বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী

Jumjournal
Last updated Jul 25th, 2020

1808

featured image

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী

 

লাল সবুজের পতাকা ও বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব অর্জনের পেছনে মূল ধারার বাঙালি বীর সন্তানদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী নারী-পুরুষ সাহসী যোদ্ধাদেরও ছিল অনন্য অবদান।

পাহাড় পর্বতসংকুল ছড়া ঝিরি ঝরনা উপত্যকা বেষ্টিত চিরচেনা পাহাড়িয়া জনপদে আগন্তুক হানাদার শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করার জন্যে আদিবাসী মুক্তিসেনারা নিজস্ব ঢঙে রণনীতি রণকৌশল রচনা করে সহসা পরাজিত করতেন শত্রুসেনাদের।

তাই বাংলার লাল-সবুজের পাতাকার মাঝে আকার বা পরিমাণে ক্ষুদ্রতম হলেও  মিশে রয়েছে আদিবাসী মুক্তিসেনাদের বুকের রক্ত।

তবুও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অনুসন্ধানমূলক খোঁড়াখুঁড়িতে কেমন করে যেন আদিবাসীদের অবদান, রক্ত, ত্যাগ, বিজয়ের কাহিনী অনুল্লেখিতই থেকে যায়।

বহু আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা আজও স্বীকৃতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দোয়ার থেকে দোয়ারে। অনেকে ভিনদেশে চলে গেছেন প্রিয় মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে।

কেউ ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ান। কেউ কেউ ভিটেমাটি বিক্রি করে যেন মুখ লুকিয়ে বাঁচেন।

ত্রিপুরা একটি জাতির নাম। ত্রিপুরা জাতির ভাষাকেও সহজে চেনার জন্যে ‘ত্রিপুরা’ অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়, যদিও ত্রিপুরাদের ভাষার একটি নির্দ্দিষ্ট নাম রয়েছে।

একসময়ের প্রবল পরাক্রমশালী স্বাধীন ভূখন্ড বর্তমান ভারতের একটি রাজ্যের নাম ‘ত্রিপুরা’। তাই, ত্রিপুরা বলতে একাধারে একটি ভূখন্ড, একটি জাতি ও সে জাতির ভাষাকে বোঝানো হয়।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকাংশ ত্রিপুরা বসবাস করলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও তাদের বাসস্থান চোখে পড়ে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি ছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, ফটিকছড়ি, হাটহাজারি, সীতাকুন্ড, মীরেশ্বরাই ইত্যাদি অঞ্চল, কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভী বাজার, হবিগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ইত্যাদি অঞ্চলে স্মরনাতীতকাল হতে ত্রিপুরা বসতি লক্ষণীয়।

 

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী
মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী

বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে বসবাসকারী এই জাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যোদ্ধা প্রবল সাহসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একাত্তরের সম্মুখ-সমরে।

এই লেখায় একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরা জাতির সামগ্রিক অবদান নিয়ে খন্ডিত কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হলো।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ২৯ জন ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া যায়।

কিন্তু ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধারা মনে করেন এ সংখ্যা একশতের বেশি।  ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সকলের কাছে পরিচিতদের মধ্যে

  1. রণ বিক্রম ত্রিপুরা,
  2. নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা,
  3. নীলোৎপল ত্রিপুরা, কান্ত রাম ত্রিপুরা,
  4. প্রীতি কান্তি ত্রিপুরা,
  5. বসন্ত কুমার ত্রিপুরা,
  6. ফিলিপ বিজয় ত্রিপুরা,
  7. যুগল দাশ বৈষ্ণব,
  8. প্রিয় জ্যোতি রোয়াজা,
  9. নির্পধন ত্রিপুরা (নির্পদ),
  10. মণীন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা,
  11. বিন্দু কুমার ত্রিপুরা,
  12. বোদন কুমার ত্রিপুরা,
  13. হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা,
  14. ব্রজেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা,
  15. লোকনাথ ত্রিপুরা,
  16. রণজিৎ দেববর্মণ,
  17. বেনুরায় ত্রিপুরা,
  18. রধীন্দ্র ত্রিপুরা,
  19. সুরেশ ত্রিপুরা,
  20. হৃদয় কুমার ত্রিপুরা,
  21. পূর্ণ কুমার ত্রিপুরা,
  22. গগণ চন্দ্র ত্রিপুরা,
  23. কালাচান দেববর্মণ,
  24. নীল কুমার ত্রিপুরা,
  25. সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা,
  26. ভাগ্যধন ত্রিপুরা,
  27. কর্ণ মোহন ত্রিপুরা,
  28. ভূপেন ত্রিপুরা,
  29. জয় কুমার ত্রিপুরা,
  30. অন্ন কুমার ত্রিপুরা,
  31. মোহন ত্রিপুরা,
  32. লাল মোহন ত্রিপুরা,
  33. ভূটেন্দ্র লাল ত্রিপুরা,
  34. হরেন্দ্র কুমার ত্রিপুরা,
  35. পুর্ণ মোহন ত্রিপুরা,
  36. চিত্ত কুমার ত্রিপুরা 
  37. ভুবন ত্রিপুরা

ইত্যাদি নাম সর্বাধিক পরিচিত।

ওয়েবসাইটটি অপূর্নাঙ্গ ও অশুদ্ধ তথ্য ও বানানে ভরপুর। অনেক পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম পর্যন্ত পাওয়া যায়নি এই ওয়েবসাইটের তালিকায়।

তাই সাইটটির জন্য স্থানীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে মনে হয় না। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যাবলী অচিরেই সংশোধিত হবে বলে আশা করা যায়।

 

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা

হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। ১৬ জন যুবককে নিয়ে পার্বত্য এলাকার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা দল সংগঠিত করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এই ছোট দলটিকে নিয়ে তিনি ১ নং সেক্টর হরিণা ক্যাম্পে উপস্থিত হন। সেখান থেকে তাকে ত্রিপুরা রাজ্যের অম্পিনগরে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।

প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ১ নং সেক্টরে ফিরে আসলে তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রথম মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং এই এলাকার পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ ও গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীনভাবে ও নিষ্ঠার সাথে তিনি বিভিন্ন অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন।

রণবিক্রম ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের সদস্য ছিলেন। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চারিত ও পরিচিত একটি মুখ।

১৯৬৫ সালে তিনি ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সমাবেশে অংশ নিতেন।

অসাম্প্রদায়িক ও নিপীড়নবিহীন একটি দেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ও বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বকীয় অস্তিত্ব মর্যাদার সাথে সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

২৫ মার্চের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্রোহী ই,পি,আর ইউনিট ও বেঙ্গল রেজিমেণ্ট থেকে পালিয়ে আসা সৈনিকদের রসদ সরবরাহ করার কাজে এবং তদানিন্তন পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার এইচটি ইমামের তত্তাবধানে তাদেরকে সংগঠিত করতে সহায়তায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন রণবিক্রম ত্রিপুরা।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হরিণা নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প স্থাপনে তিনি সরাসরি অংশ নেন। এই ক্যাম্পটিই পরবর্তীতে ১ নং সেক্টর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

তিনি সেখানে আব্দুল মান্নান, মোশাররফ হোসেন, এসএম ইউসুফ, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মহিউদ্দীন চৌধুরী, খাজু মিয়া প্রমুখের সাথে একসাথে কাজ করেন।

এই ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন এনাম, মেজর জিয়া ও মেজর রফিকও ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা রণবিক্রম ত্রিপুরা ভারতের দেরাদুনে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়, মানিকছড়ি, গাড়িটানা, যোগ্যাছোলা, ডাইনছড়ি, বাটনাতলী ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকায় অপারেশন করেন।

তিনি যুদ্ধের শেষের দিকে বেঙ্গল লিবারেশন ফোর্সের পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কমান্ডার পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, যে বিস্তীর্ন অঞ্চলে আমি পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সেখানকার অধিবাসীরা বিশেষ করে ত্রিপুরা জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন।

তাদের মাঝে আমি মুক্ত স্বদেশভূমির জন্যে উচ্ছ্বসিত আকাঙ্খা প্রত্যক্ষ করেছি।

নীলোৎপল ত্রিপুরা অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সহকারি সচিব। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে ছিলেন সক্রিয়।

দেশকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে লড়েছেন সম্মুখ সমরে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে তিনি ভারতের মিজোরামে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্যে।

প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। অবস্থান নেন নিজের অতি পরিচিত এলাকা রাজভিলা, রাঙ্গুনিয়া, রাজানগর অঞ্চলে এবং য্দ্ধু করেন সম্মুখ সমরে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্যে তিনি মুক্তিযুদ্ধে  অংশ নিয়েছেন।

তাঁর স্বপ্ন ছিল, দেশ হানাদারমুক্ত হলে ন্যায্যতাভিত্তিক একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করবে, সকলেই নিজ নিজ মৌলিক নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং সর্বত্র বিরাজ করবে সৌহার্দ ও সম্প্রীতি।

মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরাদের অংশগ্রহণ বিষয়ে নীলোৎপল ত্রিপুরা বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত তদানিন্তন রামগড় মহকুমার (বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা) সর্বস্তরের ত্রিপুরা-রা সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল।

ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান আমল অবধি ত্রিপুরারা অত্যন্ত অবহেলিত ও অনগ্রসর ছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আমাদেরকে ভারত-ঘেঁষা ও সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসেবে সবদিক থেকেই বঞ্চিত করে রেখেছিল।

বর্তমানেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ত্রিপুরারা সরকারের সঠিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি।

প্রীতি কান্তি ত্রিপুরা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পরিকল্পনা কর্মকর্তা। তিনি ভারতের দেমাগ্রীতে ১ নং সেক্টরের অধীনে ৪ নং সাবসেক্টরে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ সমরে অংশ নিয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।

তিনি বলেন, মাতৃভূমিকে হানাদার শাসক শ্রেণির কবল থেকে মুক্ত করার তাগিদেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত করা উচিত।

 

একাত্তরের লড়াকু যোদ্ধা কান্ত ত্রিপুরাঃ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে খুঁজে ফিরেন নিজের পরিচয়

‘মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হই নি। জীবন যুদ্ধেও পরাজিত হবো না দেখে নেবেন। তাই বাঁচার জন্যে আমি ভাতা চাই না। শুধু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি চাই।’

পত্রিকার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথাগুলো বলেন মুক্তিযোদ্ধা কান্ত ত্রিপুরা। বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলীকদমের বাবুছড়া নামের প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে চলেছেন একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা সত্তরোর্ধ কান্ত ত্রিপুরা।

আজও স্বপ্ন দেখেন যে স্বাধীন দেশের জন্য তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, সেই দেশের মাটিতে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি মিলবেই। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও তাঁর জীবনযুদ্ধের যেন শেষ নেই।

যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের কথা মনে পড়লে আজও নষ্টালজিয়ায় ভর করে তাঁকে। মেজর হেমন-এর অধীনে মুক্তিযুাদ্ধকালীন পঁচাত্তর জনের মুক্তি বাহিনীর একটি দলের সঙ্গে ভারতে ফারশুয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি।

একটানা সাতাশ দিন প্রশিক্ষণ-শেষে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আসেন। ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর টিএম আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

তাঁর জন্মভূমি কানাইজু পাড়া যুদ্ধের স্মৃতি যেন সেলুলয়েডে ধরা ছবির মত এখনও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে তাঁর মনের পর্দায়।

নভেম্বরের শেষার্ধ। রোয়াংছড়ি’র কানাইজু পাড়ায় পরিশ্রান্ত মুক্তিসেনারা দিনের আহারে ব্যস্ত। হঠাৎ তাঁদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে একের পর এক বোমা নিক্ষেপ করে এগিয়ে আসে পাক হানাদার বাহিনী।

ভাতের প্লেট সরিয়ে রেখে রাইফেল-এলএমজি-স্টেনগান হাতে তুলে নেন মুক্তিসেনারা। যুদ্ধ শুরু হয় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে। তুমুল যুদ্ধ চলে পরদিন দুপুর পর্যন্ত।

মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় কান্ত ত্রিপুরা ও তার সঙ্গীরা পাকবাহিনীর সামনে প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর গড়ে তুলেন। পিছু হটতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। কান্ত ত্রিপুরা হারান তাঁর ৩০জন সহযোদ্ধাকে।

চোখের সামনেই অন্য অনেক বীর সন্তানের সাথে বান্দরবান থেকে একই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা শৈ মং মারমা শত্রুর বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে।

যুদ্ধ চলতে চলতেই খবর পান তাঁদের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে নানা পরামর্শ প্রদানকারী মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ‘সুধাংশু স্যার’ বীরদর্পে যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন।

যুদ্ধে অংশ না নিয়েও পাকিস্তানী বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন স্থানীয় এক আদিবাসী কৃষক এবং কান্ত ত্রিপুরার স্কুল পড়–য়া ছোটভাই সুবিলা ত্রিপুরা।

তৎকালীন ইপিআর বাহিনীর একজন সুবেদারও ঐ যুদ্ধে প্রাণ হারান। কিন্তু সেই বীরের নাম মনে নেই তাঁর। শুনেছেন তার কবর পাওয়া গেছে কানাইজু পাড়ার কাছাকাছি একটি পাহাড়ের ঢালে।

কিন্তু অর্থের অভাবে একবারও যেতে পারেন নি মহান সে সহযোদ্ধার কবর দেখতে। যুদ্ধশেষে চট্টগ্রামের কালুরঘাট গিয়ে জেড ফোর্সের প্রধান মেজর জিয়ার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে একটা ‘কাগজ’ (সনদ) নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

সেই সনদও হাতছাড়া হওয়াতে এখন দিশেহারা একাত্তরের রণাঙ্গানের এই বীর মুক্তিসেনা।

আজও স্মৃতি হাতড়িয়ে দিন কাটান কান্ত ত্রিপুরা। কান্ত যেন আজ জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত এক যোদ্ধা। জীবিকার তাগিদে দিনমজুরি করে সংসার চালান।

জীবনযুদ্ধ করতে গিয়ে দিন মজুর কিংবা বন জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করেই দিন চলে তাঁর। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেয়েছিলেন কান্ত।

সেখানে লেখা ছিল, ‘সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে প্রযোজ্য সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য হবেন।’

কিন্তু তালিকায় নাম না থাকায় রাষ্ট্রীয় ভাতা ভোগ করা তার এখনও হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযোদ্ধা সনদের কপিটি বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে একটি আর্থিক সাহায্য আবেদনের সাথে জমা দিয়েছিলেন ৫ থেকে ৬ বছর আগে।

অসচেতনাবশতঃ ফটোকপি রাখা হয়নি তাঁর। ভিলেজার হিসেবে মাতামুহূরী রেঞ্জের বাবু পাড়ায় একখন্ড জমিতে তৈরি করা দু’চালা একটি ভাঙা মাচাং ঘরে ষাটোর্ধ স্ত্রী রূপতি ত্রিপুরাকে নিয়ে অসহায় এ মুক্তিযোদ্ধার দিন কাটছে।

স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন নিবেদন করেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম উঠাতে পারেননি তিনি। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তোলার জন্যে ঘুরেছেন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে।

তাঁর এই কাজে সহায়তার জন্যে বিভিন্ন সময় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের অনেকেই। কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি তালিকায় নাম তোলা।

হেডম্যান পিতা পূর্ণ চন্দ্র ত্রিপুরার অনেক বিত্ত-বৈভব থাকলেও কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যুর পর হেডম্যানের দায়িত্ব চলে যায় অন্যের হাতে।

পিতার রেখে যাওয়া বাড়ি, পুকুর জমিও এখন কান্ত ত্রিপুরার দখলে নেই। তাই দৈনিক মজুরিতেই চলে দুর্দান্ত এই মুক্তিযোদ্ধার সংসার।

 

ত্রিপুরা লোকমানসে মুক্তিযুদ্ধ

প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল চলমান সমাজ ব্যবস্থা ও প্রকৃতির উপর ভর করে গড়ে উঠেছে।

ত্রিপুরা সমাজে প্রচলিত রয়েছে নানা নৃত্যগীত ও গীতিকাব্য। লোককাহিনীভিত্তিক এসব গীত-গাঁথা গায়েন কবিদের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে।

এসব গায়েন কবিদের পরিবেশনার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রায় সময়েই দেখা যায় সরল পাহাড়িয়া জীবনের মিষ্টিমধুর-কষ্টকরুণ কাহিনী। মানব-মানবীর প্রেম, বিরহ, দুঃখ, বেদনা, রাজাদের রাজ্য বিজয়, সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয় লোক গায়েনদের গানে গানে।

ত্রিপুরা গায়েন কবিদের মুখে মুখে রচিত নানা গীতিকাব্য ও পালাগানে উঠে আসে সমকালীন সমাজের নানা চিত্র।

বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের লোকসমাজে প্রচলিত জনপ্রিয় গীতিকাব্য বা পালাগুলোর মধ্যে কুচুক হা সিকাম কামানি, পুন্দা তান্নাই, গাঁ তলিঅ থাঁমানি, লাঙ্গুই রাজা-ন বুমানি, খুম কামানি ইত্যাদি এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সাধু সংগীত ও বৈষ্ণব সংগীত উল্লেখযোগ্য।

ত্রিপুরা গায়েন কবিদের মধ্যে শশী কুমার ত্রিপুরা, বিদ্যারতন ত্রিপুরা, কাতালচান ত্রিপুরা, গাবিং কিতিং ত্রিপুরা, বিলাই খনা ত্রিপুরা, জনার্দন ত্রিপুরা, বিভূতি ভূষণ ত্রিপুরা, সাধক গায়েনদের মধ্যে সাধু খুশী কৃষ্ণ ত্রিপুরা ওরফে বলংরাই সাধু, সাধু বাহু চন্দ্র ত্রিপুরা, সাধু জাবালাক এবং বৈষ্ণব সংগীতজ্ঞদের মধ্যে মেঘনাথ বৈষ্ণব, নানে বৈষ্ণব, গঙ্গাদর্শন বৈষ্ণব প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য।

প্রচলিত জনপ্রিয় গীতিকাব্যের পাশাপাশি একাত্তরের যুদ্ধকালীন ত্রিপুরা গ্রামগুলোর কিছু চিত্রও পাওয়া যায় এসব গায়েন কবিদের পালাগান থেকে। তারই কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন কবি বি. এল. ত্রিপুরা।

সদাব্যস্তময় ত্রিপুরা লোকসমাজে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তা গায়েন কবিরা বর্ণনা করেছেন এভাবে-

হুগ’ কালাইনাই বাত’ জাক
সাকাং মাইখালাই তেলাইজাক
য়াগ’ চক খাপসা তৗইলাইজাক
খুগ’ মৗই ফনসা বাললাইজাক
মিজুক সং কাইসা থাংফাইঅ
পাথান সং কাইসা থাংফাইঅ
পন্জাই আবাসনি রাউন্ন’
য়াকবাই ফিত খাইঅই হলফাইদং
হাপিং বুরানি লাইরবক
বজাং খালজাকনাই অ বিরক?

পরিশ্রান্ত সময়ে সমবেত আহারে বসেছে জুমিয়ারা। হঠাৎ সে মুহুর্তে কোন দিক থেকে যেন মিজোদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।

কোথাও ছেয়ে গেছে পাঠানদের দলে। অর্ধ-শতাধিক রাউন্ডের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ত্রস্ত গ্রামবাসীরা কোন দিকে পালাবে বুঝতে পারছে না। নারীরাই বা যাবে কোন দিকে, এ চিন্তায় ব্যাকুল চারণ কবি।

হাপং খিকরক মাইবিদি
দুরুম দারাম-ন খানাদি
পাথান ফাইমানি নুংয়াদই?
সইন্য ফাইমানি নুংয়াদই?
সইন্য সং কাইসা থাংপাইয়ই
লাম’ পেসোয়া রগইদং।

গোলাগুলির আওয়াজে সন্ত্রস্ত পাহাড়। পাঠানদের উৎপাত দেখবে নাকি অন্য সৈন্যদের আনাগোনা দেখবে! কোন দল যেন রাস্তার মুখে বসিয়েছে পাহারা। পথে পথে নির্যাতন করা হচ্ছে গ্রামবাসীদের।

হাদুক দারিরি মুকপে দং
মুক্তিবাহিনী ফাইবাইদং
দাংগি পারাঅ হাবইদং
বক্ত পারাঅ রুতুকদং
হাদুক পারাঅ কগই দং।

অবশেষে মুক্তিবাহিনী দখল নিয়েছে এলাকা। গায়েন কবি এখানে মুক্তিবাহিনীর সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে আসার দৃশ্যের সাথে জুমে লাগানো সারিবদ্ধ সীম গাছের তুলনা করেছেন।

সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা মুক্তিসেনাদের দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গ্রামবাসী। মুক্তিসেনারা হন্যে হয়ে শত্রু সেনাদের খোঁজা শুরু করেন ত্রিপুরাদের প্রাচীন দাংগি পাড়া, ভক্ত পাড়া আর হাদুক পাড়ায়।

মুক্তিযুদ্ধ ত্রিপুরাদের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে, যার সামান্য কিছু নমুনা এই লোক গায়েন কবিদের মুখে মুখে ঘুরে ফেরা অবহেলিত গীতমালা।

ত্রিপুরা মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের সকল আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হোক। তবেই তাঁদের মহান এই আত্মত্যাগের যথাযথ সম্মান জানানো হবে।

দেশ পাবে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা একটি দায় থেকে মুক্তি। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায্যতাভিত্তিক একটি কল্যাণ রাষ্ট্র।

তথ্যসূত্র:
১. সান্তুআ জার্নাল, বিজয় দিবসের রজত জয়ন্তী সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৯৬।
২. দৈনিক সকালের খবর, ৪ এপ্রিল ২০১১।
৩. দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১১ ডিসেম্বর ২০১১।
৪. দৈনিক সমকাল, ১৬ জানুয়ারি ২০১২।


লেখকঃ মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা