মারমা রূপকথা: সর্প মানব

Jumjournal
Last updated Jan 18th, 2020

899

featured image

একদা এক গ্রামে এক বুড়ো দম্পতি বাস করতো। গ্রামটা ছিল পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা এক পার্বত্য অঞ্চলে। তাদের বিবাহযোগ্য তিনটি কন্যা ছিল। একদিন বুড়োবুড়ী তাদের বাড়ীর পাশেই ছোট পাহাড়ী নদীতে সংসারের ময়লা কাপড়-চোপড় ধুচ্ছিল।

এক সময় বুড়ো দেখতে পেল, একটা লাল টকটকে পাকা ডুমুর ফল উপর থেকে স্রোতে ভেসে আসছে। বুড়ো ফলটা ধরল। তারা এমন সুন্দর ডুমুর ফল আগে কোনদিন দেখেনি।

খেয়ে দেখল খুবই সুমিষ্ট। তারা আরও ফলটা পাওয়ার আশায় নদীর তীর ধরে উপরের দিকে খোঁজ করতে করতে চলল।

অনেকদূর গিয়ে দেখতে পেল নদীর তীরেই সেই ফল ভর্তি গাছটাকে। দেখে তারা খুশীই হল। কিন্তু হায়! গাছের ডালে জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে একটা বড় সাপ। ফল পাড়ার তো সাধ্য নেই।

বুড়ি বুদ্ধি করে বলল, “ও সাপ, তুমি ভাল, দয়া করে আমাদের জন্য দু’টো ফল ফেলে দাওনা।” সাপটা তাদের জন্য দুটো ফল ফেলে দিল। তবুও বুড়োবুড়ীর মন ভরল না। তারা বলল, “আমাদের তিনটা বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে, বড়টাকে চাইলে আরো কয়েকটা ফল ফেলে দাওনা।”

সাপ আরো কয়েকটা ফল ঝেড়ে ফেলে দিল। বুড়ী তবুও বলল, “মেজো মেয়েটাকে চাইলে গাছের অর্ধেক ফল ফেলে দাও।” সাপটা তা-ই করল। বুড়োবুড়ী ভাবল সাপটাতো খুব বোকা।

সাপের সাথে কে মেয়ে বিয়ে দেবে। তবুও নিছক কথায় ভুলিয়ে গাছের সব ফল পেলে মন্দ কি। তাই আরো বলল, “আমাদের ছোট মেয়েটাকে চাইলে গাছের সব ফল ফেলে দাও।”

সাপও গাছের সবগুলি ফল ঝেড়ে ফেলে দিল। বুড়োবুড়ী মনের আনন্দে সব ফল কুড়িয়ে ঝুড়িতে ভরে বাড়ী নিয়ে গেল। তারা সাপের কথা ভুলেই গেল। সাপ কিন্তু ভুলল না।।

পরদিন দেখা গেল সাপ তাদের বাড়ীতে এসে হাজির হয়েছে। ভাঁড়ারে, শশাবার ঘরে সর্বত্র আনাগোনা করে তার দাবীর কথা নীরবে জানাতে লাগল। সবাই ভয়ে অতংকে অস্থির হয়ে রইল।

উপায়ান্তর না দেখে বুড়োবুড়ী মেয়েদেরকে সব ব্যাপার খুলে বলল। শুনে বড় ও মেজো মেয়ে সাপকে বিয়ে করতে কিছুতেই রাজী হল না। ছোট মেয়েটা চিন্তা করে দেখল, সবার মঙ্গলের জন্য না হয় নিজেকে উৎসর্গ করে দেবে।

বোনদেরকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিয়েতে রাজী হল। বিয়ে হয়ে গেল সাপের। সাথে ছোট মেয়েটার।

রাত্রে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ছোট মেয়েটা বাসর ঘরে ঢুকল। ঘরের কোণে গোল পাকিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে সাপটা। ভয়ে মেয়েটার চোখেও ঘুম আসছে না। রাত যখন গভীর হল তখন সাপটা নড়ে চড়ে উঠল।

আস্তে আস্তে নিজের খোলস ছাড়িয়ে বের হয়ে উঠে দাঁড়াল এক সুন্দর সুপুরুষ মানুষ। তা দেখে মেয়েটা খুব অবাক হয়ে গেল।

ভুল দেখলো কি-না চোখ কচলিয়ে আবার তাকাল,না ঠিকই দেখছে। মানুষটা মেয়েটাকে বলল, “ভয় পেয়োনা আমি তোমার মত মানুষ। ভাগ্য আমাকে তোমার কাছে টেনে এনেছে। এক দুষ্ট ডাইনীর কুপ্রভাবে রাজী হইনি বলে আমাকে মন্ত্রের বলে সর্পে পরিণত করেছে। আমাকে কোন নারী স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে রাজী না হওয়া পর্যন্ত আমি মুক্তি পাবনা। তুমি আমাকে উদ্ধার করেছো, আমি তোমার কাছে চিরঋণী।”

মেয়েটা সব বিশ্বাস করল। তারপর তাড়াতাড়ি উঠে সাপের খোলসটাকে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলল। আবার যদি সাপ হয়ে যায় এই ভয়ে। খোলসটা যখন পুড়ছিল মানুষটার শরীরও একটু জ্বালা বোধ করছিল, সম্পূর্ণ পুড়ে যাবার পর সেও স্বাভাবিক হয়ে এল।

পরদিন বুড়োবুড়ী ঘুম থেকে জেগে দেখল, তাদের মেয়ে দিব্যি জীবিত আছে। সঙ্গে সাপের বদলে মানুষটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। মেয়ে তাদেরকে সব ঘটনা খুলে বলল। শুনে তারা যারপরনাই খুশী হল।

এরপর সর্প থেকে মানুষ হবার ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অবাক হয়ে চারিদিক থেকে মানুষ একে একে সবাই সৰ্প মানুষটাকে দেখে গেল। এই নবদম্পতির সুখেই দিন কাটছিল।

অনেকদিন পর তাদের একটা ছেলে হল। এবার সংসারে পূর্ণতা আসল, আরও সুখ আসল।

তাদের পাশের গ্রামে এক পরিবারে পাঁচটি আইবুড়ো কন্যা ছিল কারোর বিয়ে হয়নি। কেউ সম্বন্ধ নিয়েও আসে না। মেয়েদের চিন্তায় মা বাবার চোখে ঘুম নেই।

হঠাৎ তাদের মনে আসল পাশের গ্রামের অমুকের মেয়ের তো সাপের সাথে বিয়ে হয়েছে। পরে সাপটা মানুষ হয়ে গেল এবং তারা সুখেই সংসার করছে। তাদের মেয়েদেরকেও তো সাপের সাথে বিয়ে দেওয়া যায়।

যেই ভাবা সেই কাজ। তারা বনবাদাড় তছনছ করে চারিদিক থেকে ঘিরে একটা অজগর ধরে আনল। এনে বড় মেয়েটার সাথে বিয়ে দিল।

রাতে বাসর ঘরে ঢুকে মেয়েটা কিছুক্ষণ পর চেঁচাতে লাগল। মাকে ডেকে বলল, “মা আমার হাঁটু পর্যন্ত উঠেছে।” শুনে মা বলল, “দূর বোকা মেয়ে, জামাই বাবা তোকে আদর করছে, তাতে কি হয়েছে?” একটু পরে মেয়েটা চেঁচিয়ে ডাকল, “মা আমার কোমর পর্যন্ত উঠেছে। আমাকে ধরো”।

মা বলল, “আহা অমন করনা। জামাই বাবা হয়ত গায়ে হাত পা । তুলেছে চুপ কর। লোকেরা শুনলে হাসবে।” কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আবার চিৎকার করে উঠল, “আমার গলা পর্যন্ত উঠে গেছে, আমাকে বাঁচাও মা।”

তার মা ওদিকে নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিচ্ছে—- পোড়া কপাল, এত চেষ্টা করে বিয়ে দিয়েও শান্তি পাচ্ছি না। এরপর আর কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। মা-বাবাও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালে অনেক বেলা পর্যন্ত দরজা খুলছেনা দেখে ঘরের সবাই এই নবদম্পতিকে কয়েকবার ডেকে গেছে। তবুও দরজা খুলছেনা দেখে দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখে, মেয়েটাকে সাপটা গিলে ঢোল হয়ে আছে।

তা দেখে মা-বাবা ও বোনেরা কপাল চাপড়ে বুক চাপড়ে হায় হায় করে কাঁদতে লাগল। নির্বোধ পিতামাতা এবার বুঝতে পারল সবার ভাগ্যে সব কিছুই ঘটেনা।সবাই বলল, সাপটাকে টুকরো টুকরো বেকরে কেটে ফেলতে। কিন্তু কাটতে হবে সর্প মানুষকেই।

সবার অনুরোধ ফেলতে না পেরে অজগরটাকে ধারাল দা দিয়ে সে টুকরা টুকরা করেই কাটল। কিন্তু এক টুকরো কাটতেই সাপের এক ফোটা রক্ত তার বুকে এসে পড়ল। দু’টুকুরা কাটতেই গলায় এক ফোটা, তিন টুকরো কাটতেই কপালে আর এক ফোটা।

এই তিন ফোটা রক্ত পড়তেই সে আবার সাপে রূপান্তরিত হয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে গেল সবাই। এই অবস্থার জন্য সবাই দুঃখ করতে লাগল। তার বৌ সব শুনে খুবই কাঁদল। সাপটা অসহায় হয়ে আস্তে আস্তে বাড়ীর দিকে চলে গেল।

কয়েকদিন ঘরে এবং তার চারিপাশে কাটাল। কিন্তু সে আর মানুষ হতে পারল না। দুঃখে সে জঙ্গলে চলে গেল। খাদের একটা গর্তে বাস করতে লাগল। মাঝে মাঝে ছেলেকে দেখতে আসত। ছেলে ঘুমিয়ে থাকলে লেজ দিয়ে ছেলের দোলনা দোলাত।

ঘরের অন্যান্যরা কিন্তু অস্বস্তিবোধ করত। ছেলে বড় হলে ছেলেটাও তাকে ভয় পাবে, লজ্জিত হবে। তাই সাপটা আর আসল । সে আরও দূরে গহীন জঙ্গলে চলে গেল চিরদিনের জন্য। আর কোনদিন আসল না।


লেখকঃ মা উ চিং

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা