মণিপুরী ভাষা দিবসঃ প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
1775
‘মণিপুরী ভাষা’ খুবই প্রাচীন একটি ভাষা। অনেক পণ্ডিতের মতে এই ভাষার বয়স প্রায় সাড়ে তিন হাজার বৎসর।
মণিপুরের বিখ্যাত পণ্ডিত ও গবেষক ডব্লিউ. য়ুমজাউ সিংহ বলেন, ‘….All these facts doubtlessly show that Manipuri as a spoken language has been in existence prior to the age of the Epic or at least to the compilation of the Mahabharata as a book. Hence its age is at least 3400 years old. Its phonetic diversity and development is a sure proof of its long existence as an independent language.’ (Parishad : 1970 : P. 35).
পণ্ডিতরাজ অতোম্বাপু শর্মা এবং ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও এই অনুমিতিকে সমর্থন করেছেন।
মণিপুরী ভাষা মণিপুর রাজ্যের প্রধান ভাষা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিহাসের সেই সূচনালগ্ন থেকেই মণিপুর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ছিলো এবং প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের করতলগত হওয়ার পরও মণিপুর দীর্ঘদিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছিলো।
১৮৯১ সালে ব্রিটিশদের সাথে এক অসম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মণিপুর তার স্বাধীনতা হারায়।
১৯৪৭ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি ভারতবর্ষ থেকে তাদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নিলে মণিপুরও তার পুরনো স্বাধীনতা ফিরে পায়।
স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মণিপুর এক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনসভা ও সরকার গঠন করে এবং একটি সংবিধানও প্রণয়ন করে।
পরে রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক অনিবার্য প্রভাবের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৯ সালে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদান করে এবং সেই থেকে মণিপুর ভারতের অন্যতম একটি রাজ্য।
ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তস্থিত মণিপুর রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান ২৩.৫০° হতে ২৫.৪১° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯৩.২০° হতে ৯৪.৪৭° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে।
এর উত্তরে নাগাল্যাণ্ড, দক্ষিণে মিজোরাম ও মিয়ানমার, পূর্বে মিয়ানমার ও পশ্চিমে আসাম।
মণিপুরের মোট আয়তন ২২৩২৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ৯২%ই পার্বত্য এলাকা এবং মাত্র ৮% সমতলভূমি।
চতুর্দিকে বিশাল বিশাল পর্বতশ্রেণীর মাঝখানে প্রায় ১৮৩৪ বর্গকিলোমিটারের এক নয়নাভিরাম উপত্যকাভূমি-যেখানে রাজ্যের রাজধানী ইস্ফালের অবস্থান।
উপত্যকাভূমিতে বসবাস করে রাজ্যের প্রধান জনগোষ্ঠী ‘মৈতৈ’ জাতিসত্তা, যারা এখন ‘মণিপুরী’ নামে সর্বসাধারণ্যে পরিচিত।
আর পার্বত্যাঞ্চলে বাস করে কমপক্ষে ২৯টি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী।
মণিপুরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২৭,২২,০০০ জন, যার মধ্যে প্রায় ৫৯%ই মণিপুরী এবং তাদের সংখ্যা প্রায় ১৬,০০,০০০ জন। বাংলাদেশে যে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বাস করে তাদের অন্যতম হলো মণিপুরী জাতি।
তাদের আদি উৎসভূমি বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ক্ষুদ্র রাজ্য এই মণিপুর; যেখান থেকে কয়েক শতাব্দী পূর্বে ইতিহাসের নানা কালপর্যায়ে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক নানা উত্থান-পতনের সূত্র ধরে মণিপুরীদের অভিবাসন ঘটে বাংলার এই শ্যামল-কোমল প্রান্তরে।
বাংলাদেশে অভিবাসিত মণিপুরী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষাও এই ‘মণিপুরী ভাষা’।
মণিপুরী ভাষা মণিপুর রাজ্যের প্রধান ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা।
এই ভাষা সেই প্রাচীনকাল থেকেই রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা, বিচারালয়ের ভাষা এবং মণিপুরের বিভিন্ন ভাষাভাষী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘লিংগুয়া ফ্রাংকা’ হিসেবে প্রচলিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মণিপুরে কমপক্ষে আরো ২৯টি ভাষা বিদ্যমান।
অন্যান্য ভাষাগুলোর মধ্যে ভাষাভাষীর সংখ্যার বিচারে উল্লেখযোগ্য কিছু ভাষা হলো- থাদো, তাংখুল, কাবুই, পাইতে, মার, কুকি, লুসাই ইত্যাদি। ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখি, প্রাচীনকালে মণিপুরে অনেকগুলো গোত্ররাজত্ব ছিলো।
য়েক বা শালাই বলে পরিচিত ঐসব গোত্ররাজ্যগুলোর প্রায় একই উৎস থেকে জাত পৃথক-পৃথক ভাষাও ছিলো।
নিংথৌজা গোত্রের রাজত্ব ছিলো মণিপুরের বর্তমান রাজধানী ইস্ফালের কেন্দ্রবিন্দুতে।
নিংথৌজারা সাধারণভাবে ‘মৈতৈ’ নামে পরিচিত ছিলো এবং তাদের ভাষার নাম ছিলো ‘মৈতৈলোন’ বা মৈতৈভাষা।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নিংথৌজা গোত্রের প্রধান ‘পাখংবা’ শক্তি-সামর্থে প্রবলতর হয়ে উঠলে তিনি পার্শ্ববর্তী অন্যান্য রাজ্যসমূহ নিজ নিয়ন্ত্রণে এনে রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন এবং বিস্তার করেন নিজের অপ্রতিহত প্রভাব ও প্রতিপত্তি।
এভাবে বিভিন্ন গোত্রের উপভাষাগুলো যুক্ত হয়ে অষ্টম শতাব্দীর দিকে এসে প্রকৃত ‘মৈতৈলোন’ বা মৈতৈভাষা জন্ম লাভ করে।
এর আগে মণিপুর অঞ্চলে বিভিন্ন উপভাষা প্রচলিত ছিলো, মৈতৈলোন বা মৈতৈভাষাও তারই অন্যতম ছিলো।
তবে অষ্টম শতাব্দী থেকে মৈতৈভাষা প্ৰকত অর্থে একটি সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
অষ্টম শতাব্দীতে রাজত্বকারী মহারাজ খোঙতেকচার শাসনামলে মণিপুরী লিপিতে লিখিত তাম্রপত্রের আবিষ্কারই তার প্রমান।
অবশ্য কেউ কেউ লেখ্য মণিপুরী ভাষার বয়ঃক্রমকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী।
তাদের মতে মণিপুরী সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হলো ‘ঔগ্রী’, একধরনের গীতিকবিতা, যা ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পাখংবা কতৃক সিংহাসনারোহণকালে সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে গীত হয়েছিলো বলে বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ বা পাণ্ডুলিপিতে উল্লেখ মেলে।
তবে এটি ছিলো মৌখিক সাহিত্য এবং প্রথম লিখিত সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে যে গ্রন্থের কথা উল্লেখিত হয় তা হলো তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত বলে অনুমিত ‘পোইরৈতোন খুনথোকপা’।
এই গ্রন্থে প্রথম শতাব্দীতে রাজত্বকারী রাজা পাখংবার সময়ে মণিপুর উপত্যকার কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতা দখলের লড়াই সূচিত হলে পাখংবার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত একটি শক্তিশালী দলের প্রধান হিসেবে ‘পোইরৈতোন’-এর আগমন ও বসতিস্থাপনের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। (Nilkanta : 1982 : P. 101).
তাছাড়া ষষ্ঠ শতাব্দীতে রাজত্বকারী মহারাজ সমৈরাং (৫১৮-৫৬৮)এর শাসনামলের যে প্রস্তরলিপি আবিস্কৃত হয়েছে তাও প্রমাণ করে যে অন্তত ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে মণিপুরী ভাষা লিখিত রূপ অর্জন করেছে।
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মৈতৈ রাজ্যের সীমানা আরো বর্ধিত হয়, যুক্ত হয় আরো নতুন নতুন গোত্ররাজত্ব; ফলে বিভিন্ন উপভাষার সম্মিলনে মৈতৈভাষা আরো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে-জন্ম নেয় অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্যসৃষ্টি।
এই পর্যায়কে মৈতৈভাষার সাহিত্যিক ঋদ্ধি অর্জনের প্রথম পর্যায় বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর থেকে মণিপুরে অস্ট্রো-এশিয়াটিক, আর্য ও অন্যান্য রক্তধারার যেমন প্রবেশ ঘটতে শুরু করে, তেমনি মণিপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্ররাজত্বও মূলধারার সাথে একীভূত হয়ে বিস্তৃত হতে থাকে মৈতৈ রাজ্য ও ভাষা-সংস্কৃতির পরিধি।
সুতরাং ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীকে আমরা মৈতৈভাষার সমৃদ্ধি অর্জনের ধারায় দ্বিতীয় পর্যায় বলে চিহ্নিত করতে পারি।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সময়কালকে আমরা এই ভাষার গতিপথে তৃতীয় পর্যায় বলে আখ্যায়িত করতে পারি।
কারণ এই সময়ের মধ্যে মণিপুরের অভ্যন্তরীন বিভিন্ন গোত্র ও জনগোষ্ঠীকে মূলধারার সাথে অঙ্গীভূতকরণের কাজ প্রায় সমাপ্ত হয়ে যায়।
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু হয় আধুনিক মৈতৈভাষার পথচলা। (Ibohal : 1986 : P. 444. 445)। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তখনও রাজ্যের ‘মণিপুর’ নামকরণ হয়নি; বর্তমান ইস্ফাল উপত্যকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত প্রধান রাজ্যসহ অন্যান্য যে ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহ ছিলো সেগুলো ‘মৈতৈলৈপাক’ ‘মৈত্রবাক’ ‘কংলৈ’ ‘কংলৈপাক’ ‘মেখলী’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলো।
কিন্তু ইতিহাসের এক পর্যায়ে এসে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নানা কারণে এই রাজ্যের নামকরণ হয় ‘মণিপুর’ এবং রাজ্যের প্রধান অধিবাসী ‘মৈতৈ’রা দেশের নামে ‘মণিপুরী’ জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে; মৈতৈলোন বা মৈতৈভাষাও ‘মণিপুরী ভাষা’ নামে পরিচিত হয়।
মণিপুরে ব্রিটিশ আগমন সূচিত হলে ‘মণিপুর’ বা ‘মণিপুরী’ শব্দগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘মৈতৈলোন’ বা মৈতৈভাষাই যে ‘মণিপুরী ভাষা’ তা নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট প্রণিধানযোগ্য হবে।
‘Manipuri/ Meithei, both the name refers to one and the same language. Meithei language and its dialects form a sub-group within the broad Kuki-chin group of the Tibeto-Burman Sub-family.’ (Census of India – 1971: P. 160). ‘The Manipur Official Language Bill – 1979’-এও বলা হয়েছে, ‘Manipuri Language means ‘Meitei Lon’ written in Bengali script and spoken by the majority of Manipur population.’ (Manipur Act 14 of 1979)
প্রাচীন ইতিহাস সবসময়ই আলো-আঁধারির ছায়াচ্ছন্নতায় ঢাকা থাকে।
ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রায়ই কোনো-না-কোনো বিতর্ক থাকে, থাকে একধরনের রহস্যময়তাও।
তবে সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, মণিপুরী জাতি মঙ্গোলীয় মহাপরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্গত।
তেমনি অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানীই মণিপুরী ভাষাকে মঙ্গোলীয় ভাষাপরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার অন্তর্গত বলে মত প্রকাশ করেছেন।
ভারতবর্ষে প্রথম বিজ্ঞানসম্মতভাবে ভাষা শ্রেণীকণের কাজ করেছিলেন ড. জি. এ. গ্রীয়ারসন।
তার বিশালাকার কাজ ‘Linguistic Survey of india’ তে তিনি মণিপুরী ভাষাকে মঙ্গোলীয় ভাষাপরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে চিহ্নিত করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে,
‘The state of Manipur is very polyglot tract of country. The principal language is ‘Meithei’ of ‘Manipuri’. (Griersor : 1904: Vol-V, Pat-1: P. 419)।
তাই তিনি এই ভাষাকে মঙ্গোলীয় ভাষাপরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার অন্তর্গত হলেও ‘কুকি-চীন’ গোষ্ঠীর আওতাভুক্ত করার ব্যাপারে একটু দ্বিধান্বিত।
তিনি মনে করেন মৈতৈভাষা মণিপুর রাজ্যের প্রধান ভাষা এবং একটি দীর্ঘ ও স্বতন্ত্র ইতিহাসের অধিকারী।
তিনি তাই ‘কুকি-চীন’ গোষ্ঠীর আওতায় মৈতৈভাষাকে না রেখে একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে চিহ্নিত করে এর নাম ‘কুকি-চীন’ এর পরিবর্তে ‘মৈতৈ-চীন’ উল্লেখের পক্ষপাতী।
তাঁর ভাষায়-‘The denomination Kuki-Chin is purely a conventional one, there being no proper name comprising these tribes. Meithei-Chin would have been a better appellation, as the whole group can be subdivided into two groups, the Meithei and the various tribes which are known to us under the names of Kuki and Chin. I have, however, to avoid confusion, retained the old terminology’ (Grierson : 1904: Vol-iii. Part- iii)।
ভারতের সেন্সাস বিবরণীতে মণিপুরী ভাষাকে মঙ্গোলীয় পরিবারের তিব্বত-ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভাষাচার্য ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তিরাও একই মত পোষণ করে থাকেন।
ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় – ‘Among the various Tibeto-Burman languages, the most important in literature certainly of much greater importance than Newari is the Meithei or Manipuri Languag’ (Sanajaoba : 1991 : P. 275).
আর অন্যদিকে ইতিহাসবিদ ইবোহল সিংহ মণিপুরী ভাষাকে ‘ইন্দো-মঙ্গোলোইদ’ বলে নতুন একটি পরিবারের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করার পক্ষপাতী।
তার ভাষায়- ‘The Manipuri language is therefore the youngest daughter of Tibeto-Burman and Mongolo-pre-Dravidoid languages nourished in a family of Tibeto-Burman, to have characterised by itself a branch or a sub-family of a language which is between the Sino-Tibetan and Indo-European families with a versatile capability of expressing thought and to have an independent development for a considerable length of time, and is to be categorised with a new nomenclature the ‘Indo-Mongoloid language’. (Ibohal : 1986: P. 495).
২০০১ সালের ভারতীয় সেন্সাস বিবরণী অনুযায়ী ভারতে প্রাথমিক জরিপে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা হিসেবে ভাষা ও উপভাষা মিলে মোট ৬,৬৬১টি ভাষার অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়।
এর মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত বিচার-বিশ্লেষণে চিহ্নিত মাতৃভাষার সংখ্যা ১,৬৩৫টি এবং ‘অশ্রেণীকৃত’ হিসেবে চিহ্নিত হয় আরো ১৯৫৭টি ভাষা।
বিজ্ঞানসম্মত বিচার-বিশ্লেষণে চিহ্নিত ১৬৩৫টি মাতৃভাষার মধ্য থেকে ১০,০০০ বা তারও বেশি লোক কথা বলে এরকম ভাষার সংখ্যা চিহ্নিত করা হয় ১২২টি।
এই ১২২টি ভাষার মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ২২টি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে।
১৯৯২ সালের পূর্ব পর্যন্ত সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ছিলো ১৫টি।
এগুলো হলো – হিন্দী, বাংলা, তেলেগু, মারাঠী, তামিল, উর্দু, গুজরাটি, কন্নড়, মালয়ালাম, উড়িয়া, পাঞ্জাবী, অসমিয়া, কাশ্মীরি, সিন্ধী ও সংস্কৃত।
পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট সংবিধানের ৭৮তম সংশোধনীর মাধ্যমে (বিল নং- ১৪২) আরো ৩টি ভাষা অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই তিনটি ভাষা হলো – মণিপুরী, কঙ্কানী ও নেপালী।
এর ফলে অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্ত ভাষার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮।
তারও পরে ২০০৩ সালে সংবিধানের ১০০তম সংশোধনীর মাধ্যমে আরো ৪টি ভাষা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অষ্টম তপশীলে তালিকাভুক্ত ভাষার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি।
সর্বশেষ সংযোজিত এই ৪টি ভাষা হলো- বোডো, ডোগ্রি, মৈথিলি ও সানতালী। অষ্টম তপশীলে তালিকাভুক্ত ২২টি সহ ১০,০০০ বা তারও বেশি লোক কথা বলে এরকম মোট ১২২টি ভাষাকে সেন্সস বিবরণীতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ভাষা-পরিবার ভিত্তিক শ্রেণীকরণ করা হয়েছে।
এই শ্রেণীকরণে ভাষাগুলোকে ৫টি প্রধান ভাষা-পরিবারে বিভক্ত করা হয়েছে; এগুলো হলো- ১. ইন্দো-ইউরোপীয়ান, ২. দ্রাভিদিয়ান, ৩, অস্ট্রো-এশিয়াটিক, ৪. তিবেটো-বার্মিজ ও ৫. সেমিটো-হামিটিক।
১২২টি ভাষার মধ্যে ২৪টি ভাষাকে ইন্দো-ইউরোপীয়ান পরিবারভুক্ত করা হয়েছে।
এই ভাষা-পরিবারের প্রধান শাখা হলো ‘ইন্দো-এরীয়ান’, যার আওতায় আছে মোট ২১টি ভাষা। এই পরিবারে বাংলা, সংস্কৃত, অসমিয়া, উড়িয়া ইত্যাদি ভাষার সাথে বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
দ্রাভিদিয়ান পরিবারভুক্ত ভাষার সংখ্যা ১৭টি এবং অস্ট্রো-এশিয়াটিক পরিবারভুক্ত করা হয়েছে ১৪টি ভাষাকে। সবচেয়ে বেশি ভাষা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যে পরিবারে তা হলো তিবেটো-বার্মিজ ভাষা-পরিবার।
এই পরিবারের আওতায় মোট ৬৬টি ভাষাকে চিহ্নিত করা হয়েছে – যার মধ্যে মণিপুরী, গারো, ত্রিপুরী, মগ, লুসাই ইত্যাদি ভাষা রয়েছে।
যে ২২টি ভাষাকে অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ১৫টি ভাষাই এসেছে ইন্দো-এরীয়ান ভাষা-পরিবার থেকে।
অপরদিকে দ্রাভিদিয়ান ভাষা-পরিবার থেকে ৪টি, অস্ট্রো-এশিয়াটিক থেকে ১টি এবং তিবেটো-বার্মিজ পরিবার থেকে ২টি ভাষা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
২০০১-এর সেন্সস বিবরণী অনুযায়ী ভারতে মণিপুরী ভাষাভাষীর মোট সংখ্যা ১৪,৬৬, ৭০৫ জন।
এর মধ্যে মণিপুর রাজ্যে এই সংখ্যা ১২,৬৬,০৯৮ জন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বসতি আসামে ১,৫৪,০৫৯ জন এবং ত্রিপুরায় ২০,৭১৬ জন।
এর বাইরে নাগাল্যাণ্ড, দিল্লী, মেঘালয়সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু কিছু মণিপুরী ভাষাভাষী জনগণ আছে।
(Census of India – 2001, Paper 1 of 2007)। সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে ভারতের বাইরে মিয়ানমারে এবং বাংলাদেশে যথাক্রমে প্রায় ৩,০০,০০০ ও ৪০,০০০ জন মণিপুরী বসবাস করে বলে অনুমান করা হয়।
তবে এর বাইরে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এখন স্বল্পসংখ্যক হলেও মণিপুরী বসতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।
২০১১ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী মণিপুরের মোট জনসংখ্যা ২০০১ সালের ২১,৬৬,৭৮৮ জনের স্থলে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাতাশ লক্ষ বাইশ হাজার, যার মধ্যে মণিপুরী ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ষোল লক্ষ এবং সারা ভারতবর্ষে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে আঠারো লক্ষ।
মণিপুরী ভাষা সেই প্রাচীনকাল থেকেই মণিপুর রাজ্যের রাজ্যভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়ে এসেছে।
পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের মাধ্যমে মণিপুর ভারতের অন্যতম রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হওয়ার পর থেকেই প্রাচীনতা ও উৎকর্ষের বিচারে মণিপুরী ভাষাকে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবী জানানো হয়।
দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকার ১৯৯২ সালের ২০ আগস্ট মণিপুরী ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্ত করে এই ভাষাকে ভারতের অন্যতম প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ এক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভারতীয় সংবিধানের এই স্বীকৃতির ফলে ভারত সরকার সাংবিধানিক দায়দায়িত্ব হিসেবেই কেন্দ্রীয়ভাবে মণিপুরী ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মণিপুরী ভাষা এখন আর একটি আঞ্চলিক ভাষা নয়, বরং সর্বভারতীয় পর্যায়ের একটি জাতীয় ভাষা।
মণিপুরী ভাষার ইতিহাসে এই দিনটি তাই বিশেষ স্মরণীয়।
মণিপুরসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অথবা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রে বসবাসকারী মণিপুরী ভাষাভাষী জনগণ ২০ আগস্ট এই দিনটিকে ‘মণিপুরী ভাষা দিবস’ হিসেবে সাড়ম্বরে পালন করে থাকে।
তবে তারও বেশ আগে থেকে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দেই মণিপুরী ভাষা ভারতের নয়াদিল্লীস্থ সাহিত্য একাডেমীর স্বীকৃতি লাভ করে এবং তদনুযায়ী ১৯৭৩ সাল থেকে প্রতি বছরই মণিপুরী সাহিত্যের কোনো-না-কোনো গ্রন্থ সাহিত্য একাডেমী এওয়ার্ডে ভূষিত হচ্ছে।
এ-পর্যন্ত মৌলিক রচনার জন্যে একাডেমী এওয়ার্ড পেয়েছেন ৩৭ জন।
এছাড়া অনুবাদ সাহিত্যের জন্যেও একাডেমী এওয়ার্ড পেয়েছেন আরো অনেকেই। মণিপুরী ভাষা সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মণিপুরের শিক্ষা বোর্ড ছাড়াও আসাম, দিল্লী, কলকাতাসহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত এই ভাষা।
মণিপুর ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি গৌহাটি, আসামসহ বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে মণিপুরী বিভাগ রয়েছে এবং সেখানে মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষাদান করা হচ্ছে।
এমফিল এবং পিএইচডির অভিসন্দর্ভ রচনার ভাষা-মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহৃত হয় মণিপুরী ।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই বিচারালয়ের ভাষা হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে এই ভাষা।
বিচারালয়ের সকল নথিপত্রাদি এবং রায় মণিপুরী ভাষায় লেখার প্রথা এখনও প্রচলিত। এছাড়া বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমেও মণিপুরী ভাষায় নিয়মিত অনুষ্ঠানাদি প্রচারিত হয়।
বাংলাদেশে সিলেট বেতার কেন্দ্রেও ১৯৭৬ সাল থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক ‘মুদঙ্গ’ অনুষ্ঠানে মণিপুরী ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে মণিপুরী ভাষা কখনো কখনো এক অনাকাঙিক্ষত বিভ্রান্তির শিকার হয়।
মণিপুরীরা নিজেরা তাদের মাতৃভাষাকে ‘মৈতৈ লোন’ বা মৈতৈ ভাষা বলে থাকে।
কিন্তু সর্বসাধারণ্যে এই ভাষার নাম ‘মণিপুরী ভাষা’। এই মৈতৈ লোন বা মৈতৈ ভাষাই ‘মণিপুরী ভাষা’ নামে মণিপুর রাজ্যের রাজ্যভাষা হিসেবে ‘The Manipur Official Language Bill-1979’-এ এবং ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে ভারতের অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় সেন্সাস বিবরণীতে (ভাষা বিষয়ক) এই ভাষাকে তিব্বত-ব্ৰহ্ম ভাষাপরিবারের অন্তর্গত ভাষা হিসেবে ‘মণিপুরী ভাষা’ নামেই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে কেউ কেউ, হয়তো অনবধানবসত, এই ভাষাকে ‘মৈতৈ-মণিপুরী ভাষা’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু ‘মৈতৈ-মণিপুরী’ এই শব্দবন্দটি একটি ভ্রান্ত উপস্থাপনা।
আসলে ‘মৈতৈ’ ও ‘মণিপুরী’ সমার্থক; ইতিহাসের ধারা বেয়েই একসময় ‘মৈতৈ জাতি’ পরিবর্তিত পরিচয়ে ‘মণিপুরী জাতি’ হিসেবে এবং ‘মৈতৈ লোন বা ভাষা’ ক্রমশ ‘মণিপুরী ভাষা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে মণিপুরীদের অধিকাংশই এখন সনাতন (হিন্দ) ধর্মের চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী।
তবে মণিপুরীদের মধ্যে এখনও অনেকেই আছেন আদি ধর্ম ‘অপোকপা’ বা ‘সানামহী লাইনীং’-এর অনুসারী; আবার এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলাম ধর্মাবলম্বী যেমন আছেন, তেমনি আছেন অল্প সংখ্যক খ্রীষ্টান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও।
ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও এরা সবাই মণিপুরী জাতির অংশ, তেমনি এদের সকলের মাতৃভাষাও ‘মণিপুরী ভাষা’।
বাংলাদেশে মণিপুরীদের নিকট-অবস্থানে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ বা ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ নামে একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছেন যারা সাধারণভাবে মণিপুরী জাতির অংশ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন।
কিন্তু, ধর্মীয়-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু নৈকট্য সত্ত্বেও এই জনগোষ্ঠী মণিপুরীদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এক নৃতাত্ত্বিক উৎস থেকে উদ্ভুত-ইন্দো-এরীয়ান জনগোষ্ঠীর; তাদের ভাষা ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের।
মণিপুরীদের মূলভূমি মণিপুর রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী নেই বললেই চলে; ২০০১ সালের ভারতীয় সেন্সাস বিবরণী অনুযায়ী মণিপুর রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাভাষীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১,৪৫৭ জন, আর সমগ্র ভারতে এই সংখ্যা ৭৭,৫৪৫ জন।
ভারতের সেন্সাস বিবরণীতে বা বিভিন্ন সরকারী নথিপত্রাদিতে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ জনগোষ্ঠীকে একটি পৃথক নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা হিসেবে যেমন পরিচিত করা হয়েছে তেমনি তাদের মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকেও, উপভাষা নয়, একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
তাদের প্রধান বসতি ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে।
সেখানে সরকারীভাবে স্কুল পর্যায়ে মণিপুরী ভাষার পাশাপাশি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার জন্যেও পৃথকভাবে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঐ দুই রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে সরকারীভাবে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’ নামে পৃথক কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তাগত বা ভাষিক পরিচয়ের স্বাতন্ত্র্য উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
ফলে, বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দু’টি স্বতন্ত্র ভাষা মণিপুরী ভাষা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার পরিচয়ের ক্ষেত্রে একই ভাষা বা একই ভাষার দু’টি ভিন্ন রূপ বলে গুলিয়ে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটতে যায়।
মণিপুরী জাতি বা মণিপুরী ভাষার পরিচয়ে এই জাতীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি নিতান্তই অপ্রত্যাশিত এবং এর দূরীকরণ খুবই জুরুরী।
মণিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপিপদ্ধতি আছে। ‘মৈতৈ ময়েক’ নামে পরিচিত এই মণিপুরী লিপি কখন থেকে প্রচলিত হয়েছে বা কোন উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে, এ-নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে কিছু বিতর্কও আছে।
কারো কারো মতে, ৩৩ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরে রাজত্বকারী মহারাজ পাখংবা প্রথম এই লিপির উদ্ভবন করেন। তখন এর সংখ্যা ছিলো ১৮টি; পরবর্তীতে উচ্চারণকে আরো প্রমিত করার লক্ষে আরও ৯টি লিপি যুক্ত করা হয়।
আবার কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ১৫০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ থেকেই মণিপুরী ভাষার লিখিত ইতিহাস আছে উল্লেখ করে মণিপুরী লিপিকে সম্রাট অশোকের পূর্ববর্তী সময়ের বলে দাবি করেন।
এ-ব্যাপারে তাদের যুক্তি হলো পাটনা জাদুঘরে পূর্ব সময়ের যে-সব প্রস্তরলিপি রক্ষিত আছে সেখানে ব্যবহৃত লিপির সাথে অনেক ক্ষেত্রে মণিপুরী লিপির মিল আছে।
আমরা জানি, প্রাচীনকালে বর্তমান মণিপুর এক এবং অখন্ড রাজ্য ছিলো না। অনেকগুলো অঞ্চলে বিভক্ত মণিপুরে তখন ভিন্ন ভিন্ন গোত্ররাজত্ব ছিলো। সমস্ত অঞ্চলে সভ্যতা সমানভাবেও বিকশিত হয়নি |
মণিপুরের ‘মোইরাং’ অঞ্চলে সেই প্রাচীনকালেই এক উন্নত সভ্যতা বিকশিত হয়েছিলো বলে অনুমান করা হয় ।
মোইরাং অঞ্চলের প্রধান দেবতা ‘থাংজিং’। থাংজিং দেবতার মন্দিরকে কেন্দ্র করে সঙ্গীত নৃত্য, ক্রীড়া তথা উন্নত সংস্কৃতি চর্চার একটা আবহ সৃষ্টি হয়েছিলো ইতিহাসের সেই উষালগ্নেই।
সুক্ষ্ম ও কারুকার্যময় বস্ত্রবয়নেও দক্ষতা অর্জন করেছিলো এই অঞ্চল। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজকুমারী থোইবী কর্তৃক বয়িত কিছু বস্ত্রের নমুনা এখনও থাংজিং দেবতার মন্দিরে সংরক্ষিত আছে, যা মসলিনের চেয়েও সুক্ষ্ম ও কারুকার্যমণ্ডিত বলে অনেকে মনে করেন।
মোইরাং অঞ্চলে জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের চর্চা হতো সেই প্রাচীনকাল থেকেই। মণিপুর উপত্যকায় পঞ্জিকা বা দিনপঞ্জিকার উদ্ভাবন ও ব্যবহার শুরু হয় প্রথম এই অঞ্চলেই।
কমপক্ষে একাদশ শতাব্দী থেকে প্রাচীন মোইরাং রাজ্যে একটি বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকা প্রণয়ন ও ব্যবহারের ইতিহাস আমরা পাই।
মােইরাং অঞ্চলের একজন শাসক ‘মালিয়া ফম্বালচা’র নামে একটি বর্ষ গণনারীতি এখনও মণিপুরে প্রচলিত, যে হিসাব অনুযায়ী এখন ৩৪১১ বর্ষ চলছে।
তবে কখন কীভাবে এই বর্ষ গণনারীতি চালু হয়েছিলো তা ইতিহাসের আলো-আঁধারির ছায়াচ্ছন্নতায় ঢাকা ।
২০০ বর্গকিলোমিটারেরও চেয়ে বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত উত্তরপূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ স্বাদু পানির প্রাকৃতিক হ্রদ লোক্তাক-এর অবস্থান এই মোইরাং অঞ্চলেই। এইসব নানা কারণে কমপক্ষে দুইশত খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই মোইরাং অঞ্চলের সাথে মৌর্য সভ্যতার একটি যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো বলে জানা যায়।
আর তখন থেকেই ব্রাহ্মী লিপির অনুকরণে একটি লিপির সৃষ্টি করে এই অঞ্চলে লেখালেখির সূচনা হয় বলে ইতিহাসবিদরা অনুমান করে থাকেন। (Ibohal : 1986 : P. 501-502).
তাছাড়া তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত বলে বিবেচিত ‘পোইরৈতোন খুনথোকপা’ নামের একটি গ্রন্থের কথা আমরা জানি; মণিপুরী লিপিতে লিখিত ষষ্ট শতাব্দীতে রাজত্বকারী রাজা সমৈরাং-এর আমলের প্রস্তরলিপি বা অষ্টম শতাব্দীর রাজা খোঙতেকচার আমলের তাম্রলিপির কথাও আমরা জানি।
সুতরাং আমরা এই নিশ্চিত অনুমিতিতে পৌঁছতে পারি যে, খ্রিষ্টপূর্ব দুইশত অব্দে বা প্রথম শতাব্দী থেকে না হলেও মণিপুর অঞ্চলে অন্তত তৃতীয় শতাব্দী থেকে মণিপুরী লিপির জন্ম এবং লেখালেখির সূত্রপাত হয়েছে।
তবে মণিপুরের বিভিন্ন রাজ্যে প্রচলিত লিপির মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এতে বুঝা যায় সমগ্র মণিপুর অঞ্চলে একই সাথে একই ধরনের লিপির ব্যবহার করে লেখালেখির সূত্রপাত ঘটেনি।
মণিপুরে আবিষ্কৃত ও সংরক্ষিত মণিপুরী লিপিতে রচিত প্রায় এক হাজারেরও বেশি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পর্যালোচনায় বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে মণিপুরের সিংহাসনে আসীন হন মহারাজ খাগেম্বা।
ততোদিনে প্রায় সমগ্র মণিপুর অঞ্চলে একীভূত হয়ে এক রাজ্যে পরিনত হয়েছে। ফলে, অঞ্চলভেদে প্রচলিত লিপির ভিন্নতা রচিত বিভিন্ন গ্রন্থপাঠে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি করতো বিধায় রাজা খাগেম্বা সবগুলো লিপি মিলিয়ে সব অঞ্চলের জন্য একটি সাধারণ লিপিপদ্ধতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন।
তাই তিনি রাজ্যের বিভিন্ন পণ্ডিতদের সহায়তায় সর্বজনীন একটি লিপিপদ্ধতি প্রনয়ন করেন; যেখানে মূল লিপি ১৮টির সাথে উচ্চারণকে অধিকতর প্রমিত করার লক্ষে আরো ৯ টি বর্ণ সংযোজিত হয়।
এভাবে মোট ২৭টি মূল বর্ণ নিয়ে গঠিত মণিপুরী বর্ণমালা মণিপুর অঞ্চলের সর্বত্র সমানভাবে প্রচলিত হতে থাকে। মণিপুরী লিপির উৎস নিয়েও বেশ বিতর্ক আছে।
তবে সাধারণভাবে প্রচলিত মত হলো এই লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত। বর্তমানে প্রচলিত মণিপুরী লিপির অনেক বর্ণের সাথে ব্রাহ্মী লিপির সাযুজ্য স্পষ্ট লক্ষণযোগ্য।
তবে মণিপুরী লিপিতে ব্রাহ্মী লিপির সাথে অনেক স্থানীয় উপাদান বৈশিষ্ট্যও যুক্ত হয়েছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।
মণিপুরী বর্ণমালার এক অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো-এর প্রতিটি বর্ণমালার নামকরণ করা হয়েছে দেহের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে এবং এর গঠনও সংশিষ্ট ঐ অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গের গঠন-প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
যেমন, মণিপুরী বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হলো ‘কোক’, যার অর্থ ‘মাথা’। এই বর্ণের বাংলা প্রতিবর্ণ হলো ‘ক’ এবং শব্দে যখন ব্যবহৃত হয় তখন এর উচ্চারণ হয় বাংলা ‘ক’ বর্ণের মতো।
মণিপুরী বর্ণমালার দ্বিতীয় বর্ণ ‘সম’, যার অর্থ ‘চুল’; এর বাংলা প্রতিবর্ণ ‘স’ এবং শব্দে ব্যবহারের সময় এর উচ্চারণ হয় বাংলা ‘স’ এর মতো। একইভাবে মণিপুরী বর্ণমালার পরবর্তী বর্ণগুলো হলো- ‘লাই’ অর্থাৎ ললাট, ‘মিৎ’ অর্থাৎ ‘চক্ষু’ ইত্যাদি। মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে মণিপুরী বর্ণমালার নামকরণ এক অনন্য নিদর্শন এবং সম্ভবত পৃথিবীতে নজিরবিহীন।
মণিপুরী বর্ণমালা – ২৭টি। এর মধ্যে প্রথম ১৮টি হলো মূল বর্ণ, যেগুলোর নামকরণ করা হয়েছে শরীরের এক-একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে। এই ১৮টি বর্ণমালা নিমরূপ :
কোক (মাথা) – ক
সম (চুল) – স
লাই (ললাট) – ল
মীৎ (চক্ষু) – ম
পা (চোখের পাপড়ি) – প
না (কান) – ন
চীল (ঠোঁট) – চ
তীল (লালা) – ত
খৌ (কন্ঠনালী) – খ
ঙৌ (তালু) – ঙ
থৌ (বক্ষ) – থ
রাই (ফুসফুস) – রা
য়াঙ (মেরুদন্ড) – য়
হুক (মেরুদন্ডের নিম্নাংশ) – হ
উন (চর্ম) – উ/ঊ
ঈ (রক্ত) – ই/ঈ
ফম (গর্ভাশয়) – ফ
অতিয়া (আকাশ) – অ
পরবর্তিতে ১৮টি বর্ণের সাথে আরো ৯টি বর্ণ যুক্ত করা হয় উচ্চারণকে অধিকতর প্রমিত করার লক্ষে। পরবর্তীতে সংযোজিত এই ৯টি বর্ণ হলো :
গোক – গ
ঝম – ঝ
রাই – র
বা – ব
জীল – জ
দীল – দ
ঘৌ – ঘ
ধৌ – ধ
ভম – ভ
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সর্বজনীন লিপিপদ্ধতি প্রণীত হওয়ার পর মণিপুরী লিপি সমগ্র মণিপুর অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র ব্যবহৃত হতে থাকে।
কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে মণিপুরী জীবনে ধর্মীয় ও সংস্কৃতির এক অনিবার্য সংঘাত করাল ছায়া মেলে দেয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই হিন্দু ধর্ম মণিপুরের সর্বজনীন ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করে।
তারও কিছুকাল পরে ঐ শতাব্দীরই শেষ দিকে বাংলা অঞ্চল থেকে আসা চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের অমিয়ধারায় পুত হয় সমগ্র মণিপুর উপত্যকা ।
মণিপুরে নূতন আসা এই ধর্মের প্রায় সব গ্রন্থই বাংলায় রচিত। ফলে, ধর্ম ও রাজনৈতিক নানা কার্যকারণের সূত্র ধরে বাংলার সাথে অধিকতর নৈকট্য সৃষ্টির প্রয়াসে মণিপুরী লিপি পরিবর্তিত করে তদস্থলে বাংলা লিপি প্রবর্তন করা হয়।
পরবর্তীতে উনবিংশ শতাব্দীতে মণিপুরে ব্রিটিশ প্রভাব বিস্তার হলে বাংলা লিপি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তাছাড়া আধুনিক মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে, মণিপুরী লিপির মুদ্রণপদ্ধতি যেহেতু তখনও আবিস্কৃত হয়নি, তাই বাংলা লিপির ব্যবহার অনিবার্য হয়ে ওঠে। সম্ভবত ১৮৩৭ সালে প্রকাশিত Capt. George Gordon এর ‘A Dictionary in English, Bengali and ‘Manipuri’ গ্রন্থই মণিপুরী ভাষার প্রথম মুদ্রিত গ্ৰন্থ এবং এই গ্রন্থেই প্রথম ছাপার অক্ষরে ‘মৈতৈ’ শব্দের পরিবর্তে ‘মণিপুরী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
এভাবেই মণিপুরী ভাষা নিজস্ব লিপির পরিবর্তে বাংলা লিপিতেই লিখিত হয়ে আসছে এবং এখনও লিখা হচ্ছে।
তবে মণিপুরী পণ্ডিতদের অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেমন মণিপুরী লিপির চর্চা অব্যাহত রেখেছেন এবং এই লিপিতে বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি রচনা করে চলেছেন, তেমনি রাজার তত্ত্বাবধানে বিশিষ্ট পণ্ডিতদের দ্বারা গঠিত ‘অমাইবা লোয়শং’ অদ্যাবধি রাজকীয় নানা ঘটনাপঞ্জী মূল মণিপুরী লিপিতেই লিপিবদ্ধ করে চলেছেন।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মণিপুর রাজ্যে মূল মণিপুরী লিপি আবার পুনপ্রবর্তনের দাবী জোরালো হয়ে ওঠে।
তারই প্রেক্ষিতে অনেক কমিটি/উপকমিটি গঠিত হওয়ার পর এবং বিশেষজ্ঞ মহলের অনেক পর্যালোচনার পর ১৯৮২ সালে মণিপুরী লিপি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয় এবং সরকারিভাবে পুনপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কিন্তু তারপরও নানা জটিলতায় মণিপুরী লিপি পুনপ্রবর্তনের কার্যক্রম বিলম্বিত হয়।
তবে ২০০৫ সালে মণিপুর সরকারের সাথে মণিপুরী লিপি নিয়ে কাজ করেন যেসব সংগঠন তাদের মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তির প্রেক্ষিতে ২০০৬ সালে মণিপুরী লিপিতে লিখিত পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সরকারীভাবে স্কুল শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী একসাথে চালু করার মধ্য দিয়ে ।
পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম শ্রেণী এভাবে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এই কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে।
এই ধারাবাহিকতায় শুধু শিক্ষাক্রমে নয়, সামগ্রিকভাবে মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপির পরিবর্তে পুনরায় মণিপুরী লিপিতে লিখিত হবে।
সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে মণিপুরে বাংলা লিপিতে লিখিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাবলী মণিপুরী লিপিতে লিপ্যত্তর করার কাজ শুরু হয়েছে।
আবার এখন যারা বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করছেন তাদের অনেকেই বাংলা ও মণিপুরী উভয় লিপিতেই পাশাপাশি প্রকাশের ব্যবস্থাও করছেন।
এটা নিশ্চিত যে, আগামী ১০/১৫ বছরের মধ্যে মণিপুরে মণিপুরী লিপি পরিপূর্ণভাবে চালু হয়ে যাবে এবং বাংলা লিপির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে।
এখন এই অবস্থায় যদি বাংলাদেশে বসবাসকারী মণিপুরী জনগোষ্ঠী মণিপুরী লিপির সাথে পরিচিত না হয়, তাহলে তারা মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
আর তাই, মণিপুরী ভাষার মূল স্রোতোধারার সাথে সাযুজ্য রাখার প্রয়োজনে বাংলাদেশেও জন্যে মণিপুরী লিপি শেখা জরুরী হয়ে পড়ায় সম্প্রতি মণিপুরী ভাষা গবেষণা সংস্থার উদ্যোগে বাংলাদেশে মণিপুরী লিপি শিক্ষার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে এবং ইতোমধ্যে মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে বেশ কয়েকটি ‘মণিপুরী স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
তারই ধারাবাহিকতায় মণিপুরী অধ্যুষিত অন্যান্য অঞ্চলেও দ্রুত আরো মণিপুরী স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
মণিপুরী ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন এবং যথেষ্ট উন্নত একটি ভাষা।
বাংলাদেশে মণিপুরীদের সংখ্যাস্বল্পতার কারণে এই ভাষার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্র সীমিত হলেও ‘বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ’-এর যোগ্য নেতৃত্বে এদেশে গত ৩৬ বৎসর ধরে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্যের লালন এবং বিকাশের যে কর্মযজ্ঞ চলছে তার ফলে ইতোমধ্যেই এদেশের প্রেক্ষাপটে মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য একটি সদৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে।
আমরা আশা করবো একটি প্রাচীন ও উন্নত ভাষা হিসেবে ‘মণিপুরী ভাষা’কে সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকার এই ভাষা ও সাহিত্যের লালন এবং বিকাশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করবেন।
সহায়ক গ্রন্থাবলী
- Manipuri Sahitya Parishad; Glimpses of Manipuri Language, Literature
and Culture; Imphal, 1970.
- Padmasree E. Nilkanta Singh; Aspects of Indian Culture; Imphal, 1982
- Wahengbam Ibohal Singh; The History of Manipur (An early penod);
Imphal, 1996.
- Census of India – 1971; Language Handbook on Mother Tongues in
Census; Monograph No. 10; Delhi. 29 June 1972; All India Alphabetical List.
- Naorem Sanajaoba; Manipur : Past and Present, Vol-2: Delhi, 1991.
- G. A. Grierson; Linguistic Survey of India; Calcutta, 1904.
7 Census of india 2001; Paper 1 of 2007. Language : India. States and
Union Territories (Table C-16); Office of the Registrar General, India; 2/A. Mansingh Road, New Delhi-110011; November, 2007
লেখকঃ এ কে শেরাম : কবি ও গবেষক; সভাপতি, মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা, সিলেট।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
আরও কিছু লেখা
Leave a Reply
Nusrat Atika
very informative. I learned a lot. Thank you for publishing this article.