আদিবাসী তাতঁ বস্ত্র শিল্পের পথ প্রদর্শক মঞ্জুলিকা চাকমা

Jumjournal
Last updated Oct 6th, 2020

798

featured image

এক সময় মাত্র পাঁচশ টাকার পূঁজি লগ্নি করে দুটি কোমড় তাঁত কিনে শুরু করা বেইন টেক্সটাইলের মালিক মঞ্জুলিকা চাকমা এখন কোটি টাকার উর্দ্ধে পূঁজির মালিক।

কিন্তু কোটি টাকার পূজিঁর মালিক ও আদিবাসী তাতঁ বস্ত্র শিল্পের বিপ্লব আনার পেছনে রয়েছে তার অনেক মেধা ও শ্রম। এই সংগ্রামী নারী মঞ্জুলিকা চাকমার মেধা এবং কঠোর পরিশ্রমের কারণে আজ একমাত্র এই আদিবাসী তাঁত বস্ত্র শিল্প দেশ-বিদেশে সুপরিচিত ও সমাদৃত লাভ করতে সম হয়েছে। 

মঞ্জুলিকা চাকমা বাবা কালীরতন খীসা ও মা পঞ্চলতা খীসার ঘরে ১৯৪৪ সালে রাঙ্গামাটিতে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ষাটের দশকে ম্যাট্রিক পাশ করে পিটিআই প্রশিন গ্রহন করে কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

তিনি ম্যাট্রিক পাশ করার পর শিকতা শুরু করেন। মঞ্জুলিকা চাকমা শিকতায় অবদান রাখার জন্য ১৯৬৬ সালে তৎকালীন সরকার তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রমের শ্রেষ্ঠ শিক হিসেবে প্রথম পুরুস্কার দেয়।

Manjulika Chakma, Bangladesh Business Award 2003

এরপর একদিকে শিকতা অন্যদিকে সংসার ও সামাজিক কর্মের পাশাপাশি ১৯৬৮ সালে আইএ পাশ এবং ১৯৭৩ সালে বিএ পাশ করেন। তাঁর স্বামীর নাম চিরঞ্জীব চাকমা। বর্তমানে তিনি এক ছেলে ও দুই মেয়ের জননী। ছেলে-মেয়েরা সবাই যে যার অবস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত।

জানা যায়, এক সময় জুমে উৎপাদিত তূলা থেকে আদিবাসী মহিলা নিজেদের ব্যবহারের জন্য তূলা থেকে সূতা বের করে সেগুলো ঘরে বসে পোশাক তৈরী করতেন।

কিন্তু কালের আবর্তে বা সময়ের বির্তনের সাথে সাথে সমতলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলে অনেক পাহাড়ি এসব মোটা কাপড় ছেড়ে মিহি কাপড়ের প্রতি আকৃষ্ট হন।

এতে করে আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের ভাটা পড়তে থাকে। কিন্তু পঞ্চাশ দশকের দিকে আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের পরিবর্তন আসে। সে সময় মঞ্জুলিকা চাকমা মাতা পঞ্চলতা খীসা বাড়ির কোমড় তাঁতে টেবিল ও পর্দার কাপড়, মহিলাদের শালসহ ইত্যাদি কাপড় তৈরী করে সরকারী কর্মকর্তাদের কাছে করতেন।

এভাবে কাপড় বিক্রি করার সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল করিম নজরে পড়ে যায়। জেলা প্রশাসক তার কাপড়ের মুগ্ধ হয়ে আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের বিকাশে উৎসাহ দেন। সেই থেকে এই আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের নতুন যাত্রা শুরু হয়।

মঞ্জুলিকা চাকমা ছোটবেলা থেকে লোকজ সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি তার বাবার তত্ত্বাবধানে এবং মায়ের উৎসাহ ও প্রেরনায় সাধারন প্রাতিষ্ঠানিক শিা অর্জনের নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে আদিবাসী বয়ন শিল্পের বিস্তার ও পরিধির সম্প্রসারণে আধূনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ তাকে আরও বেশী সহায়তা ও সমৃদ্ধি করেছিল।

মঞ্জুলিকা চাকমার মা পঞ্চলতা খীসার কঠোর তত্বাবধানে এবং কঠোর নিষ্ঠা ও একাগ্রতার মধ্য দিয়ে আদিবাসী বস্ত্র শিল্পে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।

পঞ্চাশ দশকে পাহাড়ী জীবনে আধূনিক শিাকে আজকের দিনের মত এটতা প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ন মনে করা হতো না। কিন্তু মঞ্জুলিকা চাকমা ছিলেন অন্যদের থেকে একধাপ এগিয়ে।

১৯৬৫ সালে মাত্র দুটি তাঁত যোগার করে কোমড় তাঁতের বুনন পদ্ধতি হস্তচালিত তাঁতে প্রয়োগ করা এবং ১৯৭৬ সালের দিকে তিনি শিকতা ছেড়ে পুরোপুরি অদিবাসী বস্ত্র শিল্পের উন্নয়নে মনোযোগ দেন, প্রতিষ্ঠা করেন বেইন টেক্সটাইল। মঞ্জুলিকা চাকমা পরীামূলক আদিবাসীদের কোমড়-তাঁতের সাথে আধুনিক তাতেঁ মিশ্রন ঘটান।

মঞ্জুলিকা চাকমা পাহাড়ীদের মধ্যে প্রথম শিল্পোদ্যোক্তা। যে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা তো দূরের কথা ব্যবসা-বানিজ্যের কথাও চিন্তা করতো না।

সে সময় মঞ্জুলিকা চাকমার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এক।মঞ্জুলিকাএকজন আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের সফল ও পথ প্রদর্শক নন, তিনি একজন সমাজ সেবিকাও বটে।

তিনি ১৯৬৫- ১৯৯৮ সাল পর্ষন্ত সমবায় সমিতির সেক্রেটারী ও সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮-১৯৮২সাল পর্ষন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জাতীয় মহিলা সংস্থার সম্পাদিকা ও জেলা পরিবার পরিকল্পনা এসোসিয়েশনের মহিলা সম্পাদিকা ও জাতীয় কাউন্সিলার ছিলেন।

এছাড়াও এশিয়ান উইনিভার্সিটি ফর ওম্যানস্ কনসালটেড গ্রুপের একজন সক্রিয় সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় ও অর্ন্তজাতিক সামাজিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠ হয়ে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি রাঙ্গামাটি নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আন্দোলনের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।

মঞ্জুলিকা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের অন্যন্য অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন জাতীয় পুরুস্কার লাভ করেছেন। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ১৯৮৮-৮৯ বিচিত্রার ঈদ প্রতিযোগিতার পুরুস্কার।

২০০২-২০০৩ সালে আনন্দ ভূবনে ঈদ প্রতিযোগিতার প্রথম পুরুস্কার। ২০০৪ সালে আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য মেলায় ষ্টল স্থাপনের বিশেষ পুরুস্কার। ২০০৫ সালে ডেইলি স্টার ও ডিএইচএল কর্তৃক বিজনেস্ এওয়ার্ড ও সর্ব শেষ আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের অন্যন্য অবদান রাখার জন্য গত ২ অক্টোবর ২০০৫ সালে দৈনিক সমকালের প্রিয় চট্টগ্রাম লাভসহ অসংখ্য পুরুস্কার লাভ করেছেন।

তাছাড়াও তিনি বহুবার বিদেশের মাটিতে তাঁর বেইন টেক্সটাইল থেকে আর্ন্তজাতিক বানিজ্যি, শিল্প মেলায় সাফল্যর সাথে অংশ গ্রহন ছাড়াও বিভিন্ন অর্ন্তজাতিক বিভিন্ন সেমিনারে অংশ গ্রহন করেছেন।

মঞ্জুলিকা চাকমা কর্মজীবনের পরিশ্রমলব্দ সাফল্য খচিঁত- আজকের খ্যাতনামা বেইন টেক্সটাইল তারঁই স্বপ্নের প্রতিফলন। ভগবার বুদ্ধের দর্শনের প্রতি পরম শ্রদ্ধা তাঁর।

জাতিগত ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠানে তন্তগুচ্ছকে গেরুয়া রং এ রঞ্জিত করে এক রাতের মধ্যে সেই বস্ত্র বয়নে অপূর্ব কূশলতা প্রদর্শন করেছেন একমাত্র তিনি। সেই থেকে প্রতি বছর রাজবন বিহারে কঠিন চীবর দান উৎসবের সময় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।

মঞ্জুলিকা চাকমার দূরদৃষ্টি এবং দ ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠা বেইন টেক্সটাইলে বর্তমানে উৎপাদন বিভাগে দুই শতাধিক পুরুষ ও মহিলা কর্মী জড়িত রয়েছে এবং বিভিন্ন এলাকায় ১৫ থেকে ১৬টি বিক্রয় প্রতিষ্ঠান বা শো রুম রয়েছে।

জানা যায়, আজকের পার্বত্য এলাকায় যে সব সুপরিচিত বস্ত্র প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনার, মালিক ও কর্মচারীরা বেইন টেক্সটাইলের হাতেখড়ি নিয়েছিলেন।

এছাড়া তাঁর সাফল্য ও আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের সাফল্য ও সম্ভাবনা দেখে আশির দশকে প্রথম দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গড়ে উঠে বাংলাদেশ কূঠির শিল্প কর্পোরেশন(বিসিক)। যা বিসিকের উদ্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় খোলা হয়েছে আদিবাসী বস্ত্র বিক্রয় ও প্রদর্শনী বিভাগ।

আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের পথ প্রদর্শক মঞ্জুলিকা চাকমা জানান, ঐতিহ্যগত সামগ্রী এবং সংরণ করা তাঁর প্রধান শখ। এছাড়া ভবিষ্যতে একটি ঐতিহ্যগত কর্মশালা স্থাপণ ও অনগ্রসর গ্রামের মহিলাদের নিয়ে পাহাড়ি শিল্পকে ধরে রাখা ও এর সম্প্রসারণ করা তাঁর মূল লক্ষ্য।

তিনি আরও জানান, দেশে-বিদেশে আদিবাসী বস্ত্রের ডিজাইন জনপ্রিয় হয়ে উঠায় তিনি আদিবাসী বস্ত্র তৈরীতে অনেক ক্ষেত্রে পূরণো রীতি ব্যবহার করেন।

তবে যুগের পরিবর্তনের কারণে আধুনিক ডিজাইনও বেশী ব্যবহার করা হয়। তিনি জানান, বস্ত্রের দাম বেশী হরেও তিনি এখন বিমুদ্ধ কোমড়-তাতে ফোর ম্যাট, ডিনার ম্যাট, শাল, ব্যাগ, আদিবাসী মহিলাদের ঐতিহ্যবাহী পরণের কাপড় পিনোন খাদিসহ বেশ কিছু কাপড় তৈরী করেছেন।

আদিবাসী বস্ত্র শিল্প এখন দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমানে সমাদৃত লাভ করেছে। এখন আর আদিবাসী বস্ত্র শিল্প বিলুপ্ত হওয়ার অশংকা নেই।

মঞ্জুলিকা চাকমা আরও জানান, বর্তমানে কিছু কিছু ব্যাংক ক্ষুদ্র ব্যবসার(এসএমই) জন্য ঋণ দিলেও নতুন করে তাঁত কারখানা গড়ে উঠছে না। যারা কাপড়-চোপড় ব্যবসা করছেন তারা তাঁতের কাপড় দিয়ে নয়।

তারা বিভিন্ন স্থান থেকে কাপড় কিনে এনে বুটিক ও ব্লক করে বিভিন্ন রকম ডিজাইন করে বিক্রি করছেন। তিনি জানান, বর্তমানে রাঙামাটিতে তাতঁ শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছে। কারণ রাঙামাটি অীধকাংশ তাঁত শিল্পগুলো বেচা-বিক্রি নির্ভর করে থাকে পর্যটকদের উপর।

কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারনে রাঙামাটিতে পর্যটকের সংখ্যা একবারে কমে যাওয়াতে বিক্রি কম হচেছ। তাছাড়া এই শিল্পের দ কারিগর পাওয়া কঠিন।

আরও পাওয়া গেলেও বেশী টাকা দিতে হয়। তাই সব মিলিয়ে তাঁত শিল্পের অবস্থা খারাপ যাচ্ছে।


মঞ্জুলিকা চাকমা এখন নিজের আলোয় উজ্বল। তিনি এবং তাঁর পূর্বসরি মাতা পঞ্চলতা খীসার বয়ন শিল্পের উন্নয়নে সমর্পিত করে রেখেছেন। সেই সমর্পন উত্তোরত্তর স্বীকৃতি ও সাফল্য ধারায় স্নাত হয়ে আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসে এবং সমাজে তিনি স্মরনীয় হয়ে থাকবেন।

এদিকে, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে জানা যায় এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের তৈরী বস্ত্র শিল্প ছিল অবহেলিত। আর এর জন্য পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ চড়াই উৎরাই ।

ঘটেছে যুগের পরিবর্তন। আর তার সাথে সাথে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে আধুনিক বুনন প্রনালী ও হস্তচালিত তাঁতের আধুনিক যন্ত্রপাতি। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের তৈরী বস্ত্র শিল্প আর অবহেলিত নয়।

বর্তমানে এই শিল্পের সাথে জড়িত থেকে জীবনধারন করছে প্রায় হাজার হাজার নর-নারী। শুধু রাঙামাটি শহর ও আশপাশ এলাকায় প্রায় সাত হাজারের বেশী মানুষ এই শিল্পের সাথে সরাসরি জড়িত রয়েছেন। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই কর্মচারী-শ্রমিক হলেন মহিলা।

খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে গড়ে উঠা প্রায় ৫হাজারের বেশী কারখানায় প্রতিদিন তৈরী হচ্ছে আদিবাসী ডিজাইনের নতুন নতুন পোশাক।

কিন্তু নতুন নতুন ডিজাইনে পোশাক তৈরী হলেও এই শিল্পে রয়েছে নানা সমস্যা। এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা হল কাচাঁমালের অভাব অন্যদিকে রয়েছে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। অন্যদিকে কাচাঁমালের মধ্যে সূতা ও রঙের প্রচুর অভাব। তবে রাঙামাটি শহর থেকে মাত্র ২০কিলোমিটার দূরে  অবস্থিত ঘাগড়া টেক্সটাইল মিল থাকেলও তা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

রাঙামাটি শহরের আদিবাসী বস্ত্র শিল্পের মধ্যে বেইন টেক্সটাইল, বনানী টেক্সটাইল, বয়ন টেক্সটাইল, সজপদর, রাঙাবী টেক্সটাইল, রাঙা টেক্সটাইল ও ক্র্যাফটস্ও নক্সী টেক্সটাইলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান আদিবাসী বস্ত্র শিল্পকে আরও আধূনিকতায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিনিয়ত গবেষনা করে যাচ্ছেন এবং তৈরী করছেন নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক।

তথ্যসূত্র : হিলবিডি২৪/সম্পাদনা/সিআর

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা