মারমা-বিষয়ক একটি ‘লাকসু-ধর্মী’ লেখা
991
[এই লেখাটি প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বের করা বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস্ কাউন্সিল, ঢাকা মহানগর-এর ম্যাগাজিন মো লাং নীং (৮ম সংখ্যা, ২০১৯)-এ “ভাবনার পতিত জমি থেকে তুলে আনা ‘এক গোছা মারমা’” শিরোনামে প্রকাশিত আমার একটি পাঁচমিশালি রচনার ব্লগ সংস্করণ। মারমা ও ককবরক (ত্রিপুরা) উভয় ভাষায় প্রচলিত ‘লাকসু’ শব্দটি দিয়ে বোঝায় পাহাড়িদের প্রিয় এক বিশেষ ধরনের টক-ঝাল মেশানো সালাদ, যেটির প্রসঙ্গ এই লেখাতেও একটুখানি রয়েছে। – প্রশান্ত ত্রিপুরা]
প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ওড়ানো ফানুস (ছবি ইন্টারনেট থেকে নেওয়া)
সমকালীন বাংলাদেশে ‘মারমা’ একটি জাতিসত্তার নাম, একটি সংস্কৃতির নাম, একটি ভাষার নাম।
এসবের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পরিসরে আমার কাছে ‘মারমা’ শব্দটির বিশেষ কিছু তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা রয়েছে।
সেগুলির কিছুটা মিশে রয়েছে আমার স্মৃতিতে, কিছুটা বিভিন্ন সময়ে আমার মনের ভেতরে ঘোরাফেরা করেছে কৌতূহল, আক্ষেপ বা সাধ হিসেবে।
এসব ভাবনার খানিকটা খণ্ডিত আকারে ইতোমধ্যে উঠে এসেছে আমার লেখালেখিতে, আবার অনেকটাই রয়ে গেছে এখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখা হয় নি, সেভাবে জানা-বোঝা হয়ে ওঠে নি, এমন বিষয় হিসেবে।
এ ধরনের ‘এক গোছা মারমা’ নিয়েই আমার এই পরিবেশনা, যেখানে আমি আমার পূর্বপ্রকাশিত কয়েকটি লেখার নির্বাচিত অংশবিশেষ পেশ করছি যেগুলিতে মারমাদের প্রসঙ্গ কোনো না কোনোভাবে এসেছে।
পাশাপাশি মারমা-বিষয়ক আমার প্রাসঙ্গিক আরো কিছু ভাবনাও তুলে ধরছি যেগুলি ইতোপূর্বে কোথাও লিখিতভাবে প্রকাশ করি নি।
স্মৃতির মারমা গ্রাম থেকে উড়ে আসা ফানুস
আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে বরাবরই একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার সন্ধ্যাগুলি, যখন যুগপৎ লক্ষ্মীপূজা আর বৌদ্ধদের প্রবারণা উৎসব থাকে।
ছোটবেলায় এসময় বাড়িতে সার বেঁধে মোমবাতি জ্বালাতাম আমরা।
আর সেসাথে অপেক্ষায় থাকতাম কখন অদূরের মারমা গ্রাম থেকে প্রবারণা উপলক্ষে আকাশে ‘ফানুস বাতি’ ওড়ানো হবে।
আলোকিত ফানুসগুলো উপরে উঠতে উঠতে আকাশের তারাদের ভিড়ে মিশে যেত, আবার কখনোবা বাতাসে ভেসে এসে আমাদের গ্রামের সীমানায় নীচে নামতে থাকলে আমরা সেসবের পিছনে ছুটতাম।[1]
ছেলেবেলার মারমা পড়শি ও স্বজনেরা
খাগড়াছড়িতে বেড়ে ওঠার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই মারমাদের কথা আমি জানতাম, তাদের দেখতাম, এবং অনেক মারমার সাথে মিশেওছিলাম বিভিন্ন পরিসরে।
হাইস্কুলে ওঠার পর মারমা সহপাঠী পেয়েছিলাম কয়েকজন, এবং আমার একজন শিক্ষকও ছিলেন মারমা।
আর মা-বাবার সূত্রে কিছু মারমা ব্যক্তি ও পরিবারকে আমরা আত্মীয় হিসেবেই দেখতাম বা জানতাম।
এসবের বাইরে রাস্তাঘাটে এবং হাটবাজারে মারমাদের দেখতাম নিয়মিতই।
তবে খাগড়াছড়ির ত্রিপুরাদের অনেকে – বিশেষ করে মারমা গ্রাম সংলগ্ন এলাকার সাধারণ ত্রিপুরারা – মারমা ভাষা জানলেও ‘বাবু’ শ্রেণীর ত্রিপুরা ও মারমারা (এবং চাকমারাও) পরস্পরের সাথে চট্টগ্রামী বাংলাতেই কথা বলত।
ব্যক্তিগতভাবে আমিও তাতেই অভ্যস্ত ছিলাম ছোটবেলায়।
উল্লেখ্য, অন্য অনেক জায়গার মত খাগড়াছড়িতেও মারমারা এক সময় ‘মগ’ হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিল (বিশেষ করে চাকমা ও বাঙালিদের কাছে)।
তারা নিজেরাও এই পরিচয়ে অভ্যস্ত ছিল, এমনকি অনেকে নামের উপাধি হিসেবেও ‘মগ’ ব্যবহার করত।
ত্রিপুরারা অবশ্য মারমাদের ভিন্ন আরেক নামে চিনত ও এখনো চেনে – Mwkwk বা Mwkhwk (যে শব্দগুলির উচ্চারণ বাংলা বানানে ‘মুকুক’ বা ‘মুখুক’-এর কাছাকাছি হবে) – ককবরকে যেটির কোনো নেতিবাচক ব্যঞ্জনা নেই বাংলা ‘মগ’-এর মত।
অন্যদিকে মারমারা যে ত্রিপুরাদের ‘ম্রুং’ নামে ডাকে, সেটাও জানতাম ছোটবেলাতেই।
আর মারমা ভাষা সেভাবে না জানলেও হাসি-ঠাট্টা বা গালিগালাজে ব্যবহার্য কিছু মারমা শব্দ বা বাক্য ঠিকই শিখেছিলাম ছোটবেলাতেই।
এসবের পাশাপাশি মারমাদের নিয়ে ঠাট্টাচ্ছলে তৈরি করা ককবরক ছড়া জাতীয় একটা কথাও শিখেছিলাম, যার ভিত্তি ছিল ‘হেঁচকি’ অর্থে ব্যবহৃত ককবরক ‘thwkwk’ শব্দের সাথে ‘Mwkwk’ নামের মিল!
উপরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ত্রিপুরা-মারমা-চাকমা-বাঙালি অধ্যুষিত খাগড়াছড়িতে বেড়ে উঠলেও ছোটবেলায় মারমা ভাষা শেখার বা মারমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কে জানার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বা তাগিদ কখনো পাই নি (কথাটা অবশ্য চাকমা ও ত্রিপুরা ভাষা-সংস্কৃতির বেলাতেও প্রযোজ্য)।
পরবর্তীতে, আমার নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়ে ওঠার পরও, আলাদা করে মারমা ভাষা, সংস্কৃতি বা ইতিহাস নিয়ে আমার সেভাবে পড়াশোনা করা হয়ে ওঠে নি।
এই প্রেক্ষাপটেই আমি আমার মারমা-বিষয়ক আরো কিছু ভাবনা ও উপলব্ধি পেশ করছি।
আমার মারমা-বিষয়ক আক্ষেপ
নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে খানিকটা কাজ শুরু করতে গিয়ে আমার মধ্যে এই উপলব্ধি কালক্রমে জোরালো হয়েছে যে, মারমা ভাষা জানা থাকলে তা আমার গবেষক সত্তার জন্য খুবই কাজে লাগত।
শুধু তাই নয়, একজন ত্রিপুরা হিসেবে নিজের আত্মপরিচয় আরো ভালো করে বোঝার বেলায়ও যে মারমা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস জানা থাকা সহায়ক হত, তাও আমি বুঝতে পেরেছিলাম বেশ আগেই।
কাজেই স্বাভাবিকভাবেই মারমা ভাষা না জানা নিয়ে আমার নিজের মধ্যে একটা আক্ষেপ রয়েছে এখন।
এমন ভাবনার আলোকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গ্যা বিষয়ক এক আলোচনানুষ্ঠানে আমি একবার এ কথাও বলেছিলাম যে, বাংলাদেশি ইতিহাসবিদদের মধ্যে যদি মারমা তথা বর্মি ভাষা জানা বিশেষজ্ঞ থাকতেন, তাহলে তা আমাদের জন্য এ অঞ্চলের ইতিহাসের বেশ কিছু অনালোকিত দিক সামনে আনার সুযোগ করে দিত।[2]
বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলায় অবস্থিত একটি মারমা গ্রামের সীমানা (২০১৪ সালে লেখকের তোলা ছবি)। (উল্লেখ্য, চট্টগ্রামী ভাষায় ‘রোয়াং’ বলতে আরাকান অঞ্চলকে বোঝায়, যা রোয়াংছড়ি নামের ব্যুৎপত্তি ব্যাখ্যায় প্রাসঙ্গিক হতে পারে।)
ত্রিপুরা পরিচয়ের বিবিধ মারমা যোগসূত্র
বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, যাদের অনেকের বসবাস খাগড়াছড়িতে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রচলিত একটি বর্গীকরণ অনুসারে ‘নোয়াতিয়া’ হিসেবে গণ্য হয়।
এ প্রসঙ্গে এক জায়গায় আমি লিখেছি, “মাণিক্য রাজবংশের শাসনামলে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা সংকুচিত-প্রসারিত হওয়ার কোনো এক পর্যায়ে [ককবরকভাষীদের ‘নোয়াতিয়া’, ‘পুরানতিয়া’, ‘জমাতিয়া ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করার রেওয়াজ] সূচিত হয় বলে ধরে নেওয়া যায়।
… নোয়াতিয়ারা ছিল ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটা প্রান্তিক অংশ যারা গত দুই তিন শতাব্দী ধরে আরাকান বা তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের মূল ভূখণ্ডের দিকে সরে এসেছে।
এর থেকে অনুমান করা যায়, ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা আরাকানের দিকে বিস্তৃত থাকার সময় যেসব ত্রিপুরা [সেই দিকে] চলে গিয়েছিল, তারাই পরবর্তীতে রাজ্যের সংকুচিত সীমানার দিকে ফিরে আসার মুখে ‘নোয়াতিয়া’ বা ‘নতুন ত্রিপুরা’ নামে চিহ্নিত হয়।”[3]
উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ি অঞ্চলের ত্রিপুরাদের মধ্যে মারমা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে আসা অনেক উপাদান পাওয়া যায় খুঁজলে।
যেমন, ত্রিপুরাদের প্রিয় ‘লাকসু’ (শুটকি ও মরিচ – এবং প্রায়শ তেঁতুল – সহযোগে তৈরি সালাদ) – অন্তত শব্দটা – মারমা উৎস থেকেই এসেছে বলে আমার ধারণা।
একইভাবে ত্রিপুরা হেডম্যানরা যে ‘রোয়াজা’ উপাধি ব্যবহার করে, সেটি আদিতে মারমা শব্দই ছিল, যার অর্থ হল ‘গ্রাম প্রধান’।
একইভাবে ত্রিপুরাদের বিভিন্ন গোত্র বা উপগোত্রের এমন সব নাম রয়েছে – যেমন নাইতং, ফাতং, হারবাং, আনক – যেগুলি ককবরকে বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না, কিন্তু মারমা (বা রাখাইন) ভাষার সূত্র ধরে এগুলির ব্যুৎপত্তি খোঁজা সম্ভব।
উপনিবেশিত বাঙালি মননের ‘মগের মুল্লুক’
[বাংলাদেশে] আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের কথা স্কুলে পড়ানো হয়, কিন্তু [যে সময় এই চর্চা ছিল তখন] চট্টগ্রাম যে আরাকানের অংশ ছিল বা সেই রাজ্যের সীমানায় যে আরও বহু ভাষা ও বহু জাতি ছিল—এসব বিষয় পড়ানো হয় না।
বরং মারমা ও রাখাইন নামে পরিচিত দুটি জনগোষ্ঠীকে তাদের আপত্তি সত্ত্বেও এখনো অনেক জায়গায় উল্লেখ করা হয় ‘মগ’ হিসেবে।
পাশাপাশি মগরা যে জলদস্যু ছিল, তা-ও শেখানো হয় ইতিহাসের ক্লাসে।
ওদিকে বাংলা ক্লাসে বাগধারা শেখানো হয়, মগের মুল্লুক মানে হচ্ছে অরাজকতা।
অনেকেই হয়তো জানেন, চট্টগ্রামের বাঙালিদের অপমান করার একটা মোক্ষম উপায় হলো তাদের মগ বলে গালি দেওয়া।
তবে মগ পরিচয়টা সব সময় গালি হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তা মনে হয় না।
আগে মগ বলতে আরাকানের (বা মিয়ানমারের) অধিবাসী বা সেখান থেকে আসা মানুষকে বোঝানো হতো।
আর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে চট্টগ্রামে বর্তমানে যেসব বাঙালি সম্প্রদায় রয়েছে, তাদের অনেকে (যেমন-বড়ুয়ারা) একসময় আসলেই মগ নামে পরিচিত ছিল।
ফ্রান্সিস বুখানন নামে একজন পর্যবেক্ষক ১৭৯৮ সালে ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা ও নোয়াখালি অঞ্চল) ও চট্টগ্রাম (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ) সফর করে যে বিশদ বিবরণ লিখে রেখে গেছেন, তাতে অন্তত সে রকমই উল্লেখ আছে।
মগ শব্দের ব্যুৎপত্তি নিয়ে যেসব ব্যাখ্যা এযাবৎ পড়েছি, আমার কাছে কোনোটাই খুব একটা নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি।
আমার নিজের অনুমান হচ্ছে, বাংলা ভাষায় মগ শব্দটা গালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, হয়তোবা বুখানন যে সময় চট্টগ্রাম অঞ্চল সফর করেছিলেন, তখন বা আরও পরে।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ব্রিটিশরা যখন ১৭৫৭ সালে চট্টগ্রামের দখল পায়, আরাকান ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য এবং চট্টগ্রামের উপর দাবি আরাকানিরা তখনো পুরোপুরি ছাড়েনি।
এই অবস্থায় ১৭৮৪ সালে আরাকান চলে যায় বার্মা সাম্রাজ্যের অধীনে।
আরও পরে, বার্মা যখন মণিপুর ও আসাম দখল করে নেয়, ১৮২৪ সালে প্রথম ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধ হয়, যার ফলে আরাকান ও আসাম চলে যায় ব্রিটিশদের অধীনে এবং আরও দুটি যুদ্ধের পর ১৮৮৫ সালে পুরো বার্মা চলে আসে ব্রিটিশদের দখলে।
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক পরিসরে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় সে যুগে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ব্রিটিশদের পাশাপাশি পর্তুগিজ ও ফরাসিরাও বেশ তৎপর ছিল।
এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সাম্রাজ্যগুলোর সঙ্গে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বিভিন্নমুখী আঁতাত গড়ে উঠেছিল, যেমন—আরাকানিদের সঙ্গে পর্তুগিজদের, বার্মার সঙ্গে ফরাসিদের, ব্রিটিশদের সঙ্গে শ্যাম দেশের (বর্তমান থাইল্যান্ড)।
কাজেই এ উপমহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ইংরেজদের জয়লাভ আর ইতিহাসে জলদস্যু হিসেবে মগ ও পর্তুগিজদের ঠাঁই হওয়ার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকতেই পারে (ইংরেজদের বদলে ফরাসি বা পর্তুগিজরা বাংলা দখল করলে আমরা হয়তো ইংরেজ ও থাই জলদস্যুদের কথাই পড়তাম ইতিহাসে)।
পাশাপাশি যখন আমরা এটা স্মরণ করি যে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রসার ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনামলে এবং বার্মা জয়ের পর সেই দেশ শাসনে ব্রিটিশদের অন্যতম সহযোগী ছিল নববিকশিত বাঙালি বাবু শ্রেণীর লোকজন, তাহলে এটা অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে আরাকানি ও বর্মিদের হিংস্র ও বর্বর হিসেবে দেখিয়ে সাম্রাজ্যের মতাদর্শিক ভিত রচনার ব্রিটিশ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলা ভাষায়ও মগরা অরাজকতার প্রতিমূর্তি হিসেবে জায়গা করে নেয়।
তা না হলে বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক থেকে মগরা যে স্রেফ দস্যুতে পরিণত হয়ে গেল, এর ব্যাখ্যা কী?
ওদিকে আরও বড় দস্যু যারা ছিল, তারা এই অঞ্চলকে বিভিন্নভাবে নিঃস্ব-রিক্ত করে বুনে রেখে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িকতার বীজ।[4]
নতুন একটা মারমা রূপকথা লেখার আহ্বান
চলুন, নতুন ‘একটা মারমা রূপকথা’ লিখি, যেখানে থাকবে দানবদের কবলে পড়া দুই বোনের কাহিনী।[5]
আমাদের কাহিনীর বাহ্যিক কাঠামো আমরা নেব একটা ত্রিপুরা কিংবদন্তী থেকে, যেটার অংশবিশেষের সাথে মিল রয়েছে সাতভাই চম্পা গল্পের।
এরপর আমাদের নয়া রূপকথার কিছু উপাদান আমরা নেব সমকালীন প্রেক্ষাপট থেকে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আদি কাহিনীটা একটু জেনে নেওয়া যাক।
ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রচলিত গল্পটির মূলে রয়েছে ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার দুই বোন, কাহিনীর শুরুতে যাদের দেখা মেলে জুমক্ষেতে কর্মরত অবস্থায়।
সেখানে তারা পড়ে ঝড়ের কবলে।
এই অবস্থায় তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিনিময়ে “সাপরূপী এক দেবতা (বা কোনো ভাষ্যে রাজকুমার) বড় বোনকে বিয়ে করে।
কিন্তু মেয়ে দুটোর বাবা খবর পেয়ে সাপটিকে মেরে ফেলে।
স্বামী হারানোর শোকে বড় বোন নিজের চোখের জলে ডুবে যায় [লোকবিশ্বাস অনুসারে স্থানটি হল ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত ‘ডুম্বুর’ নামের তীর্থস্থান, যেখানে বর্তমানে একটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ রয়েছে], আর অনুতপ্ত ও বিলাপরত সুন্দরী ছোট বোন শিকারে বেরুনো রাজার চোখে পড়ে যায়।
রাজা তাকে বিয়ে করে রাণীর আসনে নিয়ে বসায়।
তারপর, রূপকথায় যেমনটা হয়, অন্যান্য রাণীর হাতে নিগৃহীত হওয়ার পর গল্পের শেষে সাত পুত্র ও এক কন্যা সমেত সে আবার ফিরে পায় তার যথাযথ মর্যাদার আসন।
উপরে উদ্ধৃত কাহিনীর আদলে নতুন যে ‘মারমা রূপকথা’ আমরা লিখব, সেটার প্রধান চরিত্র হবে কর্ণফুলী নদির তীরবর্তী এক পাহাড়ি গ্রামে জন্ম নেওয়া দুই বোন।
ধরা যাক তাদের নাম হল তুমাচিং সুজাতা মারমা ও উম্রাচিং সাগরী মারমা।
তাদের উপর নজর পড়ে মানুষের বেশে ঘুরে বেড়ানো কিছু সর্পদানবের, যাদের দংশনে মুমূর্ষু বড় বোনের চোখের জলে তৈরি হয়েছে কাপ্তাই হ্রদ।
ছোটবোনের গায়েও তারা ছোবল মেরেছিল, কিন্তু তাতে তার চোখ থেকে বেরুচ্ছে আগুনের ফুলকি, যা থেকে দাবানল ছড়িয়ে পড়বে ভেবে ত্রস্ত হয়ে পড়েছে সর্পদানবদের সহযোগী রাজপ্রহরীরা, যারা আহত দুই বোনকে আটকে রেখেছে কবিরাজের দালানে।
এই অবস্থায় এই দুই বোনের কথা শুনতে পেয়ে তাদের কাছে ছুটে যান কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে বাস করা এক দম্পতি – যারা রাজা ও রাণী নামে পরিচিত – কিন্তু তাদের মাথায় নেই ক্ষমতার মুকুট…। (এইটুকু লেখার পর আমার ‘রূপকথা’ লেখার কাজ অসমাপ্ত রেখে দিতে হয়েছিল।)
কেমন হতে পারে আমাদের অসমাপ্ত রূপকথার পরিণতি?
এটি আসলে নির্ভর করছে, আপনি আমি – আমরা অনেকে – এটিতে কতটুকু কী ভূমিকায় অংশ নিচ্ছি, তার উপর।
সর্পদানবেরা কি মানুষের বেশেই ঘুরে বেড়াতে থাকবে বা কোনো সুরক্ষিত বলয়ে অবস্থান করবে নিশ্চিন্তে?
তুমাচিং ও উম্রাচিং কি ন্যায়বিচার পাবেন? চলুন, উত্তর রচনায় আমরা সবাই যে যেভাবে পারি অংশ নেই।
টীকা ও তথ্যসূত্র
[1] ‘অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কাছে খোলা চিঠি’, যা এই ব্লগেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল অক্টোবর ২৮, ২০১৩ তারিখে, এবং পরে বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস শিরোনামে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ সংকলনেও গ্রন্থিত হয় (২০১৫, সংবেদ)।
[2] অনুষ্ঠানটির শিরোনাম ছিল ‘রোহিঙ্গ্যা সংকট: কারণ, প্রক্রিয়া এবং আমাদের করণীয়’, যা ছিল বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র আয়োজিত একটি সামাজিক সংলাপ, অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা-তে, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
বাংলাদেশি গবেষকদের মধ্যে মারমা/বর্মি ভাষা জানা বিশেষজ্ঞ না থাকা বিষয়ক আমার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক স্বনামধন্য অধ্যাপক কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে খানিকটা তাচ্ছিল্য বা বিদ্রূপ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আমি এখনো মনে করি আমি ভুল কিছু বলি নি, এবং সেই অধ্যাপক কেন ওভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। যাই হোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, যা এখানে খুব একটা বিবেচ্য নয়।
[3] উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে ‘সাংস্কৃতিক প্রান্তিকতা ও আত্মপরিচয়ের সংকট’ শিরোনামে ১৯৯২ নামে প্রথম প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে, যা এই লেখকের জাতিরাষ্ট্রের কিনারায় প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলনেও রয়েছে (২০১৮, সংহতি প্রকাশন)।
[4] ‘চট্টগ্রাম-আরাকান কি আসলেই মগের মুল্লুক?’ শিরোনামে প্রথম আলো পত্রিকায় নভেম্বর ১৪, ২০১২ তারিখে প্রথম প্রকাশিত, যা এই লেখকের বহুজাতির বাংলাদেশ: স্বরূপ অন্বেষণ ও অস্বীকৃতির ইতিহাস শীর্ষক প্রবন্ধ সংকলনেও রয়েছে (২০১৫, সংবেদ)।
[5] এই আহ্বানটি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস আপডেট হিসেবে প্রথম প্রকাশ করেছিলাম ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮ তারিখে। সেই পোস্টে মন্তব্য হিসেবে নিচের কথাগুলিও জুড়ে দিয়েছিলাম: “‘একটি মারমা রূপকথা’ নামে সেলিম আল দীন রচিত একটা নাটক রয়েছে, যেটি মাথায় রেখেই কথাটি আমি এই পোস্টে আমি ব্যবহার করেছি উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতর, তবে নাটকটির বা নাট্যকারের কোনো সমালোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়।
উল্লেখ্য, নিজের একাধিক কাজকে সেলিম আল দীন ‘নব্য-নৃগোষ্ঠী নাটক’ হিসেবে পরিচয় দিতেন। সে হিসেবে বাংলাদেশের পারিভাষিক অভিধানে জায়গা করে নেওয়া সমস্যাজনক পদ ‘(ক্ষুদ্র) নৃগোষ্ঠী’র প্রসারে তাঁরও একটা ভূমিকা ছিল, যে কথা আমি অন্যত্র বলেছি, তবে সেই প্রসঙ্গ এখানে বিবেচ্য নয়।”
ত্রিপুরাদের মধ্যে প্রচলিত দুই বোনের কাহিনীর যে সারসংক্ষেপ উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতর দেওয়া হয়েছে, তা নেওয়া হয়েছে ‘মাণিক্য রাজবংশ, বুরাসা দেবতা এবং খুমপুই-এর কাহিনী’ শীর্ষক আমার একটি পুরানো রচনা থেকে, যা সংকলিত হয়েছে সম্প্রতি [২০১৮, সংহতি প্রকাশন] প্রকাশিত আমার জাতিরাষ্ট্রের কিনারায়: প্রান্তিকতার খাদ থেকে স্বপ্নের মহাকাশে নামের বইয়ে। সেখানে অন্তর্ভুক্ত আরেকটি প্রাসঙ্গিক নিবন্ধের শিরোনাম হল, ‘সুজাতা বা সাগরীর জন্য ন্যায়বিচার কেন আমাদের লড়াইয়ের অংশ’।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।