ভাষা, হরফ ও জাতীয়তা
833
ত্রিপুরাদের […] মধ্যে প্রচলিত একটি লোককাহিনী অনুযায়ী একদা তাদের নিজস্ব হরফ ছিল। সেগুলো লেখা ছিল শিমগাছের পাতায়।[†] একদিন একটা ছাগল হরফ-লেখা পাতাগুলো খেয়ে ফেলে।
ঠিক একই ধরনের একটা কাহিনী ম্রো জনগোষ্ঠীর […] মধ্যেও প্রচলিত রয়েছে, যাদের বেলায় হরফ-লেখা পাতাগুলো খেয়ে ফেলে একটি গয়াল।
এ ধরনের কাহিনীর কোনো নিগূঢ় অর্থ আছে কিনা তা মিথ-বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
তবে অন্তত একটা দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়, তা হল, ‘অক্ষরসমৃদ্ধ’ একাধিক সংস্কৃতির প্রান্তিক সীমানায় অবস্থিত ত্রিপুরা বা ম্রোদের মত ‘অক্ষরবিহীন’ সমাজের সদস্যদের কাছে তাদের ‘নিজস্ব’ কোনো হরফ না থাকার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি মনে হতেই পারে।
অন্তত আমি নিজে, শৈশবে বাংলায় অক্ষরজ্ঞান শিখতে শুরু করার পর থেকে, এ ধরনের প্রেক্ষাপটেই ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রচলিত কাহিনীটা শুনে এসেছি।
এ প্রসঙ্গে আমি নিজেদের ভাষার কোনো লিখিত রূপ না থাকার বিষয়টি একটা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য কি ধরনের সংকট সৃষ্টি করতে পারে, সে বিষয়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে কিছুটা আলোকপাত করব।
আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের অনেকগুলোতেই জাতীয়তাবাদের প্রধান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধানতম ভিত্তি হল ভাষা।
এ ধরনের রাষ্ট্রের একটা তালিকা দাঁড় করালে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই প্রথম সারিতে থাকবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও জাতীয়তাবাদের প্রধান উৎস যে ছিল ভাষা আন্দোলন, এ বিষয়ে সম্ভবত বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
এ দেশে বাঙালির (অন্তত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটা বড় অংশের) আত্নপরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে বাংলা ভাষা নিয়ে তার অহংকার, এ ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার সংগ্রামের ইতিহাস।
এক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা তার কাছে শুধুমাত্র কতগুলো ধ্বনিবাচক প্রতীক হয়ে থাকেনি, এগুলো হয়ে উঠেছে তার আত্নপরিচয়ের মূর্ত প্রতীক।
হোক না বাংলাদেশের [অনেক] মানুষই এখনো অক্ষরজ্ঞানবঞ্চিত, তবু বাঙালি তার বর্ণমালা নিয়ে গর্ব করতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বাঙালি জনগোষ্ঠীর আশপাশে যেসব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে, যাদের আলাদা ভাষা থাকলেও নেই কোনো ‘নিজস্ব বর্ণমালা’, তাদের ভাষার একটা লিখিত রূপ দাঁড় করানোর তাগিদ দেখা দিলে প্রথম যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিতে পারে, ত হল, এ কাজের জন্য কোন হরফ ব্যবহার করা হবে? বাংলা, রোমান, না অন্য কিছু?
[যেমন] সাম্প্রতিককালে ‘ত্রিপুরা’ জনগোষ্ঠীভুক্ত অনেকের কাছে ঠিক এ প্রশ্নটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে ‘ত্রিপুরা’দের পরিচয় সম্পর্কে খুব সংক্ষেপে হলেও কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার।
‘ত্রিপুরা’ নামটা হল ‘তিপ্রা’ বা ‘টিপরা’র সংস্কৃতায়িত রূপ। বাঙালিরা এককালে যাদের ‘টিপরা বলে জানত (ব্রিটিশদের কাছে Tipperah), তারাই বাংলাদেশে বর্তমানে ‘ত্রিপুরা’ নামে নিজেদের পরিচয় দেয়।
ত্রিপুরাদের ভাষার নাম ‘ককবরক’ (বরকদের ভাষা)।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবশ্য ককবরকভাষীরা দেববর্মা (পুরানতিয়া), নোয়াতিয়া, জমাতিয়া, রিয়াং প্রভৃতি পরিচয়ে বিভক্ত এবং সরকারিভাবে আলাদা আলাদা ‘উপজাতি’ হিসাবে তালিকাভুক্ত।
সেখানে ‘ত্রিপুরী’ বা ‘ত্রিপুরা’ নাম দিয়ে ককবরকভাষীদের সবাইকে বোঝানো হয় না, এগুলো বর্তমানে সচরাচর যথাক্রমে দেববর্মা ও নোয়াতিয়াদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
ককবরকভাষীদের সবাইকে একত্রে বোঝানোর জন্য ‘বরক’ নাম ব্যবহার করা যেতে পারে, অনেকে করেও, তবে এক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা রয়েছে।
নামকরণের এসব সমস্যার বিস্তারিত পর্যালোচনায় না গিয়ে আমি এখানে ‘ত্রিপুরা’ আর ‘ককবরকভাষী’কে মোটামুটি সমার্থক হিসাবেই দেখব, যদিও একথা উল্লেখ করা দরকার যে, বংশগতভাবে ‘দেববর্মা’ (যাদের অনেকে ‘দেববর্মণ’ উপাধিও ব্যবহার করে, যেমন সঙ্গীতকার শচীন দেববর্মণসহ ত্রিপুরার রাজবংশের লোকেরা) বা ‘ত্রিপুরা’ হলেও ককবরক ছেড়ে বাংলা বা অন্য কোনো ভাষাকেই প্রথম ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছে, এ রকম পরিবারের সংখ্যা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ও বাংলাদেশে একেবারে কম নয়।
বাংলাদেশে রাঙামাটি এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাসরত অধিকাংশ ত্রিপুরাই মূলত চাকমাভাষী, তবে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ত্রিপুরাদের প্রথম ভাষা এখনো ককবরকই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরেও চট্টগ্রাম, বৃহত্তর কুমিল্লা ও সিলেট প্রভৃতি অঞ্চলে বেশ কিছু ত্রিপুরা বা ককবরকভাষী জনপদ রয়েছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ককবরকভাষীদের সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি হবে এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এ সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক হবে।
লিখিতরূপে ককবরকের চর্চার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়।
ত্রিপুরার মাণিক্য উপাধিধারী রাজারা ঐতিহাসিকভাবে ‘টিপরা’ জনগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হলেও ককবরককে লিখিত রূপ দেওয়ার কোনো চেষ্টা করেন নি।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, পঞ্চদশ শতাব্দী বা তারও আগে সূচিত ‘সংস্কৃতায়ন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ত্রিপুরার রাজবংশের উপর ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ প্রভাব পড়েছিল ত্রিপুরা রাজ্যে (ব্রিটিশ আমলে ‘পার্বত্য ত্রিপুরা’ নামে চিহ্নিত ভূখন্ড যা একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল, বর্তমানে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য) [যেখানে] বাঙালিদের অভিবাসনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকে রাজাদের প্রত্যক্ষ উৎসাহে।
ত্রিপুরার রাজারা নিজেদের ‘চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয়’ হিসাবে [প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ব্রাহ্মণদের সহায়তায়, এবং রাজ্য পরিচালনায় ব্রাহ্মণ ও] কায়স্থদের সহায়তা নিয়েছি[লেন]।
ককবরকের এই উপেক্ষিত অবস্থার পাশাপাশি ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙালিদের অভিবাসনের যে প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের জের হিসাবে বিপুলসংখ্যক বাঙালি হিন্দুর ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ, ফলে ১৯৪৯ সালে রাজ্যটি আনুষ্ঠানিকভবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর মূলত বাঙালিদের হাতেই এ রাজ্যের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলে যায়।
এভাবে খোদ ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরকভাষীরা সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
কালক্রমে বাংলাই হয়ে ওঠে ত্রিপুরার রাজভাষা, বাংলাভাষীদের মূল ভূখন্ডে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভের বহু আগেই। অন্যদিকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ককবরক মূলত একটি কথ্য ভাষাই থেকে যায় এবং রাজপরিবারসহ শহুরে অনেক ‘দেববর্মা’ পরিবারে কথ্য ভাষা হিসাবেও বাংলাই ক্রমশ জায়গা করে নেয়।
অবশ্য বেশ অনেক বছর হল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এ ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
আমি ১৯৯১ সালে একবার আগরতলা বেড়াতে গিয়ে অনেক সরকারি-বেসরকারি ভবনের সামনে ককবরকে লেখা সাইনবোর্ড দেখে চমৎকৃত ও আনন্দিত হয়েছিলাম।
সবচেয়ে ভাল লেগেছিল ককবরকে সাহিত্যচর্চার প্রসার দেখে।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত ককবরকে লেখা এবং ককবরক সংক্রান্ত বেশ কিছু বইপত্র আমি তখন জোগাড় করেছিলাম।
ককবরকে লেখা বইপত্রের মধ্যে কোনোটা ছিল বাংলা হরফে লেখা, কোনোটা রোমান হরফে, কোনোটা মিশ্র।
স্পষ্টতই তখন পর্যন্ত ত্রিপুরার ককবরকভাষীদের মধ্যে অনেকেই মনঃস্থির করে উঠতে পারে নি কোন্ লিপি তারা বেছে নেবে।
সরকারিভাবে বাংলা হরফই ব্যবহৃত হওয়ার কথা, কিন্তু ককবরকভাষীদের মধ্যে অনেকেই রোমান হরফ ব্যবহারের পক্ষপাতী, যা একটা রাজনৈতিক দাবিতেও পরিণত হয়েছে।
আমরা যারা বাংলাদেশে আছি, তারাও ধীরে ধীরে এই লিপিবিতর্কে জড়িয়ে পড়ছি।
বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অল্পসংখ্যক যারা ককবরক কবিতা-গল্প ইত্যাদি লেখে, তারা মূলত বাংলা লিপিই ব্যবহার করে এসেছে এ পর্যন্ত।
তবে ইদানীং বেশ কিছু প্রকাশনায় রোমান লিপিতি লেখা [গল্প], কবিতা প্রভৃতির সাক্ষাত নিয়মিতই মিলছে।
অর্থাৎ ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরকভাষীদের মধ্যে রোমান হরফ ব্যবহারের যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তার প্রভাব বাংলাদেশেও এসে পড়ছে।
এদিকে [১৯৯৭ সালের ‘শান্তি চুক্তি’র পর] পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত [ও পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ পুনর্বিন্যস্ত] হওয়ার পর ভবিষ্যতে অন্তত প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে ‘পাহাড়ি’ ভাষাসমূহ পড়ানোর ব্যবস্থা করা হতে পারে, এ রকম একটা সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ত্রিপুরাদের মধ্যে অনেকে ভাবতে শুরু করেছে, ককবরকের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন্ লিপি ব্যবহার করা সর্বোত্তম হবে?
এ ধরনের প্রশ্ন অন্যান্য পাহাড়ি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও কমবেশি প্রযোজ্য, যেমন চাকমা ও মারমাদের ‘নিজস্ব হরফ’ (বর্মীর [অনুরূপ]) রয়েছে।
তাদেরও ভাবতে হচ্ছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই হরফ ব্যবহার করা হবে, নাকি বাংলা বা রোমান?
এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যাদের ভাষা, তারাই ঠিক করুক কোন্ লিপি ব্যবহার করা তাদের জন্য সর্বোত্তম হবে।
কিন্তু এ বিষয়ে ভেবেচিন্তে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হলে মুদ্রণপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে ভাষাতাত্ত্বিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বহু অনুষঙ্গ তলিয়ে দেখার দরকার পড়ে।
নিজেদের ভাষায় লিখতে ও পড়তে অনভ্যস্ত একটা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের কর্তৃত্ব নিয়ে কথা বলার লোক খুব কম থাকাটাই স্বাভাবিক।
আর সীমিতসংখ্যক যেসব ব্যক্তি নিজেদের উদ্যোগে মাতৃভাষার লিখিত চর্চার সঙ্গে যুক্ত, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে ভাষার একটা আদর্শ লিখিত রূপ দাঁড় করানোর ব্যাপারে তাদের ধ্যান-ধারণা ও মতামতগুলোতেও নানান সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।
ঠিক এ রকম প্রেক্ষাপটেই ককবরকের লিখিত চর্চা শুরু হয়েছিল, ফলে ককবরকভাষীরা নিজেরা লিপি নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারে নি।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ হিসাবে এ বিষয়ে যারা মতামত দিয়েছেন বা দিয়ে চলছেন, তাদের অধিকাংশই জন্মসূত্রে ককবরকভাষী নন।
লিপি নির্বাচনের প্রশ্নে এ ধরনের বেশ কয়েকজনের অভিমত পর্যালোচনা করে আমি দেখেছি যে, বাঙালি ককবরক বিশারদরা সবাই রোমান হরফের বিপক্ষে এবং বাংলা হরফের পক্ষে মতামত দিয়েছেন, যদিও ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ রকম পক্ষপাতিত্বের কোনো ভিত্তি নেই।
নীচে উদাহরণ হিসাবে এ রকম কয়েকজনের অভিমত আমি তুলে ধরব।
তবে তার আগে ককবরকভাষীদের লিপি নির্বাচনের সমস্যা ও এ সংক্রান্ত বিতর্ক সম্পর্কে আমি কতটুকু কী জানি, কীভাবে জানি, এ বিষয়ে আমি কেন আগ্রহী, এসবের প্রেক্ষাপট এখানে খানিকটা বলে নিলে ভাল হয়।
আমি একটি ককবরকভাষী ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম এবং ককবরকভাষী হিসাবেই আমার শৈশব শুরু হয়।
কিশোর বয়স থেকে আমি ককবরকে লেখালেখি করতে আগ্রহী ছিলাম।
যেহেতু ককবরক চর্চার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না, নিজের মত করে বাংলা হরফ ব্যবহার করে ‘উচ্চারণ’ অনুযায়ী ককবরক লিখতে গিয়ে অনেক সময়ই বুঝতে পারতাম না কোন্ শব্দ কোন্ বানানে লিখলে সবচেয়ে ভাল হবে।
পরে আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাষাতত্ত্বের উপর কিছু পড়াশুনা করি এবং ককবরকের মূল ধ্বনিগুলো (phonemes) চিহ্নিত করার চেষ্টা করি।
এছাড়া ককবরকের অন্যান্য দিক নিয়েও আমি কিছু কাজ করেছিলাম এবং আমার নিজের জানা শব্দভান্ডারের ভিত্তিতে একটা ‘ফোনেটিক’ অভিধান তৈরির কাজেও হাত দিয়েছিলাম।
আমার এসব কাজ [কিছুক্ষেত্রে] অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত অবস্থাতেই রয়ে গেছে, তাই নিজেকে একজন ককবরক বিশেষজ্ঞ বলে আমি দাবি করতে পারি না, তবে ভাষাতত্ত্বে আমার যে সীমিত প্রশিক্ষণ আছে, তার ভিত্তিতে এবং নৃবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসাবে, সর্বোপরি একজন ককবরকভাষী হিসাবে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎসারিত লিপিবিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকজন ককবরক বিশারদের অভিমত মূল্যায়ন করে নিজেও কিছু মতামত দেব।
আমার সংগ্রহে যেসব ককবরক-বিশারদের বইপত্র রয়েছে, তাদের একজন হচ্ছেন ড. সুহাস চট্টোপাধ্যায়, একজন ভাষাবিজ্ঞানী, যিনি ককবরক নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং ‘ত্রিপুরার কগ্বরক ভাষার লিখিতরূপে উত্তরণ’ নামে একটি বই লিখেছেন।
এ বইয়ে তিনি ককবরকভাষীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন এবং দ্বিভাষিতার কথা বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য বাংলা বর্ণমালাই বেশি গ্রহণযোগ্য বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন।
একই ধরনের অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে মোহন চৌধুরী ও অনাদি ভট্টাচার্য নামে দু’জন বাংলাভাষী ককবরক-বিশারদের লেখায়।
ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে ককবরকভাষীদের বাংলা শেখা প্রয়োজন বটে, তবে বাংলা শেখার প্রয়োজন এক জিনিস আর ককবরক লেখার জন্য বাংলা লিপি বেছে নেওয়াটা অন্য জিনিস।
বাংলা হরফে ককবরক লিখতে অভ্যস্ত কারো পক্ষে বাংলা লেখা/পড়া/বলার ক্ষেত্রে যে খুব বড় সুবিধা হবে, তা নয়।
আর বাড়তি সুবিধা যদি কিছু থাকেও, তাহলে একই যুক্তিতে রোমান হরফ বেছে নেওয়া হলে তা ককবরকভাষীদের ইংরেজি শেখার বেলায়তো কাজে লাগবে।
সাধারণভাবে বলা যায়, যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলা লিপির পক্ষে ওকালতি করেন, তারা মূলত ককবরকভাষীদের জন্য বাংলা শেখা অপরিহার্য ধরে নিয়েই তা করেন।
অথচ এক্ষেত্রে ককবরকের স্বাধীন বিকাশের পরিসর যে সীমিত হয়ে যেতে পারে, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
এমনিতে বাংলাভাষী বিশেষজ্ঞরাও এটা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেন যে, দ্বিভাষিতার দিকটা বিবেচনায় না নিয়ে শুধুই একটি অলিখিত ভাষাকে লিখিত রূপ দেওয়ার বিষয়টাকে প্রাধান্য দিলে রোমান হরফই বেশি গ্রহণযোগ্য।
যেমন, মোহন চৌধুরীর মতে, ‘রোমান হরফের ইতিবাচক দিক হল এটি বিজ্ঞানসম্মত।’ যদি তিনি তাই মনে করেন, তাহলে তার বা তার মত অন্যদের রোমান হরফের পরিবর্তে বাংলা বর্ণমালার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণ কী?
একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, যারা বাংলা বর্ণমালার পক্ষে রায় দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে একটা ধারণা ক্রিয়াশীল যে ককবরকভাষীরা রোমান হরফে নিজেদের ভাষায় লিখতে-পড়তে শুরু করলে বাঙালিদের সাথে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক দূরত্ব বেড়ে যাবে।
এ রকম আভাসই মেলে সুহাস চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যে: ‘[হরফ নির্বাচনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হলে] ককবরকভাষীদের সঙ্গে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির দীর্ঘদিনের সম্পর্ক হিসাবে ধরতে হবে।’
মোহন চৌধুরী আরো সরাসরিভাবে কথাটা বলেছেন, ‘[ককবরক লেখার জন্য রোমান হরফ ব্যবহার করা হলে] বাংলার সঙ্গে ককবরকভাষীদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন হবে।’
আমার মনে হয়, এ ধরনের আশঙ্কা অনেকাংশেই অমূলক।
ককবরক লেখার জন্য রোমান হরফ গ্রহণ মানেই এই নয় যে, বাংলা ভাষা বা বাঙালিদের সঙ্গে ককবরকভাষীদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
তবে ঐতিহাসিকভাবে এই সম্পর্ক যে সমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে নি, সেটাও বিবেচনায় রাখা দরকার।
অধিকন্তু যদি বাংলা হরফ কিছুটা জোর করেই ককবরকভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে তা হবে শিক্ষিত বাংলাভাষীদের জাত্যাভিমানের বহিঃপ্রকাশ এবং তাতে বাংলাভাষী ও ককবরকভাষীদের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্বই বাড়বে।
এদিক থেকে অনাদি ভট্টাচার্যের দেওয়া একটা তথ্য আমার কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়।
তিনি জানান যে, বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নাকি বলেছেন, ‘ককবরকের জন্য বঙ্গলিপিই গ্রহণ করা উচিত।
ককবরকের ক্ষেত্রে রোমক বা নাগরীলিপি অবলম্বন করা সমীচীন হইবে না। ইহাতে জাতীয় ক্ষতি হইবে।’
যদি সুনীতি চট্টোপাধ্যায় কথাটা বলেই থাকেন, তাহলে তিনি সেটা বলেছেন যতটা একজন ‘ভাষাবিজ্ঞানী’ হিসাবে, তার চেয়েও একজন ‘বাঙালি’ হিসাবেই।
‘জাতীয় ক্ষতি’ মানে কাদের ক্ষতি?
স্পষ্টতই এখানে বলা হচ্ছে না যে রোমান লিপি গ্রহণ করা হলে ককবরকের বা ককবরকভাষীদের কোনো ক্ষতি হবে।
আর সমগ্র ভারতের কথা বিবেচনা করেও নিশ্চয় সুনীতি চট্টোপাধ্যায় জাতীয় ক্ষতির আশঙ্কা ব্যক্ত করেন নি।
কারণ নাগরী লিপি তো ভারতীয়ই। সেক্ষেত্রে এটির ব্যবহার কেন বিবেচিত হতে পারে না?
যা অনুক্ত রয়ে যায়, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না, তা হল, শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে এই আশঙ্কা কাজ করে যে ককবরকভাষীরা বাংলা ছাড়া অন্য কোনো লিপি গ্রহণ করলে তা তাদের ভাষাভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরো সুসংহত করবে।
বলা বাহুল্য, ককবরকের জন্য কোন্ লিপি ব্যবহার করা হবে, এ ব্যাপারে ককবরকভাষীদের মতামতই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত এবং সেদিক থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে রোমান হরফের দিকেই ইদানীং পাল্লাটা ভারি হচ্ছে বলে আমার ধারণা।
তবে ককবরকভাষীদের মধ্যেও বাংলা লিপি ব্যবহারের পক্ষপাতী লোকের অভাব নেই।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ত্রিপুরার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব (দশরথ দেববর্মা), যিনি জন্মসূত্রে একজন ককবরকভাষী [ছিলেন], একটি পুস্তিকায় লিপিবিতর্কের প্রেক্ষিতে বাংলার পক্ষে তাঁর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।
ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা লিপির পক্ষে দেওয়া তাঁর যুক্তিগুলো খুবই দুর্বল হতে পারে, তবে এ রকম একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও যে লিপিবিতর্কে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাতেই এ বিতর্কের রাজনৈতিক গুরুত্ব ধরা পড়ে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দশরথ দেব একজন সিপিএম নেতা [ছিলেন] এবং সে হিসাবে তিনি হয়ত পার্টির অবস্থানকেই তাঁর পুস্তিকায় তুলে ধরেছিলেন।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরককে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সিপিএমের অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তবে মূলত বাঙালি প্রধান এই দলের নেতৃত্ব যে লিপি নির্বাচনের ব্যাপারে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে ককবরকের জন্য বাংলা লিপি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা বলা যায় না।
চূড়ান্ত বিশ্লেষণে লিপি নির্বাচনের তাৎপর্য প্রতীকী বলেই আমার কাছে মনে হয়।
এমন না যে, বাংলা হরফ ব্যবহার করা হলেই বাংলাভাষী ও ককবরকভাষীদের সম্পর্ক নিবিড়তর হবে, বা রোমান হরফ ব্যবহার করা হলে এ সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
বরং উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান তাই নির্ধারণ করবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি।
বাস্তবে বাংলা বা রোমান হরফ যেটাই ব্যবহার করা হোক না কেন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর মত ককবরকভাষীদের মধ্যে যারা রোমান হরফের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, তারা সেটা করছে তাদের জাতিগত বা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধকে তুলে ধরার জন্যই।
অবশ্য এক্ষেত্রে একজন বাঙালির তুলনায় একজন ত্রিপুরাকে কিছুটা হীনম্মন্যতায় ভুগতেই হবে।
একজন নিরক্ষর বাঙালিও গর্ব করে বলতে পারে, ‘আমাদের নিজস্ব বর্ণমালা আছে, তোমাদের তা নেই।’
সেক্ষেত্রে একজন জাত্যাভিমানী ত্রিপুরার সামনে একটাই পথ খোলা থাকে, ছাগলের পেট কেটে হারানো বর্ণমালা উদ্ধারের চেষ্টা করা।
বস্তুত বাংলাদেশেই অন্তত তিনজন ব্যক্তির কথা আমার জানা আছে যারা ‘ত্রিপুরা বর্ণমালা’ উদ্ভাবন করেছেন।
এ ধরনের উদ্ভাবিত বর্ণমালার কোনোটাই হয়ত কখনো ব্যাপকভাবে চালু হবে না, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে যে এ ধরনের প্রয়াস চালিয়েছেন বা চালাচ্ছেন, তা থেকে এটাই বোঝা যায় যে, কখনো কখনো বর্ণ শুধু ধ্বনির বাহন হিসাবে কাজ করে না, এগুলো হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের অন্যতম প্রতীক।
ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে বিশেষ অহংকারের দাবিদার একটা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক এই কারণেই ত্রিপুরাদের মত ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকদের লিপি নির্বাচন নিয়ে এত ভাবতে হচ্ছে।
লেখকঃ প্রশান্ত ত্রিপুরা
[*] নিবন্ধটি – যার পূর্ণ শিরোনাম ছিল ‘ভাষা, হরফ ও জাতীয়তা: ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতা’ – প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম আলোতে, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০০০। সম্পাদিত জায়গাসমূহ আয়ত বন্ধনী […] দ্বারা নির্দেশিত।
[†] এই নিবন্ধ প্রকাশের পর ত্রিপুরা সমাজের একজন সুপরিচিত প্রবীণ ব্যক্তিত্ব, রাঙামাটির (প্রয়াত) সুধাংশু বিমল ত্রিপুরা, আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর জানা কাহিনী অনুসারে ত্রিপুরা বর্ণমালা আদিতে লেখা ছিল কলাপাতায়। লোককাহিনীর বেলায় এ ধরনের বিবিধ ভাষ্যের অস্তিত্ব অবশ্য হামেশাই দেখা যায়, কাজেই কোন্ ভাষ্যটা ঠিক, সে আলোচনা অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।