মনিপুরী রূপকথা: মিথ্যা বলার পরিণাম
986
সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামে ছিল একটি ছোট পরিবার।
পরিবারে স্বামী-স্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। স্ত্রীর নাম পাচতলেইমা। পাচতলেইমা ছিল খুব অলস।
পাশের বাড়ির বউ তাড়ালেইমা ছিল কর্মঠ। তাড়ালেইমার কাজ দেখে সবাই প্রশংসা করত।
রাস যাত্রার নাচও সে খুব ভালো জানে। মৃদঙ্গের গমগম ধ্বনিতে তাড়ালেইমা বহুবার নেচেছে। শুধু তাই নয়, সে নানান ধরনের চাদর, গামছা, শাড়ি বুনতে পারে।
পাচতলেইমার স্বামী একদিন স্ত্রীকে ডেকে বলল, ওহে গৃহলক্ষ্মী, তোমার মতো একজন তো পাশের বাড়িতেও আছে, ওর কারুকাজ তুমি কি দেখতে পাও না?
বাড়িতে অতিথি এলে বসতে দেয়ার মতো কোনো কিছু নেই। অতিথিকে পরতে একটা বড় গামছাও দিতে পারবে না।
কেউ একজন ঘুমাতে এলে একটি বাড়তি বিছানার চাদরও নেই। এভাবে কী থাকা যায়? তুমি তোমার মায়ের বাড়ি চলে যাও।
স্বামীর কথা শুনে পাতলেইমা ভয় পেয়ে বলল, তুমি আমাকে আলসে ভাবছ?
বাচ্চার জ্বালায় কিছুই করতে পারছি না। আচ্ছা, তুলা নিয়ে আস, আমি কি করতে পারি দেখাব।
স্বামী কথাটা শুনে খুশি হলো। সে ভাবল, আমার বউ আসলেই কর্মঠ নারী।
তাড়ালেইমা তাদের আলাপ শুনল। সেও স্বামীকে বলল, চরকাটা ঠিক করে দাও।
স্বামী বলল, ঘরে তুলা নেই। তুলা আনতে হলে কুকী পরিবারে যেতে হবে। তাড়াইলেমা বলল, তুলার দরকার নেই।
ওদিকে পাচতলেইমার স্বামী পাহাড়ি এক কুকী পরিবার থেকে তুলা এনে দিল। কুকীদের শর্ত হলো অর্ধেক তাদের দিতে হবে।
তুলার আবার বিভিন্ন জাত আছে। পাচতলেইমার স্বামী যে তুলা এনেছে তা একেবারে ধবধবে সাদা তুলা।
তারপর স্ত্রীকে বলল, বুনন কাজে তোমাকে পাশের বাড়ির তাড়াইলেমাকে হারাতে হবে। এগুলো শেষ হলে আরও এনে দিব।
দিন যায়। পাচতলেইমা তুলা দিয়ে কাপড় আর বুনে না। সে ঐ তুলা দিয়ে সন্তানের পায়খানা পরিক্ষার করে প্রতিবেশীর ক্ষেতে ফেলে।
আর তাড়ালেইমা সে সব সংগ্রহ করে ময়লাগুলো বাদ দিয়ে পরিস্কার তুলা জমা করে।
এদিকে পাচতলেইমার স্বামী ভাবে, তার বউ এবার চাদর, গামছা বুনবে। কোনো কিছুই আর কিনতে হবে না।
নিজের কাপড় নিজে বুনলে আর কারো কাছে যেতে হবে না। ভাবতে তার খুব ভালো লাগল।
একদিন পাচতলেইমার স্বামী জিজ্ঞাসা করল, তুলা যে এনেছিলাম তা কোথায়?
পাতলেইমা বলল, ধনুক দিয়ে তুলা কাটা শেষ। কিন্তু কাপড় বুনতে গিয়ে দেখি বাড়িতে চরকা নেই।
কীভাবে আমি কাপড় বুনব? তখন স্বামী চরকা, সুতার নল ও বসার পিড়ি এনে দিল।
তারপর বলল, কোন দিন তুমি কাপড় বুনবে? পাচতলেইমা বলল, কাল রাতে ধানের আধারে কী রকম শব্দ হলো তা শুনেছ?
আমি ইদুরের ভয়ে একটি ঝুড়িতে ভরে ধুনা তুলার নলগুলো ধানের আধারে রেখেছিলাম।
স্বামী বলল, দেখি কতটা তুলা ধুনেছ। ধানের আধারে মাত্র একটি ধুনা তুলার নল ছিল। পাচতলেইমা ঐটিই বারবার এনে দেখাল।
এদিকে তাড়ালেইমা পাচতলেইমার ফেলে দেওয়া তুলা দিয়ে সুন্দর সুন্দর কারুকাজ করে কাপড় বুনল।
পাচতলেইমার স্বামী আবার একদিন বলল, কোথায় তোমার সুতা আর চরকা। শুভদিন দেখে কাপড় বুনা শুরু কর।
পাচতলেইমা বলল, আরাম্ভ করি বললেই তো করা যায় না। সুতা মিহি করা বাকি রয়েছে, ভাতের মার লাগাতে হবে।
তাড়ালেইমা তাদের কথাবার্তা সব শোনে। সে একদিন পাচতলেইমার স্বামীকে ডাকল, দাদা আমাদের বাড়িতে একটু আস।
ডাক শুনে পাতলেইমা স্বামীকে বলল, সেদিন যে সব সুতা ধুনে ভাতের মার দিয়েছিলাম, তা তেলাপোকা আর ইদুরের ভয়ে সরিয়ে রেখেছি।
এসো, একবার দেখে নিই। স্বামী বলল, তাড়াতাড়ি দেখ। স্বামী দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই পাচতলেইমা তাড়াতাড়ি ধানের গোলায় ঢুকে পড়ল।
ঢুকেই মাগো বাবাগো শেষ হলাম গো বলে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে। স্বামী এক লাফে ধানের গোলায় উঠে দেখল বউ বসে বসে কাঁদছে।
স্বামী জিজ্ঞেস করল, কাঁদছ কেন? পাচতলেইমা বলল, এতদিন যেসব সুতা তৈরি করেছি, সব কেটে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেছে।
একটি মাত্র সুতার নল রয়েছে। এখন আমি কী দিয়ে কাপড় বুনব? স্বামী কোনো কিছু না বলে মন খারাপ করে গোলার দরজা থেকে নেমে আসে।
ওদিকে তাড়ালেইমা আবার পাচতলেইমার স্বামীকে ডাকল, দাদা তুমি কি একবার আমাদের বাড়ি আসবে?
পাচতলেইমার স্বামী তাড়ালেইমার বাড়ি গেলে তাড়ালেইমা খুব আদর সম্মান করে তাকে বসতে দিল।
তারপর সে যে সব শাড়ি, ওড়না, বিছানার চাদর এবং আরও যা যা বুনেছে তা দেখিয়ে বলল, এসব তোমার তুলা দিয়ে বুনেছি।
তারপর পাচতলেইমার স্বামীকে সে সমস্ত কথা খুলে বলল। পাচতলেইমার স্বামী অবাক হয়ে তাড়ালেইমার দিকে একবার, সুন্দর কারুকাজ করা লোভনীয় কাপড়গুলোর দিকে একবার তাকাতে লাগল।
তাড়ালেইমা বলল, দাদা, অবাক হয়ে বসে রইলে কেন? এসব থেকে তোমার পছন্দমতো অর্ধেক নিয়ে যাও, বাকি অর্ধেক আমার জন্য রাখ।
এগুলো তো তোমার তুলা দিয়ে বুনেছি।
পাচতলেইমার স্বামী বলল, থামো, থামো হে আমার বোনটি। আমার সঙ্গে কাপড় ভাগাভাগি করতে যেও না।
যে কুকী পরিবার থেকে আমি তুলা এনেছিলাম তার সামনে ভাগাভাগি করতে হবে।
তাড়ালেইমা একটি কারুকাজ করা বিছানার চাদর, একটি শাল, একটি গামছা দিয়ে বলল, নাও দাদা এগুলো তোমার ব্যবহারের জন্য নিয়ে যাও।
বাকিগুলো আমি ঐ কুকী পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করব। পাচতলেইমার স্বামী কয়েকটি রঙিন চকচকে কারুকাজ করা কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরল।
বাড়ি ফিরে মিথ্যেবাদী আলসে স্ত্রী পাচতলেইমাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। পাচতলেইমা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
রূপকথাটি রণজিৎ সিংহ কতৃক বর্ণিত
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।