মারমা জনগোষ্ঠীর বিবাহ বিচ্ছেদ (খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া খোয়াযা)
925
মারমা বিবাহ বিচ্ছেদ
মারমা পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” বলা হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্ন পদ্ধতি। স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে মারমা সমাজ স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সামাজিক রীতি ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্ধশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” প্রদান করা আয়ঃ-
ক) স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বেচ্ছায় সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদন করতে পারে।
খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের আওতায় “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” দান করা যায়।
গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট/নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন মূলে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” প্রেরণ করে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রদান করে থাকে (যদিও তা সামাজিক
প্রথাসিদ্ধ নয়)।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” দাবী করার অধিকার লাভ করে।
নিম্নোক্ত কারণে মারমা সমাজে স্বামী বা স্ত্রী “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ-
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় বা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদ স্নদপত্র দ্বারা “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” দাবি করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে অপরজন “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” দাবি করতে পারে।
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে, সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” দাবি করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কে্উ একজন নিরুদ্দেশ হলে কিংবা ৩ মৌসুম যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদন পূর্বক দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হলে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” প্রদান করতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ জঘন্য অপরাধের জন্য দন্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন কারাভোগে থাকে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” দাৰী করতে পারে।
ছ) যদি স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বৌদ্ধ পুরোহিত বা সাধুমা (হ্লূদমা) হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদন করতে পারে।
জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্সেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, অকর্মণ্য এবং নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতে মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদন করতে পারে।
ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদন করতে পারে।
ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়,পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়,সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” প্রদান করতে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত ফলাফল
ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কে্উ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। এরূপ বিবাহ বহু বিবাহ হিসেবে গণ্য হয় না।
খ) “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী এমন কি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান অবৈধ ৰা জারজ হিসেবে গণ্য হয়।
গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর পারস্পরিক পুনঃ সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘মেয়াপোই/মাঙলা ছং পোই/লাক থাই মাঙলা পোই’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়। তবে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর উভয়ের যদি অন্যত্র বিবাহ না হয় সেক্ষেত্রেই মেয়াপোই/মাঙলা ছং পোই/লাকখাই মাঙলা পোই অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়।
ঘ) “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর স্বামী ও উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।
ঙ) “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।
চ) “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্ত্রীর অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের উপর স্বামীর অধিকার থাকবে না। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
ছ) “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের সময় সামাজিক আদালতে পক্ষগণের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে কনেপন সংক্রান্ত পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।
“খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা“ সম্পাদনকালে স্ত্রীর অন্তসত্ত্বা গর্ভবতী বা অবস্থায় অনাগত সস্তানের উপর দায়দায়িত্ব
ক) “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় যদি গর্ভবতী বা অন্তসত্ত্বা থাকে অথবা “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের অধিকার বা স্বীকৃতি মারমা সামাজিক প্রথা অনুসারে দিতে হয়।
উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার মায়ের হেফাজতে ৩ বৎসর পর্যন্ত থাকে ও তার পিতার নিকট হতে ভরণপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
বিচ্ছেদকালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত মতে স্বামীর নিকট হতে ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবের যাবতীয় খরচ পায়।
তবে উক্ত সন্তান সাবালকত্ব অর্জন না করা পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে।
খ) বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে, সেক্ষেত্রে সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান না করে তাহলে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের তারিখ হতে ২৮০ দিন পর দ্বিতীয়বার বিবাহ ব্যতীত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত গর্ভে যদি কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় এবং বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য থাকবে না।
তবে “খায়াখ্রাং/লাঙমেয়া থোয়াযা” সম্পাদনের পর স্ত্রীর পূনঃ বিবাহ হলে তখন গর্ভজাত সন্তানের পিতৃত্বের বিষয়টি ধাত্রী বিদ্যামতে বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।