আমার কিশোরকাল – ড. মানিক লাল দেওয়ান

Jumjournal
Last updated Dec 5th, 2019

1770

featured image

চতুর্থ শ্রেণি পাস করার পর আমাকে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কিন্তু কার বাসায় থেকে আমি পড়াশোনা করব তা নিয়ে সকলে চিন্তিত ছিলাম।

বাবার বাল্যবন্ধু বাবু নিশিকান্ত তালুকদারকে অনুরোধ করাতে তিনি আপার রাঙ্গামাটিস্থ বাসায় আমাকে রাখতে রাজি হলেন।

এক বুক আশা ও আগ্রহ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলের একমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৪৫ খ্রি: সম্ভবত জানুয়ারি মাসে ভর্তি হই।

ছাত্র সংখ্যা ক্লাসে বিশের বেশি হবে না। একজন ছাত্রী ছিল। নিশিকান্ত বাবুর বাসা থেকেই স্কুলে আসা যাওয়া শুরু করলাম।

বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব এক মাইল। আমরা হেঁটেই স্কুলে যেতাম কারণ তখন কোন গাড়ি ঘোড়ার প্রচলন ছিল না। সকাল ১০ টায় ক্লাস শুরু হত এবং অপরাহ্ন ৫টায় স্কুল ছুটি হত।

দুপুর বেলা ১টায় আধ ঘটার জন্য টিন ছুটি ছিল। সাধারণত এক মুঠো মুড়ি অথবা কয়েকটি ভাজা বাদাম রুমালে বেধে প্রত্যেকে দেওয়া হত। হৈ হল্ল করে সেগুলি খাওয়ার মজাই আলাদা ছিল।

স্কুলের দপ্তরি কামিনী দে স্কুলের টিফিন দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি হলেন বাজার ফান্ড অফিসের অবসরপ্রাপ্ত হেড ক্লার্ক ও মাঝেরবস্তী নিবাসী জয়ন্ত দে বাবুর স্বর্গীয় পিতা।

তিনি তাঁর শুভ্র মাথায় কোন দিন সময় মত ঘণ্টা বাজাতে বা টিফিন দিতে ভুল করেছেন বলে মনে হয় না।

আমার সহপাঠী বন্ধুদের সাথে দু এক দিনেই খাতির হয়ে গেল। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ক্লাস সহপাঠীদের অনেকের নাম আমার মনে নেই।

তখন মি: ফজলুল করিম ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। যিনি প্রায়ই লাল তুর্কী টুপি মাথায় দিয়ে চলাফেরা করতেন।

তার আমলে আমাদেরকে স্কুলে সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কাপ্তাইয়ে একটি বনভোজনের আয়োজন করা হয়।

আমরা সুশৃংখলভাবে লঞ্চ থেকে নেমে কাপ্তাই বনভূমিতে প্রবেশ করি।

বন্য জন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা কার জন্য বনে নির্দিষ্ট স্থানে পিকনিকের ব্যবস্থা করা হয়। গহীন বনে ঢুকতে বা ঘুরাফিরা আমাদের জন্য নিষেধ ছিল।

পিকনিকের স্পটের কাছেই একটি মাচা ঘরের বিশাল কাঠের তৈরি বাংলো। এই বাড়ির সামনেই আমরা কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর সারিবদ্ধভাবে বসে পড়লাম।

প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা সার্বক্ষণিক আমাদের দিকে নজর দিচ্ছিলেন। কাপ্তাই এর সংরক্ষিত বনাপল তখন শিহরণ জাগানো বনভূমি।

বিশাল আকারের সেগুন গাছ ও অজস্র মূল্যবান নানাজাতের গাছে পরিপূর্ণ ছিল এই বন। ছায়া সুশীতল ছিল বনের পরিবেশ। এক নতুন অভিজ্ঞতা আমাদের কিশোর মনকে আনন্দে দোলা দিয়েছিল।

কর্ণফুলীর দু’কলে ছিল গহীন অরণ্য। বহুজাতের বন্যপ্রাণি; যেমন- হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, হরিণ, বনমুরগি ও জানা অজানা বহু পশুপাখির অভয়স্থল ছিল এই অরণ্য।

এক কালে গণ্ডার , গয়াল, কালো বাঘ এবং ময়ুরও ছিল সংরক্ষিত পার্বত্য চট্টগ্নামের বনাঞ্চলে। ইতিহাস বলে ১৭৬০ খ্রি: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মীর কাসেমের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চল লীজ নেয়।

সে বছরেই বৃটিশরা এই বন্দরে অবতরণ করে। তার ১০০ বছর পরে ১৮৬০ খ্রি: বৃটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে একটি জেলাতে রূপান্তরিত করে।

চাকমা রাজা দৌলত খা ও তদীয় পুত্র জানবাক্স খা এবং সেনাপতি রনু খা দেওয়ান কয়েকার যুদ্ধ করে বৃটিশ আগ্রাসন ঠেকাতে পারেননি। জানবাক্স খা ১৭৮৫ খ্রি: বশ্যতা স্বীকার করার পর উনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয়ার্ধ্বে ১৮৭১ সালে ইংরেজরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বনায়ন শুরু করে।

অতএব ১৯৪৫ সালে প্রায় শত বছরের পুরনো কাপ্তাইয়ের সবুজ বনে আমরা বনভোজন করেছি। এটি ছিল আমার জীবরের প্রথম বনভোজন এবং একটি স্মরণীয় মুহূর্ত।

বনভোজে কি কি খেয়েছিলাম তা মনে নেই। তবে ভাত ও ডিমের কথা মনে আছে। হেডমাস্টার স্যার খাওয়ার সময় বার বার জিজ্ঞাসা করছিলেন ‘লাগছে কেমন’?

আমরা উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিয়েছিলাম ‘বেশ বেশ’। পিকনিক শেষে অপরাহ্নে আমরা লঞ্চে উঠলাম এবং কর্ণফুলীর দু’তীরের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটি ফিরে এলাম।

১৮৬০ খ্রি: পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি করা হয়। এই জেলার প্রাণকেন্দ্র ছিল রাঙ্গামাটি। রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ ইংরেজি স্কুলই ছিল শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় তিনটি মহাকুমা যথা- রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবান ছিল। রামগড় ও বান্দরবানে কোন হাই স্কুল ছিল না। রাঙ্গামাটি শহরটি গাড়ি-ঘোড়া বা যান-বাহন বিহীন একটি বাজার বললেও ভুল হবে না।

শহরটি দু’ভাগে বিভক্ত ছিল, আপার ও লোয়ার রাঙ্গামাটি। বর্তমান আসামবস্তী সংলগ্ন কৃষিখামার থেকে ডিসি বাংলো পর্যন্ত এলাকাকে আপার রাঙ্গামাটি বলা হত।

ডিসি বাংলোটি বৃটিশ আমলে তৈরি অন্যতম কলোনীয়াল পুরাতন ভবন। এই ভবন সংলগ্ন পূর্ব পাশে ডিসি অফিস ছিল। বর্তমান ডিসি বাংলো এর গোড়া থেকে প্রায় এক মাইল দীর্ঘ পোয়া মাইল প্রস্থ একটি উপদ্বীপ পূর্ব দিকে প্রসারিত ছিল। যা মোটামুটি সমতল।

এই উপদ্বীপটিকেই লোয়ার বা নিচু রাঙ্গামাটি বলা হত। এটিই ছিল রাঙ্গামাটি শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। উপদ্বীপের প্রথম অংশে ছিল ডিসি অফিস, সড়ক ও জনপথ অফিস, পোস্ট অফিস ও থানা কতোয়ালী।

এরপর একটি বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। মাঠের উভয় পার্শ্বে ছিল অনেক বিশাল আকারের মেহগিনি গাছ যা দিন দুপুরে প্রতিনিয়ত ছায়া দান করত। এই উপদ্বীপের তিন দিক (পার্শ্বে) কর্ণফুলী নদী দ্বারা বিধৌত।

মাঠের দু’পার্শ্বে দুটি পাকা রাস্তা যা পরবর্তীতে মিলিত হয়ে উপদ্বীপের পূর্ব সীমানা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এ রাস্তার দু’পাশে সরকারি কর্মচারীদের সারিবদ্ধ বাসা ও আম্র-নিকুঞ্জ পথচারীকে মোহিত করত।

তখন বসন্তে অসংখ্য কোকিলের আগমন ছিল এবং তাদের কুহু কুহু ডাকে রাঙ্গামাটির পরিবেশ মোহময় হয়ে উঠত। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধের পানি আসার সাথে সাথে কোকিল ও অন্যান্য পাখির সংখ্যা কমে গেছে।

তবে সুখের বিষয় বিগত কয়েক বছর যাবৎ কোকিল ও অন্যান্য পাখির সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। পাতিকাকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া রাঙ্গামাটিতে অন্যান্য পাখিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মনে হয়।

তা সত্ত্বেও শহরে দ্রুত গাছ-গাছরা লাগানো হচ্ছে বিধায় বনানী সৃষ্টি হচ্ছে এবং পাখির সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। কাপ্তাই বাঁধের আগে রাঙ্গামাটিতে বা পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন অঞ্চলে পাতিকাক ছিল না। দাঁড়কাক ছিল। এখন পাতিকাকের আক্রমণে দাঁড়কাক প্রায় উধাও।

কর্মচারীদের কলোনীর শেষ প্রান্তে ডান পাশে ছিল সরকারি হাসপাতাল ও বাম পাশে ছিল ছোট একটি কারমাইক্যাল ক্লাব। এরপর ছিল চার সারি বিশিষ্ট বিশাল এক বাজার।

বৃটিশ আমলের শেষের দিকেও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর তুলা উৎপন্ন হত। ঐতিহাসিকভাবে তুলার মাধ্যমেই চাকমা রাজা মোগলদেরকে খাজনা দিতেন।

এই কার্পাস তুলা ব্রিটিশদের বড় আকর্ষণ এবং চট্টগ্রাম দখল করার অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। রাঙ্গামাটি বাজারে বিশাল বিশাল তুলার স্তূপগুলি আমার স্মৃতিতে এখনও অম্লান হয়ে আছে।

মনে হয় এই তুলা ইংল্যান্ডে চালান দেওয়া হত। অধিক তুলা উৎপাদনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম মোগল আমলে কার্পাস মহল নামে পরিচিত ছিল।

১৯৪৭ সালে ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের সাথে একীভূত হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে তুলার উৎপাদন ক্রমশ কমতে থাকে। রাঙ্গামাটি বাজারের শেষ প্রান্তের বাম কোণে একটি কালীমন্দির ও ডান কোণে একটি মসজিদ ছিল।

কালীবাড়ি ও মসজিদের মাঝখানে একটি খালি মাঠ ছিল। যেখানে প্রতিবছর বলী খেলার আয়োজন করা হত। কালীবাড়ির পাশেই বিশাল এক বহু বছরের পুরনো বটগাছ ছিল যেখানে হাজার হাজার বাদুর ঝুলে থাকত৷

লোয়ার রাঙ্গামাটির শেষ প্রান্তে কর্ণফুলীর বালুর চড়ে পানি থেকে বুদবুদ উঠত যা আগুন দিলে জ্বলত। কেউ কেউ সেখানে গ্যাসের খনি আছে মনে করত।

কিন্তু ১৯৬১ সনে কাপ্তাই বাধে লোয়ার রাঙ্গামাটি সম্পূর্ণ জলমগ্ন হলে সেই বুদ বুদ আর গ্যাসের কথা হয়ত সবাই ভুলে গেছে।

তবলছড়ি, রিজার্ভ বাজার, পুরনো বাস স্টেশন, কাঁঠালতলী, বনরূপা, চম্পক নগর, কালিন্দীপুর, ট্রাইবেল আদাম, দেবাশীষ নগর, কল্যাণপুর, কলেজ গেইট, ভেদভেদী ইত্যাদি নবসৃষ্ট রাঙ্গামাটির অংশগুলো গহীন জঙ্গলে ঢাকা ছিল।

বর্তমানে এই গ্রামগুলো আপার রাঙ্গামাটি বা রাঙ্গামাটি শহরের বিশেষ অংশ। কর্ণফুলীর পূর্ব পাড়ে বর্তমান ডিসি বাংলোর পূর্ব দক্ষিণ দিকে প্রায় আধ মাইল দূরে ছিল চাকমা রাজবাড়ী, অনেকটা বাকিংহাম প্যালেসের মতো করে তৈরি ছিল এই সুন্দর অট্টালিকা।

রাজা ভূবনমোহন রায় এই বাড়ি তৈরি করেন। রাজবাড়ির ফটকের দুই পাশে ছিল পাথরের তৈরি দুটি বড় সিংহ মূর্তি। ১৯৬১ সালে কাপ্তাই হ্রদের জলে এই ঐতিহাসিক রাজবাড়ি নিমজ্জিত হয়।

১৮৬০ সালে বৃটিশ দখলের পর পার্বত্য তা গ্রামের হেডকোয়াটার্স ছিল চন্দ্রঘোনা। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি পূর্ণাঙ্গ জেলাতে পরিণত হলে রাঙ্গামাটিতে হেডকোয়াটার্স স্থানান্তরিত করা হয়।

আমাদের প্রিয় স্কুল রাঙ্গামাটি সরকারি হাই ইংলিশ স্কুল সম্বন্ধে কিছু বলতে হয়। রাজা ভূবনমোহন রায়ের লেখাপড়ার জন্য বৃটিশ সরকার একটি এমই (মিডল ইংলিশ) স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয়।

রাজা ভুবনমোহন রায়ই সর্বপ্রথম এই স্কুল থেকে এ্যানট্রেন্স পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি রাজা হলে তাঁর সম্মতিক্রমে এই স্কুলটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

অতএব চাকমাদের শিক্ষান্নোয়নে রাজাদের অবদান নেই এ অপবাদটি সঠিক নয়। শিক্ষা প্রসার ও মেধা সন্ধানে রাজা ভূবনমোহন রায় ও তদীয় ছোটভাই রমনীমোহন রায় তৎকালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ ইংরেজি স্কুলের ছাত্রদের জন্য ইংরেজি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন এবং বিজয়ীদের রৌপ্য তৈরি মেডেল দিতেন।

আমার প্রয়াত শ্বশুর বাবু নিশিকান্ত তালুকদার ১৯২৩ সালে ‘পর হিতৈষণা’ এবং ১৯২৪ সালে Labour in Honour (শ্রমের মর্যাদা)-র উপর বাংলা ও ইংরেজি রচনা লিখে যথাক্রমে কুমার রমনীমোহন রায় ও রাজা ভূবনমোহন রায়ের রৌপ্য মেডেল অর্জন করেন।

তিনি ১৯২৫ সালে Mathmatic (Compulsory), vernacular and classics (Pali) both in Compulsory and additional papers-এ লেটার নম্বর পেয়ে এবং Marked with a star হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

তাঁর মত মেধাবী ছাত্র আমাদের চাকমা জাতিতে কম জন্মেছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় কানের ভুল চিকিৎসার জন্য তিনি বধির হয়ে যান।

যার ফলে তিনি মাসিক বিশ টাকা হারে বৃত্তি অর্জন করেও উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যেতে পারেননি এবং সারা জীবন ডিসি অফিসের কেরানীর চাকুরি করে ১৯৭৯ সালে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

আমি মনে মনে চিন্তা করি বৃটিশ আমলে যারা ICS পদ লাভ করতেন তাঁরাও সকলে নিশিকান্ত বাবুর মত মেধাবী ছিলেন না।

অতএব আমার প্রয়াত শ্বশুরও যদি সুস্থ শরীরে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারতেন তার ইংরেজি ও অন্যান্য শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান নিয়ে ICS পরীক্ষা পাস করা তার জন্য তেমন কোন কঠিন কাজ ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়।

ইংরেজি তিনি এত ভাল জানতেন এবং লিখতেন যে তৎকালীন ডিসি নিবলেট নাকি বলতেন “Nishi Kanta knows from A to Z অতএব নিশিকান্ত বাবুর মত একটি বিরল মেধা ও প্রতিভা ঝরে যাওয়া বা নষ্ট হওয়া চাকমা (জাতির জন্য একটা দুর্ভাগ্য বটে।

বাবার বাল্যবন্ধু নিশিকান্ত তালুকদারের বাসায় আমার ঠাই হল। এই বাসায় থেকে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে আমার পঞ্চম শ্রেণির পড়ালেখা শুরু হল ১৯৪৫ সালে।

নিশিকান্ত বাবুর স্ত্রী তরঙ্গিনী একজন সাদাসিধে পরম দরদী মহিলা। তিনি আমাকে নিজ সন্তানের মতই গ্রহণ করলেন। আমি নিশি বাবুকে কাকা এবং তাঁর স্ত্রীকে পিসিমা ডাকতাম। নিশি পরিবার বেশি বড় নয়।

দু’ছেলে ও দু’মেয়ে। বড়ছেলে প্রভাস দাদা তখন দশম শ্রেণিতে পড়তেন। বড়মেয়ে মিনতি দিদি কেন যেন নিম্ন প্রাইমারি পাশ করে আর পড়তেন না, দ্বিতীয় ছেলে প্রশান্ত বয়সে আমার একটু ছোট এবং আমার বোধহয় দু’ক্লাস নিচে পড়ত।

সর্বকনিষ্ঠ সন্তান দীপিকা (কল্যানী) তখন নিম্ন প্রাইমারিতে পড়ত। সে পরবর্তীতে আমার সহধর্মিনী হয়।

আমার মনে হয় পরদরদী ও বদান্যতার জন্য তালুকদার পরিবারটি নিজ সন্তানদের প্রতি নজর দিতে পারেনি।

যার ফলশ্রুতিতে ছেলেমেয়েদের ভিতর কেউ উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারেনি। বড় ছেলে প্রভাসদা ম্যাট্রিক পাস করে কলিকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে কয়েক বছর পড়াশোনা করে দেশে ফিরে আসেন।

পরে বাপের মতই ডিসি অফিসের একটি কেরানী চাকুরিতে যোগ দেন। বড় মেয়ে মিলি দি (মিনতি দিদি) সম্বন্ধে আগেই বলেছি। ছোট ছেলে প্রশান্ত (বাদল) এর পড়াশোনার প্রতি কোন আগ্রহ ছিল না।

মজার ব্যাপার হল পাস ফেলের প্রতি তার কোন অনুভূতি ছিল না। সে পরীক্ষায় প্রায়ই ফেল করত কিন্তু এতে কোন লজ্জা বা অনুশোচনা ছিল না। স্কুল থেকে এসে মাকে হাসি মুখে বলত মা আমি ফেল করেছি।

১৯৫২ সালে মায়ের মৃত্যুর পর ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় তার ও ছোট বোন দীপিকার (কল্যানী) উচ্চতর পড়াশোনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে পিতার মেধা কোন ছেলে মেয়ের কাছে প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে ছোট মেয়ে দীপিকা সুযোগ পেলে শিক্ষায় অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত বলে আমার ধারণা। আমার বৈবাহিক জীবনে এর প্রমাণ আমি পেয়েছি।

এখন নিজ সম্বন্ধে কিছু বলি তালুকদার বাড়িতে আসার পর দেখলাম আমার মত আরও তিনজন বাইরের ছেলে, তবে নিশিকান্ত বাবুর আত্মীয় এ বাসায় থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।

তারা হল সুমতি কাকা, দেবেন দাদা উভয়েই ক্লাস টেন এর ছাত্র। অন্যজন ধীরেন দা আমার এক ক্লাসের উপরে অর্থাৎ ক্লাস সিক্স এর ছাত্র। নূতন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে খুব বেশি সময় লাগল না।

ঝগড়াবিলে থাকতে আমার বড় বোন স্বর্ণলতা দিদি যেমন আমার ভরসা ছিল এখানেও মিনতি (মিলি দি) বয়সে যে আমার দু এক বছরের বড় ঠিক বড় বোনের মত আচরণ করতে লাগল।

পরিবাবের একমাত্র তার সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল যেহেতু লোয়ার প্রাইমারি স্কুলে এক সাথে পড়েছিলাম। তার সহযোগিতা ও সহমর্মীতায় তালুকদার বাড়িকে নিজের বাড়ি বলে মনে হতে লাগল।

খুব মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া শুরু করলাম। পড়া না বুঝলে মাঝে মাঝে সিনিয়রদের বা স্বয়ং নিশিকান্ত বাবুর কাছ থেকে শিখে নিতাম। একমাত্র ডিসি বাংলো ছাড়া আর শহরের কোন বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না।

খেলার মাঠের এক কোণায় বসানো ছোট একটি জেনারেটর থেকে ডিসি বাংলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হতো। আমরা কেরোসিনের হারিক্যান জ্বালিয়ে রাতে পড়াশোনা করতাম।

আমি এবং আমার মত অনেক ছেলে হাফপ্যান্ট পড়ে স্কুলে যেতাম। পায়ে জুতা, স্যান্ডেল পড়ার সুযোগ বা সামর্থ ছিল না। ফোম বা প্লাস্টিক তখন আবিষ্কার হয়নি।

বাসায় কাঠের খড়ম পড়তাম বিশেষ করে পা ধুয়ে রাতে বিছানায় যাওয়ার সময়। প্রায় সবাই খালি পায়ে স্কুলে যেতাম।

তখন ১৯৪৫ সাল। সারা পৃথিবী যুদ্ধে মত্ত। অভাব অনটন মানুষের নিত্য সঙ্গী। তদুপরি আমাদের দেশ বা সমগ্র ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন দেশ। বৃটিশরা তখন নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য ব্যস্ত।

ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষের মঙ্গল চিন্তা করার সময় কোথায়? মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ প্রায় সমগ্র দেশকে গ্রাস করেছিল। তবে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের সমসাময়িক অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল।

জনসংখ্যা ছিল পাহাড়ি প্রধান ও সংখ্যায় কম। ভূমি ছিল বেশি ও উর্বর। অতএব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অনাহারে খুব কম লোক হয়ত মারা গেছে। জঙ্গলে পাহাড়ি আলুরও অভাব ছিল না।

কেহ কেহ এ আলু খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত করত। বৃটিশ-রাজ উপজাতীয় জনগণকে পার্শ্ববর্তী সংখ্যাগুরু বাঙালিদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি প্রণয়ন করে।

উক্ত বিধি বলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বাঙালি পাহাড়ে বসতি স্থাপন করতে পারত না। হাটবাজার ব্যতীত অন্য জায়গায় বাঙালি লোকজন দেখা যেত না।

পাহাড়ি ও বাঙালি বিশেষ করে মুসলিম বাঙালিদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য ছিল প্রচুর। মুসলমানেরা শিক্ষায় খুবই অগ্রসর ছিল। ধান কাটার মৌসুমে তারা চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে দলে দলে পাহাড়ে প্রবেশ করত।

ধান কাটা শেষ হলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যেত। ব্যবসা বাণিজ্য ও শিক্ষা বিস্তারে হিন্দু বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল। তাই তারা পাহাড়িদের কাছে তুলনামূলক শ্রদ্ধার পাত্রও ছিল।

পাহাড়িরা চট্টগ্রাম বা সমতলে গেলে বাঙালিরা তাচ্ছিল্য করে জুম্ম, হাপ্পুয়া, মামু ইত্যাদি সম্বোধন করে কথা বলত যা পাহাড়িরা মোটেও পছন্দ করত না।

চট্টগ্রামে চাকমা রাজার জমিদারী ছিল এবং বেশির ভাগ প্রজা ছিল মুসলমান। এসব নানা কারণে মুসলমান বাঙালিরাও পাহাড়িদের কাছে শ্রদ্ধাবান ছিল না। বরং অবহেলার পাত্র ছিল।

কারণে অকারণে বাঙালিরাও পাহাড়িদের কাছে নাজেহাল হত সন্দেহ নেই। অতএব বৃটিশ আমলে বাণিজ্যিক আদান প্রদান থাকলেও পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।

উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি দূরত্ব বজায় থাকত। পাহাড়ি-বাঙালি উভয়েই বৃটিশদের অধীনে হওয়া সত্ত্বেও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি পাহাড়িদের স্ব-স্ব সংস্কৃতি জীবনাচরণ ও স্বকীয়তা রক্ষার কবচ হিসেবে কাজ করত।

বৃটিশ আমলে পাহাড়িরা শিক্ষাদীক্ষায় বা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত না হলেও মানসিকভাবে সুখে ও শান্তিতে ছিল।

বৃটিশ সরকার কখনও কোন অমানবিক কর্মকাণ্ড পাহাড়িদের উপর চাপিয়ে দেয়নি বলেই পাহাড়িরা পরাধীন অবস্থায়ও নিজেদেরকে স্বাধীন মনে করত এবং স্বাধীন ভাবেই চলাফেরা করত।

পাহাড়িরা প্রকৃতির সন্তান, অতএব প্রকৃতিই তাদেরকে স্বাধীনচেতা করেছে। অবাধ ছিল তাদের তখনকার দিনের চলাফেরা।

(লেখাটি তার ‘আমি ও আমার পৃথিবী’ শীর্ষক আত্মজীবনী থেকে নেয়া )


লেখক: প্রাক্তন চেয়ারম্যান, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ডীন, ভেটেরিনারি ফ্যাকাল্টি, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা