির পথ বেয়েই আত্মমর্যাদাশীল হয়ে ওঠে। আবার ভাষার শক্তি আসে শিক্ষা ও সংস্কৃতি থেকে। পৃথিবীতে কতগুলো ভাষা রয়েছে তা নিয়ে মতভেদ আছে। UNESCO এর পরিসংখ্যানে ছয় হাজার। বাংলাদেশও একটি বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বহু সংস্কৃতির দেশ। এখানে সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী বাঙালী ছাড়াও প্রায় ৩০টি ভিন্ন ভাষা ব্যবহারকারী ৪৫টিরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী দেশের পার্বত্য অঞ্চলসহ উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বসবাস করে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী থেকে একবারেই আলাদা।
জাতি বৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম
জাতিবৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল আমাদের এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এর ভৌগলিক অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি এখানকার মানুষের আবাসস্থলের প্রকৃতি, ভাষা ও সংস্কৃতি দেশের অপরাপর অঞ্চল থেকে একেবারে ভিন্ন। এখানে ১০ ভাষাভাষী ১১টি আদিবাসীর বসবাস রয়েছে। বম, চাকমা, খুমি, খেয়াং, চাক, লুসাই, ম্রো, মারমা, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরা। প্রত্যেক আদিবাসীরই নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা রয়েছে। এক পাহাড়ে কয়েক বর্গ কিলোমিটার জায়গায় এত ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী জনমানুষের পাশাপাশি বসবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত দেশের আর অন্য কোথাও দেখা যায় না। তাদের মধ্যে একটি হল বম আদিবাসী জনগোষ্ঠী। বমদেরও স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমৃদ্ধ ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি রয়েছে। তারা কুকি-চিন বা সিনো-টিবেটান ভাষাগোষ্ঠীর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম জো জাতির একটি অংশ। এ ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন পরিচয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে, মিয়ানমারের চিন স্টেট ও আরাকান, ভারতের মিজোরাম (লুসাই হিল), নাগাল্যান্ড, মণিপুর, আসামে বসবাস করে।
বম জনগোষ্ঠীর পরিচয়
বমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলায় এবং রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায় ৭০টি গ্রামে বসবাস করে। সরকারী পরিসংখ্যানে বম জনগোষ্ঠীর পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় না। ১৯৯১ সালের আদমশুমারীতে বম জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা ৬,৯৭৮ জন বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে বমরা সরকারী পরিসংখ্যান যথাযথ নয় বলে মনে করেন। ২০০৩ সালে বম সোশ্যাল কাউন্সিল বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত জরিপ অনুসারে বম আদিবাসীর জনসংখ্যা ৯,৫০০।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত প্রাচীন কোন কোন তথ্যে বনযোগী নামে জনগোষ্ঠীর কথা পাওয়া গেলেও বম নামে কোন জনগোষ্ঠীর কথা পাওয়া যায় না। বমরা নিজেদের বমজৌ বলতেন এবং বিভিন্ন লেখক সেটাকে উচ্চারণগত বিকৃতিতে বনযোগী, বনজো, বমজৌস বিভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এস এল পারদো ও জির কুং সাহু The Bawms: The Forest Wandering Tribe of the Chittagong Hill Tracts গ্রন্থে লিখেছেন, ‘Banjogi, Bonjoogees, Banzoos, Bounjous, Bounjwes, Bangogis, Bunjogi, Bom-Laejo, Bom-Zou were synonymous to the word Bawm-Zo.’ ‘বম’ শব্দের অর্থ – বন্ধন, মিলন, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত করা বা হওয়া। এক সময়ে শুধুমাত্র জুমচাষী ও শিকারী বমরা গহীন অরণ্যবেষ্ঠিত দুর্গম পাহাড়-পর্বতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের একিভূত বা সংযুক্তকরণের তাগিদ থেকে “বম” শব্দের উদ্ভব হয়েছে।
বমদের বিশ্বাস তাদের আদি নিবাস চীনের চিনলুং পর্বতের গুহায়। চীন ভাষার বিচারে “বম” সম্প্রদায়কে “কুকী” (Kuki) বা “চীন” (Chin) বলে দাবী করেছেন লেউইন, রীবেক, গ্রীয়ারসন, হাচিনসন, উল্ফেনেডেন, শ্যাফার প্রমূখ লেখক। তারা সেখান থেকে ভারত, মিয়ানমারে ও পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বমরা সপ্তদশ শতকে কিংবা তারও আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছেন বলে ধারণা করা হয়।
বম ভাষার পরিচয়
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভাষাকে ইন্দো-আর্য ও ভোট-বর্মী দুই প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন গবেষকরা। বম ভাষা হচ্ছে ভোট-বর্মী দলভুক্ত কুকি-চিন বা সিনো-টিবেটান উপবিভাগের অন্তর্ভুক্ত। এই ভাষা বাংলাদেশের দশ-বার হাজার বম মানুষের মুখের ভাষা। খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমনের পূর্বে বম, পাংখোয়া, লুসাই, তথা মিজো/জৌ ভাষার কোন বর্ণমালা ছিল না। তারা সাধারণত মৌখিক ভাষার মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় তাদের অলিখিত সাহিত্য, লোকগীতি, গল্প, পৌরাণিক কাহিনী ও ধাঁধাঁগুলো ধরে রাখতো। এখনো অনেক আদিবাসীদের ভাষার লিখিতরূপ নেই। Rev. J. H. Lorrain এবং Rev. F. W. Savidge খ্রিস্টান মিশনারীদ্বয় ১৮৯৪ সালে রোমান বর্ণমালা অনুসরণে বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। তা দিয়ে বাইবেলের অংশ, ধর্মীয় শিক্ষার পুস্তিকা, অভিধান ইত্যাদি প্রকাশ করেন। মিজোরাম থেকে আগত লুসাই ধর্ম প্রচারকগণ এই বর্ণমালা বম, পাংখোয়াদের মধ্যে প্রচলন করেন। এই একই বর্ণমালা বম, পাংখোয়ারা ব্যবহার করে। ১৯১৮ সালের পরবর্তী সময়গুলোতে যখন বম, পাংখোয়ারা খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করেন তখন থেকে এই বর্ণমালার ব্যবহার। প্রথমাবস্থায় লুসাই ভাষায় বাইবেল, ধর্মীয় সংগীত ব্যবহৃত হত।
১৯১৮ সালে বমদের মাঝে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের পরবর্তী সময়গুলোতে প্রচারকগণ বমদেরকে এই বর্ণমালায় পাঠদান করতে থাকেন, তারা ছোট হরফ আর বড় হরফ এবং শব্দ গঠনের দু’একটি নমুনা সম্বলিত এক পৃষ্ঠার কাগজে পাঠদান দিতে থাকেন। বাংলাদেশের দশ বারো হাজার বম জনমানুষের লিখিতরূপে ভাষার ব্যবহার এবং তার চর্চার ইতিহাস কিন্তু খুব দীর্ঘ নয়। তবে বম ভাষার জনমানুষের ভালো দিক হলো মিজোরামের মিজো ভাষার বই বমরা পেতে পারে সহজে যে ভাষা বমরা ৭০/৮০ শতাংশ বুঝে। আসলে এই মিজো ভাষাই বর্তমানে আমাদের LINGUA FRANCA। মিজোরামের গান খুবই জনপ্রিয়, মিজোরামের গান বমদের মুখে মুখে থাকে। এই মিজো ভাষা বাংলাদেশের বম, পাংখোয়া ও লুসাই সবাই কম বেশি বুঝে। মিজোরামের এই মিজো ভাষায় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয়।
সেই ১৮৯৪ সালে মিশনারীদের প্রবর্তন করা রোমান লিপি বমদের কাছে পৌঁছায় সম্ভবত ১৯২০ সালের পরবর্তী কালে। ১৯২৯ সালে দু’জন বম মিজোরামের সিরতে নামক গ্রামে লেখাপড়া শিখতে যান। জানা মতে এই দু’জন – (Kualthang ও Ngun Khar) বমদের মধ্যে প্রথম বর্ণমালা a aw b জানা লোক। এরপর ১৯৩২ সালে রোয়াংছড়ি উপজেলার পানখ্যাং গ্রামে স্কুল খোলা হয়। এটি বম গ্রামে প্রথম স্কুল। এই স্কুলে পাঠ্যবই হিসেবে মিজোরাম থেকে আনা মিজো/লুসাই ভাষার পাঠ্যবই ব্যবহৃত হত। বইয়ের আকারে বম বর্ণমালা শিক্ষার বই ‘বম বু বুল বু’ (Bawm Bu Bul Bu) বেরিয়েছে ১৯৫২ সালে। তার আগেই ১৯৪৮ সালে সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার-সালিশ ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বম সম্প্রদায় প্রথম Bawm Dan Bu (Bawm Customary Law) নামে একখানি পুস্তিকা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। বম ভাষায় পবিত্র বাইবেল অনূদিত হয়েছে।
বম ভাষা ভোট-বর্মী শাখার (Tibeto-Burman) কুকি-চীন দলভুক্ত ভাষা। বম ভাষার ২৫ টি বর্ণমালা আছে। তার মধ্যে ৫ টি স্বরবর্ণ (vowels) আর ২০ টি ব্যঞ্জনবর্ণ (consonants)। লক্ষণীয় যে, এই ২৫ টি বর্ণমালার মধ্যে “J” এর কোন ব্যবহার নেই।
বম ভাষার ব্যবহার ও চর্চা ক্ষেত্র
বম ভাষা বর্ণমালা ও সাহিত্য চর্চার প্রধান ক্ষেত্র দু’টি – এক) ধর্মীয় আর দুই) সামাজিক। বর্তমানে বম, পাংখোয়া এবং লুসাইরা একশত ভাগই খ্রিস্টান। তাদের মাঝে খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু হয় ১৯১৮ সালে। ভারতের মণিপুর ও মিজোরামের লুসাইরা একই ভাষাভাষী বমদের কাছে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। ১৯১৮ সাল হতে বম জনগোষ্ঠী পর্যায়ক্রমে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়াতে বর্তমানে এদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক রীতি-নীতিতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ভাল কথা যে, বম সমাজের শতকরা আশি জন নিজ ভাষায় লেখাপড়া জানে। চিঠিপত্র, লেনদেন, হিসাবপত্র, সভা সমিতির কার্য বিবরণী, নথিপত্র তথা সামগ্রিক সামাজিক যোগাযোগ বম ভাষায় সম্পাদিত হত। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্টীর মধ্যে ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে বম সমাজ অনেকখানি এগিয়ে আছে। বম জনগোষ্টী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক কিংবা স্ব-উদ্যোগে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও তা চর্চা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে বম সমাজ অনেকখানি এগিয়ে আছে। এই ভাষায় তারা চিঠিপত্র, হিসাব-নিকাশসহ দরকারী সকল কাজ করে থাকেন। বর্তমানে বমদের শতকরা ৮০ জন নিজ ভাষায় লেখাপড়া জানেন। বর্ণমালা পরিচিতির প্রাথমিক বই (Bawm Premier) পারিবারিক উদ্যোগে অথবা গীর্জা অথবা পাড়া, সমাজ ভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় শিশুদের পড়ানো হয়। বাইবেল ছাড়াও ধর্মীয় সংগীত, বাইবেলের ব্যাখ্যাসহ ধর্মীয় পুস্তক এবং বিবিধ বিষয়ের বই-পুস্তক বম ভাষায় রয়েছে। বম ভাষায় দু’টি পত্রিকা বের হয় – একটি মাসিক, অন্যটি ত্রৈমাসিক। বম ভাষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মীয়, উন্নয়নমূলক, সচেতনতামূলক বিবিধ বিষয়ের বই পুস্তকের প্রকাশনা রয়েছে। বম ভাষায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন Dr. Lorenz Loffler এর সহযোগিতায় সম্পাদিত একটি অভিধান (Dictionary) আছে।
বম ভাষার বর্তমান চিত্র
বর্তমানে বম ভাষার উন্নয়ন এবং চর্চার ক্ষেত্র খুবই সীমিত। যতখানি চর্চা হচ্ছে তার অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে চার্চসমূহ। বর্তমানে বম ভাষাগুলো টিকিয়ে রেখেছে চার্চসমূহ। চার্চ ভিত্তিক প্রকাশনাই প্রধান। সামাজিক দিক থেকে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। লক্ষণীয় যে, গির্জা বা সমাজ ভিত্তিক বম ভাষা পড়ানোর উদ্যোগও আজকাল আগেকার দিনের মত খুব জোড়ালো নয়। পাড়ায় পাড়ায় বম ভাষা পড়ানোর উদ্যোগ আর নেই। আজকাল অধিকাংশ বম ছেলেমেয়েরা বম ভাষায় লেখা পড়তে পারে না। সরকারি/বেসরকারি স্কুলে শুধু বাংলা পড়ানোর ফলে নিজ ভাষা শেখার সুযোগ নেই। সে সুযোগ না থাকার কারণে কিংবা বাংলা ভাষার প্রভাবে বর্তমান প্রজন্মের প্রায় অনেকেই নিজেদের ভাষায় লিখতে এবং পড়তে পারে না। এভাবে ধীরে ধীরে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, আত্ম-পরিচিতি ও মূল্যবোধ হারাচ্ছে কারণ, ভাষাকে ক্রিয়াশীল রাখার মাধ্যমেই একটি জনগোষ্ঠী তার স্বতন্ত্র আত্ম-পরিচিতি, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধরে রাখতে পারে।
বম ভাষা ও বর্ণমালা এখন বিপন্নপ্রায়। বাংলা শব্দ/ভাষার হাতে যে মার খাচ্ছে, সে তো প্রতিদিনই আমরা দেখতে পাচ্ছি। বাংলা শব্দের আধিক্য ছাড়া বম ভাষা বলাটা যেন এখন রীতিমত কষ্টকর। বম ভাষার মধ্যে অযাচিত বাংলা মিশেল ভাষাকে ক্ষতি করে চলেছে, দেখা যায় বাংলা মিশেল ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা বাক্য সমাপ্ত করি না অথবা করতে পারি না। আমরা আমাদের বমদের ভাষাগুলোর পরিধিকে ক্রমাগত সীমিত করে চলেছি, এটি যে কোন ভাষার দুর্দশারই ছবি। শুধু বম ভাষা নয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনমানুষের কোন ভাষাই বোধ হয় ভাল নেই, যতটা ভাল থাকা উচিত। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের বম ভাষাও দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে, অন্যান্য আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগুলোর মাতৃভাষা বিলীন হওয়ার পথে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশের এই আদিবাসী ও ক্ষুদ্র জাতিগুলোর মাতৃভাষাগুলোর সংরক্ষণ ও বর্ধনের জন্য ব্যবস্থা আশু প্রয়োজন। সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে অনেক জনগোষ্টীর ভাষা চিরতরে হারিয়ে যাবে, যে দেশে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, সে দেশে এমন ঘটনা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে।
মাতৃভাষায় শিক্ষা
একটি ভাষাকে রক্ষা, সমৃদ্ধ ও বিকশিত করতে হলে মাতৃভাষায় শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ আজ তাদের স্ব-স্ব মাতৃভাষা রক্ষণ ও বর্ধনের জন্য অঙ্গীকার করেছেন। ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, এ ব্যাপারে জরুরী পদক্ষেপ না নিলে আগামী শতাব্দীতে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ ভাষা হারিয়ে যাবে। মনের ভাব মনের মত করে প্রকাশ করা যায় শুধুমাত্র মাতৃভাষায়। মানুষ তার জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রাগ-অনুরাগ মাতৃভাষাতেই প্রকাশ করে।
মোঃ হাবিবুর রহমান যথার্থই বলেছিলেন, “জন্মের পর যে ভাষা আমরা শুনি, যে ভাষায় আমাদের কথা ফোটে ও জ্ঞান হয় এবং যে ভাষা না শিখেও বা তালিম না করেও আমরা শিখি সেই আমাদের জন্মের ভাষা আমাদের মায়ের ভাষা। এই ভাষা আমাদের আপন ভাষা। অন্য ভাষা আমাদের কাছে পরভাষা।”
এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, “মাতৃভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষা আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিয়া পরান আকুর করে? কাহার হৃদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করে দেখ মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোন জাতি কখনও কি বড় হইতে পারিয়াছে?”
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্টী নিজ ভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার রাখে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি আদিবাসীর জন্য মাতৃভাষা ভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা চালুকরণে জাতীয় শিক্ষানীতিমালা’ ২০১০ ইং ১৮নং ধারায় বাস্তবায়নের অনুমোদন রয়েছে। আমরাও চাই সব ভাষা বিকশিত হোক।
লেখক: জির কুং সাহু
তথ্যসূত্র: এলেট; বৈসুক-সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু সংকলন’ ১৪; জুম ঈস্থেটিকস্ কাউন্সিল (জাক); রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।