পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপন
3056
বাংলাদেশ সরকার বলছেন বর্তমানে পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী মঙ্গোলীয় জাতিভুক্ত আদিবাসী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি ১১টি জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা বা আদিবাসী নয়।
তাদের পূর্বপুরুষেরা অন্য দেশ থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছে। বাঙালিরাই এখানকার আদি বাসিন্দা এবং তারাই আদিবাসী। এখানে আদিবাসী এবং আদি বাসিন্দা শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (International Labour Organization) ১০৭ নং সনদে (convention) অনুস্বাক্ষর করেছেন।
সেই সনদের ১ ও ২ নং অনুচ্ছেদে উপজাতি ও আদিবাসীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (International Labour Organization) ১৬৯ নং সনদের ১ নং অনুচ্ছেদের উপজাতি এবং আদিবাসীদের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার অদ্যাবধি সেই সনদে অনুস্বাক্ষর করেনি। সম্ভবত সরকার সেই কারণেই বলছেন যে, সেই সনদের সংজ্ঞাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বেলায় প্রযোজ্য। অর্থাৎ তারা আদিবাসী নয়।
তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার উভয় সনদের আদিবাসীর সংজ্ঞা এড়িয়ে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার বলছেন যে, বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও বাঙালিরাই আদি বসতি স্থাপনকারী বা আদিবাসী।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাসকারী মঙ্গোলীয় জাতিভুক্ত সবলোকই বহিরাগত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৭ ও ১৬৯ নং সনদে উপজাতি বা আদিবাসী হওয়ার জন্য কোন জনগোষ্ঠীর একটা দেশের বা দেশের একটা অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপনকারী হওয়ার কোন শর্ত নেই।
আদিবাসীর সংজ্ঞা ব্যাখ্যা করা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা বা প্রথম বসতি স্থাপনকারী কিনা তা পরীক্ষা করাই এর উদ্দেশ্য।
এখানে উল্লেখ্য যে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ উপমহাদেশের ঔপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর দাপ্তরিক বা বৃটিশ কর্মকর্তাগণ কর্তৃক এদেশের সমাজ, অর্থনীতি, এবং ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে রচিত বই পুস্তকের বাইরে অন্য কোথাও তথ্যাদি পাওয়া যায় না।
সেসব তথ্যাদির আলোকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনের বিষয়টা এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণাদি: অষ্টাদশ শতাব্দী
ফ্রান্সিস বুকাননই একমাত্র বৃটিশ নাগরিক এবং বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তা যিনি ২৬ এপ্রিল, ১৭৯৮ খ্রি: থেকে ৩ মে ১৭৯৮ খ্রি: তারিখ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ্রমণ করেছিলেন।
তারও আগে তিনি ২১ মার্চ ১৭৯৮ খ্রিঃ থেকে ১৭ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রি: পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়ার কোম্পানি হাট, চুনতি; চকোরিয়ার মানিকপুর, হারবাং, দুলাহাজরা, ঈদগড়, উখিয়া, রামু জোয়াবিয়া নদীর খুরুজকুল পর্যন্ত পৌঁছেন।
তিনি নাফ নদীর মোহনা পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নৌকার অভাবে সেখানে যেতে পারেন নি। ৩০ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রি: থেকে মহেশখালী দ্বীপ ভ্রমণ ও তথায় কয়েকদিন অবস্থান করে একই পথ ধরে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ১৮ এপ্রিল নাগাদ তিনি নাফ নদীর তীরবর্তী সাতকানিয়া উপজেলার বাজালিয়া পৌঁছেন।২
বুকানন সেখানে একজন স্থানীয় বাঙালি মুসলমানের কাছ থেকে শঙ্খ নদীর অববাহিকায় (উজানে) বসবাসকারী বিভিন্ন পাহাড়ি জাতিগুলোর সাথে ভ্রমণ পথের দূরত্ব এবং ভ্রমণকালের একটা বিবরণ লাভ করেন।
তাকে জানানো হয় যে, শঙ্খ নদীর উত্তর তীরে দুয়াছড়ি পর্যন্ত মুসলমানেরা বসবাস করে। সেখান থেকে দুপুর নাগাদ বেতছড়া (বুকাননের মতে পিনছড়া) পৌঁছা যায়।
অনুরূপ সময়ে সেখান থেকে উজানে ঘোবাও নামে একটা ছড়ায় পৌছানো যায়। সেখান থেকে একদিনের পথে উজানে নোপতং পৌছান যায়। সেখানে কোন জনবসতি নেই। নদীতে পাথর থাকায় নোপতং এর উজানে যাওয়া যায় না।
নোপতং এর উজানে স্বাধীন জাতি বনযোগীরা বসবাস করে বলে তাকে জানানো হয়। তারা জুমিয়া প্রধান আগুনিয়ার প্রজা বলে জানা যায়। এতে প্রমাণ হয়, তখনকার সময় শঙ্খ নদীর অববাহিকার উজানে পাহাড়ি জাতির লোক ছাড়া বাঙ্গালীদের কোন বসতি ছিল না।৩
ফ্রান্সিস বুকানন চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ অঞ্চল থেকে ফেরার পথে ১১ এপ্রিল ১৭৯৮ খ্রি: বর্তমান চকোরিয়া উপজেলার মানিকপুর এলাকায় অংসিওসি তামাং নামের একজন মারমা প্রধানের বাড়িতে যান।
পরদিন ১২ এপ্রিল অংসিওসি বুকাননের তাবুতে এসে মানিকপুরের পরে মাতামুহুরী নদীর উজানে (এর উৎপত্তিস্থল পর্যন্ত) যে সমস্ত ছড়া, খাল বা স্রোত এর সাথে মিশেছে সেগুলোর বিবরণ একটা কাগজে লিখিতভাবে দেন।৪
সেই বিবরণ থেকে বুকানন জানতে পারেন যে, ক্রিনদং নামের একটা পাহাড় থেকে মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি হয়েছে।
তিনি সেই বিবরণ থেকে আরও জানতে পারেন যে, মাতামুহুরী নদীর উভয় তীরে অনেক ছড়া, খাল বা স্রোত এসে পড়েছে।
এসব নদীর তীরে মুরং, টিপেরা ইত্যাদি পাহাড়ি জাতির লোক বাস করে। বান্দরবান সার্কেলের রাজাদের পূর্বপুরুষ কংহ্লা প্রু এসব জাতিদের এক একটা গ্রামে একজন করে রুয়াসা (রোয়াজা) নিযুক্ত করে থাকেন।
সেই রুয়াসাদের মাধ্যমে তারা রাজাকে খাজনা দেয়। মানিকপুরের কিছু উজানে একটা এলাকায় মুসলমানেরা বাস করে। এই বিবরণ অংসিওসির বিবরণের সাথে অনেকটা মিলে যায়।৫
বুকানন ২৮ এপ্রিল, ১৭৯৮ খ্রি: তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের উদ্দেশ্যে কর্ণফুলীর উজানে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন।
চিৎমরম, সীতাপাহাড়, কাপ্তাই, রাইংখং, ধূল্যাছড়ি, কুকরিয়া বিল, মানিকছড়ি মুখ, মগবান, চেঙ্গী নদীর মোহনা, কাইন্দ্যা, চিলাকধাক, সুবলং, কাচালং নদীর মোহনা হয়ে ০১ মে, ১৭৯৮ খ্রি: তারিখ নাগাদ তিনি বরকল পৌঁছান।
সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন যে, বরকলের উজানে কর্ণফুলী নদীতে উথানচাদারা, হরিণ দুয়ার এবং হাতীর মুখ নামে তিনটি জলপ্রপাৎ আছে।
হাতীর মুখ এবং মঈন মুরা এলাকার মধ্যবর্তী স্থানে তাইবিয়াক নামক একজন সর্দারের অধীনে কুকি এবং বনযোগীরা বসবাস করে।
বরকল থেকে মঈন মুরা নৌপথে আট দিনের রাস্তা। বুকানন হিসাব করে বলেন যে, চিৎমরম/সীতাঘাট থেকে নদীপথে কলের দূরত্ব ৮০ মাইল এবং সরাসরি ৩২ মাইল।৬
বুকাননের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, তিনি তার ভ্রমণ পথের যে সব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন সেসব স্থানে শুধুমাত্র চাকমাদের বসতি দেখেছেন। তিনি তার বিবরণে কোথাও বাঙালি বসতির কথা উল্লেখ করেননি।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম ভ্রমণ কালেও তিনি তার ভ্রমণ পথের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়গুলোতে মার্মা, ম্রু ম্রং, কুকি এবং আরাকানীদের বসতিই দেখেছেন, যা তিনি তার ভ্রমণ বিবরণীতে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।৭
বুকানন বরকল যাওয়ার পথে ২৯ এপ্রিল, ১৭৯৮ খ্রি: তারিখ সকাল ৯টায় চেঙ্গী নদীর মোহনায় কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে পৌঁছান।
তিনি সেখানে তার সফরসঙ্গী একজন বাঙালির কাছ থেকে জেনেছেন যে, চেঙ্গী নদীর (রনেলের মানচিত্র অনুযায়ী চিংগ্রী) উজানে নৌকায় ৬ দিনের পথ যাওয়া যায়।
তাদের একজন তাকে জানায় যে, সে চেঙ্গী নদীর উজানে ৫ দিনের পথ গেছে। সে আরও জানায়, সে সময় চেঙ্গী নদীতীরে চাকমারা বাস করত। চাকমা রাজা এ নদীতীরে যেখানে বাস করতেন সে সেখান পর্যন্ত গিয়েছে।৮
বুকানন একই দিনে বরকলের পথে বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ কাচালং (তার বিবরণে কাজলং) নদীর মোহনায় কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে নৌকা থামান এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন।
সেখানে একজন ইউরোপীয় লোককে দেখার জন্য পার্শ্ববর্তী চাকমা গ্রামের লোকেরা তার তাবুর কাছাকাছি আসে। তিনি চাকমাদের চেহারা বর্মীদের অনুরূপ বলে মন্তব্য করেছেন।৯
বকানন কাচালং নদী মোহনার চাকমাদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, কাচালং নদীর উজানে নৌকায় ৩ দিনের পথ যাওয়া যায়।
মাঝে মাঝে উক্ত নদী বেয়ে লুসাই নামের একটি জাতির লোক লুঠতরাজ করার জন্য নেমে আসে।
লণ্ঠনকারীদের একটি দলকে চাকমারা ৮ দিন পর্যন্ত অনুসরণ করেও তাদের কোন বাড়ি বা পাড়া খুঁজে পায়নি বলে তাকে জানিয়েছে।
চাকমাদের ধারণা তারা সম্ভবত কন্দল (সম্ভবত খান টুং পাহাড়) পাহাড়ে বাস করে।১০
মাইনী নদী অববাহিকা সম্বন্ধে বুকাননেনর ভ্রমণ বৃত্তান্তে কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় না। কাচালং নদীর উজানে অর্ধ-দিবসে মাইনী, ১ দিনে সিজক, আবার একই দিনে গঙ্গারাম এবং ১০ অথবা ১২ ঘণ্টায় তৈচং (মিজোরাম) যাওয়া যায়। জনবসতি সম্বন্ধে কোন উল্লেখ নেই।
ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে প্রমাণিত হয় যে, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্তমান তিন জেলায় বিভক্ত তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কোন বাঙালি বসবাস করত না।
উনবিংশ শতাব্দী
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৭৬০ খ্রি: তারিখে মোগল নবাব মীর কাশেম আলী খান এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রাম জেলাসহ বাংলার অপর দু’টি জেলা (বর্ধমান এবং মেদেনীপুর) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীনে ছেড়ে দেওয়ার ১০০ বছর পরে ১৮৬০ সালে তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ি অঞ্চলকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম (চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল) নাম দিয়ে একটি নূতন জেলা সৃষ্টি করা হয়।
গত (বিশ) শতাব্দীতে বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন সংক্রান্ত তেমন কোন তথ্যাদি বৃটিশ রেকর্ড-পত্রে পাওয়া যায় না।
তাছাড়া ১৯৪৭ খ্রি: পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সময় পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের জনসংখ্যা ছিল একবারেই কম।
১৮৭২ খ্রি: পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম লোক গণনা শুরু হয়। ঐ বছরের গণনা থেকে ১৯৫১ খ্রি: পর্যন্ত লোকসংখ্যার হিসাব থেকে তা জানা যায়।
মূলত লাঙ্গল চাষে পাহাড়ি জাতিসমূহের অজ্ঞতা এবং একই সাথে অনীহার কারণেই চাকমা রাজা হরিশচন্দ্র রায় বাহাদুর রাঙ্গামাটিতে এবং নীলচন্দ্র দেওয়ান বড়াদামে বাঙালি চাষাদের দ্বারা দুটো তালুকে সমতল জমি আবাদ করান। তারাই শেষ পর্যন্ত এ জেলায় বসতি স্থাপন করেন।
১৮ জুন, ১৮৭৫ খ্রিঃ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার এ. ডবলু. বি. পাওয়ার কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের কাছে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে লিখেছেন যে, জেলায় তিন প্রকারের চাষের জমি আছে।
১) সীমান্ত এলাকায় বাঙালিদের শুধু লাঙ্গল চাষ
২) বাঙালি এবং চাকমাদের মিশ্রণে চাষাবাদের দুটো ঘটনা (রাঙ্গামাটিতে) এবং নীলচন্দ্র দেওয়ানের গ্রামে
৩) শুধুমাত্র পাহাড়িদের দ্বারা লাঙ্গল চাষ।১৩
সীমান্ত এলাকায় শুধুমাত্র বাঙালিদের দ্বারা চাষাবাদের ঘটনা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
পার্বত্য চট্টগামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ১ জুলাই, ১৮৭২ খ্র: তারিখে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের কাছে দাখিলকৃত বার্ষিক প্রাতবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, ১৮৬৮-৬৯ আর্থিক বছরে তিনি চট্টগ্রাম জেলার সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ১২০ মাইল দীর্ঘ সীমানার মধ্যে বাঙালিদের দ্বারা লাঙ্গল চাষের সন্ধান পেয়েছেন, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্তৃপক্ষকে কোন খাজনা দেয় না।
তাদের দাবি হল যে, তারা চট্টগ্রাম জেলা কর্তৃপক্ষ থেকে ঐ সকল জমি বন্দোবস্ত নিয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, তারা যে জমি চাষাবাদ করছে সেগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার জামি, চট্টগ্রাম জেলার নয়।
তার অনুসন্ধানে তিনি শুধু একজনের কাছেই ৭০৮ একর অবৈধ দখলী জমি খুঁজে পেয়েছেন। তিনি তার এই প্রচেষ্টার ফলে লাঙ্গল চাষের উপর খাজনার অঙ্ক বাড়াতে পেরেছিলেন।১৪
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার এ.ডবলু.বি পাওয়ার-এর পূর্বোক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, কক্সবাজার পার্বত্য মহকুমা নামে (Cox’s Bazaar Hill Tracts) একটা মহকুমা পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ ছিল।
মহকুমার বিশাল অংশ নোয়াবাদ তালুক দেখিয়ে চাষাবাদের আওতায় এনে দখল করা হয়। চট্টগ্রাম জেলা কালেক্টরেটে তারা খাজনা দেয়।
কক্সবাজার পার্বত্য মহকুমার বাঙালিদের দ্বারা দখলকৃত জমি উদ্ধার করা সম্ভব নয় জেনে চট্টগ্রাম বিভাগের তৎকালীন কমিশনার ই. ই. লুইস বাংলা সরকারের সচিবের কাছে ২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৫ খ্রি: তারিখে লিখিত এক পত্রে কক্সবাজার পার্বত্য মহকুমার নোয়াবাদ তালুক হিসেবে দখলকৃত জমি সেই মহকুমা থেকে কর্তন করে।
কক্সবাজার মহকুমায় যোগ করে দুই জেলার সীমানা সংশোধন করার সুপারিশ করেন, যা সরকার গ্রহণ করেন। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার একটা অংশ কক্সবাজার জেলায় অন্তর্ভুক্ত হয়।১৫
উপরের আলোচনা থেকে এটা এখন পরিষ্কার যে, প্রধানত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সমতল ভূমি আবাদ করতে করতে প্রথমে গোপনেই বাঙালিদের একটা অংশ এই জেলায় ঢুকে যায় এবং পরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে বসতি স্থাপন করে।
পাহাড়ি নেতাদের ইজারালব্ধ জমি আবাদ ও তাতে লাঙ্গল চাষ করার উদ্দেশ্যেই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাঙালিদের একটা দলকে এই জেলায় আনা হয়।
পরে নিজেরা জমি বন্দোবস্ত নিয়ে এই জেলায় বসতি স্থাপন করে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। তারপরও পুরো উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি-স্থাপনকারীদের সংখ্যা অত্যন্ত ধীর গতিতে বাড়তে থাকে।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম লোকগণনা থেকে ১৯০১ খ্রি: পর্যন্ত এবং ১৯০১ থেকে ১৯৫১ খ্রি: পর্যন্ত লোকগণনার হিসাব পরীক্ষা করলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। উল্লেখিত সময়ে লোকগণনার হিসাব নিম্নে তুলে ধরা হল :
সাল লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ
১৮৭২ ৬৯৬০৭ নাই
১৮৮১ ১০১৫৯৭ ৩১৬০৯ জন
১৮৯১ ১০৭২৮৬ ৫৬৮৯ জন
১৯০১ ১০৭২৮৬ ১৭৪৭৬ জন
৬ ডিসেম্বর, ১৮৭৩ খ্রি তারিখে বাংলার সচিবের কাছে লিখিত চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার এইচ. এ. ককরেল এর চিঠি থেকে জানা যায় যে, ১৮৭২ খ্রি: এর লোকগণনা মতে শুধু বান্দরবান সদর মহকুমার (বিভাগ) এবং শঙ্খ নদী মহকুমার লোকসংখ্যা ছিল ৬১৯৫৭ (৪০৫৪৭+২১৪১০) জন।
সেখানে চাকমা সার্কেল এবং মং সার্কেলের লোকসংখ্যার কোন হিসাব দেখান হয় নি। উল্লেখ্য যে, কমিশনারের পত্রে উল্লেখিত সংখ্যা শুধু জুমচাষীদের হিসাবই ধরা হয়েছে, যার অর্থ এরা সবাই পাহাড়ি জাতির লোক।১৬
উক্ত পত্রের হিসাব অনুযায়ী (শুধুমাত্র বোমাং সার্কেলের) পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা এক লক্ষের কাছাকাছি হওয়ার কথা। ১
৮৭২ খ্রি: এর গণনায় লোকসংখ্যা কম দেখানোর ফলেই ১৮৭২ থেকে ১৮৮১ খ্রি: লোকসংখ্যা বৃদ্ধির তফাৎ এতো বেশি হয়েছে। ১৯০১ খ্রি: পর্যন্ত পরবর্তী দশকগুলোর লোকসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ সঠিক ছিল বলে ধরে নেওয়া যায়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা বুঝানোর নিমিত্তে ১৯১১, ১৯২১, ১৯৩১, ১৯৪১, ১৯৫১ খ্রি: এর লোকগণনার হিসাব তুলে ধরা হল:
সাল মোট জনসংখ্যা মুসলমান হিন্দু
১৯১১ ১৫৩৮৩০ ৫০৯৮ ১৪২৩৯
১৯২১ ১৭৩২৪৩ ৭২৯২ ৩১৫৩৯
১৯৩১ ২১২৯২২ ৮২১৬ ৩৬৭৭৬
১৯৪১ ২৪৭০৫৩ ৭২৪০ ৪৮৮১
১৯৫১ ২৮৭২৭৪ ১৮০৭০ ৪০৯৮৪
এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, ১৯৪১ খ্রিঃ হিন্দু জনসংখ্যা পূর্ববর্তী দশকের তুলনায় ৮ গুণ কমেছে। জনসংখ্যার এই হ্রাসের একমাত্র কারণ হল হিন্দু ধর্মাবলম্বী এিপুরাদেরকে হিন্দুর পরিবর্তে ত্রিপুরা জাতি হিসেবে আলাদাভাবে দেখান। ঐ বছর লোকগণনায় তাদের সংখ্যা ৩৫২৪৬ জনকে আলাদাভাবে দেখানো হয়েছে।১৭
বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের কারণসমূহ : আইনী শিথিলতা এবং চাকমা নেতাদের ভূমিকা
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জুমচাষের জমি ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে পাহাড়ি জাতির লোকদের লাঙ্গল চাষ পদ্ধতির মাধ্যমে সমতল ভূমিতে চাষাবাদ এবং বসতি স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার সি. জি. বি. স্টিভেন্স কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনারের কাছে ১৫ মে, ১৯২৫ খি: তারিখে লিখিত এক পত্র থেকে জানা যায়, ১৯০০ খি: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিতে সমতল ভূমির লোকদের এই জেলায় জমির মালিকানা লাভে ১৯২০ খ্রি: পর্যন্ত কোন বিধি নিষেধ ছিল না।
সেই সুযোগে ঐ সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রাম জেলার সমতল ভূমির কিছু লোক বিশেষত এই জেলার সমতল ভূমিতে মালিকানা লাভ করে।১৮
মি: স্টিভেন্স আরও লিখেছেন যে, যেখানে পাহাড়ি জুমিয়াদের সমতল ভূমিতে বসতি স্থাপনের সুবিধার্থে তাদের নামে যে জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হয় সেই জমিও তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালিদের কাছে বর্গা দেওয়া হয়।
এভাবে পাহাড়ি জাতির নেতাদের নামে দেওয়া সমূদয় জমিও বাঙালিদের মালিকানায় চলে যায়। সে জন্য চাকমা নেতাগণ পরোক্ষভাবে দায়ী।
তারা তাদের ইজারালব্দ জমি আবাদ করার জন্য বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলেন। সে সব জমির মালিকানা পরে তাদের (বাঙালিদের) কাছেই হস্তান্তর করেছেন। মি: স্টিভেন্স লিখেছেন-
“The hill man does not really like laboring in the field; holders of quite small grants will have to work done by mohammadan laborers because they are too lazy to do the work themselves. They also find it difficult to get hill men to work for them and most important of all, even when the hill men do work on the land he does not work so well or get such good results as the plains man, whose forefathers have cultivated with the plough for generations.”19
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, লুসাই, খিয়াং, ম্রো এবং অন্যান্য পাহাড়ি জাতির লোকেরাই যে বাঙালিদের অন্তত তিনশ বছর আগে থেকেই এখানে বসবাস করে আসছিল ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ বৃত্তান্ত এবং বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দাপ্তরিক নথিপত্র দ্বারা প্রমাণিত। বাঙালিরা একশ বছরের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছে।
১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটা আলাদা জেলা সৃষ্টির আগ পর্যন্ত বৃটিশ শাসকেরা এই এলাকা সম্বন্ধে যে ধারণা পোষণ করতেন তা হল : “The country is so unhealthy, so difficult and so remote, we really have no hold on it. Our police officers are almost invariably attacked with fever on the 4th or 5th days after entering the forest. Even the elephant hunters, whose vocation takes them into the forests only in the finest season, often time, suffer much. (Sir. Henry Rickets)20
যে পাহাড়ি জাতিগুলো এরকম একটা অস্বাস্থ্যকর অঞ্চল আবাদ করে তথায় বসতি স্থাপন এবং যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে তারাই যদি সেই এলাকার আদিবাসী না হয়।
তাহলে সেটা তাদের চরম দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জাতিগুলোর/আদিবাসীদের প্রতি সরকারের মনোভাব একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী/জাতির জাত্যাভিমানেরই প্রতিফলন।
তথ্যসূত্র :
১। Francis Buchanan in South-East Bengal (1798), পৃষ্ঠা ১০-১২
২। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩ – ৮৬,
৩। প্রাগুক্ত,
৪। প্রাগুক্ত,
৫। প্রাগুক্ত,
৬। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ১১৫,
৭। প্রাগুক্ত,
৮। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ১১০
৯। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ১১২-১১৩
১০। প্রাগুক্ত,
১১। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ১১৮,
১২। Selections from correspondence on the revenue administration – History of Chittagong Hill Tracts (1862-1927) page 82,
১৩। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ৫৫,
১৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ৯৮-৯৯,
১৫। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ৬৯,
১৬। District Census Reports, Chittagong Hill Tracts, 1961 এবং অন্যান্য রিপোর্ট,
১৭। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা -৫০১,
১৮। প্রাগুক্ত, ” ঐ
১৯। প্রাগুক্ত, – পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার এ. ডবলু. বি. পাওয়ার কর্তৃক তার ১৭ জুন ১৮৭৫ খ্রি: তারিখের পত্রে উন্বত।
লেখক: জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, বিশিষ্ট লেখক ও প্রবীণ আইনজীবী, রাঙ্গামাটি।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।