সাঁওতাল বিদ্রোহ: ভারতবর্ষে স্বাধিকার আদায়ের ইতিহাসে উজ্জ্বল মাইলফলক

Jumjournal
Last updated May 30th, 2020

1497

featured image

সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে পরিশ্রমী জাতির একটি বললে হয়তো ভুল হবে না। সহজ, সরল আর কঠোর পরিশ্রমী এই জাতি জঙ্গল পরিষ্কার করে পতিত জমিতে সোনা ফলাতে পারে।

১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে জমিতে বসবাস আর আবাদ করে আসছিলো সাঁওতালরা সেগুলো জমিদারদের দখলে চলে যায়।

খাজনা দিতে না পেরে অনেকটা বাধ্য হয়ে কটক, দলভূম, মানভূম, বরাভূম, ছোটনাগপুর, পালামৌ, হাজারীবাগ, মেদিনীপুর, বাকুড়া, বীরভূম জেলা থেকে তারা সরে যেতে শুরু করে।

জমিদারদের উৎপীড়নের মুখে শান্তিপ্রিয় সাঁওতালরা তাদের দীর্ঘদিন ধরে আবাদকৃত উর্বর জমি পেছনে ফেলে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ‘রাজমহল’ পাহাড়ের কাছাকাছি সমতলের জঙ্গল কেটে বিশাল ভূখণ্ড আবাদযোগ্য জমিতে পরিণত করে।

বিতাড়নের শিকার হওয়া সাঁওতালরা দলে দলে যোগ দেওয়ায় অল্প সময়েই বিশাল এলাকাজুড়ে সাঁওতাল পরগণা গড়ে ওঠে।

সাঁওতালরা দীর্ঘদিন ধরেই এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, পতিত জমিতে যে প্রথমবার চাষ শুরু করে, সেই জমি তার। সেখানে তাদের চাপ দেওয়া হলে তারা অন্যত্র সরে যাবে।

কিন্তু দীর্ঘদিনের শোষণ আর বঞ্চনার ক্ষোভও সাঁওতালদের মধ্যে দানা বেঁধে উঠতে থাকে। রাজমহল পাহাড়ের নিকটবর্তী এলাকার নতুন পত্তনে তাদের শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

পতিত জমি আকারে পড়ে থাকার সময় খাজনা আদায়ের ব্যাপারে কোনো কড়াকড়ি না থাকলেও সাঁওতালরা যখনই সেই জমি থেকে ফসল ফলাতে শুরু করে তাদের উপর সেখানেও খাজনা আদায়ের জন্য শুরু হয় অত্যাচার। 

রাজমহলের পাহাড়ের কাছে সমতলের জঙ্গল কেটে সেখানে ছোট ছোট সাঁওতাল গ্রাম গড়ে ওঠে। প্রতিটি গ্রামেই ছিল নির্বাচিত একজন সর্দার, একে বলা হয় মাঝি।

মাঝি ছাড়াও একটি গ্রামের মধ্যে ছিল একজন পরামাণিক, একজন গোরাইত, একজন যোগ-মাঝি, একজন দেশ-মাঝি।

এদের প্রত্যকের হাতেই ছিল একেকটি গ্রাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। আর কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় ‘সাঁওতাল পরগণা’। ‘পরগণাইত’কে পরগণা প্রধান হিসেবে গণ্য করা হয়। 

সাঁওতালি নাচে কয়েকজন সাঁওতাল; Image: Wikimedia Commons/Kushal Gangopadhyay

সাঁওতালরা শুধুই যে জমিদারদের শোষণের মুখোমুখি হয়েছে ব্যাপারটি এমন নয়। তাদের শোষণ করেছে মহাজন, এমনকি স্থানীয় মধ্যবিত্ত হিন্দু ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত।

মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের সুদের হার ছিল অমানবিকভাবে চড়া। সমসাময়িক এক ইংরেজ লেখকের বর্ণনা থেকে জানা যায় সুদের হার ছিল ক্ষেত্রবিশেষে ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ।

ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে শস্য, গবাদি পশু, এমনকি নিজে কিংবা নিজের পরিবারের সদস্যকে আজীবন বিকিয়ে দিতে হয়েছে।

সাঁওতালদের শোষণ করার আরেকটি উপায় বের করে নিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। সহজ সরল এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকায় এদেরকে ওজনে কম দিয়ে খুব সহজেই ঠকানো যেত।

অল্পদিনের মাঝেই ব্যবসা আর মহাজনী কারবারের সুযোগ পেয়ে বর্ধমান, বীরভূম থেকে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ীরা পাড়ি জমাতে থাকে।

ঠকানোর জন্য কেনাবেচায় দুই ধরনের ঝুড়ি, দাড়িপাল্লা ব্যবহার করা হতো। গরীব সাঁওতাল যখন হাটে তার জিনিসপত্র বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসতো তখন তা মাপা হতো বড় পাল্লায়। নকল তলা লাগানো কৌটায় মেপেও ঠকানো হতো এদের।

আর লবণ, তেল ইত্যাদি দ্রব্যাদি কিনতে গেলে, ব্যবসায়ীরা তা হালকা ভরের বাটখারা দিয়ে ওজন করতো। প্রতিবাদ করলে নয়-ছয় বুঝিয়ে দেওয়া হতো সহজ সরল এসব চাষীদের।

তাই কঠোর পরিশ্রম করেও হাতে কোনো অর্থ থাকতো না সাঁওতালদের। চাষের সময় বীজ কিনতে উচ্চ সুদে ধার করা ছাড়া উপায় থাকতো না এদের।

কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার সাথে সাথেই মহাজন, জমিদার আর পাওনাদারেরা হানা দিত। ফসলের সর্বস্ব লুটপাট হয়ে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে বেঁচে থাকতেই টানাপোড়েন শুরু হয়ে যেত সাঁওতাল পরিবারগুলোয়।

উৎসব-আনন্দে কিংবা আগামী বছর আবারো মাঠে ফসল ফলিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ধার-দেনা করতে হয় তাদের।

এমনই দুষ্টচক্রে পড়ে কখনো ঘরবাড়ি, কখনো নিজের গবাদিপশু, কখনো নিজেকেই বিকিয়ে দিতে হয় পাওনাদারের কাছে।

তৎকালীন সময়ের আদালতের একটি মামলা থেকে জানা যায়, এক সাঁওতাল চাষী টাকা প্রতি ১২ আনা সুদে ২৫ টাকা ঋণ নিয়েছিল।

একসময় পাহাড় পরিমাণ সুদে চাপা পড়ে সমগ্র জীবন দাসত্ব করেও সে সেই ঋণ শোধ করতে পারেনি, উত্তরাধিকারসূত্রে তার পুত্র, পৌত্রদের কাঁধেও ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।

আদালতে অভিযোগ করেও খুব একটা ফল পাওয়ার ঘটনাও পাওয়া যায় না। সাঁওতালদের করা মামলায় মহাজন আর জমিদারেরা জয়ী হয়ে যেতেন।

এমনই একটি ঘটনা ঘটে পাকুড় জেলা থেকে চল্লিশ মাইল দূরের ভাগানডিহি গ্রামে। সেই গ্রামের সিধু, কানু, চাঁদ আর ভৈরব নামে চার ভাইয়ের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারটিকে বিপদে ফেলার জন্য জমিদার আর মহাজনেরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো।

শক্ত সামর্থ্য চার ভাইয়ের পরিবারটি চুরি আর লুটের শিকার হয়ে সর্বশান্ত হয়ে যায়। পুরো এলাকার তরুণ সাঁওতালদের মধ্যে সঞ্চার হতে থাকে প্রবল ক্ষোভ।

গ্রামগুলোতে পরগণাইতের ডাকে সাড়া দিয়ে লোকেরা বৈঠক করতে থাকে কীভাবে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।

সিধু আর কানুর নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে যুবকেরা। তীর-ধনুক নিয়ে মহড়া চলতে থাকে গ্রামগুলোতে। এই অবস্থায় সাঁওতালদের মুখে মুখে তাদের দেবতা ‘মারাং বুরু’র আবির্ভাবের কথা।

সিধু আর কানুর সাথে বিভিন্নরূপে দেবতার প্রতিনিধি বলে স্বীকার করে নিল অনেক গ্রামের মাঝিরা। আশেপাশের সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে শালপাতা নিয়ে বার্তাবাহকেরা পৌঁছে গেল। ভাগনাডিহি গ্রামে সিধু আর কানুর কাছে চারদিক থেকে অসংখ্য সাঁওতাল আসা শুরু করেছিল।

তবে তাদের এ রকম সভা সমাবেশের ব্যাপারে স্থানীয় মহাজন আর জমিদারেরা পুলিশদের কান ভারী করছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করবে বলে অনেকেই প্রচার করছিল। 

সিধু আর কানুর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল সাঁওতালরা; Image source: skmu.ac.in

তবে সাঁওতালদের উদ্দেশ্য ছিল খুব সহজ। তারা ইংরেজদের কাছে তাদের দাবি দাওয়ার কথাগুলো বলতে চেয়েছিল।

ইংরেজ লাটের কাছে সুদের নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধ্ব ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য একত্রিত হয়েছিল।

কলকাতায় গিয়ে লাটের সাথে দেখা করে তাদের অভাব অভিযোগের কথা জানাতে দলে দলে স্রোতের মতো সাঁওতাল যোগ দেওয়া শুরু হয়েছিল।

সেখান থেকে তারা থানার দারোগা, বীরভূমের জেলা শাসক, বিভিন্ন জমিদার আর মহাজনদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ এবং তারা শুধুমাত্র বর্তমান অবস্থার প্রতিকার চায়। বারবার প্রতিকার চেয়েও কোনো উত্তর তারা পায়নি।

১৮৫৫ সালের ত্রিশ জুন রাতে চারশত গ্রামের সাঁওতাল ভাগীরথী নদীর তীরে এক সভায় মিলিত হয়। তারা যখন কলকাতা অভিমূখে রওনা হয় তখন মূল দলেই ছিল ত্রিশ হাজার সাঁওতাল।

তাদের সবাই ছিলো অশিক্ষিত এবং তাদের মাঝে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। তীর, ধনুক, টাঙ্গি, বর্শা আর দুই একদিনের খাদ্য নিয়ে তারা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল।

কিন্তু রাস্তায় এই বিপুল মানুষের খাদ্য আসবে কীভাবে এ ধারণা ছিল না। তাই কিছু সাঁওতাল আশেপাশের জনপদে লুটপাট করেছে বলেও জানা যায়। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে যায়।

স্থানীয় পুলিশ আর জমিদারদের লাঠিয়ালদের সাথে খণ্ড বিখণ্ড লড়াই চলতে থাকে। ভাগলপুর আর রাজমহলের মধ্যে রেল আর ডাক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিছিন্ন করে দেয় বিদ্রোহীরা।

বিভিন্ন ছোট বড় সড়কের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাদের হাতে। ১৯ জুলাই তাদের দমন করতে প্রশাসন সামরিক আইন জারি করে।

১৩নং বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন ফ্রান্সিস, ৭নং বাহিনী নিয়ে লেফটেন্যান্ট লোকার্ত, ৪২নং বাহিনী নিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল লিপট্রাপ সাঁওতালদের উপর বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করে। জমিদার আর নীলকরেরা সরকারের পাশে সহায়-সম্পত্তি নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। 

সাঁওতাল বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনী আর পুলিশের পাশে দাঁড়ায় জমিদার আর নীলকরেরা; Image source: Antique print, 1856

২৭ সেপ্টেম্বর বর্ধমানের কমিশনার লিখেন, “অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে নিযুক্ত সেনাবাহিনীকে নীলকর সাহেবরা অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে।” 

শুধু অর্থ দিয়েই নয় অনেক দলিল থেকে জানা যায় স্থানীয় জমিদাররা সৈন্য অভিযানে হাতি, ঘোড়া দিয়ে সাহায্য করতেন। সংগ্রামী সাঁওতালরা বন্দুকের গুলির সামনে দলবেঁধে তীর ধনুক নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল।

ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পেরে না উঠে দলে দলে সাঁওতাল মারা যেতে থাকে পথে প্রান্তরে। সাঁওতালদের পাশাপাশি এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল বাঙ্গালী এবং বিহারী হিন্দু-মুসলমান কৃষক আর কারিগরেরা।

দীর্ঘদিন ধরে কামার, কুমোর, গোয়ালা, ডোম প্রভৃতি পেশার মানুষদেরকেও শোষণ করে আসছিল মহাজন আর জমিদাররা। সাঁওতালদের বিদ্রোহের মাদলে সাড়া দিয়ে তারাও রাস্তায় নামে। 

১৫ জুলাই মহেশপুরের সংঘর্ষে সিধু, কানু আর ভৈরব নিহত হয়। বিদ্রোহ দমনের নামে ইংরেজ সেনাদল সাঁওতাল গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।

ক্যাপ্টেন শেরবিল বারোটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ভাগনাডিহি গ্রামও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। খাবারের অভাব, রোগব্যাধি, তীব্র দমন পীড়নের কারণে শুরু থেকেই ভালো অবস্থানে ছিল না সাঁওতালরা।

১৭ আগস্ট সরকার দশ দিনের মধ্যে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়। আত্মসমর্পণ করলে যাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আছে তাদের বাদ দিয়ে বাকী সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

বিদ্রোহীরা এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। 

৪৯ রেজিমেন্ট জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম; Image source: London News

এই ঘটনায় সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন মারাত্মক ক্ষীপ্ত হয়। বীরভূমের পালারপুরে ক্যাপ্টেন কোপির আদেশে প্রায় দেড় হাজার বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়।

বিদ্রোহী নেতাদের ধরিয়ে দিতে পারলে প্রচুর অর্থ পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়। এই যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে মেজর জারভিস নামে এক সেনাপতি বলেছিলেন,

একে যুদ্ধ বলে না, এ ছিল গণহত্যার ব্যাপার। তারা আত্মসমর্পণ করতে জানত না। যতক্ষণ তাদের নাগরা বাজবে, তারা সকলেই দাঁড়িয়ে পড়বে, তীর ছুড়তে থাকবে, গুলি খেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে।তাদের তীরে সরকারি সৈন্যরাও মারা যেত। এই যুদ্ধে এমন সিপাই ছিল না যে নিজের কাছে লজ্জ্বিত বোধ না করত। বন্দীরা প্রায়ই ছিল আহত লোক। এমন সত্যবাদী আর সাহসী মানুষের দল আমি আর দেখিনি।

বিদ্রোহীদের সংগঠিত করায় অনেক সংগঠককে ধরে এনে সিঊড়ি শহরের কেন্দুয়ার ডাঙ্গার স্কলের সামনে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, বীরসিং ছাড়াও শত শত নেতাকে হত্যা করায় আন্দোলন নেতৃত্বশুন্য হয়ে যায়।

বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ করে বিদ্রোহী দমন করতে থাকে সরকারি বাহিনী। তার প্রতিবাদে তীর-ধনুক নিয়ে সাঁওতাল জনপদ বাঁধা দিতে থাকে।

কিন্তু ঠিক কেন কিংবা কীসের জন্য এই সংগ্রাম সাধারণ অনেক সাঁওতাল সেই ব্যাপারটি সম্পর্কেই জানত না। 

সাঁওতালদের মূল অস্ত্র ছিল তীর,ধনুক, কুঠার আর ঠাঙ্গি। সেনাদের হাতে ছিল ভারী অস্ত্র আর কামান; Image source: ILLUSTRATED LONDON NEWS

সাঁওতালদের রক্তে পুরো  বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, ভাগলপুরসহ ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা লাল হয়ে ওঠে। দমন পীড়ন থেকেও সরকার ধীরে ধীরে সরে আসে। দাবির পুরোটা মেনে না নিলেও দাবির কিছু অংশ মেনে নেয় সরকার।

তাদেরকে সরকার দালিলিকভাবে ‘মাইনোরিটি’ বা সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সাঁওতালদের বাসের জন্য রাজমহল পাহাড়ের পাদদেশ, দামনে কোহ, বীরভূম, ভাগলপুর এলাকার বিস্তীর্ণ অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগণা নামে নতুন জেলা গঠন করা হয়েছিল।

গঠন করা হয় সাঁওতাল পরগণা নামক জেলা (ম্যাপে লাল অংশে চিহ্নিত); Image source: commons.wikimedia.org

সাঁওতাল কৃষকদের অনেকেই তাদের হারানো জমি ফিরে পেয়েছিলেন। সাঁওতালদের মাঝে শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি তাদের মাঝে ধর্ম প্রচার শুরু করেছিল ইংরেজ খ্রিস্টান মিশনারিরা।

যদিও এর মাধ্যমে সাঁওতালদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি আর ধর্মের উপর আগ্রাসন শুরু হয়েছিল বলে অনেক বিশ্লেষকের মতামত। 

এই বিদ্রোহের পর জমিদার আর মহাজনেরা যেন সাঁওতালদের জমি কেড়ে নিতে না পারে, সেজন্য পরে উপজাতি হিসেবে তাদের সুরক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছিল আইনগত ব্যবস্থা।

কিন্তু স্থানীয় আইন আদালত আর পুলিশী ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সাঁওতাল জনপদের উপর নানা মাত্রায় শোষণ অব্যাহত ছিল। তবে অধিকার আদায়ের ইতিহাসে সাঁওতালরা নিজেদের নাম প্রতিষ্ঠা করে যেতে সক্ষম হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদে বারবার শোষকের কারাগার ভেঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন শুধু সাঁওতাল পরগণায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে গেছে সারা ভারতবর্ষে।

১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০-৬১ সালে নীল বিদ্রোহ, পাবনা-বগুড়ার রায়তের আন্দোলনের মাধ্যমে এই আন্দোলনের শিখা ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতবর্ষে।

সেই বিবেচনায় এই বিপ্লব ভারতের স্বাধিকার আদায়ের ইতিহাসে অন্যতম অগ্রপথিক।  

সিধু আর কানুর স্মরণে স্মারক ডাকটিকিট; Image source: indiapost.gov.in

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অরণ্য-বহ্নি’ উপন্যাসের মতোই শতশত গল্প, উপন্যাস, ছড়া-কবিতায় বেঁচে আছে এই সাঁওতাল বিপ্লব বা হূলের অন্যতম নায়ক সিধু আর কানু ভাতৃদ্বয়।

১৯৯২ সালে ঝাড়খণ্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে এই দুই ভাইয়ের নামে।

২০০২ সালে ভারত সরকার সিধু আর কানুর সম্মানে চার রুপীর স্মারক ডাকটিকেট উন্মুক্ত করেছে। তাদের দাবীর নায্যতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি লাইন দিয়েই শেষ করছি,

সাঁওতাল উপপ্লবে কাটাকুটির কার্যটা রীতিমত সমাধা করিয়া এবং বীরভূমের রাঙ্গা মাটি সাঁওতালদের রক্তে লোহিততর করিয়া দিয়া তাহার পরে ইংরেজ রাজ হতভাগ্য বন্যদিগের দুঃখ নিবারণে কর্ণপাত করিলেন। যখন বন্দুকের আওয়াজটা বন্ধ করিয়া তাহাদের সকল কথা ভালো করিয়া শুনিলেন বুঝিলেন, তাহাদের প্রার্থনা অন্যায় নহে।

তথ্যসূত্রঃ রোর বাংলা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা