স্বাধীনতা উত্তর পার্বত্য অঞ্চলে নৃগোষ্ঠীর বাংলা সাহিত্যচর্চা সংক্ষিপ্তসার

Jumjournal
Last updated Mar 14th, 2020

1219

featured image

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে অবস্থিত প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতন সাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা (প্রতিষ্ঠা ১৮৬০) বর্তমানে তিনটি জেলায় – রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা – বিভক্ত।

এই অঞ্চল অধুনা পার্বত্য অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানে এগারটি নৃগোষ্ঠীর -চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, বম, পাংখুয়া, লুসাই, চাক, খিয়াং ও খুমি – বসবাস। প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে।

চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা ইন্দো আর্য ভাষার অন্তর্গত দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যান্যদের ভাষা তিব্বতি-ব্রহ্মী ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত। বাঙালিদের সংস্পর্শে এসে তারা বাংলা শিখেছেন। এক নৃগোষ্ঠীর ভাষা অপর নৃগোষ্ঠী বোঝেনা।

তাদের মধ্যে ভাষা বিনিময়ের মাধ্যম হল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলার বিকৃত রূপ। ১৯০১ সালে এ অঞ্চলে শিক্ষার হার ছিল ২%, স্বাধীনতা উত্তর প্রথম আদমশুমারি (১৯৭৪) তে তা ১৮.২৪% এ উন্নীত হয়।

প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব লোকসাহিত্য সুদীর্ঘকাল থেকে প্রচলিত। অনেক নৃগোষ্ঠীর ভাষার নিজস্ব হরফ আছে। লোকসাহিত্যের স্তর অতিক্রম করে অনেক নৃগোষ্ঠী বাংলা হরফে নিজ ভাষায় আধুনিক সাহিত্যচর্চা শুরু করেছে বিগত শতকে।

স্বাধীনতা পূর্বকালে তারা বাংলা সাহিত্যচর্চাও শুরু করেছে স্বাধীনতা উত্তরকালেই তাদের নিজ নিজ ভাষায় সাহিত্যচর্চাসহ বাংলা সাহিত্যচর্চা বেগবান হয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলে বাংলা সাহিত্যচর্চা শুরু হয় চাকমা রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে। আর তার নেতৃত্বে ছিলেন রাণী বিনীতা রায়। তাঁর পরিচালিত সাময়িকপত্র ‘গৈরিকা’ বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিবেশ তৈরি করে।

দেশ বিভাগের পর প্রথম ১২/১৪ বছর সম্ভবত রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বাংলা সাহিত্যচর্চা ঝিমিয়ে পড়ে। বিশ শতকের ষাটের দশকে এসে ‘ঝরণা’ ও ‘পার্বত্যবাণী’ সাময়িক পত্রকে কেন্দ্র করে তা আবার আবর্তিত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাংলা নববর্ষে বিঝু উপলক্ষে দুখানা বিঝু সংকলন প্রকাশিত হয়। স. ন. দেওয়ান সম্পাদিত জুভাপ্রদ প্রকাশিত ‘বিজু’ এবং দীপংকর শ্রীজ্ঞান সম্পাদিত মুড়াল্যা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী প্রকাশিত ‘লুরা’ পার্বত্য অঞ্চলে লিটল ম্যাগাজিনের পথিকৃৎ।

১৯৭২ সালে থেকেই তরুণ সাহিত্যামোদী ও সাহিত্য কর্মীদের উদ্যোগে বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠন গঠিত হতে থাকে। চাকমা,মারমা ও ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্যচর্চা প্রধান লক্ষ্য হলেও বাংলা সাহিত্যচর্চায় ও এসব সংগঠন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের ধারা বেগবান হয়। বিঝু উপলক্ষে কেবল পার্বত্য অঞ্চল থেকে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী প্রভৃতি স্থান থেকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন পার্বত্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা সংকলন প্রকাশ করতে থাকে।

সাপ্তাহিক বনভূমি, দৈনিক গিরিদর্পণসহ অন্যান্য পত্রপত্রিকাও বাংলা সাহিত্য চর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা করে। বিঝু ছাড়াও নববর্ষ , শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস প্রভৃতি দিবস উদযাপন উপলক্ষে সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে।

১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় উপজাতীয় (বর্তমান নাম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর’) সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ‘। এই সংস্থা সাময়িকপত্র, গবেষণাপত্র ও গ্রন্থ প্রকাশে ব্রতী হয়।

ঢাকা বা চট্টগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা ও পার্বত্য অঞ্চলের লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহী হয়। বাংলা একাডেমী,বাংলাদেশ শিশু একাডেমীসহ অনেক প্রকাশনা সংস্থা পার্বত্য লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশ করা শুরু করে।

স্বাধীনতা পূর্বকালে যাঁরা সাহিত্য চর্চা করতেন তাঁদের লেখা প্রকাশের সুযোগ ছিল একেবারে কম। স্বাধীনতা উত্তরকালে সংবাদপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশে গতি আসে। ফলে পার্বত্যবাসীর বাংলা সাহিত্যচর্চা এগিয়ে এবং তা ক্রমে বৃহত্তর বাঙালি পাঠকদের দৃষ্টিগোচর হয়।

স্বাধীনতা পূর্বকালে যারা সাহিত্যচর্চা শুরু করেন তারা উত্তরকালেও সাহিত্যচর্চায় অধিকতর মনোনিবেশ করেন  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বঙ্কিমকৃষ্ণ দেওয়ান, অরুন রায়,সলিল রায়,কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, নোয়ারাম চাকমা, বরেন ত্রিপুরা, ভগদত্ত খীসা, সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।

স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলা সাহিত্য চর্চায় এগিয়ে আসেন সুগত চাকমা, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান চাকমা, রাজা দেবাশীষ রায়, মৃত্তিকা চাকমা, সুহৃদ চাকমা, শিশির চাকমা, শান্তিময় চাকমা,

কে ভি দেবাশীষ চাকমা,অশোক কুমার মেওয়ান, শরদিন্দু শেখর চাকমা, নীরু কুমার চাকমা, নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রতিম রায়, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা,

প্রভাংশু ত্রিপুরা, মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, শোভা ত্রিপুরা, ক্য শৈ প্রু, মং ক্য শোয়েনু নেভী, মা উ চিং,মং মং চাক, অংছাইন চাক, চিং অং চাক, লাল নাগ বেগম, সাংতেয়া পাংখোয়া, সিং ইয়ং ম্রো, পারকুম লুসাই প্রমুখ।

স্বাধীনতা পূর্ব যুগে পার্বত্য অঞ্চলের লেখকদের লেখা বাংলা ধর্মীয়গ্রন্থ ও ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তরযুগে তাঁদের রচিত বাংলা কবিতা গ্রন্থ, উপন্যাস, গবেষণা ভ্রমণকাহনী, লোকসাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

এসময়ে পার্বত্যবাসীরা নিজস্ব মাতৃভাষার যতটা সাহিত্যচর্চা করেছেন তার চেয়ে বেশি করেছেন বাংলা সাহিত্যচর্চা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য তাদের মমতা অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের অবদান আর উপেক্ষিত থাকছে না।

এ গন্দি তারা অতিত্রম করে এসেছেন। বৃহত্তর বাঙালি পাঠক সমাজ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান চাকমা, শরদিন্দু শেখর চাকমা, নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রভাংশু ত্রিপুরা, সুগত চাকমা,

সুহৃদ চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সুপ্রিয় তালুকদার, শোভা ত্রিপুরা প্রমুখের সাহিত্যচর্চার সঙ্গে পরিচিত। কাজেই পার্বত্য অঞ্চলে নৃগোষ্ঠীর বাংলা সাহিত্য চর্চা স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক অর্জন।


লেখক : নন্দলাল শর্মা

তথ্যসূত্র : আলাম – ২০১২ইং, (বনযোগীছড়া কিশোর কিশোরী কল্যাণ সমিতি, বনযোগীছড়া, জুরোছড়ি, রাঙামাত্যা)

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা