বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা আন্দোলন ও চাকমা ভাষার দশা
3876
সূচনা : ভাষা হচ্ছে জাতির প্রাণ যা না থাকলে একটি জাতির মৃত্যু ঘটে। বিলুপ্ত হয় জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। কিন্তু বাস্তব সত্য হল প্রত্যেক সংখ্যাগুরু ও শাসক জাতির একটি স্বভাবজাত চরিত্র হল সংখ্যালঘু তথা অধিনস্ত জাতিকে আগ্রাসন করা।
সেটা ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ভূখন্ডের উপর। কখনও জোর করে কখনওবা ঠান্ডা মগজে খুব সুক্ষ্মভাবে। যেনতেন প্রকারেন এই আগ্রাসন চলে। এমন আগ্রাসনের স্বীকার হয়ে জানা অজানা অনেক জাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে নতুবা সংখ্যাগুরুর সাথে মিশে যেতে বাধ্য হয়েছে।
গবেষকদের মতে পৃথিবীতে ভাষা আছে মোট ৬৯১২টি। তন্মধ্যে ৫১৬টি ভাষা সংকটময় অবস্থানে রয়েছে। ব্যবহারকারীর অভাবে অচিরেই বিলুপ্ত হবে এই ভাষাগুলি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- অল্প সংখ্যক বয়স্ক লোক শুধু ঐ ভাষায় কথা বলে।
তাদের প্রজন্মরা ঐ ভাষা ভূলে গেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ ভাষার ক্ষেত্রেও হারিয়ে যাওয়ার ভয় কম নয়। এই ভয় আসে রাষ্ট্র থেকেই। তাই একটি জাতিকে টিকে থাকতে হলে তার ভাষাকে বাঁচাতে হবে। ভাষার প্রতি দরদ থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে ভাষা প্রেম একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। পরাধীনতার শেকল ভাঙার সাহস যোগায়। পৃথিবীর তাবত জাতির ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় ভাষার জন্যে তারা সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে।
এই ভাষা আন্দোলনই হয়ে ওঠেছে তাদের স্বায়ত্বশাসন কিংবা স্বাধীনতার রক্ষা কবচ। নিচে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
ভারত
১। তামিল ভাষা আন্দোলন
১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের তামিল নাড়ু রাজ্য ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে কংগ্রেস সরকার গঠনের পরেই হিন্দীকে স্কুলে বাধ্যতামূলক করা হলে প্রতিবাদ আরম্ভ হয়। ই.ভি.রামস্বামী (পেরিয়ার) ও বিরোধী জাস্টিস পার্টি এর প্রতিবাদ করে।
তারা ১৯৩৮ খ্রীস্টাব্দের ১ জুলাই ও ৩ ডিসেম্বর হিন্দী বিরোধী দিবস পালন করে। চলমান আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলন দমনের জন্য সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে নারী-শিশুসহ ১১৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং এদের মধ্যে ১১৭৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৭৩ জন মায়ের সাথে ৩২ শিশুকেও জেল জীবন বরণ করতে হয়। কারাবন্দী অবস্থায় পুলিশের অত্যাচারে তালামুথু এবং নটরাজন নামে দুই আন্দোলনকারী মৃত্যুবরণ করেন।
হিন্দি প্রশ্নে খোদ কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়। রাজাজী আর তাঁর সমর্থকরা হিন্দি চালুর ব্যাপারে অটল থাকেন অন্যদিকে সত্যমূর্তী আর ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান হিন্দিকে ঐচ্ছিক করার পক্ষ নেন। এরমধ্যে দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধে ভারতকে জড়ানোর প্রতিবাদে কংগ্রেস সরকার পদত্যাগ করে। মাদ্রাজে গভর্ণর শাসন চালু হয়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতা করে গভর্ণর ১৯৪০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী হিন্দিকে ঐচ্ছিক করে।
১৯৪৬ থেকে ৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পুনরায় হিন্দি বিরোধি আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর আবারও ১৯৪৮-৪৯ শিক্ষাবর্ষে হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হয়। হিন্দিতে ন্যূনতম নাম্বার প্রাপ্তিও বাধ্যতামূলক করা হয়।
এতে দ্রাবিড়া মুন্নেত্রা কাঝাঘাম(প্রাক্তন জাস্টিস পার্টি) কঠোর আন্দোলন শুরু করে। অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষে হিন্দিকে ঐচ্ছিক করা হয়।
২। তেলেগু ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালে তেলেগু ও অন্ধ্রের দ্বন্দ্বের জের ধরে কয়েকজন কংগ্রেস নেতার সমর্থনে একজন কমিউনিস্ট নেতা তেলেগুভাষী পৃথক প্রদেশের দাবী নেহেরুর কাছে তুলে ধরেন।
দলীয় সংহতি রক্ষার অজুহাতে সে দাবী নাকচ করা হয়। পরবর্তীতে বিশাল অন্ধ্র আন্দোলনের নেতা পোট্টি শ্রীরামুলু তেলেগুভাষী পৃথক রাজ্যের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করেন এবং ৫৬ দিন অনশনের পর মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিশাল দাঙ্গা বাধে, এতে অনেক লোক মারা যায়। অবশেষে ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে সরকার দাবী মেনে নেয় এবং ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে পৃথক রাজ্য গঠিত হয়।
৩। কঙ্কাই ভাষা আন্দোলন
গোয়া দমন দিউতে কঙ্কাই ভাষীরা তাদের ভাষা দাপ্তরীক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আন্দোলন শুরু করেন। ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে ১৯৮৬ খ্রীস্টাব্দে আন্দোলনকারীদের মিছিলে গুলী চালানো হয়।
গুলীতে ৭ জন আন্দোলনকারী নিহত হন, আহত হন অনেক। ভাষা আন্দোলনকারীদের অনেক রক্তের বিনিময়ে ভারত সরকার ১৯৮৭ খ্রীস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারী কঙ্কাই গোয়ার একমাত্র দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা দেয় এবং সে বছর ৩০ মে পৃথক রাজ্যেরও স্বীকৃতি দেয়।
৪। কান্নাড়া ভাষা আন্দোলন
১৯৫৬ খ্রীস্টাব্দে কর্নাটক রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সেখানে ’তিন ভাষা নীতি’ (হিন্দী,সংস্কৃত,কান্নাড়া) গ্রহণ করা হয়। ১৯৬০ ও ৭০ দশকে কর্নাটকে প্রবল হিন্দী ও সংস্কৃত বিরোধী মনোভাব দেখা দেয় এবং লোকজন ইংরেজীর দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সংস্কৃত স্কুলের প্রথম ভাষা হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা কান্নাড়া ভাষা না শিখেই হাইস্কুল পার হয়ে যেতে পারছিলো। ফলে কান্নাড়া ভাষা প্রবল উপেক্ষিত হচ্ছে দেখে স্কুলে প্রথম ভাষা হিসাবে কান্নাড়া চালুর দাবীতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়।
রাজনৈতিক দল, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক সবাই এতে যোগ দেন। পরে সরকার আন্দোলনের মুখে কান্নাড়াকে প্রথম ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়।
৫। কোলশি ভাষা আন্দোলন
পশ্চিম উড়িষ্যার কোশাল জেলার অধিবাসীরা গত পাঁচ দশক ধরে তাদের ভাষার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য কোলশি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি অর্জন (৮ম তফশীলে অন্তর্ভুক্তকরণ)।
কোলশি ভাষা ও এর জনগণের উন্নয়নের জন্য গঠিত সংগঠন কেডিডিএফ প্রধানমন্ত্রী ড.মনমোহন সিং-এর কাছে কোলশি ভাষাকে সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানের জন্য স্মারকলিপি দেয় ।
সংবিধানের ৯৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে বোড়ো, ডোগরি, সাঁওতালী ও মৈথিলী ভাষা সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ায় কোলশি ভাষাভাষীরাও তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে তোড়জোড় চালাতে থাকে।
৭। পাঞ্জাবী সুবা আন্দোলন
১৯৫০-এর দশক থেকে শিখদের সংগঠন আকালী দল ভাষাভিত্তিক পাঞ্জাবী সুবা (প্রদেশ) গঠনের জন্য আন্দোলন শুরু করে। শিখদের নেতা সন্ত ফতেহ সিং পাঞ্জাবের হিন্দী ভাষী এলাকা থেকে পৃথক করে পাঞ্জাবী ভাষী সুবা গঠনের দাবীতে আমরণ অনশন আরম্ভ করেন।
কিছুদিন পর ফতেহ সিং তাঁর ধর্ম-গুরু মাস্টার তারা সিং-এর নির্দেশে অনশন ভাঙেন। ’আকালী তখত’ও আন্দোলনে ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে আন্দোলনরত ১২ হাজার এবং ১৯৬০-৬১তে ২৬ হাজার শিখকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
সরকারের সাথে শিখদের আলোচনা বসে। আলোচনায় ঐক্যমত না হওয়ায় ধর্মীয় নেতা মাস্টার তারা সিং নিজেই ৪৮দিনের অনশন আরম্ভ করেন।
আন্দোলনে কোন ফল না পেয়ে সন্ত ফতেহ সিং ১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দে আবার অনশনে নামেন এবং হুমকি দেন, তাঁদের দাবী মানা না হলে তিনি দক্ষিন ভিয়েতনামী বৌদ্ধদের মতো স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করবেন। পরে ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী সরকার পাঞ্জাবীদের দাবী মেনে নেন।
৭। ওড়িয়া ভাষা আন্দোলন
১৮৪৯ খ্রীস্টাব্দে ওড়িয়াভাষী দেশী রাজ্য সম্বলপুরের শেষ স্বাধীন রাজা চৌহানরাজ নারায়ন সিং অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে বিধবা রাণী মুক্ষাপন দেবী রাজ্যচালনার ভার গ্রহণ করেন। তিনি কয়েকমাস রাজত্ব চালানোর পর বৃটিশরা সম্বলপুর দখল করে।
অন্যান্য এলাকার মতো সেখানেও নিজস্ব ভাষার (ওড়িয়া) পাশাপশি ইংরেজী চালু হয়। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট্রাল প্রোভিন্সের চীফ কমিশনার স্যার জন উডবার্ন ওড়িয়ার বদলে হিন্দীকে সম্বলপুরের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
১৮৯৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত সম্বলপুরের কবি, সাহিত্যিক, সুধীসমাজের নিরন্তর চেষ্টায় ওড়িয়া সম্বলপুরের দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদা ফিরে পায় এবং সম্বলপুর উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়।
৮। বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষা আন্দোলন
১৯৯৬ খ্রীস্টাব্দের ১৪ মার্চ আসামের করিমগঞ্জে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদার দাবীতে রেল অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলী ছুঁড়লে শহীদ হন ভাষা সংগ্রামী সুদেষ্ণা সিংহ।
বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরী ভাষার জন্য তাঁর এ আত্মত্যাগ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সর্বশেষ ২০০৬ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পায়। বস্তুত এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দ থেকে।
ত্রিপুরা রাজ্যেও মণিপুরীরা আন্দোলন করে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে ২৬মে ত্রিপুরা সরকার তাদের দাবী মেনে নিয়ে সেখানখার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করে।
৯। বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা আন্দোলন
১৯৬০ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিলে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি দাবী করে, ‘অহমিয়া’ হতে হবে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা। এ নিয়ে বাঙালী অধ্যুষিত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রবল বিরোধ দেখা দেয়।
আসামের অধিবাসীরা বাঙালী হিন্দুদের বাড়ীঘরে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এতে ২৫টি গ্রামে বাঙালী হিন্দুদের চার হাজারের বেশী বাড়ীঘর ধ্বংস করা হয়। হামলায় ৯ জন নিহত এবং আহত হয় শতাধিক বাঙালী হিন্দু।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে ৫০ হাজারের বেশি বাঙালী হিন্দু পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয় নেয়। ৯০ হাজারের মতো বাঙালী হিন্দু পালিয়ে যায় বরাক উপত্যকা এবং রাজ্যের উত্তর পূর্বাঞ্চলে।
এরপরও আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্য বিধানসভায় ‘অহমিয়া’কে আসাম রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষার মর্যাদানের জন্য বিল উত্থাপন করেন।
করিমগঞ্জ(উত্তর) আসনের বিধায়ক রনেন্দ্র মোহন দাস (বাঙালী) এর প্রতিবাদ করে বলেন, এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাষা (অহমিয়া) দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। ২৪ অক্টোবর আইন পাস হয়ে যায়।
বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষী জনগনের ওপর অহমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রতিবাদে ৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬১ গঠিত হয় ’কাছার গণসংগ্রাম পরিষদ’। পরিষদ ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদের অনেক আন্দোলন কর্মসূচী দিতে থাকে।
সর্বশেষ ১৯ মে সর্বাত্মক হরতাল চলাকালে আসাম রাইফেলসের সৈন্যরা ভাষা-আন্দেনকারীদের দিকে গুলী ছোঁড়েন। বুলেটবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের হাসপাতালে নেয়া হলে ৯ জন ঐদিন আর ২ জন পরদিন মারা যান।
এতে আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। সে থেকে আসামসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ১৯ মে ’বাংলা ভাষা শহীদ দিবস’ পালিত হয়।
১০। অন্যান্য ভাষার লড়াই
১৯৬২ খ্রীস্টাব্দে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত অহমিয়া, বাংলা প্রধান আসাম রাজ্য গঠন হয়। পরে ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে তিবেতো-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত বিভিন্ন ভাষাভাষী পাহাড়ী জনগন যেমন- মিজো, খাসিয়া, নাগা, মণিপুরী, ত্রিপুরারা ভাষাভিত্তিক পৃথক রাজ্যের জন্য সহিংস আন্দোলন আরম্ভ করে।
১৯৬৮তে শিলংয়ে সর্বদলীয় পাহাড়ী নেতারা সম্মেলনে সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত নেন। পরে তাদের দাবীর বিষয়ে সুপারিশ দেবার জন্য ভারত সরকার মেহতা কমিশন গঠন করে। মেহতা কমিশনের সুপারিশের প্রেক্ষিতে পাহাড়ীদের ভাষার ভিত্তিতে ১৯৭১-এ মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা আর মনিপুর রাজ্য গঠিত হয়।
পাকিস্তান
বাংলা ভাষা আন্দোলন
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান এ দুই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলা(বর্তমান বাংলাদেশ) পাকিস্তান অংশে পড়ে এবং নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান।
কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও ভাষাগত অনেক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণ ক্ষুব্ধ হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ বাংলাভাষী মানুষ সরকারের এই আকস্মিক ও অন্যায্য সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন দমনে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা শহরে কোন প্রকার মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করে।
মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে রফিক, সালাম, বরকত-সহ অনেকে নিহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। সরকারের এমন অন্যায় দমন নীপিড়নে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। পরবর্তীতে এই ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
চীন
চীনের উপনিবেশিক রাজ্য তাইওয়ানের আদি বাসিন্দা ফুকিয়েন ও হাক্কাসরা ফুকিয়েনিজ, হাক্কা ও অস্ট্রো এশিয়ান ভাষায় কথা বলে। কিন্তু শতাব্দিকাল ধরে তারা দুই দুইটি উপনিবেশিক জাতির ভাষা আগ্রাসনের স্বীকার হয়।
প্রথমত জাপান ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে জাপানী ভাষাকে সেখানকার জাতীয় ভাষা বানায়। দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলে তাইওয়ান চীনের ভাগে পড়ে। শুরু হয় আরেক নতুন আগ্রাসন। চীনারা মান্দারিনকে জাতীয় ভাষা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করে।
তাইওয়ানের আদিবাসীরা জাপানীজ ও মান্দারিন দুই ভাষার চাপে চরম বিপাকে পড়ে। প্রথমত জাপানী ভাষায় শিক্ষিত যুবকরা চাকরীর বাজারে অযোগ্য হয়ে ওঠে, দ্বীতিয়ত সাধারণ মানুষেরা তাদের মুখের ভাষা হারাতে বসে।
অতপর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তাইওয়ান রাজনৈতিক মুক্তির সাথে ভাষা মুক্তির আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। চীনা জাতীয়তাবাদের বিপরীত ফুকিয়েন জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলতে থাকে।
দক্ষিন আফ্রিকা
১৯৭৬ সালের ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার গাউটাং এর (তৎকালীন ট্রান্সভাল প্রদেশ) জোহানসবার্গ শহরের সোয়েটোতে এ আন্দোলনটি হয়েছিল।
ঐ অঞ্চলের কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়গুলোতে আফ্রিকানার ভাষায়(দক্ষিন আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গ ডাচদের জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণ) শিক্ষা গ্রহণ বাধ্যতামূলক আইন পাশ করায় স্কুলের কিশোর – শিশুরা এর প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে।
কারণ তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা প্রতিবাদ সভা ডাকে।
তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে যাওয়া ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালালে প্রায় ২০০ জনেরও অধিক লোক মারা গিয়েছিল। নিহতরা ছিল প্রায় সংখ্যক শিশু-কিশোর।
যুক্তরাষ্ট্র
আমেরিকায় সুদীর্ঘকাল যাবত বিভিন্ন নেটিভ আমেরিকান ভাষা ইউরোপীয় কলোনিয়াল শাসকদের আগ্রাসনের স্বীকার। এতে অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষার মৃত্যু হয়েছে।
গত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলন হয়। নেটিভ আমেরিকান ভাষা রক্ষাও ছিল ঐ আন্দোলনের একটি অংশ।
মূল প্রস্তাবনার দীর্ঘ ২০ বছর আন্দোলন এবং আলোচনার পর অক্টোবর ৩০, ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার বিভিন্ন নেটিভ ভাষা রক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য একটি আইন পাশ হয়।
কানাডা
কানাডার পুর্ব অংশের অংগরাজ্য কুইবেকের জনগণ ফরাসী ভাষাভাষী। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিগত আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করায় তারা কানাডা থেকে স্বাধীন হতে চাচ্ছে।
এর প্রেক্ষিতে গণভোটও হয়েছে যদিও সামান্য ব্যবধানে স্বাধীনতাপন্থীরা হেরে যায়। যে কোন সময় আবারো জোড়ালো হয়ে উঠতে পারে স্বাধীনতার প্রশ্ন। তখন হয়ত স্বাধীনতা না দিয়ে থাকতে পারবে না কানাডা সরকার।
লাটভিয়া
লাটভিয়াতে লাতভিয়ান-রাশিয়ান ভাষার মনোমালিন্যর কারণে, রাশিয়ান ভাষার স্বীকৃতির বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। গণভোটে লাতভিয়ানরা কয়েকশ বছরের প্রধান ভাষা (রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকা সময়) রুশ ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে।
বেলজিয়াম
বেলজিয়ামে দুইটি প্রধান ভাষা ওলন্দাজ ও ফরাসী। এ দুইয়ের মধ্যে ওলন্দাজ ভাষাভাষী ফ্লেমিং জনগোষ্ঠী ৫৮% এবং ফরাসী ভাষী ওয়ালুনস ৩১%। এছাড়াও ১% জার্মান ভাষাভাষী রয়েছে।
এই প্রধান দুই ভাষার দ্বন্দ্বে বেলজিয়ামে একাধিক বার সরকার পতন হয়েছে। ওলন্দাজ ভাষী ফ্লেমিংরা নিজেদের বেলজিয়াম হিসেবে পরিচয় দিতে চায় না। ভাষার কারণে বেলজিয়াম যেকোন সময় দ্বিখন্ডিত হতে পারে।
এখন আসি আমাদের চাকমা ভাষা প্রসঙ্গে।
চাকমা ভাষার দশা
অন্যান্য অনেক ভাষাগুলোর ন্যায় আমাদের চাকমা ভাষাটাও আগ্রাসনের স্বীকার। এই আগ্রাসন শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকে। আন্তর্জাতিক ভাষা দলিল সেই প্রমাণ দেয়।
এর কারণ যেমনি কর্তৃত্ববাদী শাসকদের আগ্রাসী মনোভাব এবং কিছু আমরা নিজেরাই। কারণ আমাদের রাজারা নিজ ভাষার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়নি, তাদের রাজ্য পরিচালনায় যাবতীয় দাপ্তরিক কাজে চাকমা ভাষাকে উহ্য রেখেছিলেন।
তাদের প্রাচীন দলিল যেমন- চাকমা অক্ষরের সীল, চাকমা ভাষায় লিখিত কোন আদেশনামা, শিলালিপি নেই। বরং অন্য ভাষাকেই তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন।
রাজা ফঁতে খাঁ(১৭১৫), রাজা শুকদেব(১৭৫৭), রাজা জানবক্স খাঁ(১৭৮২), রাজা জব্বর খাঁ(১৮০২), রাজা ধরমবক্স খাঁ(১৮১২) আমলের সীল মোহর পারসী ভাষায় উৎকীর্ণ।
চিত্র ১ : চাকমা রাজন্যবর্গের ব্যবহৃত প্রাচীন সীল মোহর। ছবিটি চাকমা জাতির ইতবৃত্ত থেকে সংগৃহীত।রাণী কালিন্দীর(১৮৪৪-১৮৭৩) শাসনেও প্রচুর বাংলার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তাঁর নামাঙ্কিত সীল, রাজানগরের প্রাচীন রাজবাড়ীর পাশে মহামুনি মন্দিরের প্রস্তর ফলকে খোদাই করা অনুসাশনটি বাংলায় লিখিত।
এছাড়াও সমস্ত রাজাদেশ লিখতে তিনি বাংলা বব্যহার করতেন। তাঁর এই বাঙলা প্রীতি দেখে সতীশচন্দ্র ঘোষ বড়ই খুশী হয়েছিলেন। এ জন্য তিনি ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থে কালিন্দী রাণীর প্রতি প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেন এভাবে- “বলা বাহুল্য তাঁহার আমলেই বাঙ্গালার সর্প্রথম প্রাধান্য দেখিতে পাইয়াছি, বহুদিন পরে পারসীর হাত হইতে অব্যাহতি লাভ করা গেল।” পৃষ্ঠা- ৮৪।
কিন্তু সংঘরাজ সারমেধ মহাথেরকে দেওয়া উপাধিযুক্ত সীলটি বার্মিজ অক্ষরে লেখা। সেটা চাকমা অক্ষরে লেখা যেতো না? তার পরবর্তী রাজাদের আমলেও চাকমা ভাষা ও চাকমা অক্ষরগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।
যেমন রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়ের(১৮৭৩-১৮৯৭) নামাঙ্কিত সীলটি বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। তাঁর সময়েও তিনি সমস্ত রাজাদেশ বাংলায় লিখতেন।
পরবর্তী সময়ে রাজা ভূবনমোহন রায়ের(১৮৯৭-১৯৩৩) আমলে বিচ্ছিন্নভাবে চাকমা ভাষা শিক্ষার কথা সতীশচন্দ্র ঘোষের প্রাগুক্ত গ্রন্থে জানা যায়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা তথ্য অনুযায়ী তখনকার চাকমা জনসংখ্যা ছিল ৪৮,৭৯৪ জন।(E.A. Gait P.S.S. Census of India, 1901, vol-VIA, part II. page-102)।
এদের মধ্যে শিক্ষিত ছিলেন মাত্র ২,২০০ জন। শ্রী ঘোষ লিখেন- “সরকারী কাগজপত্রে পরিদৃষ্ট হয়, তাহাদের প্রায় অর্ধলক্ষ অধীবাসীর মধ্যে ২,১৫৬ জন পুরুষ এবং ৪৪ জন স্ত্রীলোক মাত্র শিক্ষিত। তন্মধ্যে ৭৮৮ জন পুরুষ ও ২৪ জন স্ত্রীলোক বাঙ্গালা, আর ৫৫ জন পুরুষ মাত্র ইংরাজী জানে। অবশিষ্ট পুরুষ ও স্ত্রীলোকেরা চাকমা ভাষা লিখিতে পড়িতে পারে। পক্ষান্তরে বাঙ্গালা ভাষা-শিক্ষিতদিগের মধ্যে ২৯০ জন পুরুষ ও ৪ জন স্ত্রীলোক চাকমা লেখাপড়াতেও পরিপক্ক; এবং ১২ জন পুরুষের মঘ ভাষাতে অভিজ্ঞতা আছে” (পৃষ্ঠা-২৫২)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে রাজা ভুবন মোহন রায়ের আমলে শিক্ষিতদের মধ্যে তুলনামূলক বেশী শিক্ষিত ছিলেন চাকমা ভাষায় যার সংখ্যা 1627 (১,৩২১) জন। যা পূর্ববর্তী রাজাদের আমলে ছিলনা বলে মনে হয়।
এর পরে রাজা নলিনাক্ষ রায়( ১৯৩৫-১৯৫১) ও তৎপুত্র রাজা ত্রিদিব রায়ের(১৯৫৩-২০১২) আমলেও চাকমা ভাষার ব্যবহার তেমন ছিলনা। বরং চাকমা ভাষা ও অক্ষর গুলোর যে নবপ্রভাতের সূচনা হচ্ছিল তা একপ্রকার রাহুগ্রস্ত সূর্যের ন্যায় নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
ভাগ্য বিড়ম্বিত চাকমা জাতি বিভিন্ন সময় ধরে স্বাধীনতার কাছে উপহাস পেয়ে এসেছে। অনুরূপভাবে ১৯৪৭-এ ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির মধ্যমে আরেকবার ভাগ্য বিরম্বনায় পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে যায় পাকিস্তানের অংশ।
নতুন দেশে নতুন আইন শুরু হয়। প্রতিটি স্কুলে উর্দু হয়ে উঠে প্রথম ভাষা, দ্বীতিয় ভাষা হিসেবে স্থান পায় বাংলা। প্রথমত এই দুই ভাষার প্রতাপে চাকমা ভাষা তার গতি ফেরাতে পারেনি। দ্বীতিয়ত রাষ্ট্রীয় ভাষায় শিক্ষিত চাকমারা নিজ ভাষার গুরুত্ব ভূলে যেতে বসে।
তারা দুমুটো খেয়ে পড়ে বাঁচার জন্য রাষ্ট্রীয় ভাষার কদর অনুভব করে এবং সেই অনুভবে নিজ ভাষা ও অক্ষর তাদের কাছে চরম মূল্যহীন হয়ে ওঠে। এমন আত্মঘাতী চেতনার দরুণ হারিয়ে যেতে বসে নিজস্ব শব্দ।
তার স্থানে জায়গা নেয় বাংলা শব্দ। কথিত শিক্ষিতরা চাকমা শব্দে কথা বলতে লজ্জাবোধ শুরু করে। তাদের ভাষায় চাকমা ভাষা গ্রাম্য, অশিক্ষিত মানুষের ভাষা। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার মাধ্যমে চাকমা জাতির ভাগ্যাকাশে আচমকা কালবৈশাখি ঝড় উঠে, তচনচ করে দেয় জাতির সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য।
সর্বনাশা বাঁধের পানি ডুবিয়ে দেয় ঐতিহাসিক চাকমা রাজবাড়ী, জাতির সম্বল ৫৪,০০০ একর কৃষি জমি, অটল তলে তলিয়ে যায় শত শত গ্রাম। নিরূপায় হয়ে ৬০,০০০ চাকমার চলে যেতে হয় ভারতে আর কিছু সংখ্যক চলে যায় মিয়ানমারে।
সর্বশেষ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে চাকমা জাতি আশার আলো দেখেছিল। কিন্তু সেই আশালতা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় শোষণ বঞ্চনায়। পাকিস্তান মেরেছে পানিতে ডুবিয়ে আর বাংলাদেশ মারল সেটেলার নামক ভূমিদস্যুদের পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকিয়ে দিয়ে, আর সেনা শাসন জারি রেখে।
রাষ্ট্র দুটির একই উদ্দেশ্য চাকমাদের ভূমিহীন করা, সংখ্যালঘু করা। আর চাকমারা তাই হয়েছে। সেই সাথে তাদের ভাষা, সংস্কৃতির উপর নেমে আসে চরম অভিঘাত। রাষ্ট্রভাষা বাংলার ঝাঁঝে বিদ্যালয়গুলোতে একতরফা বাংলা শিক্ষা প্রচলন হওয়ায় সংখ্যালঘু জাতির মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের কোন সুযোগ থাকল না।
বাংলায় শিক্ষিত চাকমারা তাদের প্রতিটি বাক্যে অতিমাত্রায় বাংলা ব্যবহার শুরু করল। যার কারণে বিভিন্ন জরিপে চাকমা ভাষা ৮০% বাংলা শব্দের মিশ্রিত উপভাষা হওয়ার পথ সুগম হল।
চাকমা সাহিত্যিকরা বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে চাকমা ভাষার গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস প্রভৃতি সাহিত্য লেখা শুরু করল। এভাবে চেতনে অবচেতনে কথিত শিক্ষিত সমাজ থেকে বিলুপ্তি ঘটল চাকমাদের নিজস্ব বর্ণমালা। আন্তর্জাতিক দলিলাদিতে সমৃদ্ধ চাকমা ভাষা মৃতপ্রায় এবং অক্ষরগুলো বিলুপ্ত/অব্যবহৃত হিসেবে নথিভুক্ত হল।
কিন্তু জুম্মো, গ্রাম্য, অশিক্ষিত! চাকমারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কথায়-আলাপনে সযত্নে রক্ষা করেছে চাকমা মূল শব্দগুলো। বৈদ্যদের তাল্লিকশাস্ত্রে শিষ্য পরম্পরা রক্ষিত হল চাকমা বর্ণমালা। যদিও চাকমা অক্ষরের সফল ব্যবহার ও সংরক্ষণ হয়েছিল বহু আগে কবি শিবচরণের গোজেনলামা এবং লুরিদের আঘরতারা রচনার মাধ্যমে।
তবে আশার কথা হল বর্তমান চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় চাকমা ভাষা ও লিপির সুরক্ষা বিধানে যথেষ্ট কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি চাকমা রাজপ্রতীকটি চাকমা অক্ষরে লিখে কার্যালয়ের বহির্ভাগে এঁটে দিয়েছেন।
তবে তাঁর অফিসিয়াল সীলটিতেও যদি ইংরেজির পাশাপাশি চাকমা অক্ষর ব্যবহার করতেন তাহলে আরো গম্ভীর হতো। তাছাড়া রাজকার্যের নথিপত্রে চাকমা ভাষা ও অক্ষর ব্যবহার করলে নিজ ভাষার মর্যাদা বহুগুণে বৃদ্ধি পেত বলে আমি মনে করি।
এইতো গেল আমাদের রাজাদের প্রতি সমালোচনা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের মুক্তি আন্দোলনের প্রধান ধ্বজাধারী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কেমন সেটাও বিচার্য বিষয়।
সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে ১৩ জুলাই জাতীয় সংসদ বিতর্কে তৎকালীন সংসদ সদস্য প্রয়াত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা চাকমা ভাষাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য ৯টি ভাষার উন্নয়ন বিষয়ক প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি তৎকালীন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিষয়াবলী ও ক্রীড়া মন্ত্রী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর কাছে জানতে চেয়ে বলেছিলেন-
“…মন্ত্রী মহোদয় অনুগ্রহ করিয়া বলিবেন কি-
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের দশটি পৃথক ভাষাভাষী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, বম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরুং ও চাকদের ভাষা উন্নয়নের জন্য সরকার কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছেন কিনা; এবং
(খ) প্রশ্নে উল্লেখিত দশটি ভাষা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছেন কিনা; করিয়া থাকিলে, কবে হইতে উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হইবে; না হইলে উহার কারণ কি?”
প্রতি জবাবে মন্ত্রী বলেছিলন-
“(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম-এ প্রচলিত ১০টি ভাষা উন্নয়নের কোন পরিকল্পনা আপাতত নাই।
(খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হেতু দেশের অন্যান্য অংশের সহিত ইহার সম্পর্ক নিবিড় হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয় এবং একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমেই তাহা সম্ভব হইতে পারে। এই জন্য প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যান্য জেলার মত সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়েই বাংলা ভাষার শিক্ষা দান করা হইতেছে।”
তখনই স্পষ্ট হয়েছিল যে রাষ্ট্র চাকমা ভাষাসহ অপরাপর কোন উন্নয়ন চাইনা। বরঞ্চ জোর করে বাংলা চাপিয়ে দিয়েছে। প্রয়াত নেতার দাবী অগ্রাহ্য হল। চরম বঞ্চনায় অপমানিত হতে হল।
কিন্তু রাষ্ট্রের সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবার যে প্রয়োজন ছিল সেটা তিনি করেছিলেন সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দেওয়ার মাধ্যমে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেক শিক্ষক-ছাত্র-যুবক। তারপরেও ভাষার প্রশ্নে তেমন উচিত জবাব দেওয়া যায়নি।
কারণ আন্দোলনের অনুসংগে ভাষা ও বর্ণমালাকে ব্যবহার করা হয়নি। যেহেতু ভাষার উন্নয়নে রাষ্ট্র আগ্রহী নয় সেহেতু সউদ্যোগে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা উন্নয়ন করতে হবে। কিন্তু আন্দোলনের পক্ষ থেকে এরূপ কার্যক্রমও কোনদিন গ্রহণ করা হয়নি।
সেটা হতে পারত বিহার ভিত্তিক, কিংবা শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। যেভাবে মারমারা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। এর জন্যে কোন প্রকার ভাতা দেওয়ারও প্রয়োজন পড়তো না। কেননা স্বাধিকার আন্দোলনে যার যে অবস্থান থেকে সকলের অংশগ্রহন ছিল স্বতস্ফুর্ত।
এমএন লারমার মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্রি বোধিপ্রিয় লারমা আন্দোলনের হাল ধরেন। তারপর দীর্ঘ দেড়দশক এ আন্দোলন চলে। কিন্তু ভাষা নিয়ে কার্যক্রম গৃহীত হয়নি। তিনিও শুধু অগ্রজ এমএন লারমার সংসদে করা দাবী বুকে নিয়ে এগিয়েছেন।
বস্তুত দাবী পূরণের চাইতে নিজেদের যোগ্যতা সম্পন্ন করা যে জরুরী সেটা প্রাধান্য পায়নি। যারফলে আভ্যন্তরীনভাবে নিজস্ব মাতৃভাষা অচর্চিত থাকে, শতভাগ জুম্ম নিজস্ব বর্ণমালায় নিরক্ষর থেকে যায়।
তবে অনেক অপূর্ণতার মাঝেও যা পূর্ণতা, তিনি পার্বত্য চুক্তিতে মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করে মাইল ফলক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
চুক্তিউত্তর নব্য সংগঠক প্রসীত খীসা, তাতিন্দ্রলাল চাকমা, সুধাসিন্ধু খীসাদের কাছেও চাকমা ভাষা ও অক্ষর সংরক্ষণ নিয়ে তেমন তৎপরতা চোখে পরেনি। অথচ ভাষা হল আন্দোলনের প্রধানতম অংশ।
তাঁরা তাঁদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের যাবতীয় কাগজ পত্র বাংলায় লিখেন। যার কারণে অতি সংবেদনশীল বিষয়গুলোরও গোপনীয়তা থাকে না। অবশ্য এমএন লারমাও কিন্তু তাঁর অনুজ জেবি লারমাকে রাজনৈতিক গোপন বিষয়ে লিখিত চিঠিগুলো বাংলায় লিখেছিলেন।
(চিঠিগুলো জনসংহতি সমিতির শীর্ষ স্থানীয় সূত্রে সংগ্রহ করে সাংবাদিক ও ব্লগার বিপ্লব রহমান ‘এমএন লারমার ছিন্নপত্র: ঐতিহাসিক দলিল’ নামে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর দৈনিক মুক্তকন্ঠের সাপ্তাহিক প্রকাশনা ‘প্রবাহ’তে প্রকাশ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ইন্টারনেটে কয়েকটি ব্লগসাইটেও প্রকাশ করেন। চিঠিগুলো ইন্টারনেটে http://www.sachalayatan.com/biplobr/10242 এই ঠিকানায় গেলে পড়তে পারবেন)।
অথচ চাকমা অক্ষরে চাকমা ভাষায় হলে নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা যেমন হত তেমনি গোপনীয়তাও রক্ষা হত। অন্যদিকে সকলের নিজস্ব বর্ণমালা শেখার আগ্রহ সৃষ্টি হত।
আঞ্চলিক দলগুলো ভাষা সংরক্ষণের লড়াই হিসেবে তাঁরা তাঁদের কর্মিদের(যে কোন জাতির সদস্য) বাধ্যতামূলক নিজ নিজ বর্ণমালা শিক্ষা এবং আন্দোলনের সুবিধার্থে যোগাযোগ ও সাংগঠনিক বিভিন্ন কার্যক্রমে (যেমন বাংলাকে ব্যবহার করা হচ্ছে) চাকমা ভাষা ও অক্ষরকে সার্বজনীনভাবে ব্যবহারের বিধান চালু করতে পারতেন।
এখনও পর্যন্ত সেভাবে চাকমা ভাষা ও অক্ষরকে ব্যবহার করা হচ্ছে না। ব্যবহার করলে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয় না। এছাড়াও আমাদের জনপ্রতিনিধি যারা ছিলেন যেমন দীপংকর তালুকদার, কল্পরঞ্জন চাকমা ভাষার প্রশ্নে এরাতো লক্ষ হাত দূরে ছিলেন।
এমএন লারমার মত কখনও কোনদিন সংসদে এ বিষয়ে উত্থাপন করেইনি, স্বউদ্যোগে কার্যক্রম গ্রহণ করাতো অলীক স্বপ্ন। বিশ্ব পরিমন্ডলে একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষা ও পরিচতি লাভ করতে ভাষা ও লিপির ব্যবহার বর্তমানে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ভবিষ্যতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে।
তবুও সকল বেদনার মধ্যে একটি সান্তনা হল পার্বত্য চুক্তির খ খন্ডের ৩৩ নম্বর ক্রমিকের খ(২) নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়টি সন্নিবেশিত হয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। তারই সুবাদে সরকার চলতি ২০১৭ সাল থেকে চাকমা ভাষাসহ ৫টি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেছে।
কিন্তু অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে শুরুতেই বিপত্তি দেখা দেয়। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে বিতরণকৃত পাঠ্যবই কোন কাজে আসছে না (সুত্র: ‘তিন জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার পাঠ্যবই কাজে আসছে না’, বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, দৈনিক প্রথম আলো, ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭)।
তাছাড়া অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজস্ব বর্ণমালায় লিখতে পড়তে জানেনা। সুতরাং সবার আগে দরকার ছিল আমাদের দ্বারা এর ব্যাপক ব্যবহার। অথচ দীর্ঘকাল ধরে নিজ ভাষা ও অক্ষরগুলো আমাদের দ্বারা নিগৃহিত হয়ে আসছে।
২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সমকাল পত্রিকায় রাজীব নূর ‘চাকমাদের দুঃখিনী বর্ণমালা’ নামে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে চাকমাদের বর্ণমালা ব্যবহার সম্পর্কে একটি জরিপ চালিয়েছেন।
তিনি লিখেন- “সরেজমিন ১৪ থেকে ২৩ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত জনপদ ঘুরে এন্তি চাকমার মতো অনেক চাকমাভাষীর দেখা মিলল, যারা নিজের ভাষার বর্ণমালাটাও জানেন না।
এমনকি চাকমা সমাজের সর্বজনমান্য অনন্তবিহারী খীসা, জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা গ্রুপের প্রধান সুধাসিন্ধু খীসা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান, জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গলকুমার চাকমা,
জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলের সভাপতি মিহির বরণ চাকমা, সহ-সাধারণ সম্পাদক গঙ্গামানিক চাকমা, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক তুষারশুভ্র তালুকদার, মোনঘর শিশুসদনের শিক্ষক ও লেখক মৃত্তিকা চাকমা, সাংবাদিক-লেখক হরিকিশোর চাকমা, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা, আদিবাসী বিষয়ক গবেষক তন্দ্রা চাকমা,
আদিবাসী নেতা দীপায়ন খীসা, শিল্পী কালায়ন চাকমা ও ইউপিডিএফের সংগঠক রিকু চাকমাসহ শতাধিক শিক্ষিত চাকমা নর-নারীর কাছে নিজের নামটি নিজের ভাষায় লিখে দিতে বললে মাত্র দু’জন সক্ষম হলেন। এই দু’জনের একজন শিক্ষক ও লেখক মৃত্তিকা চাকমা, অন্যজন ইউপিডিএফ নেতা রিকু চাকমা।”
তাহলে দেখা গেল, আমরা চাকমা ভাষা ও বর্ণমালার ব্যবহার নিয়ে কোন কালে গভীরভাবে চিন্তা করিনি। হয়ত চিন্তা করলেও তা ছিল অপ্রতুল। যারফলে যা হবার তাই হয়েছে। ভাষাটা হয়ে গেছে বাংলার উপভাষা, অক্ষরগুলোও হয়েছে এলোমেলো।
১৮৯৮ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ার্সন(George Abraham Grierson) যখন ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষাগুলো নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন তখন তিনি আমাদের স্বতন্ত্র চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা বানিয়ে দেন।
তিনি আবার কুটনৈতিকভাবে বলে গেলেন যে আমাদের চাকমা ভাষাটা স্বতন্ত্র ভাষা হওয়ার দাবি রাখে। তিনি যতটা আমাদের ভাষাকে দরদ দেখিয়েছেন ততটা আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছেন। চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা করার যুক্তি দিয়ে তিনি বললেন যে বাংলার সাথে অনেক শব্দের মিল।
কিন্তু তিনি কি অহমিয়া ভাষার ক্ষেত্রে তা দেখতে পাননি? অথবা ওড়িয়া ভাষার ক্ষেত্রে? অহমিয়া, ওড়িয়া ভাষার সাথে বাংলার যে সম্পর্ক সেরূপ চাকমা ভাষার সাথে বাংলার। কই সেসব ভাষাতো বাংলার উপভাষা হল না।
বরং সেগুলো এক একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে আজ মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে। আধুনিক ভাষা গবেষক দীনেশরত্ন প্রভাকর সিদ্ধার্থের মতে- “ভাষাগত নিগ্রহের সূচনা হয়েছে গ্রিয়ার্সনের ভূল রিপোর্টে এবং গবেষণা ব্যাপারে তার স্বচ্ছ জ্ঞান ও সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব ছিল।”
এ বিষয়ে রাজীব নূর তাঁর প্রাগুক্ত প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদারের একটি মন্তব্য তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি লিখেন- “…তবে সৌরভ সিকদার নিজে গ্রিয়ারসনের এ বক্তব্য মানতে রাজি নন বলে জানান।
তিনি বলেন, “আমি গবেষণা করে দেখেছি, চাকমা ভাষা বাংলা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র একটি ভাষা।” হ্যাঁ, মিস্টার সিকদারের মন্তব্যে যথার্থতা রয়েছে বৈকি। কিন্তু গ্রিয়ার্সন চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা হিসেবে নথিভুক্ত করে বড় রকমের ভুল করেছিলেনে।
যার কারণে সেই ভুলের বোঝা আজ চাকমাদের বইতে গিয়ে হাঁপাতে হচ্ছে। তবে এটাও অবান্তর নয় যে গ্রিয়ার্সন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব করেছিলেন। কতটা কুটিল হলে একটি জাতিকে এমন কঠিন প্রতারণায় পাতানো যায়।
এর মূলে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বৈরী সম্পর্ক কাজ করেছে বলে মনে হয়। সেই ১৭৭২ থেকে চাকমা জাতির সাথে ইংরেজদের শত্রুতা আরম্ভ হয়েছিল এবং ১৮৫৭তে এসেও এর রেশ কাটেনি বরং আরো প্রকট হয়েছে, রাণী কালিন্দী ও ক্যাপ্তেন টি.এইচ লুইনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব তা সাক্ষ্য দেয়।
তার প্রায় অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে গ্রিয়ার্সনের জরিপ যা তৎকালিন ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ পালনই ছিল একমাত্র কর্তব্য।
তিনি চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা রূপে এভাবে তুলে ধরেছেন-
“In the central portion of the Chittagong Hill Tracts, in the Chakma Chief’s Circle, situated in the country round the Karnaphuli River, a broken dialect of Bengali, peculiar to locality and of a very curious character, is spoken. It is called Chakma, and is based on South-Eastern Bengali, but has undergone so much transformation that it is almost worthy ot the dignity of being classed as a separate language.” ( Linguistic survey of India, Vol-v part 1, page-321)
শেষের লাইনটিতে তিনি চাকমা ভাষার স্বাতন্ত্র্যতা লাভ করবার দরদ দেখালেন।
সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া ‘চাকমা ভাষা গবেষণা ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন-১’ বইতে গবেষক দীনেশরত্ন প্রভাকর সিদ্ধার্থও এ বিষয়টি জোরালো ভাবে তুলে ধরেছেন। গ্রিয়ার্সনের বক্তব্য অনুযায়ী চাকমা ভাষার অবস্থান সম্বলিত নিচের চিত্রটি তিনি এভাবে দেখান।
চিত্র ৮ : গ্রিয়ার্সনের জরিপে চাকমা ভাষা বাংলার উপভাষারও উপভাষা হয়েছে। ছবিটি চাগনিপ্র থেকে নেওয়া হয়েছে।আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষণীয় বিষয় হল আন্তর্জাতিক ভাষা দলিলে মায়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ভাষা স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। অথচ ঐতিহাসিক বিচারে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ বাঙালি বংশোদ্ভুত যাদের ভাষা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার সাথে হুবহু মিল।
এমনকি গ্রিয়ার্সন সাহেবও তাঁর জরিপে (প্রাগুক্ত Introduction- page 19; Section VII. South-Eastern Bengali- page 291) তৎকালীন বার্মায়(আকিয়াব জেলা) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বাংলাভাষীর সংখ্যা ১,১৪,১৫২ জন (১৮৯১ সালের জনসংখ্যা গণনা অনুযায়ী) ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেন-
“…and in the north of the district of Akyab, the last belonging to the province of Burmah, a very peculiar dialect of Bengali is spoken, wich I have named the South-Eastern.” (page 291)।
কিন্তু তিনি চাকমা ভাষাকে যেভাবে বাংলার সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন সেভাবে বাংলাভাষী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কিছু করেননি। ফলশ্রুতিতে আন্তর্জাতিক ভাষা দলিলে সেটি রোহিঙ্গা ভাষা নামে স্বতন্ত্র ভাষার রূপ পেয়েছে।
দলিলে এটি প্রাচীন গৌড়-বঙ্গ ভাষার উপভাষা হলেও সরাসরি আধুনিক বাংলার উপভাষা না হয়ে ভগ্নি স্থানীয় জায়গায় স্থান পেয়েছে যা চাকমা ভাষার চাইতে অনেক উর্ধ্বে। কিন্তু গ্রিয়ার্সন দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা নামে নতুন এক জগাখিচুড়ী বানিয়ে আমাদের স্বতন্ত্র চাকমা ভাষাকে সেটির উপভাষা বানিয়ে দেন।
যা সত্যিই মর্মঘাতী। গ্রিয়ার্সনের ভূল রিপোর্টের কারণে স্বতন্ত্র চাকমা ভাষা হয়ে গেল বাংলার উপভাষা। তাহলে দেখুন, ভাষা নিয়ে রাজনীতির ঘৃণ্য খেলা। তিনি শুধু ভাষাকে নিয়ে ক্ষান্ত হননি চাকমাদের জনসংখ্যা নিয়ে তথ্য বিভ্রাট করে গেছেন।
প্রাগুক্ত গ্রন্থে তিনি চাকমা জনসংখ্যা মোট ২০,০০০ দেখিয়েছেন অথচ তার বিশ বছর আগেও ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে চাকমা জনসংখ্যা ছিল ২৮,০০০ জন (Report on the Census of Bengal 1872, p-181)।
চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা শুধু গ্রিয়ার্সনই নন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনা রিপোর্টে ভাষাভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে চাকমাদের বাংলাভাষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (Census of India, 1901, Vol.VIA, part II, p-138)।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে হাস্চিনসনও( R.H. Sneyd Hutchinson) তাঁর লিখিত An Account of The Chittagong Hill Tracts গ্রন্থের ১৮ পৃষ্ঠায় চাকমা ভাষাকে শুধু বিকৃত বাংলা বলেননি অক্ষরগুলোও বিকৃত বার্মিজ অক্ষর বলে মন্তব্য করেন। তিনি লিখেন- “The dialect is Chakma, and is a corrupt form of the Bengali language written is corrupt Burmese.”
১৮৬৯- ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্তেইন টি,এইচ লুইনও তাঁর লিখিত দুটি গ্রন্থ যথাক্রমে The Hill Tracts of Chittagong and The Dwellers Therein (p.65) এবং Wild Races of South-Eastern India (p.165)-তে চাকমারা জারজ(বিকৃত) বাংলায় কথা বলেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি চরম তাচ্ছিল্যের সুরে লিখেন- “…ignorant of Bengallee, a bastard dialect of which is spoken by the tribe at large.” ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সতীশ চন্দ্র ঘোষও তার লিখিত ‘চাকমা জাতি’ গ্রন্থের ২৫৭ পৃষ্ঠায় একই মন্তব্য করেন।
তিনি লিখেছেন- “চাকমাদিগের মূল ভাষা বাঙ্গালা; তবে ইহা প্রচলিত বাঙ্গালার তুলনায় নিতান্ত বিকৃত, এবং সংক্ষিপ্ত কম নহে। ইংরাজ রাজপুরুষেরা ইহাকে ‘চাকমা-বাঙ্গালা’(The language is Chakma Bengali) নামে অভিহিত করিয়াছেন।”
কালে কালে এভাবে আমরা প্রতারিত হয়েছি। সংখ্যালঘু জাতি হওয়ার কারণে সংখ্যাগুরু জাতিরা অনেক হেয় করতে মজা পায়। সুকৌশলে তাঁরা আমাদের বাঙালি বানাতে চেয়েছিলেন। আমাদের ভাষাকে বাঙলা বানিয়ে দিয়েছেন।
তাঁদের সেই সূত্র ধরে শেখ মুজিবর রহমানও আমাদের বাঙালি হয়ে যেতে বলেছিলেন। যদিও বাঙালি হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে সংসদে ওয়াকআউট করেছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। সেটা ছিল জুম্ম জাতিকে বাঙালি বানানোর তীব্র প্রতিবাদ।
কিন্তু চাকমা ভাষাকে যে বাঙলা বানানো হয়েছে তার প্রতিবাদ আদৌ কেউ করেনি। এযাবৎ অনেক চাকমা গবেষক জাতি ও ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছেন কিন্তু তারাও কোন প্রতিবাদ করেনি। রাজারাও করেনি, রাজনৈতিক নেতারাও করেনি।
কেউই এর বিহিত ব্যবস্থা নেয় নি। তার কারণ কি? হয়ত তেমন চেতনা তখনও উৎপন্ন হয়নি। অথবা উৎপন্ন হলেও জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেভাবে বাংলাদেশ সংবিধানে বাঙালিত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের এই অক্ষমতার কারণে দেশি বিদেশী অনেক গবেষক চাকমা ভাষাকে স্থায়ী রূপে বাংলার উপভাষা বানিয়ে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ভাষা দলিলে চাকমা ভাষা এখন বাংলার উপভাষা।
সারা বিশ্বের মানুষ জেনেছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা নামে একটি বাঙালি উপজাতি আছে যারা বাংলা উপভাষায় কথা বলে। পাঠকবৃন্দ, এখন চিন্তা করেন মজাটা কেমন। রাগ করছেন? ভাষা যার উপভাষা সে উপজাতি হবে না তো কে? সুতরাং রাগ করবেন না। ঠান্ডা মাথায় ভাবুন, কি করবেন।
ব্রিটিশরা যেমন হিন্দি-উর্দু এ দুই ভাষার মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিয়েছিল এবং সেই জেরে দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। অনুরূপভাবে চাকমা ও বাংলা ভাষার মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দেওয়ারও একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা হল চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা বানানো। বাঙালিরাও অবশ্যই সেই সুযোগকে হাতছাড়া করেনি। তারা খুব সহজে সেটা কাজে লাগিয়েছে। আজ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য বইসহ অনেক গবেষণামূলক গ্রন্থে চাকমা ভাষাকে বাংলার উপভাষা হিসেবে উপস্থাপন করে চলেছে বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠী। আর এটি কিন্তু একদম গভীরে শিকড় প্রতিস্থাপিত হয়েছে যা অতি সহজে আল্গা করবার নয়।
যদিও ইদানিং প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে চাকমা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের একটা নগণ্য সুবিধা দিতে চলেছে সরকার। আদতে সেটা নিয়ে এত খুশি হওয়ার কারণ নেই। বরং উপভাষার বিষবৃক্ষকে আরো গভীরে প্রোথিত করার একটি মোক্ষম হাতিয়ার বটে। যতক্ষণ না এই উপভাষা নামক নর্দমা থেকে উঠে আসা যাবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের খুশি হওয়ার নেই।
চাকমা অক্ষরগুলো কয়েক বছর আগে ডিজিটালাইজেশন বা কম্পিউপটারে প্রতিস্থাপন হলেও এর ব্যাপক ব্যবহার তেমন ছিলনা। তবে ইদানিং চাকমা ভাষা ও লিপির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়হারে বেড়েছে বলা যায়।
চাকমা লিপি শিক্ষাকেন্দ্র যেমন অনেক সৃষ্টি হয়েছে তেমনি শিক্ষার্থীও যথেষ্টে বেড়েছে। ইদানিং চাকমা অক্ষরে পত্রিকা, গ্রন্থসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যানার লেখা হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য মঙ্গলজনক বলা যায়।
প্রাণ ফিরে পেতে চলেছে আমাদের প্রাণের ভাষা চাকমা ও হীরের টুকরো চাকমা বর্ণমালা। এইতো কয়েক বছর আগে ভদন্ত করুণা বংশ ভিক্ষু চাকমা অক্ষরে ‘মহাসতিপট্ঠান সূত্র’ নামে একটি বই লিখেছেন এবং সমগ্র পালি ত্রিপিটক চাকমা অক্ষরে লিখেছেন যা পিডিএফ ভার্সনে http://www.kalpataruboi.org নামক ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
তারপর ভদন্ত ভিক্ষু তি. রত্তন জোতি ‘ধম্মপদ’ ও ‘সুদোম কধা’ নামে দুইটি বই লিখেছেন। কবি আলোময় চাকমা ‘মনকধার ফুলবারেং’ নামে লিখেছেন একটি কবিতার বই। ‘করোদি’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশিত হয়েছে।
তাছাড়া ইন্টারনেটে চাকমা বর্ণমালায় লেখা আমার ব্যক্তিগত ব্লগ http://www.meyerega.wordpress.com এবং http://www.potpotteblog.wordpress.com নামে অন্য একটি ওয়েবসাইট আছে। পরিপূর্ণভাবে না হলেও প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ সফলতার সাথে এখন ইন্টারনেটে চাকমা অক্ষরগুলো লেখা যায়।
জ্যোতি চাকমা ও সুজমরিজ চাকমার কল্যাণে আজ চাকমা অক্ষরগুলো বিশ্বের দুয়ারে অবস্থান করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের কারণে আন্তর্জাতিক দলিলাদিতেও চাকমা অক্ষরগুলো বিলুপ্ত তকমা থেকে উঠে এসে নতুনমাত্রায় জীবিত হয়ে উঠেছে এবং
ভাষাটাও সংকটাপন্ন শ্রেণী থেকে ক্রমবর্ধনশীল শ্রেণীতে জায়গা পেয়েছে। তারপরেও জনসংখ্যার অনুপাতে চাকমা ভাষা চর্চাকারী নিতান্ত কম বলা যায়।
আজ থেকে একশত বছর আগে যেখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ১,৩২১ জনে চাকমা লিপিতে লিখতে ও পড়তে পারত সেখানে আজ ছয় লাখের মত জনসংখ্যার মধ্যে ১,০০০ জন পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
তাই চাকমা লিপি ও ভাষার ব্যবহার ব্যাপকহারে বাড়াতে হবে। এর জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর জোর দিতে হবে, লেখক, সাহিত্যিকদের সম্পৃক্ততা আরো জোড়ালো করতে হবে।
ছাত্র-যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয়গুরু ভান্তেরাও এর ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এখন থেকে কাজ আরম্ভ করতে হবে। চাকমা বর্ণমালায় যেন সকলে লিখতে পড়তে পারে এর জন্য সমাজে তৃণমূল পর্যায়ে বিপ্লব আনতে হবে।
আমরা আমাদের স্বতস্ফুর্ত ভাষা প্রেমের মাধ্যমে চাকমা ভাষার পূর্ণাঙ্গ মর্যাদা পেতে পারি। সরকারের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকলে আমরা কখনো মর্যাদা পাবো না। মনে রাখতে হবে এটি একটি আন্দোলন, ভাষার আন্দোলন।
অধিকার কেউ কাউকে দেয়না, তা আদায় করে নিতে হয়, ইতিহাস তাই বলে। প্রাচীন বৈদিক-সংস্কৃত ভাষার একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে বুদ্ধ সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলন করেছিলেন। তিনি তৎকালিন জনগণের ভাষা পালি বা মাগধি ভাষার মাধ্যমে তাঁর ধর্ম প্রচার করেছিলেন।
বুদ্ধ ভাষা সম্পর্কে তাঁর শিষ্যদের জন্য বিনয় বা আইনও তৈরি করেছিলেন। সে সময় যমেড় ও তেকুল নামক দুইজন ব্রাহ্মণবংশীয় ভিক্ষু বুদ্ধকে তাঁর বাণীগুলো ছন্দে আরোপন বা সংস্কৃত ভাষায় প্রচার করার কথা জানালে বুদ্ধ তাঁদের মোঘপুরুষ বলে ভর্ৎসনা করেন
এবং ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে বলেন- “ভিক্ষুগণ! বুদ্ধবচন ছন্দে আরোপন করতে পারবে না। যে আরোপন করবে তার “দুক্কট” অপরাধ হবে। ভিক্ষুগণ আমি অনুজ্ঞা করছি, স্বীয় ভাষায় বুদ্ধ বচন শিক্ষা করবে।” (বিনয় পিটক- চুল্লবর্গ, পৃষ্ঠা নং ২৪২)।
সুতরাং বুদ্ধের এই বাক্যে প্রতীয়মান হয় যে তিনি ভাষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে খুবই সোচ্ছার ছিলেন। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা অন্যান্য ভাষাগুলোকে দাবিয়ে রাখার জন্য জঘন্য ফতোয়া জারি করতে দ্বিধা করেনি। তারা বেদ, পুরাণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থগুলো অন্য ভাষায় পাঠ করলে রৌরূব নামক নরকে যেতে হয় বলে প্রচার করে।
তাদের ভাষায়- “অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ, ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।” (বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ১ম খণ্ড- দীনেশ্চন্দ্র সেন, ১১৫ পৃঃ) অর্থাৎ যারা মানব সৃষ্ট ইতর ভাষায় অষ্টাদশ পুরাণ, রামায়ণসহ ধর্মীয় গ্রন্থগুলো পাঠ এবং শ্রবণ করবে তারা রৌরূব নামক মহানরকে পতিত হবে।
কিন্তু তাদের এই ফতোয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উক্ত গ্রন্থগুলি বাংলাসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করা হয়। শ্রী চৈতন্যদেবও তাঁর বৈষ্ণব ধর্ম বাংলা ভাষায় প্রচার করেছিলেন।
পরিসমাপ্তি : পরিশেষে ডারউইনের ভাষায় বলতে চাই, ‘survival of the fittest’ বা ‘যোগ্যরাই টিকে থাকে।’ অস্তিত্ব রক্ষার্থে নিজেদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। আমি তরুণদের বলছি। এসো, দেখো।
এ সময় চোখবুজে থাকার নয়, এ সময় জেগে উঠার, বিশ্বকে জানবার, ইতিহাসকে মন্থন করবার। আমাদের পূর্বসূরীরা অনেক হাঁপিয়ে গেছে। তাই তাদের জায়গায় আমাদের নবীনদের আসতে হবে।
আজ আমরা জাতিগত, সাংস্কৃতিগত অস্তিত্ব সংকটে ভুগছি। আমাদের নিজের পরিচয় এখন আমরা নিজে দিতে পারছি না। রাষ্ট্র তার ইচ্ছামত আমাদেরকে কখনও বাঙালি, কখনও উপজাতি আর কখনও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি বলে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে।
ভাষার প্রশ্নে সেই একই বাংলার উপভাষা। সুতরাং আমাদের জাগতে হবে। ভাষা আমাদের মা ভাষা আমাদের জীবন। মায়ের উপর এত অত্যাচার, শ্লীলতাহানী দেখে যে সন্তান চোখ বুজে থাকে সে সন্তান্তের মৃত্যু হওয়া শ্রেয়।
সে রক্তহীন এক অপদার্থ। কিন্তু আমরা মরতে পারি না, কিংবা অপদার্থ হতে পারি না। আমরা আজ প্রত্যেকেই শপথ নেব ভাষা রক্ষার শপথ। আমরা আমাদের নিজস্ব অক্ষরগুলো শিখব, নিজস্ব অক্ষরে লিখব। ভাষার রক্ষার্থে যা কিছু করতে হয় করব।
লেখক: মেয়েরেগা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার।
বিঃদ্রঃ লেখাটি এর আগে ফেসবুকে নোট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র :
- ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ ও ড. আবু নোমান- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের ইতিহাস
- সতীশচন্দ্র ঘোষ- চাকমা জাতি
- বিরাজ মোহন দেওয়ান- চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত
- উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি- উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা ১ম ও ২য় খন্ড
- দীনেশরত্ন প্রভাকর সিদ্ধার্থ ও বিজয়গিরি চাকমা- চাকমা ভাষা গবেষণা ও নিরীক্ষা প্রতিবেদন ১
- অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো- ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চাকমা জাতির প্রতিরোধ সংগ্রাম
- সুকুমার সেন- ভাষার ইতিবৃত্ত
- দীনেশচন্দ্র সেন- বঙ্গভাষা ও সাহিত্য ১ম খণ্ড
- বিনয়াচার্য ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের- চুল্লবর্গ [বিনয় পিটকের তৃতীয় খন্ধ]
- মাহবুবুল আলম- বাংলা ভাষার ইতিহাস
- মঙ্গল কুমার চাকমা(সম্পাদনা)- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জীবন ও সংগ্রাম
- পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি- পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি, ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭
- ভদন্ত সুনন্দ ভিক্ষু (সম্পাদনা)- ধর্ম সেনাপতি, (রাজগুরু ধর্মরত্ন মহাস্থবির স্মৃতি
- চারণ ও সংঘবন্ধু অজিতা নন্দ মহাথের ৭৮তম জন্ম জয়ন্তী স্মারক ২০১৪)
- দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৭
- দৈনিক সমকাল, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৫
- G.A. Grierson- Linguistic Survey of India, vol-V part-I
- Yegar Moshe – The Muslim of Burma: A study of minority group
- H. Beverley- Report of The Census of Bengal 1872
- C.J. O’donnell, M.A- Census of The Lower Provinces of Bengal 1891
- E.A. Gait P.S.S- Census of India, 1901, Vol.VIA, part II
- Cap. T.H. Lewin- The Hill Tracts of Chittagong and Dwellers Therein
- R.H. Sneyd Hutchinson- An Account of The Chittagong Hill Tracts
- Cap. T.H Lewin- Wild Races of South-Eastern India
- M.A Tahir Ba Tha- A Short Story of Rohingya and Kamans of Burma
- https://www.multitree.org
- https://www.glottolog.org
- https://www.ethnologue.com
- https://www.wikipedia.org
- http://www.somewhereinblog.net
- https://www.amarblog.com
- https://www.blog.mukto-mona.com
- http://www.archive.dhakatribune.com
- https://www.mainstreamweekly.net
- http://www.sachalayatan.com
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।