বাংলা হরফে চাকমা ভাষা উচ্চারণের সমস্যা ও তার সমাধান
3129
গোত্রগত ও অঞ্চলগত ভিন্নতা ছাড়া চাকমা শব্দ উচ্চারণে চাকমা ভাষাভাষীদের মধ্যে সবচাইতে লক্ষনীয় পার্থক্য সম্ভবত শহরবাসী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে। এই পার্থক্যও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
এর সাথে জড়িত রয়েছে চাকমা ভাষাভাষী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মর্যাদা। সাধারনত যারাই বেশী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করেছে তারাই বেশী বিদেশী শব্দ ব্যবহার করে থাকেন, বিশেষ করে বাংলা শব্দ। উচ্চরণের ক্ষেত্রেও তারাই অধিক ভুল করে থাকেন।
চাকমা ভাষা বলাকালে অনেক চাকমা ব্যক্তি বাংলা বা অন্য কোন বিদেশী শব্দ ব্যবহার করেন। যেখানে চাকমা ভাষায় যথাযোগ্য শব্দ নেই, বিদেশী শব্দ ব্যবহার করাটা যৌক্তিক। তবে চাকমা শব্দের অস্তিত্ব থেকেও অনেকে বাংলা বা অন্য বিদেশী শব্দ ব্যবহার করে থাকে। যেমন “লাইনত থিঅ” না বলে “লাইনত দাড়-অ” বলা।
“ধুপ” না বলে “সাদা” বলা। “সোম্যেগোই” না বলে “ঘোল্যেগোই” বা “ধুক্যেগোই” বলা ইত্যাদি। তবে এই সমস্যা হয়তো অন্য কোন সময় আলোচনা করবো। এই প্রবন্ধে আমার আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হলো বাংলা হরফে চাকমা শব্দ উচ্চারণের সমস্যা।
উল্লেখ্য যে বাংলা হরফে পড়ে চাকমা গান গাওয়ার সময় অনেক শিল্পীই বাংলার উচ্চারণের ধারা অনুসরন করে চাকমা শব্দসমূহ উচ্চারণ করে থাকেন। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এবং সীমিতভাবে ভারতের মিজোরামের অনেক গায়ক-গায়িকাদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। ভারতের অরুনাচল প্রদেশে ও বার্মার (উভয় অঞ্চলে বাংলার প্রচলন নেই) কি অবস্থা আমার জানা নেই। উদাহরণ দিয়ে বলি।
যেটা আমার সবচাইতে কানে লেগেছে, সেটা হলো যেভাবে সংশ্লিষ্ট চাকমা শব্দটিতে ইংরেজী z বর্ণের উচ্চারণ হওয়া উচিৎ, তথাপি তা না হয়ে ইংরেজী j বর্গের উচ্চারণ করা হচ্ছে। যেমন: Bizu না বলে Biju বলা হচ্ছে। Aazu না বলে Aaju বলা হচ্ছে।
আপনারা খেয়াল করে থাকবেন যে আমি Roman বা সাধারন অর্থে ইংরেজী বর্ণ দিয়ে উপcvfক্ত “বিঝু” ও “আজু” শব্দসমূহ লিখেছি। কারণটা হলো চাকমা ভাষার Bizu ও Azu শব্দ সমূহ বাংলা হরফে লিখতে গেলেই আমাদের “য”, “জ” বা “ঝ” বর্ণ ব্যবহার করতে হয়। বাংলায় z উচ্চারণ নেই। তাই আরবী Zahed বা ইংরেজী Zebra শব্দদ্বয় অনুরূপভাবে বাংলা বর্ণ দিয়ে লেখা হলে শব্দসমূহ সঠিকভাবে উচ্চারণ করা সম্ভবপর নয়।
বাংলা হরফে ইংরেজী ও বর্ণের উচ্চারণ সম্ভব নয়। বাংলা “চ”, “ছ’, “স”, “ব” বা “শ” যে বর্ণই ব্যবহার করা হোক না কেন, s বর্নের উচ্চারণ আসবে না।
কাজেই চাকমা Saan, Songora, Sodok ইত্যাদি বাংলায় লিখে সঠিক উচ্চারণ করা যাবে। একইভাবে ইংরেজী Sun বা আরবী Salam শব্দসমূহও বাংলায় লিখতে গেলেই সমস্যা (“সান”, “সালাম”, “ছালাম” ইত্যাদি)।
রাঙ্গামাটির জনৈক চাকমা ব্যবসায়ী তার দোকানের নাম সাইনবোর্ডে লিখতে গিয়ে বাংলা বর্ণে “বেলছদক” আর ইংরেজী বর্ণে Belochodok লিখেছেন। উচ্চারণগতভাৰে Belochodok না লিখে Belosodok লেখাটাই যথার্থ হতো।
এই ক্ষেত্রে সহজেই অনুমেয় যে ব্যবসায়ী প্রথমে চাকমা শব্দটি বাংলা হরফে বানান করেছেন এবং পরে বাংলা বানানের অবলম্বনে চাকমা শব্দটির ইংরেজী বানান করেছেন।
কোন একটি শব্দ উচ্চারণ করার আগে আমরা কোন সময় শ্রুতিগত স্মৃতি (sonic memory) অনুসরণ করি আর কোন সময় দৃষ্টিগত স্মৃতি (visual memory) অনুসরণ করি। আমরা শৈশবে যেভাবে অন্যের কাছ থেকে ভাষার ধ্বনি শুনে ভাষা বলতে শিখি, তাতে আমরা শ্রুতিগত স্মৃতি অনুসরণ করেই ভাষা শিখি।
এটাই ভাষা শেখার সর্বশ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। অন্যদিকে, আমরা যখন লিখিত হরফ পড়ে ভাষা শিখি ৰা চৰ্চা করি, তখন আমরা দৃষ্টিগত স্মৃতি স্মরণ করেই ভাষা শিখি বা শব্দ উচ্চার করি। যাদের অক্ষর জ্ঞান নেই তাদের উচ্চারণে সমস্যা নেই বা কম এবং তারা শ্রুতিগত স্মৃতি অনুসরণ করে থাকেন।
আর যারা দৃষ্টিগত স্মৃতিকে প্রাধান্য দেন তারা সংশ্লিষ্ট লিপির বানানুসারে শব্দটি স্মরণে এনে সেই বানানের উচ্চারণ কাঠামো অনুসারেই শব্দটির ধ্বনি বাচনিকভাৰ উচ্চারণ করে থাকেন এবং সেভাবে অন্য লিপিতেও লিখেন।
উচ্চারণের সমস্যা উদ্ভব হয় যখন আমরা এমন একটি ভাষার লিপি দৃষ্টিগত স্মৃতি দিয়ে স্মরণ করি, যেই লিপির ধ্বনিতত্ব শব্দটির সঠিক উচ্চারণে সহায়ক নয়।
কেউ কেউ বলে থাকেন যে বাংলা বা ইংরেজী হরফ ব্যবহার না করে চাকমা হরফ ব্যবহার করলে উচ্চারণের সমস্যা হতো না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যারা এই মতে বিশ্বাস করেন আমি তাদের সাথে আংশিকভাবে সমমত পোষণ করলেও পুরোপুরি একমত না।
শিক্ষিত চাকমা ভাষাভাষী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চাকমা বর্ণ ব্যবহার করেও মূল চাকমা শব্দসমূহ উচ্চারণের ক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজী, হিন্দি বা অন্যান্য অ-চাকমা হরফের দৃষ্টিগত ও শ্রুতিগত স্মৃতিকে মাতৃভাষার ধ্বনিতত্ব অনুসারে নিয়ন্ত্রনে বা তত্ত্বাবধানে রাখতে পারছেন কিনা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি যদি প্রথম লিপি হিসেবে চাকমা লিপিতে শিক্ষিত হন, তাহলে সমস্যা হয়তো হবে না, বা কম হবে। তিনি যদি চাকমা ব্যতীত অন্য কোন লিপিকে প্রথম লিপি হিসেবে গ্রহন করে থাকেন, তাহলে সমস্যা হতে পারে।
আমার প্রয়াত স্ত্রী রাণী তাতু আমাকে একবার বলেছিলেন যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী পড়ার সময় mother tongue Interference এর কথা শিখেছেন। Linguistics এর এই তত্বে একটি hypothesis আছে যে অনেক ক্ষেত্রে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা অনুশীলনের বা চর্চার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার জ্ঞান বাধা দিতে বা Interfere করতে পারে।
উপরোল্লেখিত উচ্চারণের সমস্যার উদাহরণের বেলায় আমরা mother tongue (মাতৃভাষা) বা প্রথম ভাষা (first language) হস্তক্ষেপের পরিবর্তে first script interference (প্রথম লিপির হস্তক্ষেপ) এর কথা ভাবতে পারি।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে একটি উদাহরণ টানি। যেহেতু আমার প্রথম লিপি হলো ইংরেজী (দ্বিতীয় বাংলা, তৃতীয় চাকমা) আমার বেলায় প্রথম লিপির হস্তক্ষেপ আসে ইংরেজী থেকে। তাই বোধহয় আমার ক্ষেত্রে।
আর ৫ এবং ১ আর ch বা sh -এর উচ্চারণের ক্ষেত্রে যাদের প্রথম লিপি বাংলা তাদের চাইতে সমস্যা কম (যেমন: আমি Bozo বলি Bojo বলিনা। Sanah বলি Chanah বলিনা। Sugun বলি Shuguni বলিনা)।
তবে ইংরেজী ভাষার দৃষ্টিগত ও শ্রুতিগত স্মৃতির কারণে চাকমা উচ্চারণে আমার অন্যান্য ক্ষেত্রে নিশ্চই ভুল হতে পারে। আপনাদের কারোর গোচরে এরকম ভুল লক্ষিত হলে অনুগ্রহ করে জানাবেন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আরেকটি বলি। মাঝে মধ্যে আমি চাকমা গান গাইবান সময় বাংলা ও ইংরেজী দুই হরফে লেখা গানের কলি উচ্চারণ করেছি। উভয় ক্ষেতে তেমন অসুবিধা বোধ করিনি।
অন্তত j বনাম z এবং s বনাম ch এর ক্ষেত্রে রাজপুণ্যার সময় চাকমায় বক্তব্য রাখার সময়ও আমি ইংরেজী ও বাংলা দুই হরফই ব্যবহার করেছি, তবে শব্দগত ও উচ্চারণগত পরামর্শের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে জয় ঈসথেটিকস কাউন্সিলের ঝিমিত ঝিমিত চাকমা প্রমূখ বন্ধুগণের স্বরণাপন্ন হয়েছি।
বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু চাকমা সঙ্গীত শিল্পীদের চাকমা গানে আমি ভুল উচ্চারণ লক্ষ্য করেছি। এ সব সমস্যা হয়েছে z ও s উচ্চারণে এবং এমন কি ইংরেজী বা ফরাসী ভাষায় “silent h” (honour, hour) উচ্চারণের বেলায় যেমন Aazu, Saan, Holodya ইত্যাদি শব্দ উচ্চারণের ক্ষেত্রে (যেমনঃ Olodya না বলে Holodya বলা)।
বাংলাদেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে বাংলা হরফের হস্তক্ষেপের সমস্যা কেবল চাকমা ভাষাভাষীরা ভূগছে না। বাংলায় শিক্ষিত ত্রিপুরা, মারমা, চাক ও অন্যান্য জুম্ম বা পাহাড়ী জাতির সদস্যদেরও অনুরূপ সমস্যা হচ্ছে।
তবে ভাষাগত ও শব্দের উচ্চারণগত (phonetics) সাদৃশ্যের কারণে হয়তো চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ক্ষেত্রে যতখানি সমস্যা অন্য জাতিদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা অপেক্ষাকৃত কম। তবে এ ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা কি কেবল সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠি সদস্যরাই বলতে পারবেন।
অন্যান্যের মধ্যে Roman বা ইংরেজী হরফে চাকমা উচ্চারণের সুবিধা হবে সেই চাকমা ভাষাভাষীদের বেলায় যারা বিদেশে থাকেন। তা ভারতের অরুনাচল প্রদেশ হোক বা মায়ানমার (বার্মা), ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া বা উত্তর আমেরিকায় হোক।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও যারা Roman হরফ জানেন তারা উচ্চারণের সুবিধার জন্য বংলা হরফ ব্যবহার না করে Roman হরফ ব্যবহার করতে পারেন (যদি তারা চাকমা বর্ণ জানেন না)।
আর যদি চাকমা বর্ণে শিক্ষিত হন তাদের ক্ষেত্রে বাংলা, Rorman বা অন্য কোন বিদেশী হরফ ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সাধারন ক্ষেত্রে থাকবে না ( তবে তাদের প্রথমলিপি বাংলা হলে উচ্চারণের সমস্যা তথাপিও রয়ে যেতে পারে)।
কিন্তু computer অথবা cellphone ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তথাপিও Roman (বাংলা বা অন্য কোন) হরফ ব্যবহার করতে হতে পারে।
কোনদিন বাংলাদেশের চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে চাকমা বর্ণ শেখানো হলেও, যেই অঞ্চলে চাকমারা সংখ্যায় কম, সেই অঞ্চলের চাকমা শিশুরা চাকমা লিপিতে নিরক্ষর রয়ে যেতে পারে।
কিছু কিছু দেশের অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে এসব এলাকায় ছুটির দিনে বিশেষ চাকমা লিপির পাঠ্যসূচী সম্বলিত শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহন করে এ সমস্যার আংশিক সমাধান হলেও পূর্ণাঙ্গ সমাধান হবে না।
কাজেই চাকমা বর্ণের পাশাপাশি Roman বর্ণের প্রয়োজনীয়তা রয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ও ভারতের মিজোরামের Chakma Autonomous District Council এলাকা (যেখানে চাকমা লিপি বিদ্যালয়ে শেখানো হয়) ব্যতীত অন্যান্য দেশ ও এলাকায়।
বিশিষ্ট লেখক প্রশান্ত ত্রিপুরার মতে, লিপি সংরক্ষনের চাইতে ভাষা সংরক্ষন করা অধিক জরুরী। আমি সমমত পোষণ করি।
উচ্চারণগত সমস্যাসমূহ সমাধান কারণে আমরা phonetics বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে পারি। পাশাপাশি video ও audio প্রযুক্তির সাহায্যও নিতে পারি। চাকমা ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সাদৃশ্য থাকায় বাংলা ভাষার হস্তক্ষেপ (Bengali Tongue Interference) এর সমস্যাটা চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের যথেষ্ট প্রকট।
কাজেই এই জাতিসত্বার সদস্যদের বেলায় সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য অধিক মনোযোগী হতে হবে।
Roman হরফ ব্যবহার করলেই যে সব উচ্চারণগত সমস্যা মিটে যাবে, তা না। এ ক্ষেত্রেও Roman হরফের phonetics-কে আমাদের নিজস্ব ভাষার প্রয়োজনানুসারে পরিবর্তিত করে নিতে হতে পারে।
যথা: ইংরেজীতে “হ” (h) ধ্বনিযুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি নেই বা কম। কাজেই mhaw, nhiye| শব্দ বানানের বেলায় সমস্যা হতে পারে। যেহেতু বাংলায় ব্যঞ্জনবর্ণের বা স্বরবর্ণের সাথে “হ” বর্ণ যুক্ত হয় , বাংলার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা হতে পারে।
একইভাবে চাকমা স্বরবর্ণ উচ্চারণের ক্ষেত্রেও phonetics – এর চিহ্নযুক্ত vowel ব্যবহার করলে সমস্যা কম হতে পারে। যথাঃ saan লিখতে গিয়ে ইংরেজীতে san লেখা যায় অথবা saan লেখা যায়।
একইভাবে fawth লিখতে গিয়ে fawth লিখবো নাকি foth লিখবো? অপেক্ষাকৃতভাবে এ-সকল স্বরবর্ণের ক্ষেত্রে বাংলায় অ-কার, আ-কার, ও-কার থাকায় সমস্যা নেই বলে চলে। কাজেই এসকল ক্ষেত্রে বাংলা হরফের চাইতে ইংরেজী হরফ ব্যবহারে অধিক সমস্যা হতে পারে। এখানে আমরা প্রচলিত ইংরেজী phonetics চিহৃ অথবা সংস্কারের মাধ্যমে phonetics বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে পারি।
সাম্প্রতিকভাবে এ বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে আমার সহধর্মীনি রাণী য়েন য়েন- এর মতামত হলো যে বাংলা হরফ ব্যবহার করেও উচ্চারণগত কিছু সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। যথা: বাংলা হরফের “শ”, “স”, “ষ” বর্ণসমূহকে প্রেক্ষাপট ভিত্তিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে।
একইভাবে বাংলার “চ”, “হ”, “জ”, “য” ইত্যাদি বর্ণসমূহের বিশেষ চিহ্নযুক্তভাৰে বা চিহৃ ছাড়া ব্যবহার করা যায়। তবে এখানে আবারও বলে রাখা দরকার যে আমি চাকমা বর্ণ বর্জন করে বাংলা বর্ণ ব্যবহার করা পক্ষে নই।
তবে বাংলা বর্ণ ব্যবহার করে কেউ চাকমা শব্দ উচ্চারণ করলে অন্তত তা যাতে সঠিকভাবে চাকমা শব্দগুলো উচ্চারণ করবেন (যেমনঃ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। সেটাই আমার উদ্দেশ্য।
Roman হরফের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সংস্কার করা যেতে পারে। ফরাসী ভাষায় দুটো c বর্ণ রয়েছে। একটির নীচে s যুক্ত রয়েছে অন্যাটি s বর্ণ ব্যতীত। প্রথমোক্ত বর্ণ ব্যবহার করলে s বর্ণের উচ্চারণ হয় ও দ্বিতীয় বর্ণ ব্যবহার করলে k বর্ণের বা ক্ষেত্রমতে s বর্ণের উচ্চারণ হয়।
যারা ভাবছেন যে চাকমা বর্ণ ব্যবহার করলেই আলোচ্য সমস্যার সমাধান হবে, তাদের কাছে বলবো যে, আমি তাতে দ্বিমত পোষণ করবো না, তবে সেই ক্ষেত্রেও কিছু কিছু সমস্যা রয়ে যেতে পারে, বিশেষ করে Bengali Tongue Interference (বা English Tongue Interference) এর কারণে। তবে চাকমা লিপি যদি প্রথম লিপি হয় তাহলে উচ্চারণগত সমস্যা হয়তো নাও থাকতে পারে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সংখ্যাগুরুর ভাষা বাংলার আধিপত্যের কারণে অধিকাংশ চাকমা ভাষীকে চাকমা ভাষার অক্ষর জ্ঞান দেওয়া এবং বিশেষ করে প্রথম লিপি হিসেবে অক্ষরজ্ঞান প্রাপ্ত করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অথবা অদূর ভবিষ্যতে দূরুহ ব্যাপার।
সুদূর ভবিষ্যতে হয়তো করা যেতে পারে। তাই, যথাসাধ্য প্রচেষ্টা ও প্রয়াস সত্বেও অনেক চাকমাভাষী চাকমা লিপিতে নিরক্ষর রয়ে যেতে পারে। সম্ভবত চাকমা বণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে Roman, বাংলা ও চাকমা বর্ণমালাকে কেবল উচ্চারণের সুবিধার্থে phonetics -এর স্বার্থে বিশেষ চিহৃ সংযুক্ত করে ব্যবহার করাটাই সঠিক উচ্চারণ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সর্বাধিক বাস্তবমুখী পদক্ষেপ হবে।
পাশাপাশি আমরা চাকমা লিপির ব্যবহার প্রসারের জন্যও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারি। আমার দপ্তরে আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকমা লিপি ব্যবহার করি।
পার্বত্য চর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও চাকমা লিপির ব্যবহার ধীর গতিতে হলেও বেড়ে চলেছে। এই ক্ষেত্রে সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীগণের যথাযথ ভূমিকা কাঙ্খিত।
বিগত ১৯ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে রাঙ্গামাটিতে একটি পরামর্শ সভায় অউপরোক্ত মতামতসমূহ একটি বিতরণত প্রবন্ধ ও power point presentation এর মাধ্যমে উপস্থাপন করি।
পাশাপাশি তনয় দেওয়ান “চাকমা বর্ণমালা ও বানানরীতি” শীর্ষক একটি চমৎকার প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। পরামর্শ সভায় শীর্ষস্থানীয় অনেক চাকমা সাহিত্যিকগণের উপস্থিতি ও অংশগ্রহনের জন্য আমি কৃতজ্ঞ।২
নিম্নে পরামর্শ সভার প্রকাশিত সুপারিশমালা বর্ণনা করছি।
সভায় অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিগণের মধ্যে দু’য়েক জন চাকমা বর্ণ ব্যতীত অন্য কোন বর্ণ ব্যবহার না করার পক্ষে মতামত দেন। তবে সংখ্যাগুরু অংশগ্রহনকারীগণ প্রেক্ষাপট অনুসারে এবং বিশেষ করে উচ্চারণের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে বাংলা, ইংরেজী বা অন্যান্য লিপি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান গ্রহন করেননি। পরামর্শ সভায় অন্যান্যের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয় সম্পর্কে ঐক্যমতে পৌছানো হয়।
• কোলকাতা, ভারতে শিশু করুণা সংঘের প্রাঙ্গনে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার (বার্মা) ও অন্যান্য দেশের চাকমা প্রতিনিধিগণের নিজস্ব অর্থায়নে চাকমা ভাষা ও বর্ণমালার উপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা।
• চাকমা ভাষা যথাযথভাবে উচ্চারণ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে বনিতত্ব বিশেষজ্ঞের অংশগ্রহণসহ চাকমা ভাষার ধ্বনিতত্ব বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করা (আশা করা যায় যে এই সম্মেলনে চাকমা ভাষা, লিপি, বানান পদ্ধতি ও নিতত্বের বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌছানো যাবে অথবা অন্তত ঐক্যমত আনয়নের কার্যকর পদ্ধতি নিরূপিত হবে)।
• চাকমা বানান রীতি বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করা।
• চাকমা ভাষাতে অপ্রয়োজনীয় বিদেশী শব্দের হস্তক্ষেপ রোধের উদ্দেশ্যে শব্দসমূহের তালিকা প্রস্তুত করা ও প্রয়োজনীয় প্রচারাভিযান করা (নাটক মঞ্চায়ন, ফিল্ম তৈরী, Facebook Page পরিচালনা, প্রকাশনা ইত্যাদি)
• বিকৃত ও বিলোপকৃত জায়গার নামসমূহের প্রকৃতরূপে নামকরণ ও পুনরুজ্জীবনে সমন্বিত ভূমিকা রাখা।
• চাকমা ভাষা বোর্ড অথবা একাডেমী গঠন করা (কোলকাতা সম্মেলনে যেহেতু বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের চাকমা অধ্যুষিত প্রধান প্রধান অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, সুতরাং এইরূপ সম্মেলনেই চাকমা ভাষা বোর্ড বা একাডেমী গঠন করা গ্রাহ্য হবে। বোর্ড বা একাডেমী চাকমা ভাষা সংক্রান্ত ভিন্নমত নিরসন করে নেতৃত্বমূলত দিক নির্দেশনা প্রদান করতে পারবে)।
তথ্যসূত্র:
১ এই প্রবন্ধটি UNDP-র সহায়তায় চাকমা রাজ কার্যালয় কর্তৃক রাজবাড়ী, রাঙ্গামাটিতে ১৯ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে আয়োজিত “বাংলা ও অন্যান্য হরফে চাকমা ভাষা উচ্চারণের সমস্যা ও তার সমাধান” শীর্ষক পরামর্শ সভায় উপস্থাপিত প্রবন্ধের সংশোধিতরূপ। এর সাথে সভার সুপারিশমালা সংযোজন করা হয়েছে।
২ পরামর্শ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে নিম্ন লিখিত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সুব্রত খীসা, দেবপ্রিয় চাকমা, শুভ্রজ্যোতি চাকমা, ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, প্রসন্ন কুমার চাকমা, অম্লান চাকমা, তনয় দেওয়ান, মৃত্তিকা চাকমা, শ্রীমৎ শ্ৰদ্ধালংকার মহাথেরো, বিজ্ঞান্তর চাকমা ও লেখক।
লেখক : দেবাশীষ ওয়াংঝা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।