মারমা রূপকথা: ফৌহ

Jumjournal
Last updated Apr 30th, 2020

844

featured image

ব্রামষ্টোকারের লেখা পেনসিলভেনিয়ার কাউন্ট ড্রাকুলার” কাহিনী কমবেশি সবাই জানে, কাহিনীর ঐ ড্রাকুলা দিনের বেলা কফিনে শুয়ে থাকে মৃতের মত। আর রাতের বেলা অশুভ আতাস সাহায্যে জীবিত হয়ে উঠে।

তখন সে শুরু করে ভয়ঙ্কর সব ধ্বংস যজ্ঞ। সে মানুষের রক্ত চষে খেয়ে ফেলে। তার নানারকমের অলৌকিক শক্তি আছে।

সে মানুষকে সম্মোহন করে ফেলতে পারে। গাড়ির ইঞ্জিন বিকল করতে পারে। আর পারে আগ্নেয়াস্ত্র অকেজো করতে।

এই কাউন্ট ড্রাকুলার কাহিনী পাঠকদের কাছে নিছক একটা কাল্পনিক কাহিনী হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আধুনিক মানুষের কাছে এর অস্তিত্ব নিতান্তই হাস্যকর।

কিন্তু পার্বত্যাঞ্চলের মারমা উপজাতির কাছে যে একটা ড্রাকুলার কাহিনী প্রচলতি আছে তা কাল্পনিক বা গাঁজাখুরী বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আধুনিক যুগের শিক্ষিত লেঅকেরা অবশ্য ব্যাপারটাকে কুসংস্কার বলে ধরে নিয়েছেন।

কিন্তু যুগ যুগ ধরে সে সব কাহিনী লোকের মুখে মুখে চলে আসছে এবং সাম্প্রতিক কালেও ব্যাপারটা ঘটছে বলে একে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। কাহিনীর এই ড্রাকুলা স্থানীয় মারমা ভাষায় ‘ফৌহ্’ বলে পরিচিত।

মূলতঃ কোন মানুষ জীবিতকালে প্রেত সাধনা, জ্বীন সাধনা প্রভৃতির মত ফৌহ্ সাধনা করার ফলে ঐ লোকটির মৃত্যুর পর ফৌ-এর অশুভ আত্মা তার দেহে প্রবেশ করে।

কিন্তু সে জীবিত মানুষের জীবনী-শক্তি লাভ করে। অবশ্য তা শুধু রাতের বেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

অর্থাৎ দিনের বেলায় সূর্যের আলোতে ঐ অশুভ আত্মা নিস্ক্রিয় এবং অকেজো অবস্থায় থাকে।কুসংস্কার হোক আর যাই হোক, পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকার গ্রামগুলো হচ্ছে মন্ত্র-তন্ত্র বা কলো যাদুর আখড়া।

যুগ-যুগ ধরে এসব অপবিদ্যার লালন ও চর্চা অব্যাহত রয়েছে এসব অঞ্চলে এবং এসব অপবিদ্যার কার্যকারিতার অনেক সাক্ষ্য প্রমাণও নাকি আছে।

এই মন্ত্র-তন্ত্র চর্চার একটা অংশ। হচ্ছে “ফৌহ” সাধনা। ফৌহু সাধনার পদ্ধতিতে কতকগুলোনির্দিষ্ট মন্ত্র আছে।

ঐ সব মন্ত্র পড়ে সাধনা করলে ফৌহ-এর অশুভ আত্মার সান্নিধ্য পাওয়া যায়। কোন লোকের উপর ঐ আত্মা ভর করলে সে বিভিন্ন অলৌকিক এবং আধিভৌতিক কর্মকান্ড ঘটাতে পারে।

মূলতঃ মন্ত্র-তন্ত্র জানা ব্যক্তিদের মধ্যে নিজ নিজ বিদ্যার সাহায্যে একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে।

এতে কম জানা লোকের প্রভূত ক্ষতি হয়ে থাকে। এমনকি মৃত্যু ঘটে থাকে। এসব বিপত্তি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই ফৌহ সাধনার উৎপত্তি হয়েছে।

কোন ব্যক্তি ফৌহ সাধনায় সিদ্ধ হলে মন্ত্র-তন্ত্র প্রয়োগ করে তার কোন ক্ষতি করা যায় না এবং সে কোন মন্ত্র-তন্ত্র ব্যবহার করলে তা খুব শক্তিশালী রূপ ধারণ করে।

ফৌহ্ সাধনা করা হয় বিভিন্ন ধাপে। বিভিন্ন প্রকার ফৌহ্-এর কাহি। মারমা কিংবদন্তীতে পাওয়া যায়।

তার মধ্যে কতকগুলো বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য। যেমন ঃ (১ প্রঃ ফৌহ্ বা বাচাল ফৌহ্। (২) সোওয়াঁইঃ ফৌহ্ বা রসিক ফৌহ, (৩) লুংফৌহ্ বা কুক্তি ফৌহ্, (3) চাঃ ফৌহ্বা খাদক ফৌহ।

উপরোক্ত সমস্ত ফৌহ্ জীবিতকালে ব্যক্তিবিশেষের ফৌহ মন্ত্র চর্চার ফলে মৃত্যুর পর অশুভ প্রেতাত্মার ভর করেছে, তাদের কিছু পরিচয় তুলে ধরা হল ঃ

 (১) প্রঃ ফৌঃ প্রঃ ফৌহ তাদের নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুর পর দিনের বেলায় নিস্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এদের শক্তি খুব কম থাকে।

রাতের বেলায় প্রাণ সঞ্চার হয় ঠিকই কিন্তু তেমন কোন শক্তি না থাকায় চোখের পাতা ফেলা, হাত-পা নড়াচড়া, গায়ের রোম খাড়া হয়ে যাওয়া এসব কিছুতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

কিন্তু যত দিন যায় ততই তাদের প্রাণশক্তি বাড়তে থাকে। যখন এই প্রেতাত্মার শক্তি পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে তখন রাতের বেলা সে যাকে পায়, তার সাথেই কথা বলে এবং তর্ক করে।

তারা এতই বাকপটু যে তাদের সাথে কেউ তর্ক করতে পারে না। বারবার হেরে যেতে হয়। এভাবে একের পর এক সবার সাথেই তর্ক করে থাকে তারা কিন্তু কেউ তাকে হারাতে পারেনা।

দৈব্যাৎ কেউ যদি তাকে বাকচাতুরিতার দ্বারা হারিয়ে দিতে পারে, তখন ঐ লোকের অনেক লাভ হয়ে থাকে।

তর্ক করতে করতে যদি সকাল হয়ে আসে, তাহলে সে মানুষের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করে।

বলা বাহুল্য, উক্ত ফৌহ্ যে তাকে তর্কে হারিয়ে দিতে সক্ষম হয়, সেই ব্যক্তির, অনুমতি ছাড়া সকাল হয়ে গেলেও তার বিছানায় গিয়ে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় যেতে পারে না।

এদিকে আবার সূর্যের আলোও সে সহ্য করতে পারে না। সকাল হলেই তাদের প্রাণশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে।

কাজেই সে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে তাকে বিদায় করার জন্যে। যেহেতু ফৌহূরা অনেক ধন-সম্পত্তির ও গুপ্তধনের খবর জানত, তাদের কাছে উক্ত সময়ে যা চাওয়া হয়, তাই তারা দিতে বাধ্য থাকে।

এভাবে গুপ্তধন পাওয়ার পর তাকে দিয়ে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিতে হয়। তখন সে তার বিছানায় গিয়ে মরার মত পড়ে থাকে।

১৯৮১ সালে বান্দরবান জেলা সদরে একজন বৈদ্য মারা যাওয়ার পর ফৌহ্ আত্মা তার দেহে ভর করে। উক্ত লোকটি জীবিতকালে ফৌহ্ মন্ত্র চর্চা করত বলে জানা যায়।

লোকটি নিজেও জানত যে, মরার পর সে ফৌহ্ আত্মার সাহায্যে জীবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু তখন তার মনুষ্যত্ববোধ বলতে কিছুই থাকবেনা।

এ কারণে লোকটি তার মেয়েকে ফৌহ্-এর অশুভ শক্তির ক্রিয়া নষ্ট করার উপায় স্বরূপ ওষুধের কথা বলে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার মেয়েটি ঐ ওষুধের কথা ভুলে যায়।

এবং যথারীতি ঐ লোকটি লোকটি মারা যাবার পর অশুভ আত্মার সাহায্যে জীবিত হয়ে উঠে। তবে জানা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় তার তেমন কোন শক্তি ছিলনা।

রাতের বেলায় শুধু তার গায়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে যায় এবং চোখ দুটো এতই বড় হয় যে, চোখের চামড়াগুলো ছিড়ে যায়। তার চোখগুলো জ্বলন্ত কয়লার মত গনগনে ছিল।

তার শক্তি কম হলেও বিছানায় উঠে বসতে পারত। তবে তখনও তেমন কোন অশুভ কার্যকলাপ ঘটাতে পারত না।

কিন্তু মৃত মানুষের ঐকান্ড দেখে আশে-পাশের সমস্ত লোকজন ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে।

শুধু বেশ সাহসী কয়েকজন লোক ঐ মৃতলোকের বাড়িতে থেকে যায়। ভোর রাতের দিকে ঐ ফৌহ্ আত্মার শক্তি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে।

সূর্যের আলো ফোটার পরে তার বিছানায় মৃতের মত ঢলে পড়ে। ঐ ফৌহু ছিল প্রঃ ফৌহ্।

ঐবৈদ্যের দেহে ফৌহু আত্মা ভর করেছে, এই খবর শুনে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু ঐ বাড়িতে আসেন এবং অশুভ আত্মার শক্তি নষ্ট করার ওষুধের নাম বলে যান।

তখন কয়েকজন যুবক ঐসব শিকড়-বাকড় যোগাড় করে নিয়ে এসে পাথরে ঐ শিকড়গুলো পানি দিয়েষে ঐ মৃত বৈদ্যের মুখে ঢেলে দেওয়া হল।

ঐ ওষুধ মুখে পড়ার সাথে সাথে ধড়মড় করে এক বিকট চীষ্কার করে লাফিয়ে উঠেই আবার বিছানায় পড়ে যায়।

তারপর তাড়াতাড়ি আরো কিছু ওষুধ তার মুখে ঢেলে দিতেই আবার চীকার করে উঠে।

এভাবে পরপর তিনবার ওষুধ দেবার পরেই ঐ লোকটির দেহ থেকে ফৌহ আত্মার প্রাণ বায়ু বেড়িয়ে যায় ।

(২) সোওয়াঁইঃ ফৌহ বা রসিক ফৌহ ঃ এই ফৌহটিকে নিয়ে তেমন কোন ভয় নেই। এই ফৌহ যথানিয়মে দিনের বেলায় বিছানায় পড়ে থাকে এবং রাত্রের বেলায় জেগে উঠে।

এরপর থেকেই সে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের রসিকতা। সবার সাথেই সে বিভিন্ন মজার মজার কথা বলে রসিকতা করে।

সারারাত ধরে তার সাথে আলাপ করে তার সাথে সাথে রসিকতা করতে পারলে এবং তাকে উৎসাহ দিতে থাকলে সে যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে ভোর হবার আগে সে বিভিন্ন প্রকারের গুপ্তধন লোকজনকে দিয়ে যায়।

কিন্তু তার রসিকতায় কেউ আগ্রহ না দেখালে সে ক্ষেপে যায়। এবং ক্ষতি সাধন করে থাকে।

তবে বিভিন্ন প্রকার ফৌ-এর মধ্যে এটি সবচেয়ে কম ভয়ানক। তবে তারা কেউ কোন শুভ আত্মা নয়।

 (৩) লুংফৌহ বা কুস্তিগীর ফৌহ ও লুং শব্দের অর্থ হচ্ছে কুস্তি। কুস্তি লড়ার কারণেই উক্ত ফৌহূকে লুংফৌ বলা হয়েছে।

এই ফৌটি রাতের বেলায় শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং যাকে কাছে পায় তার সাথেই কুস্তি লড়ার জন্য চ্যালেঞ্জ করে থাকে।

তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করলে উক্ত লোককে ঐ ফৌহ্ মেরে ফেলে। কিন্তু তার সাথে কুস্তি লড়তে থাকলে, সে কারো কোন ক্ষতি করতে পারেনা।

এভাবে সারারাত ধরে কুস্তি লড়তে থাকলে, ভোর বেলায় তার শক্তি কমে আসতে থাকে। তখন ঐ ফৌকাকুতি মিনতি করতে থাকে তাকে বিদায় দেবার জন্য।

যার সাথে যে কুস্তি লড়ে তার অনুমতি ছাড়া এ ফৌহ্ দিনের নিস্তেজ অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনা। তখন তার কাছ থেকে অনেক ধন-সম্পদ আদায় করে নিয়ে তাকে অনুমতি দেওয়া হয়।

(৪) চাঃ ফৌহ বা খাদক ফৌহ এই ফোহটি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এই অশুভ আত্মা ভর করার পর থেকেই রাতের বেলায় তার পেটে রাক্ষসের মত খিদে আসে।

তখন সে লোকজনকে সামনে পেলে খাবার-দাবার আদায় করে নেয়। কিন্তু অনেক কিছু খেয়েও তার পেট ভরেনা কোন মতেই।

এভাবে সে সারারাত ধরে খেয়ে চলে। কিন্তু যখন সে অন্য কোন খাবার না পায়, তখন সে লোকজনকে ধরে খেতে থাকে।

এই খাদক ফৌহ-এর ভয়ে অতীতে অনেক গ্রাম উজাড় হয়েছে। এই ফৌহু-এর ধ্বংস যজ্ঞকে ভয় পেয়ে অনেক গ্রামের মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

এসব ফৌহ্-এর কাহিনী পার্বত্যাঞ্চলের গ্রামগুলোতে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত। আর এ সব বিষয় নিয়ে অনেক লোমহর্ষক কাহিনী আছে। অনুসন্ধান করা হলে অনেক কাহিনী জানা যাবে।

লেখক: মং সিং ঞো

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা