বাংলাদেশের মণিপুরী : এক সংক্ষিপ্ত তথ্যচিত্র
1896
বাংলাদেশে বসবাসরত মণিপুরীরা বার্মা (মায়ানমার) – মণিপুর যুদ্ধের সময় পলাতক হয়ে আপন মাতৃভূমি ছেড়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিলো।
আসাম, কাছাড়, ত্রিপুরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বসতি স্থাপনও সেই একই সময়ে। তবে তারও আগে থেকেই। এদেশে মণিপুরী বসতির সূত্রপাত হয় বলে জানা যায়।
বাংলাদেশে মণিপুরী বসতিস্থাপনের সূচনাকাল প্রায় তিন শতাব্দী আগে। মণিপুরীদের মূল বাসভূমি ভারত ও বহ্মদেশের সীমান্তে অবস্থিত এককালের স্বাধীন রাজ্য-বর্তমানে ভারতের অন্যতম রাজ্য ‘মণিপুর’।
অতি প্রাচীনকাল থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই দেশটি বিভিন্ন সময়ে ‘কংলৈপাক’ ‘মীতৈলৈপাক’ ‘পোইরৈ সানা লৈপাক’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো।
কিন্তু ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুররাজ পামহৈবা হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হলে ধর্মপ্রচারক শান্তিদাস গোস্বামীর কথানুযায়ী প্রজাদের জোরপূর্বক হিন্দুধর্ম পালন করতে বাধ্য করান এবং তাদের স্বধর্ম ‘সানামহী ধর্ম’ বা ‘আপোকপা ধর্ম’ পালন নিষিদ্ধসহ তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাদি কংলা-উত্রামাঙ (কংলা রাজপ্রাসাদের সামনে) আগুনে পুড়ে ছাই করে কংলৈ’চাদের বা মীতৈদের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ মহাভারতের বীর যোদ্ধা অর্জুনের বংশধর বলে আর্য বংশীয় পরিচয় দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করা হয়।
পরবর্তীকালে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষাংশে মণিপুররাও ভাগ্যচন্দ্র-এর শাসনামলে মাতৈদের বাসভূমি। ‘মীতৈলৈপাক’ শব্দটির পরিবর্তে ‘মণিপুর’ এবং ‘মীতৈ’ শব্দটির পরিবর্তে মণিপুরী শব্দটি প্রচলনের ব্যবস্থা করেন। তদবধি এই মীতৈ সম্প্রদায় ‘মণিপুরী’ বলে সর্বত্র পরিচিত হয়ে ওঠে।
মণিপুরীরা তাদের নিজেদের মধ্যে ‘মীতৈ’ বলে পরিচিত। মণিপুরী এবং মীতৈ শব্দ দু’টি একে অন্যের পরিচয় বহনকারী শব্দ এবং একই অর্থবোধক।
পূর্বের লুসাই’রা এখন ‘মিজো’ নামে এবং পূর্বের লুসাই পাহাড় এখন মিজোরাম নামে পরিচিত। পূর্বের ‘উৎকলী’রা এখন ‘উড়িয়া’ নামে এবং উৎকল ‘উড়িষ্যা’ নামে পরিচিত।
ঐ একইভাবে পূর্বের ‘মীতৈ’রা এখন ‘মণিপুরী’; পূর্বের ‘মীতৈ ভাষা’ এখন ‘মণিপুরী ভাষা’ এবং মীতৈদের বাসভূমি ‘মীতৈলৈপাক’ এখন ‘মণিপুর’ হিসেবে পরিচিত। এখনও অনেকেই ‘মীতৈ’ ও ‘মণিপুরী’ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে থাকেন।
এই বিভ্রান্তি অপনোদনের লক্ষে নিচে বিষয়টিকে ছক আকারে উপস্থাপন করা হলো:
উদাহরণ–১.
পরিচিতি রাজ্যের নাম জাতিসত্তার নাম ভাষার নাম
পূর্ব পরিচিতি লুসাই পাহাড় লুসাই লুসাই ভাষা
নাম পরিবর্তনের পর মিজোরাম মিজো মিজো ভাষা
উদাহরণ-২
পরিচিতি রাজ্যের নাম জাতিসত্তার নাম ভাষার নাম
পূর্ব পরিচিতি উত্তল উৎকলী উৎকলী ভাষা
নাম পরিবর্তনের পর উড়িষ্যা উড়িয়া উড়িয়া ভাষা
প্রাগৈতিহাসিক কাল অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব অনেক অনেক বৎসর পূর্বে মণিপুর বা তৎকালীন মীতৈলৈপা বা কংলৈপাক-এ অনেক রাজা রাজত্ব করার তথ্য থাকলেও ক্রমানুসারে রাজত্ব করার পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে ৩৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্রমানুসারে রাজার নাম, রাজত্বকাল ও তৎসময় সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী সম্বলিত তথ্যপঞ্জী ‘চৈথারোল কুম্বাবা’ নামক মণিপুর ক্রোনোলজীতে পাওয়া যায়।
মীতৈ বা মণিপুরীরা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত স্বাধীন মণিপুরের স্বাধীন নাগরিক ছিলো। কিন্তু ২৭ এপ্রিল ১৮৯১ তারিখে মণিপুর পুরোপুরি ব্রিটিশ অধীনে চলে যায়।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ নাগপাশ থেকে মুক্ত হলে মণিপুরও তার স্বাধীনতা ফিরে পায়।
পরবর্তীতে ১৫ অক্টোবর ১৯৪৯ তারিখে স্বাক্ষরিত ‘মার্জার এগ্রিমেন্ট’-এর মাধ্যমে মণিপুর ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করে। বর্তমানে মণিপুর ভারতের অন্যতম একটি রাজ্য।
বর্তমানে বাংলাদেশে শুধুমাত্র বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল তথা সিলেট বিভাগেই মণিপুরীদের বসবাস। অবশ্য আগে একসময় ঢাকার তেজগাঁও এলাকা, নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা অঞ্চলেও মণিপুরী বসতি ছিলো।
তবে সেইসব মণিপুরী বসতি এখন বিলীন হয়ে গেছে। মণিপুরীদের প্রধান অংশ বর্তমানে সনাতন (হিন্দু) ধর্মের চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধারার অনুসারী।
তবে মণিপুরীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বী যেমন আছেন, তেমনি আছেন মণিপুরীদের আদি ধর্ম ‘সানামহী ধর্ম’ বা ‘আপোকপা’ ধর্মের অনুসারী এবং কিছু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীও।
বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের যেসব গ্রামে মণিপুরী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস তার একটি তালিকা জেলা ও উপজেলাওয়ারী ভিত্তিতে নিচে দেওয়া হলো।
সনাতন (হিন্দু), সানামহী বা আপোকপা ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মণিপুরী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রাম বা পাড়াসমূহ:
সিলেট জেলা : সিলেট শহর ও শহরতলীর ১. মণিপুরী রাজবাড়ী, ২. লামাবাজার, ৩. লালদিঘীরপাড়, ৪. নরসিংহটিলা (বাগবাড়ী), ৫. সাগরদিঘীরপাড়, ৬. কেওয়াপাড়া, ৭. নয়াবস্তী, ৮. আম্বরখানা, ৯. বড়বাজার, ১০. শিবগঞ্জ, ১১. নয়াবাজার (কুশিঘাট) ও ১২. দক্ষিণগাছ। ইতোপূর্বে ব্রজনাথটিলা, থিঙ্গোম লৈকাই, সাদিপুর, অহন্তেম লৈকাই, গোপালটিলা, রাজারগলি, শেকপীয়ানফম, বিলপারসহ বেশ কিছু এলাকায়ও মণিপুরী বসতি ছিলো। তবে এখন সেসব বসতি বিলীন হয়ে গেছে। একসময় সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলাধীন বরম গ্রামেও মণিপুরী বসতি ছিলো। কিন্তু আজ কালের কৃষ্ণবিবরে হারিয়ে গেছে সেই বসতি। এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলার ১. লাখাত গ্রামে কিছু মণিপুরী পরিবার বাস করে।
হবিগঞ্জ জেলা : এই জেলার শুধুমাত্র চুনারুঘাট উপজেলার ‘বিশগাঁও’ অঞ্চলেই মণিপুরী বসতি বিদ্যমান। এই বিশগাঁও অঞ্চলই প্রাচীন তরফ রাজ্যের রাজধানী ছিলো। বিশগাঁও অঞ্চলে যে-সব গ্রামে মণিপুরীদের বাস সেগুলি হলো- ১. গোবরখোলা ২. আবাদগাঁও ও ৩. শিবনগর। আগে এই অঞ্চলেরই আরো বেশ ক’টি গ্রাম যেমন, যাত্রাগাঁও, ফাটাবিল, ঠাকুরগাঁও, বনগাঁও, বড়জুম, কাটানিপাড়, কাঁঠালিপড়া, তুবাতলি, চম্পকনগর, ছনখোলা, দুধপাতিল, খোলা ইত্যাদি গ্রামে মণিপুরী বসতি ছিলো। কালের প্রহারে ক্লিষ্ট হতে হতে সেসব বসতি এখন হারিয়ে গেছে।
মৌলভীবাজার জেলা : বাংলাদেশের মোট মণিপুরী বসতির অর্ধেকেরও বেশি লোকের বাস এই জেলায়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বসতি কমলগঞ্জ উপজেলায়। আমরা এখানে মণিপুরী অধ্যুষিত গ্রামের তালিকা উপজেলাওয়ারী হিসেবে উলেখ করছি।
কমলগণ্ড উপজেলা: ১. গঙ্গানগর, ২, শ্রীপুর, ৩. কাটাবিল, ৪. হক্তিয়ারখোলা, ৫. তেঁতইগাঁও, ৬. নয়াপত্তন, ৭. ছনগাঁও, ৮. কোণাগাঁও, ৯. মাঝেরগাঁও (ভানুবিল), ১০. হোমেরজান, ১১. মঙ্গলপুর, ১২. চিৎলিয়া, ১৩, ছয়চিরি ও ১৪. ভাণ্ডারীগাঁও (মাধবপুর)।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা: ১. রামনগর ও ২. টিকরিয়া (বিলাছর)। ইতোমধ্যে এই উপজেলাধীন সাতগাঁয়ের খাসপুর অঞ্চলে (যেখানে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মণিপুরী বসতি ছিলো বলে ইতিহাসে উল্লেখ মেলে) যে মণিপুরী বসতি ছিলো তা বিলীন হয়ে গেছে।
কুলাউড়া উপজেলা : ১. ভাণ্ডারীগাঁও, ২. নলধরী (খুঞ্জাও) ও ৩. ফটিগুলি। আগে একসময় গারদবাজার এলাকাতেও মণিপুরী বসতি ছিলো। তবে এখন তা বিলীন হয়ে গেছে।
জুড়ি উপজেলা : ১. ছোটধামাই, ২. গৌরাঙ্গবিল, ৩. গোয়ালবাড়ী, ৪. বরইতলী ও ৫. খুনৌ। এই উপজেলার আরো বেশ কিছু গ্রামে মণিপুরী বসতি ছিলো যেগুলো ক্রমশ কালের কৃষ্ণবিবরে হারিয়ে গেছে। এরকম কয়েকটি গ্রাম হলো-সোমাইলৈকাই, বড়ধামাই, মানিকসিং বাজার, দুর্গাপুর, বিনোদপুর ইত্যাদি।
বড়লেখা উপজেলা: ১. পাথারি, ২. পুথাডহর, ৩. হৈজালি, ৪. সোনাতনপুর ও ৫. লক্ষ্মীছড়া।
সুনামগঞ্জ জেলা : এই জেলায় মণিপুরীদের বাস শুধুমাত্র ছাতক জেলায়। এই উপভোলার শুধুমাত্র ১. রতনপুর (পাড়ুয়া) গ্রামে খুব অল্পসংখ্যক মণিপুরী পরিবার বসবাস করে। মোট গ্রামের সংখ্যা ৪৬টি।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী মণিপুরী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামসমূহ :
ইসলাম ধর্মাবলম্বী মণিপুরীর ‘মণিপুরী মুসলিম’ বা ‘মৈতৈ পাঙল’ নামে পরিচিত। এই জনগোষ্ঠীর বাস মূলত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায়। এর বাইরে সিলেট জেলায় মাত্র একটি পাড়া আছে। নিচে জেলা ও উপজেলাওয়ারী গ্রামের একটি তালিকা সন্নিবেশিত হলো।
সিলেট জেলা : এই জেলায় শুধুমাত্র সদর উপজেলার ১. খাদিমপাড়া গ্রামে মণিপুরী মুসলিম বা মৈতৈ পাঙল জনগোষ্ঠীর বাস আছে।
মৌলভীবাজরজেলা : মৌলভীবাজার জেলার সদর ও কমলগঞ্জ এই দুই উপজেলাতেই শুধু মণিপুরী মুসলিম বা মৈতৈ পাঙলদের বসতি আছে। তবে প্রধান বসতি কমলগঞ্জ উপজেলাতেই।
সদর উপজেলার একটিমাত্র গ্রামে মণিপুরী মুসলিম বা মৈতৈ পাঙনদের বসতি আছে; সেই গ্রামের নাম হলো- ১. বরশীজোড়া। আর কমলগঞ্জ উপজেলার যেসব গ্রামে তাদের বসতি তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো: ১. মোকাবিল, ২. রাতাবাড়ী, ৩. গোলেহাওড়, ৪. কালারায়বিল, ৫. নওয়াগাঁও, ৬. শুকুর উল্লারগাঁও, ৭. পুরানবাড়ী, ৮. ফুলতলী, ৯, জামিরকোনা, ১০. কুমরাকাপন, ১১. জালালপুর, ১২. পূর্ব জালালপুর, ১৩. পশ্চিম জালালপুর, ১৪. কেওয়ালীঘাট, ১৫. হকতিয়ারখোলা, ১৬. কোনাগাঁও, ১৭. তেতইগাঁও, ১৮. নয়াপত্তন, ১৯, ঘোড়ামারা, ২০. কান্দিগাঁও, ২১, বন্দরগাঁও, ২২. হোমেরজান, ২৩. দক্ষিণ তিলকপুর, ২৪. আদমপুরবাজার ও ২৫. তিলকপুর।
মোট গ্রামের সংখ্যা ২৭টি। বাংলাদেশে মণিপুরীদের নিজস্ব মাতৃভাষা ‘মণিপুরী ভাষা’ শিক্ষার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এ-ব্যাপারে সরকারী বা বেসরকারী কোনো উদ্যোগও ছিলো না।
তবে তারা নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষার ব্যবহার যেমন করে থাকেন, তেমনি মাতৃভাষায় কথোপকথন, আলোচনা, কিস্সা বলা, পুঁথি পাঠ বা অনুবাদ, ধাঁধা প্রতিযোগিতা এবং ধর্মীয়-সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাতৃভাষার ব্যবহারকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
মণিপুরীদের অনেকেই বাংলা ভাষা ভাল করে জানেন না। তাই বক্তব্য সহজবোধ্য করার জন্যে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় নিজেদের মাতৃভাষা ‘মৈতৈ ভাষা’ বা ‘মণিপুরী ভাষা’ ব্যবহার করে থাকেন।
কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু মণিপুরী ভাষার কোনো স্কুল নেই তাই প্রতিটি মণিপুরী শিশুকে সাধারণ স্কুলে বাংলায় শিক্ষা লাভ করতে হয়। ফলে, ভাষা ঠিকমত আয়ত্ব করতে না পেরে শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে বাংলায় কথা বলা শেখে।
তারপরও বাংলাদেশের প্রতিটি মণিপুরী অভিভাবক যেহেতু জানেন বাংলাদেশে বাংলা ভাষা শেখার কোনো বিকল্প নেই তাই তারা তাদের সন্তানদের জোর করে হলেও স্কুলে পাঠান।
ফলে, মণিপুরী শিশুদের মধ্যে শতভাগই স্কুলগামী এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া ছাত্র-ছাত্রীও একেবারেই নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মণিপুরীদের মধ্যে এখন সাক্ষরতার হার ৮০% -এর চেয়েও বেশি। তবে উচ্চশিক্ষিতের হার আবার খুবই কম। এক জরিপে জানা গেছে, মাধ্যমিক পাশ ও তদুর্ধ-এর সংখ্যা ২৮%।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির বাংলা ভাষার জন্যে আত্মদানের ঘটনা বিশ্বের বুকে এক অনন্য ইতিহাস।
পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ঘোষণার মাধ্যমে এই দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। আর এর পর থেকেই পৃথিবীর সর্বত্র এই দিনটিকে নিজ-নিজ মাতৃভাষাকে ভালোবাসার এক অনন্য দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মণিপুরীরাও মহান একুশের চেতনায় নিজস্ব মাতৃভাষাকে ভালোবাসার আবেগে মণিপুরী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে কাজ করা শুরু করে; জন্ম নেয় সাহিত্য ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন; প্রকাশিত হয় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ মিলিয়ে বিভিন্ন গ্রহ ও সংকলন।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
মঙ্গোলীয় পরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার অন্তর্গত মীতৈ লোন বা মণিপুরী ভাষার নিজস্ব স্কুল বা মণিপুরী বর্ণমালা শেখার কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নিয়েও দীর্ঘদিন তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি।
২০১০ সালে ‘ফেলোশীপ অব পীস, বাংলাদেশ’ এর উদ্যোগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলাধীন আদমপুরবাজারের তেতইগাঁও নিবাসী এইচ তরুণ কুমার-এর বাড়ির এক কক্ষে মণিপুরী বর্ণমালা বা ভাষা শিক্ষার ‘মীতৈ ময়েক’ স্কুল চালু করা হয়।
উক্ত স্কুলটির শুভ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন যথাক্রমে হামোম তনুবাবু, খোইরোম ইন্দ্রজিত, এস সত্যেন প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফখরুল আহমদ এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন এ হেমন্ত কুমার সিংহ। কিন্তু অচিরেই স্কুলটি নানা সমস্যার কারণে বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীকালে ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল তারিখে গঠিত হয় ‘মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা’।
এই সংস্থা মণিপুরী লিপি শিক্ষার গ্রন্থ প্রকাশ করে এবং মণিপুরী লিপি ও ভাষা শিক্ষার জন্যে বাংলাদেশের মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে বেশ ক’টি ‘মণিপুরী স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করে।
এসব স্কুলের কার্যক্রম যথারীতি এগিয়ে চলেছে এবং অন্যান্য মণিপুরী এলাকায়ও ‘মণিপুরী স্কুল’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এ-বিষয়ে সরকারী সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত জরুরী।
বাংলাদেশে মণিপুরীরা খুবই সংখ্যাস্বল্প হলেও এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং উন্নত ভাষা-সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করছে।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মণিপুরীরা খুবই অনগ্রসর। প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের।
তবে জাতি হিসেবে খুবই শ্রমশীল বিধায় একেবারে হতদরিদ্র পরিবার যেমন নেই, তেমনি ভিক্ষাবৃত্তি বা অপরাধপ্রবণতা থেকে মণিপুরীরা প্রায় মুক্ত। শিক্ষাদীক্ষায় ক্রমশ এগিয়ে চলছে এখন বাংলাদেশের মণিপুরীরা।
অনেকেই উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে চাকুরীতে নিযুক্ত হচ্ছেন। এইসব বিষয়ে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে উন্নয়নশীল একটি জাতিসত্তা হিসেবে বাংলাদেশের মণিপুরীরা প্রগতির পথে দ্রুত অগ্রসরমান একটি জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে।
লেখকঃ হামোম তনুবাবু। লেখক ও গবেষক; উপদেষ্টা, মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, সিলেট।
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
1. Dr. Naorem Sanajaoba (Ed): MANIPUR : PAST AND PRESENT, Vol-2, Delhi 1991.
2. TC Hodson: The Meitheis: 1993.
3. Dr. G A Grierson: Linguistic Survey of India, Vol-III &V. Part-1 & 3; 1903.
4. Prof. Jyotirmoy Roy: History of Manipur; Imphal 1973.
৫. এ কে শেরাম; বাংলাদেশের মণিপুরী : এই সংস্কৃতির ত্রিবেণী সঙ্গমে; ঢাকা ১৯৯৬।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।