বাংলাদেশের মণিপুরী মুসলিম
2546
বাংলাদেশের মণিপুরী মুসলিম
ভূমিকাঃ
বাংলাদেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে সহ-অবস্থানকারী অতি স্বল্প পরিচিত নৃ-গোষ্ঠী হচ্ছে মণিপুরী মুসলিম, যারা পাঙল নামেও পরিচিত। এককালীন এদেশে অধিবাস সত্ত্বেও পাঙলরা তাদের ধর্মীয়, ভাষিক ও সাত স্বাতন্ত্র রক্ষা করে চলছে।
উৎপত্তি ও ইতিহাস
পাঙলদের উৎসভূমি হলো ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর। ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের তৎকালীন মহারাজ খাগেম্বার আমলে প্রথমবারের মত মণিপুরী মুসলিমরা মণিপুরে বসতি স্থাপন শুরু করেন।
মহারাজ খাগেম্বার ছোট ভাই সানোংবা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে ক্ষমতা দখলের লক্ষে তার অনুসারীদের নিয়ে মণিপুরের পার্শ্ববতী কাছাড় রাজ্যে আশ্রয় নেন।
R.K. Jhaljit Singh এর ‘A Short History of Manipur’; Jodunath Sarker এর ‘History of Bengal (Muslim Period)’; Quaji Hamid Ali এর ‘The Manipuri Muslim’; Iboonghal Singh Introduction to Manipur’ ইত্যাদি ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাঠে জানা যায় যে, ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে সানোংবা কাছাড় রাজার সাহায্যে কাছাড়ের অধিবাসীদের নিয়ে একটি সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করেন (যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান) এবং প্রথমবারের মত মণিপুর আক্রমণ করেন।
সানোংবা মুসলমানদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার বাহিনী মণিপুর আক্রমর করতে পারলে তাদেরকে সম্মানজনক পদক, সরকারি উচ্চপদসহ মণিপুর রাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দেয়া হবে কিন্তু সে যুদ্ধে তাঁরা জয়লাভে ব্যার্থ হন।
Iboonghal Singh এর ‘Introduction to Manipur’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, “In 1603 A.D, The Mayang invaded Manipur but treaty was concluded.” (এ উক্তিতে Mayang বলতে বাংলা ভাষাভাষীদেরকে বুঝানো হয়েছে)।
পুনরায় সানোংবা সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করতে যান এবং কাছাড় রাজার পরামর্শে তৎকালীন সিলেটের শাসনকর্তা বায়েজীদ কররানীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন।
কাছাড় রাজার অনুরোধে বায়েজীদ কররানী বর্তমান সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার তরফ, বানিয়াচং, বকাইনগর ইত্যাদি জায়গা থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ১৬ জন সেনানায়কসহ ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুর আক্রমণের জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন।
সানোংবাসহ মুসলমান সৈন্যবাহিনী প্রধান মোহাম্মদ সানী তাঁর বাহিনী নিয়ে কাছাড় ও মণিপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড় অতিক্রম করে বিষ্ণুপুরের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
অপরদিকে রাজা খাগেম্বা শত্রু পক্ষের আক্রমণের প্রস্তুতির খবর পেয়ে তিনি নিজে সেনাধ্যক্ষ হয়ে “থৌবাল” নামক এলাকায় থেকে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের এই যুদ্ধে মুসলমানবাহিনী পরাজয় বরণ করে এবং ৩০টি হাতি, অসংখ্য হাতবন্দুকসহ মহারাজ খাগেম্বার হাতে বন্দী হন।
আবার ভিন্ন মতাবলম্বীদের মতে ঐ ব্যাপক যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল সন্ধির মাধ্যমে।
অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধের পরবর্তী সময়েই সন্ধির মাধ্যমে মুসলমান বীর সেনানায়করা মণিপুরী মেয়ে বিয়ে করে মণিপুরের ‘লিলং’ অঞ্চলে প্রথমবারের মত বসতি স্থাপন করেন।
কথিত আছে যে, মুসলমান বাহিনী প্রধান মোহাম্মদ সানী মহারাজ খাগেম্বার ছোট রাণীকেই বিয়ে করেছিলেন সন্ধি মোতাবেক।
ফলে সৃষ্টি হয় “মাতা মণিপুরী ও পিতা মুসলমান” এর সমন্বয়ে নতুন এক সম্প্রদায়, যার নাম “মৈতৈ পাঙল” বা “মণিপুরী মুসলিম”।
অতঃপর ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে মণিপুরী রাজাদের পারিবারিক কলহের সুযোগে বার্মার রাজা মণিপুর আক্রমণ করলে চৌরজিৎ সিংহ প্রাণভয়ে শ্রীহট্টে পালিয়ে আসেন।
১৮১৯ থেকে ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ এই সাত বছর কাল মণিপুরের ইতিহাসে ‘চহী তারেৎ খুনতাকপা’ বা ‘Seven Years Devastation’ নামে খ্যাত।
এ সাত বছর মণিপুর ব্রহ্মবাহিনীর করতলগত ছিল এবং অন্যায় অত্যাচার খুবই চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ঐ সময়েই অধিকাংশ মণিপুরী মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আগমন ঘটেছিল।
বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। R.K. Jhaljit Singh তার ‘A Short History of Manipur’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন ‘There are Pathans and Mughals among the Manipuri Muslim.’
খাদ্যদ্রব্য
বাংলাদেশে অবস্থানরত মণিপুরী মুসলিমরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ন্যায় খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে থাকেন।
তথাপি নিজস্ব কিছু খাবার রয়েছে। যেমন- মরই তল (বাখর পিঠা), চিনি তল (চিনির পিঠা), তানজাম (চালের পিঠা), কাংদ্রুম (গোল ধরনের চালের পিঠা), তামাই জাম, চেগাই তল ইত্যাদি পিঠা জাতীয় খাবার।
তাছাড়াও উতংচাক (বাঁশের চোঙার ভাত), উতি (কলার দন্ড দিয়ে তৈরী তরকারী), সুঞ্জু, লাফু, উসই, থরো, ঙামু, হাংগাম সুঞ্জু (বিভিন্ন ধরনের চাটনি), হাওয়াই (হালিমের মত) ইত্যাদি খাবার উল্লেখযোগ্য।
ধর্ম ও ধর্মীয় উৎসব
পাঙল সমপ্রদায়ের আদি পিতা ছিলেন মসলিম এবং আদি মাতা হলেন মণিপুরী। ফলে এ সম্প্রদায়ে ইসলামী ও মণিপুরী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ লক্ষ করা যায়।
পাঙল সম্প্রদায় ইসলামী ধর্মাবলম্বী ও সুন্নী সম্প্রদায়ভূক্ত। তারা কিছুটা সহজ সরল, বিশ্বাসী, ধর্ম ভীরু।
পাঙল অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রামে-মক্তবে কিংবা মসজিদে ছেলে-মেয়েরানা পারিশ্রমিকে কোরআন হাদীস শিক্ষা দেন পাঙল মৌলানা ও হাফেজগন।
পাঙলরা ইসলামী আইন-কানুন শ্রদ্ধাভরে কঠোরভাবে মেনে চলেন ও বিশ্বাস করেন এবং পালন করেন। যেমন- নামাজ পড়া, রোজা রাখা, ফিতরা দেয়া, যাকাত দেয়া, হজ্জ্ব করা, মহরম, ঈদে মিলাদুন্নবী, ফাতেহা ইয়াজদাহম ইত্যাদি।
প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ উপলক্ষে পাঙল সম্প্রদায় প্রতিটি ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী খাবার আইটেম যেমন- মারই তল (বাখর পিঠা), চিনি তল (চিনির পিঠা), তানজান (চালের পঠা) কাম, চুহি লুপপি ইত্যাদি ঈদের আনন্দের আমেজে তৈরী করা হয়।
তাছাড়া ঈদের দিন একটি নির্দিষ্ট বাড়ীতে পঞ্চায়েতের সবাই একত্রে দুপুরের খাবার খেয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন, যা যুগ যুগ ধরে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করছে।
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা
পাঙল সম্প্রদায়ের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা খুবই সুদৃঢ়। যে কোন ধরনের অনুষ্ঠান, যেমন- আকিকা, চল্লিশা (নুফনি), গর্ভবতী মহিলাদের খানা, বাৎসরিক সিরনি (কুম), মাঙাম ইত্যাদি সম্পূর্ণ পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বা তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হয়।
অনুষ্ঠান সম্পাদনে প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন- চাল, মাংস, মসলা, হাড়ি-পাতিল, লাকড়ি, মাদুর, পান সুপারি, ইত্যাদি সবকিছু পঞ্চায়েত থেকে সংগৃহিত হয়।
উল্লেখ্য যে, যে-কোনো সিরনিতে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনোরকম ভেদাভেদ ছাড়াই একত্রে সবাই মাটিতে বিছানো মাদুর (ফিদা)-এ বসে এবং পঞ্চায়েতের কোন মুরব্বীর বিসমিল্লাহ বলার মাধ্যমে সবাই বিসমিল্লাহ পড়ে খাওয়া শুরু করেন, যা অন্যত্র দৃষ্টিগোচর হয় না।
এখানে গরু ও মুরগীর মাংস ইত্যাদির সাথে ঐতিহ্যবাহী তরকারী আমথাকপা (হালিমের মত) ও এরি (মাংসের ঝুল) পরিবেশন করা হয়।
তাছাড়া পাঙল সম্প্রদায়ের কোনো লোক যখন মারা যান তখন তার আত্মীয়স্বজনসহ সমাজের সবাইকে মৃত্যুসংবাদ পৌছানোও পঞ্চায়েতের দায়িত্ব।
এখানে উল্লেখ্য যে, মৃত্যু সংবাদ যে কোনো গ্রামের শুধু একজনকে জানিয়ে দিলে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে, এভাবে আমের সর্বত্র সংবাদ ছড়িয়ে দেয় যা প্রত্যেকে নিজ দায়িত্ব মনে করে পালন করে থাকে।
মৃত্যুর দিন ঐ পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা, গরীব দুঃখীদের মধ্যে চাল ও টাকা বিতরণ করা এবং রাতের বেলা যদি মারা যান তবে সারারাত জেগে পাশে কোরআন তেলাওয়াত করা, দোয়া-দরুদ পড়া এবং দাফনের পর কোরআন খতম করানোসহ যাবতীয় কাজ পঞ্চায়েতই সম্পাদন করে থাকে।
বিবাহ
পাঙল সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতার মধ্যে অন্যতম অংশ বিবাহ পর্ব। বিবাহ রীতি বাঙালী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের। এসমাজে ঘটক প্রথা চালু নেই।
বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা কতকগুলো পর্যায়ে বিভক্ত থাকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিক পরে ছেলেপক্ষের নিকটআত্নীয়রা কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং একে বলা হয় ‘হায়জাবা কাবা’।
এ পর্বে শুধু দেনমোহর সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা অতঃপর চুড়ান্ত বাগদান পর্বের জন্য অনুষ্ঠিত হয় ‘কাপুবা’ বা পানচিনির ব্যাবস্থা।
এ পর্বে ফল মূল, মিষ্টি, পান-সুপারি, খই ইত্যাদি নিয়ে বর পক্ষের মহিলাগণ পুরুষদের পাশাপাশি লুথং বা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে কনের বাড়িতে যান এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহের দিনক্ষণ স্থির করে থাকেন।
বিয়ের পূর্বদিন রাতব্যাপী বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং এটাকে বলা হল ‘পূরজাক’ ঐ অনুষ্ঠানে কনের পরনে থাকে ‘কমিন’ (বিশেষ ধরনের পোষাক), খেমদি ব্লাউজ ও মাথায় থাকে ব্যতিক্রমী কাজ ও ফুল দিয়ে ঝালর দেয়া ‘লৈত্রেং’ (গোলাকার)। অন্যদিকে বর থাকে স্বাভাবিক সাজে।
বর ও কনের উভয় অনুষ্ঠানে রাতব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী পাঙল গান । যুবক-যুবতীসহ সবাই গানে মেতে ওঠে এবং এর সাথে যুক্ত হয় থাবালচংবা (পাঙাল নৃত্য)।
যুবক-যুবতীরা আলাদাভাবে কখনো বা যৌথভাবে এ নৃত্যে অংশগ্রহণ করে থাকে। পরেরদিন বাঙালীদের ন্যায় বর পাঞ্জাবী, পায়জামা, শেরওয়ানি ইত্যাদি পরিধান করে বন্ধু-বান্ধবসহ নিজ পঞ্চায়েতের লোকজনকে (পঞ্চায়েতের লোকজন বরযাত্রী হিসেবে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী) নিয়ে বরযাত্রী দল রওনা হন।
বরের যাত্রার সময় নিজের মা-বাবা ও মুরব্বীদের সালাম করে এবং দোয়া নিয়ে ঐতিহ্যবাহী চাদর ‘কাংথমফিদার’ উপর পা দিয়ে যাত্রা করতে হয়। বর যাত্রীগণ কার, লাইটেস ইত্যাদি নিয়ে কনের বাড়ীতে পৌঁছার পর মুরব্বীদের অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে থাকেন।
কনের বাড়ীতে ওঠানে কাংথমফিদা দিয়ে বসানো হয়। উপস্থিত মুরব্বীদের উদ্দেশ্যে বরের পক্ষ থেকে গান পরিবেশন করতে হয়। পেছনে বালিশ দিয়ে বরকে বসানো হয়।
কনে বাড়ির মহল্লার ইমাম সাহেব ইসলামী তরিকায় কোরআন সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ে পড়ান। তবে তিনজন গাওয়া উকিল (১জন উকিল ও ২জন সাক্ষী) থাকেন এবং উকিলের হাতে থাকে একটি লাঠি।
বর ও কনের আলাদাভাবে বসেন এবং নিচু স্বরে কবুল বলে থাকেন এবং গাওয়া উকিল তার সাক্ষী হন। অতীতে বর ধুতি পরিধান করে পালকি কিংবা হাতি দিয়ে যাত্রা করতেন।
তাছাড়া বিয়ের পর ‘ঙাইসেল খাংনাবা’ অর্থাৎ একে অন্যের দাওয়াত দিয়ে পরিচয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতাও প্রচলিত রয়েছে।
পাঙল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী গানসমূহ-
কাসিদা (ফার্সি ভাষা), ইন্দার সাকা (উর্দু ভাষা), কাওয়ালী, পাকাওয়ালী, গজল, মারিফাতি, আসেমবা ঈশৈই (নিজস্ব ভাষায় রচিত) ইত্যাদি। প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে ২/৩ গানের দল থাকে।
গানের প্রতিযোগিতা হয় বিয়ে কিংবা অন্য কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে। ন্যূনতম ২/৩টি ছেলে ও মেয়ে নিয়ে একটি গানের দল থাকে এবং পাল্টাপাল্টি গানের প্রতিযোগিতা হয় বিপুল দর্শকের উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে।
প্রতিযোগিতা রাতে অনুষ্ঠিত হয়, কখনো কখনো রাত পেরিয়ে ভোর অবধি চলে। পরিশেষে কনের পক্ষের মুরব্বীদের হস্তক্ষেপে প্রতিযোগিতার নিষ্পত্তি ঘটে।
শিশুর গান (নাউথেম ঈশৈ)-
পাঙল ভাষা বাংলা (অনুবাদিত)
হা ইমা, ইমা- ও ….. মা-মা আমিও আসব
ঐসু লাক্কে ইমাও বৃষ্টি পড়ছে- এসোনা
নোং চুই লাক্কনু ছাতা মাথায় আসব
য়েমপের্ক উপ্তানা লাক্কে পথ পিচ্ছিল- এসোনা
লাম্বি নাল্লি লাক্কনু লাঠি ভর দিয়ে আসব- মা।
চয়শু শুদুনা লাক্কে।
ঘুম পাড়ানোর গান (নাউশুম ঈশৈ/নহা থেম্বা ঈশৈ)-
থা থা থাবুংতোন আয় আয় চাঁদ মামা
নচা মোরাম্বী পোবিগে চাঁদ চাঁদ যে পূর্ণ চাঁদ
পোবী শানাম নাম্বীগে আমার সন্তানকে কোলে পিঠ বড় করব
থৈবোং অমতং থাদরকউ। একটি কাঁঠাল ফেলে দাও আমার জন্যে।
খেলাধুলা
পাঙল সমপ্রদায়ের উল্লেখযোগ্য খেলাধূলার মধ্যে রয়েছে, যেমন- মক্না (কুস্তি খেলার মতো), কাংজাই খেলা (হকি খেলার অনুরূপ), কাং খেলা (কাং শানবা) ইত্যাদি।
মক্না খেলাটি বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে আন্ত-পাঙল ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা ছিল। খেলা হত এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা বিভিন্ন গ্রাম এলাকাভিত্তিক দল গঠনের মাধ্যমে।
মুক্না খেলায় পাঙলদের মধ্যে যারা প্রসিদ্ধ ছিলেন তারা হচ্ছেন- মোহাম্মদ ইসলাম (কোনাগাঁও), মোঃ আব্দুর রশিদ খান (পশ্চিম জালালপুর), মোঃ আব্দুল হাই (পশ্চিম কান্দিগাঁও), মৌলানা আমির উদ্দিন (পশ্চিম কান্দিগাঁও), মোঃ আমির উল্লাহ (গোলেরহাওর)।
অনুরূপভাবে কাংজাই খেলাটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। আর কাং খেলা (কাং শানবা) প্রতিবছর চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ দিন কিংবা মাসব্যাপী যুবক-যুবতীরা এ খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে এবং চুড়ান্ত খেলা হয় ১লা বৈশাখে।
পেশা
মহিলাদের প্রধান পেশা হলো বস্ত্রবয়ন এবং পুরুষগণের প্রধান পেশা হলো কৃষি। আর কৃষকদের নিত্যসঙ্গী ছিল ‘হুক্কা’ (হিদাকপু)।
ঐতিহ্যবাহী এ হুক্কা সম্পকে Quazi Harnid Ali ‘Manipuri Muslim’ বই-এ উল্লেখ করেন : “The People of Bengal used to smoke tobacco with ‘Hukka’ a‘s they were accustomed in smoking tobacco with ‘Hukka’, they might introduce it in Manipur. In course of time smoking tobacco with prevailed in Manipur.” R.K. Jhaljit Singh rightly says- ‘Smoking of tobacco was introduced in 1610 and tobacco was cultivated as a new luxury.’
আর ‘Musalman Manipuri’ গ্রন্থে Abdul Bari লিখেছেন- ‘Till e business of tobacco and its cultivation are generally done by the Muslim.’
এছাড়াও, মণিপুরী মুসলিমরা ব্যবসা বাণিজ্য, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যেও অনেক প্রবাসী চাকুরীরত রয়েছেন।
পেশাগত জরিপ (আংশিক) ২০১২
ক্রম পেশা সংখ্যা
০১ ডক্তার সংখ্যা ০৯ (বেসরকারী মেডিকেলে ২ জন লেকচারার)
০২ প্রশাসন ০১
০৩ শিক্ষক (কলেজ) ০৩
০৪ আর্মি অফিসার ০২
০৫ উকিল ০২
০৬ মেরীন ইঞ্জিনিয়ার ০১
০৭ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার ০১
০৮ কনসালট্যান্ট (ইউনিসেফ) ০১
০৯ সিভিল অফিসার ০৮
১০ ব্যাংক অফিসার ০৬
১১ এনজিও অফিসার ০৫
১২ ইন্সপেক্টর (পুলিশ) ০১
১৩ সাব-ইন্সপেক্টর (পুলিশ) ০৫
১৪ শিক্ষক (হাইস্কুল) ২২
১৫ নন-কমিশন অফিসার (তিন বাহিনী) ২০
১৬ শিক্ষক (প্রাইমারী) ৫০
১৭ তিন বাহিনী (সৈনিক) ১৫০
পোষাক পরিচ্ছদ
পাঙল সম্প্রদায়ের পোষাক পরিচ্ছদের স্বতন্ত্রতা রয়েছে। পুরুষরা বাঙালীদের ন্যায় পোশাক ব্যবহার করেন এবং মহিলাগণ নিজস্ব কোমর তাঁতে তৈরী ‘ফানেক’ (কোমর পর্যন্ত প্যাচানো কাপড় পরে থাকেন।
‘ফানেক’ বিভিন্ন রকমের হয়, যেমন- লাই, সালু, হাংগামপাল, সোনারং, চুমহাপ্পা, মকং; (বিভিন্ন ধরনের রং ও কাজ করা) ইত্যাদি।
বিবাহিত মেয়েরা লৈফানেক আরলবা, লৈফানেক মায়াইরনবি, সালু ফানেক আরনবা, লৈচিল ফানেক, উরেং আরনবা, উরেং চুমহাপ্পা, লৈচিল উরেং (বুক পর্যন্ত প্যাচানো বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের কাপড়) ইত্যাদি পরিধান করে থাকেন। তাছাড়া কোমরে কাপড় প্যাচানো থাকে এবং সাথে ইন্নাফি বা খুদাই (ওড়না) পরে থাকেন।
বিবাহিতা মহিলারা বাহিরে কোথাও বের হলে বিশেষ ধরনের এক বোরকা ও ছাতা ব্যবহার করে থাকেন। এ সম্পর্কে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদ পত্রিকার মতিন উদ্দিনের উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে পারি-
“The Manipuri Muslim women did never come out on the street as half naked-full sleeve jacket entirely bottomed up to neck, dressed up to the sole of the feet a scarf on it, above all an umbrella on head. Face or anypart of the body of any Manipuri Muslim women (except the finger of hand and feet) can never see on the street.”
ঘরবাড়ি
পাঙল সমাজের ঘরবাড়ির বৈশিষ্ট্য ও কারুকাজ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। সব ঘরবাড়ির মধ্যে প্রায় সমান কারু কাজ ছিল এবং কাঠের তৈরী ও উপরে টিন বা শনের ছাড়নি ছিল।
পূর্ব পশ্চিমমূখী ঘরকে বলা হতো ‘সাংগাই’। উত্তর-দক্ষিণ কিংবা অন্য যে কোন মূখী আড়াআড়ি ঘরকে বলা হতো ‘সাংফাই’। প্রতিটি ঘরে কমপক্ষে ২১/২২টি তারেং (খুঁটি) থাকত এবং কক্ষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল।
যেমন- পিবা-কা (ছেলের কক্ষ), ঘরের ডানদিকে নিঙল-কা (মেয়ের কক্ষ), ভিতরের কক্ষে মাইবা-কা (মা-বাবার কক্ষ), সামনের দিকে ফুংগা (রান্নাঘর), তিন পায়াবিশিষ্ট জসবি (এংগেল) দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের চুলা থাকত ঘরের ভিতরে সোজা মূল দরজা বরাবর।
শিশুর নামকরণ
পাঙল সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মের পর শিশুর নামকরণেও নিজস্বতা রয়েছে। ছেলেদের নামসমূহ হলো- তলেন, মাজাউ, আমুদল, আমুজাউ, মুরেল, চাউতেল, আচাউ, পিতু আবুং, তনজাও, মুথই ইত্যাদি।
আর মেয়েদের নামসমূহ হলো- লেহাউ, সানাতম্বি, তম্বিসানা, ঙাউবি, সানানু, ইবেমলাই, তনু, ইবেথই, খইনু, সানারাই, জাইবি ইত্যাদি।
জনসংখ্যা ও বাসস্থান
বাংলাদেশে অবস্থানরত পাঙলদের মোট জনসংখ্যা ১০,০০০ (দশ হাজার)। বর্তমানে বসবাসরত মণিপুরী মুসলিম (পাঙল) গ্রামসমূহ (জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নভিত্তিক) :
জেলা: মৌলভীবাজার, উপজেলা: কমলগঞ্জ, ইউনিয়ন : ইসলামপুর
১) মোকাবিল, ২) রাতাবাড়ী, ৩) গোলেরহাওর, ৪) কালারায়বিল (একাংশ), ৫) নওয়াগাঁও (একাংশ)।
ইউনিয়ন: আদমপুর
৬) কেওয়ালীঘাট, ৭) হকতিয়ারখোলা, ৮) পশ্চিম জালালপুর, ৯) পূর্ব জালালপুর, ১০) জালালপুর, ১১) কালারায়বিল (বাকী অংশ), ১২) নওয়াগাঁও (বাকী অংশ), ১৩) কোনাগাঁও, ১৪) নয়াপত্তন, ১৫) তেতইগাঁও, ১৬) আদমপুর বাজার, ১৭) কান্দিগাঁও, ১৮) ঘোড়ামারা, ১৯) ঘোড়ামারা (বন্দরগাঁও), ২০) নেজাতকোনা, ২১) তিলকপুর, ২২) দক্ষিণ তিলকপুর, ২৩) হোমেরজান।
ইউনিয়ন : মাধবপুর
২৪) শুকুর উল্লারগাঁও, ২৫) পুরান বাড়ী ২৬) ফুলতলী।
ইউনিয়ন : কমলগঞ্জ
২৭) জামিরকোনা।
পৌরসভা : কমলগঞ্জ
২৮) কুমড়াকাপন।
জেলা: মৌলভীবাজার, উপজেলা সদর
২৯) বরশী জোড়া।
জেলা: সিলেট, উপজেলা: খাদিমনগর
৩০) খাদিমপাড়া।
নিচে যে গ্রাম সমূহ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্তির পথে তা উল্লেখ করা হলো :
গোলাপগঞ্জ উপজেলার দিওয়ানের চোক, বাঁশতোলা, হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং কুলাউড়া উপজেলার লংলা, কোটারকোনা এবং কমলগঞ্জ উপজেলার চৈত্রঘাট।
তাছাড়া ভারতের মণিপুরে ৫১টি গ্রাম, আসামে ৩৯টি গ্রাম, ত্রিপুরায় ৮টি গ্রাম, বার্মাতে ১টি গ্রাম, সৌদিআরবে ৩টি গ্রাম রয়েছে।
শাগৈ বা গোত্র
মণিপুরী মুসলিমদের মধ্যে মোট ২৬টি শাগৈ বা গোত্র রয়েছে এবং তন্মধ্যে নিমোক্ত গোত্রের লোক বাংলাদেশে অবস্থান করছে। যেমন- ময়চিং, ইফাম, থৌবাল, কিয়াংবাই, কাইনৌ, সাজবম, তাংথং, কন্থা, তামবাকনাই, ইংখাম, নবাব, সাংগমসুমবা, খাইদেল ইনখল, ময়নাম, কাউচিং ইত্যাদি।
শিক্ষা
পাঙল সমপ্রদায়ে সাক্ষরতার হার প্রায় শতভাগ। স্কুলগামী শিক্ষার্থীও প্রায় শতভাগ এবং ঝরে পড়ার হার খুবই নগণ্য।
কিন্তু এসএসসি পাস করার পর আর্থিক দৈন্যতা ও অসচেতনতার কারণে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে না গিয়ে চাকুরিতে যোগদানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে উচ্চ শিক্ষার হার হ্রাস পাচ্ছে।
পরিবার ব্যবস্থা
মণিপুরী মুসলিম পরিবার পিতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ সম্পত্তির বা বংশ পরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। এ সমাজে যৌথ পরিবারের আধিক্য বেশী।
দৈহিক বৈশিষ্ট্য
মৈতৈ পাঙলদের (মণিপুরী মুসলিম) চোখ বড়, নাক উচু, গায়ের রং ফর্সা ও শ্যামলা, চুলের রং কালো, উচ্চতা লম্বা ও মাঝারি ধরনের।
অলংকার
মণিপুরী মুসলিম মেয়েরা যেসব অলংকার গলায় পরে তা হলোঃ- সাংখাই কবজ, খাউরি থুংবি, লিকুপ, সন্ত্রিক, পংদ্রুম, সান্দ্রেমবি, লিকচাউ পারেং ইত্যাদি।
নৃত্য
পাঙল সম্প্রদায়ের একটি ঐতিহ্যগত ট্র্যাডিশন হচ্ছে থাবল চোংবা। সাধারণত কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে কিংবা কোনো বিশেষ উৎসবে যুবক যুবতীরা আলাদা ও যৌথভাবে পরিবেশন করে থাকে। এর প্রচার ও প্রসারের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।
সামাজিক সংগঠন
পাঙল সমাজকে এগিয়ে নিতে যেসব সংগঠন আন্তরিকভাবে কাজ করে চলেছে, সেগুলো হলো : বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম ডেভেলাপমেন্ট অর্গানাইজেশন (রেজি:), বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম এডুকেশন ট্রাষ্ট, মণিপুরী মুসলিম টিচার্স ফোরাম, বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম মহিলা সমিতি, অর্পম, বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম সৈনিক ক্লাব, বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম ছাত্রকল্যাণ পরিষদ ইত্যাদি।
পাঙল সম্প্রদায় নানা প্রতিকুলতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে, তবে সে গতি অত্যন্ত মন্থর। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় সকল বাধা পেরিয়ে এই জনগোষ্ঠী দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এটাই সকলের ঐকান্তিক চাওয়া ও প্রত্যাশা।
লেখকঃ সাজ্জাদুল হক স্বপন : লেখক, প্রাবন্ধিক ও সংস্কৃতি কর্মী।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।