ব্যূহচক্র মেলা ও রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহার
1770
রাজেন্দ্র নাথ তালুকদারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অস্থায়ীভাবে বাঁশের বেড়া ও ঢেউটিনের ছাউনি দিয়ে ‘আনন্দ বিহার’ নির্মিত হল। শুরু হল এ নব প্রতিষ্ঠিত ও নব নির্মিত বিহারে একজন অধ্যক্ষ ভিক্ষু নিমন্ত্রণের পালা।
তখনকার ডিষ্ট্রিক ইন্সপেক্টর অব স্কুল, বাবু বীরেন্দ্র লাল মুৎসুদ্দী মহোদয়কে দেওয়া হয় একজন পন্ডিত ভিক্ষুকে এ নব প্রতিষ্ঠিত বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার দায়িত্ব।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৪ খ্রিষ্টাদ্বের জানুয়ারীতে পন্ডিত বিশুদ্ধানন্দ মহাস্থবির মহোদয় এ মন্দিরের অধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তিনি কত বছর মন্দিরের অধ্যক্ষ হিসেবে অবস্থান করেছিলেন তা ডাঃ যামিনী রজ্ঞন চাকমার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্তে নেই।
‘সত্যদর্শন’ নামক বইয়ের লেখক পরমপূজ্য ভদন্ত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো মহোদয় ছিলেন শ্রীলংকার ত্রিপিটক বিশারদ। তিনি বুদ্ধ ভাষা পালিতে ও বাংলা ভাষায় স্বচ্ছন্দে ও সাবলীলভাবে ভাষণ দিতে পারতেন বলে কথিত আছে।
বস্তুতঃ রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহার প্রতিষ্ঠা লগ্ন তথা ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান বছর পর্যন্ত মহাসাড়ম্বরে আত্যন্তিক শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে ও বিশ্বাসে কর্ম ও কর্মফলের উপর বিশ্বাস রেখে শুভ মাঘী পূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারের পুত পবিত্র প্রাঙ্গনে
‘চক্রব্যূহ মেলা বা ব্যূহচক্র মেলা’ উদযাপিত হয়ে আসছে চিরাচরিত নিয়মে। শুধু আনন্দ বিহারের শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকা নন, রাঙ্গামাটির আপামর বৌদ্ধ দায়ক-দায়িকাগণ সতৃঞ্চ নয়ণে এ শুভ মাঘী পূর্ণিমার পরম পবিত্র দিনটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণেন। ‘কবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে -সেই বহু প্রতীক্ষিত ব্যূহচক্র মেলা’?
কালের অমোঘ নিয়মেসময় গড়িয়ে যায়। দিন গড়িয়ে চলে মাসের পথ বেয়ে। বছরের ৩৬৫ দিনের সিঁড়ি বেয়ে আজই সেই পূত পবিত্র শুভ মাঘী পূর্ণিমা তথা আনন্দ বিহারের সেই নন্দিত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ‘ব্যূহচক্র মেলা’।
ব্যূহচক্র মানে কি?
বৌদ্ধরা কর্মবাদী। আমরা বৌদ্ধরা বিশ্বাস করি কর্ম ও কর্মফলকে। কর্মবহতা নদীর মতো। অনাদি অনন্তকাল থেকে প্রতিটি জীবনের কর্মপ্রবাহ বয়ে চলেছে বহতা নদীর মতো। বৌদ্ধদের দৃঢ় বিশ্বাস অতীতের কর্ম বিপাকের চূড়ান্ত পরিণতি হল বর্তমান জন্ম।
আর বর্তমান এ জীবন লাভ করে তাবৎ জীবনে সদ-অসদ যা কিছু কর্ম সম্পাদন করে যাবো- তাতেই আমার ভবিষ্যৎ পরিণতি নির্ধারিত হবে। এ বিষয়ে করুণঘন বুদ্ধের কম্বুকন্ঠের উচ্চরণঃ
“অতীতে হেতবো পঞ্চ, ইদানি ফল পঞ্চকং ইতানি হেতবো পঞ্চ, আয়তি ফল পঞ্চকন্তি।”
অবিদ্যা, সংস্কার, তৃষ্ণা, উপাদান ও ভব-অতীতের পঞ্চ হেতু।
বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা-বর্তমানের পঞ্চফল।
অবিদ্যা, সংস্কার, তৃষ্ণা, উপাদান ও ভব-বর্তমানের হেতু।
বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা-ভবিষ্যতের পঞ্চফল।
এখানে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্য-করণ নীতি বা Lwa of Dependent Orignation কর্মভব ও উৎপত্তিভবের সমন্বিত বিন্যাসের মধ্যদিয়ে ব্যূহচক্র, ভবচক্র, সংসার চক্র, কর্মচক্ররূপে মধ্যদিয়ে ব্যূহচক্র, ভবচক্র, সংসার চক্র, কর্মচক্ররূপে দেখানো হয়েছে।
এ দ্বাদশ নিদান বা ভবচক্র, সংসার চক্র, কর্মচক্ররূপে মধ্যদিয়ে একত্রিশ লোক ভূমিতে আমরা তাবৎ জীব জগত ব্যূহচক্রের মধ্যে পরিভ্রমণরত অবস্থায় রয়েছি- অনাদি অনন্তকাল থেকে।
রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারে ৮৬ তম ব্যূহচক্র মেলাসূত্রঃ ইন্টারনেট
কর্মবীজ ক্ষয় প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে এ ব্যূহচক্রের মধ্যে উৎপত্তি, স্থিতি ও ভঙ্গের মধ্যে দিয়ে পরিভ্রমনরত অবস্থায় থাকতেই হবে। এতে সন্দেহ পোষণ করার কোন অবকাশ নেই।
যেদিন করুণাঘন বুদ্ধ সম্যক সম্বুদ্ধত্ব জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়ে কর্মবীজ সম্পূর্ণ ক্ষয় পূর্বক সোপাদিশেষ নির্বাণে উন্নীত হলেন- তাঁর সেদিনের কম্বুকন্ঠের উচ্চারণ ছিল নিম্নরূপঃ
“অনেকা জাতি সংসারং সন্ধা বিসসং অনিব্বিসং,
গহকারং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পুনং
গহকারং দিটেঠাসি পুন গেহং না কাহসি
সাব্বেতে ফাসুকা ভগ্গা, গহকুটং বিসংকিতং
বিসাংখার গতং চিত্তং তণ্হানং খয়মজ্ঝগা।”
অনুবাদ:
জন্ম-জন্মান্তর পথে ফিরিয়াছি পাইনি সন্ধান সে কোথা গোপনে আছে, এ গৃহ যে করেছে নির্মাণ। পুঃনপুঃন পেয়ে দেখা তব পেয়েছি এবার, হে গৃহকারক!
গৃহ না পারিবে রচিবারে আর। ভেঙ্গেছে তোমার স্তম্ভ চুরমার গৃহ ভিত্তিচয়, সংস্কার বিগত চিত্ত তৃষ্ণা আজি পাইয়াছে ক্ষয়। (সত্যেন্দ্র নাথ ঠাকুর)
করুণঘন বুদ্ধ কর্মচক্র, ভবচক্র, তথা ব্যূহচক্রের উর্ধ্বে অধিষ্ঠিত হলেন। জন্ম-মৃত্যুর উর্ধ্বে উঠলেন। একত্রিশ লোক ভূমির মারভূবন অতিক্রম করে সমস্ত দুঃখ অন্তসাধনের পথ আবিষ্কার করলেন।
ব্যূহচক্র আমাদেরকে অনাদি অনন্তকাল থেকে এ একত্রিশ লোক ভূমির আবর্তনের মধ্যে ধরে রেখেছে তার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ চতুরার্যসত্য The Four Noble Truth. বুদ্ধের আবিস্কৃত-এ মহাসত্যের শাশ্বাত বা চিরন্তন হচ্ছে- জগত দুঃখময়।
জীব জগত জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ ও প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, যা ইস্পিত প্রার্থিত তা না পাওয়ার দুঃখের অধীন। তাঁর সত্য দৃষ্টিতে ‘পঞ্চস্কন্ধ’ লাভ করাটাই পরম দুঃখময়।
এ দুঃখ আবার প্রতিনিয়ত উদয় ও বিলয় ধর্মী তথা অনিত্য। যা অনিত্য তা দুঃখময় অনাত্ম । এ দুঃখকে সম্পূর্ণ নিরোধ করণ সম্ভব।
এবং এ ভবচক্রের বা কর্মচক্রের বা সংসার চক্রের তথা ব্যূহচক্রের আবর্তিত বিবর্তিত যাবতীয় দুঃখের সম্পূর্ণ বিলয় সাধনের পথ তিনি আবিষ্কার করলেন- যা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গরূপে আমাদের বৌদ্ধদে মাঝে দুঃখ মুক্তির চিরন্তন মহাসত্যরূপে দেদীপ্যমান।
জীবের জাগতিক যাবতীয় দুঃখ অতিক্রমণের যে পথ তা আটটি Faculty তে বা কর্মশক্তিতে বিভক্ত। এ আটটি Faculty হল নিম্নরূপঃ
প্রজ্ঞাঃ
১। সম্যক দৃষ্টি
২। সর্মক সংকল্প
শীলঃ
১। সম্যক বাক্য
২। সম্যক কর্ম
৩। সম্যক জীবিকা
সমাধিঃ
১। সম্যক উদ্যম
২। সম্যক স্মৃতি
৩। সম্যক সমাধি
দুঃখ মুক্তির উপায় আর্যসত্যরূপে যে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা Faculty’র বা কর্মদক্ষতা সমূহের তালিকা উপরে বিধৃত করা গেল- তারা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।
একটির অবর্তমানে অপরটি উৎপন্ন হওয়ার বা অর্জিত হওয়ার কোন অবকাশ নেই। তারা শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার সমলংকৃত সমন্বিত সমাহার। সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা শীল বা Morality’ র অন্তর্ভুক্ত।
সম্যক উদ্যম, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি- সমাধির অন্তর্ভুক্ত। অতএব, শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার সর্ব দুঃখ অন্তঃসাধনের তিনটি Faculty’ বা কর্মশক্তি -যা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত বা অবিচ্ছেদ্য।
শীলের অবর্তমানে সমাধির কথা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র। আর সমাধি ব্যতীত প্রজ্ঞার উৎকর্ষ বিধান একেবারে অসম্ভব, অনেকটা দিবা স্বপ্নের মতো।
মোর্দ্দাকথায়-ব্যূহচক্র মানে সংসার চক্র। এ সংসারচক্রকে আমরা কর্মচক্র অথবা ভবচক্র হিসেবেও অভিহিত করতে পারি।
এখানে করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শনে সংসার চক্রের অপর নম দ্বাদশ নিদান- যা আমাদের জীব জগতকে এ ভব সংসারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
ইংরেজীতে এ দ্বাদশ নিদানকে বলা হয় Lwa of causion. একে সংক্ষিপ্তভাবে প্রতীক্য সমুৎপাদ নীতি নামেও অভিহিত করা যায়। এখানে বিধৃত রয়েছে- ‘ইমস্মিং সতি ইদং হোতি’ ইমস্স উপ্পাদা ইদং উপজ্জতি।’
বিপরীতে বা প্রতিলোমে “ইমস্মিং অসতি ইদং ন হোতি, ইমস্স নিরোধা ইদং নিরুজ্জন্তি।’ একথায় – “হেতুর উৎপত্তিতে ফলের উৎপত্তি, হেতুর নিরোধে ফলের নিরোধ।”
ব্যূহচক্র বা কর্মচক্র বা ভবচক্র বা সংসার চক্রের আবর্তিত বিবর্তিত পরিণতি সম্পর্কে জীবন ঘনিষ্ঠ সর্মক দর্শনের সুবিধার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্যকারণ নীতি অনুলোম ও প্রতিলোম উল্লেখ করে নিম্নে প্রদান করা গেল-
প্রতীত্য সমুৎপাদ (প্রতিলোম) : “ইমস্মিং সতি ইদং হোতি, ইমস্স উপ্পাদা ইদং উপজ্জতি, যদিদং অবিজ্জা পচ্চয়া সঙ্খারা, সঙ্খারা পচ্চয়া বিঞ্ঞানং, বিঞ্ঞান পচ্চয়া নামরূপ, নামরূপ পচ্চয়া সলায়তনং, সলায়তনং পচ্চয়া ফস্সো, ফস্সো পচ্চয়া বেদনা, বেদনা পচ্চয়া তণ্হা, তণ্হা পচ্চয়া উপাদানং, উপাদান পচ্চয়া ভব, ভব পচ্চয়া জাতি, জাতি পচ্চয়া জরা-মরণং – শোক-– পরিদেব – দক্খ -দোমনস্পায়াসা সম্ভবন্তি: এমেতস্স কেবলস্স দুক্খ কন্ধস্স সমুদয়ো হোতি।”
প্রতীত্য সমুৎপাদ (প্রতিলোম) : ইমস্মিং অসতি ইদং র হোতি, ইমস্স নিরোধা ইদং নিরুজ্জন্তি, যদিদং অবিজ্জায়ত্বেব অসেস বিরাগ নিরোধা সঙ্খারানিরোধো, সাঙ্খারা নিরোধা বিঞ্ঞানং নিরোধো, বিঞ্ঞান নিরোধা, নামরূপ নিরোধো, নামরূপ নিরোধা সলায়তন নিরোধো, সলায়তন রিরোধা ফস্স নিরোধা, ফস্স নিরোধো বেদনা নিরোধো, বেদনা নিরোধা তণ্হা নিরোধো, তণ্হা নিরোধা উপাদান নিরোধো, উপাদান নিরোধা ভব নিরোধো, ভব নিরোধা জাতি নিরোধো, জাতি নিরোধা – জরা- মরণং – সোক – পরিদেব – দুক্খ – দোমনস্সুপায়াসা নিরুজ্জন্তি এ মেতস্স দুক্খকন্ধস্স নিরোধো
এ প্রতীত্য সমুৎপাদ বা কার্যকরণ নীতিকে বাংলায় অনুবাদ করে সাজালে এরূপ দাঁড়ায়ঃ
অবিদ্যার কারণে সংস্কার,
সংস্কারের কারণে বিজ্ঞান,
বিজ্ঞানের কারণে নামরূপ,
নামরূপ কারণে ষড়ায়তন,
ষড়ায়তনের কারণে স্পর্শ,
স্পর্শ কারণে বেদনা,
বেদনা কারণে তৃষ্ণা,
তৃষ্ণার কারণে উপাদান,
উপাদানের কারণে ভব,
ভব কারণে জাতি বা জন্ম,
জাতি কারণে জরা, মরণ, শোক, পরিদেবন, দুঃখ দৌর্মনস্য প্রভৃতির উৎপত্তি হয়।
অতএব, ব্যূহচক্রের ফাঁদে ভব বন্ধনে বেঁধে রাখার প্রথম তথা প্রধান Component হল অবিদ্যা। ইংরেজীতে এর অর্থ Ignorance মানে অজ্ঞতা। এই ‘অবিদ্যা’ জীবজগতকে দুঃখ সাগরে নিপতিত করার প্রথম ও প্রধান কারণ।
এ অবিদ্যার কারণে আমরা প্রতিনিয়ত নানাবিধ কর্মের মধ্যদিয়ে সংস্কার উৎপন্ন করে চলেছি। রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান তথা একথায় নামরূপের মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ব্যূহচক্রের ভব বন্ধনে জটিট বিজটিট হয়ে পড়েছি- তা স্থুলচক্ষে বা চর্মচক্ষে দেখা এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ব্যতীত উপলব্ধি করা সত্যিই কঠিন ও দূরনুবোধ্য।
রূপ, বিজ্ঞান, সংজ্ঞা, বেদনা ও সংস্কার তথা নামরূপ কিভাবে Action ও Reaction এর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত নানাবিধ সংস্কার এবহবৎধঃব করে যাচ্ছি তার একটি বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা নিম্নে প্রদান করা গেল-
রূপ-পঠবী ধাতু, তেজ ধাতু, বায়ু ধাতু ও অপ ধাতুর সমন্বয়ে গঠিত রূপ বা শরীর।
বিজ্ঞান Cognition -অবধারিত অংশ।
সংজ্ঞা- Recognition part -শনাক্তকরণ অংশ।
বেদনা- Feeling part -অনুভূতির অংশ।
সংস্কার- Action part বা Reaction part. ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ার মধখ্য দিয়ে সংস্কারোৎপত্তির অংশ।
নামরূপ নামক শরীরের কোন একটি অংশে একটি ঘটনা সংঘটিত হতে যাচ্ছে- তার প্রথম ভাগে অবধারণ অংশ সচকিত হবে, অতঃপর শনাক্তকরণঅংশ পেরিয়ে অনুভূতির অংশে গমন পূর্বক Action বা Reaction এর মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটবে।
উদাহারণঃ শরীরের কোন একটি অংশে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে, জরিপ করে দেখা গেল-সেখানে একটি মশা বসে রয়েছে. মশা যেখানে বসে রয়েছে সেখানেই ভ্যথাটা অনুভূত হচ্ছে, ব্যথা থেকে মুক্তির জন্য মশাটিকে লক্ষ্য করে এক থাপ্পর বসানো হল- পরিণামে মশাটি মারা গেল অথবা কাজটি হয়ে গেল অথবা ‘সংস্কার’ কায়িক Action এর মাধ্যমে সাধিত হল।
এভাবে প্রতিনিয়ত Cognition, Recognition, Feeling ও Action এর মধ্য দিয়ে কায়িক, বাচনিক ও মানসিক এ ত্রিবিধ দ্বারে আমরা কর্ম সংস্কার Generate করে যাচ্ছি গোটা জীবন ধরে।
এবং এখানেই অবিদ্যার পরিবর্তে বিদ্যা বা জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক গুরুত্ববহ বিবেচিত হয়। অজ্ঞতাই অবিদ্যা। অবিদ্যা বা অজ্ঞতা কি? রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান সম্বন্ধে তথা পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ যে চরম দুঃখময় – তা না জানার অপর নামই অবিদ্যা বা অজ্ঞতা।
এ অবিদ্যার কারণে জীব জগতে অনাদি অনন্তকাল ধরে ভবচক্র বা কর্মচক্র বা সংসার চক্রের বা চক্রব্যূহ মধ্যে আবর্তিত বিবর্তিত অবস্থায় জীবজগত ঘূর্ণায়মান রয়েছে- তার যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধির লক্ষে আনন্দ বিহারে আজকের এ প্রতীকি ব্যূহচক্র মেলার অবতারণা বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস।
ব্যূহচক্র মেলার প্রয়োজনীতা কি আজকের এ একবিংশ শতাব্দীতে কতটুকু গুরুত্ববহ?
আনন্দ বিহার প্রতিষ্ঠার বছর হল ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ। প্রতিষ্ঠার বছর থেকে এ বিহারের পবিত্র প্রাঙ্গণে এ ব্যূহচক্র মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে পরম বিশ্বস্ততায় এবং ঐকান্তিক শ্রদ্ধাভরে।
এবারের ব্যূহচক্র মেলা আনন্দ বিহারের ৭৫ (পঁচাত্তর) তম ব্যূহচক্র মেলা। পূর্বে এ আনন্দ বিহারের ব্যূহচক্র মেলাকে ঘিরে রাঙ্গামাটির আপামর বৌদ্ধ জনতার অন্তরের টান, উন্মাতাল ভালবাসা ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ।
কথিত আছে- বহু নন্দিত ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির প্রাণশক্তিতে ভরপুর কোমল প্রাণ বৌদ্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবছর এই ব্যূহচক্রের যাবতীয় কাজ সুসম্পাদন করতেন।
বনের বাঁশ কেটে বেড়া বানানো থেকে শুরু করে তা যথাযথ প্রতিষ্ঠাপন, ব্যূহচক্র মেলা পরিচলনা, মাঘী পূর্ণিমার দিনে করুণাঘন বুদ্ধের পাদমূলে পূজা নিবেদন, পবিত্র বোধি বৃক্ষের পাদমূলে পূজার্চনা,
ব্যূহচক্রের অভ্যন্তরে সাময়িকভাবে প্রতিষ্ঠাপিত বুদ্ধের পাদমূলে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে বুদ্ধ সংকীর্তনের মধ্যদিয়ে অতীব আড়ম্বরপূর্ণভাবে সারিবদ্ধ হয়ে পূজা নিবেদনের লক্ষে আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা ছিল সর্বতোভাবে প্রাণময় পুত পবিত্র আঙ্গিকতায় ভরপুর।
কালের বিবর্তনে নির্দেশনার অভাবে রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সেই সময়কার নবম শ্রেণীর কোমল প্রাণ বেদ্ধ ছাত্র/ছাত্রীদের রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারের মাঘী পূর্ণিমার এ ব্যূহচক্র মেলার টান আজ স্পন্দিত আন্তরিকতায় প্রাণময় নয় মোটেই।
রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহারসূত্রঃ ইন্টারনেট
১৯৭৮ এর শুভ বৈশাখী পূর্ণিমার ২/৩ দিন আগে আমি এ ঐতিহ্যবাহী সুপ্রাচীন আনন্দ বিহারে উপাধ্যক্ষ হিসেবে আগমন করি। আমাকে যারা এ বিহারে পরম মমতায় সাদরে বরণ করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা হলেন রাঙ্গামাটি মৈত্রী বিহারের তখনকার অধ্যক্ষ আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধভাজন প্রয়াত ভদন্ত বিমল বংশ মহাথের,
আনন্দ বিহারের তখনকার সম্পাদক বাবু করুনেশ চাকমা ও এ বিহারের ও রাঙ্গামাটির তখনকার বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব আনন্দ বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি বাবু ডাঃ যামিনী রঞ্জন চাকমা মহোদয়। তাঁরা আজ আমাদের মাঝে নেই।
মহাকাল তাঁদেরকে মৃত্যুর মধ্যদিয়ে হরণ করে নিয়ে গেছে। আজকের এ পবিত্র মাঘী পূর্ণীমার দিনে ঐকান্তিক সশ্রদ্ধাচিত্তে কামনা করি তাঁদের পারলৌকিক উত্তরোত্তর সদগতি ও কল্যাণ।
জন্ম- জন্মান্তরের অমোঘ নিয়মে আবারও তাঁরা ফিরে আসুক আমাদের এ পোড় খাওয়া সমাজে, সমাজের ধ্র“ব জ্যোতিরূপে।
বস্তুত: ১৯৭৯ সাল থেকে দেখে আসছি পবিত্র মাঘী পূর্ণীমাকে উপলক্ষ্য করে আনন্দ বিহারের পবিত্র প্রাঙ্গণে আনন্দ বিহার কার্যনির্বাহক কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে পরম মমতায় ও আন্তরিক বিশ্বস্ততায় ব্যূহচক্র মেলা উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
মাঝে মাঝে দু’একজন তথাকথিত সদ্ধর্ম সচেতন মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে শোনা যায়-কি দরকার এত টাকা খরচ করে এ ব্যূহচক্র মেলা উদ্যাপন করার? এ মেলার দ্বারা জরাজীর্ণ বৌদ্ধ সমাজে কি কোন কাঙ্খিত সমৃদ্ধি বা পরিবর্তন আসছে?
অথবা এ মেলার প্রাণময় আবেদন নৈতিক অবক্ষয় তাড়িত বৌদ্ধদের মাঝে নৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করে দিচ্ছে কি? এরূপ অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে বিনাদ্বিধায়। তদুত্তরে আমার জবাব হল এরূপঃ- করুণাঘন বুদ্ধতো তাঁকে আমিষ সহযোগে পূজা না করতে বলেছেন।
নিরামিষ পূজাই হচ্ছে তাঁর পাদমূলে নিবেদিত পূজার শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য। এখানে আমিষ পূজা হচ্ছে –ভাত, তরকারী, ফুল, পুষ্প, মালা গন্ধদ্রব্য সহযোগে বিভিন্ন খাদ্য ভোজ্য লেহ্য পেয়াদির মাধ্যমে পূজা। আর নিরামিষ পূজা হচ্ছে- শীল, সমাধী ও প্রজ্ঞায় বিমন্ডিত হয়ে আলোকিত পুণ্য পুরুষরূপে তাঁর নির্দেশিত সর্ব দুঃখান্তসাধনের পথে পরিপূর্ণ আত্মনিবেদন।
তবুও বৌদ্ধ বিশ্বে নিরামিষ পূজার চাইতে আমিষ পূজার মাধ্যমে বুদ্ধের পাদমূলে পূজা নিবেদন করার রীতিকে বহাল রাখা হয়েছে পরম মমতায়।
বস্তুত: আমিষ পূজা এখানে মূল উপলক্ষে নয় বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এখানে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে শুভ সম্মিলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিভাবে আবাল বৃদ্ধবনিতার সমন্বিত সম্মিলন সহযোগে পরম ভক্তি বিনম্ভ্র চিত্তে করুণাঘন বুদ্ধের অপ্রমেয় গুণসমূহের স্মৃতিচারণ, পঞ্চশীল অধিষ্ঠিত হওয়া, জ্ঞাতি সম্মিলন,
পারস্পারিক কুশল বিনিময়, পুণ্যদ্যোতক পুণ্য কর্ম সুসম্পাদনের লক্ষ্যে সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, করুণাঘন বুদ্ধের পাদমূলে বসে ব্যক্তিক ও সমষ্টিগত অঙ্গীকার সমূহকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেয়ার লক্ষ্যেই আজকের এ আমিষ পূজার পুণ্যময় উপস্থিতি।
উল্লেখযোগ্য পূর্ণিমাসমূহে আমিষ সহযোগে পূজা উদ্যাপন অনেকটা আত্মশুদ্ধি, আত্মসমীক্ষা, আত্মোপলদ্ধি, আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মদর্শনের একটি মনস্কামনাজাত প্রচেষ্টা-যা সম্যক উদ্যমের পরম পরাকাষ্টারূপেও মূল্যায়িত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
এছাড়া সমন্বিত আমিষ পূজার বদৌলতে ভাবী প্রজন্মের মনোমন্দিরে বৌদ্ধ সংস্কৃতি, বৌদ্ধ ঐতিহ্যের গৌরবজ্জ্বল ও শ্রদ্ধাসহগত উত্তরাধিকরে প্রজন্মকে উত্তরাধিকারী করার প্রয়াসটি তো রয়েছেই।
শুভ মাঘী পূর্ণীমার পবিত্র তিথিকে উপলক্ষ্যে করে আনন্দ বিহারে চিরাচরিতভাবে প্রতিবছর ব্যূহচক্র মেলা উদ্যাপন ও অনেকটা উপরোক্ত Faculty বা কর্মশক্তি সমূহকে সঞ্জীবিত করার মহতী প্রয়াসেরই সার্থক কর্মউদ্যোগ।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বষয় সবার মনে রাখা দরকার যে-বুদ্ধের ধর্ম দর্শন বিত্ত প্রধান নয়-চিত্ত প্রধান। এ ধর্ম কখনো লৌকিক সুখ সমৃদ্ধিকে সবিশেষ গুরাত্বরোপ করেনি।
বুদ্ধের শাসন-সদ্ধর্ম তথা ধর্ম দর্শনকে এক কথায় বলা যেতে পারে-চিত্ত প্রধান ধর্ম-দর্শন। এ ধর্মের আত্যন্তিক উন্নতি মানে চিত্তের বা মনের উৎকর্ষ বিধান।
বস্তুত: কায়িক ও বাচনিক সৎকর্মের মধ্য দিয়ে মানসিক তথা নৈতিক উৎকর্ষ বিধানের মাধ্যমে মৈত্রী, করুনা, মুদিতা ও উপেক্ষা সহগত চিত্ত সন্ততিকে সহায়ক শক্তি হিসেবে সম্মুখে রেখে এ পৃথিবীকে সর্বস্তরের সর্ব শ্রেণির মানুষের বাসযোগ্য করে তোলাই হল বুদ্ধের ধর্ম-দশনের কালজয়ী অঙ্গীকার।
অতএব, রাঙ্গামাটিস্থ সর্বস্তরের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৈষয়িক উন্নতির সহায়ক শক্তির একটি পড়সঢ়ড়হবহঃ হিসেবে যদি এ ব্যূহচক্র মেলাকে গণ্য করে মূল্যায়িত করা হয়-তাহলেই অদূর ভবিষ্যতে এ মেলা দীর্ঘ যগের প্রাণময় আবেদন ও অঙ্গীকারের যে ধারা প্রবাহমান রয়েছে-তা ব্যাহত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই, আমি কামনা করি-রাঙ্গামাটিস্থ আনন্দ বিহারের এ বহু ঐতিহ্যমন্ডিত প্রজন্মের স্মৃতিসংবাহিকা মাঘী পূর্ণিমার এ মেলাকে আরও প্রাণবন্ত, আরও সজীব, আরও প্রতিশ্র“তিশীল, আরও কালজয়ী করার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটির সর্বস্তরের বৌদ্ধ জনগণের সমন্বিত উদ্যোগ আরও জোরদার ও সুদূরপ্রসারী হোক।
আনন্দের বিষয়ে যে, চিরাচরিত নিয়মে ব্যূহচক্র মেলা আনন্দ বিহারের দায়ক-দায়িকাদের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাজবিহার, মৈত্রী বিহারসহ অপরাপর বিহার সমূহের দায়ক-দায়িকাদের উদ্যোগে সার্বজনীনভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে। এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
ব্যূহচক্র কোন শ্রেণির মেলা? বর্তমান সময়ে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে নানান জায়গায় বিভিন্ন শ্রেণির মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তন্মধ্যে সরকারী ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত “বানিজ্য মেলা”, “কৃষি মেলা”, “আনন্দ মেলা” ,“বৃক্ষ মেলা”, “বই মেলা” প্রভৃতি।
কিন্তু মাঘী পূর্ণীমার পবিত্র দিনে রাঙ্গামাটির আনন্দ বিহার প্রাঙ্গণে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেটা হচ্ছে- “ব্যূহচক্র মেলা”। এ “ব্যূহচক্র” কোনমতেই উপরোক্ত মেলাগুলোর সাথে তুলনীয় হতে পারে না। উপরোক্ত মেলাসমূহ বৈষয়িক সমৃদ্ধি তাড়িত মনস্কামনার চূড়ান্ত পরিণতিকে সম্মুখে রেখে উদ্যাপিত হয়।
কিন্তু ব্যূহচক্র মেলায় বৈষয়িক সমৃদ্ধি পরিবর্তে সংসার চক্র, ভব চক্র, কমচক্রের আবর্ত-বিবর্তমান অবস্থা থেকে জীব-জগতের মুক্তির মনস্কামনাকেই সবিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়।
অতএব, আনন্দ বিহারের ব্যূহচক্র মেলাকে অপরাপর কামিনীকাঞ্চনগন্ধী মেলার সাথে একই কাতারে ফেলে বিচার-বিবেচনা করলে সংসারাবর্ত থেকে মুক্তির প্রতীকি উদ্যোগের প্রতি অসম্মান দেখানো হয় বলে আমার ধারণা।
বিগত ৭৫ (পচাঁত্তর) বছরে আনন্দ বিহারের এ ব্যূহচক্র মেলা রাঙ্গামাটিস্থ বৌদ্ধ জনগনের মনোমন্দিরে ভবচক্রের ব্যূহ বন্ধন থেকে মুক্তির কোন পথ দেখাতে পেরেছে কি?
বস্তুত: করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন গম্ভীর, দূরনুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ, পন্ডিত বেদনীয় ও দুর্ধর্ষ। এ ধর্ম সর্বতোভাবে বাস্তবানুগ। এ ধর্মকে যথাসময়ে পঠন, পাঠন বা গুরুমুখে শ্রবণের মধ্য দিয়ে তা অন্তরের অন্তস্থলে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করণ জরুরী।
ধর্মকে শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত রেখে যথোপযুক্তভাবে মনন ও প্রতক্ষ্য পদ্ধতিতে অনুশীলনের মাধ্যমে দান-শীল ও ভাবনাময় কর্মাদি অনুষঙ্গে শীল-সমাধি ও প্রজ্ঞার চরমোৎকর্ষ বিধান করে ভবচক্রের তথা সংসার চক্রের বন্ধন ছিন্ন করা দুর্লভ মনুষ্য জন্ম লাভকারী সকল মানুষেরই অবশ্য কর্তব্য।
করুণাঘন বুদ্ধও তাই করেছিলেন। বুদ্ধ জাতকে বর্ণিত ৫৫০ জন্মের মধ্যে দশ পারমী, দশ উপারমী ও দশ পরমার্থ পারমী পূর্ণ করে সিদ্ধার্থ জন্মে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলদ্ধির উপর ভিত্তি করে সম্যক সম্বদ্ধত্ব জ্ঞানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
আর্যসত্য আবিস্কার করেছিলেন। দুঃখান্ত সাধনের জন্য আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গ নির্দেশ করেছিলেন। ক্ষীণবীজাবস্থায় কর্মচক্রের ব্যূহ বন্ধন ছিন্ন করে পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, আমরা যাঁরা বর্তমানে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছি- হয়তো আমরা করুণাঘন বুদ্ধের মতো পরিপূর্ণ পারমী সম্ভার সাথে নিয়ে জন্ম পরিগ্রহ করিনি।
তাই দান-শীল ও ভাবনাদি অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে পুণ্য পারমী সমূহ পূর্ণ করতে হবে। কায়, বাক্য ও মনে নিরন্তর দান-শীল ও ভাবনাময় কর্ম সম্পাদন করে ভবচক্রের বন্ধন ছিন্ন করার জন্য সদা তৎপর থাকতে হবে।
অতএব, এ বিষয়টি সকলের মনে রাখা দরকার যে, ভবচক্রের, সংসারচক্রের, কর্মচক্রের ব্যূহবন্ধনের কর্মজীব ক্ষয় করণ পূর্বক ক্ষণবীজ হওয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এটি অনাদি অনন্তকালের সচেতন সাধনায় বিষয়। ধর্মপদে একটি গাথা রয়েছে:-
“মাপ্পমঞঞেত পুঞ্ঞস্স ন মং তং আগামিস্সতি।
উদবিন্দু নিপামেন উদকুম্ভোপি পূরেতি
ধীরো পূরতি পূঞ্ঞস্স থোক থোকম্পি আচিনং।” ১২২।
“এ পুণ্য আমার কাছে আসবে না- এরূপ মনে করে পুণ্যকে অবহেলা করো না। বিন্দু বিন্দু জল নিপতিত হতে হতে কলসী যেরূপ পরিপূর্ণ হয়, তদ্রুপ অল্প অল্প করে পণ্য সঞ্চয় করতে করতেই পন্ডিত ব্যক্তিরা পুণ্যময় তথা পুণ্যপুত হয়ে ওঠেন।
এখানে পুণ্যময় সত্ত্বা মানে আত্মশুদ্ধি, আত্মোপলদ্ধি ও আত্মসংযমতায় পরিপূর্ণ স্থিতধী একজন ঊহষরমযঃবহবফ ড়হব. সর্বগুণে গুণান্বিত আলোকিত মানুষ। এ আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া কিন্তু খুবই দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হয়- জন্ম জন্মান্তর ধরে কল্প কল্পান্তর পর্যন্ত । এ জন্মে আমাদের এটিই স্মরণ রাখা উচিত-প্রভূত পুণ্যবলে এ জন্মে আমরা মানুষ হিসেবে জন্মেছি। এ মনুষ্য জন্ম একটি সুদুর্লভ জন্ম। বুদ্ধের ভাষায়:-
“দুল্লভঞ্চ মনুসসত্তং বুদ্ধপাদো চ দুল্লভো
দুল্লোভোচ ক্ষণ সম্পত্তি সদ্ধম্মো পরম দুল্লভো।”
১। সৌভাগ্যবশতঃ দুর্লভ মনুস্য জন্ম লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।
২। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ জন্মে করুণাঘন বুদ্ধের চাক্ষুষ দর্শন আমার পাই নি।
৩। সৌভাগ্যবশতঃ বুদ্ধের ধর্ম দর্শনের বদৌলতে ক্ষীণবীজ হওয়ার মত ক্ষণ সম্পত্তি আমরা পরিপূর্ণতাসহ শীল, সমাধি প্রজ্ঞায় বিমন্ডিত হওয়ার মত শারীরিক সুস্থতা ও বর্তমান সময়ে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের যাবতীয় Component সমূহ পৃথিবীর মধ্যে অদ্যাবধি বিদ্যামান রয়েছে।
৪। সৌভাগ্যবশতঃ শাসন-সদ্ধর্ম সুস্থিত রয়েছে এ পৃথিবীতে। অর্থাৎ এখনো শাসন-সদ্ধর্মে শূন্যকল্প শুরু হয় নি।
করুণাঘন বুদ্ধকে চাক্ষুষ দেখা আমাদের দ্বারা সম্ভব না হরেও সৌভাগ্যবশতঃ যেহেতু আমরা পরিপূর্ণ সুস্থ সবল সদ্ধর্ম সচেতন মনুষ্য জন্ম লাভ করেছি, যেহেতু বুদ্ধের দুর্লভ শাসন ও সদ্ধর্ম অধ্যাবধি এ বিশ্বে দেদীপ্যমান সেহেতু কর্ম ও কর্মফলের প্রতি Ut-Most বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা রেখে ভব বন্ধন ছিন্ন করার জন্য সদাসর্বদা সচেষ্ট থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয় কি?
ব্যূহচক্র আলোকে মানুষের কালজয়ী আবেদন কি হওয়া উচিত?
ব্যূহচক্র বা কর্মচক্র বা সংসারচক্র বা ভবচক্রের আলোকে মানুষের কালজয়ী আবেদন হওয়া উচিত সংসারচক্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন। যে সংসার চক্রের মধ্যে আমরা আবর্তিত ও বিবর্তিত অবস্থায় রয়েছি- তার স্বরূপ উদ্ঘাটন পূর্বক একত্রিশ লোক ভূমির উর্ধ্বে উঠা চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরই কাজ।
করুণাঘন বুদ্ধের দৃষ্টিতে ‘দ্বিপদানঞ্চ চক্খুমা’ অর্থাৎ এ জীব জগতে যত প্রাণী আছে তন্মধ্যে দ্বিপদধারী যাঁরা তাদের মধ্যে থেকে একমাত্র মানুষই চক্ষুষ্মান হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারেন। করুণাঘন বুদ্ধের উচ্চারণঃ
“মাগ্গাট্ঠঙ্গিকো সেট্ঠো সচ্চানং চতুরো পদা।
বিরাগো সেট্ঠো ধম্মানং দ্বিপদানঞ্চ চক্খুমা।”
সকল মার্গের মধ্যে বা পথের মধ্যে অষ্টাঙ্গিক মার্গই শ্রেষ্ঠ। মার্গ বা পথ সত্য সমূহের মধ্যে মধ্যে চতুরার্য সত্যই শ্রেষ্ঠ সত্য। ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যই শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
আর দ্বিপদারী মানুষের মধ্যে একমাত্র চক্ষুষ্মান ব্যক্তিরাই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত ও অধিষ্ঠত হন। চক্ষুস্মান ব্যক্তিরাই ভব বন্ধন ছিন্ন করার ক্ষমতা অর্জন করেন এবং এ মনুষ্য লোকেই তা সম্ভব।
কারণ, একমাত্র মনুষ্য লোকেই সুর্খ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, যশ-অযশ ও নিন্দা-প্রশংসা তথা অষ্টলোকধর্মের কাঙ্কিত-অনাকাঙ্কিত পরিণতি রয়েছে পরিপূর্ণভাবে। ব্রক্ষলোকে, মনুষ্যলোকে ও স্বর্গলোক অষ্টলোক ধর্মের কাঙ্কিত-অনাকাঙ্কিত পরিণতি নির্ভর নয়।
আর তির্যক, প্রেত, অসুর ও নিরয় লোকও তাই। একমাত্র মুনুষ্যলোকেই অর্থাৎ মনুষ্য জন্মই পারে অষ্টলোকধর্মের উর্ধ্বে উঠে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞায় বিমন্ডিত হয়ে সংসার চক্রের ভব বন্ধন ছিন্ন করার মতো অপ্রমেয় শক্তি অর্জন করতে।
তাই এক কথায় বলা হয়েছে- “দুল্লভঞ্চ মনুস্সত্তং।” অর্থাৎ মনুষ্য জন্ম দর্লভ, যা সহজে লাভ করা যায় না। করুণাঘন বুদ্ধের কালজয়ী উচ্চরণঃ-
“পঞ্চছিন্দে পঞ্চজহে পঞ্চ চুত্তরি ভাবয়ে।
পঞ্চ সঙ্গাতিগো ভিক্খু ওঘতিন্ন্’তি বুচ্চতি”
অনুবাদঃ
“পাঁচটি ছেদন কর, পাঁচটি পরিত্যাগ কর, আর পাঁচটির ভাবনা কর”।
-যে ভিক্ষু পাঁচের বন্ধন কাটিয়েছেন তাঁকে বলা হয় ওঘোতীর্ণ।” এখানে “ওঘো” শব্দের অর্থ হল-সংসার চক্র বা কর্ম চক্র বা ভব চক্র। কর্মচক্রের ভব বন্ধনে সঞ্চারমান জীবের অনিবার্য পরিণতিকে বলা যেতে পারে ওঘো বা সংসার সমুদ্র।
এ ওঘো থেকে মুক্তির জন্য করুণাঘন বুদ্ধ ইহলোকের পঞ্চ বন্ধন:- সৎকায়দৃষ্টি, বিচিকিৎসা, শীলব্রত পরামর্শ, কামরাগ ও প্রতিঘ ছেদন করতে বলেছেন।
পরলোকের পঞ্চবন্ধন” –রূপরাগ, অরূপরাগ, মান ঔদ্ধত্য ও অবিদ্যা পরিত্যাগ পূর্বক পঞ্চ গুণে গুণান্বিত হতে বিধান দিয়েছেন। এ পঞ্চগুণ হল-শ্রদ্ধা, স্মৃতি, বীর্য, সমাধি ও পজ্ঞা।
এ পঞ্চগুণের জীবনঘনিষ্ট ও বাস্তবসম্মত ভাবনার মধ্যে দিয়ে পঞ্চদোষ এর বন্ধন কাটাতে বলেছেন। পঞ্চদোষদুষ্ট মানুষ সদাসর্বদা সংসার সমুদ্রে বা সংসারাবর্তে হাবুডুবু খেতে খেতে ব্যূহচক্রে ঘরতেই থাকে। ঘুরতেই থাকে অনাদি অনন্তকাল।
জন্ম জন্মান্তর কাল। তারা কখনো “ওঘোতীর্ণ” হতে পারে না। এখানে ‘ওঘো’ বা সংসার সমুদ্রের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হচ্ছে-কাম, ভব, দৃষ্টি ও অবিদ্যা এই চার মনোবৃত্তি। ‘কাম’ মানে কামনা, ইন্দ্রিয়-সুখাভিলাষ, তৃষ্ণা, বিষয়ানুরাগ প্রভৃতি।
‘কাম’ আবার দুই ভাগে ভিবক্তঃ বস্তুকাম ও ক্লেশকাম। রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ প্রভৃতি বস্তুকাম আর রাগ-দ্বেষাদি রিপুনিচয় হল ক্লেশকাম। ‘ভব’ শব্দের অর্থ হল-কর্ম: উৎপত্তি ভব, জীবনের অস্তিত্ব।
কামভব, রূপভব ও অরূপভব। ‘দৃষ্টি’ মানে হল মিথ্যাদৃষ্টি। আর অবিদ্যার অপর নাম তো অজ্ঞানতা বা ওমহড়ৎধহপব।
এক্ষণে আনন্দ বিহারের পবিত্র প্রাঙ্গণে পূত পবিত্র মাঘী পূর্ণিমার এ স্মরণীয় ও বরনীয় তিথিতে চক্রব্যূহ মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন কালজয়ী আবেদনে বিমন্ডিত হতে পারে-যদি এ মহতি উদ্যোগ রাঙ্গামাটির তাবৎ বৌদ্ধদের মনোমন্দিরে ‘ওঘোতীর্ণ হওয়াে সুতীব্র বাসনা জাগাতে সক্ষম হয়।
বহু ঐতিহ্যমন্ডিত আনন্দ বিহারের এ ব্যূহচক্র মেলা ও রাঙ্গামাটি বৌদ্ধ সমাজঃ
করুণাঘন বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন আচার সর্বস্ব নয়। অনেকটা মন-মনন ও অনুশীলন নির্ভর ধর্ম-দর্শন। এ ধর্ম-দর্শনের মধ্যে বারো মাসে তেরো পার্বণের ঘনঘটা নেই।
ধর্মীয় বিধি নিষেধ যতনা কড়াকড়ি ভাবে ভিক্ষু-শ্রামণেরদের জন্য রয়েছে, সাধারণ দায়ক দায়িকাদের জন্য পঞ্চ শীল পালনের নির্দেশনা ছাড়া তেমন ধরা-বাঁধা বিধি নিষেধ জল অচলভাবে নেই।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় ও শুক্রবারে মসজিদে বাধ্যতামূলকভাবে উপস্থিত থেকে ধর্মীয় বয়ান শ্রবণ অপরিহার্য। কিন্তু বৌদ্ধদের মধ্যে ধর্মীয় ক্ষেত্রে সেরূপ সামাজিক জল অচল বিধি বিধান নেই।
এতদকারণে, কোন কোন বৌদ্ধ দায়ক দায়িকার মুখে কোন কোন সময় শোনা যায়- মন্দিরে গিয়ে কি লাভ? আমার নিজের ঘরে বসেই তো আমি পঞ্চশীলে অধিষ্ঠিত হতে পারি।
এর প্রতি উত্তরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষে এটুকু বলার অবকাশ রাখি যে, পার্শ্ববতীর্ স্কুলটিতে আমাদের ভবিষ্যত সন্তান সন্ততি বা প্রজন্মকে সাধারণ ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষাদীক্ষার জন্য যেরূপ সতর্ক ও সচেতন দৃষ্টি আমরা পোষণ করে থাকি এ জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নৈতিকতা শিক্ষার যে অপরিহার্য পীঠস্থান সেই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে ও সমভাবে গুত্বারোপে পূর্বক মনুষ্যত্ববোধ উৎসর্জনের প্রাণ কেদ্রের মর্যাদা দিতে হবে।
কারণ, সাধারণ শিক্ষাদীক্ষার মধ্য দিয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধ ভাস্বর প্রজন্মই দেশে-বিদেশে তথা গোটা বিশ্বে দায়বদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালন এবং নিয়ম নিষ্ঠার অনুষঙ্গে সকলের বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দিতে পারে।
রাাঙ্গমাটিস্থ আনন্দ বিহার এবং আনন্দ বিহারকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর মহাসড়াম্বরে আয়োজিত ব্যূহচক্রমেলা প্রজন্মের কাছে কতটুকু নৈতিকতাবোধ উৎসর্জনের বাতাবরণ তৈরী করে দিতে পারছে- তা সময়ই বলে দেবে।
তবে শ্রদ্ধাবান ও শ্রদ্ধবতী দায়ক দায়িকদের সমীপে এ বিষয়টি হৃদয় দিয়ে বিঘোষিত করার অবকাশ রাখি যে,
ক) শিশুরা অনুকরণ প্রিয়।
খ) স্বগৃহ হল শিশুদের প্রথম পাঠশালা।
গ) পিতা-মাতা সন্তান সন্ততির শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
ঘ) প্রজন্মের জন্য নৈতিক শিক্ষা সাধারণ বিদ্যা শিক্ষার চাইতে বেশী জরুরী।
ঙ) আপনি আচার ধর্ম পরকে শিখাও।
চ) আত্মকেন্দ্রিক বা অহংসর্বস্ব মানসিকতা সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।
ছ) অহংকার নিজের পতন ডেকে আনে।
জ) পরচর্চা নয় আত্মচর্চাই আত্মোন্নতির চাবিকাঠি।
অতএব, ঘরে বসে পঞ্চশীল অধিষ্ঠিত থেকে নিখুঁতভাবে শীল প্রতি-পালন সর্বতোভাবে সম্ভা হলেও সন্তান সন্ততির হাত ধরে যথাকলে যথসময়ে পার্শ্ববর্তী মন্দিরে করুণাঘন বুদ্ধের পদমূলে বসে প্রণাম নিবেদন, পূজা নিবেদন,
ভিক্ষু-সংঘের অন্তরঙ্গ সান্নিধ্য এনে তাদের নৈতিক শিক্ষার অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মেচণ করে দেয়া একজন সচেতন, দূরদর্শী, দায়িত্ব সচেতন মাতাপিতারই কাজ।
তবে একজন পিতা যদি সারাদিন সুরা সমু্দ্দরে ডুবে থাকেন, সন্তান-সন্ততির সম্মুখে পিতা-মাতা যদি হরহামেশা কলহবিবাদ, মারামারি ও পরস্পর গালি গালাজ লিপ্ত থাকেন,
আত্মচর্চার পরিবর্তে পরচর্চা, পর ছিদ্রাণ্বেষণ বা পরের দোষত্র“টি অন্বেষণে যদি তারা কালক্ষেপণ করেন তাহলে তাঁরা কিভাবে, কোন আশায়, কোন দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের বদৌলতে একজন পিতৃ-মাতৃভক্ত,
ধর্মীয়ভাবে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান আলোকিত পুণ্যপুত সন্তান সন্ততি কামনা করেন? একজন দায়িত্ব সচেতন ও সদ্ধর্ম সচেতন ব্যক্তি তাঁর পুত্র-কন্যা অথবা পৌত্র, প্রপৌত্রদেরকে নিয়ে,
ধর্মীয়, সামাজিক, লোকায়ত, অনুষ্ঠানসমূহে উপস্থিত থেকে ধর্মীয় ও লোকাচাসম্মত অতি আবশ্যিক দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ যদি সুসম্পাদন না করেন তাহলে তাঁর পক্ষে ভদ্র, শিষ্ঠ, নিয়মনিষ্ঠ, কর্তব্যনিষ্ঠ, সদ্ধর্মনিষ্ঠ সুসন্তান, পৌত্র, অপৌত্র, আশা করাটা দূরাশা নয় কি?
নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ এক কথায় মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ জাগ্রত করে দেয়ার মত কোন পীঠস্থান রাঙ্গামাটিতে আছে কি?
যেখানে যথাকালে তথা রীতিমত ধর্ম শ্রবণ ও ধর্ম পর্যালোচনা করার ব্যবস্থা নেই- সেখানে ধর্মীয় ও মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ আশা করা যায় কি? যেখানে মনুষ্যত্বের মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের অভাব সেখানে মুক্ত বুদ্ধি, মুক্ত চিন্তার অবকাশ আছে কি?
যেখানে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার চর্চা হয় না সেখানে সত্যের আলোকে অলোকজ্জ্বল কোন শাশ্বত সুন্দর যদি কিছু থেকে থাকে-তাহলে তা-হল ভববন্ধন থেকে মুক্তির অপ্রমেয় অদ্বিতীয় সত্য ‘ চতুর্মহাআর্যসত্য’।
এখানে আনন্দ বিহারের শুভ মাঘী পূর্ণীমার পবিত্র তিথিতে প্রতীকী ব্যূহচক্র মেলা উদ্যাপনের মধ্যে দিয়ে জন্ম-মৃত্যুর অনন্ত রহস্যে ঘেরা একত্রিশ লোকভূমি থেকে মুক্ত হয়ে একজন Enlightened one তথা আলোকিত মানুষরূপে অনন্ত ভববন্ধন ছিন্ন করার প্রয়াস চালানো হয়।
প্রজন্মের ভবিষ্যত উত্তরাধিকারী বিনির্মাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে আনন্দ বিহার পরিচালনা কমিটির গৃহিত প্রটিতি পদক্ষেপ শাশ্বত সত্যের আরাধনায় থাকুক বাগ্ময় ও উচ্চকিত । আসুক আমরা সকলে মিলে কবি সুকান্তের ভাষায় অঙ্গীকার করি-
চলে যাবো-তবু আজ যতক্ষণ
দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বে এ শিশুর বাসযোগ্য
করে যাবো আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার
দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ ছেড়ে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাবো আশীর্বাদ,
তারপর হবো ইতিহাস।
সব্বে সত্ত্বা সুখীতা হোন্তু।
সাধু! সাধু!! সাধু!!!
লেখকঃ শ্রীমৎ প্রজ্ঞানন্দ মহাথের, প্রধান অধ্যক্ষ, রাঙ্গামাটি আনন্দ বিহার, তবলছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জিলা। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৭৭ সালে বাংলা সাহিত্য বি.এ (অনার্স) সহ এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮০ সালে পালি সাহিত্যেও এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫২ সালে বর্তমান খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার বাবু ছড়া গ্রামে এক চাকমা পরিবারে তাঁর জন্ম।
১৯৬৫ সালে তৎকালীন বোয়ালখালি দশবল বৌদ্ধ রাজ বিহারের অধ্যক্ষ পার্বত্য চট্টল বৌদ্ধ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সদ্ধর্মাদিত্য উপসংঘরাজ জ্ঞানশ্রী মহাথেরোর নিকট শ্রামন্যধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯৬৮ সালে এস.এস.সি পাশের পর বৌদ্ধ পূর্ণিমাতে অষ্টমী তিথিতে একই গুরুর উপাধ্যায়াত্বে ২৬ জন প্রথিতযশা মহাথেরগণের উপস্থিতিতে উপসম্পাদা গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে মোনঘরের সাধারণ সম্পাদকের পদক লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে এম.এ পাশের পর তিনি আনন্দ বিহার, তবলছড়ি,রাঙ্গামাটিতে উপ-অধ্যক্ষ হিসেবে আগমণ করেন এবং উ-জবনাতিষ্য মহাথেরর মহাপ্রয়াণের পর আনন্দ বিহারের অধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত হন। ২০০৪ সালে ঢাকার মিরপুরে আদিবাসী গ্রিনহার্ট স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং অদ্যাবদি এ প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। তিনি একজন সু-বক্তা এবং বিশিষ্ট ধর্মীয় গুরু হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করছেন। পার্বত্য বৌদ্ধ সংঘ ও অত্তদীপ ফাউন্ডেশন-এর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।