মারমা রূপকথা: এক টুনটুনি ও এক হাতি
966
এক বনে একটি ছোট্ট গাছে বাসা বুনে টুনটুনি ডিম পেড়েছিল। সেই বনে ছিল এক শক্তিশালী হাতি। হাতিকে আক্রমণ করার মত কোন জন্তু ঐ বনে ছিল না। হাতিটি বনের রাজা।
প্রতিদিন হাতি খাবার খেয়ে ফেরার সময় গায়ের স্পর্শে টুনটুনির গাছটিকে নাড়া দিয়ে যেত।
টুনটুনি হাতিকে মিনতি করে বলল, “হাতিরাজ! এ গাছে আমার ডিম আছে, কয়েকদিনে আমার বাচ্চা হবে। আপনি এ গাছ স্পর্শ করে যাবেন না।”
হাতি ভাবত, “আমাকে আক্রমণ করবে এমন জন্তু-জানোয়ার আজীবন থাকবে না। আর এই টুনটুনি তো এক ছোট্ট পাখি। তাই টুনটুনির কোন কথা শোনা আমার জন্য অপমান।”
একদিন টুনটুনির বাচ্চা হল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে টুনটুনি একটি গাছের উঁচু ডালে বসে দুশ্চিন্তায় রইল।
টুনটুনি হাতিকে দূর থেকে আসতে দেখে চিৎকার করে বলল, “হাতিরাজ, আজ আমার বাচ্চা হয়েছে, আজ আপনি অন্য পথ ধরে যান।”
হাতি বলল, “হা–রে, তুচ্ছ টুনটুনি! এ বনে আমিই রাজা। এ বন আমার। তুমিই আমাকে অন্য পথ ধরে যেতে আদেশ দিচ্ছ! আমার চলার পথ হবে আমার ইচ্ছায়। আমার ইচ্ছাই এ বনে চলবে।” হাতি এগিয়ে আসলই আসল।
টুনটুনি মাটিতে নেমে মাটিতে ঠোট ঠেকিয়ে বলল, “আমি প্রণাম করছি, আপনি আজ অন্য পথ ধরে যান।”
হাতি কিছুতেই টুনটুনির কথা শুনলো না। হাতির গায়ের ধাক্কায় টুনটুনির বাচ্চাগুলো বাসা থেকে পড়ে গেল। তাই টুনটুনি রাগে-দুঃখে হাতিকে গালিগালাজ করল।
এতে হাতির রাগ আরো বাড়ল। টুনটুনির গাছটিকে দুমড়ে মুচড়ে দিল এবং বাচ্চাগুলোও মরে গেল।
টুনটুনি ভাবল, “অত্যাচারীকে উচিত শিক্ষা দেয়া এক পবিত্র পথ। টুনটুনি কাক, শালিক, ব্যাঙ ও পিঁপড়ের সাথে বন্ধুত্ব করল। টুনটুনি একদিন বন্ধুদের সবাইকে জড়ো করল এবং বলল,“বন্ধুরা! তোমাদের আমার জন্য একটি কাজ করে দিতে হবে।”
“কি করতে হবে,বন্ধু?” কাক জিজ্ঞেস করল । টুনটুনি বলল, “এক নিষ্ঠুর হাতি আমার বাচ্চা দুটোকে হত্যা করেছে। আমি তাকে উচিত শিক্ষা দিতে চাই। এ কাজে তোমাদের সহযোগিতার প্রয়োজন।”
পিঁপড়ে বলল, “আমরা তোমাকে সহযোগিতা করবো। আমাদের কি কাজ বলে দাও। অত্যাচারের কাজে নিরপেক্ষ থাকা সমর্থন করার সামিল। এভাবে বসে থাকলে অশুভ শক্তি পৃথিবীকে জয় করে নেবে, তাই না শালিক বন্ধু?” শালিকও পিপঁড়ের কথায় সমর্থন দিল।
ব্যাঙ বলল, “তাড়াতাড়ি আমাদের কাজ ভাগ করে দাও, টুনটুনি বন্ধু। আমাদের কারোর সময় নষ্ট করা উচিত নয়।” কাকও বলল, “তাড়াতাড়ি বল বন্ধু, বাসায় ফিরতে হবে।”
টুনটুনি বলল, “আগামী কাল বিকাল বেলায় হাতি বিশ্রাম করার সময় কাক পোকা খাওয়ার ভান করে হাতির একটা চোখ নষ্ট করে দেবে। আগামীকাল এ বেলায় আবার এখানে আমরা মিলিত হব, পরবর্তী কাজের সিদ্ধান্ত নেব।” তারপর সবাই নিজ নিজ বাসায় চলে গেল।
পরদিন সকালে কাক টুনটুনিকে নিয়ে উড়ে উড়ে হাতীর খাবার স্থান খুঁজে নিল। কাক সারাদিন হাতির কাছাকাছি থাকল, আর টুনটুনি একটি গাছে লুকিয়ে থাকল।
বিকাল হলে হাতিও বিশ্রাম নিল। টুনটুনি শিস দিয়ে কাককে সংকেত দিল। কাক হাতির শরীরে পোকা খাওয়ার ভান করে চোখের কাছে গেল এবং এক ঠোকরে হাতির একটি চোখ উপড়ে দিল। হাতি এক চিৎকারে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পালিয়ে গেল।
সন্ধ্যা হলে নির্দিষ্ট স্থানে তারা মিলিত হল । টুনটুনি বলল, “আমাদের কাজ সফল হয়েছে, বন্ধুরা। আগামীকাল হবে শালিকের কাজ।” শালিক, ব্যাঙ ও পিঁপড়ে কাককে বাহবা দিল। তারা আলোচনা সেরে বাড়ি ফিরে গেল।
পরদিন সকালে টুনটুনি শালিককে নিয়ে হাতির খোজে বের হল। হাতি একটি ছোট্ট ডোবায় গোঙাচ্ছিল। টুনটুনি শালিককে বলল, “যাও বন্ধু, তুমি হাতির আরেকটা চোখ উপড়ে দিয়ে আস।”
শালিক উড়ে গেল এবং পানি খাওয়ার ভান করে হাতির পাশে পড়ল। “কেন এই গোঙানি, হাতি ভাই?” –শালিক জিজ্ঞেস করল। “গতকাল এক দুষ্ট কাক আমার এক চোখ উপড়ে নিয়েছে, শালিক ভাই।” হাতি জবাবে কথা বলার সুযোগে শালিক হাতির মাথায় উঠে গেল।
হাতি আঘাত পাওয়া চোখটি কাদায় ডুবিয়ে গোঙাচ্ছিল। শালিক সুযোগ বুঝে হাতির আরেক চোখে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে হাতিটার চোখে দুনিয়ার আলো নিভে গেল। হাতিটা দৃষ্টি হারিয়ে এদিক সেদিক ছুটতে ছুটতে এক পর্বতের নিকট পৌছে গেল।
টুনটুনি অন্যান্য বন্ধুদেরকে নিয়ে সে পর্বতে গেল। সূর্যও মধ্য আকাশে এল। তখন রোদ। হাতি একটি গাছের নীচে চোখের যন্ত্রণায় কাবু হয়ে বসে পড়ল। পিপাসাও পেয়ে বসেছে হাতীকে।
টুনটুনি পিপড়েকে বলল, “বন্ধু, এবার তুমি যাও। হাতিটার গুঁড়ে কামড়ে বিষ ছড়িয়ে আস।” পিপড়ে হাতীর কাছে গেল। হাতির গুঁড় কেটে বিষ ছড়িয়ে আসল। এতে হাতির পিপাসা আরও বেড়ে গেল।
পিপাসার যন্ত্রণায় হাতি ছটপট করতে লাগল। তক্ষুণি টুনটুনি ব্যাঙকে বলল, “বন্ধু, তুমি ঐ পর্বতের মাঝখান থেকে ডাক দাও।” ব্যাঙ পর্বতের মাঝখান হতে ডাক দিল।
হাতি ভাবল, “ব্যাঙের ডাক শুনতে পাচ্ছি, হয়ত ঐদিকে পানি আছে।” হাতি ব্যাঙের দিকে ছুটতে শুরু করল। ব্যাঙ হাতিকে পর্বতের চূড়ায় নিয়ে গেল। হাতিও ব্যাঙের ডাক শুনে শুনে পর্বতের চূড়ায় পৌছল।
পর্বতের অপর দিক ছিল খাড়া ও খুব উঁচু। টুনটুনি ব্যাঙকে নীচে গিয়ে ডাক দিতে বলল। হাতি ব্যাঙের ডাক শুনে পা বাড়াতেই পর্বত থেকে পড়ে গেল।
হাতির সবগুলো হাড় গুঁড়ো হয়ে গেল। হাতি বলল, “কে আমাকে মারার জন্য শত্রুতা করেছে। আমি তো কারো ক্ষতি করিনি।”টুনটুনি বলল, “আমি, আমি টুনটুনি। যাকে তুমি তুচ্ছ ভেবে যার বাচ্চাকে হত্যা করেছিলে, আমি সেই টুনটুনি।”
হাতী বলল, “আমাকে ক্ষমা করো, টুনটুনি। শরীরে যখন শক্তি ছিল, তখন ভাবতাম, এ দুনিয়াটা আমার। এখন সেই শক্তিগুলো কোন কাজে লাগছে না।”
হাতি “ক্ষমা করো, ক্ষমা করো” বলতে বলতে মরে গেল। টুনটুনি বন্ধুদেরকে নিয়ে মজা করতে করতে রাত হলে নিজ নিজ বাসায় ফিরে গেল।
লেখক: টহ-ওয়ে
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।