৭টি বৌদ্ধ বিহার এবং আমার দেখা রাঙ্গামাটি শহর
2089
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাঙ্গামাটিতে। দূরন্ত শৈশব আর উড়ন্ত কৈশোরে দেখা আমার সেই প্রিয় রাঙ্গামাটি শহর এখন কেমন আছে?
এমন না যে, অনেকবছর হলো রাঙ্গামাটিতে যাই না। তাও কেন জানি মনে হয় যে, এ শহর আর আমার নেই! কেমন যেন অচেনা লাগে ইদানিং।
২০০৮ থেকে হিসেব করলে ঢাকায় আছি ৮/৯ বছরের মতন। খুব একটা বড় সময় না। বন্ধ/ছুটি এটা-ওটা সব মিলিয়ে প্রায়ই আসা-যাওয়াটা নিয়মিত।
কিন্তু স্কুলবেলায় ফেলে আসা রাঙ্গামাটি আর এখনকার রাঙ্গামাটি শহরের পার্থক্যটা এখন আমার কাছে বেশ করে চোখে পড়ে।
দেখতে দেখতে একেবারে চোখের সামনেই রাঙ্গামাটি শহরটার চিত্রপটে ভারী রকমের পরিবর্তন যে এসছে তা খুব সহজেই ধরতে পারি।
সাম্প্রতিক সময়ে (২০১৭) রাঙ্গামাটিতে ভূমিধসে ব্যাপক প্রাণহানি এবং প্রাকৃতিক ক্ষয়-ক্ষতি অন্য সবার মতোন আমাকেও বেশ করে ভাবিয়েছে শহরটার অতীত-বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে।
তাই এবার মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম বাড়িতে গেলেই পুরো শহরটাকে নিবিড় মনযোগে একচক্কর দিয়ে আসবো। গেল ঈদের ছুটিতে যেয়ে শহরটাকে একচক্কর দিয়ে এসেছি।
রাঙ্গামাটি শহরের পশ্চিমকোণায় আমাদের রাঙ্গাপানি গ্রামটি। শহরের ঐতিহ্যবাহী এলাকা। শহরের মধ্যে পড়লেও জীবনযাত্রা এবং অর্থনীতির বিচারে এটাকে এখনো গ্রাম বলেই ধরে নিতে হয়।
গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখনো কৃষি অর্থনীতির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু সম্প্রসারিত হলেও তেমন বিকশিত হতে পারেনি। খুব কম সংখ্যক চাকুরীজীবী পাওয়া যাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় এবং মোনঘর শিশু সদন-এর অবস্থান গ্রামটির উত্তর ভাগটায়।
তারও উত্তরে ভেদভেদী। পৌর এলাকার আওতায় চলে আসলেও এই এলাকার আদি বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা এখনো গ্রামীণ অর্থনীতির উপরে নির্ভরশীল।
যদিও শহর সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে এ দুটো গ্রামের চিত্রপটও খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। রাঙ্গাপানির দক্ষিণে আসামবস্তি এলাকা।
রাঙ্গামাটি শহরের প্রধান সড়কটিকে একটি সাপের মতন কল্পনা করা যায় যা পুরো শহরটিকে চক্কর মেরেছে। এর একপ্রান্ত যদি ভেদভেদী ধরি তবে ভেদভেদী – রাঙ্গাপানি – আসামবস্তি বেয়ে সড়কটি চলে গেছে ভেদভেদী – রাঙ্গাপানি – আসামবস্তি – স্বর্ণটিলা – তবলছড়ি – রিজার্ভ বাজার – কাঠালতলী – বনরুপা – পাবলিক হেলথ – কালিন্দীপুর – রাজবাড়ি – দেবাশীষ নগর – কল্যাণপুর – কলেজগেইট – ভেদভেদী এভাবে।
পুরো রাঙ্গামাটি শহরটাকে ঘিরে থাকা বৌদ্ধবিহারগুলি একবার দর্শন করে আসবো এমনটা চিন্তা করে প্রথমে গেলাম আসামবস্তি। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশী এই এলাকাটির প্রতি দারুণ ভালোলাগা কাজ করে।
আমাদের গ্রামে কোনও নাপিতের দোকান ছিল না। বাবা প্রতিমাসে একবার করে বাড়ি আসতেন তার কর্মস্থল বিলাইছড়ি থেকে। প্রতি দু-এক মাস অন্তর চুল লম্বা হয়ে আসলে বাবার সাথে আসামবস্তি যেতাম চুল ছাঁটাই করার জন্য।
তখন আসামবস্তি বাজারটি ছিল আসামবস্তি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পাশে। বাজারটি মোটামুটি জমজমাট ছিলো।
এখন আসামবিস্ত-কাপ্তাই রোড হওয়ার পর থেকে আসমবস্তিতে নতুন দুইটি বড় ব্রীজ আসামবস্তি এলাকাটাকে অঘোষিত ট্যুরিস্ট এলাকা বানিয়েছে।
যাই হোক পুরো রাঙ্গামাটি শহরটাকে একটা চক্কর দিলে ৭টি বৌদ্ধ বিহার পাওয়ায় যায়। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে আমরা প্রথমে গেলাম আসামবস্তি ধর্মচক্র বৌদ্ধ বিহারে।
বিহারটির গেটে নামফলক দেখলাম না। তাই প্রতিষ্ঠা সাল কতো তা টুকে নিতে পারলাম না। ভিতরে প্রবেশ করতেই অদ্ভুত রকমের এক নিরবতা আর শান্তি খুঁজে পেলাম। বিহারটির অধ্যক্ষকে আগে থেকে চিনতাম।
বিহারটি ১৯৭১/৭২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয় বলে জানালেন বিহারটির বর্তমান অধ্যক্ষ। আগে বিহারটি ছিল মাটির (গুদোম ঘর) ঘরের।
এখন দোতলা বিল্ডিং হয়েছে। উপরে বুদ্ধাসন এবং বন্দনার স্থান। নীচতলায় ভিক্ষু শ্রমণদের আবাসিক কক্ষ।
সাথেই লাগোয়া করে রয়েছে একটি অস্থায়ী পাঠশালা, যেখানে আশেপাশের বা কখনো কখনো দূর-দূরান্ত থেকে কচি কচি অনাথ ও অসহায় ছেলে-মেয়েরা বিনামূল্যে পড়তে আসে।
স্কুলের পাঠ্য ছাড়াও পড়ানো হয় মারমা ভাষা ও সংস্কৃতি। কলেজ পড়ুয়া কিছু ছেলে আছে যারা এটাকে দেখাশোনা করে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মারমা পাড়ায় ঘুরতে যেয়ে আমি খেয়াল করেছি মারমাদের মধ্যে বিহারকেন্দ্রিক মাতৃভাষা শিক্ষার একটি ব্যবস্থা আছে।
মারমাদের বিহারকেন্দ্রিক এই শিক্ষাব্যবস্থাটা আমাকে খুবই টানে। পাহাড়ের প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারকে কেন্দ্র করে এভাবে প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষাসহ অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠনের শিক্ষাগুলো দেওয়া যেতে পারে।
কাপ্তাইয়ে অবস্থিত চীৎমরম বৌদ্ধ বিহারে আমার প্রায়শই যাওয়া হয়। সেখানেও দেখেছি বিহারে উপাসক-উপাসিকাদের প্রদত্ত দান-দক্ষিণার একটা নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে অনাথ শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ব্যয়ভার চালানো হয়।
চীৎমরমে প্রায় ৬০ জনের মত শিক্ষার্থী থাকে যারা থাকা-খাওয়া বিনামূল্যে পায় এবং পাশের চীৎমরম সরকারি বিদ্যালয়, কাপ্তাই কিংবা কর্ণফুলী কলেজে পড়াশুনা করে।
ব্যাপারটি সত্যিই দারুণ। রাঙ্গামাটির রাজবন বিহারে যে পরিমাণ দান পড়ে তার একটা ছোট্ট অংশ দিয়ে কমসে কম ৩০০ শিক্ষার্থীর পড়াশুনার ব্যয়ভার চালানোে যেতে পারে বলে আমার মনে হয়।
আসামবস্তি ধর্মচক্র বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করেছিলাম। কথাপ্রসঙ্গে এলাকাটার নাম কেন “আসামবস্তি” হলো তাও চলে এল।
তিনি বললেন যে, একসময় এই এলাকাটায় কোন বাঙালি বসতি ছিল না। এলাকাটায় একটা স্ব-মিল আছে। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঠ চেরার জন্য গাছের গুড়ি আসতো, এখনো আসে।
মূলত এই স্ব-মিল এবং বাজারটিকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে কিছু আসাম পরিবার আর মারমা পরিবার বসতি গড়ে তুলেছিল এখানে। একসময় বসতি বাড়তে থাকে।
এখন মারমা, আসাম অার কিছু রাখাইন পরিবারের সাথে সাথে অনেক বাঙালি বসতিও হয়েছে এখানে। আছে কিছু চাকমা এবং বাঙালি বড়ুয়া পরিবারও।
আসামরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠিক কবে থেকে বসতি করা শুরু করেছে সঠিক জানি না।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দলীয় সংগীতে একটা লাইন আছে এরকম –
“পাংখো-খুমী-লুসাই-মুরং-মারমা
তঞ্চঙ্গ্যা-বম-খেয়াং-চাক-ত্রিপুরা-চাকমা”
পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক পুরনো লিটলম্যাগ বা বিভিন্ন প্রকাশনাতেও পার্বত্য চট্টগ্রামে উপরের এই ১১টি জাতির কথার উল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু পাহাড়ে বর্তমানে এই ১১টি জাতি ছাড়াও কিছু সাঁওতাল বা সান্তাল, আসাম এবং গুর্খা বসতির সন্ধান পাওয়া যায়।
প্রবীণ অনেকের সাথে বিভিন্ন সময়ে গল্পচ্ছলে জেনেছি যে মূলত পাহাড়ে যখন নতুন নতুন রাস্তাঘাট হচ্ছিল তখন শ্রমিক হিসেবেই আসাম, সাওতাল বা গুর্খারা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছিল।
আমার মনে হয় যে তাদের জীবন-জীবিকার ধরণে তাদের ঠিক পাহাড়ি বা জুমিয়া বলে বলা যাবে না।
যাই হোক আসামবস্তি থেকে আমরা চলে গেলাম তবলছড়ি। বিভিন্ন কারণে এই তবলছড়ি বাজারটিও আমার কাছে খুবই স্মৃতিবহ।
আসামবস্তি থেকে তবলছড়ি যাওয়ার পথেই পড়ে রাঙ্গামাটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। এই গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে মা’র সাথে কতবার যে তবলছড়ি বাজার গেছি!
একসময় আমাদের গ্রাম রাঙ্গাপানি থেকে তবলছড়ি পর্যন্ত সাম্পান চলতো। মূলত বাজার দিনে। তবলছড়ি বাজারে মা’র একটা পরিচিত স্বর্ণকারের দোকান ছিল।
আমাদের গ্রামের মহিলাদের অনেকেই বেইন (কোমরতাঁত) বুনে সংসার সামলাতেন। এমন অনেক দেখেছি যে, বেইন বুনার জন্য সুতা কেনার টাকা নেই।
এই স্বর্ণকারের কাছ থেকে অনেকে কানফুল বা নাকফুল বন্ধক রেখে সুতা কাটার টাকা নিয়ে আসতেন।
দিদির বা দাদার পরীক্ষা ফি বা স্কুল ফি’র জন্য মাকেও দেখেছি বিভিন্ন সময়ে এই স্বর্ণকারের নিকট বিভিন্ন অলংকার, যেমন – সোনার চেইন, নাকফুল, কানফুল, বালা প্রভৃতি বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়ে আসতে।
যাই হোক, তবলছড়ি বাজার পার হয়ে যেতে না যেতেই পথে পড়বে শহরের বহু পুরনো বৌদ্ধ বিহার “আনন্দ বিহার”।
নামফলকে উল্লেখ আছে আনন্দ বিহার ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। মোনঘর শিশু সদনের অন্যতম পথিকৃৎ শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাস্থবির রাঙ্গামাটি থাকলে এই বিহারে থাকতেন বলে মোনঘরের ছেলেদের সাথে এই বিহারের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ।
একসময় মোনঘর থেকে পাশ করা কলেজপড়ুয়া ছেলেদের অনেকেই এই বিহারে অবস্থান করে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে অধ্যয়ন করতেন।
মোনঘরের সাবেক সিনিয়র বরেন্দ্রলাল ত্রিপুরার লেখা “সোনালী উষা, ধূসর গোধূলী” নামক মফস্বলী রোমান্টিক উপন্যাসটিতে রাঙ্গামাটির আনন্দ বিহার এলাকা, ডিসি বাংলো এলাকার সেসময়কার চিত্রগুলো পাওয়া যায়।
একটা সময় ছিল যখন রাঙ্গামাটির উঠতি তরুণ-তরুণীদের নিরাপদ প্রেমের ঠিকানা ছিল ডিসি বাংলো এলাকা বা তার আশেপাশের এলাকাগুলোে যেটাকে ছোটখাটো সমুদ্রপার বলে মনে হয়।
এখন ডিসি বাংলো এলাকাটা অত্যধিক বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হয়ে গেছে। আশেপাশে কোন পাহাড়ি এলাকা নেই। তাই সাধারণত পাহাড়িরা এখন এইসব এলাকা একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে বলেই মনে হয়।
এখনকার পাহাড়ি প্রেমিক -প্রেমিকা বা উঠতি বয়সীদের দেখা যায় আসামবস্তি ব্রীজ বা আসামবস্তি-কাপ্তাই রোডের ঐদিকে।
কে জানে অনাগত দিনে আগামী দিনের পাহাড়ি প্রেমিক-প্রেমিকা বা উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা এইপথেও নিরাপদে ঘুরতে সাহস করবে কিনা!
যাই হোক, আনন্দ বিহার দর্শন শেষে আমি আর শুভ্র রওনা দিলাম বনরুপামুখী। আমাদের পরের গন্তব্য শহরের একেবারেই প্রাণকেন্দ্র বনরুপার পাশেই কাঠালতলী এলাকায় অবস্থিত মৈত্রী বিহার।
কাঠালতলীতে অবস্থিত মৈত্রী বিহার এর প্রতিষ্ঠার সাল ১৯৬৭। আহামরি তেমন কিছু পেলাম না নোট নেওয়ার জন্য।
মনে মনে শুধু ভাবছিলাম ১৯৬৭-র দিকে এই বিহারের আশেপাশের এলাকাগুলো কেমন ছিল???
তবলছড়ি থেকে বনরুপা যাওয়ার পথে একপাশে পাশ কাটিয়ে যেতে হয় রিজার্ভ বাজার এলাকাটিকে।
রিজার্ভ বাজার এলাকাটি কাপ্তাই বাঁধের পানিতে তলিয়ে যাওয়া পুরাতন রাঙ্গামাটি শহরের বিলুপ্তির পর থেকেই পার্বত্যাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র।
রিজার্ভ বাজার লঞ্চঘাট হয়েই বিভিন্ন উপজেলার সাথে নৌভিত্তিক যোগাযোগ রক্ষা করে রাঙ্গামাটি। রিজার্ভ বাজারের পাশেই শহীদ অাব্দুল আলী একাডেমী মাঠ।
বাবার মুখে শুনেছি এই মাঠে নাকি স্বাধীনতার পরপরই একটি বড় জনসভা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই জনসভাতেই নাকি তিনি পাহাড়িদের পরামর্শ দিয়েছিলেন বাঙালি হয়ে যেতে।
পাহাড়িরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সভাস্থলেই এবং সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। জুম্ম জাতীয় চেতনার অগ্রদূত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যেমন গণপরিষদ অধিবেশন চলাকালীন জাতীয় সংসদে দৃপ্ত কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন “একজন চাকমা কখনো একজন বাঙালি হয়ে যেতে পারেন না।”
মা’র সাথে এই রিজার্ভ বাজারে যাওয়ার শৈশব স্মৃতিও আমার কাছে খুব আনন্দদায়ক। রিজার্ভ বাজার থেকেই মা বেইন বুনার সুতা কিনে নিয়ে আসতেন।
মা’র পরিচিত অনেক সুতা দোকানি ছিলেন রিজার্ভ বাজারে। দেখতে দেখতে একেবারে চোখের সামনেই রিজার্ভ বাজার থেকে রাঙামাটির প্রধান বাজার হয়ে গেল বনরুপা।
সেখানেও একটি কাহিনী আছে। একসময় রাঙামাটির প্রধান বাজার ছিল রিজার্ভ বাজার। এখন বনরুপা। রিজার্ভ বাজার এলাকাটা বাঙালি অধ্যুষিত।
কোন একসময় সেখানে বাজার দিনে পাহাড়ি-বাঙালি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়। তারপর থেকে পাহাড়িরা রিজার্ভ বাজার এড়িয়ে চলে এবং বনরুপায় চলে আসে মূল বাজারটি।
মৈত্রী বিহার দর্শন শেষ হলো। এরপরে আমরা গেলাম চাকমা রাজবাড়ি ও রাজ কার্যালয়ের পাশেই অবস্থিত চাকমা রাজবিহারে।
রাজবিহার এর প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে উল্লেখ আছে ১৮৭৩। রাজবিহারে যাওয়ার পথে প্রথমেই পড়বে চাকমা সার্কেল চীফের কার্যালয়। কার্যালয়ের একেবারেই সম্মুখে বেশ কয়েকটি বড় বড় “আজার বিজি গাজ” দেখলাম।
থুম্বোক খারা’র কথা মনে পড়ে গেল। আমি “আগাজা বিজি গুদেয়ে” পছন্দ করি। দেখলাম রাজবাড়ির ঘাটে বেশ বড়সড় একটি “আগাজা বিজি গাজ”, আছে একটি বয়সী ফুলসুমোরি গাজ’ও। ফুলসুমোরী গাছ দেখলেই আমার আবেগ উপচে পড়ে।
কেনজানি এই বৃক্ষটিকে খুব খুব এবং খুব করে ভালোবাসি। আমার খুব শখ কোন এক পূর্ণিমাতে কোন এক জুম্মবীকে কোন এক ফুলসুমোরি গাছের নিরিবিলিতে আমার জীংহানির সবগুলো বলা অথবা না বলা কথাগুলো শুনিয়ে দেবো।
রাজবিহার এলাকাটা চমৎকার নিরিবিলি পরিবেশ। আশেপাশে নির্মাণাধীন একটি চৈত্য দেখলাম। রাজবিহারে আমার পরিচিত এক ভিক্ষু অাছেন। উনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আসলাম।
রাজবিহারে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা পাশ্ববর্তী রাজবনবিহারে চলে এলাম। রাজবিহারের বিপরীতেই রাজবন বিহার এর খেয়াঙ ঘাট, যেখানে প্রতি বছর কঠিন চীবরদানের সময় বেইন বোনা হয়।
রাজবনবিহার এসে এর প্রতিষ্ঠাকাল জানলাম ১৯৭৪ সাল। রাজবনবিহার নিয়ে স্মৃতি হাতরাতে গেলে অনেককিছুই চলে আসে।
মুচকি হাসলাম মনে মনে এই ভেবে যে, একটা সময় অামি রাঙ্গামাটির রাজবনবিহারের কঠিন চীবর দানোৎসবে যেতাম কেবল ‘ডাব্য’ খেলার লোভে!
বনবিহার দেখা হয়ে গেল। এরপরে পার্টনার (আমার বন্ধু শুভ্র) এর “লদক-দদক” স্টাইলে চালানো বাইকে চড়ে আমরা চলে এলাম ভেদভেদীতে অবস্থিত সংঘারাম বৌদ্ধ বিহারে।
বাতি জালালাম। কোন বিহারে যেয়ে বাতি জালালে অামার ছোটবেলায় শোনা একটি গানের কথা মনে পড়ে-
“আমরা নাকি বৌদ্ধ জাতি-
সবাই বলে সরল মতি,
অহিংসার নামটি ধরে
জালাই শুধু মোমের বাতি।”
যাই হোক সংঘারাম বৌদ্ধ বিহার এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীমৎ শ্রদ্ধালংকার মহাস্থবির। তিনি মোনঘর শিশু সদনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও বটে এবং বলা চলে মূলত তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচর্যাতেই মোনঘর বড় হয়ে উঠেছিল।
তিনি একাধারে চাকমা ভাষা ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞও বটে। সংঘারাম বিহারের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৮৩।
ভেদভেদী সংঘারাম বিহার দর্শন শেষে আমরা রাঙ্গাপানি মিলনবিহার চলে এলাম। এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৪ সালে। মিলন বিহার যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন ভেদভেদীতে সংঘারাম বিহার হয়নি।
ভেদভেদী এবং রাঙ্গাপানি এ দুই গ্রামের লোকজন স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে গড়েছিল বিহারটি। দুই গ্রামের লোকজনের মিলন, এই ধারণা থেকেই বিহারটির নাম হয় মিলন বিহার।
এই মিলন বিহারকে কেন্দ্র করেই মোনঘর শিশু সদনটি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল বলে জানি। আমাদের গ্রামটির একেবারে প্রবেশপথে অবস্থিত এই বিহারটির সাথে আমার কৈশোরিক বেশ স্মৃতি জমে আছে।
এই বিহারে আমি প্রায় দুবছরের মতন শ্রামণ ছিলাম। আমাদের গ্রামে বনভান্তে দু’বার এসছিলেন বলে মনে আছে। ছোটবেলায় আমরা একটি গান গেতাম যা এরকম –
“আমা মন আন দোল, বনভান্তে দোল
সংসমারে আগি আমি নেই হনও জোল”
গানটি সম্ভবত রণজিৎ দেওয়ানের লেখা। বনভান্তে রাঙ্গাপানি গ্রামবাসীকে ভালোবাসতেন। প্রতিবছর রাঙ্গাপানি গ্রামবাসী রাজবন বিহারের কঠিন চীবরদানের সময় একটি বাঁশের তৈরী হাতি বানিয়ে দান করতো।
বনভান্তে নাকি আশীর্বাদ করতেন রাঙ্গাপানি গ্রামবাসী যেন একতাবদ্ধ এবং বলশালী হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটি শহরের মধ্যে নির্ভেজাল জুম্ম অধ্যুষিত এলাকা বলতে এই রাঙ্গাপানি গ্রামটিই কেবল আছে।
পুরো রাঙ্গামাটি শহর ঘুরে আমি ৭টি বৌদ্ধ বিহার পেয়েছি। অথচ কেবল রাঙ্গাপানি গ্রামের চারপাশেই হিসেব করে দেখেছি যে ৭টির মতোন মসজিদ হয়ে গেছে।
অর্থাৎ খুব দ্রুতই রাঙ্গামাটির জনমিতি বদলে গেছে। আগামী ১০/১৫ বছরে তা আরো ব্যাপকভাবে বদলে যাবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
আমার ফেলে আসা শৈশবের রাঙ্গামাটির চেহারা অার এখনকার রাঙ্গামাটির চেহারাতে অনেক ফারাক, অনেক অমিল। সেটা স্বাভাবিকই লাগতো যদি তার পরিবর্তনটা স্বাভাবিকভাবে হতো।
কিন্তু আমরা দেখছি পরিস্থিতি ভিন্ন। হুট করেই বদলে যাচ্ছে রাঙ্গামাটির চেহারা, তার জনমিতি এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য। শহরটা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেটেলার বসতি। জুম্মরা প্রায় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। আগামীতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার মতো উপক্রম হবে না তো??? রাঙ্গামাটির এই ৭টি বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্বও কি থাকবে???
লেখকঃ সুলভ চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।