মারমা লোককথা: সাদা টিয়াপাখির দেশ
904
মংগ্ৰী নামের এক গরিব দুঃখী তার স্ত্রী ও এক পুত্রকে নিয়ে গ্রামের শেষ প্রান্তে জঙ্গলের ধারে বাস করতো। স্ত্রী-পুত্র ছাড়া সংসারে আপন বলতে তার আর কেউই নেই।
ছেলেটির বয়স মাত্র দশ বছর। অতি দুঃখে তাদের জীবন কাটাতে হয়। যেদিন পরের বাড়িতে কাজ মেলে সেদিন কোন রকমে আহার জোটে।
কাজ না পেলে সারাদিন অনাহারে কাটাতে হয়। এভাবে অর্ধাহারে অনাহারে সংসারের হালটা কোনরকমে ধরে আছে। তবে লোকটি সহজ, সরল, সত্যবাদী ও ধার্মিক ছিল।
কোন কাজে কখনও ফাকি দিত না। কারো জিনিস চুরি করতো না। তাই গ্রামের সকল লোকে তাকে ভালবাসতেদা।
বাড়ি থেকে অনেক দূরের গ্রামে এক জমিদার ছিলো। তাঁর অনেক বিষয়-সম্পত্তি ছিল, চাকর-বাকরও প্রচুর। এছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে জমিদারের বাড়িতে দৈনিক হাজিরার কাজ করে যেতো।
ঐ গরিব মংগ্ৰী নামের লোকটিও তার স্ত্রী জমিদারের বাড়িতে এসে প্রায় দিন কাজ করে যেতা। যখন কাজ করতো খুব যত্ন সহকারে সুন্দরভাবে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলত।
তার সততা, সরলতা ও কাজগুলি দেখে জমিদার খুশি হয়ে এক কাঠা ধান দিয়েছিল। জীবনে এই প্রথম এতগুলো ধান একসঙ্গে পেয়েছে। গরিব মংগ্রীর আনন্দের শেষ নেই।
সে জমিদার থেকে পাওয়া ধানের অর্ধেক অংশ বীজ বোনার জন্য রেখেছিল। বাকি অংশ ধান ভেঙ্গে ছেলে ও স্ত্রীর সঙ্গে সেদিন পেট ভরে তৃপ্তি মত খেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে মংগ্ৰী মনের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে সে জুমচাষ করে অনেক ধান তার ঘরে উঠেছে। শুধু তাই নয়- গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু-মহিষ, বাগান ভরা গাছপালা, তরি-তরকারি ক্ষেত, দীঘি ভরা জলে মাছ খেলা করছে সুন্দর বাড়িঘর, বাড়িতে কর্মচারি ভর্তি, কত লোকজন আসা যাওয়া করছে—সব মিলিয়ে সে এখন অনেক সম্পত্তির মালিক, ধনী ব্যক্তি।
নরম গদীর উপর শুয়ে কোল বালিশটা টানতে গিয়েই ঘুমের ঘোরে সে ধুপ করে মাটিতে পড়ে যায়। জেগে উঠে দেখে যে ভাঙ্গা বাঁশের মাচার উপর থেকে সে মাটিতে পড়ে গেছে।
তখন প্রায় ভোর হয়ে আসছে। ঘরের ও বনের মোরগ ডাকাডাকি করছে। তখনই মংগ্ৰী মনে মনে ভাবলো। ঠিকমত জুম চাষ করলে – বাস্তবে সে একদিন সত্যিই ধনী হতে পারবে।
আর দেরি করা যায় না। কাকভোরে সে একটা দা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জুম চাষ করার জন্য উপযুক্ত পাহাড়ের সন্ধানে।
যেতে যেতে অনেক দূরে বাঁশ ও গাছপালায় পূর্ণ একটি সুন্দর পাহাড়ের সন্ধান পেল। এই পাহাড়েই জুম চাষ করবে বলে ঠিক করে নিল।
মংগ্রীর স্ত্রী খুব ভোরে উঠে বাড়ির কাজকর্ম সেরে ফেলে। ভাত রান্না করে কলা পাতায় মোচা বেঁধে সঙ্গে নিয়ে সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়ে জঙ্গল কাটার জন্য।
স্বামী ও স্ত্রী, দু’জনের কঠোর পরিশ্রমে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই জঙ্গল কাটা শেষ হয়ে যায়।
কাটা গাছগুলো শুকিয়ে গেলে আগুন লাগিয়ে দেয় ভালো করে পরিষ্কার করে – ধানের বীজ গর্ত করে, লাইন করে ফেলে দিল।
অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই ধানের চারাগুলি গজিয়ে উঠল। জুমে ফসল খুব ভালো ফলেছিল। জীবনে এই প্রথম নিজের জুমের ধান ঘরে উঠবে – এই কথা ভেবে দুঃখী মংগ্রীর আনন্দে বুকভরে যায়।
ধীরে ধীরে ধান পাকতে শুরু হলে জুমের একটা অংশ থেকে ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে এলো। সেই গরিব মংগ্রী ও তার স্ত্রী রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জুমেই কাজ করে কাটায়। রাজার বাড়িতে ফিরে আসে।
সারাদিন তাদের ছোট ছেলেটি ঘর পাহারা দিত। সেদিন ধান কেটে, ধান মাড়িয়ে – ঝাড়িয়ে পরিস্কার করে নিল। তারপর ঝাড়া বা পরিষ্কার করা ধানগুলোকে উঠোনে মেলে রোদে শুকোতে দিল।
ছোট ছেলেটিকে ধান পাহারা দেবার জন্য বাড়িতে রেখে গেল। মা ও বাবা উভয় মিলে ছেলেটিকে খুব সাবধান করে দিয়ে বলল যে, একটি পাখীও যাতে একদানা ধান খেতে না পারে সেইভাবে পাহারা দিতে হবে।
যদি কোন পাখী একটি ধান খেয়ে ফেলে — তাহলে তার রক্ষা নেই। তাকে আর বাড়িতে রাখা হবে না। ছেলেটি খুব শান্ত, নম্র ও সৎ। কোনদিন মা বাবার কথা অমান্য করে না।
সে সারাদিন তপ্ত রোদের মধ্যে উঠোনে মেলে দেওয়া ধানের পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগলো যাতে কোন পাখী একটি ধানও খেতে না পারে।
বিকাল বেলা সূর্য যখন ডুবতে যাবে তখন হঠাৎ দূর আকাশ থেকে এক ঝাক টিয়া পাখী এলে তার ধানের উপর ঝাপিয়ে পড়ল।
কোন রকমে পাখীদের তাড়ানো যাচ্ছে না। ছেলেটি চিৎকার করে পাখীদের বলে – তোমরা এই শুকনো ধানগুলোকে খাবে না। মা ও বাবা বারণ করে গেছে।
তোমরা যদি ধান খেয়ে ফেল তাহলে আমাকে আর মা ও বাবা ঘরে রাখবে না। তাই তোমাদের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছি – এই ধানগুলোকে খাবে না।
ততক্ষণে টিয়া পাখীর দল ধানগুলি খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। ছেলেটি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল – এখন আমি কি করবো কোথায় যাবো?
মা- বাবা আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে। আমার আর রক্ষা নেই। ছেলেটির করুণ অবস্থা দেখে টিয়া পাখীর দলনেতার খুব মায়া হলো। সে ছেলেটিকে ডেকে বলল – ধান তো আমরা খেয়ে ফেলেছি। তা আর ফেরানো যাবে না।
তুমি আমাদের দেশে চলে এসো। তোমার যে ক্ষতি আমরা করে ফেলেছি- আমাদের দেশে এলে তা পুরোপুরি পূরণ করে দেব। তা নিয়ে তুমি আবার বাড়িতে ফিরে আসতে পারবে।
তোমাকে আবার মা ও বাবা খুশী মনে গ্রহণ করবে। এই কথা বলে টিয়া পাখীর দল উড়ে চলে গেল।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মা ও বাবা একটু পরেই বাড়িতে ফিরে আসবে। মা-বাবা ঘরে ফেরার আগেই ছেলেটি তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সাদা টিয়া পাখীদের দেশের সন্ধানে।
চলতে চলতে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। ভয়ে ভয়ে সে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে কোথায় টিয়া পাখীর দেশ সে জানে না।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখতে পায় না। সারাদিন রৌদ্রে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন অনবরত পথ চলা – ছেলেটির শরীরে ভীষণ ক্লান্তি নেমে এসেছে, চোখে ঘুম ঢলে পড়ছে, এক সময় সে ক্লান্ত হয়ে গাছের নীচে শুয়ে পড়ল।
সারারাত ধরে এভাবেই কাটাল। ভোর বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে আবার রওনা দিল যেদিকে দু-চোখ যায়। যেতে যেতে বিশাল এক খোলা মাঠের মধ্যে সে এসে পড়ল।
সেখানে একটা রাখাল ছেলে গরু চড়াচ্ছিল। ছেলেটি রাখাল ছেলের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে অঃ মং নোয়াগ্যং সাঃ-মং নোয়ানোগ্যং সাঃ/কীঃ ফ্লোরা প্রেঃ জামালে?
অর্থাৎ ও রাখাল ভাই – রাখাল ভাই, সাদা টিয়া পাখির দেশ কোথায়? বলতে পারো? রাখাল ছেলে উত্তরে বলছে ভাঃ আস্থাং তালা চাহা ওঃ ভাঃ রী তোক সহা ওঃ ভাঃ নোওয়াখ্যীঃ তাপা খোয়ে বঃ হাঃ ওঃ যাঃ স্থক ব্রীমা কীফ্লোরা প্রেঃ মা রলি মে।
অর্থাৎ আমার ঘরের এক গ্রাস ভাত খেয়ে যেও আমার ঘরের একটু জল পান করে যেও। আমার গোয়াল ঘর থেকে একটু গোবর ফেলে দিও তবেই সাদা টিয়া পাখীর দেশে পৌঁছতে পারবে।
রাখালের কথামতো ছেলেটি এক গ্রাস ভাত খেয়ে নিল, একটু জল পান করল, গোয়াল ঘর থেকে একটু গোবর বের করে ঘরের একটা অংশ পরিষ্কার করে দিলো।
পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা, তৃষ্ণায় ছেলেটির গলা ফেটে যাচ্ছে। তবুও রাখাল ছেলে যতটুকু খাওয়ার কথা বলেছে- সে ঠিক ততটুকুই খেল।
তার বেশী খায় নি। সব কাজ সেরে নিয়ে আবার কীঃ ফ্লোরা প্ৰেঃ-এর সন্ধানে পথে বেরিয়ে পড়ল।
যেতে যেতে অনেক-অনেক দূরে এসে পড়েছে, অবশেষ বিকালের পড়ন্ত বেলায় আর একটি লোকের সঙ্গে তার দেখা হলো। সে মাঠে বিরাট একপাল ঘোড়া নিয়ে বাড়িতে ফিরছিল।
তাকে দেখে দুঃখী ছেলেটি জিজ্ঞেস করে বলল “অঃ মং ভ্রাংগ্যংসাঃ মংম্রাং গ্যং সা, কীঃ ফ্লোরা প্ৰেঃ জামালে? অর্থাৎ ও-দাদা ঘোড়া সহিস, ক্যীঃ ফ্লোরা প্রেঃ অর্থাৎ সাদা টিয়া পাখীর দেশ কোথায় ?
উত্তরে ঘোড়া সহিস বলল গঃ থমাং তালোক্ চাঃ-হাঃওঃ ভারী তাদো সহাঃ ও ভাঃ স্রাংখী তাপাক খোয়ে বহাও যা লুকব্রীমা ক্যীফ্লোরা প্রেমা রলিমে।
অর্থাৎ আমার ঘরে এক গ্রাস ভাত খেয়ে যেও আমার ঘরে একটু জল পান করে যেও আমার আস্তাবল থেকে ঘোড়ার বিষ্ঠা একটু ফেলে দিও।
তাহলেই কীঃ ফ্লোরা প্রেঃ অর্থাৎ সাদা টিয়া পাখীর দেশে পৌঁছে যাবে। দুঃখী বালকটি ঘোড়া সহিসের কথা মতো এক গ্লাস ভাত খেয়ে একফোঁটা জেল পান করল।
আর আস্তাবলের ভিতরের একটা অংশ থেকে ঘোড়ার বিষ্ঠা ফেলে পরিষ্কার করে দিলো। তারপর আবার টিয়া পাখীর দেশের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল।
এমনি করে যেতে যেতে — দিনের পর দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে – পথে কত ঝড় বৃষ্টি, কত বাধা-বিপত্তি পেয়েছে তার কোন অন্ত নেই।
কখনও ক্ষুধায় কাতর, আবার কখনও তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায় — পায়ে কত কাটা বিধেছে পা ফেটে রক্ত ঝড়ছে—এমন অবস্থায় সে পাহাড়-পর্বত- নদীনালা পার হয়ে ছুটছে।
তার শরীরে শক্তি কমে গেছে—ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে তবুও সে নিরাশ হয়নি টলতে টলতে ধীরে ধীরে হাঁটছে এক অজানা দেশের সন্ধানে।
সামনের দিকে এগিয়ে চলতে চলতে আবার একটি লোকের সঙ্গে দেখা হল। লোকটি এক পাল ছাগল মাঠে চড়াচ্ছিল। বালকটি তাকে জিজ্ঞেস করল –
অঃম্য ছোয়ী ক্যংসাঃ মং ছোয়ী ক্যংসাঃ কীঃ ফ্লোরা-প্রেঃ জামা -লে?
অর্থাৎ ও ছাগ-পালক ভাই- সাদা টিয়া পাখীর দেশ কোথায় আছে- দয়া করে আমাকে বলে দাও। আমি অনেক কষ্ট করে বহুদুর থেকে এসেছি সাদা টিয়া পাখীর বা ক্যীঃ ফ্লোরা দেশের সন্ধানে। কোন পথে গেলে সেই দেশে পৌছতে পারব-তা আমাকে একটু পথ দেখিয়ে দাও।
ছাগ পালকভাইটিও একই রকম বলেছে – ভাঃ আস্থাং তালোক্ চাঃ খাঃ ও ভাঃ রী তাদো সখা ও ভাঃ ছোয়ী খ্যী তাপাক খোয়ে বঃখাও। য়াহুক ব্রীঃমা কী ফ্লোরা প্রেমা রলিঃ মে।
অর্থাৎ আমার ঘরের এক মুঠো ভাত খেয়ে যেও, আমার ঘরের একটু জল পান কোরো। আমার ছাগলের বিষ্ঠা ফেলে দিও। তাহলেই কী ফ্লোরার দেশে পৌঁছুতে পারবে।
বালকটি ছাগ-পালকের নির্দেশমতো ঠিক ঠিক কাজ করলো। সে এক গ্রাস মাত্র ভাত খেয়ে নিল, এক ঢোক জল পান করল ও ছাগলের বিষ্ঠা ফেলে দিয়ে ঘর পরিষ্কার করে দিল।
সব কাজ শেষ করে দিয়ে ছাগ মালিকের পায়ে ধরে কাতর মিনতি করে বলল যে – এবার আমাকে কীঃ ফ্লোরা বা শ্বেত টিয়া পাখীর দেশের ঠিকানাটা বলে দিন।
কোন পথে গেলে সেই দেশে পৌঁছে যেতে পারবো? বালকটির ব্যবহার ও সরল কথায় সন্তুষ্ট হয়ে ছাগ। পালক বলে দিল যে – সোজা পশ্চিম দিক বরাবর যাবে।
যেতে যেতে সামনে পাবে একটা বড় নদী। সেই নদী পার হয়ে পশ্চিম দিকে যেতে থাকবে, তারপর সামনে দেখতে পাবে এক সুন্দর পাহাড় – সেই পাহাড়ের উপরেই আছে কীঃ ফ্লোরা প্রেঃ বা শ্বেত টিয়া পাখীর দেশ।
ছাগল পালককে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে পূর্ণোদ্যমে বালকটি রওনা হল সাদা টিয়া পাখির দেশের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে সামনে একটি নদী পেল।
নদীতে কুল ভরা জল থই থই করছে। নদীর জলের বড় বড় ঢেউ দেখে ছেলেটি ভয় পেয়ে গেল। এত গভীর জল কি করে পার হবে? একবার ভাবছে সে — বাড়িতেই ফিরে যাবে।
কিন্তু হায়, কোথায় যাবে সে — মা ও বাবা ততা বাড়িতে স্থান দেবে না। তারপর মনটাকে স্থির করল যে বাড়িতে যেহেতু ফিরে যেতে পারব না – তার চেয়ে বরং নদীতেই ঝাপ দিই – পার হতে পারলে তো বেঁচে যাবো, নতুবা মরেই যাবো। এই ভেবে সে নদীতে ঝাঁপ দিল।
দেখা গেল যে অনায়াসে সে নদী পার হয়ে এসেছে। ক্রমাগত পশ্চিম দিকে যেতে যেতেই সেই সুন্দর পাহাড় চোখে পড়ল। তারপর ধীরে ধীরে সেই পাহাড়ের উপর উঠে গেল।
অনেক কষ্ট সহ্য করার পর অবশেষে সে কীঃ ফ্লোরা প্রেঃ অর্থাৎ সাদা টিয়া পাখীদের দেশে এসে পৌঁছল। সেখানে তার পূর্ব পরিচিত টিয়া পাখীদের সঙ্গে দেখা হলো।
টিয়া পাখীরা বালকটিকে আদর করে তাদের দলনেতার বাড়িতে নিয়ে গেল। দলনেতার বাড়িতে ওঠার আগে বালকটিকেপাখীর দলনেতা জিজ্ঞেস করে যে – এখানে ঘরের উপরে ওঠার জন্য সোনার সিঁড়ি, রুপোর সিঁড়ি ও কাঠের সিঁড়ি আছে।
তুমি কোন সিঁড়ি বেয়ে ঘরে ঢুকতে চাও? তোমার ইচ্ছেমতো যে কোন একটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যেতে পারো। ছেলেটি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
ছেলেটিকে সোনর গ্লাস, রুপোর গ্লাস ও মাটির গ্লাসে জল ভরে দিল। তাকে বলা হয় যে তোমার পছন্দমত যে কোন একটি পাত্র তুলে জল খাও।
আবার একই রকম সোনার থালা, রুপপার থালা ও মাটির থালায় ভর্তি করে খাবার দিল। সেখানেও পাখীদের দল নেতা ছেলেটিকে বলল যে তিনটি পাত্রের মধ্যে খাবার দেওয়া আছে—যে পাত্রটি তোমার পছন্দ হয়, সেই পাত্রটি তুলে নাও।
দুঃখী ছেলেটি মাটির পাত্রটি তুলে নিয়ে খাবার খেলে ও মাটির বাটি তুলে নিয়ে জল পান করল।
বালকটির সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সহিষ্ণুতা ও নির্লোভপনা দেখে টিয়া পাখীর দলনেতা অত্যন্ত মুগ্ধ হলো। সে খুশি হয়ে ছেলেটিকে এক ঘড়া সোনার মোহর উপহার দিল।
ছেলেটি মোহরগুলো নিয়ে বাড়িতে ফিরে এল এবং সমস্ত ঘটনা বাবা ও মাকে খুলে বলল। হারানো ছেলেটিকে ফিরে পেয়ে ও সঙ্গে এক ঘড়া সোনার মোহর পেয়ে দুঃখী মংগ্রী অত্যন্ত খুশি হলো।
তাদের দুঃখ-দারিদ্র ঘুচে গেলো। সেদিন থেকে তারা সুখে দিন যাপন করতে লাগল। তাদের সংসারের পরিবর্তন ও উন্নতি দেখে – পাশের ঘরের এক প্রতিবেশীর ভীষণ কৌতুহল হল।
মংগ্রীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের সংসারে উন্নতি হওয়ার কারণগুলো এই প্রতিবেশী খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিস্তারিত জেনে নিল।
মােহর পাওয়ার লোভে সেও নিজের ছেলেকে কীভাবে সাদাটিয়াপাখিদের দেশের সন্ধানে যেতে হবে তা ঠিকভাবে সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিল।
প্রতিবেশীর ছেলেটি টিয়া পাখীর দেশের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। যাবার পথে রাখাল ছেলের সাথে দেখা হল।
রাখাল ছেলেটি তাকে বলল যে তার ঘরে এক গ্রাস ভাত খেয়ে যেতে, এক ঢোক জল পান করতে ও গোয়াল ঘর পরিষ্কার করে যেতে।
কিন্তু ছেলেটি থালা ভরা ভাত ও গ্লাস ভর্তি জল খেয়ে নিল। কিন্তু গোবর আর ফেলে দিল না, গেয়াল ঘরও পরিষ্কার করলো না।
খাবার খেয়ে চলে গেল। ঠিক এমনি করে পথে ঘোড়ার সহিস ও ছাগল পালের মালিকদের সাথে দেখা হল।
তারা সবাই ছেলেটিকে বলল যে এক গ্রাস ভাত খেয়ে যাবে এক ঢোঁক জল পান করে যাবে। এই ছেলেটি থালা ভরা ভাত ও গ্লাস ভর্তি জল পেয়ে সমস্ত ভাত ও জল খেয়ে ফেলল।
কিন্তু , গোবর আর ফেলে দেয় না, গোয়াল ঘরও পরিষ্কার করে না। এই ভাবে চলতে চলতে এক সময় ক্যীঃ ফুরা প্রেঃ তে এসে পড়ল।
সেখানে পাখিরা ছেলেটিকে আদর করে ডেকে নিয়ে গেল। সেখানে সোনার সিঁড়ি, রুপার সিঁড়ি, ও কাঠের সিঁড়ি পাতা আছে। উপর থেকে টিয়া পাখীদের দলনেতা ছেলেটিকে বলল যে – তোমার কোন সিঁড়িটা পছন্দ হয় ?
সেই পছন্দের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসো। ছেলেটি সোনার সিঁড়ি বেয়ে গট গট করে উপরে উঠে গেল। তারপর তাকে সোনার গ্লাস, রুপোর গ্লাস ও মাটির গ্লাসে করে জল দেওয়া হল।
তাকে জিজ্ঞেস করল- সে কোন গ্লাসে করে জল পান করবে? ছেলেটি সোনার গ্লাসে জল পান করল। ঠিক একই রকমভাবে এবার সোনার থালায় , রুপপার থালায় ও মাটির থালায় ভর্তি করে খাবার সাজিয়ে দেওয়া হল।
ছেলেটি কোন দ্বিধা সঙ্কোচ না করে -সোনার থালা টেনে নিয়ে তৃপ্তি মতো খাবার খেয়ে নিলো। টিয়া পাখীরা ছেলেটির এইরূপ আচরণ দেখে অবাক হল।
এ-তো পুরোপুরি বিপরীত -সেই আগের ছেলেটির মতো নয়। ছেলেটি টিয়া পাখীর দলনেতাকে বলে -আমাকে এক কলসী ভর্তি মোহর উপহার দাও -বাড়িতে নিয়ে যাব।
টিয়া পাখীর দলনেতা শক্ত করে ঢাকনা দিয়ে একটা বড় আকারের কলসী ছেলেটিকে দিল। বলে দিল যে বাড়িতে গিয়েই ক্লসীর মুখটা খুলে দেখবে। পথে কোন মতেই খুলবে না। ছেলেটি কলসী পেয়ে খুশি মনে বাড়িতে ফিরে গেল।
বিরাট একটি কলসী মাথায় করে নিয়ে আসতে দেখে মা ও বাবা ভীষণ খুশী হল। ছেলের মাথা থেকে কলসী নিয়ে বাবা মাথায় তুলে আনন্দে নাচতে নাচতে বলে যে- এবার আমি সবচেয়ে বড়ো ধনী হবো। মা-ও আনন্দে আত্মহারা।
ছেলেটি বাবাকে বলে যে – বাবা এবার মাথা থেকে কলসীটা নামাও। কলসীর মুখ খুলে মোহরগুলিকে গুণে দেখতে হবে। বাবা বলে, হ্যা তাই করতে হবে।
কলসীটা যখন মাটিতে রাখল, ছেলেটির মা-ও পাশে উগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে, মোহর দেখার জন্য। কলসী মুখের ঢাকনা খুলে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই কলসীর ভেতর থেকে বিশাল আকারের একটা সাপ বেরিয়ে এল।
সাপটি একে একে তিন জনকেই দংশন করল। সাপে দংশন করার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অতি লোভে সমস্ত পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।”
তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।