বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা : এ যেন আলো আঁধারি পথ রেখায় অন্তহীন পদযাত্রা
930
পাহাড়ের অন্যতম প্রাচীন জনগোষ্ঠি ম্রোদের একটি লোকশ্রুতি রয়েছে- সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সকল জাতির জন্যে লেখ্য ভাষা প্রবর্তন করার লক্ষে পৃথিবীতে নেমে এসে একবার অক্ষর বিতরণ করেন।
তখন আনন্দ ফুর্তিতে ব্যস্ত থাকায় ম্রোরা আসতে পারেনি। পরে সকলের মাঝে অক্ষর বিতরণ শেষে সৃষ্টিকর্তা একটি গরুকে ম্রোদের কাছে প্রেরণ করেন ডুমুর পাতায় অক্ষর লিখে।
পথিমধ্যে ক্ষুধার্ত গরুটি ম্রোরােদের জন্যে পাঠানো লেখাসহ ডুমুরের পাতা খেয়ে ফেলে। ফলে ম্রোদের কাছে অক্ষর আর পৌঁছেনি। সেদিন থেকেই ম্রোরা গোহত্যা উৎসব উদযাপন করে আসছে।
আবার ত্রিপুরাদের লোকশ্রুতি অনুসারে সেই অক্ষর বিতরণ সভায় ত্রিপুরা জাতির প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিল না। তাই তাদের কাছে পাঠানো হয় একটি কাঁঠাল পাতা, যা বহনের দায়িত্ব পায় একটি ছাগল।
ছাগলটিও বহু পাহাড় পর্বত পেরিয়ে ত্রিপুরা জাতির কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে এবং কাঁঠাল পাতা খেয়ে ফেলে। সেদিন থেকে ত্রিপুরাদেরও অক্ষর নেই। ভাগ্যিস এ কারণে ‘ছাগল বলি’র কোন উৎসব ত্রিপুরাদের মাঝে প্রচলন হয়নি।
অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীতের মতো বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষার বর্তমান অবস্থা বলতে গিয়ে দু’টো লোকশ্রুতি বলে ফেললাম। তবে এর পেছনেও যুক্তি রয়েছে।
ভাষা বিকাশের অন্যতম স্তর হলো কোন ভাষার লেখ্যরূপ, লিপি ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রবর্তন। ভাষা বিকাশের এই গুরুত্বপূর্ন স্তর সম্পর্কে আলো-আঁধারি লোকশ্রুতি অনেকটা এ দু’টো ভাষা সভ্যতার সাথে স্থুল রসিকতারই মতো।
সে যাই হোক। এখন আসা যাক বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাগুলোর বর্তমান অবস্থা বিষয়ে। অফিসিয়ালি বাংলাদেশ কিন্তু একটি এক ভাষার দেশ। অন্তত আমাদের সংবিধান সেটাই বলে।
কারণ, আমাদের সংবিধানে বাংলা ছাড়া অন্যান্য ভাষার অস্তিত্ব নেই। সংবিধানে বাংলা ব্যতিত অন্য কোন ভাষার কথা উল্লেখ করা হয়নি (দেখুন- বাংলাদেশের সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধনী; ৯ নং অনুচ্ছেদ)।
কিন্তু বাস্তবতা হলো দেশে মূলস্রোতের বাংলাভাষি মানুষ ছাড়াও কমবেশি প্রায় পৌনে একশত বিভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্ব রয়েছে।
মহান সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩ (ক) অংশে এসব জাতিগোষ্ঠির স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সুরক্ষা ও উন্নয়নে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লক্ষ আদিবাসীর বসবাস, যারা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ। তারা দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে বসবাস করে।
তিন পার্বত্য জেলায় অধিকাংশ আদিবাসী জনগণের বসবাস হলেও বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার, বরগুনা, পটুয়াখালি, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড়, বগুড়া, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, টাংগাইল, শেরপুর, জামালপুর, গাজীপুর, রাজবাড়ি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সিলেট, হবিগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলেও তাদের বসতি দেখা যায়। বাংলাদেশের আদিবাসীরা মোটামুটি চারটি ভাষা পরিবারেই কথা বলে; অষ্ট্রো-এশিয়াটিক, সিনো-টিবেটান, ইন্দো-আর্য, দ্রাবির ইত্যাদি।
অষ্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- খাসি, কোদা, মুন্ডারি, প্নার, সান্তালি, ওয়ার-জৈন্তিয়া।
সিনো-টিবেটান ভাষা পরিবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাষা হলো- আতং, চাক, আশো, বম, গারো, হালাম, হাকা, খুমি, কোচ, ককবরক, মারমা, মেগাম, মৈতৈ মণিপুরি, ম্রো, পাংখোয়া, রাখাইন অন্যতম।
ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারে অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে- অহমিয়া, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, চাকমা, হাজং (পূর্বে টিবেটো বর্মন ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল), সাদ্রি (ওরাং), তঞ্চঙ্গ্যা ইত্যাদি। দ্রাবির ভাষা পরিবারে অন্তর্ভূক্ত দু’টো ভাষা হলো কুড়ুখ ও সাউরিয়া পাহাড়িয়া।
ভাষার অবস্থান অনুসারে বাংলাদেশকে ১১টি অঞ্চলে বিভাজন করা যায়; (১) বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল- ময়মনসিংহ, টাংগাইল, নেত্রকোণা, জামালপুর, শেরপুর ইত্যাদি, (২) গাজীপুর, (৩) উপকূল অঞ্চল- পটুয়াখালি, বরগুনা ও কক্সবাজার, (৪) বৃহত্তর সিলেট- সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ অঞ্চল, (৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম- রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা, (৬) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল- যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, (৭) উত্তরবঙ্গ- রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, (৮) বৃহত্তর চট্টগ্রাম- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, (৯) বৃহত্তর কুমিল্লা- চাঁদপুর, কুমিল্লা, (১০) রাজবাড়ি, (১১) ফরিদপুর।
অঞ্চল আদিবাসী জাতি বা ভাষা
(১) বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল- গারো হাজং কোচ
ময়মনসিংহ, টাংগাইল, নেত্রকোণা, বর্মন ডালু হদি
জামালপুর, শেরপুর ইত্যাদি বানাই রাজবংশী
(২) গাজীপুর বর্মন কোচ গারো
(৩) উপকূল অঞ্চল- পটুয়াখালি, রাখাইন
বরগুনা ও কক্সবাজার
(৪) বৃহত্তর সিলেট- সিলেট, সুনামগঞ্জ, খাসি গারো হাজং
মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ অঞ্চল মনিপুরি পাত্র খাড়িয়া
সাঁওতাল ওরাওঁ ত্রিপুরা
(৫) পার্বত্য চট্টগ্রাম- রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও চাকমা মারমা ত্রিপুরা
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা অহমিয়া বম লুসাই
তঞ্চঙ্গ্যা ম্রো গোর্খা
চাক পাংখোয়া খুমি
সাঁওতাল গারো খ্যাং
(৬) দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল- যশোর, বাগদি (বুনো) রাজবংশী সাঁওতাল
সাতক্ষীরা, খুলনা,
(৭) উত্তরবঙ্গ- রাজশাহী, দিনাজপুর, সাঁওতাল ওরাঁও মুন্ডা
রংপুর, গাইবান্ধা, নওগাঁ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মালো মাহালি খন্ড
চাপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর বেদিয়া ভূমিজ কোল
টুরি বিল কর্মকার
মাহাতো মুরিয়ার মুশহর
পাহান পাহাড়িয়া রাই
সিং
(৮) বৃহত্তর চট্টগ্রাম- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার চাকমা মারমা ত্রিপুরা
(৯) বৃহত্তর কুমিল্লা- চাঁদপুর, কুমিল্লা ত্রিপুরা
(১০) রাজবাড়ি ত্রিপুরা
(১১) ফরিদপুর ত্রিপুরা
সূত্র: বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ২০০২, টেরি ডারনিয়ান ২০০৭, বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ২০১৩
বাংলাদেশের এসব আদিবাসী জাতিগুলোর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ভাষার নিজস্ব লিপি রয়েছে। তবে অধিকাংশ ভাষারই নিজস্ব লিখিত রূপের প্রচলন রয়েছে।
চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন ইত্যাদি ভাষা নিজস্ব লিপিতে লেখা হয়। ককবরক (ত্রিপুরাদের ভাষা), বম, লুসাই, পাংখোয়া, গারোসহ কয়েকটি ভাষা রোমান লিপিতে লেখা হয়। বাংলায় লেখা হয় সাদ্রি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিসহ কয়েকটি ভাষা।
লিপি বিতর্কের মধ্যে রয়েছে সাঁওতালদের ভাষা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলা, রোমান ও অলচিকি লিপিতে সমান্তরালে লেখালেখির ব্যবস্থা প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি এই ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করতে চাইলে এককভাবে বাংলা নাকি রোমান লিপিতে লেখা হবে, এ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি সাঁওতাল নেতৃবৃন্দ।
ভাষা বিকাশের অন্যতম উপায় হলো লিখিত ও অলিখিত উভয় ধারাতেই ভাষার স্বত্বস্ফুর্ত ব্যবহার। বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষাগুলো দীর্ঘদিন ধরে মৌখিক সাহিত্যের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
গানে, কবিতায়, ছড়ায়, ছন্দে এসব ভাষার বিকাশ ঘটেছে, রচিত হয়েছে সেসব ভাষাভাষি মানুষের কালের ইতিহাস। কিন্তু কালে কালে পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতির চাপ ও আধুনিকতা নামের দ্রুত ধাবমান দানবের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সব আদিবাসী ভাষার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।
তাই নানা ভাষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে অনেক ভাষা হারিয়ে ফেলতে থাকে তার নিজস্ব রূপ ও জৌলুস। অনুপ্রবেশ ঘটে অন্যান্য ভাষার অনুষঙ্গ।
স্বাভাবিক বিকাশের ধারায় গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়া ও মিথস্ক্রিয়া না হওয়ায় অনেক জাতিগোষ্ঠি তাদের ভাষাই হারিয়ে ফেলে। দীক্ষা নেয় ভিন্ন ভাষা পরিবারের নতুন মন্ত্রে।
ভোট-বর্মী ভাষা পরিবারের অনেক জাতিগোষ্ঠি এখন রীতিমতো ইন্দো-আর্য ভাষা পরিবারের প্রভাবশালী সদস্যে পরিণত হয়েছে। লিখিত চর্চার অনুপস্থিতি বা সীমিত সুযোগের কারণে অনেক ভাষার এই পরিণতি হয়েছে বলে ভাষা বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
অন্যদিকে লিখিত চর্চারও আনুষ্ঠানিক কোন সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা আদিবাসী ভাষাগুলো পায় না।
আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ প্রকাশনা ও সাহিত্যকর্মই ব্যক্তিগত উদ্যোগ অথবা ক্লাব-সমিতি কেন্দ্রিক কার্যক্রমের অংশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান থেকেও আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা বের হয়।
কিন্তু একাডেমিক শিক্ষায় এসব ভাষার ব্যবহার সরকারি পৃষ্ঠপোষন ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। একাডেমিক শিক্ষায় আদিবাসী ভাষাগুলোর ব্যবহার বিশেষ পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃটিশ আমলেও প্রচলিত ছিল।
কিন্তু কালের বিবর্তনে তা আজ ইতিহাসের অংশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে একক শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত করার লক্ষ্যে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন শুরু হয়।
ফলে প্রাথমিক শিক্ষাসহ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একমাত্র বাংলাই প্রচলিত হয়। শ্রেণি কক্ষে আদিবাসী ভাষাসহ সকল আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করার নিয়ম প্রচলন করা হয়।
ফলে শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে পড়ে বাংলা ভাষার সংস্পর্শে না আসা প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসী শিশুরা। প্রাথমিক শিক্ষার চক্র সমাপ্তির আগেই ঝরে পড়তে থাকে তারা।
ক্লাসের পড়ায় অমনোযোগিতা, অনিয়মিত উপস্থিতি, পরীক্ষায় অকার্যকারিতাসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও দেখা দেয় আদিবাসী শিশুদের মাঝে।
এসব প্রেক্ষাপট অনুধাবন করে ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলন করার বিষয়টি সন্নিবেশ করা হয়।
এই চুক্তির পরবর্তী সময়ে গৃহিত বিভিন্ন আইনী দলিলগুলোতেও এই বিষয়টি সন্নিবেশ করা হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর আইনসমূহ ১৯৯৮, দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্র, দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ইত্যাদি সরকারি নীতি ও কৌশলপত্রেও আদিবাসী শিশুদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে।
দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির অধীনে ‘Primary Education Situational Analysis, Strategies and Action Plan for Mainstreaming Tribal Children’ নামের একটি বিশেষ পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়।
এই পরিকল্পনা অনুসারে জনগোষ্ঠিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করা, শিক্ষকদের জন্যে প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা, মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থাসহ প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন করা, আদিবাসী সংস্কৃতি সন্নিবেশ করার লক্ষে পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার্থীদের স্কুলে গমন নিশ্চিত করার লক্ষে টিফিন ব্যবস্থার মতো বিশেষ সুবিধা বা স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি ও অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নমনীয় স্কুল ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করা যেখানে আদিবাসীদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবিকাকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে, স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি সন্নিবেশ করে সহপাঠক্রমিক শিখন- শেখানো সামগ্রী প্রণয়ন করা ইত্যাদি।
পিইডিপি-২’র পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতেও পূর্বের পরিকল্পনাগুলো ঠিক রেখে আরো কিছু নতুন পরিকল্পনা সংযুক্ত করা হয়।
আদিবাসীদের মাতৃভাষা সুরক্ষায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের অধিকারের স্বীকৃতি।
ব্যাকরণগত কিছু ব্যত্যয়ের কারণে সমালোচিত হওয়া ছাড়া আইনী ভিত্তি হিসেবে এই শিক্ষানীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ২০১০ সালে প্রণীত এই জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও নীতি হিসেবে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্রজাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো, আদিবাসী শিশুরা যাতে নিজেদের ভাষা(য়) শিখতে পারে সেজন্যে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় আদিবাসী জনগোষ্ঠিকে সম্পৃক্ত করা, আদিবাসী এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা, প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীসহ সকল জাতিসত্তার জন্যে স্ব স্ব মাতৃভাষা(য়) শিক্ষার ব্যবস্থা রাখা, যেসব এলাকায় হালকা জনবসতি রয়েছে প্রয়োজন হলে সেসব এলাকার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা এবং এলাকার জীবন-জীবিকা ও মৌসুম অনুসারে নমনীয় স্কুলপঞ্জিকা নির্ধারণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথরেখা অনুসরণ করে নানা প্রতিকুল পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৯৯৯ সালে বাংলার দামাল ছেলেদের সেই আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০০ সাল হতে দিবসটিকে পৃথিবীর প্রায় ২০০টি সদস্য রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় উদযাপন শুরু করে।
এই ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে সারা পৃথিবীর বুকে গৌরবের সাথে তুলে ধরে। সাথে সাথে বাংলাভাষি জনগণের জন্য এই ঘোষণা একটি দায়বদ্ধতা তৈরী করে দেয়।
কারণ, রাষ্ট্রভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার বিপরীতে স্থানীয় বা অন্যান্য প্রান্তিক ভাষার বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় নেওয়াটাই ভাষা-সুবিচার বা ভাষা-ন্যায্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষিদের ভাষাপ্রীতি বিশ্বের অন্য সকল ভাষার মানুষদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা।
তাই রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে বসবাসকারী সর্বদিক থেকে প্রান্তিক এই সংখ্যায় কম জাতিসত্ত্বাগুলোর নিজেদের ভাষা সংরক্ষণ বা বিকাশের দাবীগুলোও আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলা ভাষার প্রতি একজন বাংলাভাষি মানুষের যে দরদ সে দরদ একজন আদিবাসীর মধ্যেও সমানভাবে বিরাজ করা স্বাভাবিক। কোন ভাষা সংরক্ষণ বা বিকাশের জন্য ‘চর্চার’ বিষয়টিই মূখ্য।
চর্চা ছাড়া কোন ভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণ কোনটাই সম্ভব নয়। তাই বেসরকারিভাবে হলেও অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের আদিবাসীদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করার জন্যে নানামুখি উদ্যোগ নিয়ে চলেছে।
শিক্ষার বুনিয়াদ শক্ত হয় মাতৃভাষায়। সে শিক্ষা আরও শানিত হয় যদি তার বিষয়বস্তু হয় তার পারিপার্শ্বিক ও পরিচিত পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন। মাতৃভাষাই শিশুকে তার পরিবেশ ও বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের সাথে পরিচয়ের যোগসুত্র হিসেবে কাজ করে।
এ ভাষায় সে তার অভাব, চাহিদা, ও অনুভুতির কথা প্রকাশ করে, তার আনন্দ, ভালোলাগা তার বেদনা অন্যকে জানায়। মাতৃভাষা একটি শিশুর কেবল ভাব প্রকাশের বাহন তা নয়।
বরং এর মাধ্যমে সে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য ও ঘটনার বিবরণ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও প্রকাশ করে। মাতৃভাষা শিশুর অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়িয়ে তার পরিচয় ও ধারণার সীমানাকে ক্রমশ সম্প্রসারিত করে।
তার চারিপাশে অনেক নতুন ও অচেনা বস্তু ও শব্দের আনাগোণা চলতে থাকে। এসব কিছুর মধ্যে তার সমস্ত চিন্তাভাবনা, আনন্দ-বেদনা, জ্ঞান ও জিজ্ঞাসা মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকে।
মাতৃভাষার উপর ভর করেই মানবশিশু ক্রমে অন্য ভাষার সাথে সার্থক সংযোগ স্থাপন করে। এভাবেই নিজের জানা জগতের গন্ডি পেরিয়ে একটি শিশু ক্রমে অজানা জগত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান লাভ করে।
মাতৃভাষার এই গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও জাতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ২০১২ সাল হতে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে দেশের আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
৩১ অক্টোবর ২০১২ তারিখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব জনাব এম এম নিয়াজউদ্দিনের সভাপতিত্বে প্রথমবারের মতো একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে বিভিন্ন জাতিসত্তার মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এ সভায় একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) জনাব সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আহবায়ক করে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠির প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পরবর্তীতে একটি টেকনিক্যাল কমিটি, একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কমিটি এবং ভাষাভিত্তিক লেখক কমিটি গঠন করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, সাদ্রি ও সাঁওতাল ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে সকল ভাষায় অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিকল্পনাও হাতে রাখা হয়।
সরকারি এই উদ্যোগে এমএলই ফোরামকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত করা হয়। উল্লেখ্য এমএলই ফোরাম হলো আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সম্মিলিত একটি জোট।
এমএলই ফোরাম তার সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহায়তা করে থাকে। সরকারি এই কর্মযজ্ঞে প্রাথমিকভাবে ৬টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সাঁওতালরা তাঁদের বর্ণমালার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের ভাষায় শিখন শেখানো উপকরণ প্রণয়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়।
তাই ১৪ জুলাই ২০১৩ তারিখে অনুষ্ঠিত এমএলই বিষয়ক সরকারের জাতীয় কমিটির সভায় আপাতত ৫টি ভাষায় উপকরণ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরী (বিষ্ণুপ্রিয়া), মণিপুরী (মৈতৈ), তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি ও বম; তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, কুড়ুক (ওঁরাও), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভাষাগুলোও প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যবহার করা হবে বলে আশা করা যায়।
আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু করার টার্গেট করা হয়েছিল, কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি।
এরপর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তা শুরু করার জন্য আবারও টার্গেট করা হয়। কিন্তু এবারও এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। তারপর আমাদের সামনে টার্গেট হিসেবে এসে দাঁড়ায় জানুয়ারি ২০১৬।
এবার কিন্তু আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। বিগত ২৬ থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে জাতীয়ভাবে আয়োজিত কর্মশালার মাধ্যমে ইতোমধ্যে এমএলই ব্রিজিং প্লান প্রণয়ন করা হয়েছে।
২০১৫ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কালে কয়েক দফায় পাঁচ আদিবাসী ভাষার লেখক-গবেষকদের সমন্বয়ে গঠিত লেখক প্যানেলের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শিখন-শেখানো উপকরণ প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
এখন বাকি রয়েছে কেবল প্রণীত উপকরণসমূহের যৌক্তিকতা যাচাই কর্মশালা, উপকরণ প্রকাশ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে ছেড়ে দেওয়া বা স্কুল পর্যায়ে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা।
কিন্তু জানুয়ারি খুব দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে, আমরা এখনো শিখন- শেখানো উপকরণ প্রণয়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে পারিনি।
অন্তত এই বছরের জুলাই মাসের মধ্যে যদি আমরা পরীক্ষামূলক সংস্করণটি প্রকাশ করতে না পারি, তাহলে প্রজন্মের কাছে আমরা কোন জবাবদিহি করতে পারবো না।
আদিবাসী জাতিগুলো এখনো পথ চেয়ে রয়েছে, কখন আলোর মূখ দেখবে বহুদিনের কাঙ্খিত সেই মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার।
আশা করি সংশ্লিষ্ট মহল আদিবাসী জাতিগুলোর এই অপেক্ষার একটি সফল সমাপ্তি রেখা টানতে সক্ষম হবেন। আদিবাসী জাতিগুলোর আশা-আকাঙ্খাগুলো যেন আলো-আঁধারি পথরেখায় হারিয়ে না যায়- এই কামনাই করি।
লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।