বম আদিবাসীদের লোকসংগীত ও লোকনৃত্য
1538
লোকসংগীত:
বম আদিবাসীদের লোক সংগীতের মধ্যে অনেক শ্রেণির গান রয়েছে। যেমন: কাইলেক, লা ফিং, লাতুং। লাফিং বা লাতুং গান খুবই বৈচিত্র্যময়, মাধুরভাব-সমৃদ্ধ। মূলত এগুলো ভাব প্রধান গান।
এ গান বিষয়, ভাব, রস আর সুরের দিক দিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই লোকগীতির মধ্যে বম সমাজের কঠোর জীবন-সংগ্রাম, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের গভীর যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা, বৈষম্য, নৃশংসতা ও মহানুভবতার চিত্র নিখুঁতভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
ন্যূনতম প্রয়োজনীয় খাদ্য যোগাড়ের জন্য উদয়াস্ত কঠোর শ্রমসাধ্য জুমচাষ ও বন্য জন্তু শিকারের চিত্র অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে বারংবার উপস্থাপিত হয়েছে জীবন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
বমদের লোকসংগীত বিশেষ স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত। বমদের অনেক প্রাচীন গাথা রয়েছে। বম আদিবাসীদের সমাজ জীবনে তাই এতো গান। এমন কোন লৌকিক উৎসব আচার অনুষ্ঠান নেই যেখানে নৃত্যগীত নেই।
নান দু থু সিম লাউ
নান দু লা সাক উ।
বঙ্গানুবাদ-
মিনতি করি কহিও না কথা
গাহিও গান পরান ভরিয়া।
প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রাণের আর্তি, বিরহ ব্যথা, দৈনন্দিন জীবন সমস্যা, সমাজের মানুষের মনের কথা, প্রেম-ভালবাসা, মনের আশা-আকাক্ষা সমস্তই প্রকাশ পায় সংগীতে। প্রেমিক প্রেমিকার বিরহ বেদনা, প্রেম-অনুরাগ, সখ্যতা আদান প্রদান হয় সুরের মাধ্যমে।
‘রিরৎ’ (এক প্রকার একতারা), ‘মিমীম’ (ধানের নাড়া দিয়ে তৈরি বাঁশি) আর ‘জলপাল’ (এক প্রকার বাঁশি) বাঁজিয়ে যে সুর সৃষ্টি হয় তাতে বিরহ বেদনা ও বিচ্ছেদের ব্যথা মূর্ত হয়ে উঠে। কথা নেই আছে শুধু সুর। আছে এক সহজ-সরল আবেদন।
বিয়ের গান (Lawi la):
বিবাহ উৎসবে নিম্নের গীত পরিবেশন করা হয়। নিমে একটি বিয়ের গান দেয়া হল-
Nem ziarmar leilak bak a tum,
Tuandawh senchiarnu tusun chu,
A lungtum valpa run in sung,
Tuanrel lai ka rel lai ati.
Um bang ei ruang khat um u law,
Fang bang ei kau khat um u law,
Dawh te nan run tuan rel u law.
A ke kar dindian a mawi e,
Awihrial thi lai tla a ngawngah,
Seitimh a hawinu lu chungah,
A kawmhrual nih a dung an zul.
A dungmai ah relnu relpa,
A lai ah senchiarnu monu,
Tuandawh senchiarnu a lawi e,
A duh valpa in lei a lawi e.
বঙ্গানুবাদ-
ধীর পায়ে সিঁড়ি নামে ঐ রূপসী কন্যা
চলিছে আজি রিনিঝিনি
বাঁধিবারে ঘর প্রাণবন্ধুর।
লাউ যেমন ধরে এক লতায়
ধান যেমন আসে এক শীষেতে
বাঁধিয়ো ঘর এক হৃদয়বৃন্তে।
চরণ ফেলিয়া যায় কন্যা ধিকি ধিকি
জোড়া পুঁতির মালা গলায় ঝনঝনিয়ে
পিছে পিছে তার সখি দল
আগে সখা পিছে সখা
মধ্যে রূপকন্যা রূপখানি মেলিয়া
চলিছে আজি মন-মানুষের কাছে।
লোকনৃত্য/নৃত্যগীত
বম আদিবাসীদের নানা ধরনের লোকনৃত্য রয়েছে। এই নৃত্যগীত সমাজ জীবনে আনন্দোৎসবের চেয়ে শোকানুষ্ঠানের প্রাধান্য লক্ষ্যণীয়।
তবে শোকানুষ্ঠানের প্রাধান্য থাকলেও স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজিত আনন্দ উৎসবও কম নয়। সফল শিকারীর আনন্দ উল্লাসের নৃত গীত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মৃতদের স্মরণোৎসব হলো বমদের শিং নৃত্য। বন্যজন্তুর মাথা/কঙ্কালগুলো ঘরের দেয়ালে সাজিয়ে শিকারীর শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করা হয়।
জীবিতকালে এইসব মৃত জীবজন্তুদের অন্তত একবার শুচীকরণ করতে হয়। না হলে পরকালে এরা হিংস্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, এরকম বিশ্বাসের জন্য ‘সালু লাম’ অর্থাৎ শিং নৃত্যের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
রীতি অনুযায়ী শুচীকরণ সম্পন্ন হলে তারা গৃহকর্তার বশীভূত হয় বলে বমরা বিশ্বাস করে। নিম্নে বম আদিবাসীদের লোকনৃত্য বর্ণনা দেওয়া হলো:
ক. রোখা: বাঁশনৃত্য (Bamboo dance):
রোখা, বাঁশনৃত্য বা Bamboo dance নামে অতি খ্যাত। কারোর অপঘাতে মৃত্যু, প্রসবজনিত মৃত্যু অথবা অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এই নৃত্যগীত হয়।
শোকার্ত পরিবারের বাড়ির উঠানে, সমান জায়গায় যুব-যুবা, প্রবীণ-প্রবীণারা সকলেই সমবেত হয়। এই নৃত্যগীতে যুবক যুবতীরা সাধারণত অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা করে।
নিজেদের মধ্যে অনুনয় বিনয় আর এক রকম জোরাজুরিতে অবশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করে। জোড়া জোড়া লম্বা বাঁশের দুই প্রান্তে আড়াআড়িতে দুবার উপরে নিচে, দুবার পাশাপাশি অর্থাৎ একবার ফাঁক একবার চাপা ঠুকাঠুকিতে ছন্দতাল সৃষ্টি হয়, যখনই ফাঁক পড়বে সুচারু পদস্ফালন করে বৃত্তের আকারে যুবক যুবতীরা নেচে নেচে ঘুরে যায়।
পার্শ্বে উপবিষ্ট অন্যরা তখন গেয়ে চলে। বিরহ বিধুর একটা করুণ সুর এই গানে ধ্বনিত হয়। বিচ্ছেদের ব্যথা মূর্ত হয়ে উঠে। ছন্দে ছন্দে বাঁশের ঠুকাঠুকি আর হালকা চপল গানের সুর শোকের পরিবেশকে হালকা করে।
শোকার্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দান ও সাহচর্য দেওয়া এই নৃত্যগীতের মূল বিষয়বস্তু।
রোখা তলা হেন
আয় খালান, কান, পু লু চু,
থলান মেন্ আ রল মান রী লৌ হেন;
কা হয় মান লৌ না রেঃ লান্
রোখা তলা হেন
লুংতিয়াম আ কিয়াম, মান রী লৌ
কাথাই কীর মেন্ কীর মেন্ কীর মেন্
কা রুণ- আল মুন লৌ হি তেঃ
রোখা তলা হেন
কান জুয়াত মায়সিয় নু বাং আয়
কা হয় থলা মী কা হয় থলা মী
খয়ানু নিঃ আ তেলই তির তুয়ান।
রোখা তলা হেন
তিলিম মার ঙৌ কী ঠা খী,
মাল সম্ মানলৌ না রেঃ লান
লেই দায় তাং দাঙ না যাওয়ে।
বঙ্গানুবাদ-
পিতামহের মরদেহ মাটিতে যায় নাই মিলিয়া
নয়ন জুড়িয়া তোমায় না দেখিতেই
চলিয়া গেলে আমায় ছাড়িয়া।
মনে সাধ পুরিল না রে বধূ
ওগো বধূ ফিরিয়া এসো ফিরিয়া এসো
ঘর যে আমার বড় শূন্য হলো।
সোহাগী গয়ালরে যেমন রাখিতাম আদরে
নয়ন ভরিয়া দেখিতাম দিবানিশি যাহারে
বিধাতা ছাড়াইয়া নিল ত্বরা করি।
চেয়ে দেখো সোহাগী গয়ালটির শিং দু’টি
আসছে পার্বণ-উৎসবে উঠিব যে মাতি
শুয়ে রইলে যে নরম মাটির কোলে।
খ. সাবাংরুয়াই (Savangruai):
কোন বিত্তবান লোকের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজিত আনন্দ উৎসব। এতে সব গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করে থাকে। আয়োজক গৃহস্থের শৌর্য বীর্য খ্যাতি গুণকীর্তনই এ অনুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু। গৃহস্থের বাড়ির আঙ্গিনায় নারীপুরুষ হাত ধরাধরি করে বৃত্তাকারে একবার সামনে একবার পেছনে ধীরগতিতে তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করে। এদের মধ্যে এক মূল গায়েন গানের মধ্য দিয়ে আয়োজক বিত্তবানের বীররসাত্মক কাহিনী পরিবেশন করে আর অন্যরা ধুয়া তোলে।
গ. লাদৌ বা বর-লা (Lado/Vawr La):
সফল শিকারীর আনন্দ উল্লাসের গীত। শিকারলব্ধ বন্যজন্তুর মাথা সমেত গ্রামের প্রবেশ দ্বারে উচ্চরবে উদ্ধত ভঙ্গিতে আস্ফালন সহকারে যে বীররসাত্মক গীত গাওয়া তাকে ‘লাদৌ বা বর-লা’ বলা হয়। খ্যাতিমান শিকারী তার শিকারলব্ধ জন্তুর মাথা উঁচুতে ধরে বিজয়ের গীত গায় আর সঙ্গীরা ধুয়া তোলে।
Vawmkhuai e a kap lo tin e
Val me tluangkhawng lah u e
Kan phun e al tlingte sawn thlai e
Kan lei ri ah nak e
Ka khup e, ka hawi val rual lakah khin e,
Leng e a leng hen hawng ka zoh u law,
Tlang ah e leisawk bang ring zil e zel hen dah ka suak e.
বঙ্গানুবাদ-
ওহে যদি শূয়োর, ভালুক নাই ফেলছো
কিসে তোমার দর্প আস্ফালন।
তাকিয়ে দেখো ঐ যে যশমান শিরোমণি
আমি চলি চূড়ায় চূড়ায়।
ঘ. সিয়া কী দেং (Sia ki deng):
সিয়া কী দেং বা শিং নৃত্য মৃতদের স্মরণোৎসব, অতি ব্যয়বহুল ভোজ উৎসব। কেবল যশমান মৃতলোকের স্মরণার্থে এই নৃত্যানুষ্ঠান হয়ে থাকে।
জীবকালে তার যশ, খ্যাতি ও নানান সুকীর্তি পরিবেশন করাই শিং নৃত্যানুষ্ঠানের মূল বিষয়বস্তু। অংশগ্রহণকারী সকলই পুরুষ।
মাথায় পাগড়ীসহ উত্তম পোষাক পরিধান করে একক অথবা সমবেতভাবে নৃত্য পরিবেশন করে। এই নৃত্যে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন।
শিং জোড়া হাতে নিয়ে প্রথমে সামনে, উঁচুতে, পিছনে এবং বাঁ পা উচু করে জাগিয়ে, একইভাবে ডান পা উচু করে জাগিয়ে ফাঁকে শিং দুইটি ঠুকঠাক বাজায়, আবার এক পা অপর পায়ের সাথে জড়িয়ে হাটু মাটিতে না লাগিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে নিতম্ব মাটিতে বাজিয়ে আবার উচিয়ে শিং দুটির ঠুকঠাক তালে তালে এই নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
এই নৃত্যে শারীরিক সক্ষমতা এবং বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন হয়। এই নৃত্যে গীত হয় না।
ঙ. সালু লাম (Salu lam) :
গৃহের সম্মুখ দেয়ালে সারি সারি সাজানো বন্যজন্তুর মাথা/কঙ্কালগুলো জীবকালে অন্তত একবার শুচীকরণ বিধেয় নয়তো পরকালে হন্তার জন্য এরা হিংস্র, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হুমকি হয়ে দাঁড়ায় এরকম বিশ্বাসের জন্য ‘সালু লাম’ এর আয়োজন।
রীতি অনুযায়ী শুচীকরণ সম্পন্ন হলে তারা গৃহকর্তার বশীভূত হয়। সে উদ্দেশ্যে দেয়াল থেকে সব মাথাগুলো নামানো হয়, দাঁত, চোখ, যোয়াল, শিং, মাথার খুলি, দাঁতের কপাট, একে একে ধুয়ে মুছে ফকফকা করা হয়।
অনেক দিন রৌদ্রে, বৃষ্টিতে অযত্নে অবহেলায় ঝুলে থাকায় নড়বড়ে হয়ে যাওয়া অংশগুলোকে দড়ি বা বেত দিয়ে পোক্ত করে বাঁধা হয়। এরপর শুরু হয় নৃত্যানুষ্ঠান।
জন্তুর মাথা দুই হস্তে উচ্চে উত্তোলন করে ডানে বাঁয়ে ঘুরিয়ে নাচিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিমায় পদস্ফালন ও বাহুশক্তি প্রদর্শন পূর্বক আত্মপ্রসাদমূলক নিম্নোক্ত সংগীত গায়। এই নৃত্যগীতে পৌরুষের স্পর্শ অনুভব করা যায়।
Tui sum van zoh u le
Ti na e van rial ruah zui e.
Ka ral e andawhpa ram a tuan e
A lung her ko sele e !
Free translation-
Looking to and from, albeit I am going against the stream
And must endure the torrents of rain which the heavens disgorge upon me
Still with a steadfast aim I keep to the hunt
Isn’t a call for a duel for anybody!
লেখক: জির কুং সাহু, বিশিষ্ট লেখক, বান্দরবান।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।