মুকুর কান্তি খীসার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
1054
ভারতীয় উপমহাদেশে আদিবাসীদের মধ্যে প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিঃ মুকুর কান্তি খীসার সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জি
জন্মঃ মুকুর কান্তি খীসা (Mukur Kanti Khisha) ১৯৩৫ সালের ২৭শে নভেম্বর বর্তমান খাগড়াছড়ি উপজেলাধীন খবংপুজ্যা(খবংপড়িয়া) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গগণ চন্দ্র খীসা ও মাতার নাম ক্ষেমতি খীসা।
তাঁর পিতামহ বিরাজমুনি ১৮শতকের শেষের দিকে খবংপুজ্যা গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং তাঁর মাথা থেকে শিরোস্ত্রাণ বা ‘খবং’ পড়ে যাওয়ায় গ্রামটি ‘খবংপুজ্যা ‘ নামকরন হয়।
চার ভাই তিন বোনের মধ্যে মিঃ মুকুর কান্তি খীসা ছিলেন সবার কনিষ্ঠ। তিনি আমার বাবা বিপত্তারণ খীসার আপন ছোট ভাই। অদম্য মেধাবী এ ব্যক্তিটির শৈশব কেটেছে খবংপুজ্যার নির্মল প্রকৃতি ও আলেঅ বাতাসের সান্নিধ্যে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার সময় তিনি তৎকালীন খাগড়াছড়ি জুনিয়র হাইস্কুলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। তখন আমার বড় জ্যাঠা(বাবার বড় ভাই) বিঘ্নবিনাশন খীসা ভারতে ফরেস্ট অফিসার পদে চাকুরী করতেন।
দেশ ভাগ হওয়ার সময় তাকে ভারত বা পাকিস্তান যে কোন একটি দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের অপশন দেয়া হলে তিনি ভারতে থেকে যান এবং লেখাপড়ার জন্য ছোটভাই মুকুর কান্তি খীসাকেও ভারতে নিয়ে যান।
শিক্ষাজীবনঃ শৈশবে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় Khabong Paria Lower Primay School(বর্তমানে খবংপড়িয়া সরকারি প্রার্থমিক বিদ্যালয়)এ। সেখান থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি খাগড়াছড়ি মিডল ইংলিশ স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণি এবং উক্ত স্কুলটি ১৯৪৭ সালে জুনিয়র হাই স্কুল (বর্তমানে খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়)এ উন্নীত হলে সেখানে ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বড় ভাইয়ের সাথে ভারতে চলে গেলে তৎকালীন কোলকাতায় বিখ্যাত Hare Schoolএ অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (ম্যাট্রিক) পাশ করেন। কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করলে তিনি The Telegraph School Awards of Excellence, Bishop Thoburn Award সহ কোলকাতার চারটি সেরা স্টুডেন্ট’স এওয়ার্ড লাভ করেন।
অতপর তৎকালিন সময়ের কোলকাতার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান Presidency College (বর্তমানে Presidency University) থেকে বিএ অনার্স(ইংলিশ), এমএ(পলিটিকাল সায়েন্স) ও এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবনঃ ইন্ডিয়ান এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস(আইএএস) পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ২৭তম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস(আইএফএস) পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ৮ম স্থান অর্জন করলে ১৯৫৯সালে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন।
চাকুরীজীবনে তাঁর সর্বপ্রথম পোস্টিং হয় Spain এর রাজধানী Madridএ। সেখানে গ্লোরিয়া লংবার্ডো নামে এক স্প্যানিশ মহিলার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহ সম্পাদনে তাঁরা বেশ কিছু জটিলতার সম্মূখীন হন।
তৎকালীন সময়ে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে চাকুরীরতদের বিদেশী নাগরিক বিবাহ করার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা ছিলো। চাকুরিতে যোগদানের পূর্বে আরোপিত শর্তসমূহ প্রতিপালনের জন্য অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করতে হতো। মিঃ খীসার ক্ষেত্রেও সে শর্ত প্রযোজ্য ছিলো। মাদ্রিদে চাকুরিকালীন সময়ে গ্লোরিয়া লংবার্ডোর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে তিনি বিবাহের অনুমতি চেয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় তাঁর সে আবেদন অনুমোদন করারতো দূরের কথা বরং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তল্পিতল্পাসহ দিল্লীতে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। পরে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নির্দেশে তাঁর বদলী স্থগিত হয় এবং তাঁর অনুমতিতে তাঁদের বিবাহ সম্পাদন হয়।
তাদের ঔরসে দুই কণ্যা সন্তানের জন্ম হয়। দীর্ঘ অনেক বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত (সরকারি সর্বোচ্চ গ্রেডের কর্মকর্তা) হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের পর তিনি ১৯৯৩সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ইন্ডিয়ান এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস(IAS) ও ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস(IFS) পরীক্ষায় তিনি যে রেকর্ড গড়েছিলেন ভারতের কোন সিডিউল ট্রাইব বা সিডিউল কাস্ট অদ্যাবধি সে রেকর্ড ভাঙতে পারেননি।অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট খাগড়াছড়ির এই কৃতী সন্তানটি ছাত্রজীবনে “Why I best in India” বিষয়ক রচনা প্রতিযোগিতায় সমগ্র ভারতে ১ম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট হিসেবে কর্মজীবনে তার বিশাল সুপরিচিতি ছিল।
লেখালেখিতে তিনি খুবই ভালো ছিলেন। Hare Schoolএ পড়াকালীন সময়ে তিনি ‘মনের ফসল’ নামে সাহিত্য পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। জীবনে তিনি অসংখ্য ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট, কাপ্তাই বাঁধের কারনে সৃষ্ট পাহাড়িদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী, নির্যাতিত-নিপীড়িত পাহাড়িদের শোষন ও বঞ্চনার ইতিহাস এবং তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন, চাকমা সম্প্রদায়ের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তি ও সমকালীন রাজনীতি এবং তৎসময়ে উপমহাদেশের ক্ষমতাধর শাসকদের চরিত্রের নেতিবাচক দিকসমূহ উপস্থাপনের মাধ্যমে ন্যারেটিভ স্টাইলে তার লেখা All That Glisters ও Time and Again উপন্যাসগুলি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঠকদের কাছে খুবই সমাদৃত হয়েছে।
বিরল তথ্য সম্বলিত তাঁর বইগুলি বর্তমানে অনেক লেখক ও গভেষক পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহার করছেন। অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা বইগুলিতে জন্মভূমির প্রতি তাঁর গভীর টান ও আত্মিক সম্পর্কের বিষয়টি বার বার গুরুত্বারোপ করেছেন।
১৯৪৭ সালের দেশবিভক্তিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও বেশি ভয়াবহ হিসেবে উল্লেখ করে উক্ত কারনে শত সহস্র পরিবারের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে দুঃখের সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন এবং নিজের ক্ষেত্রেও আজীবন এ সীমাহীন বেদনা বয়ে বেড়ানোর আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
বিদেশীনি বিয়ে করলেও জন্মভূমি ও শিকড়ের প্রতি তাঁর গভীর টান সবসময় অবিচল ছিল। তাইতো তিনি সবসময় আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রেখেছেন এবং সাধ্যানুযায়ী বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিতে কার্পন্য করেননি।
তাছাড়া তাঁর লেখা বইগুলিতে চাকমা জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সম্পর্কে বিরল তথ্য সংযোজনের মাধ্যমে স্বাজাত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ পরিলক্ষিত হয়।
মুকুর কান্তি খীসার আরো কিছু ছবি –
মৃত্যুঃ আকস্মিকভাবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ক্ষণজন্মা এ ব্যক্তিটি ২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর স্ত্রী ও দুই কণ্যা(রিতা খীসা ও অনিতা খীসা)কে রেখে Spain এর রাজধানী Madridএ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি গলফ খেলতে খুবই ভালোবাসতেন। মৃত্যুর চারদিন আগেও তিনি গলফ খেলেছিলেন।
Source : CHT Aid Foundation
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।