বড় পরঙ: স্নেহ কুমার চাকমার শরনার্থী জীবনের স্মৃতিচারণ

Jumjournal
Last updated Jul 15th, 2020

2683

featured image

মে মাস ১৯৬৪ সন। আনুমানিক রাত্রি ৮টা। চারটি পরিবার। মগবান (রূপকারী) গ্রামের খেয়া ঘাট পার হয়ে আগুনের মশাল জ্বালিয়ে নিলাম। রাস্তায় উঠে দক্ষিণ দিকে রওনা হলাম।

সারা রাত্রি হেঁটে খুব ভোরে গহীন রিজার্ভে ঢুকে পড়ি। রিজার্ভের ভিতর হাঁটছি। মাঝে মাঝে বানরের ঝাঁক এবং ধনেশ্বর পাখি দেখা যায়।

নানা পাখির কলকাকলি এবং বানরের শব্দে আমরা যে জনমানবহীন জায়গা দিয়ে চলেছি তা জানান দিয়ে যায়। আমার জীবনে এই প্রথম রিজার্ভে পদচারণা। হিংস্র জীব-জানোয়ারের শঙ্কা নিয়েই চলেছি।

অনেক ছড়া, ঝিরি অতিক্রম করে অবশেষে একটি বড় ছড়ায় পৌঁছালাম। ছড়ার পানি স্বচ্ছ। পানি পান করে ছড়ার নিম্ন ভাগে হাঁটতে লাগলাম।

ছড়াতে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা জাতের মাছ। লতা-গুল্ম, নানা প্রকারের গাছ ঘন বাঁশঝারের কারণে সূর্যকিরণ কদাচিৎ মাটিতে পৌঁছে। ছড়ার নাম গবছড়ি।

অবশেষে ছড়ার পাড়ে রান্নার ব্যবস্থা হল। ভাত খাওয়া হল, তারপর আরও হাঁটা শুরু হল। বেলাশেষে বড় হরিণায় পৌঁছালাম। এখানে রাত্রি যাপন করি।

খুব ভোরে মেয়েরা রান্না-বান্নার কাজ সম্পন্ন করেন। তারপর সকালে খাওয়ার পর হরিণার মেঠো পথ ধরে দক্ষিণ দিকে রওনা হই। একসময় হরিণা পার হয়ে লুসাই হিলে ঢুকে পড়ি।

ভর দুপুরে একটি চাকমা পাড়ায় পৌঁছালাম। এখানে আম-কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসলাম। পানি চেয়ে পানি পান করি। তারপর দাদু শিক্ষামনি চাকমা এবং অন্যেরা বাঁশ-দাবা (এক প্রকার বাঁশের তৈরি হুকো) টানলেন।

এখানে একটি বিবাহ অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠানে ভাত খেতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Administrative Officer) সাহেব বিবাহ অনুষ্ঠানে আসবেন বিধায় আমাদেরকে দেখতে পেলে অসুবিধা হওয়ার আশঙ্কা থাকায় আমাদের এ স্থান ত্যাগ করতে হল।

মাথার উপর খাঁ খাঁ রৌদ্র। খুব জোরে হাঁটতে লাগলাম। একটি ছড়ায় পৌঁছালাম। জায়গাটি জনমানবহীন। এখানে থামলাম এবং রান্নার আয়োজন করা হয়। ছড়ায় স্নান করি। কাপড়-চোপড় কাচলাম। ভাত খেলাম।

সামনে একটি উঁচু পর্বত দেখা যায়। পর্বতটি উঠতে হবে। এ সময়টুকুতে পর্বতটি উঠা সম্ভব নয়। তাই পর্বতের পাদ-প্রান্তে রাত্রি যাপন করি। সকালে ভাত পাকানো হল। ভাত খেলাম।

সবাই ভাতের মোচা (কলা পাতায় জি ভাতের টোঙা) ও পানির চোঙা নিলাম। তারপর পর্বতটি উঠতে লাগলাম।

সকলের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মাঝে মাঝে জিরিয়েও নিই। সুর্যদেব মাথার উপরে উঠে এসেছে। তবেই পর্বতটি উঠা শেষ হয়। পর্বতটির চূড়ায় যেই উঠলাম সর্বাঙ্গ শরীরে বাতাসের হিল্লোল বয়ে যেতে লাগল। যেন নব জীবন ফিরে পেলাম।

চূড়া থেকে তাকালে চতুর্দিক প্রকৃতির এক অপরূপ শোভা ধরা পড়ে যা বর্ণনা করেও অপরকে নিজের মত করে উপলব্ধি করানো যায় না। পানি পান করলাম। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম।

পর্বতটির নাম পুংখাই। এখানে একটি বি.এস.এফ ক্যাম্প এবং বসতি রয়েছে। বসতির পথ ধরে সোজা দক্ষিণে হাঁটা শুরু করি। সঙ্গে নিয়ে আসা ভাত খাওয়া হল।

বসতির লোকের নিকট জানতে পারি এখান থেকে ডেমাগিরি অনেক দূরে। ডেমাগিরি হচ্ছে আমাদের গন্তব্য স্থান। জোরে হাঁটতে হচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

দুর থেকে আলোকচ্ছটা দেখা যায়। ঐ নাকি ডেমাগিরি! তাই পৌছে গেছি এই মনোবলে জোরে হাঁটতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। সত্যি সত্যি ডেমাগিরি পৌঁছে গেলাম।

ডেমাগিরি কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। ইহা লুংলেই জেলার সাবডিভিশন।

ডেমাগিরিতে অনেক চাকমা পরিবার বসবাস করেন। অনেকের দোকান রয়েছে। এখানে আমার এক মামা বীরেন্দ্র বিজয় চাকমার সাথে দেখা হল। তিনি রোড ডিভিশনে চাকুরি করেন।

ডেমাগিরি বাজারে প্রথম নলআম দেখলাম। নলআম রিজার্ভের এক ধরনের লতার ফল। মামা এটি কিনে আমাকে খাওয়ালেন।

পরের দিন সকালে অফিসের সহিত যোগাযোগ হল। শরণার্থীর তালিকাভক্ত হলাম। তারপর হাঁড়ি-পাতিল, বাসন, ল্যাম্প, কেরোসিন, সরিষার তৈল, সাবান, ডাল, ললিত আলু ইত্যাদি দেওয়া হল।

শরণার্থী ক্যাম্পে চলে গেলাম। এখানে চাউল দেওয়া হল। ডেমাগিরির কিছু দক্ষিণে পাহাড়ের পৃষ্ঠে, পাদ-প্রান্তে শরণার্থী ক্যাম্প করা হয়েছে।

শরণার্থীরা সবাই চাকমা। আমি বরাবরই দাদুর পরিবারে রয়েছি। শরণার্থী ক্যাম্পগুলি জায়গা অনুপাতে বসানো হয়েছে। ফলে কোন কোন ক্যাম্পে একটি বা দুইটি পরিবারই অবস্থান করতে পারে।

এখানে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর সংবাদ রেডিও থেকে শুনলাম। আমাদের ক্যাম্পের অনতিদূরে একটি ক্যাম্পে এক পরিবার আছে। এ ক্যাম্পের লাগোয়া একটি বিরাট গাছ রয়েছে।

পরিবারে এক গর্ভবতী মহিলা ছিলেন। এক সময় দিন দুপুরে বৃষ্টিসহ বাতাস বয়ে যায়। গর্ভবতী মহিলার উপর গাছটি ঝাঁপিয়ে পড়ে।

তখন ক্যাম্পে শুধু গর্ভবতী মহিলাই ছিলেন। থানা থেকে দারোগা পুলিশ আসে। বড় করাট দিয়ে গাছটি কেটে ঠেলে মৃতদেহটি বাহির করা হয়। এ বীভৎস করুণ দৃশ্য অনেকদিন পর্যন্ত চোখে ভেসে ছিল।

প্রায় দিন শরণার্থী আসতে থাকে এবং শুনা যায় আরও শরণার্থী আসছে। অফিস থেকে জানতে পারি এর মধ্যে ২৬ হাজার শরণার্থী জমা হয়েছে। শরণার্থী আসা অব্যাহত থাকার মধ্যেও শরণার্থী চালান দেওয়ার কাজ আরম্ভ হল।

এক হাজার থেকে দেড় হাজার জনসংখ্যা সম্বলিত শরণার্থী নিয়ে এক একটি ব্যাচ গঠন করা হলো। প্রতি ব্যাচে শিক্ষিত একজনকে ব্যাচ লিডার নিযুক্তি দিয়ে ব্যাচ লিডার করা হল। আমাকে ৯ নং ব্যাচের লিডার করা হল। আমার ব্যাচে সাড়ে এগার শত শরণার্থী ছিলেন।

ব্যাচ লিডারের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেক শরণার্থীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা রাখা, রেশনিং, স্বাস্থ্যগত বিষয়, চিকিৎসা, জন্ম-মৃত্যু, শৃঙ্খলা, অভিযোগ ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা।

জুনের শেষে শরণার্থী চালান দেওয়া হল। ২/৩ দিন অন্তর অন্তর শরণার্থী চালান দেওয়া অব্যাহত থাকল।

শরণার্থী ক্যাম্পগুলি পর্যাপ্ত পানির হিসাব রেখে ঝর্ণা বা ছড়ার কাছাকাছি করা হয়েছে। তাই এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পের দূরত্ব এক নয়।

সুতরাং ক্যাম্পে পৌঁছাতে হলে কোন সময় দুপুরে কোন সময় বেলা শেষে পৌছাতে পারা যায়। যেখানে শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছে সেখানে বি.এস.এফ ক্যাম্প রয়েছে।

কোন কোন সময় বৃষ্টির মধ্যেও হাঁটতে হয়েছে। অনেক শিশু বৃদ্ধ বৃদ্ধা পথিমধ্যে মারা গিয়েছে। আমাকে তাদের কবরস্থ করার তদারকি পিতা/ভাইকে দিয়ে করে যেতে হয়।

এ করুণ দৃশ্যের সহিত জীবনে আমার প্রথম পরিচয়। মৃতের আপনজনের কান্না, আর্ত-হাহাকার, আহাজারি আমাকেও ব্যথিত করে তোলে। আমাদের কাফেলার সহিত বি.এস.এফ থাকে। এক যুগল দম্পতি রয়েছে।

বেচারা প্রত্যেকদিন তার সুন্দরী স্ত্রীকে কাল্লোং-এ বয়ে নিয়ে যায়। আমার মনে হতো তাদের গভীর ভালবাসা, প্রেমের উপাখ্যানে লেখা লাইলী-মজনু, শিরিন-ফরহাদ এর ভালবাসার চেয়ে কম নয়।

এদের মত এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখী কোন প্রেমিক-প্রেমিকা হয়েছে কিনা আমার জানা নাই। তাদের নিকট জানতে পারি অসুখের কারণে নবপরিণীতার এ অবস্থা হয়েছে।

যে রাঙাচুলিকে বাঘাইছড়িতে মুসলমান যুবক কর্তৃক লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল সেই রাঙাচুলি চাকমা তার পিতা-মাতা, তার বড়ভাই গোবিন্দ অর্থাৎ পরিবারও আমার ব্যাচে রয়েছে।

রাঙাচুলি সত্যিই রূপসী। চেহারা সুন্দর এবং গায়ের রং ও অনেকটা পাকা টমেটোর মত। আমরা জানি না কোথায় যাবো। আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে। জানতেও চাইলাম না আমাদের গন্তব্য স্থান কোথায়।

বি.এস.এফ’রা আমাদেরকে অগ্রবর্তী ক্যাম্প পর্যন্ত স্কর্ট দিয়ে পৌঁছিয়ে দেয়। শরণার্থীর জন্য ১টি জীপ গাড়ি থাকে। রোগী, অসুস্থ, হাঁটতে অক্ষম বয়োবৃদ্ধদের জন্য জীপ গাড়িটি ব্যবহৃত হয়।

কোন কোন সময় ব্যাচ লিডারের জন্যও গাড়িটি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারণ অফিসিয়াল কাজ সারতে অনেক সময় ব্যাচ লিডারের দেরী হয়। ঐ সময় শরণার্থীর কাফেলা হয়তো অনেক আগে এগিয়ে গেছে। বি.এস.এফ এর নিকট ছোট সাহেব হিসেবে আমার পরিচয় ছিল।

শরণার্থী ক্যাম্পে মাঝে মাঝে ২/৩ দিন বিশ্রামের জন্য অবস্থান করানো হয়। তখন ডাক্তারের চিকিৎসা সেবা, ঔষধ প্রয়োজন মত পাওয়া যায়।

প্রাণভরে স্নান করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া যায়। বাবার নিকট শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশ সেনাবাহিনীর রসদ বহনের জন্য অনেক চাকমা ডেমাগিরি, লুংলেহ গিয়েছিলেন।

ঐ সময় বাবাও ডেমাগিরি গিয়েছিলেন। তখন তুত্রসিং চাকমা লুংলেহ ছিলেন এবং এক লুসাই মেয়ে বিবাহ করেন। পরে মায়ের চাপে তিনি স্ত্রীকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

তুত্রসিং সরকারি চাকুরি করতেন। লুংলেহ শহর পর্বতের পৃষ্ঠে মনোরম এবং স্বাস্থ্যকর স্থান। চতুর্দিকে দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি গিরিরাজ যেন মেঘের সহিত লুকোচুরি করছে।

শহরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। বাড়ি-ঘর বিল্ডিং পর্বতের পৃষ্ঠে, ঢালুতে ছবির ন্যায় মনে হয়। কোথাও সমতল ভূমি নাই। লুসাইরা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল।

তাই গভীর রিজার্ভ গড়ে উঠতে পারে নাই। লুসাই জেলার দেড় ও কাউ দুইটি ছড়ার উদ্দাম বেগে প্রবাহিত জলস্রোত মিলে চির যৌবনা কর্ণফুলীর উৎপত্তি। কিন্তু পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলীর বুকে বাঁধ দিয়ে কর্ণফুলীকে বন্ধ্যা করেছে। আমাদেরকে ভূমিহারা করেছে, বাস্তুহারা করেছে।

তাই আজ আমরা ভারতে শরণার্থী। শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি মাঠে আমাদেরকে বসান হল। অনেক স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী বিস্কুট ও বাঁশের চোঙাতে করে চা দিয়ে অভ্যর্থনা করল।

ততক্ষণে আমি একজন বি.এস,এফ সহ তাদের ক্যাম্পে যাই এবং ক্যাম্প কমান্ডারের নিকট আমার ব্যাচের রিপোর্ট প্রদান করি। আমরা সম্পূর্ণ বিএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণাধীনে। অতপর ব্যাচে ফিরে আসলাম।

ছাত্র-ছাত্রীরা বিস্কুট আর বাঁশের চোঙায় চা হাতে নিয়ে আমার অপেক্ষায় রয়েছে। ছাত্রীরা আমাকে ঘিরে ফেলে তাদের চা-বিস্কুট খেতে অনুরোধ করে। সকলে চায় নিজেরটি আগে খাওয়াতে।

এমতাবস্থায় আমি কারও চা-বিস্কুট নিতে চাইলাম না। পরিশেষে ঠিক হল সকলের পক্ষ থেকে চা এবং বিস্কুট খেতে। আমি তাই করলাম। মেয়েরা বাইলুম দিল।

বাইলুম একপ্রকার তামাক পাতা। লুসাইরা জুমে ইহার চাষ করে। এক প্রকার পাতলা কাগজ দিয়ে বাইলুম বানানো হয়। বাইলুম তাদের অত্যন্ত প্রিয়। আমি ধূমপান করি না বলা সত্ত্বেও অনেক বাইলুম দিয়ে গেল।

পুস্তক দিল। কয়েকজন ছাত্রী পুস্তকে তাদের ঠিকানা লিখে দিয়ে অনুরোধ করল যেন আমি তাদেরকে চিঠি লিখি। ছাত্রদের পক্ষ থেকেও চা বিস্কুট নিলাম। তার পর বি.এস.এফ’রা আমাদেরকে শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

পরের দিন অনেক ছাত্রী আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য শরণার্থী ক্যাম্পে আসে। বি.এস.এফরা দেখা করতে দিল না। তবে বি.এস.এফ এর মাধ্যমে আমার জন্য নিয়ে আসা বাইলুম, বাইলুম পাতা, বাইলুম বানানোর কাগজ ও ধর্মীয় পুস্তক দিয়ে যায়।

এখানে দুই দিন অবস্থান করি। আমাদের যাত্রা শুরু হল। চলতে চলতে এক সময় টুরিংগাং শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছালাম। ছড়াটি বেশ প্রশস্ত, স্রোতস্বিনী, পানি স্বচ্ছ, পরিষ্কার, শিলাখণ্ডে ভরা। টুরিংগাং নামটি আমাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করছিল।

যেহেতু টুরিংগাং নামটি লুসাই ভাষা নয়। আমরা খালকে গাং বলি। তাই টুরিং খালকে টুরিংগাং বলা প্রাসঙ্গিক।

সুতরাং এক সময় এখানে চাকমার বসবাস ছিল বলে আমি মনে করি। আমাদের পৌছার আগের ব্যাচের এক শরণার্থী মহিলাকে কয়েকজন লুসাই যুবক জীপে তুলে নিয়ে যায়।

প্রশাসন তৎপর হয়েও মহিলাকে উদ্ধার করতে পারে নাই। বরং চার/পাঁচ দিন পর দুবৃত্তরা জীপে করে নিয়ে এসে মহিলাকে শরণার্থী ক্যাম্পের কাছে রেখে চলে যায়।

টুরিংগাং শরণার্থী ক্যাম্পে তিন দিন অবস্থান করার পর আইজল শরণার্থী ক্যাম্পে চলে আসি। এ ক্যাম্পে আসার দ্বিতীয় দিনে দুপুরে গোবিন্দ চাকমা দৌড়ে আমার নিকট আসে এবং বলে যে, তিনজন লুসাই যুবক তার বোন রাঙাচুলিকে জোর করে ধরে নিতে চাচ্ছে।

আমি তাড়াতাড়ি ক্যাম্প কমান্ডারের নিকট গিয়ে রিপোর্ট করি। কমান্ডার সাহেব হুইসেল বাজান। তারপর বি,এস,এফ’রা শরনার্থী ক্যাম্পের সাম্ভাব্য সব রাস্তা ঘিরে ফেলে।

একজন লুসাই ধরা পড়ে। বাকীরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কমান্ডার সাহেব ধৃত যুবককে উত্তম মধ্যম দিয়ে থায়ি ওয়্যারলেস করেন। কিছুক্ষণ পর আইজল থানার ওসি পুলিশ ভ্যানে করে সদলবলে হাজির হন।

ওসি সাহেব চাকমা। নাম ললিত চন্দ্র চাকমা। তিনি লংগদু থানার তুলাবান নিবাসী ছিলেন। রাঙ্গামাটি সরকারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারতে চলে যান এবং পুলিশ বিভাগে চাকুরি নেন। ধৃত হওয়া এবং পালিয়ে যাওয়া যুবকদেরকে তিনি ভাল করে চিনেন এবং জানেন বললেন।

এ আইজল টাউনের সেরা গুণ্ডা-বদমায়েস। মাত্র দুই দিন হলো এরা কি কান্না ভোগ করে। জেল থেকে বাহির হয়েছে।

এ দিনই রাত্রি ১টার সময় বাকী দুই যুবককে হোটেল থেকে আটক করেন। দুই দিন পর আইজল কোর্টে বিচার হয়। কোর্টে বাঙালি গোবিন্দ ও তাদের বাবাকে ওসি গাড়িতে করে নিয়ে যান।

বিচারে যুবকদের ৮ বছর করে সাজা হয়েছিল। আইজল শরণার্থী শিবিরে সাত দিন অবস্থান করেছিলাম। আমাদের আইজল থেকে ট্রাকে করে আসামের ভাগা হাইস্কুলে নিয়ে আসা হয়।

হাইস্কুলের পার্শ্ব দিয়ে ভাগা নদী প্রবাহিত। বৃষ্টির পানিতে নদীর কূল ছাপিয়ে গেছে। স্কুল বন্ধ। স্কুলের কিছু দূরে মুসলমান বস্তি। বস্তিতে আমাদের কাকেও যেতে দেওয়া হয় না।

বস্তির কোন লোকও এখানে আসতে পারে না। একদিন আমি দুইজন সঙ্গী নিয়ে চুপিসারে মুসলমান বস্তিতে যাই। আমাদেরকে দেখে মুসলমানেরা আলাপ করতে আগ্রহী হল।

আমাদেরকে উঠানে বসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। পাকা কাঁঠাল খাবো কিনা জিজ্ঞাসা করে একটি পাকা কাঁঠাল এনে দিল। আমরা খেলাম। আমরা জাতিতে কোন জাতি জানতে চাইল।

আমাদের নিকট পাকিস্তানী টাকা আছে কিনা থাকলে তারা নিতে চাইল। কিছুক্ষণ পর আমরা ফিরে আসলাম। এখানে পাঁচ দিন কাটালাম।

এখান থেকে দুপুরের দিকে ট্রাকে করে আমাদেরকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। পূর্ব থেকে আমাদের জন্য রান্না করে রাখা ভাত-ডাল-সবজি দিয়ে সন্ধ্যায় খাওয়ানো হল।

প্লাটফরমে একটি ট্রেন রয়েছে। ট্রেনে তোলা হল। ট্রেন চলতে থাকল। সারারাত্রি ট্রেন চলার পর সকালে লামডিং রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলাম।

ট্রেন থামল। কোন শরণার্থীকে নামতে দিল না। আমি কয়েকজন বি.এস.এফ’এর সঙ্গে নামলাম। প্লাটফরমে তাদের সহিত চা-নাস্তা করলাম। এখান থেকে তিনসুকিয়া পৌছালাম। বড় রেল স্টেশন, বড় টাউন।

অনেক পর্বতের সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে আমাদের রেল চলছিল। যখন সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে রেল চলতে থাকে তখন বাতাসের চলাচলের স্বাভাবিকতা হারিয়ে যায়, বিদঘুটে অন্ধকার অনুভূত হয়। অনেক সুড়ঙ্গ অতিক্রম করেছি।

শরণার্থীদের মধ্যে কেউ বলে পনেরটি, কেউ বলে সতেরটি, কেউ আরও অধিক সুড়ঙ্গ পার হয়েছি বলে মন্তব্য করল। তবে কয়েকটি সুড়ঙ্গের পথ দীর্ঘ রয়েছে বৈকি।

টেন ১ ঘণ্টা থেমে আবার চললো। তিনসুকিয়া, ডিগবয় অতিক্রম করে অবশেষে দুই রাত্রি একদিন থাকার পর সকাল ৮টায় লেডু রেল স্টেশনে পৌঁছালাম।

ডিগবয় কেরোসিন খনির জন্য প্রসিদ্ধ। লেডু হচ্ছে আমাদের সর্বশেষ রেলওয়ে স্টেশন। লেডু হয়ে একটি বড় সড়ক বার্মা রোড নামে পূর্ব দিকে চলে গেছে। বৃটিশ শাসনের সময় এ রোড হয়ে বার্মায় আসা যাওয়া হতো।

লেডুতে আমাদেরকে অভ্যর্থনা করা হল। অভ্যর্থনাকারীরা আমাদেরকে শরণার্থী শিবিরে নিয়ে আসলো। ১৫/২০ মিনিট হাঁটার পর শিবিরে পৌঁছলাম। এ শিবির হচ্ছে আমাদের শেষ শরণার্থী শিবির।

সামান্য উচু এবং প্রসারিত সমতল ভূমিতে শিবিরগুলি তোলা হয়েছে আমাদের আনার পূর্বে। একটি শরণার্থী গ্রুপ ব্যাচ নং ৮ এখানে আনা হয়েছে।

 এ ব্যাচের ব্যাচ লিডার সুমতি রঞ্জন তালুকদার। আমরা এ শিবিরে আগস্ট মাসে পৌছি। শিবিরের প্রশাসন এখন সিভিল প্রশাসনের নিকট ন্যস্ত হয়েছে। শিবিরে পুলিশ পোস্ট, ডাক্তার খানা, রেশনের ডিলার রয়েছে।

শরণার্থীদেরকে রেশন ব্যতিরেকে হাত খরচের জন্য পরিবারে সিঙ্গেল বা দুজন সদস্য হলে ২৮/- (রুপি), পরিবারে তিন সদস্য থেকে সংখ্যানুপাতে পরিবার পিছ মাসিক টাকা দেওয়া শুরু হলো।

আমি মাসিক ২৮/- রুপি পাই। দাদুর পরিবারে আমার খাওয়া দাওয়া হলেও শরণার্থী কার্ডটি সিঙ্গেল করি। যে সমস্ত পরিবার বড়, কপর্দকহীন তাদের কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়।

শিবিরে শরণার্থীদের ঘোরাফেরা করার আর কোন বাধা নেই। ফলে অনেক শরণার্থী দূরে গিয়ে কাঁচা তরিতরকারি সংগ্রহ করতে পারে। শিবিরে তরিতরকারির অভাব প্রচুর।

লেডু রেলওয়ে স্টেশনে হাট-বাজার, দোকানপাত রয়েছে। লেডুর বিস্তৃত এলাকা ব্যাপী পাহাড়। তবে পাহাড়গুলি উঁচু নয়। পাহাড়গুলি কয়লার খনিতে ভর্তি।

সন্ধ্যাকালীন সময় থেকে প্রভাত পর্যন্ত নীলাভ ইলেক্ট্রিক বাতিতে পাহাড়গুলি আলোকিত থাকে।

নেপালি বংশোদ্ভুত এক ভারতীয়ের জায়গায় শরণার্থী শিবিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি ধনী ও প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।

তার ছেলে সরোজ কান্তি প্রধান প্রায় সময় শরণার্থী শিবিরে আসে। তার সহিত বন্ধুত্ব হয়। সে কলকাতায় ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছে এবং বাংলাও শিখেছে।

তার সহিত লেডুর কয়লাখনির বস্তি এলাকায় অনেকবার গিয়েছি। কয়লাখনি দেখেছি। এখানে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর অনেক হিন্দু পরিবার বস্তিতে বসবাস করে। তাদের ঘরে উঠি। আলাপ আলোচনা করি।

নেপালিদের বস্তিও রয়েছে। এখানে সরোজ কান্তি প্রধান মদ্য পান করার জন্য প্রায়দিন আসে। আমি কোন কোন সময় তার সঙ্গী হই। তখন আমার জন্য একটি ডিম মামলেট থাকতো। একবার সে আমাকে হিন্দু বিবাহ অনুষ্ঠানেও নিয়ে যায়।

সে আমাকে জানায় ডিগবয় এবং ডিব্ৰুগড়-এ বুদ্ধিস্ট টেম্পল আছে। বুদ্ধিস্ট টেম্পলগুলির ঠিকানা ও কিভাবে যাওয়া যায় ধারণা দেয়।

তিনসুকিয়া রেলওয়ে অফিসে একজন চাকমা চাকুরি করে তাও তার নিকট জানতে পারি। তার সহিত লেডুর পূর্বে বার্মা রোড হয়ে গাড়িতে করে কালা পানি, লেখা পানি (জায়গা) যাই।

কয়লাখনিতে গিয়ে খনির শ্রমিকদের কাজের ধরন চেয়ে থাকি। কেউ খনির গহ্বরে গিয়ে, কেউ খনির বাইরে কাজ করে।

গহ্বরে গিয়ে যারা কাজ করে তাদের মাথায় হেলমেট, কপালে বা হাঁটুতে ইলেক্ট্রিক ভাল্ব, কোমরে সুইচ বক্স, হাতে শাবল নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে গহ্বরে ঢুকে পড়ে।

বাহির থেকে বৈদ্যুতিক পাখার সাহায্যে পাম্প করে গহ্বরে বাতাস প্রবেশ করানো হয়। তাদের মজুরিও অনেক। খনির বাইরে যারা কাজ করে তারা কয়লা ভূপাকারে বাহিরে রাখে, কয়লা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো, কয়লা রেলে তুলে দেওয়া ইত্যাদি।

এদের মজুরি খনির গহ্বরে যারা কাজ করে তাদের চেয়ে অনেক কম। এক সময় আমি দৈনিক মজুরি ৫০রুপি হারে খনির গহ্বরে কাজ করার জন্য অফিসের ম্যানেজারের সহিত ঠিক করি। শিবিরে এসে দাদুকে বলি।

দাদু শিশির কুমার দেওয়ানকে জানান। আমি তাকে কাকী সম্বোধন করি। তিনি খনির কাজ যে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা হওয়ার সম্ভাবনা, মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমাকে কাজ না করতে বুঝান।

আমি তার পরামর্শ গ্রহণ করি। তার ইচ্ছা তার মেয়ের সহিত আমার বিবাহ দেওয়া। যে কোন সময় তিনি এ শুভ কাজটি সম্পন্ন করতে চান। তিনি আমার বংশ পরিচয় ভালো করে জানেন।

দাদুরও ইচ্ছা আমি তার মেয়েকে বিবাহ করি। মনে মনে ভাবি, যে জন্য বাড়ি ত্যাগ করেছি সেই একই কারণ আমাকে তাড়া করছে। প্রায় সময় মার্গেরিটা টাউন ঘুরতে যাই।

মার্গেরিটা, লেডু লক্ষীপুর জেলার অন্তর্গত। মার্গেরিটা টাউনে জেলা প্রশাসকের অফিস রয়েছে। লেডু থেকে ট্রেনে করে আসা-যাওয়া খুবই সহজ ও চমৎকার।

এ সময় আমি অসমিয়া ভাষা রপ্ত করি। তাই ঘোরা ফেরা করতে আমার কোন অসুবিধা হয় না। একদিন আমি জেলা প্রশাসকের সহিত তার অফিসে দেখা করি।

তাকে আমার পরিচয় দিয়ে আমাদের দুর্দশার কথা বলি। তাকে দাদা বলে সম্বোধন করলাম। সাবলীলভাবে অসমিয়া ভাষায় কথা বলায় তিনি

আমাকে উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করলেন। কোন সময় প্রয়োজন হলে তিনি সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দিলেন।

এক সময় তিনসুকিয়া অফিসে চাকমা বাবুর খোঁজ করতে গিয়ে চাকমা বাবুর বাসার খোঁজ পেলাম। বাসায় গেলাম এবং আমার পরিচয় দিলাম। শরণার্থীদের কথা শুনালাম। তিনি প্রাণনাথ চাকমা।

রেলওয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে চাকুরি করেন। দেশ-বিভাগের সময় ভারতে চলে গিয়েছেন। তিনি সপরিবারে এখানে থাকেন। এখানে এক রাত্রি কাটাই। সেপ্টেম্বর মাস। আরও শরণার্থী ব্যাচ এসে পড়েছে।

হাজার হাজার শরণার্থী। তীব্র গরম, পেটের অসুখ (ডায়েরিয়া), জ্বর লেগেই আছে। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি অপ্রতুল। শরণার্থীর সংখ্যানুপাতে শরণার্থী শিবিরগুলি কম হওয়ায় ঘেঁষাঘেষি করে থাকতে হয়।

অবশ্য পরে প্রয়োজনীয়তার কারণে শরণার্থীরা স্ব-উদ্যোগে শিবির তোলে। এখানে মাত্র একজন ডাক্তার ও একজন কম্পাউন্ডার। ঔষধ সাপ্লাই কম। এমনই দিন গিয়েছিল দৈনিক ১০/১১ জন মারা গেছে। শিশুর সংখ্যাই বেশি ছিল।

যাদের যৎ সামান্য টাকা আছে তারা ঔষধ কিনে চিকিৎসা করতে পারলেও অধিকাংশ শরণার্থীর সেই সামর্থ্য নাই। বাধ্য হয়ে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর থাকতে হয়। প্রায় দিন ছিল মৃত্যুর দিন।

শিবির সংলগ্ন সরকারি বড় রাস্তার পাশে শিবিরে প্রবেশ পথে একটি বড় বট বৃক্ষ আছে। বট বৃক্ষের প্রসারিত ডালপালা সাজানো অবস্থায় প্রলম্বিতভাবে চতুর্দিক বিস্তৃত।

ফলে বটের শীতল ছায়ায় শরণার্থীদের অবস্থান হরহামেশা থাকে। তারা একে অপরের নিকট অতীত এবং বর্তমানের সুখ-দুঃখের কত কথা না বলাবলি করে।

কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতের কথা বলতে পারে না। কারণ ইহা সম্পূর্ণ ভারত সরকারের উপর নির্ভর করছে। সরকার চাইলে মারতেও পারে বাঁচাতেও পারে।

এর মধ্যে শুনা যাচ্ছে সরকার শরণার্থীদের দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসন করবে। শরণার্থীদের কিছু অংশ আসামের কাছার জেলার মনাছড়াতে নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে ৬০,০০০ (ষাট হাজার) চাকমা ভারতে শরণার্থী হয়েছিল।

(লেখাটি লেখকের জীবনীগ্রন্থ ‘জীবনালেখ্য’ থেকে সংকলন করা হয়েছে)


লেখক: স্নেহ কুমার চাকমা ।  সদস্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙ্গামাটি।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা