মারমা জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার (মোজইং/আমুই/আমুইছঁয়/আমুই পয়)

Jumjournal
Last updated Dec 22nd, 2019

1438

featured image

মারমা উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী মারমা সমাজ ব্যবস্থায় জুম চাষকে অদ্যাবধি তাদের প্রধান পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়োজন হয় না, যার কারণে মারমা সমাজে স্থাবর সম্পত্তির তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন ছিল না বললেই চলে।

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী মারমা সমাজে অতীতে তেমন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।

ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য নুতন নুতন জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে মারমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পতির উপর স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার উদ্ভব হচ্ছে।

মারমা সমাজভুক্ত কোনো একটি পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব পালন, মূতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

 

মারমা উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

উত্তরাধিকার: মারমা সমাজভুক্ত পরিবারের কারো মৃত্যু হলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন ও রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার সদগতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়।

উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক মৃত্যুকালে যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে যান সেসবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি, হিসেবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদিপশু ইত্যাদিও উত্তরাধিকারীগণের আপোষ রফায় ভাগবন্টন ও হস্তান্তর হয়। কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধি-বিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না।

কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয় ।

মারমা সমাজে সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে), জীবদ্দশায় সম্পাদিত উইল বা দানমূলে দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দাবী মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

সম্পত্তির মালিকের এ সকল দায়-দাবী না মিটিয়ে স্থাবর/অস্থাবর সকল সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।

 

সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি

তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন। বোমাং সার্কেলের মারমাদের বেলায় এক ধরণের আর মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমাদের বেলায় ভিন্ন ধরণের রীতি ও প্রথা অনুযায়ী উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

সার্কেল ভেদে তারতম্য অনুযায়ী মারমা সমাজে তিন ধরণের উত্তরাধিকার রীতি ও প্রথার প্রচলন রয়েছেঃ-

ক) বোমাং সার্কেলে মারমা পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র, স্ত্রী, কন্যা সকলেই অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করে। বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী মারমা পরিবারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী পুত্র ও কন্যাদের মধ্যে সামুহাদা অনুসারে ভাগ বন্টন হয়।

খ) মং সার্কেল ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজে স্ত্রী ও কন্যাগণ মৃত স্বামী বা পিতার স্থাবর সম্পত্তিতে কোনো প্রকার আইনগত উত্তরাধিকারস্বত্ব লাভ করে না। তবে স্বামী বা পিতা যদি মৃত্যুর পূর্বে দান বা উইল করে দেয় তাহলে সেটুকু সম্পত্তির উত্তরাধিকারস্বত্ব লাভ করে।

 

কেইস রেফারেন্স: প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য ও ৯৮নং কচুখালী মৌজার হেডম্যান প্রয়াত চাইথোয়াই রোয়াজা একজন মারমা ও একজন চাকমা মহিলাকে বিবাহ করেন। প্রয়াত চাইথোয়াই রোয়াজার মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসকের আদালত রাঙ্গামাটি-এর মিচ মামলা নং- ৮৮/১৯৯৪ স্মারক নং- ৩৩৭/আদালত, তারিখঃ ১৬/০৫/১৯৯৪ইং মূলে কেবলমাত্র উভয় স্ত্রীর (প্রথমা স্ত্রী ও দ্বিতীয় স্ত্রীর) গর্ভজাত পাঁচজন পুত্র সন্তানকে তাঁর আইনগত উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কন্যা সন্তানগণকে মৃত পিতার আইনগত উত্তরাধিকারী স্বত্ব দেয়া হয়নি।

 

ক) বোমাং, মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজে মৃত ব্যক্তির যদি পুত্র সন্তান না থাকে সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও কন্যাগণ মৃতের স্থাবর সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারস্বত্ব লাভ করে।

 

কেইস রেফারেন্স: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন চাকমা সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত ৯৬নং কলমপতি মৌজার বাসিন্দা আলাম প্রু মগ পুত্রসন্তানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে একমাত্র কন্যা উসাইন্দামা মার্মানী মৃত পিতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকার লাভ করে। উসাইংন্দামা মার্মানী পুত্র সন্তানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক আদালতের মিচ মামলা নং- ৫২৪/৯৭ তারিখঃ ২৩/০৩/১৯৯৮ইং মূলে তার ঔরসজাত দুই কন্যা মৃত মায়ের সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারস্বত্ব লাভ করেছে।

 

খ) বোমাং সার্কেলের মারমা সমাজে মৃত ব্যক্তির যদি দ্বিতীয় স্ত্রী থাকে, তাহলে ‘সামুহাদা’ অনুসারে মৃতের সম্পত্তিতে তার উভয় স্ত্রীর সন্তানের ভাগ পায় ।

কেইস রেফারেন্স: বান্দরবান জেলা প্রশাসক আদালতের মিউটেশন মামলা নং-১২(ডি)/৮৮-৮৯ মূলে উমাচিং মারমা বনাম চৌ হ্লা প্রু মারমার মোকদ্দমায় মৃত ব্যক্তির দুই স্ত্রীর মধ্যে মারমা সামাজিক নিয়মে সম্পত্তির কে কত অংশ পায় এ বিষয়ে বোমাং সার্কেল চীফের মতামত চাওয়া হলে, বোমাং রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরী মারমাদের অনুসৃত ‘সামুহাদা’ বিচ্ছেদানির ৩৪ ধারা উল্লেখ করে মতামত প্রদান করেন যে, প্রথমা স্ত্রী ও তার সন্তানেরা  (সাত ভাগের চার) অংশ আর দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানেরা   (সাত ভাগের তিন) অংশ পায়। (তারিখঃ ২২/০৪/১৯৮৯)।

 

জেলা প্রশাসক এই মতামত গ্রহণ করে মোট ০.২৪ (চব্বিশ শতক) একর জমি হতে প্রথমা স্ত্রী ও সন্তানদের  (সাত ভাগের চার) অংশ পরিমাণ ০.১৩৭২ একর আর দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের    (সাত ভাগের তিন) অংশ পরিমাণ ০.১০২৮ একর করে নামজারীর আদেশ দেন (তারিখঃ ১১/০৭/১৯৮৯)।

জেলা প্রশাসকের এই রায়ের বিরুদ্ধে মৃতের দ্বিতীয় স্ত্রী চৌ হ্লা প্রু মারমা প্রথমে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আদালতে রিভিশন (মিচ রিভিশন নং- ১১৮৮৯), ও পরে ভূমি আপীল বোর্ডে আপীল (স্মারক নং- ১৬৩/৯২) ও (রিভিউ পিটিশন নং১১৭/৯৭) দায়ের করে। কিন্তু বোমাং রাজার মতামতকে উর্ধ্বতন আদালত বরাবরই বহাল রাখে।

অবশ্য দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস চৌ প্রু মারমা আবার মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রীট পিটিশন নং- ১৫৮০/২০০০ দাখিল করেন, যা এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০- এর ৪৮ বিধিতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্তের বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

ক) বোমাং সার্কেলে প্রচলিত ও স্বীকৃত প্রথা অনুযায়ী বোমাং রাজ পরিবারের পিতৃমাতৃকুলে সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বোমাং সার্কেল চীফ হন। যদি সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বোমাং সার্কেল চীফ পদ গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন না করেন, সেক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বোমাং সার্কেলের মারমা সমাজে প্রচলিত ও সমাজ স্বীকৃত সার্কেল চীফ নিয়োগ পদ্ধতি অনুযায়ী বোমাং রাজ পরিবারের সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে সার্কেল চীফ পদে নিয়োগ দান করেন।

 

কেইস রেফারেন্সঃ অং শৈ প্রু চৌধুরী বনাম ক্য সেইন প্রু চৌধুরী গং: বোমাং সার্কেল চীফ মং শৈ প্রু চৌধুরীর মৃত্যুবরণ করার কারণে সরকার ১৫তম বোমাং সার্কেল চীফের আইনগত উত্তরাধিকার প্রশ্নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ কার্যাদি বিভাগের নোটিফিকেশন নং- বিকাবি (আইন) ৩২৯৬/২০৫ তারিখঃ ০৪/১১/১৯৯৬ইং বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত তারিখঃ ২১/১১/১৯৯৬ইং মূলে বোমাং সার্কেল চীফের উত্তরাধিকার প্রশ্নে রাজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ও উপযুক্ত ব্যক্তিকে পরবর্তী বোমাং সার্কেল চীফ করার প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথাকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিবেচনায় বোমাং রাজ পরিবারের বয়োকনিষ্ঠ সদস্য ক্য সেইন প্রু চৌধুরীকে বোমাং সার্কেল চীফ নিযুক্ত করেন।

বর্তমান বোমাং সার্কেল চীফ রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরী সরকারের উপরোক্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রথমে সিভিল আপীল নং- ৮/৯৭ দায়ের করেন। অতঃপর সিভিল আপীলের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রীট পিটিশন নং- ৫১০১/১৯৯৬ দায়ের করেন। মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের ১২/০১/১৯৯৭ইং প্রদত্ত আদেশে রীট পিটিশন খারিজ হয়।

উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে বর্তমান বোমাং সার্কেল চীফ আপীল দায়ের করলে আপীল বিভাগ মামলাটি গ্রহণ করে মাননীয় বিচারপতি মোস্তফা কামাল তার প্রদত্ত ১১/১২/১৯৯৭ইং তারিখের আদেশ প্রদানের সময় নিম্নোক্ত বিষয়কে মামলার মূল বিবেচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেন।

“the Court will only inquire whether the selection has been made following the tradition, Custom and Usage which gover the selection in question. If so made the judiciary will not intervene. If extraneous considerations have influenced the executive decision the court has certainly the power to declare the selection to have been made without lawful authority, all the susceptibilities of the tribal People should not be ignored”.

অতঃপর মাননীয় বিচারপতি তার প্রদত্ত আদেশে উল্লেখ করেন যে, “For all the foresaid reasons we do not think that the respondents were guided in their selection of Bohmong Chief on the right and relevant considerations, they have taken extraneous matters into consideration which have vitiated the appointment and recognition”.

the appeal is therefore allowed without any order as to casts. the Impugned Notification No. Spet Aat Bit Aim- 32/96/205 dated 04-11-1996 published in the Bangladesh Gazette and issued without lawful authority and of no legal effect.

খ) মং সার্কেলে প্রচলিত ও মারমা সমাজে স্বীকৃত প্রথা অনু মং সার্কেল চীফের পুত্র মং সার্কেল চীফ হন। মং সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজের প্রচলিত প্রথা ও সমাজ স্বীকৃত রীতি অনুসারে মং সার্কেল চীফের আইনগত উত্তরাধিকার নিজ ঔরসজাত পুত্র ও কন্যা ব্যতীত দত্তক পুত্র বা কন্যাদের বেলায় প্রযোজ্য নয়।

মং সার্কেল চীফের পুত্র-কন্যার অবর্তমানে পৈত্রিক সূত্রে রক্ত সম্পর্কীয় কোনো যোগ্য ব্যক্তি মং সার্কেল চীফ হন। পৈত্রিক সূত্রে রক্ত সম্পর্কীয় যোগ্য ব্যক্তির অবর্তমানে মাতৃকুলের কোনো যোগ্য ব্যক্তি মং সার্কেল চীফ হবার আইনগত অধিকার লাভ করেন।

 

কেইস রেফারেন্সঃ রাজকুমারী উনিকা দেৰী বনাম বাংলাদেশ সরকার গং

মং সার্কেল চীফ প্রয়াত মং প্রু সাইন চৌধুরী মৃত্যুবরণ করলে তার স্ত্রী রাণী নীহার বালা মং সার্কেল চীফের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। প্রয়াত মং চীফ নিঃসন্তান ছিলেন। মং সার্কেল চীফ মং প্রু সাইন চৌধুরী জীবদ্দশায় উনিকা দেবীকে দত্তক কন্যা হিসেবে লালন-পালন করেন এবং চাকমা রাজ পরিবারের সদস্য রাজীব রায়ের সাথে উনিকা দেবীর বিবাহ সম্পাদিত হয়।

উনিকা দেবী মং সালে চীফের জীবদ্দশায় রাজকন্যার যাবতীয় সুযোগ সুবিধায় ও সস্নেহে লালিতপালিত হলেও প্রয়াত মং সার্কেল চীফ ও রাণী নীহার বালার মৃত্যুর পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিমতে প্রয়াত মং সার্কেল চীফ নিঃসন্তান হওয়ায় মং সার্কেল চীফের রক্তের সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় পাই হ্লা প্রু চৌধুরীকে মং সার্কেল চীফ পদে নিয়োগ প্রদান করেন।

মং সার্কেল চীফের দত্তক কন্যা রাজকুমারী উনিকা দেবী মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশন নং- ৩৪৬৬/৯৮ মূলে পাই হ্লা প্রু চৌধুরীকে সার্কেল চীফ পদে নিয়োগের বৈধতার প্রশ্নে দায়ের করলে মাননীয় বিচারপতিদ্বয় সৈয়দ মোদাচ্ছির হোসেন ও মোহাম্মদ আরায়েস উদ্দিন উপরোক্ত মামলায় ২০/০৮/২০০০ ও ২১/০৮/২০০০ইং তারিখে প্রদত্ত আদেশে রাজকুমারী উনিকা দেবীর দাবী যুক্তিসঙ্গত না হওয়ায় উপরোক্ত রিট পিটিশন খারিজ করেন এবং ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিমতে সরকার কর্তৃক মং সার্কেল চীফ পদে পাই হ্লা প্রু চৌধুরীকে প্রদত্ত নিয়োগ বৈধ ঘোষণা করেন।

উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে উনিকা দেবী আপীল দায়ের করলে আপীল মামলা নং- ১২৪১/২০০১ এর আদেশে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের বেঞ্চ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ১৯০০ এর ৪৮ বিধিতে মারমা সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি যোগ্য হন তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

 

কেইস রেফারেন্সঃ উচিং থোয়াই চৌধুরী বনাম জেলা প্রশাসক, রাঙ্গামাটি গং: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভূক্ত ৩২১নং রাইখালী মৌজার হেডম্যান অং থোয়াই চিং চৌধুরী (অনন্ত চৌধুরী) মৃত্যুবরণ করলে ৩২১নং রাইখালী মৌজার হেডম্যান পদে প্রয়াত হেডম্যান অং থোয়াই চিং চৌধুরীর পুত্র উচিং থোয়াই চৌধুরীকে বোমাং সার্কেল চীফের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিমতে উক্ত মৌজার প্রয়াত হেডম্যান মৃত থোয়াই প্রু চৌধুরী (রায় সাহেব)-এর সন্তান অংসা থোয়াই চৌধুরীকে জেলা প্রশাসক আদালতের মিচ মামলা নং-০৩(ডি) ৯৩/৯৪ (৩২১) ১৮/১১/১৯৯৪ইং মূলে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

প্রয়াত হেডম্যান অং থোয়াই চিং চৌধুরীর পুত্র উচিং থোয়াই চৌধুরী এ বিষয়ে বিজ্ঞ অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের আদালত চট্টগ্রাম বিভাগ, চট্টগ্রামের নিকট ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ১৭(২) ধারামতে উপরোক্ত নিয়োগ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন মামলা দায়ের করলে মিচ রিভিশন মামলা নং- ১১৩/৯৪ রাঙ্গামাটি-এর উদ্ভব হয়।

অতঃপর বিজ্ঞ অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ১৭/০৪/১৯৯৫ইং জেলা প্রশাসক, রাঙ্গামাটি কর্তৃক ৩২১নং রাইখালী মৌজায় হেডম্যান নিয়োগের ক্ষেত্রে বোমাং সার্কেল চীফের সুপারিশকে অবজ্ঞা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মতামতের ভিত্তিতে ১৮/১১/১৯৯৪ইং অংসা থোয়াই চৌধুরীকে প্রদত্ত নিয়োগ আদেশ বাতিল ঘোষণা করেন এবং উচিং থোয়াই চৌধুরীকে ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিমতে হেডম্যান পদে নিয়োগ প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।

উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে অংসা থোয়াই চৌধুরী মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন মামলা দায়ের করলে পরবর্তীতে উভয়ের মধ্যে হেডম্যান পদের প্রশ্নে উদ্ভুত বিরোধ সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি হয়। ফলে বিজ্ঞ অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার আদালতের ১৭/০৪/১৯৯৫ইং প্রদত্ত আদেশ মোতাবেক উচিং থোয়াই চৌধুরী হেডম্যান পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।

মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগের প্রদত্ত আদেশের উপরোক্ত কেইস রেফারেন্সসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মারমা সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সার্কেল চীফ ও হেডম্যান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে মহামান্য আদালত এ ক্ষেত্রে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

 

মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পানি খেলা
মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পানি খেলা

 

মারমা সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাসঃ

ক) বোমাং সার্কেলের মারমা পরিবারে পিতার মৃত্যুর পর তার পুত্র ও কন্যা সন্তানেরা অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। তার বা তাদের উপস্থিতি অন্য সকল নিকটাত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। অবশ্য সন্তান বলতে ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকেও বুঝায়। পুত্র বা কন্যার মৃত্যুজনিত কারণে পুত্রবধু, মৃত কন্যার স্বামী এবং মৃত পুত্র-কন্যার সন্তানগণ আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। তবে মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজে পুত্র সন্তান বর্তমান থাকলে স্ত্রী ও কন্যা মৃতের স্থাবর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়।

খ) মারমা পরিবারে মৃত ব্যক্তির যদি পুত্র সন্তান না থাকে, সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানেরা মৃতের সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারী হয় এবং কন্যা সন্তানগণ মৃতের সম্পত্তির সমান হারে ভাগ পায়। মৃতের কন্যা সন্তানগণের মধ্যে ঔরসজাত কন্যা, অবৈধ কন্যা, দত্তক কন্যা সকলেই কন্যা সন্তান রূপে গণ্য হয়।

গ) স্বামীস্ত্রী: মারমা পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী তার মৃত স্ত্রীর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

ঘ) পিতামাতা: মৃত ব্যক্তির যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনী থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে, সেই পিতামাতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) রক্ত সম্পর্কীয়: মারমা সমাজে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী, পিতা, মাতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, তার পুত্রকন্যা, তাদের অবর্তমানে বোন, বোনের পুত্র-কন্যাগণ মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

চ) মারমা পরিবারে মৃতের যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এবং ভাইপো-ভাইঝি ও ভাগ্নে-ভাগ্নী, এদের রক্ত সম্পৰ্কীয় নাতি-নাতনী কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে তার কাকা/জেঠা, তাদের পুত্রকন্যা আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ছ) মারমা সমাজে মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে পিসি, তার অবর্তমানে পিসতুতো ভাই-বোন ও তাদের পুত্র-কন্যা আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

জ) মৃত ব্যক্তির ‘চ’ ও ‘হ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় উত্তরাধিকারীও যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মামা, তার অবর্তমানে মামাতো ভাই-বোন, তাদের পুত্র-কন্যা আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

 

সম্পত্তির ভাগবন্টনঃ মারমা সমাজে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগৰণ্টন নিম্নরূপে করা হয়ঃ

ক) বোমাং সার্কেলে অনুসৃতঃ ‘সামুহাদা’ বিচ্ছেদানির রীতি অনুযায়ী মারমা সমাজের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাগণ সম্পত্তির অংশ পায়।

খ) মং সার্কেল ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজের কন্যা সন্তানগণ কোনো প্রকার পৈত্রিক সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয় না। যদি পিতা তার জীবদ্দশায় কন্যা সন্তানকে দান বা উইলনামা মূলে কোনো স্থাবর সম্পত্তি প্রদান করে কেবলমাত্র সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তান পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক আইনগত উত্তরাধিকারিগণের সকল প্রকার আপত্তি আইনতঃ অগ্রাহ্য হয়। তবে পুত্রের অবর্তমানে স্ত্রী ও কন্যা সন্তানেরা ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

গ) মৃত পিতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মৃত মাতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠ কন্যা পায়।

ঘ) বোমাং, সার্কেলে সামুহাদা অনুসারে মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমারা সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে মাতার স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্র ও কন্যা সন্তানগণ হারাহারিভাবে পায়।

 

অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার স্বত্বঃ যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করে সেই ব্যক্তির (জন্মদাতার) সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয় সেক্ষেত্রে পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পারে না, কেবলমাত্র নিজ মায়ের নামীয় (যদি থাকে) সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা