বিক্রম কিশোর মাণিক্য, যার আকস্মিক মৃত্যু না হলে ত্রিপুরা আজও স্বাধীন থাকতো

Jumjournal
Last updated May 9th, 2021

1812

featured image

Analysis on Hidden Conspiracy Against the Sovereignty of Tripura Kingdom:

আজ ১৭ই মে, ত্রিপুরা/তিপ্রা/ত্রিপুরী জাতির ‘জাতীয় শোক দিবস’ (TIPRA NATIONAL MOURNING DAY)। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৩ মাস আগে, স্বাধীন ত্রিপুরার ১৮৪তম মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য আজকের এই দিনে এক মর্মান্তিক মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন (রাত ৮টা ৪০ মিনিটে)। মৃত্যুকালে মহারাজার বয়স ছিল মাত্র ৩৯ বছর। এত অল্প বয়সে মহারাজার মৃত্যু, সত্যিই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

কারো কারো মতে, মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনাটি ছিল ষড়যন্ত্রমূলক ও পরিকল্পিত!! প্রশ্ন হচ্ছে – মহারাজার বিরুদ্ধে এমন সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র করা হল কেন? এর উত্তর খুঁজাটা সত্যিই কঠিন বটে! কারণ, এসব বিষয়ে রাজপরিবারের কেউই মুখ খোলেননি।

হয়তো তারা জানেন, হয়তো জানেন না। তবে, উত্তর যে একদম পাওয়া যাবে না, তা কিন্তু নয়। এর উত্তর খুঁজতে গেলে পেছনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা অতীব জরুরী।

মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের জন্ম ১৯ আগস্ট ১৯০৮ সালে আর রাজ সিংহাসনে স্বাধীন ত্রিপুরার ১৮৪তম মহারাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন ১৯২৩ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে। অথচ এই অল্প বয়সেই তিনি পুরো ত্রিপুরাকে আধুনিকায়ন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন।

পিতা মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য ত্রিপুরার আধুনিকায়নে যে সূচনা করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন পুত্র মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য।

যার ফলশ্রুতিতে রাজ্যে গড়ে উঠে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিমান বন্দর; আধুনিকায়ন হয় শহর ও রাস্তাঘাট; প্রণীত হয় রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান; আধুনিকায়ন হয় রাষ্ট্রীয় পুলিশ, সেনা ও বিমান বাহিনী।

এমনকি রাজ্যের ভুমিপুত্রদের প্রথাগত ভূমি মালিকানা সংরক্ষণের জন্য “সংরক্ষিত অঞ্চল” ঘোষণা করা হয়।

এক কথায় বলতে গেলে, একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে যা যা প্রয়োজন, তার সবই বাস্তবায়ন করেছিলেন মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য। সেজন্যই “আধুনিক ত্রিপুরার স্থপতি” তথা “আধুনিক ত্রিপুরার জনক” হিসেবে তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে যায়।

আধুনিক ত্রিপুরা গঠনের পাশাপাশি মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের আরেকটি পরিকল্পনা ছিল – হৃত রাজ্যাংশ পুনরুদ্ধার করা।

ব্রিটিশদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকাতে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাবে।

তাই মহারাজা চেয়েছিলেন তাঁর হারানো রাজ্যাংশ পুনরুদ্ধার করতে, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল চট্টগ্রাম (চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান), নোয়াখালী (নোয়াখালী, ফেনী), ব্রিটিশ তিপেরা (কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর), সিলেট (সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার)। ঐতিহাসিক কাল থেকে এসব অঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল।

মহারাজা চেয়েছিলেন বৃহত্তর স্বাধীন ত্রিপুরার সার্বভৌমত্ব, যেটি পূরণের লক্ষ্যে তিনি কিছুটা কৌশল অবলম্বন করেন। কৌশলগুলো বাস্তবায়নে তিনি প্রধানত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অনুসরণ করার চেষ্টা করেন।

১ম ধাপঃ বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন

মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৩০ সালে বিশ্বের বহু দেশে রাষ্ট্রীয় সফর করেন, যার মধ্যে ছিল – ইতালি, মোনাকো, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি। এসব দেশের রাজপরিবার এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে মহারাজার সৌহার্দ্যপূর্ণ সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়। তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বিশেষভাবে সম্মানিত হন।

এভাবে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মহারাজা বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে দারুণ সফল হন।

যার ফলে, পরবর্তীকালে সেসব দেশের পক্ষ থেকে মহারাজাকে পুনরায় রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়।

মহারাজাকে ১৯৩৬ সালে অলিম্পিক খেলা পরিদর্শনে রাষ্ট্রীয়ভাবে আমন্ত্রণ জানান জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার। তিনি মহারাজাকে আন্তরিক অভ্যর্থনাও জ্ঞাপন করেন। মহারাজা ইংল্যান্ড ও আমেরিকাও সফরে যান।

ইংল্যান্ডের রানী তাঁকে রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা জানান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজবেল্ট ২১বার তোপধ্বনির মাধ্যমে মহারাজাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান ও অভ্যর্থনা জানান।

ইউরোপ ও আমেরিকার স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকা মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের বিদেশ সফর নিয়ে প্রতিবেদন ও ছবি প্রকাশ করে। যার ফলশ্রুতিতে মহারাজা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

২য় ধাপঃ ২য় বিশ্বযুদ্ধে ত্রিপুরা সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রেরণ

বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে মহারাজা তাঁর হৃত রাজ্যাংশ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেন। অর্থাৎ সেসময় যদি তিনি হারানো অঞ্চল ফিরে পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবী জানাতেন, তাহলে বিশ্বের বহুদেশের রাষ্ট্রপ্রধান মহারাজার এই দাবীকে সমর্থন জানাতেন।

কিন্তু সে সুযোগ আসার আগেই ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সারা বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ফলে, মহারাজাকেও তাঁর কৌশল পরিবর্তন করতে হয়।

অক্ষশক্তির ইতালি ও জার্মানির সাথে ত্রিপুরার যেমন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল, ঠিক একই সম্পর্ক ছিল মিত্রশক্তির আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে।

তাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য প্রথমে নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধে সহযোগিতা চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে মহারাজার কাছে বিশেষ অনুরোধ এসেছিল।

সেই অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে মহারাজা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তাছাড়া, ১ম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য ত্রিপুরা সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন এবং যুদ্ধ তহবিলে প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন। তাই, সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২য় বিশ্বযুদ্ধে একই পথ অবলম্বন করেন মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য।

ত্রিপুরা সেনাবাহিনীর প্রায় ২৫০ সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ত্রিপুরা বিমানবাহিনীর দুটি বিমান বার্মা আক্রমঙ্কালে জাপানীদের গুলিতে বিধ্বস্ত হয়। এরপরও ত্রিপুরা সেনাদের যুদ্ধ কৌশলের কাছে জাপানীরা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হন।

অবশেষে ১৯৪৬ সালের ৬ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল স্যার ক্লাউডি আউচিনলীক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বেইনকে আগরতলায় প্রেরণ করে ত্রিপুরা সৈন্যদের সামরিক সামরিক দক্ষতা ও বীরত্বের প্রতি সম্মান স্বরূপ মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যকে ১৩ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে “GUARD OF HONOR” প্রদান করে বিপুল সম্মানে ভূষিত করেন।

৩য় ধাপঃ হৃত রাজ্যাংশে বসবাসরত প্রজাদের মতামত গ্রহণের উদ্যোগ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি হলে ১৯৪৫ সালের ২৪শে অক্টোবরে জাতিসংঘ (United Nations) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু মহারাজা জাতিসংঘে যোগদান করেননি।

কারণ, তখনো ত্রিপুরা রাজ্যের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না। মহারাজা চেয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকার থেকে হৃত রাজ্যাংশ উদ্ধার করে একটি পূর্নাঙ্গ স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের মানচিত্র প্রতিষ্ঠা করতে, যাতে করে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হতে আর সমস্যায় পড়তে না হয়। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছিল, সমস্যা তত বাড়ছিল।

সারা ভারতে দ্বি-জাতি তত্ত্ব তথা হিন্দু-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশভাগের রাজনৈতিক চর্চা গড়ে উঠতে থাকে। এর প্রভাব পড়ে মহারাজার কাঙ্ক্ষিত পরিকল্পনায়।

মহারাজা অনেকটা হতাশ হন। কারণ, তাঁর হারানো রাজ্যাংশে (বিশেষ করে – চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার) হিন্দু প্রজাদের জনসংখ্যা যথেষ্ট থাকলেও মুসলিম প্রজাদের জনসংখ্যাই বেশি।

কাজেই, মুসলিম প্রজারা যদি স্বাধীন ত্রিপুরায় যুক্ত হতে না চান, তাহলে দলিল সূত্রে যুক্ত করাটা অসম্ভব।

অবশেষে, মহারাজা তাঁর হৃত রাজ্যাংশে বসবাসরত প্রজাদের মতামত যাচাইয়ের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি মনোযোগ দেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতি, যেখানে মুসলিমের সংখ্যা ছিল মাত্র ২%, বাকি ৯৮% ছিল অন্যান্য ধর্মালম্বী।

তাই, অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা রাজ্যে যুক্ত করার বিষয়ে মহারাজা অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্কেল চীফ ও নেতৃবৃন্দদের ত্রিপুরা রাজদরবারে আমন্ত্রণ জানান।

যার স্মৃতিস্বরূপ বেণুবন বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করে দেন। কিন্তু বিনিময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দরা মহারাজাকে কতটুকু মূল্যায়ন করেছেন কিংবা আদৌ মূল্যায়ন করেছেন কিনা – সেবিষয়ে খুব একটা জানা যায় না।

বরং জানা যায় যে, চাকমা নেতৃবৃন্দরা ভারতের পক্ষে ছিলেন আর মারমা নেতৃবৃন্দরা বার্মার পক্ষে ছিলেন। শুধু ত্রিপুরারা ছিলেন স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে যুক্ত হওয়ার পক্ষে। এজন্য ত্রিপুরা নেতৃবৃন্দ খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা রাজ্যের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।

একইভাবে, মহারাজা তাঁর হৃত রাজ্যাংশের মুসলিম ও হিন্দু প্রজাদের মতামত জানার স্বার্থে নানাভাবে উদ্যোগী হন। কিন্তু সেসব উদ্যোগ তিনি আর বাস্তবায়ন করার সুযোগ পাননি।

কারণ, ততক্ষণে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে নানা গোলযোগ সৃষ্টি হতে থাকে। ধীরে ধীরে মহারাজার বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ষড়যন্ত্রের দানা বাঁধতে থাকে।

বিক্রম কিশোর মাণিক্য
বিক্রম কিশোর মাণিক্য

ত্রিপুরাদের একাংশ পূর্ব বাংলার (বর্তমানে বাংলাদেশ) কমিউনিস্টদের আইডিওলজিতে বিশ্বাসী হয়ে অতি উৎসাহে নানা ইস্যুতে “ত্রিপুরা রাজতন্ত্র” বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে, যাদের মূল লক্ষ্য ছিল – ত্রিপুরা রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি। এ সুযোগটা লুফে নেয় হিন্দু বাঙালি ও মুসলিম বাঙালির একাংশ।

বেশির ভাগ হিন্দু বাঙালিরা চেয়েছিল ত্রিপুরার রাজতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব বিলুপ্তি হোক এবং ভারতে যোগদান করুক। এদের সাথে পূর্ব বাংলা, কলকাতা এবং জাতীয় কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের দারুণ যোগাযোগ ছিল।

একইভাবে, বেশির ভাগ মুসলিম বাঙালিরা চেয়েছিল ত্রিপুরার রাজতন্ত্র ও সার্বভৌমত্ব বিলুপ্তি হোক এবং পাকিস্তানে যোগদান করুক। এদের সাথে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের ভালো যোগাযোগ ছিল।

এমনকি, কংগ্রেসের যেসকল নেতৃবৃন্দ অবিভক্ত স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিল, তারাও চেয়েছিল ত্রিপুরার স্বাধীনতা লুপ্ত হয়ে ভারতে যোগদান করুক।

আর মুসলিম লীগের যারা পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিল, তারাও ত্রিপুরা রাজ্যের স্বাধীনতার বিলুপ্তি চেয়েছিল, যাতে করে জোর করে হলেও পাকিস্তানে যোগদানে বাধ্য করা সম্ভবপর হয়।

কমিউনিস্ট পন্থী ত্রিপুরা, ভারতপন্থী হিন্দু বাঙালি এবং পাকিস্তানপন্থী মুসলিম বাঙালি – এই তিনটি পক্ষই “ত্রিপুরা রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি” চেয়েছিল।

কমিউনিস্ট পন্থী ত্রিপুরারা চেয়েছিল “সমাজতান্ত্রিক ত্রিপুরা” প্রতিষ্ঠা করতে আর ভারতপন্থী হিন্দু বাঙালি এবং পাকিস্তানপন্থী মুসলিম বাঙালিরা চেয়েছিল ত্রিপুরার সার্বভৌমত্ব বিলুপ্ত করতে।

সেইসাথে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ এবং মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দরাও পার্শ্ববর্তী স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ত্রিপুরার অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারছিল না।

তাই তারাও স্বাধীন ত্রিপুরার অস্তিত্বের বিলুপ্তি চেয়েছিল। এসব পরিস্থিতি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পাঁচটি পক্ষই চেয়েছিল যে, মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের রাতারাতি মৃত্যু হোক। তবেই না তাদের স্বপ্ন পূরন হবে, নতুবা স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে!!

কাজেই, মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনার পেছনে পাঁচ পক্ষের কারো না কারো ষড়যন্ত্র কিংবা পরিকল্পনা ছিল, সেটা অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়।

এমনকি মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনাটি যদি না ঘটতো, তাহলেও অন্য কোন ষড়যন্ত্র কিংবা পরিকল্পনায় মহারাজাকে মেরে ফেলার চেষ্টা হতো, সেটাও অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যায়।

সেই যে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্ধকার অধ্যায় শুরু, তা আজোবধি চলমান আছে। বর্তমানেও দেখা যায়, ত্রিপুরা রাজ্যের একাংশ মানুষ ত্রিপুরা রাজপরিবারকে পছন্দ করেন না, রাজনীতিতে রাজপরিবারের অংশগ্রহণকে পছন্দ করেন না, রাজ্যের নানা ইস্যুতে রাজপরিবারের প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনাকে গ্রহণ করতে পারেন না।

এমনকি মহারাজাকে “মহারাজা” সম্বোধন করতেও তাদের জিহ্বা আটকে যায়। বরং তারা পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে সর্বদা প্রস্তুত। এজন্য টিভি চ্যানেলে, সংবাদ মাধ্যমে, পেপার-পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ত্রিপুরা রাজপরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে সমালোচনার ঝড় তোলা হয়।

প্রয়োজনে হত্যা করার মতো পরিকল্পনাও গোপনে গোপনে নকশা করা হয়। বর্তমানের এসব হিংসাত্মক আক্রমণ থেকেও প্রমাণ করা যায় যে, সেসময় মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের মৃত্যুর পেছনে মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনাটি ছিল আসলে সাজানো ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পিত।

প্রশ্ন হচ্ছে সেদিন যদি মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের মৃত্যু না হতো?? তাহলে, তিনি আর পুনরায় হত্যা-ষড়যন্ত্রের শিকার হতেন না।

কারণ, তিনি রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী, নিরাপত্তা বাহিনী, গ্রাম্য মিলিশিয়া বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে আরো শক্তিশালী ও কঠোর করে তুলতেন, যাতে করে রাজপরিবার এবং রাষ্ট্র সুরক্ষিত হয়।

এতে করে ত্রিপুরাদের স্বাধীনতা হারানোর মতো আর কোন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকতো না।

মহারাজা তাঁর গৃহীত পরিকল্পনা ও উদ্যোগগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতেন। হয়তো তিনি সফল হতেন, হয়তো হতেন না।

তবে, প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের স্বাধীন ত্রিপুরার সার্বভৌমত্ব যে টিকে থাকতো, তা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অর্থাৎ, দক্ষিণ এশিয়ায় ত্রিপুরাদের অন্তত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকতো।

মহারাজা হয়তো ধীরে ধীরে জাতিসংঘে (United Nations) যোগ দিতেন। ফলে, রাষ্ট্রের যেকোনো পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে মহারাজা জাতিসংঘ ও বিশ্ববাসীর কাছ থেকে সরাসরি সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ার অধিকার রাখতেন।

ফলে বর্তমানে যে, বিদেশী শরণার্থী ও অনুপ্রবেশের সমস্যা সেটি আর কখনোই হওয়ার সুযোগ থাকতো না। আর সেসব সমস্যা হলেও সমাধানের জন্য ত্রিপুরারা সরাসরি আন্তর্জাতিক আদালতের সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে পারতেন।

আর যেহেতু ত্রিপুরারা ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধ করেছিল, কাজেই সেই মিত্রপক্ষরাও (যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স-রাশিয়া-চীন) অবশ্যই ত্রিপুরাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন।

অনেক ক্ষেত্রেই ত্রিপুরারাও ন্যাটোর মতো আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সামরিক জোটের সদস্য হতো। উপরন্তু, Tripura Royal Army, Tripura Royal Air, Tripura Royal Navy, Tripura Royal Homeland Security Force, Tripura Royal Special Force, Tripura Royal Intelligence প্রভৃতি নামে ত্রিপুরাদের নিজস্ব সেনা, বিমান, নৌ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষায়িত বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী থাকতো।

সেইসাথে Tripura Royal Academy for Science and Technology নামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থাকতো।

অনেকক্ষেত্রে ত্রিপুরা হতো দক্ষিণ-এশিয়ার শক্তিশালী রাষ্ট্র। কাজেই, বাংলাদেশ, মিজোরাম, আসাম ও মায়ানমারে বসবাসরত ত্রিপুরাদের সমস্যা সমাধানে এবং একতাবদ্ধ সমাজ বিনির্মাণে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারতো। এভাবে, ত্রিপুরারা হয়ে উঠতে পারতো পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী জাতি।

লেখক : মুকুল ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা