মারমা জাতির আদ্যোপান্ত
2335
মারমা জাতির বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী আদিবাসী জুম্ম জনগােষ্ঠীর মধ্যে মারমা জনগােষ্ঠী সংখ্যায় দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগােষ্ঠী। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে মারমাদের সবচেয়ে বেশি বসবাস রয়েছে বান্দরবান জেলায়। এ জেলায় সর্বত্র তাদের বসতি রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার সদর ও ভাইবােনছড়া, মানিকছড়ি, মাটিরাঙ্গার উপজেলার তবলছড়ি, মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি ও পানছড়ি উপজেলার বরনাল (খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলা ব্যতীত অন্য সব উপজেলায়) এবং রাঙ্গামাটি জেলার চন্দ্রঘােনা, রাজস্থলি, কাউখালী ও সদর উপজেলায় মারমাদের বসতি রয়েছে। (ত্রিপুরা ১৯৯৪)।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বঙ্গু, খােয়ে, শিলো, থৌলে ও সাব্রুম এলাকা, মিজোরামের রাইক্ষ্যং ও সাংলাকক্ষ্যং এলাকা এবং মায়ানমারের আরাকান প্রদেশে লেমাই গােয়ং, পুলুতং ও নাজিরােওয়া, খ্যান প্রদেশের ডালাক্মে, পালাক ওয়া, কুখ্যং, পিক্ষ্যং ও কুলাডাইন নদীর উজানে, রেঙ্গুন শহরের বিভিন্ন এলাকায় মারমা জনগােষ্ঠীর বসবাস রয়েছে (মংক্যশােয়েনু ১৯৯৮)।
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমা জনগোষ্ঠীর মােট সংখ্যা হচ্ছে ১,৪২,৩৩৪ জন। এর মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বসবাস করে ৫৯,২৮৮ জন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় বসবাস করে ৪০,৮৬৮ জন এবং খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাস করে ৪২,১৭৮ জন।
১৯৯১ সালের পর মারমাদের জনসংখ্যা নিয়ে কোনাে সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়নি| তবে মারমাদের ভাষ্য অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের জনসংখ্যা ২লক্ষাধিক হবে বলে অনুমিত। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ভারতে মারমাদের জনসংখ্যা ২৮,১৩৬ জন। এর মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যে বসবাস করে ২৭,৯৬৬ জন। বর্তমানে ভারতে মারমাদের জনসংখ্যা প্রায় ৫০,০০০ জন বলে অনুমান করা যায়।
মারমা নামের উৎপত্তি
‘মারমা’ (Marma) শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে মূলত ‘মায়াইমা’ (Mramma) বা ড্রাইমা’ (Mraima) শব্দ থেকে (ক্যশৈপ্রু ১৯৯৪।’মারমা’বা ম্রাইমা’ নামক একটি জনগােষ্ঠী বা জাতিসত্তার অস্তিত প্রাচীনকালেও ছিল বলে জানা যায়। আনুমানিক নবম ও দশম শতাব্দীতে হীনযান বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি ও তিব্বতী-দ্রাবিড়ীয় গােষ্ঠীভুক্ত ‘ম্রাম্মা’ নামের এক জাতি প্রাচীন ব্রম্মদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে উপস্থিতির পরিচয় পাওয়া যায় (মংক্য শােয়ে ১৯৯৮)।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতের কৃষ্ণা ও গােদাবরী নদী অঞ্চলের লােকেরা বর্মীদের কাছে ‘তলই’ নামে পরিচিত ছিল এবং এদের রাজ্য ছিল এবং রাজ্য ছিল হাইসাওয়াদী (হংসবতী)। ঐ রাজ্যের রাজধানী ছিল পেগু । সাহ্মালা’ (সমল) ও ‘ওয়িমালা’(বিমল) নামক দুজন তলইং রাজপুত্র তাদের নেতৃত্বে প্রায় ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে ঐ পেগু নগর গড়ে তুলেছিল। ঐ সময় নৌ পথে এরাই সর্বপ্রথম ‘ম্রাইমা চা’ বা ‘মারমা জা’ নামক বর্ণমালা বার্মার দক্ষিণ পূর্বাংশে ছড়িয়ে দিয়েছিল।
যেহেতু মারমা জনগােষ্ঠীর পূর্বপুরুষগণ এই প্রাচীন হস্তলিপির মাধ্যমে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে এবং নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এই হস্তাক্ষরের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করে নিজ বংশ রক্ষা করে চলেছে, সেহেতু আজ এরা নিজ গােষ্ঠীসহ অপরাপর জনগােষ্ঠীর কাছে নিজেদেরকে মারমা নামে পরিচয় দিয়ে থাকে (মংক্যশােয়েনু ১৯৯৮)।
বিশিষ্ট লেখক আবদুল হক চৌধুরীর মতে, মারমা শব্দটি ব্রহ্মদেশের তেলেইং ভাষার ‘মেয়ামা’ শব্দের বিবর্তিত রূপ। একাদশ শতকের তেলেইং রাজার মুদ্রা সূত্রে জানা যায়, তেলেইংদের প্রাচীন জাতীয় নাম ছিল ‘মেয়ামা’ (চৌধুরী ১৯৮৮)। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত এই মারমা জনগােষ্ঠী নিজেদেরকে মারমা’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে আরাকানের রাজা কর্তৃক চট্টগ্রাম এলাকা শাসনের জন্য প্রেরিত পেগুর রাজকুমার মংচপ্যাইং তথা মুসলিম নাম আলী মানিকের সময় (১৬১৪ খ্রি.) থেকে।
যদিও ব্রিটিশ ও মােগল আমলের শাসকশ্রেণী কর্তৃক আরাকানি বা রাখাইনদের পাশাপাশি এই জনগােষ্ঠীকেও মগ নামে অভিহিত করা হয়েছিল। ১৭৯৮ বােমাঙ কংহ্লাপ্রু ব্রিটিশ গবেষক ফ্রান্সিস বুখাননের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এই জনগােষ্ঠীর পরিচয় দিয়েছিলেন ‘মা-রা-মা’ হিসেবে (সেন্দেল ১৯৯৪)।
স্বাধীনতার পর মারমারা বাংলাদেশে সরকারিভাবে ‘মারমা জনগােষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তক ‘মারমা’ অভিধাটি সরকারিভাবে হিসেবে স্বীকৃত হয়। তৎকালীন বােমাং রাজা মংশৈপ্রু চৌধুরী এই অভিধাটি স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানান।
কারণ বােমাঙ সার্কেলের বসবাসকারী এই জনগােষ্ঠীর লােকেরা নিজেদের ‘মগ’ নামে কখনাে কখনাে অভিহিত করে না। তারা নিজেদেরকে ‘মারমা’ মনে করে এবং ‘মারমা’ অভিধাটি ব্যবহার করে (ক্যশৈপ্রু ২০০৩) মূলত এই মারমা জনগােষ্ঠীকে অতীতে কোথাও আরাকানি মগ, কোথাও খ্যংঃসা, কোথাও জুম্ম পাহাড়িয়া প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। কিন্তু তারা নিজেদেরকে ‘মারমা’ নামেই পরিচয় দিয়ে থাকে।
মারমা জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি
স্বাধীন আরাকান ও চট্টগ্রাম
সুপ্রাচীন কাল থেকে আরাকান ও চট্টগ্রাম একটি অখণ্ড দেশ রূপে পরিগণিত ছিল বলে জানা যায়। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে (১৪৬ খ্রিস্টব্দে) চাইন্দা-সূরীয়া (চন্দ্র-সূর্য) নামক মগধের এক সামন্ত আরাকান ও চট্টগ্রাম অধিকার করে সর্বপ্রথম একটি রাজ্য স্থাপন করেন এবং তিনি সেখানকার রাজা হন।
তিনি আরাকানের ধঞবতী বা ধাইঞাওয়াদিতে (ধান্যবতী) রাজধানী স্থাপন করেন। তার সঙ্গী মগধাগত হিন্দু বৌদ্ধ সৈন্যরা ঐ রাজ্যের অনুন্নত ও জড়ােপাসক আদিম জনগােষ্ঠীকে সর্বপ্রথম আর্য ধর্ম, ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতিতে দীক্ষা ও শিক্ষা দান করে। তিনি আরাকানের চাইন্দা-সূরীয়া (চন্দ্র-সূর্য) রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
এই বংশের মােট পঁচিশজন রাজা রাজত্ব করেন। তার মধ্যে প্রথম এগারাে জন রাজার আমলে খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতক অবধি আরাকান-চট্টগ্রাম অখণ্ড রাজ্যরূপে শাসিত হয়। ষষ্ঠ শতকে চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যচ্যুত হয়ে সমতটের খড়গ রাজ বংশের শাসনাধীনে চলে যায় এবং আরাকান স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্যরূপে ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চাইন্দা-সূরীয়া (চন্দ্র-সূর্য) বংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয় (চৌধুরী ১৯৮৯)।
খ্রিস্টিয় দশম শতকের মধ্যবর্তী কাল অবধি ফেনী নদীর দক্ষিণ তীর থেকে নাফ নদীর উত্তর তীরের মধ্যবর্তী ভূ-ভাগটির বর্তমান নাম ‘চট্টগ্রাম’ প্রচলিত ছিল না । তখন এ ভূ-ভাগটি আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। চন্দ্র বংশের নবম রাজা সুলা-তাইং-চাইন্দা (সুলত-ইঙ্গ-চন্দ্র-৯৫১-৯৫৭ খ্রি.) ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে তার নিজ অধিকৃত রাজ্যাংশের উক্ত ভূ-ভাগের বিদ্রোহী সুরতনকে (সুলতানকে) দমন করতে এসে সসৈন্য আধুনিক কুমিরার কাউনিয়া ছড়ার দক্ষিণ তীর অবধি অগ্রসর হন এবং পথানে একটি পাথরের বিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করে তাতে ‘চিৎ-তৌৎ-রগৗং’ (যার অর্থ যুদ্ধ করা অনুচিত) শব্দটি উৎকীর্ণ করিয়ে স্বদেশে ফিরে যান।
তখন থেকে এই ভূ-ভাগটি ‘চিৎ-তৌৎ-গৌং’ (চইক-তেঃ-গঙঃ বা Chittagong) নামে খ্যাত হয়।কালক্রমে ‘চিৎ-তৌৎ-গৌং’ (চইক-তেঃ-গঙঃ বা Chittagong) শব্দ বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয় (চৌধুরী ১৯৮৮, ১৯৮৯, রিজভি ১৯৭৫)।
১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা হন মাঙঃফালং (মিনফালঞ-১৫৭১-১৫৯৩ খ্রি.)। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামের পাঠান শাসনকর্তা জামাল খান পণ্ণীকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ অমর মাণিক্য উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন।
এ সময় কোনাে কারণে রামু চকরিয়ার আরাকানি সামন্ত শাসক আদম শাহ আরাকানের রাজার বিরাগভরিয়া হয়ে অমর মাণিক্যের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরাকানরাজ আদমকে ফেরত চাইলে অমর মাণিক্য আশ্রিতকে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন। আরাকানরাজ তাতে রুষ্ট হয়ে ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে দু লক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন। তার ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে লুটপাট চালায়।
অপমানিত হয়ে অমর মাণিক্য আত্মহত্যা করেন (চৌধুরী ১৯৮৮, ১৯৮৯)। মাঙঃফালং ঢাকা পর্যন্ত অধিকার বিস্তার করেন এবং তিনি ঢাকা পরিদর্শনে যান। তার আমলে নােয়াখালীর আলমদিয়া ও মুগীদিয়ায় দুটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করে সেনাবাহিনী মােতায়েন করেন। তিনি অসংখ্য রণতরী নিয়ােজিত করে চট্টগ্রামের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেন।
১৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ মাওঃফালং (মিনফালং)-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র মাঙঃ রাজাগ্ৰীঃ (মিনয়াজাগ্যি বা সলিম শাহ ১৫৯৩-১৬১২ খ্রি.) আরাকানের রাজা হন (চৌধুরী ১৯৯৪)। তিনি একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপ ডি ব্ৰতাে নিকোতে (Philip De Brito Nicote) নামক একজন পর্তুগিজকে লেখা এক চিঠিতে তিনি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন আরাকান, চোকোমাস ও বাংলার সর্বোচ্চ ও অত্যন্ত শক্তিশালী রাজা হিসেবে (হাবিব উল্লাহ ১৯৯৫, কানুনগাে ১৯৮৮)।
মাওঃরাজাগ্রীর পেগু আক্রমণ ও বােমাঙ রাজবংশের ইতিহাস
প্রাচীনকালে ব্রহ্মদেশ টংগু, থেটন, হংসবতী, মার্টাবান, প্গা (প্গাইং)আভা, প্রোম প্রভৃতি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। টংগুর রাজা ত্বাঙশােয়েথীর, (১৫৩১-১৫৫০ খ্রি.) আমলে আভা, প্রােম, টংগু, হংসবতী, মার্টাবান প্রভৃতি রাজ্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। তিনি নিজে পেণ্ডর সিংহাসনে আরােহণব্রহ্মদেশের সম্রাট হিসেবে ঘােষণা করেন।
সেসম য় পেগু হচ্ছে হংসবতী (হাইংসাওয়াদি) রাজ্যের রাজধানী । ত্বাঙশােয়েথীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন তার ভগ্নিপতি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ক্যথাং অনরথা। পরবর্তীতে তিনি ‘ব্রাং নঙ’ ঊপাধি গ্রহণ করেন। ত্বাঙশোয়েথীর মৃত্যুর পর ব্রাঙনঙ (১৫৫১-১৫৮১) পেগুর সিংহাসনে আরােহণ করেন (ফেইরি ১৮৮৯)।
ব্রাঙনঙ-এর পুত্র রাজা নাইন্দা ব্রাঙ (১৫৮১-১৫৯৯ খ্রি.)-এর আমলে আরাকান ১০,রাজাগ্রী পেগু শহর আক্রমণ করেন। মূলত পেগু অভিযানের অধিনায়ক ছিলেন সেই সময়কার চট্টগ্রামের শাসনকর্তা মহাপঞাগ্য। টংগু রাজ্যের রাজা সিহাসু
আরাকানের রাজার কাছে কিনদংজা ও কসাজা নামক দুজন দূত প্রেরণ। ‘ল এবং পেগু শহর আক্রমণের জন্য সহযােগিতা কামনা করেন । আরাকান রাজ মাজঃরাজাগ্রীকে প্রস্তাব করা হয় যে, পেগু অভিযানে সফল হলে তাকে শ্বেতহস্তী, রাজকন্যা ও বিভিন্ন মূল্যবান রত্ন নিবেদন করা হবে ।
আরাকান রাজ মাঙঃরাজাগ্রী প্রস্তাবে রাজি হন। এর প্রেক্ষিতে ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে শ্বেতহস্তীর লােভে পেগু আক্রমণ করা হয়। যুদ্ধে পেণ্ডর রাজা নাইন্দা ব্রাঙ নিহত হন। বিজয়ী আরাকানের বাজা মাঙঃরাজাগ্রী চারটি শ্বেতহস্তী, রাজপুত্র মংচপ্যাইং, রাজকন্যা খাইমাহ্নাং ওরফে সাইংডহ্নাং এবং ৩৩ হাজার তলইং প্রজা বন্দি করে আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ প্রত্যাবর্তন করেন।
এসময় পেগু অভিযানে চট্টগ্রাম ও গাঙ্গেয় বদ্বীপের দটি নৌ সেনা দলের বহর যােগদান করেছিল বলে জানা যায়। এছাড়াও ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে চাকমা রাজা কংলহ্লাপ্রু এবং পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে বঙ্গের বারােজন সামন্ত রাজা এই অভিযানে যােগদান করে (চন্দমালালঙ্কার ১৯৮৯)।
রাজা মাঙঃরাজাগ্রীর মৃত্যুর পর তার পুত্র মাঙঃখামৌং (১৬১২-১৬২২ খ্রি.) ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার ইসলামি নাম ছিল হােসেন শাহ। আরাকান রাজ মাংঃখামৌং-এর রাজত্বকালে তার অধিকৃত চট্টগ্রাম-নােয়াখালীর নদী-সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় পর্তুগিজ দৌরাত্ম বৃদ্ধি পায়।
তিনি সেই দৌরাত্ম দমন করার জন্য তার সৎ মামা পেগুর ভূতপূর্ব রাজকুমার মংচপ্যাইংকে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করে পাঠান। রাজকুমার মংচপ্যাইং তার অনুগত তলইং বাহিনীকে নিয়ে চট্টগ্রাম আগমন করেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যে এখানকার পর্তুগিজ দৌরাত্ম দমন করে আরাকান মাজের প্রশংসা ভাজন হন। এই সাফল্যের জন্য ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে মাঙঃখামৌং তাকে ‘বােমাঙ’ উপাধিতে ভূষিত করেন, যার অর্থ প্রধান সেনাপতি বা মহাসেনাপতি (চৌধুরী ১৯৮৯, ১৯৯৪, রিজভি ১৯৭৫, ক্যশৈ প্রু ২০০৩, আহসান ১৯৯৩)।
মায়ানমারের ইতিহাসবিদ ঞোমা’র মতে সে সময় মংচপ্যাইংকে বাংলার বারােটি শ্যর শাসক হিসেবে চট্টগ্রামে নিয়ােগ দেওয়া হয় (ঞোম্রা ১৯৯৭)। সে সময় * গ্রামের প্রশাসন বারােজন সামন্ত রাজার হাতে ন্যস্ত ছিল যারা প্রতি বছর চট্টগ্রামে নিযুক্ত আরাকানের রাজার ভাই সরয়কে একটি বার্ষিক কর প্রদান করতে(কানুনগাে ১৯৮৮)।
১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি মােগল সেনাপতি বুজুর্গ উমেদ খাঁ তৃতীয়তম বােমাঙ হেরীপ্রুর বাহিনীকে পরাজিত করে চট্টগ্রামের বৃহদাংশ শঙখনদীর উত্তর তীর অবধি মােগল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। শঙ্খনদী মােগল অধিকৃত চট্টগ্রামের দক্ষিন সীমানা নির্দিষ্ট হয়। শঙ্খ নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশটি আরাকানের অধিকারে থেকে যায়। হেরীপ্রু তখন থেকে ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিন আরাকানি শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। হেরীপ্রুর মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুস্পুত্র হেরীঞো (১৬৮৭-১৭১৭ খ্রি.) ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত হন।
মহাদণ্ডায়ু (১৭১০-১৭৩১ খ্রি.) নামক আরাকানের একজন সামন্ত ১৭১০ সালে সান্দাউইজিয়া নাম ধারণ পূর্বক আরাকানের রাজা হন। তিনি রাজা হয়ে আরাকানের হারানাে গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। নৌ শক্তির পুনরুদ্ধার করে তিনি সমুদ্রে আরাকানের হারানাে প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করেন।
তার রাজত্বকালে ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পুনরাধিকারের জন্য অতর্কিতে আরাকানি নৌ বহর কর্ণফুলি নদীতে প্রবেশ করে চট্টগ্রাম অবরােধ করেছিল। এসময় দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হেরীঞো সান্দাউইজিয়াকে উল্লেখযােগ্যভাবে সহযােগিতা করেছিলেন। এ কারণে তিনি হেরীঞোকে ‘বােমাঙগ্রী’ উপাধি প্রদান করে সম্মানিত করেন। বােমাংগ্রী শব্দের অর্থ হলাে বােমাংদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (চৌধুরী ১৯৮৯, ১৯৯৪, আহসান ১৯৯৩)।
১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে হেরীঞোর মৃত্যু ঘটে। তখন হেরীঞোর পৌত্র (মৃত পুত্র ছদাপ্রুর সন্তান) কংহ্লাপ্রু (১৭২৭-১৮১১ খ্রি.) ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে আরাকান অধিকৃত দক্ষিণ চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হন। তিনি দোহাজারী দুর্গের সেনাপতি আধু খাঁ ও তার পুত্র শের জামাল খাঁর খণ্ড আক্রমণের চাপের মুখে ক্রমশ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকেন।
একে একে রামু, ঈদগড়, ইয়াংছা, মাতামুহুরী প্রভৃতি অবস্থান ছেড়ে দেওয়ার পর শেষ পর্যন্ত লামায় অধিকার সংকুচিত হয়ে যায়। অবশেষে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে দোহাজারী দুর্গে অধ্যক্ষ শের জামাল খার আক্রমণের মুখে দক্ষিণ চট্টগ্রামের শেষ শাসনকর্তা বোমাংগ্রী কংহ্লাপ্রু শেষ অবস্থান লামা থেকে তার অনুগামীদের নিয়ে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও মােগলদের অধীনে চলে যায় (চৌধুরী ১৯৮৯,১৯৯৪, আহসান ১৯৯৩)।
উল্লেখ্য যে, সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে আরাকান রাজ মিনখামৌং তৎকালীন চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিয়ােগ করে মংচপ্যাইংকে বােমাঙ (লিভার অফ জেনারেলস্) উপাধি প্রদান করেন। এর ফলে পেণ্ড থেকে তার সাথে আনা মােন বা তলইং প্রজাগনও ধীরে ধীরে চট্টগ্রামে এসে বসতি স্তাপন করতে থাকেন। কালক্রমে তারা বােমাঙ রাজার প্রজাতে পরিগণিত হন। ধারণা করা যায় যে, বর্মী বংশোদ্ভূত রাজ কুমার ও তলইং প্রজাগােষ্ঠীর সাথে তৎকালীন আরাকানের শাসনাধীন বৃহত্তর অঞ্চলে বসবাসরত পূর্বতন আরাকানিদের রক্ত ও সংস্কৃতি সংমিশ্রণ ঘটেছে।
পেগুর ভুতপূর্ব রাজকুমার বােমাঙ মংচপ্যাইং ও তার অধস্তন পাঁচ পুরুষ ১৬১৪. খ্রি. অবধি ১৪২ বছর কাল চট্টগ্রামে আরাকানের অধীনে শাসনকর্তা ছিলেন। ইংরেজ আমলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভূতপূর্ব আরাকানি শাসনকর্তা বােমাঙগ্রী ও পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করে রাজস্ব সংগ্রাহকরূপে আদিপুরুষের বােমাংগ্রী পদবির স্বীকৃতি লাভ করেন।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের শেষ আরাকানি শাসনকর্তা বােমাগ্রী কংহ্লাপ্রু আরাকানে আঠারাে বছর কাল অবস্থান করেন। অতপর চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত হওয়ার পর ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার অনুগামীগণসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং পর্যায়ক্রমে রামু, ঈদগড়, চকরিয়া, ম্যক্ছেখালে বাসস্থান পরিবর্তন করে বসবাস করেন তারপর কংহ্লাপ্রু ও তার অনুগামীরা ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে সাতকানিয়া থানার বাজালিয়া গ্রামের শংখ নদীর চরে বসতি স্থাপন করেন (চৌধুরী ১৯৮৯, আহসান ১৯৯৩)।
বােমাঙ রাজপরিবারে সংরক্ষিত তথ্য অনুসারে, বােমাঙগ্রী কংহ্লাপ্রু মােগলদের হয়রানির কারণে আরাকানের রাজার সাথে পরামর্শ করার জন্য ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজ দরবারে যান এবং সেখানে কয়েক বছর বাস করেন। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা তাকে পুনরায় ‘বােমাংগ্রী’ উপাধি প্রদান করেন (U than prue 1994)।
এরপর তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে দক্ষিণাঞ্চলে বােমাঙ রাজা ব্রিটিশ কোম্পানির দাবি মােতাবেক কার্পাস শুল্ক দান শুরু করেন। ফলে এ ক্ষেত্রে কোম্পানিকে তার সাথে সংঘাতে জড়িত হতে হয়নি (কানুনগাে ১৯৮৮)।
ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে সম্ভবত ঠিকাদার মারফ্ত পার্বত্য রাজাদের কাছ কাছ থেকে কর আদায় করা হতাে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা প্রথম কর সংগ্রহের ব্যাপারে পার্বত্য রাজাদের সাথে সরাসরি যােগাযােগ করে। তাই তখন থেকে ইংরেজদের রাজস্ব রেকর্ডে বােমাংগ্রী কংহ্লাপ্রুর নামােল্লেখ দেখা যায়।
তিনি ১৭৯১ খ্রিস্তাব্দে ৭০১ টাকা ও ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ৭০৩ টাকা আদায় করেন (চৌধুরী১৯৮৯ “)। ম্যাকেঞ্জির মতে, The whole country South of the Karnafuli is norminally subject to the head of the Phru family, called at various times the Poang and the Bohmong Rajah. Most of those living north of the Karnafuli acknowledge a chief called the Mong Rajah (Mackenzie 1989).
বােমাঙগ্রী কংহ্লাপ্রু-র পুত্র সাকথাংপ্রু (১৮১১-১৮৪০খ্রি.) সম্ভবত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে রাজা হন কিছুটা দেরিতে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে। এই সময় (১৭৯০-১৮৪০খ্রি.) বােমাঙ রাজপরিবার কর্ণফুলি থেকে শুরু করে নাফনদী পর্যন্ত অঞ্চলের শাসক ছিলেন (Mackenzie 1989)। বােমাঙগ্রী সাকথাইপ্রু বান্দরবান শহরে তার রাজধানী গড়ে তােলেন।
বােমাংগ্রী কংহ্লাঞোর আমলে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করে এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে বােমাং সার্কেল ঘােষণা করে। চাকমা সার্কেলের মতাে বােমাঙ সার্কেলকেও কয়েকটি মৌজায় এবং প্রতিটি মৌজা কয়েকটি পাড়া বা গ্রামে বিভক্ত করা হয়।
পেলেংসাঃ (প্লাইংসাঃ) মারমাদের বসতি স্থাপন ও মং রাজবংশের ইতিহাস
আরাকানের ‘রখইং রাজওয়াং সইক্যাইঃ’ নামক ইতিহাস গ্রন্থে, স্বাধীন আরাকানের সময়ে কাইসা নদী বা কর্ণফুলী নদীর অববাহিকায় আরাকানের শাসনাধীনে ‘কাইসা ম্রোহ’ (কাইসা নগর) নামক একটি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় কাইসা নগরের জন্য আরাকানের রাজা একজন শাসক নিয়ােগ করতেন।
আরাকানি ভাষায় তাকে বলা হতাে ‘কাইসা ম্রোহ্জাঃ’ অর্থাৎ কাইসা নগরের শাসক (চন্দমালালঙ্কার ১৯৮৯)। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে পেগু যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সময়ে হাইসাওয়াদি (হংসবতী) রাজ্যের পতনের পরিপ্রেক্ষিতে আরাকানের মহারাজা মাঙঃরাজাগ্রী (মিনরাজাগ্যি) কর্তৃক আরাকানের তৎকালীন রাজধানী ম্রকউ শহরে ৩৩ হাজার তলইং জনগােষ্ঠীকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেসব জনগােষ্ঠার অংশবিশেষকে ধাইঞাওয়াদি (আরাকান) রাজ্যভুক্ত মাংব্রা অঞ্চলের পাশ্ববর্তী এলাকা দিয়ে প্রবাহিত পেলেংখ্যঙঃ নামক নদীর তীরে বসবাসের জন্য স্থানান্তর করা হয়।
পেগুর রাজকুমার মংচপ্যাইংকে ১৬১৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়ােগের পর ১৬১৪ খ্রি. থেকে ১৬৬৬ খ্রি. পর্যন্ত আরাকানি শাসনাধীনে তিন পর্যায়ে যথাক্রমে কিনডজা, কিঞো ও ঠকাজা-র নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাতামুহুরী, কাইসা বা কর্ণফুলি এবং হালদা নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে পেলেংখ্যং নদীর তীরে বসতি স্তাপন করেছিল ।
পেলেংখ্যং নদীর তীরে এক সময় বসবাস করার কারণে তারা নিজেদের পেলেংসাঃ বা পেলেং নদীর সন্তান বলে পরিচয় দিয়ে থাকে (উচনু ২০০৭)। ১৬৩৮ আরাকানের রাজা শ্রীসুধাম্মার (শ্রীসুধর্ম) মৃত্যুর পর তার একজন অমাত্য নরপতি আরাকানের সিংহাসন দখল করে রাজপরিবারের সদস্য ও পণ্ডিতদেরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে থাকলে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালাতে থাকে।
দেশের এই রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় রাজা শ্রী সুধাম্মার পুত্র নাগাথোয়াইখিন রাজ পরিবারের সদস্যবর্গ ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যান। এ সময় তিনি চট্টগ্রামের কাইসা এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময় প্রায় ৫০০০০ সৈন্য তাকে অনুসরণ করে কাইসা বা কর্ণফুলি নদীর তীরে বসবাস করতে থাকে। নাগাথােয়াইখিন ‘কাইসা অঞ্চলের শাসক হিসেবে ‘ম্রাইমাগ্রিদের মাঙঃ’ বা ম্রাইমাগ্রিদের রাজা বলে পরিচিত লাভ করেন (রিজভি ১৯৭৫, চৌধুরী ১৯৮২, কানুনগাে ১৯৮৮)।
আরাকানের নতুন রাজা নাগাথােয়াইখিন এর অবস্থান জানার পর শত্রুতার পথে না গিয়ে তাকে কাইসা অঞ্চলের শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেন (চন্দমালালঙ্কার ১৯৮৬)! পেলেংসাঃ গােত্রের প্রধান কিঞোকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা শ্রীসুধাম্মার পুত্র নাগাথােয়াইখিন কর্তৃক ‘ধাবইং’ (ধা্বইং) উপাধি দেয়া হয়েছিল।
১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা থেকে আরাকানি শাসনের পতন হলে মােগল শাসনাধীনে মারমাদের পেলেংসাঃ গোত্র মােগলদের কর প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের স্থায়ী আবাসভূমি গড়ে তুলেছিল। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের দিকে তারা পেলেংসাঃ রাজবংশের পূর্বসূরী ম্রাচাই ধাবইং এর নেতৃত্বে সীতাকুণ্ড এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ম্রাচাই ধাবইং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে কার্পাস মহলের কর আদায়ের চুক্তি অনুসারে ঐ এলাকার চিফ পদ লাভ করেন (উচনু ২০০৭)।
আরাকানের রাজধানী ম্রোহঙ-এর মহামুনি বুদ্ধমূর্তির অনুকরণে চাইঙ্গা ঠাকুর নামক একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে একটি বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন ১৮১৩খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু সেটা স্থাপনের জন্য কোনাে ভালাে মন্দির ছিল না। এ সময় চাইঙ্গা ঠাকুর পেলেংসা গােত্রের রাজা কংজাই ধাবইংকে বিষয়টি অবগত করেন।
তার অনুরােধে কংজাই ধাবইং এক বছরের মধ্যে মহামুনি মন্দির নির্মাণ করে দেন। এই মহামুনি বুদ্ধমূর্তি ও মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কংজাই ধাবইং-এর উপর সমস্ত ভার অর্পণ করা হয় । কংজাই ধাবইং মন্দিরের কাছাকাছি একটি ভিক্ষু আবাস ও খাওযার পানির সংকট মেটানাের জন্য তিনি বড় একটি পুকুর খনন করেন। দীঘিটি এখনাে ধাবইং দীঘি বা ধামাই দীঘি নামে পরিচিত।
কংজাই ধাবইং ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে পরলােক গমন করলে তার পুত্র ক্যজসাইং(১৮২৫-১৮৭০ খ্রি.) পেলেংসা গােত্রের রাজা হন। মহামুনি বুদ্ধ মন্দিরে আগত তীর্থযাত্রীদের আবাসনের সমস্যা দেখা দিলে তিনি মন্দিরের পাশেই একটি প্রশস্ত দালান তৈরি করে দিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের বাইরেও এই মহামুনি মন্দির বিখ্যাত হয়ে ওঠে এবং বিদেশি পর্যটকরাও এই মন্দিরে আসতে থাকে।
তার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘মং রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে। এই উপাধি তার পরবর্তী বংশধররাও ধারণ করে চলেছেন। মং রাজা নারাপদি লুসাই যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সর্বাত্মক সহযােগিতা করেছিলেন। এ কারণে ব্রিটিশ সেনাপতি মেজর রবেন কর্তৃক এবং তাকে এবং তার উত্তরাধিকারীদেরকে বাৎসরিক ১৫৩টি স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল (খান ২০০১, লিংকন ২০০০)।
ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগাের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আরকানের পেলেংখ্যং থেকে পেলেংসাঃ ও লংগাদুসাঃ গােত্রের মারমাগণ সর্বপ্রথমে মাতামুহুরী উপত্যকায় এসে বসতি স্থাপন করেন। তারা চাকমা রাজা জান বকস খাঁ-এর রাজত্বের শেষ দিকে আরও উত্তর দিকে সরে এসে চাকমা রাজাকে পঞ্চাশ টাকা মাটি পােড়া খাজনা দেবার অঙ্গীকারে সীতাকুণ্ড পাহাড় এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন।
তাদের প্রথম দলপতির নাম কংজাই ওরফে কুঞ্জ ধাবইং এবং দলপতি কুঞ্জ ধাবইং-এর মৃত্যুর পরে ক্যজসাইন চৌধুরী তাদের দলপতি হন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে চাকমা রাণী কালিন্দি-এর আমলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চাকমা রাজ্যকে বিভক্ত করে উত্তরাঞ্চলকে নিয়ে তাদের দলপতির নেতৃত্বে নতুন মং সার্কেল গঠন করে (কানুনগাে ১৯৮৮)। সে সময় বর্তমান খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে মং রাজার রাজবাড়ি স্থাপিত হয়।
মংপ্রুসাইন (১৯৫৪-১৯৮৫ খ্রি.) ১৯৫৪ সালে মং রাজা হিসেবে অভিষিক্ত তিনি কলকাতার রিপন কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে আইন পাশ করেন। লেখাপড়া শেষে রাজ্যশাসনের যােগ্যতা অর্জনের জন্য তাকে কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চলে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব দিয়ে পাঠায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। ১৯৩২সালে রাজা মংপ্রুসাইন চাকমা রাজা ভুবন মােহন রায়ের কন্যা রাজকুমারী নিহার দেবীকে বিয়ে করেন।
মুক্তিযুদ্ধে মারমা জনগােষ্ঠীর ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ছাত্র ও যুবকেরা সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে ও প্রশাসনের সাম্প্রদায়িক নীতির কারণে শেষ পর্যন্ত মারমাসহ অনেক আদিবাসী যুবকের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়ে উঠেনি। তা সত্ত্বেও অনেক মারমা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এমনকি মং রাজা মংপ্রুসাইন সপরিবারে ভারতে আশ্রয় নিয়ে স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৮-১৯৬৯ সাল থেকে রাজা মংপ্রুসাইন পাকিস্তান বিরােধী প্রতিটি আন্দোলনে গ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে যখন শত শত লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল তখন তিনি খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়িস্থ রাজবাড়িতে তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেন।
পাক সেনারা রামগড় দখল করার পূর্বেই তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়েও তিনি বসে থাকেননি। তিনি কর্নেলের ব্যাজ পরে কুমিল্লার আখাউড়া সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন। সেজন্য পাক সেনারা মানিকছড়িতে এসে রাজবাড়ি, তৎসংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দির ও গ্রামের জুম্মদের ঘরবাড়ি ধ্বংস ও লুটপাত করে ।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা থেকে মংসাথােয়াইং (পানখাইয়া পাড়া), আদুং, কংজহ্রি, উক্যজেন (অব. যুগ্মসচিব), মংসাথােয়াইং (গুইমারা)সহ মারমা জনগােষ্ঠীর অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধা হলেন—চিংহ্লামং চৌধুরী, মংশৈহ্রা (বান্দরবান), মংশৈহ্লা (বান্দরবান),মংশৈপ্রু(নাইক্ষ্যংছড়ি) প্রমুখ ।
বান্দরবানের অধিবাসী তৎকালীন ইপিআরের রাইফেলম্যান উক্যচিং মারমা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অসম সাহসিকতার জন্য যুদ্ধের পরে তাঁকে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি এখনাে বেঁচে আছেন। অভাব-অনটনের মধ্যে তিনি কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করছেন বান্দরবান শহরের অদূরে লাঙ্গে পাড়া নামক গ্রামে।
মারমাদের সামাজিক সংগঠন
গােত্র
মারমা জনগােষ্ঠী মােট কয়টি গােত্রে বিভক্ত এ ব্যাপারে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। ভাষা ও বসতি অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে এই গােত্র বিভাজন করা হয়ে থাকে। ডব্লিউ হান্টারের বরাত দিয়ে গবেষক সেলিনা আহসান মারমা জনগােষ্ঠীকে ১৫টি গােত্রে ভাগ করে দেখিয়েছেন। সেগুলাে হলাে
১. রেগ্রেসা : এই গােত্রটি বান্দরবান জেলায় শঙ্খনদীর তীরে বসবাস করে ।
২. পেলেংসা : গােত্র হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে আগত মারমাদের দ্বিতীয় দল যারা কোলদাইন নদীতে পতিত হওয়া পেলেংখ্যং নদীর তীরে বসবাস করত এবং বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে মং সার্কেলে বসবাস করে।
৩. মারােসা : এই গােত্রটি কোলদাইন নদীর তীরে বসবাস করতাে।
৪. সাবােকসা : শঙ্খ নদীটি উজানে সাবােকখ্যং,মাঝামাঝিতে রেগ্রেখ্যং ও ভাটিতে সাঙ্গু নামে পরিচিত। সাবােকখ্যং এলাকায় যারা বাস করে সাবােকসা নামে পরিচিত।
৫. কক্দাইনসা : চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়ার পশ্চিমে বাঁশখালীর নিকটস্থ পাহাড়গুলাে কক্দাইন নামে পরিচিত। ঐ অঞ্চলে যারা বসবাস করতো তারা কক্দাইনসা নামে পরিচিত।
৬.ক্যকফ্যাসা : যে গােত্রটি কোলদাইন নদীর আশপাশে বাস করতাে তবে নদীর একেবারে নিকটবর্তী এলাকায় বাস করতাে না, তারা ক্যকফ্যাসাঃ নামে পরিচিত।
৭. লংগাদুসা : এই গােত্রটি কর্ণফুলির একটি শাখানদী কাচালং নদীর অববাহিকায় বসবাস করতাে।
৮. কোয়াইঃচাঃরিসা : এই গােত্রটি রাজকীয় সুপারির কৌটা বহন করতাে বলে কোয়াইঃচাঃরিসা নামে পরিচিত।
৯. কগদাসা : এরা মারমা জনগােষ্ঠীর একটি যাযাবর গােত্র ছিল, যারা পুরাতন রাজার প্রতি অতি সামান্যই আনুগত্য দেখাতাে। এদের বসবাস হচ্ছে চন্দ্রঘােনা এলাকায়।
১০. পেলেংগ্ৰীঃসা : এই গােত্রটিও আরাকানের কোলদাইন নদীর অববাহিকান থেকে এসেছে। ব্যতিক্রম হচ্ছে ‘গ্রীঃ’ শব্দটি বৃহৎ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
১১. কোলাসা : এই গােত্রটি মাতামুহুরী নদীর অববাহিকায় বসবাস করে।
১২. পালাউসাঃ : মারমাদের এই গােত্রটিও মাতামুহুরী নদীর অববাহিকায় বসবাস করে থাকে। আরাে তিনটি গােত্র হচ্ছে :
১৩. তাইঃছিত্ সাঃ
১৪. ক্যক্মাসাঃ ও
১৫. মাহ্লাইংসাঃ ।।
মূলত এই গােত্রগুলাে এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মারমাদের মধ্যে রেগ্রেসাঃ পেলেংসাঃ গােত্র দুটিই প্রধান। রেগ্রেসাঃ গােত্র বােমাং সার্কেলে এবং পেতে গােত্র মং সার্কেলে বসবাস করে থাকে (আহসান ১৯৯৩)।
তবে এই গােত্রগুলাে ছাড়াও আরাে কিছু গােত্র রয়েছে। যেমন : ওয়ইংসাঃ,ফারাংসাঃ , সাকপ্ৰেগ্যাসাঃ প্রভৃতি। তবে বর্তমানে মারমাদের মধ্যে রেগ্ৰেসাঃ,পেলেংসাঃ, মারােসাঃ, কক্দাইনসাঃ, ক্যক্ফ্যাসাঃ, লঙগাদুসাঃ, ওয়ইংসাঃ এবং ফারাংসাঃ নামক গােত্রগুলির অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় ।
পরিবারের ধরন
হয় সমাজে পরিবারই হচ্ছে চূড়ান্ত আর্থ-সামাজিক একক। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কার্যকলাপ সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনকে প্রভাবিত করে। মারমা জনগােষ্ঠীর গ্রামগুলােতে দুই প্রকারের পরিবার কাঠামাে দেখা যায় । সেগুলাে হলাে—১. একক পরিবার ও ২. যৌথ বা বর্ধিত পরিবার।
একক পরিবারে থাকে স্বামী, স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত সন্তান। যৌথ বা বর্ধিত পরিবারে থাকে স্বামী, স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত সন্তানদের পাশাপাশি বিবাহিত সন্তানগণ এবং তাদের পুত্র-কন্যা ও এমনকি স্বামীর বা স্ত্রীর বা উভয়েরই পিতা-মাতা। কখনাে বা কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনও কম বেশি স্থায়ীভাবে এই ধরনের পরিবারে বাস করে।
সমাজে একক পরিবারের কাঠামােই বেশি দেখা যায়। পরিবারের সদস্য সচরাচর ২ থেকে ১২ জনের মধ্যে এবং গড়ে প্রতি পরিবারে ৬ জন করে সদস্য থাকে। মূলত যৌথ বা বর্ধিত পরিবারগুলাে তৈরি হয় সরাসরি একক পরিবারগুলাে থেকে । সাধারণভাবে মারমারা একক পরিবার গঠন করতেই প্রাথমিকভাবে পছন্দ করে অথনৈতিক কারণে।
পরিবারে পিতাই হচ্ছে প্রধান ব্যক্তি। পরিবারের ভালাে মন্দও পিতাকেই দেখাশােনা করতে হয়। পরিবার ও সমাজের মধ্যে যে কোনাে ধর্মীয় সামাজিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে তার দায় সবচেয়ে বেশি। তিনি সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবের যে কোনাে ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে থাকেন। পরিবারের সকল সদস্যই পরিবার প্রধানকে শ্রদ্ধা করে থাকে।
মারমা সমাজ পিতৃসূত্ৰীয়, কিন্তু নারীর ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে নারীর ভুমিকা অনস্বীকার্য এবং পরিবার প্রধানের মৃত্যুর পর স্ত্রীকেই পরিবার প্রধানের ভুমিকা পালন করতে হয়। পরিবারের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী সমান অংশীদার রূপে বিবেচিত হয়। সংসারে নারী যদি কোনাে কিছু উপার্জন করে তাহলে তা পরিবারের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য স্বামীর হাতে তুলে দেয়, উপরন্তু পারিবারিক কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই মতামত থাকে।
মারমা ব্যক্তির জীবনচক্র
মারমা সমাজে মানুষের জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ এই তিনটি অধ্যায়কে সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে সিদ্ধ করে নেওয়া হয়েছে । জন্ম,মৃত্য ও বিবাহকে কেন্দ্র করে কিছু সুনির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান মারমা সমাজে দেখা যায়।
জন্ম
সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় কিছু নিয়ম পালন করা হয়। গর্ভবতী নারী এ সময় আলাদা একটি ঘরে বসবাস করে। কোনাে কোনাে সময় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আলাদা একটি আঁতুড়ঘরও বানানাে হয়ে থাকে। এ ঘরকে বলা হয়ে থাকে ‘মুইজাং’। ঐতিহ্যগতভাবে একজন ধাত্রী প্রসবকালে নারীকে সহায়তা করে থাকে। নাভি রজ্জুটি ধাত্রী একটি বাঁশের ধারালাে টুকরা দিয়ে কেটে ফেলে এবং নাভী রজ্জুটি একটি দেশীয় সুতা দিয়ে বাধা হয়।
নবজাতক শিশুটি যদি মেয়ে হয়, তাহলে বাঁশের মাচাং-এ তৈরি করা আঁতুড়ঘরের সি-ভির বামপাশে একটি অগ্নিকুণ্ডটি জ্বালানাে হয় । আর যদি নবজাতক ছেলে হয় তাহলে সিড়ির ডান দিকে অগ্নিকুণ্ডটি জ্বালানাে হয়ে থাকে। এটি খাবার পানি গরম করা, রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়।
গর্ভফুল সাধারণত মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। তারপর নবজাতকের মুখ ধাত্রী কর্তৃক একটি আর্দ্র কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এরপর সে মধু ও অজগরের প্লীহার গুড়া দিয়ে একপ্রকার মিশ্রণ নবজাতকের ঠোঁটে ও জিহ্বার উপর রাখে । বিশ্বাস করা হয়, এর দ্বারা নবজাতকের পাকস্থলিতে কোনো সমস্যা থাকবে না। সাতদিন পর আঁতুড়ঘরের পাশে নির্মিত উনুন নষ্ট করে ফেলা হয় এবং উনুনের মাটিগুলাে যেখান থেকে সংগৃহীত হয়েছিল পুনরায় সেখানে রেখে দেয়া হয়। এ সময় প্রসূতি বুকের দুধ বৃদ্ধিতে সহায়ক এমন খাদ্যদ্রব্য খেয়ে থাকে।
একপর্যায়ে নতুন শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি লবণ মিশ্রিত ভাতের মণ্ড খাওয়ানাে হয়। সন্তান জন্মানাের পর আরেকটি আচার পালন করা হয়। এর নাম ‘মেদেঃতঃরে’ । এর অর্থ হলো ক্ষমা প্রার্থনা। এটি শিশু জন্মের পনেরাে দিন পর হয়ে গাকে। এই অনুষ্ঠানে ধাত্রী ও অন্যান্য বয়স্ক প্রতিবেশীর জন্য বিশেষ খাবার ও মদের আয়োজন করা হয়। খাদ্যদ্রব্য পরিবেশনের আগে সন্তানের মা ধাত্রীকে এক গ্লাস মদ দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে এ কারণে যে, সন্তান প্রসবে সহযোগিতা করে ধাত্রী অশেষ কষ্ট স্বীকার করেছে।
আঁতুরঘরে সাতদিন অবস্থান করে শুচিকরণের বিভিন্ন আচার-‘তানুষ্ঠানের পর মা ও শিশু আসল বাড়িতে ফিরে আসে। তখন বাচ্চাকে একটা দোলনায় রাখা হয়। মারমা সমাজে এক টুকরা লােহা বা একটা দা দোলনার নিচে রাখাটা সাধারণ বিষয়, যার দ্বারা অশুভ আত্মার প্রভাব কাটানাে হয় । তার সাথে কিছু নির্দিষ্ট গাছের শেকড়-বাকড়ও শিশুর কবজিতে বাঁধানাে হয় কালাে সুতা দিয়ে। স্বাভাবিকভাবে শিশুদের জন্য দোলনা ব্যবহৃত হয় বছর তিনেক (আহসান ১৯৯৩)।
শৈশব
শৈশবে শিশুর যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে মা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাবার খাওয়ানাে, গােসল করানােসহ প্রতিদিনের যত্ন শুধুমাত্র মাকেই করতে হয়। যদিও পিতা দৈনিক আদর যত্বের সাথে যুক্ত নয় তারপরও শিশু ও পিতার মধ্যে অনুরাগপূর্ণ সম্পর্ক থাকে এবং শিশুর জন্য পিতা বাজার থেকে বিভিন্ন খেলনা এনে দেয়।
সাধারণত প্রায় ছয়মাস মা বাইরের কোনাে কাজে যায় না, এ সময় সে শিশুর যত্ন নেয়। বুকের দুধ খাওয়ানােটা সাধারণ রীতি । মা যখন কাজে বের হয়, তখন নানা বা নানি যে কেউ শিশুর দেখভাল করে থাকে। মা বাইরে যাবার সময় বাড়িতে যদি কেউ না থাকে তাহলে শিশুরা প্রতিবেশীদের হাতে থাকে। শিশুকে কোলে নিয়ে মা সাধারণত কোনাে কাজে যায় না। শিশুর পাঁচ-ছয় বছর বয়স হলে সমবয়সীদের মাঝে খেলাধুলা করে।
পিতামাতাকে সহযােগিতা করতে শুরু করে সাত-আট বছর বয়স থেকে। সাধারণত মেয়েরা মায়ের সাথে কাজ করে। পানি আনা, বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, পশু-পাখিদের যত্ন নেওয়া, হাঁড়ি-পাতিল ধােওয়া, মন্দিরে ভিক্ষুদের খাবার পৌঁছানাে প্রভৃতি কাজ তারা মায়ের সাথে করে ।
নয়-দশ বছর থেকে শিশুরা গবাদি পশু চরাতে শুরু করে এবং এগারাে বারাে বছর বয়সে মেয়েরা জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ও কাপড় বুনতে শুরু করে (আহসান ১৯৯৩)। তবে শহরাঞ্চলে বেড়ে ওঠা শিশুদের সাথে গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠা শিশুদের সংস্কৃতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকে। শহরের আধুনিক শিশুরা এ বয়সগুলােতে স্কুলে ভর্তি হয়। সেখানে আধুনিক শিক্ষার সুযােগ রয়েছে সেখানে শিক্ষা গ্রহণকেই জোর দেওয়া হয়।
যৌবন
মারমা সমাজে ছেলে ও মেয়েদের যৌবনে পদার্পণের সময় সেটিকে প্রতীকায়িত করতে কিছু নির্দিষ্ট আচার ব্যবস্থা থাকে। যখন একজন মেয়ে নদী বা ঝিরি থেকে পানি ভর্তি কলস নিয়ে আসে এবং বন থেকে ভারি জ্বালানি কাঠ বোঝাই করে নিয়ে আসে সেটাকে যৌবনে পদার্পণ হিসেবে দেখা হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রে তারা যখন প্রথম জুম কাটতে শুরু করে সেটাকে যৌবনের শুরু বলে ভাবা হয় (আহসান ১৯৯৩)।
মারমা সমাজে কোনাে কোনাে গােত্রের মেয়ের জন্য ‘রাঙতাঃপােই’ অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। অনুষ্ঠানের আয়ােজন হয় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও অন্যদের জানানাের জন্য যে কন্যা যৌবনে পদার্পণ করেছে, অর্থাৎ বিবাহযােগ্য হয়েছে। অনুরূপভাবে কোনাে কোনাে গােত্রের ছেলেদের জন্যও ‘লাকপাই ছোয়ে অনুষ্ঠান করা হয়। এ অনুষ্ঠানের জন্য ছেলের বয়স ১৪ বছরের বেশি এবং ২০ বছরের কম হতে হয় (চাকমা, রায়, ও দে ২০০৭)।
বিবাহ, বিবাহ ব্যবস্থা ও বিবাহ রীতি
পাত্র পক্ষের প্রস্তাব ও কনে পক্ষের সম্মতি এ দুটি বিষয় মারমা সমাজের নিয়মিত বা সামাজিক বিবাহের প্রথম পর্ব।এ পর্বে সাধারণত পরিচিত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি অথবা নিকট বা দূর সম্পর্কীয় কোনাে আত্মীয় বিয়ের প্রস্তাব বাহক (ঘটক) হিসেবে সামাজিকভাবে বিবাহ বন্ধনের জন্য নৈতিক দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি একপক্ষের প্রস্তাব অপরপক্ষের নিকট পৌছে দেন। পাত্রী পক্ষের অভিভাবক এর ‘হ্যা’ সূচক সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্রের পিতা-মাতা কিংবা বন্ধু-বান্ধব অথবা গুরুজনেরা বেজোড় সংখ্যক ব্যক্তি গিয়ে প্রথাগতভাবে ব্যবহার্য উপকরণসহ (যেমন : এক বােতল মদ, ২৫টি সুপারি, ১ বিড়া পান, বিন্নি ভাত, মিষ্টি, চিনি, আঁখ, এক জোড়া নারিকেল ইত্যাদি) পাত্রী পক্ষের বাড়িতে যায়। তারা পাত্রী পক্ষের বাড়িতে গিয়ে এক বােতল মদ পাত্রীর মা বাবাকে প্রদান করে বিয়ের প্রস্তাবে তাদের মতামত গ্রহণ করে।
পাত্রীর মা-বাবার সম্মতির পর মেয়ের মতামত নেয়া হয়। মেয়ের সম্মতি পাওয়া গেলে পাত্র পক্ষের দেয়া মদের বােতল পাত্রী পক্ষ গ্রহণ করে অনুরূপ আর এক বােতল মদ পাত্রীর পরিবার থেকে পাত্রপক্ষকে দেয়া হয়। এ সময় উভয় পক্ষের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়। অধুনা এসব রীতি কদাচিৎ অনুসৃত হয়।
পাত্র-পাত্রী কোনাে রাশির জাতক-জাতিকা এবং তাদের বিয়ের শুভলগ্ন ইত্যাদি দেখার জন্য জ্যোতিষ শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন একজন গণককে (বিদ্বাংছ্রা) ডাকা হয়। উপস্থিত সকলের সম্মুখে জাতক-জাতিকার রাশিফল, বিয়ের দিনক্ষণ ও তার বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। এক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর জন্মবারও বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে থাকে। সবকিছু শুভ লক্ষণযুক্ত হলে পাত্রী পাত্রপক্ষের গুরুজনদের প্রণাম – আশীর্বাদ গ্রহণ করে। এসময় পাত্রপক্ষ একটি থাবিং রূপা বা স্বর্ণের একটি আংটি দিয়ে পাত্রীকে আশীর্বাদ করে ।
মারমা সমাজে বিবাহ অনুষ্ঠানের দুদিন পূর্বে পাত্রের বাবা বা অভিভাব বাড়িতে গৃহ দেবতার উদ্দেশ্যে ‘চুং-মং-লে’ পূজার আয়ােজন করে। উক্ত পূজায় দেবতার উদ্দেশ্যে একটি শূকর ও পাঁচটি মুরগি বলি দেয়া হয়। অতীতে বিবাহের দিন-তারিখ ধার্য হবার পর পাত্র পক্ষ থেকে পাত্রী পক্ষের বাড়িতে একটি মোরগসহ বিয়ের নিমন্ত্রণ পাঠানাে হতাে।
কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে স্বর্ণমুদ্রা,রৌপ্যমুদ্রা,বা তাম্রমুদ্রা পাঠানাের রেওয়াজও লক্ষ করা যায়। বিয়ের নির্ধারিত দিনে পাত্রের বাড়ির প্রবেশদ্বারে কলা গাছের দুটি কচি চারা বসিয়ে তার পাশে ‘রিজাংও’ (সাদা সুতা দিয়ে প্যাচানো দুটো পানি পূর্ণ কলসি) এবং ‘সিফাইক্ ও’ (বিন্নি চাউল থেকে তৈরি পানীয়) রাখা হয়।
বউ আনতে যাবার দিনে একটি সেদ্ধ মােরগ, চিংরে (মদ তৈরি হবার পূর্বে ভাত, পানি ও মুলির সংমিশ্রণ) এক বােতল, এক বােতল মদ, একটি থবিং (মারমা মেয়েদের নিম্নাংশের পরিধেয় কাপড়), একটি বেদাই আংগি (উর্ধাঙ্গের পােশাক), একটি রাংগাই আংগি (বক্ষ বন্ধনী), এক জোড়া কাখ্যাং (পায়ের খরু), একটি গবং (মাথার বন্ধনী) নিয়ে পাত্রের মা, বাবা, বন্ধু-বান্ধবসহ বাদ্য-বাজনা সহকারে কনের বাড়িতে যান।
গ্রামাঞ্চলের বিয়েতে বরপক্ষ কনে নিয়ে ফিরে যাবার পথে কনের সমবয়সী ও বন্ধু বান্ধবীরা বাঁশ ফেলে পথ রােধ করে। এসময় তাদের দাবি অনুসারে মদ ও নগদ অর্থ উপহার দিয়ে কনে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ চালু আছে (চাকমা, রায় ও দে ২০০৭)।
মারমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে সব চাইতে বেশি শুরুত্বপূর্ণ পর্ব হলাে বৌদ্ধভিক্ষু কর্তৃক ‘পরিত্রাণ’ সূত্রাদি পাঠ করা। এই পর্বের জন্য ‘মঙ্গল বাসন” পরিবেশন করা অত্যবশ্যকীয় কাজ। মঙ্গল-বাসনে থালাভর্তি ভাত, জংলী আলু, কলা, শুটকি মাছ, কার, কুমড়া, শাক-সবজি, রান্না করা গােটা দুটি মােরগ-মুরগি ইত্যাদি থাকতে হয়।
মঙ্গল বাসনের পাশে দুটি ‘মঙ্গল ঘট’ দিতে হয়। মঙ্গল ঘটে থাকে পান,নারিকেলের আগাপাতা, কালােজামের আগাপাতা, দূর্বাঘাস ইত্যাদি যা মঙ্গল অর্থাৎ পরিত্রান সুতা দিয়ে পেঁচিয়ে দিতে হয়। বৌদ্ধভিক্ষু কর্তৃক পরিত্রাণ সূত্র পাঠ করার সময় বর ও কনে উভয়কে ঘিরে মঙ্গল সূত্রের ঘের দেওয়া হয় সুতা দিয়ে ।
এই সুতা নয় প্যাচ দেওয়াই নিয়ম। এই সতার একটি অংশ বৌদ্ধভিক্ষুর হাতে রেখে মহামঙ্গল সূত্র’সহ ‘পরিত্রাণ সূত্রগুলাে পাঠ করা হয়ে থাকে। এই পবিত্র সূত্রের ঘেরের ভিতর যারা থাকে ও যে সকল দ্রব্য থাকে তা সবকিছুই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পরিত্রাণ সূত্র পাঠের মাধ্যমে পবিত্র হয়ে যায় এবং এ অনুষ্ঠানে আগত সকল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীকে পঞ্চশীল প্রদান করা হয়ে থাকে (মংক্যশােয়েনু ২০০৭)।
বিবাহের মূল অনুষ্ঠানটি ‘উবদিদাই’ বা ‘মদেছ্রা বা ‘আখাছ্রা’ (বিবাহের মন্ত্র জানা ব্যক্তি) দ্বারা বরের বাড়িতে পরিচালিত হয়। তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে মন্ত্রপূতজল পর্ণ পাত্রে একগুচ্ছ জামের কচি পাতা ডুবিয়ে তা দিয়ে বর ও কনের মাথায় পাঁচ সাতবার পবিত্র জল ছিটিয়ে দেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের মূলপর্বে কনের ডানহাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলের সাথে বরের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুলটি যুক্ত করে তাতে পবিত্র জল ছিটিয়ে দেয়া হয়।
এ অনুষ্ঠানকে মারমা ভাষায় ‘লাক্ থেক্ পােই’ বলা হয়। মারমা সামাজিক রীতি অনুসারে লা থেক্ পােই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে সমাজ সিদ্ধ করা হয়। বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালনাকারী ‘উবদিদাই’ বা ‘মদেছ্রা’ বা ‘আখাছ্রা’ তার হাতে থাকা একটি তলােয়ারের মধ্যে পাঁচ প্যাচে প্যাঁচানো সুতার কুণ্ডলি জড়িয়ে রেখে সেখান থেকে আশীর্বাদ প্রদানকারীদের দেন।
এই কুণ্ডলী থেকে প্রথমে বরের হাতে সুতার কুণ্ডলি এমনভাবে পরিয়ে দেওয়া হয় যাতে তলােয়ার এবং হাতের মাঝে কোনাে ব্যবধান না থাকে। এরপর বর নিজে অপর একটি সুতার কুণ্ডলি তলােয়ার থেকে ব্যবধান না রেখে কনের মনিবন্ধে পরিয়ে দেয়। নবদম্পতিকে আশীর্বাদের জন্য আসা অতিথিকে ‘মদেছ্রা’ এক আঙ্গুল পরিমাণ মদ (জুংখাই) পরিবেশন করা হয়।
একটি মােরগ মেরে আস্ত সিদ্ধ করার পর ‘মদেছ্রা’ সেই মােরগের জিহ্বার অংশ বিশেষ অংশ (চাইংগা) টেনে প্রথমে বর ও কনের মা-বাবাকে এরপর ক্রমান্বয়ে উপস্থিত সকলের সামনে তুলে দেখান। ‘চাইংগা’ যদি বাম দিকে হেলে থাকে তাহলে মনে করা হয়, বর যদি কনের আত্মীয়-স্বজনের সাথে মিলে মিশে জীবিকা নির্বাহ করে তাহলে সর্বাধিক উন্নতি করবে এবং ডান দিকে যদি হেলে থাকে তাহলে মনে করা হয় এর উল্টো ফল হবে।
এর পর সিদ্ধ মােরগটিকে প্রয়ােজনীয় উপকরণ মিশিয়ে খাওয়ার উপযােগী করে বর-কনের জন্য একটি পাত্রে পরিবেশন করা হয়। বর ও কনে একত্রে একপাত্রে খাওয়ার অনুষ্ঠানকে ‘লাকছংচাঃচ’ বলা হয়। বিয়ের এই সামাজিক আনুষ্ঠানিকতাকে ‘মেয়াপােই বা ‘মাঙলা ছং পােই’ বলে (চাকমা, রায় ও দে ২০০৭)।
মারমা সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক ; মারমা সমাজে নিম্নে বর্ণিত বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ বলে গণ্য করা হয়—
ক। একই গােত্রের যে কোনো আত্মীয়ের মধ্যে তিন পুরুষ অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত;
খ। যে কোনাে ধরনের ও কাকাতাে/ মাসিতাে ভাই বােনের মধ্যে;
গ। মামা ভাগ্নির মধ্যে;
ঘ। পিসি-ভাইপাের মধ্যে;
ঙ। স্ত্রীর আপন বড় বোনের সাথে;
চ।কাকা-ভাইঝির মধ্যে;
ছ। মাসি-ভাগিনার মধ্যে;
জ।বিমাতার সঙ্গে;
ঝ।একই পিতার ঔরসে ভিন্ন ভিন্ন মাতার গর্ভজার ছেলে মেয়েদের মধ্যে;
ঞ।ভ্রাতুস্পুত্রের স্ত্রী; ট. ভাগিনার স্ত্রী;
ঠ।মামি সম্পর্কীয় আত্মীয়;
ড। কাকি সম্পর্কীয় আত্মীয়;
ঢ।তালতাে ভাইদের সাথে আপন কন্যা ও
ণ. ভাই বােনের মধ্যে।
বিবাহের প্রকারভেদ
মারমা সমাজে সচরাচর দুই ধরনের বিবাহের অস্তিত্ব রয়েছে।যথা: ১. সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ ও ২. পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ। আধুনিক ও শিক্ষিত সমাজে কোর্ট ম্যারেজ ও মিশ্র বিবাহের প্রবণতা ইদানীং দেখা গেলেও সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সমাজসিদ্ধ করা ব্যতিরেকে মারমা সমাজ তা অনুমোদন করে না। রক্ত সম্পর্কীয় নিষিদ্ধ বা অনুমােদিত বিবাহ ও বহু বিবাহকে স্বীকৃত বিবাহ হিসেবে মারমা সমাজে গণ্য করা হয় না।
সামাজিক বা নিয়মিত বিবাহ
পিতা-মাতা বা অভিভাবক সামাজিক রীতিনীতি বা নিয়ম অনুসারে এ বিবাহের সম্বন্ধ ধার্য করে থাকে অথবা পাত্র পাত্রী পরস্পরকে পছন্দের মাধ্যমে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পাত্রকে ঘর জামাই তুলে মেয়ে বিয়ে দেবার রীতিও মারমা সমাজে ধার্য বিবাহ হিসেবে স্বীকৃত । তবে এ ধরনের বিবাহ আড়ম্বরপূর্ণ হয় না এবং পাত্রের কাছে পাত্রীর পিতার কোনাে দাবি থাকে না। পাত্রীর বাড়িতে ঘর জামাই ওঠার পর সামাজিক নিয়মে পাত্র-পাত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সাধারণত পুত্র সন্তানের অনুপস্থিতি বা সংসারে কাজকর্মের প্রয়ােজনে ঘর জামাই তােলা হয়।
পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ
মারমা সমাজে পিতা মাতা বা অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে সামাজিকভাবে প্রচলিত নিয়মের বাইরে প্রেমঘটিত কারণে যুবক-যুবতী ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করাকে পলায়ন বা অনিয়মিত বিবাহ বলা যায়। এ ধরনের পলাতক যুবক-যুবতীর মধ্যে পরে বিয়ে হােক বা না হােক মারমা সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী গােপনে পালিয়ে গিয়ে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধে সামাজিক বিচারে উভয়ের সাজা হয়।
সাজা হিসেবে যুবককে দিতে হয় একটি শূকর, কিছু নগদ টাকা ও এক বােতল মদ, আর যুবতীকে দিতে হয় একটি মােরগ, কিছু নগদ টাকা ও এক বােতল মদ। পলাতক যুবক-যুবতী সাবালক হলে এবং বিবাহ নিষিদ্ধ নিকটাত্মীয় না হলে বৌদ্ধ ভিক্ষুর নিকট মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করে শুদ্ধ হবার পর তাদেরকে সমাজে গ্রহণ করা হয়। পরে সামাজিক সদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘মেয়াঃপােই’ বা ‘মাঙলাছংপােই’ অনুষ্ঠানের জন্য অনুমতি দেয়া হয়।
মারমা সমাজে মিশ্র বিবাহ
পার্বত্য জেলা সমূহে বসবাসকারী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছাড়াও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আদিবাসী জনগােষ্ঠীর সাথে উভয় পক্ষের সম্মতিতে ‘মেয়াপােই’ বা ‘মাঙলাছংপােই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহ তা মারমা সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে। এরূপ বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্রী যে জনগোষ্ঠী থেকে মারমা সমাজে এসেছে সেই পিতৃকুলের ধর্ম, বর্ণ, গােত্র, মর্যাদা, পদবি প্রভৃতি লােপ পাবে এবং স্ত্রী হিসেবে মারমা স্বামীর ধর্মীয় বিশ্বাস, বর্ন,গোত্র, মর্যাদা, পদবি ধারণ করবে। অনুরূপভাবে কোনাে মারমা নারীর সাথে অন্য জনগােষ্ঠীর পুরুষের বিবাহ হলে এবং ধর্মান্তরিত হয়ে অন্য জনগােষ্ঠীভক্ত হলে বিবাহিত নারী মারমা সমাজের উত্তরাধিকারসহ পদবি হারাবে।
বহু বিবাহ
মারমা সমাজে বহু বিবাহ স্বীকৃত। তবে সাধারণত বহু বিবাহ বহুল প্রচলিত নয় এবং সমাজে অনেক ক্ষেত্রে ভালাে চোখে দেখা হয় না। একজন বিবাহিত মারমা স্বামী তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন না করে স্ত্রীর সম্মতিতে যে সমস্ত কারণে বহু বিবাহ করতে পারে, সে কারণগুলাে হলাে—ক. সন্তানহীন দম্পতির বংশ রক্ষার তাগিদে, খ. স্ত্রী দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, গ. স্ত্রী উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ হলে, ঘ. স্ত্রী শারীরিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে, ঙ. স্ত্রীর অনুমতি বা সম্মতি সাপেক্ষে, চ. স্ত্রী যদি কোনাে কারণে স্বামীর অমতে দীর্ঘ বছর পিত্রালয়ে বা দেশান্তরে থাকে, ছ. স্ত্রী যদি ব্যাভিচারে কিংবা পরকীয়ায় লিপ্ত হয় এবং এ ধরনের অপরাধে সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়।
বহু বিবাহ বলতে প্রথম স্ত্রী জীবিত থাকাবস্থায় আরাে এক বা একাধিক নারীকে বিয়ে করা বােঝায়। প্রথম স্ত্রী মারা গেলে বা প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হলে সব সমাজেই দ্বিতীয় বার বিয়ে করার রীতি আছে। তবে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ বা স্বামীর মৃত্যু ব্যতীত নারীদের বহু বিবাহ মারমা সমাজে স্বীকৃত নয় ।
মৃত্যু ও সৎকার পদ্ধতি
মারমা সমাজে মৃত্যুর কারণ, লিঙ্গ, বয়স, সামাজিক অবস্থান ভেদে মৃত্যু পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন ভিন্নভাবে অনুষ্ঠিত হয়। তবে মূল আনুষ্ঠানিকতায় ভিন্নতা থাকে না। মারমা সমাজে মৃত্যুর কারণকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। এক. স্বাভাবিক মৃত্যু এবং দুই. অস্বাভাবিক মৃত্যু, যাকে মারমা ভাষায় বলা হয় ‘আচিইনসি’ অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে বয়স, সামাজিক অবস্থান বা লিঙ্গভেদকে বিবেচনা করা হয় না ।
সকল ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা প্রায় একই হয় । অবিবাহিত কিন্তু বিবাহযােগ্য কোনাে পুরুষ বা নারী মারা গেলে লাশে কাঠের গুড়ি বা কলা গাছের গুড়ি দিতে হয়। সামাজিক অবস্থানভেদে উচ্চতর ব্যক্তিদের বেলায় অতিরিক্ত কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয়। যেমন- ‘রাথাঃগাঙ পোই‘’ ‘সইং আকাহ’ ইত্যাদি। মারমা সমাজে মৃতদেহের তাৎক্ষণিক সৎকার হয় না। অ অমাবস্যার দিনে কারাে মৃত্যু হলে শুধু তাকেই সেদিন সৎকার করতে হয়।
মৃতের ব্যবহৃত খাট মন্দিরে দান করা হয় এবং ব্যবহৃত বিছানা, কাপড় শ্মশানে ফেলে দেওয়া বা পুড়ে ফেলা হয়। মৃতদেহকে মাটিতে সমাধিস্থ করা বা পোড়ানোর আগে আত্মীয়- স্বজনসহ ঘনিষ্ঠজনদের শেষবারের মতাে দেখানাে হয়। চিতা থেকে মৃতের অস্থি সংগ্রহ করে সামর্থ অনুযায়ী শ্মশানে স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করে দেয়া হয়।
স্বাভাবিক মৃত্যুর বেলায় মারমা সমাজে মৃতদেহের সৎকারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম লাশকে সহনীয় গরম পানি দিয়ে স্নান করানাে হয়। এরপর নতুন পােশাক পরানো হয়। পুরুষ হলে জামার সামনের দিকের অংশটি উল্টোভাবে পিঠের দিকে রেখে পরানো হয়। মেয়েদের বেলায় স্বাভাবিকভাবে পরিয়ে বােতাম লাগানাে হয়।
অতপর সুগন্ধি দ্রব্য ছিটিয়ে ‘ছংবাইং’ (শবাধার) এর উপর তােলা হয়। মৃতদেহের দু পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দুটিকে একত্র করে সাদা সুতা দিয়ে সাত পাকে বাঁধা হয়। এরপর গ্রামের মন্দিরের বৌদ্ধ ভিক্ষু দ্বারা মৃতের সদগতি কামনা ও ধর্মদেশনা করা হয়। শবাধারকে উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর লম্বালম্বি করে রাখা হয়। মৃতের মাথা থাকে উত্তর দিকে।
মৃত ব্যক্তি যদি পরিবারের প্রধান বা বয়ােজ্যেষ্ঠ হয়, তাহলে ‘ছংবাইং’ ব্যবহার করা হয়। তবে মাতা-পিতা জীবিত থাকা অবস্থায় কেউ মারা গেলে তার মরদেহ মেঝেতে রাখা হয়। মৃতদেহের পাশে বসে ‘নিবাই সুক’ (গৌতম বুদ্ধের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন গাঁথা) পড়া হয়।
পারলৌকিক বিশ্বাস অনুসারে মৃতের আত্মার প্রয়ােজন মেটাতে মরদেহের বুকের উপর ধাতব মুদ্রা, পায়ের দিকে খােমেজা, মাথার দিকে জলভর্তি পাত্র রাখা হয়। মৃতদেহের মাথায় বিশেষ চোঙায় ভর্তি করে রাখা হয়। চাল তরিতরকারি দিয়ে খােমেজা রান্না করা হয়।
মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার পূর্বে মন্দিরের বিহারাধ্যক্ষ (মৃতদেহ রাখার খাট) ছঙবাইঙ এর পাশে বসে ‘স্দাঙঃতাং’ বা মুক্তির দেশনা দেন। ঐ সময় মূতের পাশে নাঃরাঙঃ ছাইং হ্লোক (ছােট বাঁশের চোঙায় সমান চাল দিয়ে সশব্দে নাড়ানো) করা হয়। একই সময় আরেকজনকে কুঙখ্যোঃ (একটি বাঁশের বেতকে টুকরো টুকরো করে ভাঙা) করতে হয়।
লাশের সাথে কুষ্ঠি লিখে দিতে হয়। মৃত ব্যক্তির জন্ম তারিখ, মৃত্যুর তারিখ, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে দান করা টাকা,-পয়সা,চাল, তালাহ্ (কফিন), মঙহমুঙ (বিশেষ চোঙা), কুঙখ্যাঃ এসবের হিসাব লিখে দেয়াকে কুষ্ঠি বলা হয়। চিতায় লাকড়ির স্তুপে কফিনসহ মৃতদেহ উঠানাের পর বৌদ্ধভিক্ষু এ সমবেত লােকজনকে শীল প্রদান করেন। অতপর মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতি ও মুক্তি কামনা সম্বলিত ধর্ম দেশনা করা হয়।
তারপর ‘রিজাকখ্যাহ’ (উৎসর্গ) অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। মৃত ব্যক্তি যদি বিবাহিত তাহলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটি পাতার প্রতীকী সাক্ষী রেখে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানো হয়। সব রকম আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার পর পরিবারের সদস্যগণ প্রথমে চিতায় জ্বালানি কাঠের স্কুপে আগুন দেয়। এরপর অন্যরা আগুন দিতে পারে।
স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন ব্যক্তির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন হতে সাত দিনের ভেতর মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ম্সা ছােয়াইং’ (পিণ্ড দান) দেয়া বাধ্যতামূলক। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে এ অনুষ্ঠানটি বাড়িতে না করে বৌদ্ধ মন্দিরে করা হয়।
মারমা সমাজে মৃতদেহকে শ্মশানে নিয়ে দাহ করা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ম। শব দাহ করার জন্য শ্মশানে উত্তর-দক্ষিণমুখী লম্বালম্বিভাবে জ্বালানি কাঠের স্তুপ দিয়ে চিতা সাজানাে হয়। পুরুষের জন্য তিন এবং মহিলার জন্য চার স্তর। বিশিষ্ট চিতা সাজানাে হয়।
চিতার উত্তর দিকে মৃতের মাথা রেখে মরদেহসহ ‘ত্লাঃ’ (খাটিয়া)বসানাে হয়। এর আগে চিতার চারদিকে মরদেহসহ ‘ত্লাঃ (খাটিয়া)-কে প্রদক্ষিণ করনাে হয়। এভাবে সতকার শেষে মৃতের আত্মার মুক্তি ও উন্নত জীবন লাভের প্রার্থনায় কিছু আনুষ্ঠানিকতা, যেমন : ছােয়াইং (পিণ্ডদান), সূত্রপাঠ, প্ৰবজ্যা ইত্যাদি সম্পাদন করা হয়। মৃত ব্যক্তির আত্মার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধভিক্ষুদের অন্নদান করা হয়। মারমা সমাজে মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। এটি পিণ্ড, অন্ন, অষ্ট পুরস্কার প্রভৃতির মাধ্যমে হয়ে থাকে (চাকমা, রায় ও দে ২০০৭)।
ঐতিহ্যগত সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান
পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মতাে মারমাদেরও রয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। রাজা (সার্কেল চিফ)-হেডম্যান (মৌজা প্রধান)-কার্বারী (গ্রাম প্রধান) নিয়ে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। মারমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও বিচারিক ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে রয়েছেন বােমাঙ রাজা। এছাড়া চাকমা সার্কেল ও মং সার্কেলের অধীন মারমাদের বেলায় রয়েছে চাকমা রাজা ও মং রাজা। বলাবাহুল্য, রাজা বা সাকেল চিফরা কেবলমাত্র স্বজাতি জনগােষ্ঠীর রাজা নন। সার্কেলের আওতাধীন সকল জনগােষ্ঠীরই তিনি রাজা।
মারমাদের কোনাে প্রকার দ্বন্দ্ব, বিরােধ, সামাজিক সমস্যা, নারী ঘটিত সামাজিক সমস্যা উদ্ভব হলে তা প্রাথমিকভাবে কার্বারীর মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। এক্ষেত্রে এলাকার মুরব্বিদেরও ভূমিকা থাকে বা সাধারণত কার্বারী গ্রামের মুর- ব্বিদের পরামর্শ নিয়ে বিরােধ নিষ্পত্তি করেন।
কার্বারী আদালতের সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রথমে হেডম্যান আদালতে, পরবর্তীতে সার্কেল চিফের আদালতে শরণাপন্ন হয় (চাকমা, রায় ও দে ২০০৭)। কার্বারী পর্যায়ে বিরোধ নিষ্পন্ন হবার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা পক্ষ হেডম্যান আদালতে শরনাপন্ন হলে মৌজা হেডম্যান সাধারণত গ্রাম্য কার্বারীদের সমন্বয়ে গঠিত সালিশি বোর্ডের মাধ্যমে বিরােধ বা মামলা নিষ্পত্তি করে থাকেন।
ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে বোমাংগ্রীদের ঐতিহ্য অনুসারে তাদের নিজস্ব প্রশাসনের পদ সমূহ হলো : ১. জমাদাঃ (দেহরক্ষী), ২. দগইং (পেয়াদা), ৩. হ্লুদা (সেপাই দলের প্রদান), ৪. আমাংদা (সেপাই দলের উপপ্রধান), ৫. রেঃসাঃ (সেপাই), ৬,চগইং(বােমাং কার্যালয়ের করণিক), ৭. রােয়াসীঃ (বােমাঙ রাজার ঘােষণা প্রচারক), ৮. রােয়াজাঃ (গ্রাম প্রধান ও খাজনা আদায়কারী) এবং ৯. ফাইসীঃ বা বাইংদাসীংঃ (রােয়াজাঃর অধীনস্ত খাজনা আদায়কারী)।
তবে কালের বিবর্তনে এ ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলােতে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির আওতায় গ্রাম পর্যায়ে কার্বারী, মৌজা পর্যায়ে হেডম্যান এ সার্কেল পর্যায়ে রাজা কর্তৃক সামাজিক বিচার ও প্রশাসনিক কার্য চালানাে হচ্ছে (উচনু ২০০৭)।
মারমাদের অর্থনৈতিক সংগঠন
আর্থ সামাজিক অবস্থা
মারমা সমাজে উৎপাদন পদ্ধতি আজও প্রাক-ধনতন্ত্র ভিত্তিক। সঞ্চয় প্রবৃত্তি-মনােভাব আজও এদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। প্রাচীনকাল থেকেই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে এই জনগােষ্ঠীর লােকেরা, যা এদের পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছে। নিজেদের প্রয়ােজনের অতিরিক্ত কোনাে বনজ সম্পদ অপব্যবহার করে না।
এমনকি এদের দৈনন্দিন উপকরণাদিও বাহুল্য বর্জিত। শখ করে কিংবা গৃহস্থালির নিত্য-নৈমিত্তিক প্রয়ােজনে কখনাে কখনাে পশু শিকার করে, তাতে কাপড় বােনে। কিন্তু এটা কোনাে জীবিকার প্রয়ােজনে নয়। তাছাড়াও পারিবারিক প্রয়ােজনে তুলা, তিল, নানা জাতের ফসলের চাষ করে। ফলের বাগান,জাত কাঠের বাগান তৈরি করে বাড়ির আঙ্গিনায় গরু, ছাগল, মুরগি ইত্যাদি গৃহপালিত পশু পালন করে থাকে। প্রত্যেক মারমা মহিলা পারিবারিক প্রয়ােজনের তাগিদেই এগুলাে করে থাকে এবং সীমিত পরিসরে (মংক্যশােয়েনু ১৯৯৮)।
জুম চাষাবাদ পদ্ধতিতে উৎপাদন ও বনজসম্পদ আহরণের উপর এদের জীবিকা সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য অঞ্চলের এসব মারমা পরিবারগুলাে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের পাদপ্রান্ত পর্যন্ত মােটামুটি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও সচ্ছল ছিল বলে জানা যায়।
নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসল হানি,খাদ্য মন্দাভাব দেখা দিলেও এদের খুব একটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অরণ্যরাজি হতে এসব খাদ্য ঘাটতি পুষিয়ে নেয়া যেত। এ কারনে বিশ্বের উল্লেখযােগ্য যে কয়টি মহামন্দা, খাদ্যাভাব ও মহামারি দেখা দিয়েছিল,এসব মারমা সমাজকে মারাত্মক আকারে মােকাবেলা করতে হয়নি। সহায় সম্বলহীন অবস্থায় এদের অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি।
কিন্তু পরবর্তীতে গত শতাব্দীর ষাট দশকের গােড়া থেকে পাশ্ববর্তী লােকজনের আগ্রাসী মনোভাব, ভূমি আত্মসাৎ, ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্যোগহীনতা ইত্যাদি কা্রনে মারমাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী জীবনে ছেদ পড়ে। এমনকি গত শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু, ক্ষেত্র বিশেষে অচল ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে কোনাে পর্যায়ে প্রতিকারের যথাযথ উদ্যোগ ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
ফলে জীবিকা অন্বেষণের পথহারা এই জনগােষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী হবার প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও আগ্রহ ক্রমশ হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানকালে এদের মধ্যেও প্রান্ত-আর্থিক সীমায় অবস্থান করা ভূমিহীন ও বেকারদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে শুরু করেছে।
বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগণের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা প্রােগ্রামের আওতায় ৫% হারে সুদ ধার্য করত। সরকারি অর্থায়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং ঋণ গ্রহণের সুযােগ-সুবিধা মারমা সমাজে থাকা সত্ত্বেও তা প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনার লাল ফিতার ডোরাকাটা দাগের আড়ালে নথিবদ্ধ হয়ে আছে। বাস্তবমুখী কোনাে অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা সমাজের মঙ্গলে ব্যয়িত হয়নি।
ইউনিসেফ বা এডিবি বা এসিমক এর আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তক আর্থিক সাহায্যপুষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডও মারমা জনজীবনের অর্থনৈতিক প্রবাহকে তুরান্বিত করতে সক্ষম হয়নি। বন বিভাগের জুম নিয়ন্ত্রণ, পাল্পউড চাষ, জুমিয়া পুনর্বাসন, বনায়ন, উদ্যান চাষ ও রাবার চাষ, সংরক্ষিত ও রক্ষিত বন ঘােষণা ইত্যাদি কর্মসূচি মারমা জনগণের চিরাচরিত জীবিকা অন্বেষণের অবলম্বন জুম চাষাবাদকে নিরুৎসাহিত করলেও চাষাবাদযোগ্য জমির সংকট তার্থনৈতিক সমস্যাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছে।
তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ভেঙে দিয়ে পর্যুদস্ত করে ফেলে। এক সময় নদী- খাল-ঝিরি ও ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গল–সমতল ভূমিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা চাষাবাদ ব্যবস্থা আজ পাহাড়ের পাদদেশে এসে ঠেকেছে (মংক্যশোয়েনু ১৯৯৮)
মারমাদের অর্থনীতি প্রধানত জীবিকাভিত্তিক অর্থনীতি। এরা নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন করে কিন্তু বর্তমানে জীবিকা অর্থনীতির জায়গায় ধীরে ধীরে এদের মধ্যে বিনিময় অর্থনীতি অর্থাৎ বাণিজ্যিক অর্থনীতি গড়ে ওঠার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছু সংখ্যক অর্ধশিক্ষিত মারমা বিভিন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাকরি করতে আগ্রহান্বিত হচ্ছে।
আবার কিছু শিক্ষিত মারমা প্রজন্মকে ছোটখাটো ব্যবসা-বাণিজ্য ও ঠিকাদারি কাজে ব্যতিব্যস্ত হতে দেখা যাচ্ছে অর্থ উপার্জনের মনােভাবে। জীবিকার তাগিদে মারমা জনসমাজের মধ্যও এখন দিন-মজুরির শ্রমিক শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং ধারণা করা যায় মারমা জনসমাজের অথনীতিও পুঁজিবাদী বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণরূপ ধারণ করতে আর বিলম্ব হবে না (মংক্যশােয়েনু ১৯৯৮)।
পেশার প্রকারভেদ ও প্রবণতা
সম্প্রতিক সময়ে সমতলের মানুষদের সাথে মারমাদের সংস্পর্শ ও আন্তঃসাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার কারণে মৌলিক অর্থনৈতিক কাঠামাে ও কার্যাবলি পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। মারমা সমাজের সদস্যদেরকে নতুন নতুন পেশায় শামিল হতে দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে সমতল জমি চাষ, পরিকল্পিত বন-বাগান, ছােট-খাটো ব্যবসা, মজুরিখাটা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত।
সংক্ষেপে মারমা জনগােষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিম্নোক্তভাবে তালিকাভুক্ত করা যায়—১. জুম চাষ, ২. সংগ্রহ, ৩. পশুপালন, ৪. মদ তৈরি, ৫. কাপড় বুনন, ৬. সমতল জমি চাষাবাদ, ৭. কারিগরী বা হস্ত শিল্প ও ৮, ব্যবসা।
একটি জরিপে দেখা গেছে, মারমা সমাজে জুম চাষ করে ৪২.৩%, হাল চাষ করে ৩৬.৩%, অকৃষিমূলক কাজ (অদক্ষ) করে ৪.৮%, অকৃষিমূলক কাজ (দক্ষ) করে ২.৭%, চাকরি করে ৩.২%, ব্যবসা করে ৪.৬%, পশুপালন করে ১.৯%, হাঁস-মুরগি পালন করে ২.২% এবং অন্যান্য কাজ করে ২.৭% পরিবার (মল্লিক২০০১) ।
মূলত জুম চাষ মারমা সমাজের প্রাথমিক অথনৈতিক কাজ। জুম চাষকে কেন্দ্র করে মানুষজন সারা বছরই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে অল্প কিছু সময় বাদে। তাঁদের কিছু কিছু গুরুতুপূর্ণ অর্থনৈতিক কাজ ঋতুভিত্তিক হয়ে থাকে। যেমন :জুমচাষ,শন কাটা, বাশ কাটা প্ৰভতি। মারমাদের উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি তেমন উন্নত নয়, এই দিক দিয়ে চিন্তা করলে তাদের জীবন-ধারা খুবই সহজ-সরল। এটা চমকপ্রদ যে, মারমা সমাজে প্রযুক্তির নিম্নস্তরেও ভিন্ন ভিন্ন। কার্যাবলির জন্য কিছু কিছু বিশেষায়ন রয়েছে।
শ্রম বিভাজন
সমাজে বিশেষ কোনাে কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কাজের নির্দিষ্টতা ও সুনির্দিষ্ট শ্রম বিভাজন থাকে পুরুষ, নারী ও ওশিশুর মধ্যে। মারমা সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ই পরিশ্রমী। সাধারণত নারী গৃহস্থালির সব রকম কাজ করে।
পুরুষের কাজগুলাে সাধারণত কঠোর কায়িক শ্রমভিত্তিক। যাহােক নারীরাও কঠিন কায়িক শ্রমগুলাে করে। যেমন : পাহাড়ি বন থেকে শন কাটা ও সেগুলো পিঠে বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসা প্রভৃতি। উৎপাদনমূলক কাজ নারী ও পুরুষ উভয়ই করে থাকে। জুম ক্ষেত নির্বাচন করা, জঙ্গল কাটা, গাছ কাটা প্রভৃতি দায়িত্ব পুরুষের।
নারীর কাজ হলাে গর্ত তৈরি ও বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, ফসল কাটা, শস্য মাড়াই ও বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসা। সমতল জমি আবাদের ক্ষেত্রে এ প্রস্তুত করা পুরুষের কাজ। সংগ্রহ করার কাজটি মূলত নারীদের। কাপড় বোনা ও মদ তৈরি নারীদের কাজ। ঝুড়ি তৈরির কাজটি পুরুষেরা করে থাকে।
গবাদি গত চরানাে ও গৃহস্থালির কাজে মাকে সাহায্য করাটা শিশুরাই করে থাকে। তবে দক্ষতার বিচারে নারী ও পুরুষের কাজে মৌলিক স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। মারমা পুরুষের চেয়ে মারমা নারীরা অধিক সময় ধরে কাজে যুক্ত থাকে, সন্তান প্রসব ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঘরে থাকার অল্প কিছু সময় ব্যতীত সারা বছরই কর্মব্যস্ত থাকে।
মারমা সমাজে নারী ও পুরুষের উভয়ের জন্যই ঐতিহ্যগতভাবে প্রধান নয় এমন কিছু পেশাও দেখা যায়। যেমন : স্কুল শিক্ষক, হাসপাতালের আয়া, সুদ ব্যবসায়ী, দরজি, দোকানদার প্রভৃতি। পেশার ক্ষেত্রে রূপের পরিবর্তন মূলত সমতলের মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের সাথে আদিবাসীদের মিথস্ক্রিয়ার কারণে ঘটেছে (আহসান ১৯৯৩)।
জুম চাষ : ঐতিহ্যগত উৎপাদন ব্যবস্থা
জুম চাষ হচ্ছে মারমা জনগােষ্ঠীর একটি ঐতিহ্যগত উৎপাদন ব্যবস্থা। এফ কে খান ও এ এল খীসার মতে, ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জুম ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কৃষির একমাত্র রূপ। তারা বর্তমানে বাংলাদেশ হিসেবে বিস্তৃত এলাকায় এ স্থানান্তর কৃষি ব্যবস্থা প্রচলিত থাকার কথাও বলেছেন হালচাষের বিস্তৃতির সাথে সাথে স্থানান্তর কৃষির এলাকা সংকুচিত হয়ে আছে এবং বর্তমানে তা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলগুলােতেই সীমাবদ্ধ। এ ধরনের স্থানান্তর কৃষি বা জুম চাষের নির্দিষ্ট কতগুলাে ধাপ রয়েছে।
জুম চাষের জন্য স্থান নির্বাচনের কাজটি পরিবারের প্রধানের দ্বারা হয়ে থাকে। সাধারণত তিনি ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো একটি সময়ে সুবিধাজনক একটি স্থান নির্বাচন করেন। চূড়ান্তভাবে স্থান নির্বাচনের পর জুমভূমিতে বাঁশ দিয়ে একটি ক্রস চিহ্ন বানিয়ে গেঁথে রাখা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে প্রতীকটি দুই টুকরো বাঁশ একসাথে বেধে তৈরি করা হয়।
এর দ্বারা বোঝানো হয় যে, জায়গাটি একজন মানুষ জুমচাষের জন্য নির্বাচিত করে ফেলেছে।ফসল তোলার পর স্থানটি বিভিন্ন লতা-গুল্ম, গাছ প্রভৃতিতে আবার ভরে ওঠে।একে বলা হয় পুংঃছো(রান্যা)।এ সময় যে কারাে দ্বারা স্থানটি জুম চাষের জন্য নির্বাচিত হতে পারে। পরিবারের পূর্ণ বয়স্করা জঙ্গল, ছােট ছােট গাছ এবং ঘাস কেটে জায়গাটি পরিষ্কার করে।
গাছ কাটা প্রতীকীভাবে নির্দেশ করে যে স্থানটি ইতোমধ্যে কারো দ্বারা নির্বাচিত হয়ে গেছে। জুমের জন্য সব সময় পাহাড়ের ঢালুতে স্থান নির্বাচন করা হয়। গাছ কাটার পর স্থানটি পরিষ্কার করা হয় এবং কেটে ফেলা বােপঝাঁড় ও পাতাগুলো শুকানোর জন্য ১৫-২০ দিন ফেলে রাখার পর আগুনে পােড়ানো হয় ।
এই ছাইগুলাে পুরাে ক্ষেতে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এই কাজগুলাে করা হয় সাধারণত পুরুষের দ্বারা, যাতে আত্মীয়-স্বজনেরও অংশগ্রহণ থাকে। যখন কোনো স্থান পরীক্ষামূলকভাবে নির্বাচন করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে জঙ্গল কাটা হয়ে যায় তখন একটি ছোট স্থান পরিষ্কার করে মঞ্চ জাতীয় একটা কাঠামাে তৈরি করা হয় বাঁশ দিয়ে।
দুটি বড় মাটির ঢেলা, সেই কাঠামাের উপর তুলে রাখা হয়। তারপর দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানানো হয়—’আমি এ বছর জুম চাষ করার জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করবো, দয়া করে ভূত-প্রেত যাতে আমার পরিবারের কোনাে ক্ষতি করতে না পারে, যদি অনুমতি দেন আমাকে জানানাে হােক’।
এরপর জুম ক্ষেত থেকে এক টুকরা গােলক নিয়ে এসে রাতে ঘুমানাের সময় বালিশের নিচে রাখা হয় স্বপ্ন কামনা করে। বাড়ির কর্তাটি যদি মাছ, দুধ, মাংস প্রভৃতির সাথে ভাত খাওয়া স্বপ্ন দেখে থাকে তাহলে এ্টি ভালাে চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং পরীক্ষামূলকভাবে নির্বাচিত ক্ষেতটি চাষাবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়।
যদি স্বপ্নে চুলকাটা, ঠাট্টা-তামাশা, সাদা পোষাক পিরধান করা প্রভৃতি দৃশ্য দেখা যায় তাহলে অশুভ চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত জুম ক্ষেতটিতে চাষাবাদ করা হয় না, নতুন একটি স্থান খোঁজা হয়।
এপ্রিল মাসের কোনাে এক সময় প্রথম ভারী বৃষ্টিপাতের পর ধানের বীজ বপন করা হয় কার্পাস, ভুক্তা, মারফা, শিম, আলু প্রভৃতির সাথে। মাটিতে দাউজু নামক বিশেষ দা দিয়ে ছোট গর্ত খুড়ে বীজ বপন করা হয়। লােকজন পাহাড়ের নিচ থেকে উপরের দিকে বীজ বপন করে উঠে আসে পিঠে বীজ ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে।
বীজগুলো বোনা হয় দুই ইঞ্চি গর্তে ১০-১২ ইঞ্চি দূরত্ব রেখে। তিল সাধারণত পুরাে ক্ষেতে ছড়িয়ে বোনা হয়। একইভাবে ধন্যা ও টকপাতার গাছের বীজও পুরাে ক্ষেতেই ছড়িয়ে বপন করা হয়। জুম ক্ষেতের সীমানাবর্তী স্থানে হলুদ, আদা ও বন্য ফুল চাষ করা হয়। মারমারা সাধারণত নিজেদের বীজ ব্যবহার করে নতুবা বিনিময় প্রথার মাধ্যমে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে।
জুমক্ষেতে যাতে আগাছা না জন্মায় তার জন্য যতটুকু সম্ভব প্রচেষ্টা থাকে। এজন্য তিনবার আগাছা পরিষ্কার করা হয়। প্রথমবার আগাছা পরিষ্কার করা হয় যখন ধানের চারাগুলাে প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়। আগাছা পরিষ্কারের কাজটা নারী, উভয়ের দ্বারাই হয়ে থাকে এবং প্রতিবেশীরাও এ কাজে সহযােগিতা করে আগাছা হাত দিয়ে টেনে পরিষ্কার করা হয় এবং পঙঃখােয়াইদাঃ নামক এক প্রকার দা ব্যবহার করা হয়। আগাছাগুলাে পরিষ্কার করার পর জুম ক্ষেতের বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার আগাছা পরিষ্কার করা হয় প্রথমবারের ৪-৫ সপ্তাহ পর।
প্রতিটি জুমক্ষেতে বাঁশ দিয়ে একটি ছােট কুঁড়েঘরের মতাে জুমঘর বানানাে হয়, যাকে মারমা ভাষায় ‘বক্’ বলা হয়। এটি বিশেষত ফসল তােলার সময় কাজে লাগে। ফসল তােলার পরবর্তী কাজগুলাের জন্য অস্থায়ীভাবে সেগুলাে রাখতে এটি ব্যবহৃত হয়। যেমন : ধান মাড়াইয়ের সময়, জুম চাষি এবং অন্যান্য কাজের লােকজন (পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও মজুর), যারা ফসল তােলা ও তার পরবর্তী কাজগুলাে করে। তারা একত্রে এ সময় বক্-এ অবস্থান করে।
জুন-জুলাই মাসের দিকে প্রথম মারফা উত্তোলিত হয়। এরপর জুলাই-আগস্ট মাসে তােলা হয় ভুট্টা। ধান তােলা শুরু হয় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে। ধান তােলার আগে অবংমা (লক্ষ্মী) পূজার আয়ােজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানটি কার্বারীর দ্বারা পরিচালিত হয়।
এ অনুষ্ঠানে সমাজের কিছু অভিজাত মানুষকেও নিমন্ত্রণ করা হয়। এ সময় বিশেষ ভােজের ব্যবস্থা করা হয়। এ ধরনের ভােজ দেবার মাধ্যমে পরিবারের জন্য মঙ্গল বয়ে আসে। একটি সুসজ্জিত বাঁশের মাচায় একটা কলা পাতা বিছিয়ে তার ওপর কিছু চাউল রাখা হয়। মাচার ওপর থেকে সুতা দিয়ে বেধে একটা কাঁকড়া ঝােলানাে থাকে।
একটা শূকর বেঁধে রাখা হয় সেই স্থানে, যার মাংস ভোজ সভায় পরিবেশিত হবে। অন্য একটি মাচায় একটি পাত্রে মুরগির বাচ্চার রক্ত রাখা হয়। তার সাথে দুটি ডিম, এক বােতল মদ, বিভিন্ন প্রকারের ধান, একটি সেদ্ধা মুরগির বাচ্চা, এক বাণ্ডিল সুতা, কিছু সেদ্ধ করা বিভিন্ন শাক-সবজি, একজগ পানি, একপ্লেট ভাত, একটি সিদ্ধ করা চিংড়ি, তিনটি মরিচ ও দুটি রৌপ্য মুদ্রা রাখা হয়। এ সকল দ্রব্যাদি পানি দিয়ে ধোওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে ঐ মাচার সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করে। তারপর দুজন লােক ঐ দ্রব্যাদিসহ মাচাটি তুলে ধান ক্ষেতে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যায়। শূকরটাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্যেকে শােভাযাত্রা সহকারে ঐ দ্রব্যাদি পূর্ণ মাচাটিকে অনুসরণ করে।
এরপর একজন পুরোহিত দেবীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকে। সময় খাদ্যদ্রব্যাদি সকল উপস্থিত লােকজনকে বিতরণ করে দেয়া হয়। এরপর দুজন ব্যক্তি শূকরটিকে ক্ষেতে নিয়ে জবাই করে এবং তার মাংস রান্না করা হয়। সকলে ভাত-মাংস ও মদ খেয়ে অনুষ্ঠানটি উপভােগ করে।
ধান তােলা শুরু হয় ‘তসলাং’ (আগস্ট-সেপ্টেম্বর) মাসে। উত্তোলিত ফসল রাখা হয় জুমক্ষেতে অস্থায়ী কুঁড়েঘরে। এরপর মাড়ানাে শস্যগুলাে শুকানাে হয় এবং গৃহে নিয়ে আসা হয়। ফসল যদি ভালাে হয় তাহলে পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত ফসল রেখে দিয়ে অতিরিক্ত অংশগুলাে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
বাড়ির জন্য রাখা ধানগুলাে বাঁশের তৈরি একটি আঁধারে করে রেখে দেওয়া হয় আলাদা একটি ঘরে । ধান তােলার পর ‘ওয়াগ্যেওয়াই’ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ভুট্টা, ঢেঁড়স, শিম প্রভৃতি উত্তোলন শুরু হয়। এরপর ‘নাইত’ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) মাসে তুলা, আদা, হলুদ প্রভৃতি তােলা হয় (আহসান ১৯৯৩)।
বাজার ব্যবস্থা
বেচা-কেনামূলক বাজারব্যবস্থায় মারমাদের অংশগ্রহণ দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে গ্রামের স্থানীয় ব্যবসা ও আঞ্চলিক ব্যবসা, যাতে অন্য কোনাে বড় বাজারে পাইকারী ক্রয়-বিক্রয় যুক্ত থাকে এবং শহরের বাজারগুলােতে গৌণ ব্যবসা। কিছু কিছু মারমা গ্রামে কিছু খুচরা বিক্রির দোকান থাকে।
অধিকাংশ পাইকারি ব্যবসাগুলাে হয়ে থাকে গৃহস্থালিতে, যেখানে মারমারা তাদের পণ্য বাঙালি ক্রেতা বা দালালের কাছে বিক্রি করে থাকে। এর মধ্যে জুমে উৎপাদিত পণ্য যেমন থাকে, তেমনি সমতল ভূমিতে উৎপন্ন দ্রব্যও থাকে। বন থেকে আহরণ করা দ্রব্য, যেমন : বাশ, শন, জ্বালানি কাঠ প্রভৃতিও বাজারে বিক্রয় করা হয়।
বিক্রয়ের অন্যান্য দ্রব্য হলাে ঝুড়ি, বয়নকৃত দ্রব্যাদি ও মদ। এসব দ্রব্যাদির অধিকাংশই বেচা হয় দালান ও মহাজনের মাধ্যমে। গ্রামের অভ্যন্তরেও এগুলাে কেনাবেচা হয়ে থাকে। দালাল ও মহাজনরা হচ্ছে বাঙালি, যারা মারমাদের গ্রামে এসে থাকে তাদের বিভিন্ন জনিসপত্র পাইকারিভাবে কিনতে। কৃষিজ দ্রব্য গুদামজাত করে রেখে ধীরে ধীরে
করার রেওয়াজ মারমা সমাজে নেই, কেননা এ ধরনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তারা সেই ফসলগুলাে সংরক্ষণ করে থাকে যেগুলাে তাদের ভােগের জন্য অপরিহার্য। এ পরিস্থিতির কারণেও তারা উৎপাদিত দ্রব্যাদি ফসল তােলার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।
এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার উন্নতি সাধনের দ্বারা এবং বাজারের কর্মকান্ডে আরো দক্ষভাবে অংশ নেওয়ার উৎসাহ তৈরি করে আয় বাড়ানাের দারুণ সুযোগ রয়েছে। এইদিকে বিবেচনায়, সেই লক্ষ্যে তাদেরকে পরিচালিত করতে হবে এবং বাজারমূখী করে তুলতে হবে। বাজারের কর্মকাণ্ডে তাদেরকে আরাে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং গুদামজাতকরণ, পরিবহন প্রভৃতির ক্ষেত্রে যথার্থ পৃষ্ঠপােষকতার প্রয়োজন রয়েছে। এটি হতে পারে সমবায় ব্যবস্থা অথবা সরকারি সহযােগিতার মাধ্যমে (আহসান ১৯৯৩)।
উত্তরাধিকার আইন ও সম্পত্তির মালিকানা
১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৪২ বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়ােজন হয় না। যার কারণে মারমা সমাজে স্থাবর সম্পত্তি তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা স্বত্ত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন ছিল না বললেই চলে। এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে মারমা সমাজে তেমন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।
ইদানীং জুম চাষের জন্য নতুন নতুন জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে অবস্থানের কারণে মারমা জনগােষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনােযােগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা উদ্ভব হচ্ছে।
মারমা সমাজভুক্ত পরিবারে কারাে মৃত্যু হলে তার সত্ত্বার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্য-বাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন ও রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়।
সম্পত্তির মালিক মৃত্যুকালে যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যান সেসব উত্তরাধিকারযােগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি, যেমন : আসবাবপত্র, থালাবাটি, কাপড়-চোপড়, অলংকার, গরু, মহিষ, ছাগল ইত্যাদিও উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপােস রক্ষায় ভাগ-বণ্টন ও হস্তান্তর হয়। কিন্তু লিখিত কোনাে আইন বা বিধি বিধানমতে সেগুলাে ভাগবণ্টন করা হয় না। তাই উত্তরাধিকারযােগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বােঝানাে হয়।
মারমা সমাজে সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সত্ত্বার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে), জীবদ্দশায় সম্পাদিত উইল বা দানমূলে্য দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা হস্তান্তরিত হয়নি, এমন ভূ-সম্পত্তি দায়/দাবি মেটানাের পর যা অবশিষ্ট থাকবে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তাবে। সম্পত্তির মালিকের এ সকল দায়দাবি না মিটিয়ে স্থাবর অস্থাবর সকল উত্তরাধিকারযােগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে না ।
তিন পার্বত্য জেলার সংশিষ্ট জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/হিউপি কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চিফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণপূর্বকর ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির ৭ ধারা মতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণ উত্তরাধিকার সনদ প্রদান করবেন। বােমাঙ সার্কেলের মারমাদের বেলায় ভিন্ন ধরনের রীতি ও প্রথা অনুযায়ী উত্তরাধিকার নির্ধারণ হয়ে থাকে। সার্কেলভেদে তারতম্য অনুযায়ী মারমা সমাজে তিন ধরনের উত্তরাধিকার রীতি ও প্রথার প্রচলন রয়েছে।
ক. বােমাং সার্কেলে মারমা পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র, স্ত্রী, কন্যা সকলেই অপ্রতিরােধ্য আইনগত উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করবে। বােমাং সার্কেলে বসবাসকারী মারমা পরিবারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও কন্যাগণ মৃতের স্থাবর সম্পত্তির ১৬ আনার মধ্যে ৪ আনা এবং পুত্রগণ ১২ আনা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।
খ. মং সার্কেল ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজে স্ত্রী ও কন্যাগণ মৃত স্বামী বা পিতার স্থাবর সম্পত্তিতে কোনাে প্রকার আইনগত উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করে না। তবে স্বামী বা পিতা যদি মৃত্যুর পূর্বে দান বা উইল করে দেয় তাহলে সেটুকু সম্পত্তির উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করবে (চাকমা, রায় ও দে (২০০৭)।
মারমা সমাজে পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ বণ্টন নিম্নরূপে করা হয় :
ক. বােমাং সার্কেলে অনুসত ‘সামুহাদা বিচ্ছেদানির’র রীতি অনুসারে মারমা সমাজের পুত্র সন্তানগণ পাবে তিন-চতুর্থাংশ এবং স্ত্রী ও কন্যা সন্তান থাকলেও উপরােক্ত হারাহারি নিয়মে সম্পত্তির ভাগ বণ্টন হবে।
খ. মং সার্কেল ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমা সমাজের কন্যা সন্তানগন প্রকার পৈতৃক সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয় না। যদি পিতা তার জীবদ্দশায় কন্যা সন্তানকে দান বা উইলনামা মূলে কোনাে স্থাবর সম্পত্তি প্রধান করে কেবল মাত্র সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তান পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। একত্রে স্বাভাবিক আইনগত উত্তরাধিকারীদের সকল প্রকার আপত্তি অগ্রাহ্য হবে। তবে পুত্রের অবর্তমানে স্ত্রী ও কন্যা সন্তানেরা ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।
গ. মৃত পিতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠ কন্যা পাবে।
ঘ. বােমাঙ, মং ও চাকমা সার্কেলে বসবাসরত মারমারা সমাজের প্রচলিত রীতি অনুসারে মাতার স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্র ও কন্যা সন হারাহারিভাবে পাবে (চাকমা, রায় ও দে ২০০৭)।
বাসস্থানের ধরন
যে কোনাে সমাজে বাসস্থান মৌলিক চাহিদার একটি। সাধারণত মারমাদের সনাতনী গৃহায়নের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রপঞ্চ রয়েছে। তারা বাঁশের তৈরি একটি ঘরে থাকে । ঘরের সাথে একটি মুক্ত মাচা যুক্ত থাকে যা স্থানীয়ভাবে মাচাং নামে পরিচিত। গৃহটি কয়েকটি খুঁটির উপর মাটি থেকে ৬-৭ ফুট উপরে নির্মিত হয়।
এই গৃহ তৈরিতে বন থেকে সংগৃহীত বাঁশ, কাঠ এবং শন ব্যবহৃত হয়। উঁচুতে বাড়ি বানানাের কারণ হলাে বন্য প্রাণী ও বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি থেকে বাড়িটাকে মুক্ত রাখা। বাড়িটা বিন্যস্ত হয় পরস্পর সংযুক্ত কাঠের সারির মধ্যে। প্রতিটি বাড়িতে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন : মাচাং, রুমের বিন্যাস প্রভৃতি। স্বাভাবিকভাবে একটি খাঁজ কাটা বাঁশ বা গাছ ব্যবহৃত হয় ভূমি থেকে মাচাং-এ উঠার জন্য।
প্রতিটি বাড়িতে থাকে সাজরুম, একটি শয়ন ঘর, একটি বৈঠক ঘর, যা অতিথি কক্ষ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়, একটি রান্নাঘর ও একটি গুদাম ঘর। মাচাংটি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন কাজে। যেমন : ফসল ও কাপড় শুকানাে প্রভৃতি। এ ধরনের মাচাং-এ ধান, সরিষা, মরিচ, তামাক প্রভৃতি শুকানাে হয় !
মাচাংয়ের এককোণে একটা হাসমুরগির খোয়াড় রাখা হয়। মাচাংয়ের নিচের স্থান ব্যবহৃত হয় জ্বালানি কাঠ, শূকর, কাপড় বােনার তাঁত রাখার কাজে। বাড়িটি বানানাের কাজ করে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। পরিবারের নারীরা পুরুষদেরকে বাঁশের ফালি বানাতে সহায়তা করে, যা বাড়ি তৈরির বিভিন্ন অংশকে বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয় (আহসান ১৯৯৩)। মারমাদের গৃহায়নে এই সনাতনী ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শহরাঞ্চলে এ গ্রামাঞ্চলে অবস্থাপন্ন মারমারা আধুনিক নকশার ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ।
ভূমি মালিকানা ও প্রথাগত ভূমি অধিকার
ঐতিহ্যগতভাবে মারমারা (পাহাড়িরা) বিশ্বাস করে যে, গ্রামীণ সমাজে জাতিগোষ্ঠী এবং কোনাে কোনাে সময় এমনকি কোনাে অশরীরী আত্মা হচ্ছে ভূমির চুড়ান্ত মালিক। ব্যক্তি স্বত্বাধিকারীগণ শুধু এটি ভােগ করার অধিকারটা রাখে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক ভূমির ওপর মালিকানা স্বত্ব লাভের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির ওপর সরকারের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত কর্তৃত্ব এনে দেয়।
ভূমির ওপর এই মালিকানা ভূমি মালিকানার ঐতিহ্যগত বিশ্বাসকে বড় ধরনের আঘাত করেছে। আইনটি সমাজের কাছ থেকে ভূমির মালিকানা স্বত্বটি কেড়ে নেয় এবং এটিকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে যাতে মারমাদের (পাহাড়ি) কোনাে অংশগ্রহণ বা প্রতিনিধিত্ব নেই।
ঔপনিবেশিক শক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির ব্যবহার থেকে লাভবান হতে পারে। এ কারণে উদ্যান, শিল্পায়ন এসবের কাজে ভূমির ব্যবহারের উপর কোনাে বিধি নিষেধ আরােপ করেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামকে এ ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য উন্মুক্তকরণ ভূমির ওপর মারমাদের (পাহাড়ি) নিয়ন্ত্রণ হারানাের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
পাহাড়িদের অর্থনৈতিক জীবনের ওপর ব্রিটিশ সরকারের প্রথম সরাসরি আঘাত হালচাষের প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে, যা বিদ্যমান জুম কেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। জুম চাষ ও ফসল তােলার সামগ্রিক প্রক্রিয়াটা নির্ভর করতাে সামাজিক মালিকানা, বিনিময় বণ্টনের ধারণার উপর।
মারমাসহ পাহাড়িদের জন্য জুম চাষ ছিল জীবনযাপনের একটি পথ, যা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবােধকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। লাঙ্গল চাষ তাদেরকে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যা তারা দীর্ঘসময় ধরে শুধু চর্চাই করেনি, উপরন্তু একে কেন্দ্র করে তারা তাদের সমগ্র সমাজের সামাজিক সাংস্কৃতিক বিন্যাস নির্মাণ করেছে। লাঙ্গল চাষ বাজারের জন্য অভাবকে আবশ্যক করে তােলে, যখন এটি উদ্বৃত্ত তৈরি করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি মালিকানার ধরন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত, যা পুরাে অঞ্চলজুড়ে অপরিহার্যভাবে সমান নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে মারমাদের ভূমি মালিকানার ধরনও সাধারণত তিন প্রকারের; যথা : ১. রেকর্ডীয় ভূমি, ২. ভােগদখলীয় ভূমি ও ৩. সমষ্টিগত মালিকানাধীন ভূমি।
১. মারমাদের মধ্যে যারা সাধারণত অভিজাত শ্ৰেণীসহ শিক্ষিত ও সচেতন তাদের মধ্যে রেকর্ডীয় ভূমির মালিকানা রয়েছে। তারা সরকারি অফিসে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে ভূমি বৈধ কাগজপত্রাদি সগ্রহ করে। তবে এ ধরনের ভূমির পরিমাণ অত্যন্ত কম বলা যায়। মারমাদের মধ্যে সংখ্যালঘু একটা ক্ষুদ্র অংশ এ ধরনের ভূমি মালিকানার অধিকারী।
২. মারমাদের মধ্যে একটা বড় অংশ—বিশেষত যারা শহর থেকে দূরে থাকে। তাদের ভােগদখলীয় ভূমির মালিকানা রয়েছে। হেডম্যানের অনুমতি নিয়েই তারা বংশ পরম্পরায় এসব ভূমি ভােগদখল করে আসছে। তাদের ভূমি সরকারি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত নয়। তাদের কাছে ভূমির কোনাে কাগজপত্র নেই। মারমাসহ আদিবাসী পাহাড়ি সমাজে এ নিয়ে কোনাে সমস্যা তৈরি হয়নি। এ কারণে তারা স্মরণাতীত কাল থেকে ভূমি ব্যবহার করছে কোনাে দলিল ছাড়া এবং কোনাে বিরােধ ব্যতীত। এ ধরনের ভূমি মালিকানা মারমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
৩. মারমাদের মধ্যে আরাে রয়েছে সমষ্টিগত বা সামাজিক মালিকানাধীন ভূমি। সাধারণত মৌজার হেডম্যানের তত্ত্বাবধানে ঐতিহ্যগত প্রথায় এসব ভূমি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সামাজিক মালিকানাধীন ভূমিতে সাধারণত জুম চাষ, গােচারণ, গৃহস্থালি কাজে বনজ সম্পদ আহরণ ইত্যাদি অধিকার থাকে স্থানীয় মৌজাবাসীর বা গ্রামবাসীর। সামাজিক মালিকানাধীন ভূমিতে জুম চাষের পর পাহাড়িদের অভ্যন্তরে একজন চাষি তার সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেখানে গাছ বা ফলজ গাছ লাগিয়ে এবং কয়েকবছর তা যত্ন নেয়ার মাধ্যমে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এ ধরনের ভূমির সরকারি বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রে চাষিটিই প্রথমে বৈধ মালিকানা স্বত্ব পাবে।
মারমা পরিবারগুলাের অধিকৃত ভূমিগুলােকে ছয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়; যথা : ১. বাস্তুভিটা, যা তাদের ঘরের আশপাশের জায়গাজুড়ে রয়েছে; ২. আবাদযােগ্য জমি, যাতে জুম চাষ বা লাঙ্গল চাষ করা হয়; ৩. উদ্যান, যা তাদের বাস্তুভিটার সীমানার বাইরে এবং এতে গাছ ও ফলজ গাছ লাগানাে হয়; ৪. পতিত জমি, যাতে কোনাে চাষাবাদ বা গাছ লাগানাে হয় না; ৫. পুকুর; ও ৬. অন্যান্য (মল্লিক ২০০১)।
মারমা জাতির ধর্মীয় অবস্থা
প্রধান ধর্ম ও অতিপ্রাকৃত জগত
মারমারা সাধারণত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী (থেরবাদী), তবে সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে একই সাথে তারা সর্বপ্রাণবাদেও বিশ্বাস করে। বিভিন্ন প্রকার দেব-দেবীর পূজাও এ সমাজে প্রচলিত। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপদের ক্ষেত্রেও অশুভ প্রেতাত্মার প্রভাব রয়েছে বলে তারা মনে করে।
এ কারণে প্রকৃতি পূজার সংস্কৃতিও সাধারণ একটি বিষয়। তাদের বিশ্বাস-প্রাকৃতিক বিপদ-আপদ এবং দুর্ভাগ্য প্রভৃতি হচ্ছে বিভিন্ন দেব-দেবীর অসন্তোষের ফলাফল এবং পূজার মাধ্যমে এই দেব-দেবী ও অশুভ প্রেতাত্মার সন্তুষ্টি বিধান করার চেষ্টা করে। মারমাদের প্রকৃতি পূজার মধ্যে পাহাড়, নদী, অরণ্য, বৃক্ষ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (আহসান ২০০১)।
এ কারণে মারমা সমাজের ধর্ম, আচার ও বিশ্বাসের আলােচনায় শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলােই ওঠে আসে না, এর সাথে দেব-দেবী, প্রকৃতি ও অশুভ প্রেতাত্মার বিভিন্ন পূজা-অর্চনার বিবরণও ওঠে আসে। (আহসান ২০০১)। মারমা সমাজে কিছু অল্প সংখ্যক খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীও লক্ষ করা যায়, তবে এই সংখ্যা খুবই কম (রাফি ২০০১)।
ধর্মীয় উৎসব
কছুংলাব্রে বৈশাখী পূর্ণিমা) : এই ধর্মীয় উৎসবটি উদযাপন করা হয় বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা দিনে। এটি বৌদ্ধদের জন্য অতি পবিত্র অনুষ্ঠান। কারণ এই দিনে গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এ দিন খুব ভােরে বিছানা থেকে উঠে লােকজন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। সকালবেলা পরিবারের পূর্ণবয়স্ক লােকেরা চন্দনের জল নিয়ে দল বেঁধে মন্দিরে যায়। মন্দিরের সম্মুখস্থ একটি বিশেষ বটবৃক্ষের গােড়ায় একজনের পর একজন এই চন্দনের পানি ঢেলে দেয়।
এই বৃক্ষকে বলা হয় ‘বােধিবৃক্ষ। এই আচারটি পালন করা হয় এ কারণে যে, এই বােধিবৃক্ষের নিচে বসে গৌতমবৃদ্ধ তার বাণী প্রচার করেছিলেন। এই বৃক্ষটিকে মারমারা খুব শ্রদ্ধা করে। বৃক্ষের গােড়ায় চন্দনের জল ঢালার পর মন্দিরে একটি বিশেষ প্রার্থনায় সকলে সমবেত হয়। এ সময় তারা পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করে। শীল গ্রহণের অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয় বৌদ্ধভিক্ষুর মাধ্যমে। এ সময় ভিক্ষু উপস্থিত লােকজনকে ধর্মদেশনা করেন। এ দিনে মারমারা মন্দিরে ভিক্ষুদের জন্য ছােয়াইং (বিশেষ খাবার) দিয়ে থাকে।
ওয়াছো (আষাঢ়ী পূর্ণিমা) : এটি উদযাপিত হয় আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা দিবসে। এ অনুষ্ঠানটি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বয়ােজ্যেষ্ঠদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বয়ােজ্যেষ্ঠগণ তিন মাসের জন্য বর্ষাবাস পালনের কাজ শুরু করেন, যাকে ওয়াছাে বলা হয়। বর্ষাবাসের সময় বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বয়ােজ্যেষ্ঠরা কিছু বিশেষ আচার অনুষ্ঠান পালন করেন।
ভিক্ষুরা মন্দিরে থাকেন এবং এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে যান না। উপাসকরা নিয়মিত ধ্যান, পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণসহ সকল প্রকার বমীয় আচারাদি পালন করে থাকেন এ সময়ের মধ্যে। এই ওয়া বা বর্ষাবাস শেষ হয় আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা রাতে।
ওয়াগ্যোওয়াই (আশ্বিনী পূর্ণিমা) : ওয়াগ্যোওয়াই আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা দিনে।উদযাপিত হয়। এই দিনে বৌদ্ধ মন্দির পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। সমাজের লোককজন খাবার বানিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, মন্দিরের বৌদ্ধভিক্ষু বয়োজ্যেষ্ঠগণ, যারা ওয়া বা বর্ষাবাস পালন করেছেন, তাদেরকে বিতরণ করা হয়।
এই দিনে ওয়া বা বর্ষাবাস সমাপ্ত হয়। এই দিনে মন্দিরে দুপুরের আগেই ছােয়াইং (ভিক্ষুদের খাবার) দান করা হয়। এই দিনে সমাজের লােকজন সকাল ও বিকেলে মিন্দরে গিয়ে প্রার্থনা করে এবং বুদ্ধমূর্তির সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করে।
কঠিং বােওয়ে (কঠিন চীবর দান) : কঠিংবােওয়ে বা কঠিন চীবর দান ওয়াগ্যোওয়াই বা প্রবারণা উৎসবের এক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের মূল আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে ভিক্ষুদেরকে একটি বিশেষ কাপড় দান করা, যাকে কঠিন চীবর দান বলা হয়। এই উৎসবটি অনুষ্ঠানের পরের দিন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি বুদ্ধমূর্তি নিয়ে শােভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। ভিক্ষুদের সম্মান দেখানাের জন্য গ্রামের লােকজন যাত্রাপথে ছাউনি বানিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করে এবং ছােয়াইং ও বিভিন্ন দ্রব্যাদি দান করে (আহসান ২০০১)।
মারমা জাতির সামাজিক উৎসব
রাজপুণ্যাহ
মারমা সমাজে যারা জুম চাষ করে তারা প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বােমা রাজার মাধ্যমে সরকারকে খাজনা দিয়ে থাকে। জুমের খাজনা দেবার সময় একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। একে রাজপুণ্যাহ বা মারমা ভাষায় ‘পইজ্রা’ বলা হয়। প্রতি বছর জুমের ফসল তােলার পর এটি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কয়েক দিনব্যাপী অনুষ্ঠানটি সাধারণত রাজবাড়ির দরবার হলের সামনে হয়।
এটি প্রতি বছর ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে জুমের ফসল তােলার মৌসুমে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ নির্ধারণের পর প্রতিটি মৌজার হেডম্যান, গ্রামের কার্বারী ও অভিজাত ব্যক্তিদের কাছে নােটিশ দেওয়া হয়। মারমা ভাষায় লেখা একটি বিশেষ চিঠি বােমাঙ রাজার দপ্তর থেকে হেডম্যানদের কাছে পাঠানাে হয়। এতে রাজপুণ্যাহ অনুষ্ঠানে এসে ‘অইং’ বা উপহারসহ জুমের খাজনাগুলাে পরিশােধ করে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানাে হয়। এর আগে প্রতিটি হেডম্যানকে তৌজি বা জুমচাষি পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করে রাখতে বলা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে রাজা পঞ্চশীল গ্রহণ করে পূত-পবিত্র থাকেন। দুপুরের সময় রাজা ঐতিহ্যবাহী পােশাক পরে আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে বয়ােজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন। এরপর শােভাযাত্রা সহকারে দরবার হলের দিকে যাত্রা করেন। এ সময় রাজার ঐতিহ্যবাহী যন্ত্রীদল বাদ্যযন্ত্র বাজাতে থাকে। এসব বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে—খরা (এক প্রকার শিঙ্গা), মঙঃ (পিতলের তৈরি এক
প্রকার দুন্দুভী), প্যাহ্ (এ প্রকার ঢােল), হ্নেঃ (এক প্রকার বাঁশি), চে (কাঠ ও চামড়ার তৈরি এক প্রকার দুন্দুভি) প্রভৃতি। এ সময় রাজার নিজস্ব সৈনিকেরা তাকে অভিবাদন জানায়। এদেরকে বলা হয় দ্গই। রাজার দরবারে আগমনের সময় একজন ব্যক্তি একটি সােনালি ছাতা রাজার মাথার ওপর ধরে রাখে।
একটি,সুসজ্জিত আসনে রাজার উপবেশনের পর সকল হেডম্যান, কার্বারী, সম্রান্ত ব্যক্তি এ সমবেত বিভিন্ন গ্রামের লােকজন রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে তার পাশে উপবেশন করে। এরপর তালিকা থেকে একজন ঘােষকের ঘােষণা অনুযায়ী। হেডম্যানগণ একে একে প্রতি জুমের জন্য ৬.৭৫ টাকা করে খাজনার টাকা জমা দিয়ে থাকে। এই খাজনার টাকা থেকে বােমাঙ রাজা ২.৫০ টাকা, হেডম্যান ২.২৫ টাকা ও সরকার ২.০০ টাকা পেয়ে থাকে।
এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি বড় ধরনের মেলা বসে। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। পরদিন রাজা আমন্ত্রিত অতিথিদের সম্মানার্থে একটি ভােজসভার আয়ােজন করে থাকেন। এই ভােজসভার ব্যয়ভার বহনে হেডম্যানকার্বারীদেরও অংশীদারিত্ব থাকে সাধ্য অনুসারে। রাজার সভাপতিত্বে একটি আলােচনা সভারও আয়ােজন করা হয়, যেখানে বিভিন্ন সমস্যা ও ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে আলােচনা করা হয়। উল্লেখ্য যে অবিবাহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বিধবা, বিপত্নীক, শিকারি ও বৈদ্য জুমের খাজনা প্রদান থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে (আহসান ১৯৯৩)।
সাংগ্রাই
মারমা সমাজের সামাজিক ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে অন্যতম একটি প্রধান উৎসব হলাে সাংগ্রাইং (বর্ষবরণ ও বর্ষবিদায়)। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। সাংগ্রাইং-এর প্রথম দিনে কিছু নির্দিষ্ট কর্মসূচি পালন করা হয়। যেমন : ক. তরুণ-তরুণীরা সবাই মিলে বৌদ্ধ মন্দির পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তােলে।
এই কাজটিকে একটি পবিত্র কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; খ. সমাজের সবাই মিলে বৌদ্ধ মন্দিরে যায় এবং পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করে থাকে; গ. বৌদ্ধভিক্ষুর কাছ থেকে ধর্মীয় দেশনা শুনে থাকে; ঘ. বুদ্ধমূর্তিকে নতুন চীবর দান করে থাকে; ঙ. মন্দিরে টাকা-পয়সা দান করে ও প্রদীপ জ্বালায়; চ. বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরকে ছােয়াইং (খাবার) দান করে।
এই দিনে মন্দিরের বুদ্ধমূর্তিগুলাে নদীর তীরে শােভাযাত্রা সহকারে নিয়ে গিয়ে স্নান করানো হয়। শােভাযাত্রায় বৌদ্ধভিক্ষু, স্থানীয় সম্ভান্ত ব্যক্তিগণ ও সাধারণ লােকজন ‘গ্রহণ ক্রান। বুদ্ধমূর্তিটিকে নিয়ে যাওয়ার সময় বাদ্যযন্ত্র বাজানাে হয়। লােকজন সাথে করে চন্দনের জল ও ডাবের পানি সাথে করে নিয়ে যায় ।
বুদ্ধমূর্তিগুলােকে বাঁশের তৈরি সুসজ্জিত একটি মঞ্চে রাখা হয়। এরপর ভক্তরা চন্দন ও ডাবের পানি বুদ্ধমূর্তিগুলাের উপর ঢেলে দেয়। এই ঢেলে দেওয়া পানিগুলাে লােকজন সংরক্ষণ করে রাখে। এই পানি খেলে রােগ-ব্যাধির নিরাময় ঘটে বলে তাদের বিশ্বাস।
সাংগ্রাইং উৎসবে মৈত্রী পানি বর্ষণ
স্নানের পর বুদ্ধমূর্তিগুলােকে ইতােপূর্বে দায়কদের দানকৃত নতুন চীবর পরানাে হয়। একইভাবে আবার বুদ্ধমূর্তিগুলাে মন্দিরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর বিকেলে মন্দিরে গিয়ে শীল প্রার্থনা করে ধর্মোপদেশ শুনে থাকে এবং প্রদীপ জ্বালানাে হয়। পরবর্তী দুটি দিনে আরাে কিছু কর্মসূচি পালিত হয়। যেমন : ১. বিশেষ খাদ্যদ্রব্য ও বিভিন্ন প্রকার পিঠা তৈরি; ২. বৌদ্ধভিক্ষুদের জন্য ছােয়াইং দান এবং বয়ােজ্যেষ্ঠ ও প্রতিবেশীদের জন্য বিশেষ খাবার প্রেরণ; ৩. বয়ােজ্যেষ্ঠদের পূজা; ৪. মৈত্রী পানি বর্ষণ; এবং ৫. মন্দিরে প্রার্থনা করা হয়।
মৈত্রী পানি বর্ষণ সাংগ্রাইং উৎসবের একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে বড় একটা মাঠে একটি মণ্ডপ বানানাে হয়। মণ্ডপের দুই দিকে দুটি বড় পানি ভর্তি নৌকা রাখা হয়। একটি নৌকার পাশে তরুণদের একটি দল অবস্থান নেয়। যখন খেলা শুরু হয় তখন উভয় দল তাদের প্রতিপক্ষ দলের দিকে নৌকায় রাখা পানি ছুড়তে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না ফুরিয়ে যায়। নৌকার পানি ফুরিয়ে গেলে তা আবার পানি দিয়ে ভরানাে হয়। একটা ব্যাচ শেষ হলে আরেকটা নতুন ব্যাচ এসে খেলা শুরু করে। মূলত মারমা সমাজ আশা করে পূর্ববর্তী বছরের সমস্ত যন্ত্রণা, দুঃখ, দুর্ভাগ্য এবং মালিন্য এই পানিতে ধুয়ে মুছে যাবে এবং অনাবিল একটি নতুন বছর শুরু হবে (আহসান ১৯৯৩)।
মারমা জাতির ভাষা, লােক-সংস্কৃতি ও সাহিত্য
ভাষা ও বর্ণমালা
মারমা জনগােষ্ঠীর ভাষা টিবের্টো বৰ্মান (ভােট-বৰ্মী) শাখার বর্মী দলভুক্ত। এর নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। কোনাে কোনাে ভাষাতাত্ত্বিকের মতে, মারমা বর্ণমালার উৎপত্তি ঘটেছে মােন-খমের লিপি থেকে। আবার কারাে মতে, বর্মী বর্ণমালার মতােই মারমা বর্ণমালার উৎপত্তি ঘটেছে ব্রাহ্মী লিপি থেকে (রাফি ২০০১)। বর্তমানে মারমা লিপিতে বর্ণসংখ্যা মােট ৪৫টি। তার মধ্যে ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১২টি স্বরবর্ণ রয়েছে।
ভাষা গবেষক উঅংসাউ (মায়ানমার, য়াংগুন) এর গবেষণালব্ধ তথ্যসূত্রে জানা যায় যে, প্রাচীন ভারতবর্ষের সম্রাট অশােকের শিলালিপিতে ব্যবহৃত উওরাঞ্চলীয় ব্রামী হরফ (যা খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ হতে খ্রিস্টপূর্ব ৩২ অব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল ) কালক্রমে ৬ বার আকার বা রূপ পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে প্রচলিত বর্ণের রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (U aung tha u 1995) । বাংলাদেশে বর্তমানে মারমা ভাষা ও মারমা বর্ণমালা বিপদাপন্ন অবস্থায় রয়েছে।
অতীতে মারমা ছেলেমেয়েরা সীমিত পর্যায়ে মায়ানমার থেকে আনীত ‘ম্রাইমা সাঙবুঙগ্রী’, ‘মাইমা ফাইত্চাসইত্’ ইত্যাদি পাঠ্যপুস্তকের সাহায্যে বৌদ্ধ মন্দিরে বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করতাে। বহুকাল আগে থেকেই মারমারা তাদের বর্ণমালা রাজকার্য ও ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থাদি লেখার কাজে ব্যবহার করে আসছে। মারমা সমাজে ‘সমুহাদা উইচ্ছেদানি’ ‘মনুগ্যি ধম্মাসাত্’ প্রভৃতি পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
মারমা সমাজের নিজস্ব বর্ণমালার ব্যবহার বেশ প্রাচীন। অনেক ক্ষেত্রে দেব-দেবীর পূজার শ্লোক, মন্ত্র-তন্ত্র, তাবিজ লিখন প্রভৃতি এই বর্ণমালার সাহায্যে করা হয় । মাত্র কয়েক দশক আগেও পার্বত্য অঞ্চলের অফিস আদালতে, বােমাঙ রাজদরবারে ও কাচারিতে মারমা ভাষা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বান্দরবান জেলায় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর উদ্যোগে প্রতি বছর ২ মাস মেয়াদি কোর্সের মাধ্যমে মারমা ভাষায় লিখতে পড়তে শেখানাে হচ্ছে। এছাড়া স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মারমা শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষার উপর দক্ষতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে মারমা ভাষায় সাহিত্য প্রতিযােগিতার আয়ােজন করা হয় (উচনু ২০০৮)।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আওতায় পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলােতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মাতৃভাষায়
প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে (মােহসীন ২০০২)। কিন্তু এখনাে সরকারি উদ্যোগে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়নি।
মারমা সঙ্গীত ও গীতি নাট্য
মারমা সমাজে সঙ্গীত ও গীতি নাট্যের ধারা বেশ প্রাচীন। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধারায় মারমা সঙ্গীত ও গীতি নাট্যের উদ্ভব হয়েছে এবং সেগুলো বংশ পরম্পরায় মারমাদের সাংস্কৃতিক গতিধারায় প্রবাহিত হয়ে আজ পর্যন্ত দেদীপ্যমান রয়েছে। মারমা সঙ্গীত ও গীতিনাট্যের প্রধান প্রধান ধারাকে নিম্নোক্তভাবে সাজানাে যায় —
ক. কাপ্যা : এটি এক ধরনের লােকসঙ্গীত ও কাহিনী কাব্য। কোনাে মহাপুরুষের জীবনের প্রতিচ্ছবিও এতে উঠে আসতে পারে। যেমন : ‘পাইংদাইং মাঙঃসাঃ’, ‘সাইংদোয়েঃসু’ প্রভৃতি কাপ্যা! মারমা সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কাজ করার সময় বা অবসরে কিংবা শিশুকে ঘুম পাড়াবার সময় এ কাপ্যা গাওয়া হয়ে থাকে। প্রতিযােগিতামূলকভাবেও কাপ্যা গাওয়া হয়। যুবক-যুবতীরা পরস্পরের সৌন্দর্য বর্ণনা করে কিংবা প্রশংসা করেও কাপ্যা গেয়ে থাকে।
খ. চাগায়াঙ : এটি একপ্রকার লােকগীতিধর্মী গান। জুমে বা জমিতে কাজ করার সময় এ গান জুমিয়া কৃষকেরা উচ্চ কণ্ঠে গেয়ে থাকেন। মারমা সমাজের প্রায় সকল স্তরে এ লােকগীতির জনপ্রিয়তা রয়েছে। মনের আনন্দ কিংবা ফুর্তির জন্য এবং অপরকে আনন্দ দেওয়ার জন্য এ ‘চাগায়াঙ’ গাওয়া হয়।
গ. সাখ্রাঙঃ : এটি কাহিনীভিত্তিক লােকসঙ্গীত, যা মারমা প্রধান গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যাবেলায় বা রাতের বেলায় গাইতে দেখা যায়। এ সাখ্রাংঃ বিশেষ ধরনের এতিহ্যবাহী সঙ্গীত। এটি মূলত গৌতম বুদ্ধের জীবনচরিত্র ও বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির বিভিন্ন পর্বকে নিয়ে রচিত লােকসঙ্গীত। যেমন : ‘সইতাথানু সাখ্রাংঃ’, ককানু সাখ্রাংঃ’ প্রভৃতি। বৌদ্ধ জাতক অনুসারে গৌতম বুদ্ধ আগের জন্মগুলােতে মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এভাবে বােধিসত্বদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবন কাহিনী নিয়ে এ ধরনের লােকসঙ্গীতগুলাে রচিত হয়েছে।
ঘ. রদুহ্ : ছন্দময় সুকোমল সুর বিন্যাসে এ জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় এবং সুখময় জীবন গঠনের শিক্ষা এ লােকসঙ্গীতে রয়েছে। এখানে প্রধানত অতীতের মহাপুরুষ, লােকনেতা, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক গুরু, সুশীল চরিত্রের সমাজ নেতাদের গুণগান থাকে এবং তাদের জীবনধারা থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর ও সচ্চরিত্রের জীবন গড়ার ইঙ্গিত থাকে।
কোনাে কোনাে রদুহ্ হচ্ছে নিঃসঙ্গ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের গান। এই রদুহ্’র সুর যদিও দুঃখমূলক তবুও এর সুরে ছন্দের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এটি চিত্তাকর্ষক। কাহিনী ভিত্তিক রদুহ’র মধ্যে রয়েছে উদিনা রদুত্ (উদয়ন), ধাইমাউইজয়া রদুহ্ (ধর্ম বিজয়) প্রভৃতি। অবশ্য কাহিনীভিত্তিক নয় এমন ‘রদুহ্’ও রয়েছে।
ঙ. লাঙ্গা : মারমা লােক সঙ্গীতের ধারায় এটি অনেকটা নিঃসৃর্গ প্রশস্তিমূলক গীতি কবিতা। মনের অগােচরে যুবক-যুবতী, বুড়াে-বুড়ি, সবাই এ গান গায়। কোনাে এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৌন্দর্যকে বর্ণনা করে বা কোনাে এক মহাপুরুষের জীবনকাহিনী বিবরণ দিয়ে এ লাঙ্গা রচনা করা হয়।
চ. সাইঙগ্যাইত্ : সাইঙগ্যাইত্ একপ্রকার দলীয় সঙ্গীত ! বিভিন্ন উৎসব পার্বণে দলগতভাবে এটি পরিবেশন করা হয়। বাংলা জারি গানের মতাে প্রথমে একজন গাওয়ার পর অন্যরাও তার সাথে তাল মিলিয়ে গাওয়া হয় দল বেঁধে। এ গান অনেকটা তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করা হয় । ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাইং (চৈত্রসংক্রান্তি) এর মৈত্রী পানি বর্ষণের সময় মারমা তরুণ-তরুণীরা খেলাচ্ছলে পরস্পরের প্রতি প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করে এ সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে।
ছ. লুঙঃদি : এটি একটি দলীয় সঙ্গীত প্রতিযােগিতামূলক কোনাে অনুষ্ঠানে বিজয়ী দল লুঙঃদি’ গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে এবং দলগতভাবে গ্রামের প্রতিটি ঘরে গিয়ে ‘লুঙঃদি’ সঙ্গীত গেয়ে পুরস্কারস্বরূপ নজরানা আদায় করে। লুঙঃদি সঙ্গীতের একটি বিশেষ সুর আছে।
জ. সাইঙবক্ : এটি মূলত ধর্মীয় সঙ্গীত। সাধারণত মন্দিরে শীল প্রার্থনার সময় কোমল ও ছন্দময় সুরে উপস্থাপিত হয় বন্দনামূলক এ লােকসঙ্গীত ।
ঝ. আফোওয়েহ্ : ক্ষমতাশালী ও অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতি প্রজাসাধারণ বা অধস্তনগণ কর্তৃক তুষ্টি সাধনের জন্য রচিত গান বিশেষ।‘এঃ’ নামক একপ্রকার বেহালা জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের সংযােগে এ লােকসঙ্গীত গাওয়া হয়। অতীতে রাজারা আনন্দে সময় কাটাবার জন্য ‘আফোওয়েহ্ শিল্পীদের ডেকে এ গানের আসর বসাতেন। পরবর্তীকালে তা সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ে।
ঞ. ন্বইলা : মারমা সমাজে কোনাে ব্যক্তির মৃত্যু হলে মৃতের বাড়িতে মৃতদেহ দাহ না করা পর্যন্ত পাহারা দেওয়ার জন্য কোনাে রকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই ‘ন্বাইলাঃ’ সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ লাভের বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট কোমল সুর ও ছন্দে এ সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। এর গ্রন্থগুলি বৌদ্ধ মন্দিরে সংরক্ষিত রাখা হয়। প্রয়ােজনের সময় মৃতের বাড়িতে এনে পাঠ করা হয় ।
ট. খইসই তেঃখ্রাং : ‘খইসইতেঃখাঙ’ হচ্ছে আধুনিক গানের প্রতিশব্দ। ঐতিহ্যবাহী লােকগীতি ছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক গান মারমা সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এ সমস্ত গানে তবলা, বেহালা, বাঁশি, হারমােনিয়াম, গিটার, ম্যান্ডােলিন প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
ঠ. পাংঃখুঙ : ‘পাংঃখুঙ’ হচ্ছে কাহিনীভিত্তিক গীতিনাট্য। এ ‘পাংঃখুঙ’-এর একটি নির্দিষ্ট সুর ও ছন্দ রয়েছে। আনুমানিক একশত বছর পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা সমাজে এ গীতি নাট্যের উদ্ভব হয়। প্রথমদিকে শিল্পী একাই ‘পাওঃখুঙ’-এর গান গেয়ে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করতাে।
কালক্রমে দলীয় রূপ লাভ করে। ২০ থেকে ৫০ জন লােক নিয়ে ‘পাঙঃখুঙ’ দল গঠিত হয়। বিভিন্ন উৎসবে অর্থের বিনিময়ে এ ‘পাংখুঙ’ দলসমূহ গীতিনাট্য পরিবেশন করে থাকে। বিভিন্ন পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার অবলম্বনে এই গীতি নাট্যগুলাে পরিবেশিত হয়। (সাচপ্রু ২০০৩, উচনু ২০০৭)।
ভূর্জপত্র ও কাগজে লেখা বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি অনুসন্ধানপূর্বক বিভিন্ন পাঙঃখুং গীতিনাট্যের নাম হদিস পাওয়া যায়। এ নাট্যগ্রন্থগুলি মারমা হস্তাক্ষরে ও মারমা বর্ণমালায় রচিত। সেগুলাে হলাে—-
১. বায়াগুমা, ২. বদ্র, ৩. সাংজোয়ে, ৪. দাম্মাজেয়া (ধর্মজয়), ৫. মাগালুলাং, ৬. গােঃসালানা, ৭. উদিনা(উদয়ন), ৮. ম-হ, ৯. রামা (রাম), ১০. থাম্রা, ১১. সিলাবাহুং, ১২. উইঃজেয়া (বিজয়), ১৩. মনহরী (মনােহারি), ১৪. শােওয়ে ফঙদ, ১৫. ফলুমাং, ১৬. মেচাইন্দা, ১৭. সাইটাথানু, ১৮. কঃকানু, ১৯, লঙমেয়া, ২০. মাংঃসাঃ, ২১. ওয়াইচাকুমারা, ২২. ম-ন, ২৩. চোঃমালাপ্রম্ন, ২৪. লঙঃচাইন্দা, ২৫. টেমী, ২৬. জানাক্কা (জনক), ২৭. সুওয়েনাসামা (সুবর্ণ শ্যাম), ২৮. নেমি, ২৯. পুরীদ্দা নাঘাঃ, ৩০, চাইন্দাকুমারা (চন্দ্র কুমার), ৩১. নারাদা (নারদ), ৩২. উইধুরা(বিধুর), ৩৩. ওয়েসাইন্দ্রা (বেস্সন্তর), ৩৪. ওয়ংগ্রইং প্রভৃতি।
বিশিষ্ট লেখক ক্যশৈপ্রু খােকার মতে, শত বছর পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়া। এলাকায় শিয়ালবুক্কা (Sial bookka) পাড়ায় সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন মননশীল ও সাহিত্যরসিক একজন মারমা বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষ ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম মারমা ভাষা ও বর্ণমালার মাধ্যমে পাঙঃখুও রচনা করেন এবং সুরারােপ করেন।
তিনি বৌদ্ধ পুরােহিত হওয়ায় ঐ পাড়ার জনৈক মারমা শিল্পীর মাধ্যমে একক গীতিনাট্য পালা প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে ঐ একক পালাগানকে, বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়ে পুর্ণাঙ্গ পাঙঃখু গীতিনাট্য পালায় উন্নীত করা হয় মারমা জনগােষ্ঠীর মধ্যে গীতি-নৃত্য-নাট্য শিল্পের এই পাঙঃখুঙ-এর জনপ্রিয়তার কারণে তা মারমা সমাজের সামাজিকগতভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং অদ্যাবধি দৃশ্যমান ।
ড. জাইত্ : এটি এক প্রকার গীতিনাট্য। এটি একটি নির্দিষ্ট সুর ও ছন্দে পরিবেশিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলায় একে ‘ওয়াকশান’ বলা হয়। ২০ থেকে ৪০ জন নিয়ে ‘জাইত্’ দল গঠিত হয় । এই গীতিনাট্যের নৃত্যের মুদ্রা, গানের ধরন ও বাদ্যযন্ত্র ‘পাংঃখুঙ’ থেকে ভিন্ন। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে জাইত্দলসমূহ অর্থের বিনিময়ে সারারাতব্যাপী নাচ-গান পরিবেশন করে থাকে। (সাচপ্রু ২০০৩, উচনু ২০০৭)।
মারমা সমাজে বিভিন্ন প্রকার জাইত্ পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। যেমন : ১. বাে-দোওয়, ২. মাচক্যাই, ৩. মাঅংপ্রু, ৪. সীলাবাহুং, ৫. তাইংছিঃ, ৬. আলাঙবাহুং, ৭. সা-বেয়া প্রভৃতি।
পাঙঃখুঙ এবং জাইত্কে তিনটি বিষয়ের সঙ্গমে গড়ে ওঠা নাট্যশিল্প বলা যায় । মারমা সামাজিক মিথ, লােকজ প্রথাগত রীতিনীতি এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় জাতক গল্পের সম্মিলিত রূপ এই গীতিনাট্য শিল্প। পাঙঃখু এ বঙ্গীয় বাদ্যযন্ত্র এবং জাইত এ বর্মী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পােশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তদানুরূপ।
মারমা নৃত্য
মারমা সমাজে নৃত্যের ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত। মূলত নৃত্যগুলাে জীবন-জীবিকা, বিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। মারমা নৃত্যের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন : ক.ঙ্চোয়ে আকাহ্, খ. সইঙঃ আকাহ্, গ, কুমুইঙ আকাহ, ঘ. য়ইঃ আকাহ্, ঙ, ছিমুইঃ আকাহ্, চ. লংবাইঃ আকাহ্ প্রভৃতি।
ক.ঙ্চোওয়ে আকাহ্ : মারমা সমাজে ঙ্চোওয়ে আকাহ’ একটি গীতিনৃত্য বিশেষ । এককভাবে একজন শিল্পীর মাধ্যমে এ নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এই গীতিনৃত্যে ভবিষ্যতের ঘটনাবলি কেমন হতে পারে তার ইঙ্গিত থাকে। বর্তমানে এর প্রচলন তেমন একটা নেই ।
খ. সইঃ আকাহ্ : ‘সইঃ আকাহ্’ মারমা সমাজে প্রচলিত এক প্রকার দলীয় নৃত্য বিশেষ । সমাজের কোনাে মহৎ ব্যক্তি, ধর্মীয় নেতা কিংবা বৌদ্ধ ভিক্ষু বা রাজার মৃত্যুতে শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে এ ধরনের নৃত্য পরিবেশিত হয় ; শবদেহ বিশিষ্ট কফিন কাঁধে করে তালে তালে এ নৃত্য পরিবেশন করা হয় বিভিন্ন দলের মধ্যে প্রতিযােগিতামূলকভাবে । এ নৃত্যে ৩২ প্রকার মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে ।
গ. ক্যমুইঙ আকাহ্ : ‘কুমুইঙ’ এর বাংলা অর্থ হলাে ঢেঁকির চড়ুন। আদিকালে যখন উন্নত বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার হয়নি তখন এই চুডুনের সাহায্যে এক প্রকার নৃত্যের তাল সৃষ্টি করা হয়েছিল। কালক্রমে এখান থেকে ‘কুমুই আকাহ্’ বা চুড়ন নৃত্যের প্রচলন হয়ে যায়। এটাকে প্রাচীনতম মারমা নৃত্য বলে ধারণা করা হয় । এই নৃত্যে ৪ থেকে ৬টি চুড়ন ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে চুড়ুনের পরিবর্তে বাঁশের টুকরা ব্যবহার করা হয় ।
ঘ. য়ইঃ আকাহ্ : ‘য়ইঃ আকাহ’ শরীর দোলানাের মধ্য দিয়ে পরিবেশিত এক প্রকার নৃত্য বিশেষ। শরীর একটি বিশেষ ছন্দে হেলে-দুলে পরিবেশিত হয় বলেই এই নৃত্যের নাম ‘য়ইঃ আকাহ্’ রাখা হয়েছে। এই নৃত্য একক, দ্বৈত বা সমবেতভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
ঙ. ছিমুইঃ আকাহ্ : ‘ছিমুইঃ আকাহ্’ বা প্রদীপ নৃত্য বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই নৃত্য বিবাহ উপলক্ষে বর-কনের উভয় পক্ষের পিতামাতা ও গুরুজন স্থানীয় ব্যক্তিদের সম্মানার্থে পরিবেশিত হয়ে থাকে। ধর্মীয় পূজা পার্বণের পরেও এ নৃত্য পরিবেশিত হয়।
চ. লঙবাইঃ আকাহ্ : ‘লঙবাইঃ আকাহু’ বা থালা নৃত্য বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। দুই হাতের তালুর উপর দুটি পিতলের থালা বসিয়ে একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় এটি পরিবেশিত হয়। প্রাচীনকালে এটি রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হতাে। পূর্বে এটি প্রতিযােগিতামূলক নৃত্য হিসেবেও গণ্য হতাে (উচনু ২০০৮)।
পােশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার
পূর্বে মারমা পুরুষরা ‘ধোয়াঃ’ (ধুতি) নামে একপ্রকার তাঁতে বােনা কাপড় পরিধান করতাে। এ কাপড় দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা যায়। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কোমর থেকে পায়ের গােড়ালি পর্যন্ত ঢাকতেও দেখা যায়। এই ‘ধেয়াঃ’-এর সাথে ব্যারিষ্টা আঙ্গি (একপ্রকার জ্যাকেট) পরিধান করে সাধারণত জামার উপর দিয়ে।
পুরুষের মাথায় ‘গবং’ (পাগড়ি) ব্যবহার করে। বর্তমান সময়ের পুরুষেরা লুঙ্গি ও শার্ট ব্যবহার করে। মেয়েরা ‘বেঃদাইত আঙ্গি’ নামক একপ্রকার ব্লাউজ পরে । মেয়েরা যে অন্তবাস পরে তাকে বলা হয় রাংগাইত্’ । বর্তমান সময়ের মেয়েরা অন্তর্বাস হিসেবে ‘ক্রোঃদাইত্ আঙ্গি’ (এক প্রকার ব্রা) পরিধান করে ! মেয়েরা অধােবাস হিসেবে বিভিন্ন প্রকার নকশা বিশিষ্ট ‘থবিইং’ পরে। কোমরে বন্ধনী হিসেবে ব্যবহার করা হয় রুপার তৈরি খাঃগ্রোঃ । মারমাদের পােশাক পরিচ্ছদ এবং ডিজাইনের ব্যবহার বর্মীদের সাথে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায় (উচনু ২০০৮)।
মারমা নারীরা বিভিন্ন প্রকার অলঙ্কার পরতে ভালােবাসে। এর মধ্যে সাধারণত ব্যবহার রয়েছে এমন অলংকার হচ্ছে—ন্দঙঃ (কানের দুল), লাক্কক্ (চুড়ি), ক্খ্যাঙঃ (পায়ের মল), খাঃগ্রোঃ (কোমর বন্ধনী) প্রভৃতি ! অলঙ্কারগুলাে সাধারণত রুপার তৈরি হয়ে থাকে। মূলত গ্রামাঞ্চলে স্বর্ণালঙ্কার পরার প্রচলন কম। শহরাঞ্চলে বসবাসকারী মারমা নারীদের মধ্যে স্বর্ণালঙ্কার পরার রেওয়াজ দেখা যায় (আহসান ১৯৯৩)।
খাদ্যাভ্যাস ও খেলাধুলা
মারমারা মাছ ও মাংস ব্যতীত অন্যান্য শাকসবজি জাতীয় খাবারে শুটকি ব্যবহার করে। তরকারিতে ঙাপ্পি (মাছের পেস্ট) নামে এক প্রকার খাদ্য দ্রব্য ব্যবহার করে থাকে। মরিচের ভর্তা দিয়ে বিভিন্ন প্রকার সেদ্ধ করা শাক-সবজি তাদের অনেকের পছন্দ। একে মারমা ভাষায় ‘তােহ্জাঃ ‘ বলা হয়। মরিচের চাটনি সাধারণত ঙাপ্পি দিয়ে সুস্বাদু করা হয় (উচনু ২০০৭)।
মারমা সমাজে বিভিন্ন প্রকার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা প্রচলন রয়েছে। যেমন : দোঃ কজাঃ বােওয়েঃ (ঘিলা খেলা), তাছিঃ (দাড়িয়া বান্ধা), গ্যাং (লাটিম), ক্যাং লুঙঃ বােওয়েঃ (কুস্তি), হােঅক্ তাইঃ (লুকোচুরি), ব্রিঃদাইঃ (দৌড়) প্রভৃতি। বর্তমানে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলাগুলাে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ।
প্রবাদ প্রবচন
মারমা জনগােষ্ঠীর ভাষায় বিভিন্ন প্রকার প্রবাদ প্রবচনের অস্তিত্ব রয়েছে। তার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলাে :
মারমা
বাংলা ‘মাওঃমা অমোঃ মহিহ্
‘জিহ্বার যেমন অস্থি নেই, শামা অরােঃমহিহ।
রাজারও তেমন আত্নীয় নেই’ ‘খৃহ্ মতইকে অই খ’
‘হােচট না খেলে কেউ মাকে ডাকে না’ ‘ছাং লাগে লাইঃ লাে’
‘হাতির যেতে কোনাে রাস্তার দরকার হয় না ‘ওয়াঃ নাহ্ ওয়াঃ খ্যইংরাহূরে
বাঁশ দিয়ে বাঁশ বাঁধতে হয় | ছাং নাহ্ ছাং ফাইঃ রাহরে’
হাতি দিয়ে হাতি ধরতে হয়’
আঃক্রিঃখা আবাইত মূসা
‘শক্তি থাকাকালে অপরাধ হয় না।
(জোর যার মুক তরি)। ‘অম্যাক কঙঃগে তুলুঙঃ, কঙঃগে তয়ক’ | ‘মণি ভালাে হলে একটাই যথেষ্ট, মানুষ
ভালো হলে একজনই যথে।’ কিঃস্যে খালেঃ মতােয়াই’
‘টিয়া পাখি কখনো ডাক দেয় না’
শিক্ষা
১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গঠন করে। ১৮৬২ সালে নতুন জেলা সদর দপ্তর চন্দ্রঘােনায় জেলার সর্বপ্রথম একটি স্কুল স্থাপিত হয়। স্কুলটির নাম ছিল চন্দ্রঘােনা বাের্ডিং স্কুল । প্রাথমিক পর্যায়ের এই আবাসিক স্কুলটিতে চাকমা ও বার্মিজ নামের দুটি ক্লাশে ইংরেজি, বাংলা ও বার্মিজ পড়ানাে হতাে।
এই স্কুল প্রতিষ্ঠার পূর্বে এই অঞ্চলে জনশিক্ষার কোনাে উপযুক্ত ব্যবস্থা ছিল না : ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ধর্মগুরুদের দ্বারা ধর্মীয় বিষয় এবং অনান্য বিষয়ের মধ্যে চিকিৎসা ওষুধ সংক্রান্ত যৎসামান্য শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তবে এটিকে কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে ধরে নেয়া যায় না।
ধর্ম শিক্ষাসহ ব্যবহারিক বিষয়ে কিছু ধারণা দেয়াই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। বার্মিজ ও পালি এ দুটো ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। প্রকৃত পক্ষে চন্দ্রঘােনায় এই স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে পাশ্চাত্য শিক্ষা বা ইংরেজি প্রচলন হয় (চাকমা ২০০০)।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনের পরও মারমাদের শিক্ষার হার তেমন একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ১৯৯৯ সালের একটি জরিপ অনুসারে ৭ বছর ও তার উর্ধ্বে মারমাদের স্বাক্ষরতার হার হচ্ছে মাত্র ২৪% এবং স্কুল গমনের হার প্রাথমিক পর্যায়ে হচ্ছে ৪৫% এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৭% (চাকমা ২০০০)।
আবার ২০০১ সালে প্রকাশিত একটি বেসরকারি জরিপ অনুসারে ৬-১০ বছরের মধ্যে স্কুলে মারমা শিশুদের তালিকাভুক্তির হার হচ্ছে ৪৪.৮%। আলাদাভাবে ছেলেদের হার ৪৮.৬% ও মেয়েদের হার ৪১.২%। আবার ১১-১৫ বছরের মধ্যে মারমা শিশুদের স্কুলে তালিকাভুক্তির হার হচ্ছে ৫৬.৫%; আলাদাভাবে ছেলেদের হার ৬১.৫% ও মেয়েদের হার ৫১.৬% । উক্ত জরিপ অনুসারে দেখা গেছে যে, ৩৭.৩% মারমা পরিবারে কোনাে স্বাক্ষর ব্যক্তি নেই। এর মধ্যে ৪৩.০% পরিবারে কোনাে স্বাক্ষর পুরুষ সদস্য এবং ৬৭.২% পরিবারে কোনাে স্বাক্ষর নারী সদস্য নেই ।
সাত বছর ও তার উর্ধ্বে মারমা শিশুদের স্বাক্ষরতার হার ২৯.৭% । এর মধ্যে ছেলেদের স্বাক্ষরতার হার ৩৮.৯% এবং মেয়েদের স্বাক্ষরতার হার ১৯.৮%। আবার ১৫ বছর ও তার ঊর্ধ্বে মারমা সমাজে স্বাক্ষরতার হার হচ্ছে ২৬.৬%।
ছেলে ও মেয়েদের এ হার যথাক্রমে ৩৭.৫% ও ১৪.২%। প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে মারমা শিশুদের তালিকাভুক্তির হার হচ্ছে ৮৩.৩%। ছেলে ও মেয়েদের প্রাথমিক পর্যায়ে তালিকাভুক্তির হার যথাক্রমে ৯৪.৩% ও ৭২.৫%। মাধ্যমিক স্তরে মারমা শিশুদের স্কুলে তালিকাভুক্তির হার ৩৮.৭%। ছেলে ও ময়েদের মধ্যে এ হার যথাক্রমে ৪৮.৭% ও ২৮.৯%।
১১-১২ বছরের মধ্যে মারমা শিশুদের স্বাক্ষরতার হার হলাে ৫০,০%। ছেলে ও মেয়েদের এ হার যথাক্রমে ৪৯.২% ও ৫০.৮%। দেখা যাচ্ছে যে, প্রাথমিক পর্যায়ে মারমা শিশুদের স্কুলের তালিকাভুক্তির হার যে সময় ৮৩.৩%, সেই সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে এ হার ১০৭%। আবার ৬-১০ বছর বয়সে মারমা শিশুদের মন তালিকাভুক্তির হার যেখানে ৪৪.৮%, সেখানে সমগ্র বাংলাদেশে এ হার ৭৭.১% (নাথ ২০০১)
একই জরিপ অনুসারে দেখা গেছে যে, ৩৩.২% মারমা পরিবার শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ এই সমস্ত পরিবারে একজনও লিখতে-পড়তে পারে না। এ থেকে বােঝা যায় যে, মারমা জনগােষ্ঠীর শিক্ষার বর্তমান অবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়। মারমা জনগােষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত লােকের সংখ্যা অত্যন্ত কম এবং তদনুপাতে চাকরিপ্রাপ্ত মারমাদের সংখ্যাও খুব সামান্য।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে মারমা বুড্ডিস্ট এসােসিয়েশন কর্তৃক প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মারমা সমাজে ডাক্তারের সংখ্যা ১৩ জন, ইঞ্জিনিয়ার ১৩ জন, কৃষিবিদ ৩ জন, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ৪০ জন, স্নাতক ডিগ্রি প্রাপ্ত ১৪৭ জন মাত্র । এর মধ্যে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নারীর সংখ্যা মাত্র ২৮ জন। মূলত এই হার কোনাে ক্রমেই সন্তোষজনক নয় (মংক্যশােয়েনু ১৯৯৮)।
নিজস্ব মাতৃভাষা চর্চার সুযােগ এবং পরিসর অত্যন্ত সীমিত বলে নিজস্ব শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশে তাদের বিস্তর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। জাতায় শিক্ষা কার্যক্রম এর পাশাপাশি প্রচলিত নিজস্ব ভাষা, বর্ণ বিকাশেও ব্যাপক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যা জাতীয় মূলধারা সমৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তা না হলে তাদের সঠিক উন্নতি ও অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। সামগ্রিকভাবে জাতীয় উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে।
নারীর অবস্থা
মারমা নারীরা নারীরা পরিবারে যেমন তেমনিভাবে সমাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাদের অবস্থান সম্মানজনক। মারমা নারীরা পরিশ্রমী ও সকল প্রকার উৎপাদনে অংশগ্রহণ থাকে। পরিবারে একজন নারী সন্তানের যত্ন নেওয়াসহ গৃহস্থালির সব কার্যক্রম করে থাকে।
পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ সমান মর্যাদা রয়েছে। সমাজে পুত্র ও কন্যার মধ্যে তেমন বৈষম্য থাকে না। মারমা সাবালিকাদের জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার থাকে। যুক্তিসঙ্গত কাল সাথে বিবাহ-বিচ্ছেদেরও অধিকার রয়েছে। সমাজে নারীর পুনর্বিবাহ অনুমােদিত। ধর্মীয় কর্মকাণ্ডেও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ও পূজায় ভমিকা রাখার সমান অধিকার রয়েছে। মন্দিরে ঢুকতে ও প্রার্থনায় অংশ নিতে নারীর জন্য কােন বাধা নেই (আহসান ১৯৯৩)।
মারমা সমাজে (বােমাং সার্কেলে) নারীদের সম্পদের আইনগত উত্তরাধিকার রয়েছে। নারীরা স্বামী বা পৈতৃক সম্পত্তির উপর অংশীদারিত্ব পেয়ে থাকে। মারমা সমাজে নারীরা স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারে এবং নিরাপত্তাহীনতা বােধ করে না। মারমা সমাজে নারী-শিক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখা যায়।
অফিস আদালতে চাকরি করার ক্ষেত্রেও কোনাে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে না। শিক্ষিত নারীরা এখন সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষিকা, নার্স প্রভৃতি হিসেবে কাজ করে থাকেন। মারমা পরিবারে নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধ করে (আহসান ১৯৯৩)।
মারমা সমাজের মধ্যে নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য বা অসমতা তেমন প্রকট নয়। মারমা সমাজে নারীদের বিচরণের গণ্ডিও আপেক্ষিকভাবে অনেক বেশি উন্মুক্ত। বিভিন্ন হাটে-বাজারে ক্রেতা বা বিক্রেতার ভূমিকায় মারমা নারীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমা নারীদের উপর সহিংসতা নিজের সমাজের অভ্যন্তরে নেই বললেই চলে।
তবে অন্যান্য আদিবাসী নারীর মতাে মারমা নারীরাও বিভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির নেত্রী উমে মগ লিখেছেন ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলনের কঠিন দিনগুলােতে অনেক নারীর স্বামা নিহত, আহত, বন্দি ও ফেরারি হয়। এই দুঃসময়ে কঠিন সংগ্রাম করে তাদেরকে পরিবারের ভরণপােষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।
আন্দোলন দমনের নামে তাদের প্রতি অত্যন্ত নিপীড়ক ছিলাে, সশস্ত্র অভিযান চলাকালে গ্রাম ও ঘরবাড়ি পুড়ে যাওয়া ও লুণ্ঠন করার পাশাপাশি ধর্ষণ ছিলাে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে কোনাে সময়ে যে কোনো মেয়েকে ইজ্জত বির্সজনে বাধ্য করা হয়েছিলাে’ (উমে মগ ১৯৯৯)। মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা নারীদের ওপর সহিংসতা কোনাে বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। সমগ্র আদিবাসী নারীর উপর সহিংসতারই একটি অংশ।
এমনকি ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সশস্ত্র সংঘাতের অবসান হলেও অন্যান্য আদিবাসী নারীসহ মারমা নারীর উপর সহিংসতা বন্ধ হয়নি। ২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সমকাল পত্রিকায় একজন মারমা নারী উপর পাশবিক নির্যাতনের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
তাতে বলা হয়েছে ‘চট্টগ্রামে মারমা নারী শ্রমিক গণধর্ষণের প্রতিবাদে আয়ােজিত সমাবেশে বক্তারা বলেছেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শরিক হিসেবে তার উপর এই নিপীড়ন রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী চেহারাকে উন্মোচন করে। মারমা বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের ভাষায় ধর্ষণ নামক কানাে প্রতিশব্দ নেই। কারণ তাদের সমাজে এ ধরনের আচরণের অস্তিত্ব নেই’। দেখা যাচ্ছে, নিজেদের সমাজে যে সহিংসতার মুখােমুখি নারীকে হতে হয়নি, রাষ্ট্রীয় চরিত্রের কারণে সেইসব সহিংসতার মুখােমুখি হতে হচ্ছে।
মারমা সমাজে ‘লাক্ থেক্ পােই’ বা ‘লাক্ ছং পােই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার স্বামী হতে ভরণপােষণের অধিকারী হয়। একজন মারমা নারী বিবাহের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসারে কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান বা উপহার হিসেবে কিংবা স্বউপার্জিত অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে ।
বিবাহের পূর্বে অর্জিত কোনাে সম্পত্তির উপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে। স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের কারণে সতিনের সাথে একসঙ্গে সংসারে অবস্থান বা বসবাসে অসম্মত হলে, সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে স্বামীর নিকট হতে ভরণপােষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা সামাজিক আদালতের মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করে স্বামীর নিকট হকে খােরপােষ লাভের অধিকারী হয়।
বিবাহের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য বা অব্যাহত না রাখলে অথবা ভরণপােষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখে। স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখে। পক্ষান্তরে স্বামী পুরুষত্বহীন বা নপুংসক অথবা দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হলে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারী-হেডম্যান আদালতের বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারী হয়। (চাকমা, রায় ও দে ২০০৭)।
রাজনৈতিক সংগঠন
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মারমাদের জাতীয় জীবনে এখনাে সামন্ত বা ঐতিহ্যগত প্রবল প্রভাব রয়েছে। মারমাদের মধ্যে রাজনীতির ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি সাধিত হলেও মারমা সমাজে সামন্ত বা ঐতিহ্যগত অভিজাত শ্রেণী এখনো অনেকাংশে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করে চলেছে বলা যায়।
পরিবার থেকে শুরু করে গ্রাম, মৌজা ও জাতীয়—সকল স্তরে মারমা সমা, নেতৃত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ বললে অত্যুক্তি হবে না। সাধারণভাবে মারমাদের মধ্যে রাজনৈতিক অসচেতনতাই এর পেছনে মূল কারণ বলা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে মারমাদের মধ্যেও এখনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা শক্তিশালী রূপ ধারণ করতে পারেনি।
দেশের আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতিতে মারমা নেতৃত্বের কিঞ্চিৎ প্রতিনিধিত্ব লক্ষ করা গেলেও এই প্রতিনিধিরা হয় অভিজাত শ্রেণীর থেকে, না হয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উঠে এসেছে। এখনাে সাধারণ মারমারা গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ নির্বাচনী গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রথম স্বাদ পায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে। ১৯৫৯ সালের মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ৩৯টি ইউনিয়ন কাউন্সিল। গঠিত হয় সেগুলিই হলাে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ও গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে ১৯৫৯ সালের আগে কোনাে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ছিল না।
১৯৫৯সালের মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩৯টি ইউনিয়ন কাউন্সিল ও ১১টি থানা কাউন্সিল গঠিত হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউনিয়ন কাউন্সিলসমূহে দেশের অন্য ইউনিয়ন কাউন্সিলসমূহের ন্যায় সালিশি আদালতের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। মৌজা হেডম্যান ও রাজাগণ আদিবাসীদের সামাজিক বিরােধসমূহ বিচার নিষ্পত্তি করতেন বলে ইউনিয়ন কাউন্সিলসমূহের এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
মারমা জনগােষ্ঠী থেকে প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধি জাতীয় রাজনীতিতে পদাপ। করেন বােমাঙ রাজা মংশৈপ্রু চৌধুরী ১৯৬৫ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পিই ১৫০ চট্টগ্রাম ১০ আসন থেকে প্রাদেশিক সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে। নির্বাচনের পরপরই তিনি মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য দুটি আসনে মধ্যে বান্দরবান থেকে অংশৈ চৌধুরী নির্বাচিত হন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চাইথােয়াই রোয়াজা জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম ২নং আসনে অংশৈপ্রু চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ৩টি আসন বরাদ্দ করা হয়। উক্ত নির্বাচনে বান্দরবান থেকে মংশৈপ্রু চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদে বান্দরবান থেকে মংশৈপ্রু চৌধুরী জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন (চাকমা ১৯৯৩)।
১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে অন্যান্য আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মতাে মারমা জনগােষ্ঠীরও আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে চেয়ারম্যানসহ ২২ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে ৩টি সদস্যপদ মারমাদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যান পদ মারমাসহ সকল আদিবাসী জনগােষ্ঠীর জন্য উন্মুক্ত। আঞ্চলিক পরিষদের দুটি আদিবাসী নারী আসনের মধ্যে একটি চাকমা জনগােষ্ঠীর নারী এবং অপরটি চাকমা ব্যতীত সকল আদিবাসী জনগােষ্ঠীর নারীর জন্য সংরক্ষিত।
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলাে প্রতিটি চেয়ারম্যানসহ ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট। এসব পরিষদের মধ্যে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ১০টি সদস্যপদ মারমা ও খিয়াং জনগােষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৪টি সদস্যপদ ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৬টি সদস্যপদ মারমা জনগােষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে (চাকমা ১৯৯৩)। ইতােমধ্যে ”বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে মারমা জনগােষ্ঠী থেকে মনােনীত হয়েছে।
২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলায় ২৫টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে মারমা জনগােষ্ঠী থেকে ৪ (চার) জন চেয়ারম্যান পদে, ৪ (চার) ভাইস চেয়ারম্যান পদে এবং ২ (দুই) জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে।
লেখক-মংসিংঞা মারমা
টীকা
1. Tsu-la-Ting Tsandra
2. Taungu, Thaton, Hansawadi, Martaban, Pagan, Ava, Prome
3. Nga Tun Khin
4. Digest of Buddhist law
5. Law of Menoo
তথ্যসূত্র
১. চৌধুরী, আবদুল হক, ১৯৮৯। চট্টগ্রাম-আরাকান, ১১৫, নবাব সিরাজদ্দৌলা রোড, চন্দনপুরা, চট্টগ্রাম।
২. .., ১৯৮৮। ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা’,বাংলা একাডেমী ঢাকা।
৩. …., ১৯৯৪। প্রাচীন আরাকান, রােয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়য়া বৌদ্ধ অধিবাসী বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৪. চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ, ১৯৯৩। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য স্থানীয় সরকার পরিষদ’, স্থানীয় সরকার পরিষদ, রাঙ্গামাটি।
৫. …, ২০০০। বিংশ শতাব্দীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম : ফিরে দেখা’, লামপ্রা, সম্পাদক : অম্লান চাকমা, জুম ঈসথেটিকস্ কাউন্সিল (জাক), রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
৬, চাকমা, মঙ্গল কুমার, ২০০৩। গণতন্ত্র, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং নাগরিক সমাজ : পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষিত, সংহতি, সম্পাদক : সঞ্জীব দ্রং, প্রকাশনায় : বাংলাদেশ আদিবাস ফোরাম, ঢাকা।
৭ মংক্যশােয়েনু, ১৯৯৮। মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’, সাংগু, উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, বর্ষ : ছয়, সংখ্যা : এক (৫ম খণ্ড), প্রকাশক : উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, বান্দরবান।
৮ ত্রিপুরা, সুরেন্দ্রলাল, ১৯৯৪। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি’, প্রকাশক : উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাঙ্গামাটি।
৯ চাকমা, এডভােকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ; রায়, এডভােকেট প্রতিম ও দে, সাংবাদিক শৈলেন, ‘মারমা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন’, প্রকাশক: কপাে সেবা সংঘ,রাঙ্গামাটি।
১০. খান, লে. কর্নেল এস আই এস নূরুন্নবী, বীর বিক্রম (বরখাস্ত), ২০০১। মংরাজার মুক্তিযুদ্ধ’, কলম্বিয়া প্রকাশনী, মিরপুর, ঢাকা।
১১. উচনু, ডিসেম্বর ২০০৭। মারমা, আদিবাসী জনগােষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি, সম্পাদক : মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম, সুগত চাকমা, ঢাকা।
১২. উল্লাহ, এন. এম. হাবিব, ১৯৯৫। ‘রােহিঙ্গা জাতির ইতিহাস’, বাংলাদেশ কো- অপারেটিভ বুক সােসাইটি লি., ঢাকা ১০০০।
১৩. লিংকন, কংজঅং চৌধুরী, ২০০০। ‘মং রাজাদের ইতিহাস’, বৈসাবি, প্রকাশনায় : উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাঙ্গামাটি ।
১৪. সাচপ্রু, ২০০৩। ‘মারমা সংস্কৃতিতে সংগীত ও গীত নাট্যের ঐতিহ্য’, পইজ্রা, প্রকাশক : উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, বান্দরবান।।
১৫. সেন্দেল ভেলাম, ১৯৯১। ;দক্ষিণপূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুখানন’, (অনুবাদ : সালাহ উদ্দীন আইয়ুব)।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ১০০০।
১৬ ডঃ মনিরুজ্জামান, ২০০৪। ‘মারমা-বাংলা সম্পর্ক : একটি প্রাথমিক অনুসন্ধান’, ‘চেদ্না | (মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা), ৮ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, সম্পাদক : উশেপ্রু মারমা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল।
১৭ শরদিন্দু শেখর চাকমা, …। জুম্ম জনগণ যাবে কোথায়’, প্রকাশক : …।
১৮ মংক্যশেমেনু, ২০০৭। মারমা উৎসব ও বিবাহ’ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় উৎসব ও বিবাহ, সম্পাদক : সুগত চাকমা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, রাঙ্গামাটি।
১৯. Kyaw Shwe Prue, 2003. A BRIEF HISTORY OF THE MARA-MAS OF CHITTAGONG HILL TRACTS, সাংগু, উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, ১ম-৩য় তিন খণ্ড একত্রে, প্রকাশক : উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট, বান্দরবান।
20. Ahsan, Selina, 1993. “The Marmas of Bangladesh’, Pub : HRDP, Winrock International, BARC, Farmgate, Dhaka-1215.
21. Rafi, Mohammad, 2001. “Introduction to Chittagong Hill Tracts’, Counting the hills, Edited by: Mohammad Rafi and A. Mushtaque R. Chowdhury, The University Press Limited, Dhaka 1000.
22. — , 2001. ‘Immigration and Politico-development history’, Ibid.
23. Nath, Samir Ranjan, 2001. ‘Enrollment and literacy’, Ibid.
24. Mallik, Debdulal, 2001. ‘Land ownership and cultivation’, Ibid.
25. — , 2001. ‘Analysis of selected economic indicators’, Ibid.
26. Rafi, Mohammad, and Nath, Samir Ranjan, 2001. ‘Village, bouse hold, and house hold member’, Ibid.
27. Mohsin, Amena, 2002.
The Politics of nationalism’, The University Press Limited, Dhaka 1000.
28. Mackenzie, A, 1989.
The North-East frontier of India’, New edition by BK Roy Burman, Mittal Publication, Delhi-110035 (India).
28. Qanungo, Dr. Sunity Bhushan, 1988.
A history of Chittagong’, Vol. 1, Published by Dipankar Qanungo. Chittagong.
30. Rizvi, S.N.FI, 1975.
angladesh District Gazetteer! (Chittagong), General Edition, Bangladesh Govt. Press.
31. Phayre, Lieut. general Sir Arthur P, 1883.
‘History of Burma’, London : TrÜbher & co. Ludgate Hill.
32. Chaudhuri, Sukoinal, 1982.
Contemporary buddhism in Bangladesh’, Atisha memorial publishing society. Culcutta, India.
33. Qanungo, Suniti Bhushan, 1988.
Chakma Resistance to British Domination, Shanti Press, 41 Katapahar Iane, Terri Bazar, Chittagong 4000.
34. U aung tha u, Ryb 1995
Arakanese alphabet : origin and evolutfion’, সাঙ্গু, উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউট।
৩৫. U than prze, পুনর্মুদ্রণ ২০০৩।
| A brief histoty of Borang dynesty, পইজ্রা, বােমাঙ রাজপুণ্যাহ ১৯৯৪ স্মরণিকা।
৩৬. ঞোম্রা, ডিসেম্বর ১৯৯৭। ‘কুঙ : বঙ হ্রাপুঙদ’, ম্রাবতী চাবেদই, আঙঃজিংঃ ম্রোহনে,রেঙ্গুন।
৩৭. চন্দমালালঙ্কার, ১৯৮৯ (১২৯২ মঘী)। রখইং রাজওয়াং সই ক্যাইঃ (আরাকানের ইতিহাস)’, (দ্বিতীয় খণ্ড-পঞ্চম থেকে সপ্তম অধ্যায়), মায়ানমার।
৩৮. কবিসারাভি সীরিপবর (অজ্ঞ মহাধম্ম রাজাধিরাজ গুরু) ১১৪৯ (মঘীসন)।
‘ধঞবতী অরেঃদপুং’, মায়ানমার।
মূল্যবান পরামর্শ ও মতামত প্রদানের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার
১. মি. মংক্যশােয়েনু, লেখক ও গবেষক, বান্দরবান
২. মি. ক্যশৈহ্লা, সংস্কৃতি কর্মী ও চেয়ারম্যান, পার্বত্য জেলা পরিষদ, বান্দরবান।
৩. মি. মংনুচিং, পরিচালক, টিসিআই, বান্দরবান।
৪. মি. উচনু, লেখক, গবেষক ও গবেষণা কর্মকর্তা, টিসিআই, বান্দরবান
৫. মি. উক্যশৈপ্রু খােকা, লেখক ও গবেষক, বান্দরবান
৬. মি. উক্যজেন, অব. যুগ্ম সচিব, খাগড়াছড়ি
৭. অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী, শিক্ষাবিদ, খাগড়াছড়ি
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।