‘বড় পরঙ’ একটি জ্বলন্ত ইতিহাসের প্রামাণ্য চিত্র তৈরী এই প্রজন্মের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব
1313
এক সময় ছিল ‘কর্ণফুলি পেপার মিল’ এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ কাগজ কল।
মনুষ্যসৃষ্ট কাপ্তাই বাঁধের কারণে যে জলাধার ফুলে উঠে (কাপ্তাই লেক), তাও সে সময় কালে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ হ্রদ বললে বেশী বলা হয় না।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে যে লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এবং তাদের এক বড় অংশ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল এমন ঘটনা সমগ্র বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই।
বিশ্ব পরিবেশ ধ্বংসের এই মূহুর্তে বাঁধের বিরোধীতায় পৃথিবীজুড়ে যে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, ও জন সচেতনতা গড়ে উঠেছে তা যদি পঞ্চাশের দশকের সেই দিনগুলোতে হতো তাহলে আইয়ুব খানের কোন ক্ষমতাই কাপ্তাই বাঁধ তৈরী করতে পারত না। এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত ।
শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘুমন্ত পাহাড়ী মানুষ নয় সারা দেশের (পাকিস্তানের/বাংলাদেশের বাঙালীরাও) মানুষ কাপ্তাই বাঁধ রুখে দিতোই।
এ মহাদেশের ১৯৬৪ সালে কাপ্তাই বাঁধে সর্বহারা হয়ে দেশান্তরিত বড় পরঙীদের নিয়ে একটা দুর্দান্ত প্রামান্য চিত্র নির্মাণ অতি গুরুত্বপূর্ণ। বড় পরঙীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা ইতিহাসের নিরিখে খুবই জরুরী।
ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এই হাতের লাগালের মধ্যে থাকা মর্মন্তুদ সত্য ঘটনা একদিন অজানাই রয়ে যাবে যদি না এখনিই এই ঐতিহাসিক বিষয়টা রেকর্ড করে রাখা না হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মরণ ফাঁদ কাপ্তাই বাঁধের কারণে দেশান্তরিত অরুনাচলে বড় পরঙী জ্ঞাতিদের খোঁজ খবর নেয়া আমাদের নৈতিক কর্তব্য।
শ্রদ্ধাভাজন পরিমল দা, আপনার পোস্টের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ । বড় পরঙের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আপনার আগ্রহ ও আন্তরিকতা আমাকে আরো অনুপ্রেরনা যোগাচ্ছে।
লিখতে চাইছি ১৯৬৪ সালের বড় পরঙ থেকে শুরু করে এযাবত কাল কে কে দেজহুল থেকে অরুনাচল গিয়েছেন বা তাদের নিয়ে ভেবেছেন, প্রবন্ধ, গান, কবিতা বা বই লিখেছেন।
সে সময় আসাম সরকারের সেক্রেটারী প্রয়াত উতঙ্গমনি চাকমা ওতোপ্রোত জড়িত ছিলেন । উনাকেই আসামের গর্ভণর, চীফ মিনিষ্টার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন নেফায় চাকমা ও হাজং উদ্ভাস্তুদের বসতির ব্যাপারে।
ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়েন প্রায়ত নেতা স্নেহ কুমার চাকমা, ইন্দ্রমনি চাকমা, ঘনশ্যাম দেওয়ান থেকে শুরু করে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়া বেশ কয়েকজন স্বনাম ধন্য ব্যক্তি।
বড় পরঙীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন ভারতীয় রেলে চাকরীরত গৌহাটির শ্রদ্ধেয় প্রাণনাথ চাকমা।
কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থদের নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করেছেন হরিকিশোর চাকমা (বর্তমানে এক দুর্ঘটনায় পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে নির্বাক জীবন কাটাচ্ছেন) সহ আরো কয়েকজন।
তিনি সক্ষম থাকলে হয়তো আজ বড় পরঙ নিয়ে আরো কিছু করতে উদ্যোগী হতেন। ‘জীবনালেখ্য’ নামে অন্য এক স্নেহ কুমার চাকমা (আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য) বড় পরঙের দিনগুলো নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা সবিস্তারে লিখেছেন।
১৯৬৭ এ আমার আপন দাদুর ছোট ভাই (বৃটিশ নৌবাহিনীর ডাক্তার) প্রমোদ তালুকদারের বড় ছেলে শাক্য প্রসাদ তালুকদার (এস পি তালুকদার নামে যিনি পরিচিত) বড় পরঙীদের দেখতে গিয়েছিলেন নেফায়।
আক্ষেপ করে বলেন, “ভারত সরকার চাকমাদের তৎকালীন নেফায় চাকমা হিসেবে বসতি দেয় নি, বরং চীন সীমান্তবর্তী প্রদেশ হওয়ার কারনে কৌশলগত দূরদর্শী লক্ষ্য নিয়ে রিহাব্লিটেড করেছে।
ঐ অঞ্চলকে ভারতের বগলের মধ্যে রাখতে এবং বুড্ডিস্ট হিসেবে স্থানীয় খামতি, সিম্পুইদের সাথে একাকার হয়ে ভারতীয় ভূখন্ডকে সম্ভাব্য শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে।
তাই অরুনাচলে চাকমাদের বিরুদ্ধে যতোই হাল্লাচিল্লা হোক না কেন ভারত সরকার সেই চাকমাদের ঠিকই রক্ষা করবে। ”
যাইহোক, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সুকুমার দেওয়ান (সুখু দা) দর্শনা থেকে কোলকাতা হয়ে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গিয়েছিলেন নেফায়।
নেফায় যেহেতু আমাদের আপন বড় মামা শিশির দেওয়ান, মাসী মিনাক্ষী মা আর এক মামা দেশান্তরিত হয়ে গিয়েছেন । তাদের খোঁজ খবর নিতেই সুখু দা র সে সময়ে নেফায় পদার্পণ । এরমধ্যে অনেকেই গেছেন নিশ্চয়।
শ্রদ্ধেয় বিমল ভান্তেও সম্ভবত ১৯৮০ দশকে প্রথম খোঁজ নিয়েছেন বড় পরঙীদের ।
১৯৯৪ সালে লোহিত জেলার চৌখামে এক বৌদ্ধ মন্দির উদ্ভোধনে দালাই লামার অনুষ্ঠানেও গিয়েছেন। পরবর্তীতে ডায়ুনে এস কে এসের শাখা প্রতিষ্ঠাও করেছেন।
অরুনাচল আমি প্রথম যাই ২০০২ সালে। তখনই আমার দেখা হয় আমাদের আপন স্বজনদের সাথে।
খামতি ও সিঙফুদের রাজা যথাক্রমে চৌখামুন গৌহাই ও পিসিলা সিঙফুর সাক্ষাৎকার, এমন কি ডিব্রুগড় গিয়ে উতঙ্গমণি চাকমার ও ইন্টার ভিউ নিই।
সেই সফরে আমি পরিচয় পাই স্বর্গীয় তারা চরন চাকমার আপন ছোট বোনের (কালাচোগী মা)।
পরে তারা চরন বাবু দিল্লীতে বেড়াতে গেলে তারই সেই ছোট বোনের মেয়ে নাগরীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
তখন আরো এক জনের দেখা পাই । তিনি পুলক জীবন খীসা (পুলক দা)-র আপন মাসী (উজ্জলা)। মিয়াও তে থাকতেন উনি।
যদ্দুর মনে পড়ে ধীমান (দীপক জ্যোতি দা বা পুলক দার ছোট ভাই) যখন ইন্ডিয়ান স্কলারশীপ নিয়ে পড়তে আসে তখন সেও অরুনাচলের এই মাসীর সাথে দেখা করে গেছে।
ইতিমধ্যে আমি নিজেই অনেককে বেড়াতে নিয়েছি অরুনাচল। আমার বড় ভাই ধীরাজ কুসুম, টুকু দা সহ শান্ত, অমীয়, আনন্দ, নন্দিতা কেরল, বিশ্বজিত, রচনা, রীনা, মীনা মা, আমেরিকি প্রবাসী রবি থেকে শুরু করে অনেক কে।
এর পর পর জানি প্রতীম রায় পাম্পু, শ্রদ্ধেয় প্রফেসর হিরোহিতো চাঙমা, অতীন (গপ্প্যে) দা ভুঝি সহ ঘুরে এসেছেন। শ্রদ্ধেয় নন্দপাল ভান্তে বহু বছর ধরে লাগাতার অরুনাচল যাতায়াত করছেন।
তার সুবাদে দেজহুল থেকে অনেক অনেক মানুষ গেছেন অরুনাচল। শ্রদ্ধাস্পদ প্রকৃতি বাবুও গেছেন। গেছেন অনেকেই। যাচ্ছেনই এখন।
বড় পরঙীদের নিয়ে সুন্দর কবিতা লিখেছেন কৃঞ্চ দা, গান করেছেন স্বনামধন্য রঞ্জিত দেওয়ান।
সম্প্রতি বড় পরঙ নিয়ে বই লিখেছে সমারী চাকমা। তার বইটিও সাড়া জাগিয়েছে। তবে তার বইয়ে যে ‘ডুবুরী’
শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা একেবারেই ঠিক হয়নি। ডুবুরী রা জলে ডোবে, মরে না।
আর বড় পরঙীরা কাপ্তাই বাঁধের জলেও ডুবে নি। এরা উদ্ভাস্তু হয়ে দেশান্তরিত হয়েছে ।
অরুনাচল যাচ্ছিলেন ২০১৪ সালে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়। পরে যাওয়া হয়নি। বড় পরঙীদের সাথে দেখা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব মনে করি।
আমাদের মুরুব্বীদের অতিশয় কর্তব্য। বড় পরঙীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা ইতিহাসের নিরিখে খুবই জরুরী। অরুনাচলের বড় পরঙী জ্ঞাতিদের সাথে যারা এখনো দেখা করতে বা সম্পর্ক খুঁজতে অবহেলা করছেন তাদের কাছে অনুরোধ আর কালক্ষেপন নয়।
একটি মূহুর্তও আর আপনাকে অপেক্ষায় নেই। আপনি কি বিচ্ছিন্ন হতে চান? নাকি ছিঁড়ে যাওয়া বাধঁন জোড়া দিতে চান?
বড় পরঙ নিয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করার বিষয়ে অনেকেই মতামত দিচ্ছেন। ডাঃ পরশ খীসা থেকে শুরু করে বন্ধুবর রবিধন।
হ্যাঁ নিশ্চয়ই জরুরী। আর বেশী দিন নেই বড় পরঙীরা । গত ৫৫ বছরে শতকরা ৮০/৯০ জন মারা গেছেন। যে ক’জন বেঁচে আছেন তারাও আগামী ১০ টা বছর আর থাকবেন এই পৃথিবীর বুকে।
অরুনাচলে বড় পরঙের প্রত্যক্ষ কাহিনী সরাসরি কারো মূখ থেকে শোনার মতো এক জনকেও পাবো না। তখন বিলাপ করে লাভ হবে না ।
লেখকঃ প্রধীর তালুকদার
তথ্যসূত্রঃ প্রধীর তালুকদারের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।